নীলাদ্রি পাল
লেখক পরিচিতি
(বাবার বদলির চাকরির সুবাদে স্কুল, কলেজ মিলিয়ে মোট দশ জায়গা ঘুরে পড়াশোনা। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণিতে এক সঙ্গে দুটো স্কুলে পড়াশোনা। কলকাতায় থাকাকালীন স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে এবং বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায় থাকাকালীন ওখানকার এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুই স্কুল থেকেই বার্ষিক পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ন হয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে প্রবেশ। পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম পর্বের পরীক্ষা দেওয়ার পর স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রধান শিক্ষকের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ট্র্যান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে ভর্তি। একবছরের কিছু বেশি ওই স্কুলে পড়াশোনার পর আবার কলকাতায় এসে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পড়াশোনা করতে করতে মালদা জেলার ললিত মোহন শ্যাম মোহিনী বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করে মালদা জিলা স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে সাত মাস আট দিন ক্লাস করে আবার কলকাতায় ফিরে শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজে এসে ভর্তি। সেখান থেকেই একেবারে স্নাতক হয়ে সাংবাদিকতা এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবকল্যাণ দপ্তরের অধীন অ্যাকাডেমি সুবার্বিয়া থেকে ফটোগ্রাফি পাশ করে সাংবাদিকতা এবং চিত্র সাংবাদিকতায় প্রবেশ। আনন্দবাজার পত্রিকা, সংবাদ প্রতিদিন, সাপ্তাহিক বর্তমান, তথ্যকেন্দ্র সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং ম্যাগাজিনে সাংবাদিকতা ও চিত্র সাংবাদিকতায় ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাওয়া।)
পর্ব – এগারো
রায় লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মজুমদার চৌধুরী ১৬৪৯ সালে দেহত্যাগ করেন। হালিশহর থেকে তিনি তাঁর বিশাল জায়গীরের দেখাশোনা করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৬৫০ সাল থেকে ১৭১৬ সাল পর্যন্ত সাবর্ণ জমিদারির প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করা হত নিমতা-বিরাটি থেকে। লক্ষ্মীকান্তর পৌত্র, পঁচিশ তম পুরুষ বিদ্যাধর রায় চৌধুরী তখন জমিদার। তিনি হালিশহরে বসবাস করলেও প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতেন নিমতা-বিরাটি থেকে। জমিদারির কাজ দেখাশোনার জন্য সাবর্ণ পরিবারের অনেকেই হালিশহর থেকে চলে এলেন এই নিমতা-বিরাটি অঞ্চলে। সেখানেই তাঁরা বসবাস শুরু করলেন। আগে থেকেই সেখানে সাবর্ণদের ঘরবাড়ি ছিল।
জোব চার্নক প্রথম ভারতবর্ষে যখন এলেন তখন ১৬৫৫ কি ১৬৫৬ সাল। বয়স তখন তাঁর বাইশ-তেইশ বছর। যে জাহাজে তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন তার মাস্টার রোলে কিন্তু জোব চার্নকের নাম ছিল না। অর্থাৎ তিনি বেআইনি ভাবে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন। ইংরেজ যুবক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কিছু না কিছু কাজ তিনি জোগাড় করে ফেলবেন, সেই আশায় ভারতবর্ষে এসেছিলেন। প্রথমে বেশ কিছু জায়গায় কর্মরত হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নৌসেনা প্রধান হিসেবেও তিনি কর্মরত ছিলেন।
১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে জোব চার্নক যখন পাটনার কুঠিয়াল ছিলেন তখন তিনি দেখলেন কলকাতা বন্দর ও সুতানুটি বন্দর দিয়ে অসংখ্য ইওরোপীয় জাহাজ ব্যবসার উদ্দেশ্যে চলাচল করছে। আর্মেনীয়, পর্তুগিজ, ডাচ ইত্যাদি ইওরোপীয় জাহাজ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে এদেশ থেকে সুতো ইওরোপে নিয়ে যাচ্ছে। এইসব প্রত্যক্ষ করে তিনি ফিরে গেলেন পাটনায়। দু’বছর বাদে অর্থাৎ ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার এলেন। খিদিরপুর এবং খেজুরিতে অবতরণ করে সবকিছু দেখে তিনি আবার ফিরে গেলেন। এখানে কিন্তু তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোনো ব্যবসা বাণিজ্য ছিল না।
এরপর জোব চার্নক হুগলির কুঠিয়াল হন। সেখানে জোব চার্নক বেআইনি কাজকর্মে লিপ্ত হন এবং নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। এইসব ঘটনায় মুঘলরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন। ঝড় জলের দুপুরে মুঘল সৈন্য তাঁকে তাড়া করে। মুঘল সেনার তাড়া খেয়ে কয়েকজনকে নিয়ে কয়েকটি ছিপ নৌকায় দক্ষিণের দিকে অর্থাৎ কলকাতার দিকে পাড়ি দিলেন। বিকেলের দিকে এসে নামলেন সুতানুটির ঘাটে। সেই দিনের তারিখটা ছিল ২৪ অগাস্ট, ১৯৯০।
মুঘল সেনারা যখন দেখল, জোব চার্নক ও তাঁর দলবল সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের জমিদারি অঞ্চলে অবতরণ করেছেন তখন তারা চলে গেল। সাবর্ণ বংশীয় জমিদার বিদ্যাধর রায় চৌধুরীর কাছে জোব চার্নক রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে বিদ্যাধর তাঁর জায়গীরে তাঁকে পুনর্বাসন দিলেন। সাবর্ণ জায়গীরে থাকার সময়ই জোব সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হলেন। সিফিলিস আক্রান্ত রোগী সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। জোবও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না।
সুতানুটির ঘাটে অবতরণের পর মাত্র আঠাশ মাস বাদে ১৬৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি জোব চার্নক মারা যান। জোব চার্নককে নিয়ে কলকাতার প্রতিষ্ঠার যে গল্প জনমানসে প্রচারিত আছে তা একেবারে ভিত্তিহীন। জোব চার্নকের সঙ্গে কলকাতার কোনো সম্পর্কই নেই। কলকাতার অস্তিত্ব আবহমানকাল ধরে। মনসা মঙ্গল কাব্যে কলকাতার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ডব্লিউ পি ১৪৯৪/২০০১ নম্বর কেসে ২০০৩ সালের ১৬ মে মাননীয় কলকাতা হাইকোর্ট রায় দেন কলকাতার কোনো জন্মদিন নেই। জোব চার্নকও কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা বা জনক নন।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)