পাবক উপাধ্যায়
চতুর্থ পর্ব
ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের দেশে
হেমকুণ্ডের বরফগলা জলে গোটা দশেক ডুব দেওয়াতে সাঙ্ঘাতিক কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। সেকারণে একদিনে দুটো ট্রেক করার মনোবাঞ্ছা ত্যাগ করতে হল। তবে, হেমকুণ্ড সেরে একদিনেই ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ট্রেক করা সম্ভব। আমার সাথে যাঁরা রাত্রে হেমকুণ্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই গুরুদ্বারের পূজো সেরে সকাল সকাল নীচে নেমে ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের দিকে রওনা হয়েছেন। সম্ভবতঃ সন্ধ্যের মধ্যেই তাঁরা ফিরে আসবেন। ঘাঙারিয়া থেকে উত্তরের দিকে দুদিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে- বাঁদিকের টা ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স এবং ডানদিকের টা সোজা ওপরে উঠে গেছে হেমকুণ্ড সাহেব। ঘাঙারিয়া থেকে ৫কিমি দূরে ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স। যেখান থেকে ভ্যালির রাস্তা শুরু হয়েছে তা থেকে প্রায় ৭ কিমি জুড়ে ভ্যালির সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে আছে রংবেরংয়ের সুন্দর সুন্দর হরেকরকম ফুলে। গায়ে এত জ্বর নিয়ে আমার যাওয়া উচিত হবে না ভেবে দুপুর-বিকালের দিকে নেমে এক নিঃশ্বাসে গুরুদ্বারার আশ্রয়গৃহে পৌঁছালাম। কোনো মতে কাঁপতে কাঁপতে ফ্রেশ হয়ে একটু গরম চা খেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম কিছুতেই আসছে না। কাঁপুনি বাড়ছে। সঙ্গে মেডিসিন ছিল। দু একটা বিস্কিট খেয়ে একটা প্যান ফর্টি, একটা পি ৬৫০ আর একটা মন্টিকোপ-এ ট্যাবলেট খেয়ে আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙতে দেখি বাকি শরণার্থীরা খেয়েদেয়ে নাক ডাকাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে কেঊ কেঊ ফোন ঘাটছে, কেউ বা আবার ফোন করে পরিবারের বাকিরা যাঁরা আসতে পারেননি তাঁদেরকে হেমকুণ্ড অভিযানের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যে ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ঘুরে এসেছে, হেমকুণ্ড সাহেব ট্রেকের পরিকল্পনা করছে। ফোনটা অন করে দেখি ঘড়িতে তখন রাত নটা তেইশ। ততক্ষণে গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেছে। খিদেই পেট চোঁ চোঁ করছে। ভালো রকমের আহার দরকার। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে তখনও। ছাতাটা নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখি বেশিরভাগ ধাবা ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। পাহাড়ের জীবন এক্কেবারে অন্যরকম। পাহাড়ে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যায় আর অনেক কাকভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সূর্য্যিমামা জাগার অনেক আগেই প্রায় সকলেই জেগে যায়। পাখিরাও খুব ভোরে ভোরে নিজেদের গলার রেওয়াজ শুরু করে দেয়। ওদের মধ্যে কেউ কেউ আবার খুভ ভোরেই একে অপরের সাথে ঝগড়াঝটি আরম্ভ করে দেয়, কেউ আবার ভোরেই প্রেমালাপ শুরু করে দেয়, কেউ বা নতুন নতুন বন্ধু পাতায়। সত্যিই সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। শহরে বাবুরা এই অপার আনন্দের কিই বা বুঝবে। যাদের ৮ টা বা ৯ টা না বাজলে ঘুম ভাঙে না তারা এই সুন্দর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হবে কী করে।
মিনিট দশ-পনেরো এদিক ওদিক করে যখন তেমন কিছু পেলাম না, তখন অগত্যা গুরুদ্বারার সামনের রেস্তোরাঁ থেকে গরম গরম কেশর মালাই দুধ, গোটাকয়েক গোলাপজাম আর রাবড়ী দিয়েই রাত্রভোজন সেরে নিলাম। পেটে খাবার পড়তেই চোখ ঘুমে ঢুলে এল। এবার একটা লম্বা ঘুমের দরকার। গুরুদ্বারের মন্দিরের ভেতরটা তখন ফাঁকা কেবল দু একজন একমনে ধ্যান-আসনে বসে আছেন। আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। এর আগে যতবার ভেতরে যাবার চেষ্টা করেছি অসম্ভব রকমের ভীড় ছিল। এখন একেবারে ফাঁকা। চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে নানারকম সুগন্ধাদি দ্রব্যের সৌরভে বাতাস ভরে আছে। সামনে একটা সমাধি বানানো সেটাই গুরু গোবিন্দ সিং এর বেদী। মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে তাঁর অমৃতবাণী, শৈশব, কৈশর ও যৌবনের কতকগুলি চিত্র, শিখ ধর্মের মূল্যবান কিছু গ্রন্থাদি প্রদর্শন করা। ভিতরে প্রবেশ করতেই পরম শান্তি অনুভব করলাম। সে এক অকল্পনীয় শান্তি। সে শান্তি যে কেবল নিস্তব্ধতাময় শান্তি তা ঠিক নয়; সে যেন এক সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ অনুভূতি, সে যেন এক চাওয়া-পাওয়া বিযুক্ত শান্তি, সে এমনি শান্তির অনুভূতি যে শান্তি প্রতিটি মানুষের কাম্য, সে যেন এক বিশ্বজাগতিক শান্তি। মন্দিরের ভেতরে এতকিছুর মধ্যেও যেন কিছুই নেই, সবকিছু থেকেও না থাকার অনুভব হচ্ছে। বোধহয় বাকিরাও এমনই অনুভব করছেন। গুরু গোবিন্দ সিং এর মূর্তিতে প্রণাম করে আসনে বসলাম। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে তা ঠিক মনে নেই। মন্দির থেকে যখন বাইরে বেরিয়ে আসলাম তখন শুধু অলৌকিক অপারজাগতিক স্বজ্ঞাবোধের কিছু সংস্কার উদ্বুদ্ধ হচ্ছিল। অনেক রাত হয়েছে। পরের দিন ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের উদ্দেশ্য রওনা দিতে হবে। সুতরাং বেশি রাত না করে নিদ্রামগ্ন হওয়ায় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভ্যালির উচ্চতা প্রায় ৩৬৫৮ মিটার। চমোলী জেলার পশ্চিম হিমালয়ের ভ্যুন্দর উপত্যকার এবং পুষ্পবতী নদীগর্ভের প্রায় ৮৭.৫০ স্কোয়ার কিমি স্থান জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে এই ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ন্যশনাল পার্ক। দৈর্ঘ্যে ৮ থেকে ৯ কিমি এবং প্রস্থে ২ থেকে ২.৫ কিমি বিস্তৃত। ১৯৩১ সালে তিনজন ব্রিটিশ পর্বত আরোহী নিয়ে ফ্রাঙ্ক এস. স্মাইথ, এরিক শিপ্টন এবং আর. এল. হোল্ডস্ওর্থ এই পথেই পাড়ি দিয়েছিলেন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অবিভূত হয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে এই স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং পরে স্থানটিকে “ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স” নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তীকালে ‘ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স’ স্থানটিকে জাতীয় উদ্যানরূপে ঘোষণা করা হয় ১৯৮২ সালে। “এটি এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট” নামে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছে। অসংখ্যা ছোটোবড় ঝরনা আর দু একটা রূপোলী সাদা হিমবাহ চাদরের মতো জড়িয়ে রেখেছি ভ্যালিকে। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস একসময়ে এই ভ্যালিতে পরীরা বাস করতেন। তাঁরা এখনও বলে থাকেন যে, কেউ একবার ভ্যালিতে গেলে আর ফিরে আসে না; পরীদের দ্বারা বন্দী হয়ে যায়।
ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্কে কম করে ৭০০ থেকে হাজার প্রজাতির ফুল ফুটে থাকে। প্রাকৃতিক উপায়েই সৃষ্ট তারা। বছরের কেবল কয়েকসপ্তাহেই তারা ঝরে যায়। মূলতঃ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ফুলেদের দেখা পাওয়া যায়। সেসময় সমস্ত ভ্যালি আসম্ভব সুন্দর বিচিত্র লাখো লাখো কোটি কোটি ফুলে ভরে থাকে। এই সৌন্দার্য পৃথিবীর অন্য কোথাও কেউ পাবে না। এই স্থানকে ওয়ার্ল্ড অফ্ ফ্লাওয়ার্স বললেও ভুল বলা হবে না। এখানে Blue Poppy, Doggy face flowers, Thyme, Cheerful Senecio, Cinquefoil, Cosmos flaunts, Wild Rose, Cobra Lilly, Brahma Kamal, Lax Willowherb, Bog Star, Inula Grandiflora Grey stem spirea, Himalayan knotweed, Erigeron (sunflowers type) ইত্যাদি হাজার হাজার ফুলের সমাবেষ দেখতে পাওয়া যায়। কেবল কয়েক দিনের জীবনশৈলী নিয়ে তারা আবির্ভূত হয় এই ধরণীতে।
একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলাম পরের দিন। তেমন কোনো তাড়াহুড়োর দরকার নেই। কারণ, ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের পথ শুনেছি তেমন দুর্গম নয়। তেমন চড়াই-উতরাইও পাওয়া যাবে না বোধহয়। সকাল ৬টাই বিছানা ছাড়লাম। বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে স্নানাদি ক্রিয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম তৎক্ষণাৎ। সঙ্গে ডার্ক চকোলেট আর ড্রাই খাবার তো আছেই। ঘাঙারিয়া থেকে যাত্রা শুরু হয়ে গেল ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্কের দিকে। ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শনের জন্য টিকিট মূল্য ১৫০ টাকা। প্রবেশের পথেই লম্বা ভিড় দেখে শঙ্কা হল ঠিক টাইমে ফিরতে পারবো কি না। হাজারে হাজারে মানুষ চলেছে ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের শহরে। বিশ ত্রিশ মিনিট লাইন অতিক্রম করে টিকিট সংগ্রহ করে যাত্রা শুরু করলাম। প্রবেশদ্বার থেকেই রকমারি অপূর্ব সুন্দর ফুলেদের ভিড় শুরু হয়ে গেল। প্রবেশের মুখে এবড়োখেবড়ো পাথরের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে ভ্যালির দিকে।
ব্লু পপি থেকে শুরু করে বগ স্টার ইত্যাদি ফুলেদের হাট চারিদিকে। মৃদুমন্দ বাতাসে তারা আন্দোলিত হচ্ছে। হাওয়ার সুরের ছন্দে নিঃশব্দে তারা গান গেয়ে নেচে চলেছে। কি অপরূপ দৃশ্য, কি আবেগী সে নৃত্য। এমনকি পিচ্চি সাইজের ফুলগুলোর শোভা এতই আকর্ষণীয় ছিল যে দুদণ্ড তাঁদের না দেখে পথ অতিক্রম করলে মনে হচ্ছিল বিশাল কিছু মিস করে যাচ্ছি। মনক্যামেরাতে বন্দী করে চলেছি একের পর এক ফুলগুলোকে। মোহান্বীত হয়ে যেন তাঁদের পিছনেই ধেয়ে চলেছি। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে একটা টিমের সঙ্গী হয়ে গেছিলাম কিন্তু ভ্যালির সৌন্দর্যে এতই অবিভূত হয়ে পড়েছিলাম, কখন যে তারা এগিয়ে গেছে তাঁর কিছুটি টের পাই নি। পথে অবশ্যি বন্ধুর অভাব হয় নি। নেদারল্যাণ্ড থেকে আগত একটি টিমের সাথেও পরিচয় হয়। তারা কেবল ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সেই জন্যই সুদূর পথ অতিক্রম করে এসেছে। আমার তোলা ছবিতে তারা মুগ্ধ হয়ে আমাকে তাঁদের টিমের সঙ্গী করে নিল। ময়ূখ নামের একটি ভারতীয় যুবক, সেও অবশ্যি নেদারল্যাণ্ডেই থাকে, তার সাথে গভীর সখ্যতাও হয়ে যায় খুব অল্পসময়য়েই। কিন্তু যতই ছবি তুলি না কেন ছবি তোলা আর শেষ হয় না তাঁদের। “Sir please take a photo of mine.”, “this side once more……….” ছবিগোলো এত সুন্দর এতই চোখে লাগার মত ছিল যে একটা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললেই প্রত্যেককেই ঐ একই স্থান থেকে ছবি তুলতে হচ্ছিল। তবে আমি ফোটোগ্রাফার হিসাবে একেবারেই খারাপ নয়। আমার ক্ষুদ্র ফোনেই এত সুন্দর ছবি তুলি যে কেউ দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবেনা যে সেগুলি ফোনক্যামেরাতে তোলা। মজার বিষয় হল তাঁদের মধ্যে থেকে ময়ূখ নামক যুবকটির আই ফোন ফোর্টিন প্রো ছিল। কিন্তু তবু ও সে আমার কাছে এসে বার বার জিজ্ঞেস করছিল কিভাবে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললে ছবি সুন্দর হয়। আমি তাঁকে ছবি এবং ছবি তোলা সম্পর্কে যা জানতাম রীতিমতো বিশ্লেষণ করতে থাকলাম। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক অতিক্রান্ত হল। বেশ বিরক্ত বোধ করতে থাকলাম এবার। পরীর দেশে এসে ছবি নিয়ে এত মাতামাতি করলে ভ্যালির অপরূপ মাধূর্য উপভোগ করবো কখন। আমি তাঁদের বললাম, “Guys you people carry on. I shall join you later. I’m going ahead, please excuse me.” ময়ূখ বলল “Sure Bro. You please. But you must send me all the photos you would capture.” আমি প্রত্যুত্তরে বিদায় জানিয়ে বললাম “Definitely. I will. See you later.”
সদ্য গড়ে ওঠা বন্ধুবর্গকে পিছনে রেখে ভ্যালির দিকে যাত্রা শুরু করলাম অবশেষে। সামনে বিরাট এক ঝরনা। ঝরনার জল যেন হুড়মুড়িয়ে ছুটে পড়ছে মাটিতে। এত স্বচ্ছ, এত ক্রিস্টাল ক্লিয়ার মনে হচ্ছিল যেন অগোচরে কেউ স্বচ্ছ-শুভ্র কাঁচের পাতগুলোকে ছুঁড়ে ফেলছে নীচের দিকে। সেগুলোই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে আলোকবিন্দুর ন্যায়। এমন লাবণ্যময় দৃশ্য দেখে যে কেউ মোহান্বিত না হয়ে থাকতে পারবে না। দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। যেন এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে বেঁধে রেখেছে, ঘাড় ঘোরাতে দিচ্ছে না। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে তার হিসাব নেই। মোহের তন্দ্রা ছোটে একটা আওয়াজে— “পাঁ জী আগে চলিয়ে। আগে ভি সান্দার নজারা মিলেগা।” দর্শনার্থীদের মধ্যে থেকে কেউ আমাকে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সম্ভবত এমন মন্তব্য করে চলে গেলেন। একটু এগিয়ে যেতেই একটা অতিব সুন্দর লোহার সেতু চোখে পড়ল। সেতু অতিক্রম করেই ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের দেশে পৌঁছাতে হবে। সেতুটির নীচে প্রবাহিত হয়েছে ভ্যুন্দর গঙ্গা যেটি ঘাঙারিয়ার কাছে পুষ্পবতী নদীর সাথে মীলিত হয়ে লক্ষণ গঙ্গা নাম ধারণ করে বয়ে গেছে গোবিন্দঘাটের দিকে। সেতুটি অতিক্রম করে জঙ্গলের পথে প্রবেশ করলাম। সামনের পথ খুব চড়াই-উতরাই। বড়ো বড়ো করে হিন্দি হরফে লেখা ছিল “আগে সে রাস্তা চড়াই হ্যায়।” পরবর্তী দু থেকে প্রায় তিন কিমি রাস্তা এমন চড়াই। একজন স্থানীয়কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে রাস্তা নদীর তীর বরাবরই ছিল, সে রাস্তা এত চড়াই-উৎরাই ছিল না, বিগত বছর ল্যাণ্ডস্লাইড হওয়ার কারণে সে রাস্তা এখন বন্ধ। কয়েক মাস ধরে নতুন রাস্তা বানানো হচ্ছে এবং সমস্ত দর্শনার্থী সেই পথেই চলেছে। পাথরগুলো ভালো করে আঁকড়ে বসেনি তখনও। একটু ভুল হলেই গড়িয়ে যেতে হবে গভীর খাতে। পরবর্তী কয়েক কিমি খুবই সচেতনতার সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। কিছু আগেই স্থানীয় পিটঠুদের একজন বলে গেল কয়েক দিন আগেই বনদপ্তরের কর্মীরা চীতা, হায়না আর একটা বাঘ ছেড়ে গেছে ঐ জঙ্গলে। গা ছম ছম করছে। কেমন একটা অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ফীল হচ্ছে। মনে মনে চাইছি কোনো একটা বন্য প্রণীর দেখা পেতে। কিন্তু নিরাশ হতে হল। একটু এগিয়ে যেতেই লক্ষ্য করলাম এক অদ্ভুদ তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। আমার খুবই কাছে থেকে আওয়াজ ভেসে আসছিল, খুব সম্ভবত কোনো পাখির আওয়াজ টাওয়াজ হবে হয়তো। আশেপাশে, সামনে-পিছনে হন্যে হয়ে খুঁজলাম। কিন্তু না, কোনো পাখী তো দূরের কথা, কিছুই চোখে পড়ল না। হতাশ হয়ে বসে পড়লাম রাস্তার একপাশের পাথরের ওপর।
ব্যাগ থেকে ড্রাই ফ্রুট আর ডার্ক চকোলেট বের করে খেয়ে নিলাম। দু মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার পথচলা শুরু হয়ে গেল। দুপাশে অতীব সুন্দর ছোট বড়ো ফুলের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি। পৃথিবীতে এত সুন্দর সুন্দর ফুলও যে হয় তা ভ্যালিতে না আসলে বিশ্বাস হত না। এত বিচিত্র ফুলের হাট বসেছে। এ যেন পরীর দেশে চলে আসলাম। যতদূর চোখ যায় শুধু চারিদিকে ফুল আর ফুল, হাজার হাজার রংবেরঙ্গের ফুলে ছেয়ে আছে সর্বত্র ভ্যালি। এদের একটিও আগে কখনো দেখিনি। কোনো কোনো ফুলের সাথে সদৃশ কোনো ফুল দেখে থাকলেও ভ্যালিতে যে ফুল গুলো কয়েক দিনের জন্য ফোটে সেগুলো পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে তো মনে হয় না।
কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম সেরে পাশের ঝরনা থেকে মন ভরে জলপান করে নিলাম। যাত্রা শুরু হল আবার। ভ্যালিতে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ছে। পাশাপাশি দুজন যাওয়া যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। দূরে থেকে মনে হচ্ছে সামনের দিকে একটা জায়গা লোকজমায়েত হয়েছে। কাছে যেতেই দেখতে পেলাম একদল লোক হুমড়ি খেয়ে নীচে একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব সম্ভবত কিছু একটা পড়ে গিয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম স্থানীয় পিটটু একজন ভদ্রমহিলাকে কাঁধে করে ওপরে তুলে নিয়ে আসছে। ভদ্রমহিলাকে দেখে বুঝলাম বাঙালী। সপরিবারে ভ্যালি দেখতে এসেছিলেন ওঁরা। আলগা পাথরে পিছলে পড়ে খাতের দিকে গড়িয়ে পড়েছিলেন। নীচে একটা গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আটকে গেছিলেন বলে রেহাই। নয়তো বেঘোরে প্রাণ হারাতে হত। ভালো রকম আহত হয়েছেন তিনি। সর্বাঙ্গে তাঁর ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে। কয়েকজন মিলে হাতাহাতি করে টেনে তুললেন তাঁকে। আমার ব্যাগে ভলিনি স্প্রে ছিল দিয়ে দিলাম এবং তাঁকে রেস্ট নিতে বললে ভ্যালির দিকে এগিয়ে গেলাম।
ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের যাত্রাপথে বহু বাঙালীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। নানা কথোপোকথনের মাধ্যমে জানতে পারি যে কেউ জীবনের শেষ ইচ্ছে পূরণের লক্ষ্যে এসেছে এই ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের দেশে। তাছাড়া কোলকাতা থেকে আগত বেশ কয়েকটি টিমের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিচয় হয়ে যায়। এক অন্যরকম অনুভূতির সাক্ষী হয়ে থেকে যায় ভ্যালির উদ্দেশ্যে যাত্রা। হয়তো কিছুদিন পর ব্যস্ত শহরে নিমজ্জিত হয়ে যাবো, কাজের প্রেসার মাথার ওপরে আসবে, অথবা হয়তো নতুন কোনো স্থানে নতুন কোনো ভ্রমণের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ হবে, কিন্তু ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্সের সৌন্দার্য চির জীবন অন্তরে থেকে যাবে, থেকে যাবে হৃদয়ের মণিকোঠায়, থেকে যাবে মনের গহিনে।
ঘণ্টাখানেক এভাবে ওপরের দিকে উঠতে থাকি, কখনো পাথরের মধ্যে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করতে হয়, তো কখনো অচেনা অজানা গাছের মধ্যে দিয়ে রাস্তা বানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছিল। বেশখানিকটা পথ অতিক্রান্ত হবার পর রাস্তা নীচের দিকে ধাবিত হয়ে গেছে। পাহাড়ে নীচে নামাটা শারীরিক দিক দিয়ে তেমন কষ্টকর না হলে ও হাঁটু বা গোড়ালি ক্রাকের সম্ভবনা প্রবল। খুব সন্তর্পনে না নামলে যেকোনো মুহূর্তেই পা খোইয়াতে হবে। ধীরে ধীরে পা মেপে রাস্তা অতিক্রম করে অবশেষে ভ্যালিতে পৌছালাম। চারিদিকে লাখো লাখো লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা ফুলের মেলা বসেছে। মৌমাছি থেকে শয়ে শয়ে প্রজাপতির দল ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে চলেছে। তাদের আর কোনো অভাব নেই। যেফুলে ইচ্ছা সেই ফুলেই মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য, চোখ জুড়িয়ে গেল। এত প্রজাপতি একসাথে জীবনে কখনো দেখিনি। নাকে এক অপরিচিত গন্ধ অনুভব করলাম। খুব সম্ভবত বিচিত্র ফুলের বিচিত্র শোভা একসাথে মিশে গিয়ে এই অদ্ভুত রকমের সুঘ্রাণের সৃষ্টি করেছে মনে মনে বললাম-
তুঝে জিতনা তারীফ করু বহ ভী কম পড় যায়ে
চাঁদনী কী খুব সুরতী ভী তেরে পাস ফীকে হো যায়ে…
সমাপ্ত