শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’ উপন্যাস।)
আঙ্গ দেশ, আঙ্গ ঘর, আঙ্গ মানুষ
ছাড়ি আবার যাইব কোন চুলায়
ধিকি ধিকি আগুন জ্বলা শুরু হই গেছিল এধার ওধার। কেউ খবর রাখের আর কেউ খবর রাখের না। কামকাজ হালাই কে আর কত মাথা ঘামায়। ঘামানোর দরকার তো আছে এ কতা কে আর অস্বীকার করের। দুনিয়াদারির যা হালচাল কে যে কোনমুই যাইব কইতে হারেন না। অভাব অনটনে মানুষজন দিশাহারা হই যা অবস্থা হইছে সামলে সুমইলে উঠইতে কত যে সময় হার হইব কে জানে। দিনদয়ালের মুখ চাই মাইনষে বাঁচি রইছে। চোখের দিকে চাওনি যায় না। ঝরঝর করি জল হড়ে। কার কাছে কইয়ুম, কে আর হোনে। তবুও লোক দেইখলে জিগাই এতদিন কনডাই আছিলা, ক্যমনে দিন কাডাইছ। কইত হারে না, কতাগাইন মুয়ের কাছে আই আটটি যাই। আঁই ভাবি এমনটা কেন হয়? ঘটনা গাইন সময়ে সময়ে হাল্টি হাল্টি যায়। কারা দায়ী এর লাগি। রাজিয়ার বাপ, ফাতেমার মা আঙ্গ উঠানে হিড়ি হাতি দিলে বয়। মনটা ওগলাই ওগলাই ওঠে। হেটের জ্বালা বড় জ্বালা। অন দেশ গাঁয়ের অবস্থা ভালা হইলে, আনাজপাতির দাম কইমলে আশা জাগে। এতদিন তো ঘরে দানাপানি ছিল না, দিনমজুরি ছিল না। আঙ্গ ঘরেও তো এমন বন্দোবস্ত ছিল না যে ওদের বাড়ি বাড়ি খাওয়ামু। আঁই মাথার উপর হাত রাখলেন হাত দুটি ধরি কয়, ‘দিদি গো, অভাবের সংসার, হোলামাইয়াগুনরে লই কেমনে যে বাঁচুম, ভাইবলে দুই চোয়ে ঘুম আয়ে না।’ এত মন্দার কালেও মাইনষের মধ্যে ভাব ভালোবাসার কমতি হয় নি। মনের টানটানি লই হিসাব কইষতে হয়নি, দোষারোপ করেনি কেউ কারোরে। এ হক্বলটা ঠিকই তো ছিল। ‘খোদার গজব লাইগলে কে কারে আগ্রায়, কন দেখি, আত্মীয়স্বজন বইলতে দূর সম্পর্কের খালা খালু, ফুফা ফুফু, ওরাও তো অভাব অনটনের জ্বালায় জ্বলি হুড়ি মরে। অন্যদের আশ্রয় দিব, তার জো আছে।’ কী আর কমু, জ্বলে পুড়ে মরি আর কি। চালের কোলার তুন থালায় করি এক সের খানেক চাল আইনল আঁচলে ধরি লয়। রাজিয়ার বাপের হাতে পাঁচটা ট্যাঁয়া দিয়া কইলাম বাজার তুন চাইল ফাইল কিনি খাইও, হোলামাইয়ারে পাঠাই দিও, গাছে গাছে লাউ কুমড়া ধইরছে, দিব একটা দুইটা। বেগুন, মাইরালা বাটা নিবা নি ফাতেমার মা। কাইন্দ না, দেশের হাল কিছুটা ফিরছে, তোঙ্গ দেখা কইছে এই অভাব থাইকত ন, সরকার নাকি ব্যবস্থা করের। এসকল তোঙ্গ জেঠার কাছেই হুনছি। সব নাকি ঠিক হইয়া যাইব গা, ফের হেট ভরি দু’বেলা খাইতে পরবা। ‘ সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা।’ আচ্ছা, মনের মধ্যে কোনও খেদ রাইও না, আবার আগের মতো যাওয়া আসা কর। চাষবাস ঠিক মতো হইলে মনমেজাজ ঠিক হই যাইব। হক্বল সময় কি সমান চলে, কোন না। এই যে দেখইছ দিনের আলো, আর কিছুক্ষণ পরেই আঁধার নামি আইব। কোনঢার উপরে কি আঙ্গ হাত আছে, কও না। যাও ঘরে যাও, সাপখোপের যা উৎপাত, টুক করি ছোবল মারি দিব। খালের জল টইটম্বুর, বাঁশের সাঁকোটাও ল্যাকপ্যাক ল্যাকপ্যাক করে, সাবধানের মার নাই। ও একখান কথা কইতে ভুলি গেছি, মুরগি ডিম দিলে, দশ বারটা পাঠাই দিতে ভুলি মাগো না। ওই সুযোগে রাজিয়া আর ফাতেমার লগে দেখা হই যাইব, ওগোরে কদ্দিন হইল, দেই না। আকবরের বাপ হুনছি খোঁড়াই খোঁড়াই হাঁটে। হেতাগো ঘরবাড়িও তেমন আর মজবুত নাই হুনিয়ের, ভাঙ্গি ভাঙ্গি হড়ের। ‘কন তুন যে কী হই গেল। টানাটানির সংসারে কোনরকমে ডাইল ভাত খাই খাইখরচা হাই কাঢি গেছিল, খোদার গজব লাইগল, হক্বলকিছু ওলটপালট হই গেল।’ ভগবানের দোষ কেন দিতে আছ রাজিয়ার বাপ, এই যা কিছু আকাম কুকাম দেইখছ, বেগ্গাইন বেআক্বেল মাইনষের কাম। পিছা মারি ওদের খোয়ারে। ‘ আমনে ইয়ান হাঁচা কতা কইছেন। শতানের বাচ্চা ফজলের বাপ, আঙ্গ চুষি চুষি খার। গ্ৰামের মুরুব্বি সাজি বই রইছে, ঝোপ বুঝি কোপ মারে। দিব নি একদিন মাথা হাঢাই, তন বুইঝব ছোটলোকরা চেতি গেলে কেমন হয়। দুষ্ট গরুর চাই হূন্য গোয়াল ভালা। ওই বেটা নেমকহারাম, বুরবুক। পানিতে ডুবি যাচ্ছিল ওর হোলা, আঁই তো বাঁচাইছি।’ কি কও রাজিয়ার বাপ! ‘ আঁই কি আর সাধে কইয়ের। ভেতরে ভেতরে ঘোঁট পাকার। হুইনতেছি মৌলবি সাব আর হাজি মোতালেব মিঞার লগে যোগসাজশ করি হিন্দু মুসলমানের মধ্যে গন্ডগোল লাগাইবার ফন্দি আঁটতেছে। জম্ম ইস্তক আঙ্গ হাশাহাশি ঘর গেরস্তি। পুরা দেশে নাকি কানাকানি ফুসুর ফাসুর চইলতেছে ভাই ভাইয়ের কাম আর চইলতন, আরও যে কত কতা, কানে আঙ্গুল দেনের কাম।’ এসব কী হুইনতেছি রাজিয়ার বাপ! ‘ আমনেরা কিচ্ছু ভাবিয়েন না, আমরা আছি তো। আঙ্গ হরান থাইকতে কেউ আমনেগ টিকিটিও ছুঁইত হাইরত ন, এই কসম খাইলাম। ওই হালার বেটাদের আমরা দেইখা লমু। আমনেরা নিশ্চিত হই ঘুমান গিয়া। বকলম, মক্বায় তাই হাজি হইছে, মাইনষের দাম দিত জানে না। এই দেশটার কী হইল, ধম্ম ধম্ম করি সব মইরব। মুখে আগুন দিবার আর গোর দিবার লাগি কেউ রইত ন।’
ফিসফিসানি গুনগুনানি এত তাড়াতাড়ি যে ঘরে ঘরে চলি আইব তা আর কে জাইনত। লোকে ভাইবছিল হক্বলটাই কতার কতা। হায়রে জীবন কী খেলটাই না খেইলতে আছস আঙ্গ লগে। হুইনছি ইয়ানে দশ পুরুষের বাস। ইয়ানের মাটির লগে জীবন মিশি আছে, দিনরাইত ওঠাবসা। এই গাছগাছালি, পাখিদের কিচিরমিচির, ভরা বর্ষায় খালবিলের জলের কলকলানি নাড়ি ধরি টান মারে। বড় সুখদুঃখের ঘর, হোলামাইয়া লই সংসার। যত্ন আত্মীর খামতি তো নাই। রোজের কথা রোদে কই। কদ্দিন হইল বড় হোলাটা শহর তুন বাড়ি আইছে। হিয়ানে ইসকুলে হড়ে বাপের কাছে থাই। গ্ৰামে লেখাপড়ার তেমন ব্যবস্থা নাই। অঙ্কের মাষ্টার ভালা তো, বিজ্ঞানের ভালা ন, বাংলার মাষ্টার ভালা তো, ইংরাজির ভালা ন। হোলার মাথাটা ভালা, চট করি বুঝি হালায়, বাপের তদারকিতে যদি আর একটু আগাইত হারে, এই চিন্তায় গ্ৰাম ছাড়া। হিয়ান তুন কত কতা হুনি আইছে। ধমকাই দিলাম – আজারইগা কথা কইচ্ছা। হুদা কথা কান পাইততে নাই। হড়ালেখায় মন দে। ক্লাসে হক্বল বিষয়ে ভালা কইরলে না মাষ্টারমশাইরা সুনাম কইরব। আঁর হোলা কথাখান হুইনল বটে, মনটা যেন অন্য কথায় ঘুরঘুর করের। ‘মা এক দেশের মধ্যে দুইঢা দেশ থায়ে। এই কথার উত্তর আঁই দিবার লাই ভাববার আগেই আর একটা প্রশ্ন করি বইসল। আচ্ছা আমরা মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা বাজাই, পূজা দিই ক্যান? বন্ধুরা মসজিদে আজান দেয়া ক্যান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হড়ে ক্যান? উত্তরটা ভাইবতে চিন্তা করতি লাগে ন। যার যার ধর্ম তারা হালন করে। ‘ এত ধম্ম কেন গো?’
ভারি কঠিন প্রশ্ন আঁর হোলা করি বইসল, যার উত্তর আঁর কাছে জানা নাই, আঁরও খুঁইজত হইব। কি জানি এই প্রশ্নও ও আঁরে করছি পারে – ‘এত রকমের মানুষ কেন?’ এত প্রশ্ন ওর মাথায় আইল কেন! বিদ্যা যত শিখব, প্রশ্ন তত আইব। হোলাটা তো আর মাথা খাই ফালাইল। আঁই জানি না বিধায় ওরে কইলাম, তুই তোর কামে যা, বেশি হন্ডিতি ফলাইস না।
আঁই হত্যেকদিন দুপুরে স্নান সারি ঠাকুরের আসনের সামনে বই কৃষ্ণের ‘অষ্টোত্তর শতনাম’ পাঠ করি। আসন ভর্তি কত ঠাকুর – শ্রীচৈতন্য, জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা, লক্ষ্মী নারায়ণ, গোপাল, সরস্বতী, শিব, গণেশ, লোকনাথ বাবা, তিরুপতি, রামকৃষ্ণ সারদা মা, কুলগুরু রামঠাকুর আসন জুড়ে বসি আছে। হৌড়বাড়ি আইবার সময় দু’একটা দেবতাদের হানের টানে লইও আইছি। এর লাগি হৌড়ি কোন আপত্তি করে ন। গীতা, রামায়ণ মহাভারত ভাগবত ও আসনের এক কোনায় জায়গা হাইছে। আঁর হৌড়ি ধর্মপুস্তক গুলারে বড় যত্ন করি রাইখছে। এগুলা আঁর হৌর গয়ায় পিন্ডদান সারি হিরার সময় লই আইছে। হুইনছি দেড়-দুইমাস ধরি নৌকায় চড়ি তবে না হিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তি করি আইছিল। গয়া কাশী মথুরা বৃন্দাবন সব তীর্থ করি পুণ্য লাভ করেছিল নাকি। গ্ৰামের লোকে কইছিল ‘অগস্ত্য যাত্রা’ যদি আর ফিরি না আসে। দশ গ্ৰামের লোক দেইখতে আইছিল। হোলামাইয়া বুড়াবুড়ি বউঝি কেউ কি বাদ গেছিল। সেই সব কি আজকের কতা! কবে মরি স্বগ্গে গেছে। বুড়াবুড়িদের ফটোতে রোজই মালা দি আর পেন্নাম করি যদি আশীর্বাদের ছিঁটেফোঁটা মেলে তবে তো ভবনদী আরামসে পার হইতে হারূম আর আঁইও রোজ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই যাতে বাপের বংশ, হৌরের বংশের সাত কুল উদ্ধার হই যায়। আমনেরা কইতে হারেন সাতকুল কেন, বাকি বংশরা বাদ হড়ি গেল কেন? আসলে এর বেশি বংশপঞ্জি আঁর সংগ্ৰহে নাই যে। হক্বলে জিগায়, ‘ জেঠি, আমনে এরম গরীবের মতো থায়েন ক্যান?’ আঁই মাটিতে তাই বটে, চাঁদ আঁর ঘরবাড়ি, তোমরা দেখতি পাও না, একদিন তোঙ্গরে আঁর রাজবাড়ি দেখাইয়ুম।
এত কথা তো কইলাম কিন্তু একটা কথা মনের মধ্যে খচখচ করে। এই দুনিয়াদারির ব্যাপারস্যাপার লই আঁর মধ্যে আঁর হোলার মতো নানা প্রশ্নরা আসি কিলবিল করে। কেন দরজা জানালাগুলান আমরা ফটাস করি খুলতি চাই না? বাধাটা যে কন্নাই বুইঝতি হারি না। আঁর মনটা যেন ক্যামনে হারি বসি থাই। নিজেরে নিজে জিগাই হর্দাটা সরাইব কোন জাদুবলে? আঁই নিজেও কী হারিয়েননি মন তুন সরাই দিতে দেবদেবীর মূর্তিগুলান যা আঁই এতকাল হুজা করি আইছি, মনে মনে ভাবিই চলছি আঁই হিন্দুর মাইয়া, হিন্দুর বৌ, হিন্দুর সোলার মা। আমনেরা বিশ্বাস করেন আঁর যন্তনা হয়, কষ্টে বুকটা হাডি যায় কিন্তু কন্নাই যাই! আঁই কি আঁর ঘরের আসনের দেবদেবীর ফালাই দি এমন কাউদের বসাইতে হারি তারা খালি মাইনষের জয়গান গাইছে। বুক চাপি ধরি চেঁচায় কইবার আঁর কী সাহস আছে ‘ও রাজিয়ার বাপ, ফাতেমার মা তোমরা খালের ওপারের আলাদা কেউ নয় গো, আঙ্গ লোক। ওরাও তো কই তো হাইরত ন, ‘আইও হক্বলে এক জায়গায় হাত ধরাধরি করি থাকি, তোমরা আঙ্গ ঘরে আইও, আমরা তোঙ্গ ঘরে যাই। ভালোবাসি তো কও, হরানঢা দি ভালোবাসি, আমনেগো দুঃখে আঙ্গ দুঃখ হয়, তাহলি কন চাই কার কাছ তুন এই উত্তর হাইয়ুম, কেউ দিতে ন।’ একটা সোজা কতা তো বুঝতামই হারি না যার লাগি এই হাডুডু খেলা আর দড়ি টানাটানি তার দরকার কিয়ের লাই। এমন পৃথিবীর তো আঙ্গ দরকার নাই। প্রশ্ন তো জাগে কারা জিই রাখতি চায় এইঢা? আঁধার রাখতেও আঁই বিছানায় বই বই উত্তর খুঁজি, মনঢারে ঝাঁকাই জোরে জোরে একটুকুও আলোর দেখা হাই না, শুধুই আঁধার আর আঁধার, আঁর মনের অনেক ভেতরে এই আঁধার লুকাই আছে, আঁই তো তাড়াইতে হারিয়েন না। হক্বলটাই ভাঙিচুরি হালাইত হইব, নিজের লাই একখান নতুন ঘর বানাইত হইব, একই ঢঙের নতুন ঘর বানাইতে হইব, জমিন থাইকব, গাছগাছালি থাইকব, একটাই বাড়ি থাইকব, একটাই দেশ, একটাই পিথিবী থাইকব, ধম্ম চুলোয় যাক, মানুষ থাক, শুধুই মানুষ থাক। স্বপনটা ভাঙ্গি চায়, দেখি এক চুলও কেউ সরে না, যে তার জায়গায় দাঁড়াই আছে, সাঁকোটা গেছে হুড়মুড় করি ভাঙ্গি, মেঘনার খালটা টইটম্বুর, এপার ওপার আসার কোন নামগন্ধও নাই, উপায়ও নাই।
মারি হালারনি, কে কারে মারি হালার! চুপ চুপ, চুপ থাক হক্বলে, হারা দেশে মারামারি কাঢাকাঢি লাগি বইছে, যে যার ঘরে ঢুকি যাও, ইষ্টনাম জপ কর।
রহমত হালের গরু লই মাঠের দিকে যাইবার আগে দাবনা দেয়। বুঝি হুনি কয়, না, নাবুঝি কয়, ‘কেয়ামতের দিন আইছে, আর কেউ বাঁচাইতে হাইরত ন।’ মাইনষের মরণ আইছে, এ সময়টা কে ঠিক করি দিল, মানুষই ঠিক কইরছে, তা হইলে আর কী, মরণকুয়ায় ঝাঁপ দাও। রক্তের নেশা চাপি বইছে, কেউ আর রক্ষা কইরব, কারও হাতে রামদা,কাতান, কারো হাতে ছুরি, ভোজালি, কারও হাতে হেঁসো, কোতল কইরত হাইরলে, গলা নামাই দিতে হারলেই ধম্মের বড়াই। কোন শহরে কার কত মইরছে ওই নি তো আঙ্গ মাথা ব্যথা নেই। চল যাই মা বোনদের ইজ্জত লুটি, মৌলভির কাছে লই চল, ধম্ম পাল্টাই ওগো মাইয়া বিয়া করুম,বাড়িঘর লুটি, দোয়ান লুটি, ওগোরে তাড়াই ছাড়ি পাকিস্তান গড়ুম, আহা কী সুখ কী সুখ, আঙ্গ ধম্মের নিজের একখানা দেশ হইব। দেখিব ওরা এই দেশে কেমনে থায়। ‘বুইঝলেন না জেঠি, রক্তের নেশায় ওরা উন্মাদ হই গেছে, কানাঘুষায় কত কতা হুইনতেছি, কিচ্ছু ভয় কইরবেন না। আমরা আছি তো।’ ধম্ম ধম্ম করি দেশের লোক উচ্ছন্নে যাইব। হুইনতেছি আঙ্গ বাড়ি তুন মাইল দশেক দূরে মাইয়াগুলারে ঘর তুন বার করি আনি ইজ্জত লুইটছে, বিয়া করি নাম হাইলাইটস দিছে। কী যে কইরত চায় কিছুই বুঝি না। কেউ কেউ ধান পাট ক্ষেতের আলু ধরি ধরি কোমর সমান জল ডিঙ্গাই রাইতের বেলায় আঙ্গ গ্ৰামে ফ্লাইং আইছে। শরিলের যা কাহিল অবস্থা আর চেয়ারা হইছে, না দেইখলে বিশ্বাস কইরতে হাইরত ন। আঙ্গ গ্ৰামের মোসলমান হাড়ার আনোয়ার ফজলুল জিয়াদ ওসমানরাই রাতদিন পালা করি হায়ারা দিছে। ‘আঙ্গ গ্ৰামে ঢুকি আমনেদের ছুঁই দেখুক না আল্লার কীরা আঙ্গ তুন খারাপ মানুষ হইতন কেউ। পাকিস্তান ইন্ডিয়া লই আঙ্গ কাম নাই। রক্ত ঝরাইতে আইলে কেউ ফেরত যাইত ন। এই দেশটা আমনেদেরও, রান কিয়ের লাই,কন্নাই আর যাইবেন।’ ওগো এত কথা হুনিও অনেকে বিশ্বাস কইরত হারেন ন। হক্বল ঘরের এগ্গা দুগা যুবক হোলাপাইন দেশ ছাড়নের লাগি হোটলাহুটলি বাঁধা আরম্ভ করি দিল। আঁই কইলাম কইলকাতা যাই খামু কি, থায়নের জায়গা হাইয়ুম কন্নাই। কেউ আঁর কথা বিশ্বাস কইরল, কেউ করে ন। ভরসা যে কইরব তেমন অবস্থা কি আর আছে? ওপারের তুন দিল্লী কইলকাতার বাবুরা আওনের পর গোলমাল কিছুদিনের লাই থাইমল বটে, ওরাও চলি গেল আঙ্গ অবস্থা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরে হড়ি থাইকল।
পাকিস্তান হিন্দুস্তান কেন হইল, এর উত্তর আঁই দিতি হাইরতাইন, কারা দিতি হাইরব, হেইঢাও আঁই কইতাম হাইরতামন। তবে দিল্লির দরবার তুন কথাগাইন ভাইসতে ভাইসতে চলি আয় আঙ্গ দরজায় আই ধাক্বা মাইরল। ভাইবলাইম এ আবার কীয়ের দশা, শনির দশা! রাহু আই একদিন আঙ্গরে আসি গ্ৰাস করি হালার। শিক্ষিত বাবুরা কি একবারের লাইও খবর রার, এই পোড়াকপাইলা মাইনষের দিন কাইটছে ক্যামন করের, নেংটি ইঁদুরের মতো আমরা যে মরার ভয়ে এক কলসি যন্তন্না লই দিন গুজরান করিয়ের একবারও কি জিগাইছে আঙ্গ দেশ কোনঢা। দলে দলে লোক গা-গঞ্জ ছাড়ি হাঁঢি হাঁচি চলি মাইয়ের, গাড়িঘোড়া কপালে জুইটব কিনা কে জানে। হাঁসের তো হাঁঢের। মুফতি মাইয়াগুন টানি লই মাইয়ের রাস্তার মধ্যিখান তুন। হাত জোড় করি পায়ে পইড়লেও রেহায় হায়ের না, ওরা ছিঁড়ি ছিঁড়ি খাইব, খাইব। বেশি কথা কইলে কল্লা দুই ভাগ করি দিয়ের। তবুও কি থামের, দলে দলে লোক যার তো যার। বুক ভরি রোদন, নিজের জন্মভূমি ছাড়ি চলি যাইত হর চিরজীবনের লাগি। এমন দৃশ্য কী মানি লওন যায়! কেউ যাইবার আগে শেষবারের মতো বাড়ির সামনের বাস্তব গাছের গোড়ায় যাই মাথা ঠেকায়। বছরের পর বছর ধরি কত পূজা আচ্চা কইরছে, কত মানত কইরছে রোগের তুন ভালা থাওনের লাই, সুখে শান্তিতে থাওনের লাই, গোবরের জল ছিটাই লেপাপোছা কইরছে, কত বিয়াসাদি, পূজা আচ্চা হইছে এই বাড়িঘরের উঠানে, কত দাপাই দাপাই এই হুইরের জলে সাঁতার কাটছে। কেউ কী জানতে একদিন এমন দশা হইব, সাধের ঘরের মায়া কাটাই চলি যাইত হইব। হায়রে জীবন, তোরে লই এত লীলা খেলা। কেউ এর শোক সামলাইতে হারে ন। বুক হাসি গেলে এক মাইল দুই মাইল যাই হেরত আইছে। কাঁদি কাঁদি কয়, ‘মারি হালাক ওরা, তবু দেশ ছাড়ি কুথায়ও যাইতাম ন।’ হিরি আই ধানের গোলার কাছে আই কিছুক্ষণ দাঁড়াই থায়, দুই দিন আগের কাটা ধানের ছড়াগুলি জড়াই ধরে, গন্ধ শোঁকে। ঘরদুয়ার খানৈর কাছে আই বেবোর হই দাঁড়াই থায়, কিছুক্ষণ চুপ করি তাই ঝরঝর করি কাঁদি হালায়। ঘরটা যাইবার কালে উদোম রাখি চলি গেছিল। ছুটি আই দড়াম করি দরজাটা খুলি ঢুকতেই এক বুক নিঃশ্বাস যেন ঘরের ভেতরে ঢুকি গেল। হিমড়ারা লাইনদি চইয়েয় হায়ার হাশ দিই কেমন সুন্দর এপাশ তুন ওপাশ চলি গেল, যেন নিজের ঘর হামলার। যিয়ানে আমরা ভয়ে ভয়ে মরি ঘর ছাড়তি বাধ্য হই, এগো কোন ভয় বরং নাই। ওগো বোধ হয় কোন ধম্মের বালাই নেই তাই ওগো লেজ গুটাইয়া হালাইবার চিন্তাও নাই। যত মাথাব্যথা চুলওয়ালা মাথা, দাড়ি গোঁফওয়ালা মাইনষের। হেথাগো দল ভারি করা চাই, একটা ভেন্ন দেশ চাই, ভেন্ন ধম্ম চাই, উঁচুনিচু নিয়া লড়াই চাই, রাজা উজির চাই, জবরদস্ত সৈন্নসামন্ত চাই, তাহইলেও কী শান্তি আছে ! মইরবার হড়েও তো সুখের আস্তানা চাই। আঁই খালা ভাবি মরি, হিয়ানে যাই কী লই কাদের লগে যুদ্ধ কইরব। এত যে চাই, একবারও কী ভাবি দেইখছে এর পাওনাগণ্ডার হিসাব কইষব কে ?
আঁর ঘর ছাড়ি যাইতে কিছুতেই মন চাইল না। আঁর স্বামী রাতের অন্ধকারে লুকাই বাড়ি আইছে শহর তুন। বুকটা ধুকপুক করের যে আঁর বুঝতে দেরি লাগেনি ন। কী হইছে, এরকম করেন ক্যান? বইয়েন আগে, জল খাই ঠাণ্ডা হন। হোন, দেশকালের অবস্থাখান ভালা ন। শহর তুন অশ্রসশ্র লই উগ্ৰ ধর্মান্ধ লোকগুলা হুইনলাম গ্ৰামে ঢুইকব। কী কইরতাম কও। কারো হাত কাঢি ফালাইছে, রামদার এক কোপে ধড় নামাই দিছে। ‘হক্বলে ঘর বাড়ি ছাড়ি চলি গেলেও মিটার টানে হেরত চলি আইছে। আঁর যাইবার ইচ্ছা নাই। আঙ্গ মোসলমান হাড়ার যোয়ান হোলাদের এক দল আই কই গেছে, ‘আঙ্গ জান থাইকতে কেউ আমনেগো পাড়ায় ঢুইকত হাইরত ন। আমরাও দেখি নিমু, তেমন দরকার হইড়লে ঠ্যাং কাঢি হালাই দিমু। আঙ্গ আপদ বিপদে আমনেগ তুন কত সাহায্য হাইছি ছোট তুন, সে সকল কতা কী ভুলিতে পারি! আমরা হইলাম ঘরের লোক, ওরা বাইরের লোক, একবার ঢুকি দেখুক, তবে না বুইঝব।’ ‘আমনে আঁর উপর বিশ্বাস রায়েন, হক্বল কিছু ঠাণ্ডা হই যাইব, ফের শান্তি আইব, এরমভাবে চইলতে হারে নি কখনও! নদীর জোয়ার ভাটার মতো সময়টা হালটি যাইব। ‘ তোঁর মনে সূরা বল আছে। তুমি হইলা বাপের বেটি। সাধে নি তোমারে গ্ৰাম শুদ্ধ লোক মানে।’ এসকল কতা কই আমনে লজ্জ্বা দেন ক্যান, লোকে হুইনলে কী কইব। আমনে বরঞ্চ আইনের মানুষ। দূর দূর গ্ৰামের তুন আই আমনের পরামর্শ লয়। আমনে হইলেন চার পাঁচ মাইলের মধ্যে পড়ালেখা জানা লোক। ফাষ্ট ডিভিসনে তিনটা লেটার নিই পাশ, আঁই হলাম ক অক্ষর গোমাংস। আমনে আঁর প্রশংসা করেছেন। ‘কইরব না আবার, তোমার হাতের লেখা খান মুক্তার মতো ঝকঝকে, তোমার মতো বুদ্ধি করি ঘর সংসার সামলাইতে কয়জন জানে। এত ঢঙের এত রঙের কাঁথা সিলাই কর, ডিজাইন করা, চোখ হিরান রায় না।’ চুপ করেন চাই। এখন ভাবেন গ্ৰামের মানুষগুনেরে কেমনে বাঁচাইবেন।
হুইনতি হাইলাম দেশটা শেষমেশ দুইভাগ হইই গেল। লোকজন বলাবলি কইরল দেশ নাকি স্বাধীন হইছে। স্বাধীনতার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না। আসলে আমরা গ্ৰামের মানুষ, এইসবের আমরা কিইবা বুইঝব, এইসবের কি দরকার বুইঝতেই তো হারালাম না। কেউ কেউ আসি বইলল, দেশটার নামও কি পাল্টাই গেছে। দুই দেশ নাকি হইছে। ভারত আর পাকিস্তান। এই দেশের নাম নাকি পূর্ব পাকিস্তান। বড় আশ্চর্যের কতা। আর এক অংশের নাম হইল পশ্চিম পাকিস্তান। তাই হইলে তিনটা দেশ হইল, দুইটা দেশ হইল কেমন করি। আবার ওরা নাকি আমাদের শাসন কইরব। এইঢা কইরে সম্ভব হইল! মনের মধ্যে খচখচানি রইয়েই গেল। আঁর স্বামীর কথায় বুঝলাম আঙ্গ ছোট্ট মাথার কাম না এটা বোঝা, বড় বড় মাথাওয়ালা নেতারা রইছে না, ওদের মাথায় কত বুদ্ধি। একটা কথা কিছুতেই বুঝি উঠতি হাইরলাম না, আঙ্গ ভাগ্য ওরা ঠিক কইরব ওরা, অথচ একবারও আঙ্গরে জিগাইল না। ভাগটা আসলে কোথায় হইল! আঙ্গ তো সেই ঘর, সেই বাড়ি, সেই গ্ৰাম, আঙ্গ গ্ৰাম তুন দশ মাইল, কুড়ি মাইল, একশ, দুইশ, পাঁচশ, তাহইলে ভাগটা ঠিক কোন জায়গায় হইল! কোন গাছ, কোন রাস্তা, কোন জমিন, কোন নদী, কোন রেললাইন, আঁই কী পাগল হই গেছি না কী অন্যরা? একবার সুযোগ হাইলে জিগাইতাম এই ভাগের কী কোন দরকার ছিল? লোকজনের এত উল্লাশই বা কিয়ের লাগি? এত পুলক জাইগল কেন? হিন্দুরা বেশি করে হিন্দু হইছে, আর মুসলমানরা বেশি করি মুসলমান হইছে, এই আনন্দে ? আঁর কয়দিন ধরে মনে হতি লাগিল, মানুষ তো আগে ছিল কাছাকাছি, অমানুষ হইছে বলে দূরে চলি গেল! তাইলে বোধহয় এটাই এখনকার বুদ্ধিমান মাইনষের ধর্ম! তাই হইব হয়তো! বর্বর হওয়াও একটা ধর্ম, না হ গলে দেশটা এমন করি ভাগ হয়! আঁই তো মূর্খ মাইয়া, মনে হইল, দেশটি ভাঙ্গি আরও টুকরো টাকলা হইব। অত দূর তুন কোনদিন দেশ চালানো যায়! আঁর স্বামী কুড়ি পঁচিশ মাইল দূরে শহরে রায়, তাইতেই আঁর কেমন খালি খালি লাগের, সংসারটা আরও কাছাকাছি থাইকলে কী ভালাই না লাগত, ঠিকঠাক চইলত আর কি।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)