তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায়: এগারো
তাকে আবার মেলার মাঠেই ফিরিয়ে আনা হল। তাকে হাত ধরে নিয়ে এলো সেই কোটিকল্প। বলল,
‘জাদুজগৎটা রইল হাতের কাছেই। ইচ্ছে হলেই যখন খুশি তুই যেতে পারবি সেখানে। আমি যখন সঙ্গে আছি তোর চিন্তা নেই। তুই বরং মায়াপ্রকল্প বিশ্বটাতেই থাক আপাতত। দ্যাখ্ সেখানে মানুষজন কী করছে। তাদের সেসব কাজকর্মের পিছনে কী উদ্দেশ্য গোপন আছে সেটা বুঝতে গেলে তোকে আবার জাদুজগতে যেতে হবে। তুই বলবি, তোকে আমি নিয়ে যাব। জগতের মানুষজনকে দ্যাখ্, কার সম্পর্কে তোর জানার ইচ্ছে হয় বলিস। তবে তোকে বলে রাখছি, এই যে মায়াপ্রকল্পে কাজেকর্মে ব্যস্ত জগৎবাসী তাদের সমুদয় কাজকর্মের একটাই আসল উদ্দেশ্য। কেউ প্রত্যক্ষভাবে ছুটছে তার পিছনে, কারো মধ্যে সেই উদ্দেশ্য রয়েছে প্রচ্ছন্নভাবে। যেভাবেই থাকুক না কেন, জগৎ বা জগৎবাসী পরিচালিত সেই মহা উদ্দেশ্য চরিতার্থে। তোর মনে হতেই পারে, কেউ তো মুখে বলছে না সেই মহা উদ্দেশ্যের কথা। সবাই মুখে বা প্রকাশ্যে তাদের কাজেকর্মে দেখাচ্ছে কী প্রবল তাদের মধ্যে সমস্ত পার্থিব ধনসম্পদ, সুখস্বাচ্ছন্দ্য, খ্যাতিযশ, প্রভাব-প্রতিপত্তির চাহিদা। কথা হল, মানুষের এইসব মৌখিক চাহিদার পিছনেই লুক্কায়িত সেই মূল উদ্দেশ্য—- তার কথা স্পষ্টভাবে মায়াপ্রকল্পাধীন এইসব জনসম্প্রদায়ও কি ছাই বোঝে ? তারা নিজেরাই ওয়াকিবহাল নয় কেন তারা অর্থের পিছনে ছুটছে, কেন তাদের যেকোন প্রকারে সৎপথে বা অসৎপথে প্রচুর প্রচুর অর্থ হাতে পাওয়া চাই। তার জন্য কেন তাকে তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন অথবা সমস্ত জীবনের সমস্ত স্বাভাবিকতাকে বাজি রেখে অথবা বর্জন করে দিবসরাত পাঠ্যপুস্তকে নিমগ্ন থেকে স্নানখাওয়া ভুলে বেড়ানো ভুলে সামাজিকতা ভুলে বিনোদন ভুলে যাবতীয় আনন্দ ভুলে কাষ্ঠকঠিন প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়ে সামিল হতে হবে কোন সুযোগ হস্তগত করার অভিপ্রায়ে কাম্য তালিকাভুক্ত হতে; যাতে সে আরও কঠিন বাস্তবতাকে অর্জন করতে সক্ষম হয়, যাতে সে তার ভবিষ্যতের আমৃত্যু জীবনটাকে বিকিয়ে দিতে পারে কোন প্যাকেজের অধীনস্থ করে যেখানে তার সাধ-আল্হাদ-অদৃষ্ট অথবা ললাটলিখন ঘোষিত হবে কোন নির্মম নিষ্ঠুর নিষ্পেষণের মুহূর্মুহু কষাঘাতে, সেখানে যে আর সে যেমন জন্ম নিয়েছিল যে আনন্দবারি সিঞ্চনে যে অমৃতলোকে থাকার জন্য তাকে আর কোনদিনই হাতের নাগালে পাবে না। কেন এই জীবন যে তার অধিকারী সে কি তা কোনদিনও জানতে পারে ? কোন্ মোহে বা কী উদ্দেশ্যে ? সেই আসল উদ্দেশ্যটা সে দেখতে পায় না কোনদিন, না দেখেই ছুটে মরে মায়াপ্রকল্পের এইসব দৃশ্য মায়াগুলির অদম্য নেশায় অপ্রতিরোধ্য হাতছানিতে। তাকে অন্যকিছু বোঝাতে যাওয়া নিষ্ফল হবে, বুঝবে না, এতই সে মায়াতে আচ্ছন্ন। সে এইসব মায়াগুলিকে বর্জিত থাকাকে বিফলতা বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, মায়াগুলিই তার কাছে বাস্তবতা। বিকল্প যেসব মহামুক্তির ধারণা তোকে বোঝালাম তাকে বলতে গেলে সে বলবে বাতুলতা, সে কৃপাদৃষ্টিতে তাকিয়ে তোকে ভাববে তুই আজব জীব। তোকে করুণা করবে, হেসে উড়িয়ে দেবে তোর কথা এবং তোকে বর্জন করবে তুই কাজের জগতে এক কল্পনাবিলাসী অসফল আপদ বলে। এ তো হল একটা মাত্র উদাহরণ।’
বলতে বলতে থামল কোটিকল্প। একটামাত্র উদাহরণের বহর দেখেই তার ততক্ষণে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। বর্ণনা আপাতত সাঙ্গ হওয়াতে সে কিঞ্চিৎ আরাম পেল। কী শুনল তা ভেবে বুঝতে চেষ্টা করল। কথাগুলি সমস্ত যে তার আদ্যোপান্ত স্মরণে ছিল এমন নয়, তবে অন্তরস্থ হয়েছিল ভাবার্থ বিষয়। সে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করতে পারছিল সেই অদ্ভুত মানুষটিকে যে তার শৈশব থেকে সমস্ত জীবন উৎসর্গ করল এক লোভনীয় অথবা বরণীয় কেরিয়ার বানাতে যার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছে প্রতিবেশীরা, যাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করছে নিজেদের পুত্রকন্যার কাছে, যার কৃতিত্বে গর্বিত এবং অহংকৃত সেই ব্যক্তিটির জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী পিতামাতা, আর যে নিজে ওইরূপ প্রবল কেরিয়ারের দৌলতে কোন গগনচুম্বী সংস্থায় কর্মপ্রাপ্ত হল বিপুল অর্থোপার্জনের চুক্তিতে যার ভিত্তিতে সে বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি সমস্ত সাংসারিক সুখ ও বিলাসদ্রব্যগুলিকে অবহেলায় করায়ত্ত করতে পারবে, জাগতিক সমস্ত বিনোদন ও কাম্য বিষয়সমূহকে পেতে পারবে ইচ্ছেমত হাতের মুঠোয়, তেমন এক সফল ব্যক্তি এ সমস্ত কিছু কেন করছে কী উদ্দেশ্যে সেই মূল প্রশ্নটা অবগত না থেকেই এ আবার কী কথা ? সে এসব কথা বিশ্বাস করতে পারল না। মেলাপ্রাঙ্গনে সে তার চোখের সামনে উদাহরণে উপস্থাপিত সেই ব্যক্তিটিকে দেখতেও পেল। খুব যে খুঁজতে হল তাকে এমন নয়। বেশি খুঁজতে হবেই বা কেন ? এমন ব্যক্তি ডুমুরের ফুল হতে পারে না। ভুরি ভুরি রয়েছে হাতের কাছে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি। তারা সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে মেলার আর সমস্ত লোকের দলে। নানা কর্মে নানা পেশায় নিয়োজিত তারা। ভবিষ্যতে যারা তাদের দলভুক্ত হতে চলেছে সেই কেরিয়ার তৈরি করার সাধনায় নিমগ্ন মানুষগুলোও রয়েছে মেলার ভিড়ে। গুণে শেষ করা যাবে না তাদের সংখ্যা, সবাইকে দেখতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হবে, জীবন কেটে যাবে কেবল ভিড় দেখেই। এইসব মানুষগুলি সদাব্যস্ত তাদের কাজে, মেলার ভিড়েই সামিল হয়ে আছে যদিও তাদের দিকেই কেবল নজর ফেললে মনে হবে যেন তারা ভিড়ে থেকেও নেই, চলছে একদম আলাদা পথে নিজেদের মত নিজেদের নিয়মে। তা এমন কাকে দেখেই না মনে হয় ? মেলার ভিড়টাকে চট করে দেখলে প্রথমে যে কোন দর্শনার্থীর মনে হতেই পারে একটা অগোছালো ব্যাপার, চলছে হুড়ুম-হুম লণ্ডভণ্ড জনতা। সবাই চলছে যে যেদিকে পারে, একের গতিপথ অন্যে কাটাকুটি করে, কোথাও কোন চলনে বা বলনে ছিরিছাঁদ নেই তিলমাত্র। প্রথম দর্শনে তারও এমনটাই মনে হয়েছিল। পরে সে এখানে থাকতে থাকতে বুঝেছে, দিনের পর দিন দেখে দেখে বুঝেছে, মেলাটা আসলে প্রথম দেখে সে যেমন ভেবেছিল তেমন নয় কোনক্রমেই। এখানে চলছে লোকজন ভুতগ্রস্ত হয়ে নয়, তাদের উদ্দেশ্য-বিধেয় সমস্তকিছুই জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। চলছে নানা চরিত্রের জনতা নানা দিকে নানামুখে যদিও তবু প্রত্যেকটি চরিত্রের জনতার চলন অন্য চরিত্রের জনতার চলন থেকে আলাদা করা যায়। একেক দল জনতার চলন একেক ধর্মের, সেই ধর্ম প্রথমে বুঝতে হবে নিবিড় মনোযোগ দিয়ে, দেখে নিতে হবে তার বৈশিষ্ট্যসমূহ যত্ন সহকারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তবেই কেউ পরিশেষে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যার সারমর্ম হল এই যে মেলার ভিড় মোটেই এলোমেলো নয়। ভিড়ের সামগ্রিক চলন আসলে বহুধাবিভক্ত অগণিত ধারাসমূহের আপন আপন চলনচরিত্রের এক মিশ্র ফল। এই মিশ্রণ একসঙ্গে পাকানো থাকে বলে প্রথম দর্শনে তালেগোলে হরিবোল লাগে। যথোপযুক্ত নিষ্ঠা দিয়ে সেই জটপাকানো মোটা দড়ি স্বরূপ ভিড় থেকে একেকটি সূত্রকে আলাদা করে চেনাও সম্ভব এবং সেই কর্মটি যে কাঙ্খিত অধ্যবসায় দিয়ে করতে সমর্থ হবে সে বুঝবে মেলার ভিড়ের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। সে তখন জানতে পারবে যে এই প্রতিটি সূত্র আসলে একটি নির্দিষ্ট চরিত্র বা শ্রেণিকে নির্দেশ করছে যেমন একটি উদাহরণ উপস্থাপিত হয়েছে অল্প আগে। এই নির্দিষ্ট সূত্রটি ভিড়সদৃশ মোটা দড়িগুচ্ছে পাকানো অবস্থায় থাকা সত্বেও তার স্বরূপ সহজেই উন্মোচন করা যায় যদি সূত্রটি দৃষ্টিগোচর হয়। এই সূত্র যেহেতু নির্দিষ্ট তার প্রকৃতি অজ্ঞাত থাকতে পারে কোন্ যুক্তিসাপেক্ষে ? যদিনা প্রকৃতি অনির্দিষ্ট হয় তার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অপরিষ্কার থাকতে পারে না। সূত্রটি যখন মূল জট থেকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে তখন সেই সূত্রের গতিপথ ও প্রান্তবিন্দুগুলি জানা কী এমন কষ্টসাধ্য কাজ যে মূল উদ্দেশ্য অজ্ঞাত থাকবে ? সূত্রানুযায়ী চলছে যে জনতা সে জানবে না সূত্রের প্রান্তবিন্দুসমূহ ? একথা সে যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস করতে নারাজ। আর নিজের সেই অবিশ্বাস সে তুলে ধরল প্রশ্নের আকারে,
‘এরা সবাই জানে না তাদের আসল উদ্দেশ্য ? ওই কেরিয়ার যেটা এত যত্নে এত নিষ্ঠায় গড়ে তুলল সেটা তাদের আসল উদ্দেশ্য নয় ? যাকে অবলম্বন করে তারা জীবনকে এমন সাফল্যে ভূষিত করল সেটা তাদের আসল উদ্দেশ্য হবে না কোন্ যুক্তিতে ? আমি তাদের অন্য কোন আসল উদ্দেশ্য থাকতে পারে এমনকিছু দেখছি না।’
কোটিকল্প বিনা বাধায় শুনল তার প্রশ্ন। সে থামলে পর শান্ত ভঙ্গিতে জানাল,
‘তোর মত তারাও ভাবে ওটাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু এই জনতার পিছনে প্রচ্ছন্ন থাকে অন্য একটা বিষয়, যেটা মূল চালিকাশক্তি। সেটাই তার আসল উদ্দেশ্য যাকে কেউ বুঝতে পারে না এবং যে তার সমস্ত কাজকর্মের জন্য প্রেরণা জাগিয়ে রাখে অফুরন্ত।’
‘সেটা কী ?’
‘সেটা দেখবি গিয়ে জাদুজগতে। কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দে। এই যাকে তুই সাফল্য বলছিস যে সেটা পেল তার তাতে কী লাভ ?’
‘লাভ নয় মানে ?’ সে বেশ অবাক হয়ে ভাবল, যে প্রশ্ন তাকে করল তার পথপ্রদর্শক তাতে মনে হচ্ছে যেন এত কিছু জানা সত্ত্বেও বোকার মত হয়ে গেল তা আর তাই সে যোগ করল, ‘এটাই তো সে পেতে চেয়েছিল। এই শীর্ষবিন্দুতে আরোহণ। সেই আরোহণটা যখন ঘটল তার মত লাভবান আর কে ? আমি যা হতে চেয়েছিলাম তা পেলাম, সেই সারাজীবনের অভাবনীয় আকাঙ্খা পূরণ আমার লাভ নয় ? শীর্ষবিন্দুকে পাওয়া ?’
তার যুক্তিগুলিকে শুনল সে কোন ব্যাঘাত না ঘটিয়ে।তাকে বলতে দিল যত সে বলতে চায়। শুনল শেষপর্যন্ত। সে বলা শেষ করলে পর সুস্থির ভঙ্গিতে জানতে চাইল,
‘কোন মানুষের ক্ষেত্রে শীর্ষবিন্দু বলে কিছু আছে কি ?’
একটু থমকে গেল সে প্রশ্নটা শুনে। খানিকটা ভাবল। উত্তর সাজাল,
‘হবে না কেন ? কেউ হয়তো সারাজীবন ধরে চেয়েছিল একদিন সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবে। হতে পারল কোনদিন। ওটাই তার শীর্ষবিন্দু।’
উত্তর পেয়ে সে থেমে যাবে ভাবা গিয়েছিল। বাস্তবে তা হল না। কী যে সে ভাবছে বোঝা মুশকিল। থৈ পাওয়া যাচ্ছিল না। আবার সে প্রশ্ন তুলল,
‘তাতে কি সে থেমে যাবে ? পুরো শান্তি কি মিলল তার ?’
‘অবশ্যই মিলবে। সে তো সব পেয়ে গেল। আর কী বেশি পেতে পারে ? এত বড় উচ্চপদ পায় যেজন, যে তাকে ভাবে তার তুলনায় জীবনের সেরা প্রাপ্তি হিসেবে, যদি সে পেতে পারে সেটা কোনক্রমে কেন তৃপ্ত হবে না ?’
‘হয় কি ?’
তার অনবরত প্রশ্ন এসেই যাচ্ছিল একের পিঠে আরেক। এই প্রশ্ন করা কি থামবে না আর, ভাবছিল সে। তারও নেশা ধরে গিয়েছিল, হার মানা চলবে না। দেখা যাক কত প্রশ্ন করার ক্ষমতা থাকতে পারে তার। কোথাও না কোথাও তাকে থামতে হবেই। সে না থামা পর্যন্ত তাকেও থামলে চলবে না। সে তাই যুক্তি দেখাল,
‘একশ’বার হবে। প্রত্যেকটি মানুষের কোথাও না কোথাও গিয়ে চরম পরিতৃপ্তি লাভ ঘটে। ঘটতে বাধ্য। মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমানা থাকবেই। তারপরে সে আর দূরে যাবে না।’
শুনে সে না ভেবেই প্রশ্ন তুলল,
‘তাহলে তার অনন্ত চাহিদার কী হবে ?’
এবার সে বিভ্রান্ত হল। এই প্রশ্নটা সে শুনবে বলে ভাবতেই পারে নি। এটার কথা মাথাতেই ছিল না। সত্যিই তো মানুষের চাহিদার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। সেখানে তো এটা সত্যিকথা। যেহেতু মানুষের রয়েছে অন্তহীন চাহিদা কোন প্রাপ্তিই তো তাকে তৃপ্তি দিতে পারবে না। তাহলে দাঁড়ালো কী ? দাঁড়ালো এই যে তার জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন ঘটল এবং সে বুঝতে পারল, তার দিগদর্শক কোন বাক্যই তার মর্মার্থ না বুঝে বলছে না। সে তার ধারেকাছেও আসতে পারবে না। তার তুলনায় সে জন্মের ঘন্টাখানেক পরের শিশু। তার আর কিছু বলার থাকল না, শ্রোতা হয়ে থাকা ছাড়া। তাকে নিরুত্তর দেখে কোটিকল্প বোঝাতে লাগল,
‘আসলে এই অনন্ত চাহিদাই কোন মানুষের জন্য মূল ও শেষকথা। কোন প্রাপ্তিই তাকে শান্তি দিতে পারবে না, তাকে থামতে দেবে না। কোন শীর্ষপদই তার কাছে চূড়ান্ত বলে মনে হবে না কোনদিন। তার উচ্চাকাঙ্খা বাড়তেই থাকবে। একটা উদ্দেশ্যপূরণ তার কাছে আরও বড় উদ্দেশ্যপূরণ লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে আসবে। এভাবে যদি একের পর এক তার উদ্দেশ্যপূরণ ঘটতেই থাকে তাহলে শেষপর্যন্ত একসময় সে গিয়ে পৌঁছবে তার আসল উদ্দেশ্যপূরণের প্রসঙ্গে, যা এতদূর পর্যন্ত সুপ্ত ছিল তার মধ্যে, তার কাছে অজানা ছিল। সে এবার সেটা চিনবে, তাকে সে পেতে চাইবে। এভাবেই একদিন জানা যাবে কোন্ অজানা উদ্দেশ্য এতদিন তার মধ্যে সুপ্ত থেকে তাকে অফুরন্ত প্রেরণা জুগিয়ে এত কাজ করিয়েছে তাকে দিয়ে, তাকে এতদূর টেনে এনেছে।’
কোটিকল্প থামল। সে বেশ হতবাক সব শুনে। অভিভূত গলায় প্রশ্ন জানাল,
‘সেটা কী ?’
‘সেটা তুই দেখতে পাবি জাদুজগতে গিয়ে। তবে তোকে এটাও জানাচ্ছি যে ওই মূল উদ্দেশ্যপূরণও কিন্তু থামতে দেবে না কাউকে। সেটাকে যদি সে করায়ত্ত করতে পারেও তখন তার লক্ষ্য হবে আরও বড় কিছু। সেটা কী আমারও জানা নেই। হতে পারে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম। তার আগে তুই মেলার অন্য মানুষগুলিকে দেখে নে। আমি তো মোটে একটি উদাহরণ দেখলাম তোকে এতক্ষণ। অন্য সমস্ত উদাহরণও আছে। সেগুলিও তো বুঝে নেওয়া দরকার। চল্, দেখি।’
দেখার প্রসঙ্গ তুলতেই সে হুড়মুড় করে বলে উঠল,
‘আমাকে এবার সাধারণ স্বাভাবিক লোকজন দেখাও। এসব বড় বড় মানুষজনের বড় বড় চাহিদা আর কাজকর্ম দেখলে এ পর্যন্ত।সাধারণ মানুষ দেখাও।’
কোটিকল্প অবাক হওয়ার ভঙ্গি দেখিয়ে বলল,
‘আমি দেখাব কী রে, সব তো তোর চোখের সামনেই আছে। তুই নিজের ইচ্ছেমত যাকে খুশি দেখে নে। তাকে বুঝতে না পারলে বলবি, বুঝিয়ে দেব। তবে জানবি, এই যে একটি কেরিয়ারসর্বস্ব মানুষের উদাহরণ দিলাম এ কিন্তু একজন সাধারণ মানুষই, তুই যেসব ছাপোষা লোকদের কথা বলতে চাইছিস তার সঙ্গে এই ব্যক্তির কোন তফাৎ নেই। বরং জানবি, আরও সাধারণ মানুষেরও আসল উদ্দেশ্য এই একটাই যা রয়েছে অন্যদেরও এবং সেটা বোঝা আরও জটিল যেহেতু তারা নিজেদের কোন লক্ষ্যই প্রকাশ করতে শেখেনি। তোর ধারণামত এই ছাপোষা মানুষগুলিকে দেখে তোর মনে হবে তারা বুঝি বেঁচে আছে কেবলই বেঁচে থাকতে হয় বলে, তারা কেউ দশটা-পাঁচটা অফিস করে, দোকান চালায়, দালালি করে, নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করে কেউবা সংসার প্রতিপালনের জন্য, কেউ শ্রমিক, কেউ খাতা লেখে, কেউ গাইড, কেউ শিক্ষক, কেউ উকিল, কেউ গাড়ি চালায়, কেউ মাল বয়, কেউ চাষী, কেউ মাছ বা সবজি বিক্রি করে এমনই কত্তো কিসিমের কাজকর্ম করে জীবন কাটায়। তারা সকালে বাজার করে, সারাদিন নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে, সন্ধেবেলা পাড়ার ক্লাবে বা চায়ের দোকানে আড্ডা মারে, সঙ্গীদের নিয়ে তাস খেলে বা নেশা করে, বাড়িতে ছেলে-মেয়ে-বউয়ের কাছে হম্বিতম্বি করে বা ভিজে বেড়াল হয়ে তাদের হম্বিতম্বি সহ্য করে, রাজাউজির মারে চেনামহলে।এই তো ? এদের তুই দেখতে চাইছিস ? দ্যাখ্ না যত খুশি, এদের দেখলে তুই আরও ভড়কে যাবি যেহেতু এরা বাঁচতে গেলে কাউকে যে কিছু প্রাথমিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে চলতে হয় সেটাও ভেবে দেখে না কোনোদিন। তুই জিজ্ঞেস করলে বলবে, লক্ষ্য আবার কী, বেঁচে আছি বলেই বেঁচে থাকছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, হেঁটেচলে বেড়াচ্ছি। এর আবার কোন উদ্দেশ্য-বিধেয় থাকতে হবে নাকি ? এরা সবাই আজ দিনটার জন্যই বাঁচে, কাল আসবে ভাবেই না। আরও সাদা কথায়, এরা যে মুহূর্তে বেঁচে থাকছে সে মুহূর্তটাকেই চেনে, অন্যসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। এরা সবাই মুহূর্তেকের জীব, এদের মধ্যে যদি তুই বেঁচে থাকার আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে যাস তো আরও খাবি খেতে হবে। এরা সবাই উদ্দেশ্যবিহীন, এলোমেলো জীবনাচরণে। কিন্তু জানবি, এদের মধ্যেও অন্তরদেবতা ঘুমিয়ে থাকলেও মনে তার সুপ্ত বা গুপ্ত রয়েছে সেই একই উদ্দেশ্যে যাতে চালিত গোটা জীবসমাজ।’
‘সেটা কি জানতে হবে জাদুজগতে গিয়েই ?’
প্রশ্ন করলে যে উত্তর পেয়েছে এযাবৎ সেটা তার জানা বলে নিজেই সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে দিল কাম্য প্রশ্নে। উত্তর পেল,
‘অবশ্যই। মায়াপ্রকল্পে সবই তো মায়াচ্ছন্ন, আসল-নকল বুঝবি কী করে ? তোর এখানে দেখা সাঙ্গ করে নে, তারপর এদের আসল উদ্দেশ্যটা দেখবি জাদুজগতে গেলে।’
তো সে এইসব সাধারণ বা ছাপোষা মানুষগুলির জীবন পরিক্রমা দেখতে গেল। তারাও সবাই মিলেমিশে জগাখিঁচুড়ি পাকিয়ে রয়েছে মেলার ভিড়ে। মোটা গুচ্ছদড়ির মধ্যে তারাও সবাই পাকিয়ে রয়েছে নানারকম নানারঙা সূত্র হয়ে। তবে তাদের সুতোর রঙ বিবর্ণ—- চটে যাওয়া হলদে বা লাল বা সবুজ এইরকম। হোঁচট খেতে খেতে চলছে তারা, গমনপথ মসৃণ নয়, ওঠা-নামায় ভরপুর, কোথাও বা বিচ্ছিন্ন, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। চলনে নেই কোন ছিরিছাঁদ বা জাঁকজমক, নেই কোন ঠমক বা গমক। অতীব সাদামাটা বলতে যা বোঝায়, কোন চমকের লেশমাত্র নেই। তারা সবাই মুখ বুজে চলেছে, দেখলে মনে হবে কেউ চালিয়ে দিয়েছে বলেই চলছে। বড়োই মুখচোরা চলন, কোন ভাষাই নেই চলাচলে। সে দেখে বুঝল, এদের মধ্যে আসল উদ্দেশ্য কী এই চলনের তার প্রকাশ ঘটা তো দূরস্থান, আদৌ কোন ইচ্ছে-অনিচ্ছে আছে কিনা সেটাও আঁচ করা মুশকিল। এরা কোন স্বপ্ন দেখতে জানে কিনা সন্দেহ, স্বপ্ন দেখা যেতে পারে জীবনে বুঝিবা সেটাও শোনেনি কোনদিন। এরা যে বেঁচে আছে, সংসারধর্ম পালন করছে সেটাও বোঝার উপায় নেই এত নীরব এরা। কী লাভ এদের দেখে, এরা তো সব জীবন্ত শবদেহ সমান, ভাবল সে। নিজের কথা জানাতে এমনভাবে অক্ষম কোন মানুষ যে দেখলে মনে হবে বুঝি ভাষার ব্যবহার শেখেনি কেউ। এরা কথা বলতেই জানে না, উদ্দেশ্য-বিধেয়র হদিশ অবশ্যই জানবে না। বলল তাই,
‘এদের দেখার কোন মানে হয় না। এরা সব অপোগণ্ডের দল। এদের স্বকীয়তা বা স্বাধীনতা বলে নেই কিছুই। এরা একেবারেই মানুষ নয়, এই সাধারণ জনতা। সব কীটপতঙ্গের দল।’
‘কিন্তু এদেরও কণ্ঠস্বর আছে। সম্মিলিত কণ্ঠস্বর, তা বড়োই সবল ও প্রবল। ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের ইচ্ছের কথা প্রচার করে না ঠিক, সেই অর্থে আসল উদ্দেশ্যটার প্রকাশ বড়োই জটিল পন্থায়। তবে একটা কথা ঠিক, এরা প্রকার-প্রকরণে বড়োই সরল। ‘
কোটিকল্প বোঝাবার চেষ্টা করল। সে বিরক্তি ঢালল তার কথায়,
‘সেই সরলতা দিয়ে আমার কী হবে ? কী জীবনের বা চলাচলের আসল উদ্দেশ্য তা কি এদের পিটিয়ে মেরে ফেললেও এরা বলতে পারবে ?’
‘এত হেলাফেলা করবি না,’ গলায় গাম্ভীর্য দিগদর্শকের, ‘এরা, এই সাধারণ মানুষরা জগৎকে বোঝে তাদের মত করে, তাদের চোখ দিয়ে দেখে। আমার তো মনে হয়, কী জীবনধারণের আসল উদ্দেশ্য তা এরা বোঝে সর্বাধিক, নিজেদের মত করে।জগৎকে আসলে এরাই চালায়।এরা চললেই চলে জগৎ, নইলে অচল।’
‘তুমি দু’রকম কথা বলছ,’ সে প্রতিবাদের গলা তুলল, ‘একটু আগে তুমিই বলেছ যে এদের জীবনযাপন জটিলতায় ঢাকা আর তাই আসল উদ্দেশ্য এদের দেখে বোঝা বেশি কঠিন। আবার এখন বলছ উল্টোটা।’
‘তুই আমার কথা ভুলভাবে বলছিস,’ কোটিকল্প সংশোধন করে দিল, ‘আমি একবারও বলিনি যে এদের জীবনযাপনে জটিলতা আছে। বরং বলেছি উল্টোটা। বলেছি যে এদের জীবনযাপনে আছে এতটাই সারল্য যে কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সামনে রেখে চলতে জানে না এরা এবং যেহেতু এদের চলনে কোন লক্ষ্য দেখতে পাবি না তাই আসল উদ্দেশ্য কী হতে পারে তার সদ্ধান জানা আরও জটিল হয়ে যাবে। কিন্তু তোকে এই সত্যিকথাটা জানাচ্ছি যে এই সাদামাটা মানুষগুলি জীবনের আসল উদ্দেশ্যটা বোঝে সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে সরলসাদা কথায়। তোকে বলেছি প্রতি পদে পদে ওই আসল উদ্দেশ্যটা জানতে হলে জাদুজগতে যেতে হবে, বলেছি তো ? সেটা ওইসব বড় বড় চাহিদাসম্পন্ন লোকগুলির জন্য বেশি দরকার। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে বড় বড় স্বপ্নের কথা, বড় বড় লক্ষ্যের কথা, আসল উদ্দেশ্যটা বলতেই পারবে না। কিন্তু এইসব সাধারণ মানুষগুলি ? আসল উদ্দেশ্যটা কী জানতে চাইলে এদের নিয়ে জাদুজগতে যেতে হবে না, এখানে এই মেলাতেই যদি বুদ্ধি করে সরলসাদা প্রশ্ন করতে পারিস বিচক্ষণতার সঙ্গে ওরা এক কথায় বলে দেবে উত্তরটা। কোন ধানাই-পানাই করবে না। তোর তো দেখছি কিছু বলার আছে মনে হচ্ছে দেখে।’
‘আছেই তো। তুমিই বা তাহলে জাদুজগতে নিয়ে গিয়ে উত্তরটা জানাতে এত ধানাই-পানাই করছ কেন ?’ অভিযোগের গলা তার, ‘কেনই বা ধানাই-পানাই করছিলে এদের দেখতে চাইছিলাম বলে ? আমি তো গোড়া থেকেই এদেরকে দেখতে চাইছিলাম। তুমিই আমাকে সাড়া দিচ্ছিলে না।’
কোটিকল্প হেসে ফেলল। এবার তত ঘূর্ণি নেই হাসিতে। বলল,
‘তাহলে শোন্, বলছি, না বলে আর উপায় নেই এখন। তুই এতদিনে সাবালক হয়েছিস বুঝতে পারছি। এদিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, এত ভনিতা তাই। তুই আর এখন খাবি খাওয়ার অবস্থাতে নেই, চোখকান খুলে গেছে। রেগে হয়তো আগুন হয়ে যাবি, তবুও বলতে হবে রহস্যটা। জাদুজগৎটা আসলে একটা ভড়ংবাজি, না এনে উপায় ছিল না বলে আনতে হয়েছিল। লোকেরা সব জাদুর মোড়কে দেখতে ভালোবাসে। তারা ভাবতেই পারবে না সব উত্তর রয়েছে স্বাভাবিকতায়, চোখের ওপর। জটিল যাদের জীবনপ্রণালী তাদের কথা জাদুজগতে গিয়েই জানা যাবে। সরল লোকরা জাদুটাদুর ধার ধারে না, এক কথায় জানিয়ে দিতে পারে জীবনের গূঢ় রহস্য। কিন্তু জটিল লোকগুলিকেও তো বুঝতে হবে ? তারা সব জগতের দর্শন-বিজ্ঞান রচনা করে। সাধারণ মানুষ তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। তাদের কথা বেশি বেশি না জানলে মনে হতেই পারে জগতের আসল বিষয় জানা হল না। যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় জগতের সাধারণের চলন ও কণ্ঠস্বর, সেই অসাধারণ ও প্রকৃত অর্থে জটিল লোকদের কথা প্রতিফলিত হয় একমাত্র ওই জাদুজগতেই। তাই তার আমদানি। সাধারণ মানুষকে বুঝতে পারবি মেলার মাঠে বসেই, জিজ্ঞেস করলে স্পষ্ট বলে দেবে অন্তরের কথা, কোন রাখঢাক থাকবে না। মুশকিল হল, তাদের অত সাদামাটা কথা বিশ্বাস করতে পারবে না কেউ। লোকেরা চায় অলংকার, বাগাড়ম্বর। তাই এই জাদুজগৎ। কিন্তু যদি আস্থা রাখতে পারিস তো এখানে এই মেলার মাঠে বসেই সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করে জেনে যেতে পারিস কী সব মানুষের জীবনযাপনের আসল উদ্দেশ্য। উপযুক্ত প্রশ্ন করলে তারা তোকে এককথায় বলে দেবে তা। সহজে জেনে যেতে পারবি অত জটিল প্রশ্নের উত্তর।’
শুনে সে কিছুটা সময় চুপ করে কিছু ভাবল। তারপর ক্ষীণ অভিযোগের গলায় বলল,
‘আমি প্রথম থেকেই চাইছিলাম অসহ্জ লোকগুলিকে না দেখতে। সহজে জেনে যেতে পারি প্রশ্নের উত্তর যাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এড়িয়ে চলার তো কোন যুক্তি নেই।’
‘জানিস না একটা সারসত্য যে জগৎ চলে জটিল পথেই ? বিজ্ঞানের সোজা কথাটি তুই দেখতে পাবি, বুঝে নেওয়ার রাস্তাটা বড়োই জটিল। দার্শনিকরা জীবনের সরলতম বিষয়টি বোঝাবে তোমাকে অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়াতে। সহজকে সহজভাবে পেতে জগতের বড়োই অনীহা। তুমি জটিল পথে চলে তবেই জানতে পারবে জগতের সব নিয়ম সরল, কারণ যত জটিল হবে প্রক্রিয়া তত সুন্দর হবে সরলের প্রকাশ।’
থামল কোটিকল্প। সে আবার গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগল। তারপর কিছুটা আবদার গলায় ফুটিয়ে তুলল আগ্রহের সুরে,
‘তাহলে এইসব সাধারণ মানুষকে আমি কী প্রশ্ন করব বলে দাও যাতে তারা সহজ ভাষায় বলে দেবে সমগ্র মানবজাতির অথবা জীবকুলের মূল উদ্দেশ্য কী।’
উত্তর দিতে গিয়ে দিগদর্শক একটু বিরতি নিল এবং বলল,
‘তুই তাদের কাছে যা, গিয়ে একেবারে প্রাথমিক প্রশ্নটা করবি, সেটা হবে তেমন কাজ সম্পর্কে যা প্রত্যেকটি লোককে অবশ্যই করতে হয়।’
‘সেই প্রাথমিক প্রশ্নটা কী ?’
‘বললাম তো, যে কাজটা জীবমাত্রেরই করতে হয় সেইটা নিয়ে যে প্রশ্ন। তুই ভেবে দ্যাখ্, কী না করে উপায় নেই মানুষের বা জীবকুলের। ভেবে বল্ না।’
সে ভাবল একটু সময়। প্রশ্নের আকারে জানতে চাইল,
‘সবাইকে খেতে হয়, পরতে হয়, এসবই তো না করে উপায় নেই ?’
‘ঠিক, তবে খাদ্যগ্রহণটা এক্কেবারে প্রাথমিক। তুই গিয়ে প্রশ্ন কর্, খাও কেন তোমরা, খাওয়ার কী দরকার। তারপর প্রশ্ন করতে পারিস, বিয়ে করে কেন সংসার তৈরি করতে যাচ্ছ, কী লাভ সংসার বানাবার। প্রশ্ন করে দ্যাখ্, সাধারণ লোক কী বলে। অসাধারণ লোক বলবে যা শুনে থৈ পাবি না। সাধারণ লোক দেবে সোজা উত্তর।’
সে নিজের মনে বক্তব্য বিষয় নিয়ে খানিকটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। সে ভাবল, কেউ যদি তাকে এই প্রশ্নগুলি জিজ্ঞেস করত সে নিজে কী উত্তর দিত। নিজের উত্তরটা নিয়ে এদিক-ওদিক-নানাদিক ভেবে নিল। তার চোখের সামনেই মেলার জনস্রোত চলমান। এখানে সবাইকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট যে এদের মধ্যে নেই কোন অসাধারণ মানুষ, তারা রয়েছে অবশ্যই ভিড়ের মোটা দড়িগুচ্ছের কোন সরু সরু পাকানো সুতোয়। আপাতত তাদের প্রকাশ একেবারেই প্রাধান্য পাচ্ছে না। সে ভাবল, হতে পারে এটা তার দিগদর্শকের কোন কৌশল। সে দাবি মেনে তার সামনে থেকে ওইসব অসাধারণ বিখ্যাত মানুষগুলিকে সরিয়ে রেখেছে, তারা উহ্য হয়ে আছে চলমান মেলাপ্রাঙ্গণের ভিড়ের প্রসঙ্গ থেকে। এই ভিড়ে যারা রয়েছে তারা সবাই জনগণ, তারা সমস্তই সে যেমন বোঝে তেমন ছাপোষা মানুষের ভিড় যারা একা কোনকিছু ঠিক করে না, কোন তত্ত্ব তৈরি করে না, কোন দার্শনিক মতামত দেয় না, সমাজকে সংস্কার করতে চায় না, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার দৌড়ে নেই, বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন দেখে না লিখে বা গান গেয়ে বা খেলাধূলা করে বা অন্য কোন উপায়ে, তাদের জীবনে কোন উচ্চাকাঙ্খা নেই, আছে যা তাকে স্বাভাবিক রাস্তায় জীবনযাপনের প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। তাদের কণ্ঠ জনগণের কণ্ঠ, তাদের কোন একক সর্বজনগ্রাহ্য কণ্ঠ থাকে না, তারা কথা বলে সম্মিলিত ভাবে, কিন্তু তাদের সেই সম্মিলিত গর্জন সমাজ ও সভ্যতাকে কাঁপিয়ে দিতে পারে, চালিত করতে পারে। এই জনতার ভিড়ে এবং তাদের একটানা চলনে সে শুনতে পাচ্ছিল সেই জনগণের কণ্ঠের না থামা গুঞ্জন। সে এবার স্থিরনিশ্চিত হল যে তার জন্যই কেবল এই জনতার ভিড়কে সামনে রাখা হয়েছে কোন অজানা কারসাজিতে। যদি সে গিয়ে ওই জনগণের ভিড় থেকে কোন এক বা দু’জনকে তার প্রস্নগুলি করে তারা কী উত্তর দেবে ? সে নিজে কী উত্তর দিত ? সে কথাটাই জানাল সে,
‘আমি তো ভাবছি আমাকে কেউ আমি কেন রোজ খাচ্ছি এই প্রশ্নটা করলে বলতাম খাওয়া দরকার তাই খাচ্ছি।’
‘যদি এই উত্তর হয় তো উত্তরদাতাকে তোর পরের প্রশ্নটা করতে হবে, খাওয়ার দরকার হচ্ছে কেন।’
‘সে বলতে পারে, দরকার-টরকার বুঝি না, খিদে পাচ্ছে ইচ্ছে হচ্ছে তাই খাচ্ছি।’
‘সেক্ষেত্রে তোকে পরের পর প্রশ্ন করে যেতে হবে যতক্ষণ না সে আসল উত্তরটা দেয়।’
‘সেটা বুঝবো কী করে ?’
তার গলায় অসহায় সুর। দিগদর্শক বোঝাল,
‘বুঝতে পারবি ঠিক একসময় কোন্ টা আসল উত্তর, সেটা স্পষ্ট বোঝাবে খাওয়ার প্রাথমিক উদ্দেশ্যটা। ততক্ষণ তাকে প্রশ্ন করতে থাকবি তোর মত করে যাতে সে শেষপর্যন্ত তুই যেটা শুনতে চাইছিস সেটা বলে। যদি তুই যা বললি সেটাই হয় তার উত্তর তো তোকে পরের প্রশ্ন করতে হবে, খিদে পেলে দিনের পর দিন যদি না খাও তো কী হবে।’
‘সে বলতে পারে, বা রে, তাহলে কাজকর্ম করব কী করে।’
‘তাহলে তোর প্রশ্ন হবে, কাজকর্ম করার জন্য কর্মক্ষম থাকার কারণেই খাচ্ছ, খাওয়ার আর কোন উদ্দেশ্য নেই কি।’
‘সে বলতে পারে, বা রে, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলে তো না খেয়েই মরে যাব।’
তার কথা শেষ হতে না হতেই কোটিকল্প তাকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ব্যস, তোর জায়গাতে তুই পৌঁছে গেলি। এটাই আসল উত্তর, কিছুটা পরোক্ষভাবে হলেও। প্রত্যক্ষভাবে উত্তরটা জানতে হলে তোকে আরেকটা প্রশ্ন করলেও ক্ষতি নেই। তুই এবার তাকে প্রত্যক্ষভাবে এই প্রশ্নটা করতে পারিস, তুমি বললে না খেয়ে থাকলে একসময় তুমি মরে যাবে, তার মানে তোমার খাওয়ার মূল উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা। যদি এই প্রশ্নটা হয় তাহলে উত্তরটা কী হবে ? মনে কর্, তুই শুনলি প্রশ্নটা। কী উত্তর দিবি ?’
একটু ভাবল সে। ভেবে সতর্ক গলায় জানাল,
‘আমি হলে বলব, হ্যাঁ।’
কোটিকল্প বেশ সপ্রতিভ গলায় ও ভঙ্গিতে বলল,
‘তুই কেন, এই একই উত্তর দেবে সমস্ত লোক। শোন্, অধিকাংশ লোক প্রথম প্রশ্নটার উত্তরেই এই কথাটা বলে দেবে। তুমি কেন খাচ্ছ, প্রশ্নটা করলেই কেউ অত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে উত্তর না দিয়ে বলে দেবে, খাচ্ছি বেঁচে থাকব বলে। প্রশ্ন করে দ্যাখ্ না প্রত্যেকটি লোককে, দশজনের মধ্যে আটজনই সোজাসুজি এই কথাটাই বলবে। ইচ্ছে হলে প্রশ্ন করে দ্যাখ্ লোকের পর লোককে ধরে। দ্যাখ্ না পরীক্ষাটা করে।’
সে কিছুটা অনুপ্রাণিত হল লোককে ধরে ধরে প্রশ্ন করার জন্য। সবাই তো যাচ্ছিল তার সামনে দিয়ে, ভিড়ের সাধারণ জনতা। নানারকম চেহারা, বেশভূষা, হাঁটাচলা প্রত্যেকের। কোটি কোটি লোক তারা, কিন্তু একটি লোকের থেকে অন্যজন কোন না কোন দিক থেকে আলাদা অবশ্যই, এমনকি যদি কোন লোকের কেউ যমজ তাকেও তার অন্যটির থেকে কোন না কোনভাবে দু’রকম ভাবা যাচ্ছে। স্রোতের এই লোকসমূহকে ধরে ধরে প্রশ্ন করা যেতে পারে, করাটা বেশ উৎসাহোদ্দীপক কাজও বটে, কিন্তু করাটাতে একটাই তার আপত্তি মনে মনে, সে এতোই কমবয়সী বালকসদৃশ চেহারার যে সে প্রশ্ন করতে গেলে লোকেরা তাকে পাত্তাই দেবে না হয়তো। ভাববে, এই বালকটির কথায় কান দেওয়ার কোন মানেই হয় না, হেসে উড়িয়ে দেবে তাকে সবাই। তার এই ভয়টা সে এবার প্রকাশ করল,
‘আমি এতটাই বালক, চেহারাতেও বটে, লোককে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে কেউ শুনবেই না।’
তার ভয়টা শুনে দিগদর্শক চট করে উত্তর দিল না। তার কপালাকৃতি চেহারাচিত্রণে ভাঁজসদৃশ প্রকাশ দেখা গেল এবং চিন্তিত শোনাল গলা,
‘সেটা একটা কথা বটে। তুই ঠিকঠাকই ভেবেছিস। আসলে বড়দের দুনিয়ার সমস্যা এখানেই, তারা ছোটদের কাজকর্ম, কথাবার্তা ছেলেমানুষী বলে সত্যিই হেসে উড়িয়ে দেয়। বড়োরা ছোটদের সঙ্গে কথা বলে সবসময় অন্যরকম গলায়, অন্য ভঙ্গিতে, অন্য ভাষায়। এতে যে কতটা তাদের চেহারাবিকৃতি ঘটে তারা ছাই নিজেরাও কি সেটা বোঝে ? বুঝলে এমন কৃত্রিম আচরণ করত না। ছোটরা যে তাতে বিরক্ত হয় তারা বোঝে না। লোকগুলো আসলে যেমন ছোটদের সঙ্গে কথা বলার সময় তেমনই স্বাভাবিক থাকতে পারে, তাতে ছোটদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে এবং ছোটরা তাদের নিজের বন্ধু ও প্রিয় বলে মনে করবে। কিন্তু বড়দের দুনিয়ার মানুষগুলির কেন যে এই দুর্বুদ্ধি কেজানে, কেন যে তারা ভাবে ছোটদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাদের মত হতে হবে এবং নিজেকে সঙ সাজাতে হবে সেটা ওই মাথামোটা বড় বড় ধারি ধারি লোকগুলি নিজেরাই কখনো ভেবে দেখার মত সুবুদ্ধির নাগাল পায় না। এখানেই যত সমস্যা। আসলে কী জানিস, বড়দের দুনিয়ায় বাস করে যেসব মানুষ তারা জীবনের স্বাদ ভুলে যায়, বেশি বেশি বুঝতে বুঝতে জীবন তাদের কাছে তিক্ত। এসব লোকেরা বড় হওয়ার প্রক্রিয়াতে সহজ-স্বাভাবিক দুনিয়াটাকে হারিয়ে ফেলে এবং বেশি বুঝতে গিয়ে নিজেদের স্বার্থপর মর্কট বানিয়ে ফেলে। বড় হওয়াটা তুই জানবি এবং পরে নিজেও টের পাবি যে জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বা অভিশাপ। বড় হলে তুই তোর এই সহজ-সরল পৃথিবীটাকে হারিয়ে ফেলবি। ক্রমাগত চাপে ভুগতে ভুগতে তুই ভুলে যাবি স্বপ্ন দেখার কথা, ছোট বয়সের কাজকর্ম তোরও মনে হবে ছেলেমানুষী। কিন্তু কী বল্ তো, এই ছেলেমানুষী দৃষ্টিভঙ্গিটা হারিয়ে যায় বলেই বড়দের জীবন এত জটিলতায় ভরে যায়। তারা আর কোনদিন নিঃস্বার্থ, স্বাভাবিক থাকার কথা ভাবতে পারে না, ভাবাটাকে মনে করে বোকামি। বাকি জীবনে এই মানুষটি তার সেই অমূল্য হারিয়ে ফেলা জীবনটাকে আর কোনদিনও ফিরে পায় না, শেষপর্যন্ত মৃত্যু হয় তার অতীব দুঃখজনক পরিস্থিতিতে। তখন সে এক জটিল, স্বার্থপর, হিংসুটে, বিশ্বনিন্দুক, বিতৃষ্ণ ও সবার অপ্রিয় দুর্জন বৃদ্ধ। কেউ আর তাকে পছন্দ করে না, ভালোও বাসে না, সেও কাউকে ভালোবাসতে পারে না। তার চোখে ও মনে তখন কেবলই সন্দেহ আর কেবলই ঘৃণা। সে পরিণত হয় এক চূড়ান্ত অমানুষে।’
কথাগুলি বলতে বলতে থামল তার পথপ্রদর্শক। সে যত শুনছিল তার মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধছিল। তাহলে কী হবে ? সে তো এখনও বুঝতে পারল না কী মানুষের আসল উদ্দেশ্য ? সে সবেমাত্র জেনেছে যে প্রশ্নোত্তর প্রক্রিয়াতে সেই অভীষ্ট জানাটার জায়গায় পৌঁছনো গেছে, জানাটা পুরো হয়নি এখনও। সেটা জানতে হলে মাঠে নেমে তার এই জায়গাটা যে সঠিক সেটা যাচাই করে নিতে হবে। কিন্তু তার মাঠে নামার তো এটাই বড় বাধা, সে তো বালক, বড়রা তার সঙ্গে কথা বলবে কেন ? দেখা গেল যে তার দিগদর্শকও এই প্রশ্নটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে এবং জানিয়েছে যে তার মত একজনের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক লোকরা এত গুরুগম্ভীর আলোচনায় যাবে না। অতএব আর কী ? সে যখন পুরোপুরি হতাশ হতে চলেছে তখন কোটিকল্প তাকে সাত্বনা দিয়ে জানাল,
‘ভাবিস না। ব্যবস্থা সব আমার হাতে। তুই ভেবে মরছিস কেন ? বড়োরা যাতে তোর সঙ্গে কথা বলে সেই উপায় করছি। তোকে তাদের মত বড় বানিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। ওটা আমি যখন-তখন করতে পারি।একটু এগিয়ে-পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপার। আরে, ওই এগিয়ে-পিছিয়ে দেওয়ার কাজটাই তো করি আমি। ওটা আমার পেশাও বলতে পারিস। এত নিখুঁত ভাবে কাজটা করি যে মানুষ বুঝতেই পারে না কিভাবে তার জীবন কেটে যায়। কেটে গেলে তখন বোঝে, কেটে গেল। তারপর আসে তার শেষদিন। আর সে বোঝে পৃথিবীর বুকে তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, সারাটা জীবন সে কিভাবে শেষ করে দিল বাউণ্ডুলে ও বেহিসেবী হয়ে। সে তখন আমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়, যেটা করা তার আগেই উচিত ছিল। আমিই বা তখন কী করি বল্ তো তাকে নিয়ে ? সে তখন বোঝা আমার নিয়মে। আমি আর যাই করি জানিস, নিজের নিয়ম ভাঙ্গি না। আমি কেবল এগিয়ে যাই এখন থেকে। আমি অতীতে ফিরে যেতে জানি না। এই মরণাপন্ন লোকটির হাত ধরলে আমাকে পিছিয়ে যেতে হয়। সেটা নিয়মবিরুদ্ধ। তবে তোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি, কারণ তুই আমাকে বুঝেছিস, আমার হাত ধরেছিস, আমাকে তোর আশ্রয় বলে ভেবেছিস। তোর ক্ষেত্রে দরকার হলে আমি পিছিয়েও যেতে পারব নিজের নিয়ম অক্ষুণ্ন রেখে। তবুও দ্যাখ্, তোকে আমি পিছিয়ে নিয়ে যাব বলে ভাবছি না, কারণ ওটা আমার নিয়ম বহিৰ্ভূত কাজ। আমি নিজেও সেটা করি না। যদিও তোকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরকার হলে তাই যাব, কারণ তোর বয়সে আবার সমস্ত জীবন অতীতে পিছিয়ে গিয়ে শুরু করা সম্ভব। যদি পিছিয়ে যাসও তুই, কেবল তুইই পিছিয়ে যাবি, বাকি জগৎ যেমন চলছে সম্মুখের দিকে তেমনই চলতে থাকবে।’
অনেকটা সময় কথা বলে থামল কোটিকল্প। সে জিজ্ঞেস করল,
‘তাহলে কী করবে তুমি এখন আমাকে নিয়ে ?’
‘তোর বয়সটা বাড়িয়ে কেবল তোকেই বড় বানিয়ে দেব। অন্তত কুড়ি-পঁচিশ বছর এগিয়ে যাবে তোর বয়স। দেখতে বড় হয়ে যাবি। সেটা ভবিষ্যতের গর্ভে। তার জন্য তোকে আবার জাদুজগতে নিয়ে যাব। সেখানে এই মানুষগুলিও থাকবে। ভবিষ্যৎ থেকে পিছিয়ে তখনকার তুই এসে যাবি বর্তমানে ওই জাদুজগতে এবং সেখানে এই মানুষগুলিকে ধরে ধরে উত্তর জেনে নিবি। তারপর তোর বয়স আবার বর্তমানে এনে দেব জাদুজগতের কাঠামোতে।’
কোটিকল্প কথা থামাল। তারপর তার হাত ধরে নিয়ে গেল জাদুজগতে। সেখানে গিয়ে তার জন্য হাত তুলল। ব্যাপারটা যা ঘটল অনেকটা ভোজবাজি বলে মনে হল তার। কী ঘটল সে নিজেও বুঝতে পারল না। কেবল দেখল, সে হঠাৎ অনেকটা বড় হয়ে গেছে, অনেককিছু আগের চেয়ে অনেক ভালো বুঝতে পারছে। সে আসলে পঁচিশ বছর পরের সে হয়ে বসে আছে। এখন সে অনেক বেশি প্রাজ্ঞ, তার জ্ঞানচক্ষু অনেকটা প্রসারিত এবং তার মধ্যে কী একটা হাহাকার সবসময়। সে বুঝল, এটাই তবে বড় হওয়ার হাহাকার যেটার কথা শুনল সে এইমাত্র। তবে হ্যাঁ, এখন সে মানুষগুলিকে ধরে ধরে প্রশ্ন করতে পারে। তার কথা শুনবে সবাই।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)