শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে  তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’  উপন্যাস।)

 মাইয়া মানুষ না পুরুষ মানুষ

             জন্ম কেমনে দিই তোরে

গভ্যযন্তনাটা চাগাড় দি উইঠলে মনের ভেতরে কত কথার জম্ম হয়, কথাখান বুইঝাইতাম হাইরতাম ন, উপলব্ধি কইরলে টের হাওন যায় শরীলের ভিতর আর একখানা শরীর বাড়ের দিনে দিনে।  হ্যাতের কী হ্যাতির পরানটা  হেটের তুন বাইরে আওনের লাই ছটফট করের। আঁই আর কী কইরত হারুম। কেউ কয় ঘরের ভেতরে হায়চারি কর। ডাক্তার বদ্যির কী আর কাম, মাইয়ালোকের প্রসব করানো তো তেনাগ কাম নয়। দশ গ্ৰাম ধরে কাত্যায়নীই ভরসা। খবর দিলে মাঝে মাঝে আই নাড়িচাড়ি দেখে হেটেরটার অবস্থাটা ঠিকঠাক আছেনি। কাত্যায়নী ঠিক মনে হইলে কয়, ‘চিন্তা করার কিচ্ছু নাই, তেনার সৃষ্টি তিনি ঠিক রাইখবেন, অস্থির হইও না বাছা, লক্ষণ দেই মনে হর, হোলা হইব।’ হক্বলে  আঁর ঘরে উঁকিঝুঁকি মারের। আঁর হোলামাইয়ারা তো মনের আনন্দে লাফার তিরিং বিড়িং করি। আঁর জায়েরা দাইয়ের কানে কানে কী যেন শুধায়। কোনো গোপন কথা নাকি যা আঁই হুইনতাম হাইরতাম ন। বিপদের গন্ধ হাইয়ের। হেটের যন্তন্নায় কাবু হই কাতরাইলে নিজেরে এই কতা কই সামলাইতাম, বেটি সবুর কর আর তো মোটে কটা দিন, হরে তো হোলার মুখ দেইখবি, তন সব কষ্ট দূর হই যাইব। দাই  কত কতা কইল, কী খাইয়ুম, কেননে বইয়ুম, কেননে হুইয়ুম, কী রঙের, কী ধরনের কাপড় হরুম, কনডাই হরুম। তবুও ক্যান যে এত কানাকানি, ভয়ে চুপসে যাইলাম যদি ঠিকঠাক জম্ম দিতে না হারি, সকলে মিলি আরে না দুইসব। নিজেরে ঘরের মাঝে একরকম বন্দী করি ফালাইলাম। হক্বলে উপদেশের পর উপদেশ দিল, ‘সাবধানের মার নাই।’ কু্ঁচোটা থাকি থাকি গুঁতো মারে। কি জানি ওর কী চাই, বুইঝতে তো হারি না, নিজের হেটে নিজে হাত বুলাই যদি মা’র আদরটা বুইঝত হারে, অবুঝ মন মানতি চায় না।  বাঁ দিকে কাত হই চোখ বুঝি থাই, শান্তিতে ঘুমাই গেলি নিশ্চিন্তি হই, বেটা আবার গুঁতোয়, দুষ্ট হোলা না হই যায় না, দাই ঠিকই কইছে, মাইয়া হইলে এমন শতান হইত ন। খালি কেন খাই খাই ভাব হর, অন এ এত, তার মা’র হেট তুন বার হইলৈ আর দেইখতে হইত ন। দিদি হাউরি কয়, এই সময় দেবদেবীর স্মরণ ল, বুইঝলি না, মনটা শান্ত হইব। কথাটা যে মন্দ কয় নি, সেটা টের হাইলাম, কুলগুরুর স্মরণ লইলে খালি মনে হয়, উনি সামনে দাঁড়াই আছেন। আগেও আঁর কোলে হোলামাইয়া আইছে, সে তো বছর ছয়েক আগে, হরীলটা তরতাজা ছিল মনে আছে, মনের অবস্থা কেমনে ছিল, দুনিয়ার অবস্থা কেমনে ছিল, বাড়িঘরের অবস্থা কেমনে ছিল, অতশত আর মনে নাই। তবে এই নতুন বউঝিরা লই এখন তেমন ঘর ভর্তি  ছিল না। এই বয়সে মা হওয়া মাগো সামনে শরম শরম লাগে। শেষবার মাইয়া হইছিল, তাতে কে কতটা খুশি হইছিল জানি না, তবে আঁর উনির কী আনন্দ হইছিল সে আঁই বুইঝতে ভুল করি না। এইবারের ব্যাপারখানা যে আলাদা সে কী আর বুঝি না, অসময়ে হোলা জগতের মুখ দেইখবে। দুনিয়াজোড়া বোমা বারুদের খেলা। চারদিকে গা ছমছমে ভাব। ক্ষুধার জ্বালায় মাইনষে জ্বলি পুড়ি মইরছে। কারো কোনও দিকে তাকানোর সময় নাই, মইরল কি বাঁইচল কার কি আই যায়। এই তো গেল মাইনষের কথা, গরুগোতানের খড় খৈল জোটে না। আঁর হোলাখান আইবার লাই কত ছটফটানি কি মানুষের কোলে উইঠব, গাছগাছালির হাওয়া খাইব, কত সখ হোলার। আঁর হরীলের মধ্যে ছোট্ট হরাণঢা খেলা করে। ওর চোখ ফোটের আস্তে আস্তে, ওর ঠোঁট নাড়েড়,মাথার চুল গজার। দাই কয় আঁর গভ্ভে হোলা বাড়ের।  আঁই মানুষটা তা হইলে কী ! মাইয়া মানুষ, আর পুরুষ মাইনষের মেশানো মন লই হাঁটিচলি বেড়ানো আর এক অন্য মানুষ। আঁর হোলা জম্ম দেওয়ার আগের ভাবখানা কাম কইরতেছে কিনা। দাইয়ের কওনের তুন ভাইবতে থাকি আঁই মানুষটা আসলে অন কোন জাতের! আঁর মাইয়াটা আই ঘুরি ঘুরি যার। ইশারা করি কইলাম, কন্নাই যাস, হুনি যা, ভাইরে দেইখবি আয়, এইখানে কান পাত, আদর কর, ইয়ানেই তো নাক ডাকি ঘুমায়। মাইয়াটা আঁর খিল খিল করি হাসে। ভাই হইব হুনি হোলাটা কাছে ঘেষে না, শরম লাগে না হিংসা করে, কে জান!

মা আইছে কতদিন বাদে নাতির সঙ্গে লই। হাঁড়ি পাতিলে মন্ডামিঠাই, নাইরকেলের নাড়ু, তেঁতুলের আচার আমের আচার মুড়ির মোয়া, খইয়ের মোয়া। মারে পেন্নাম করতি গেলে হা সরাই কয়, ‘ কী করছ, কী করছ, তোর হেটে অন ভগবানের বাস, আঁর পাপ হইত না, দুই হোলামাইয়ার মা হইচস, এয়নও আক্বল হয় ন ।’ কত নিয়ম কানুনই না সময়ে সময়ে হাল্টি যায়, তার কোন ইয়ত্তা আছে। মা’র চেহারাখান দেখি বড় কষ্ট হইল, কেমন বুড়া হই গেছে। গালটা ভাঙি গেছে, হরীল চলে না। মাইয়ারে দেইখতে আসা চাই।

হক্বলে আই ঘিরি ধইরছে, পেন্নাম ঠুইকত লাগে। 

‘ আমনে আইছেন খুব ভাল লাগের। আমনের মাইয়া তো খালি মা মা করে।’ ‘তোমরা আছ হক্বলে, আঁর আর চিন্তা কিয়ের লাই।’ ‘ আয়েন মাইয়মা বয়েন, দু’চারখান সুখ দুঃখের কথা কই।’  ঝুলির তুন এক লগে কত শত গল্প ফুরফারাইয়া বাইর হই আইয়ে। ঝাল নোনতা মিষ্টি কত স্বাদ মিলাই লই মা কইতে থাকে। বাপের দেশের কথা হুনি ন তাও তো কম দিন হয় নাই। কত লোক স্বগ্গে গেল, কত লোকেরা ব্যামো হই বিছানা নিল, কত মাইয়া হৌরবাড়ি গেল, কতজন ব্যবসাপাতি করি বড়লোক হইল, কত লোক বিদেশ বিভুঁইয়ে গেল, কত লোকের নাতিপুতি হইল, কত গ্ৰাম ছারখার হইল। যতক্ষণ না থামাই, মা তো গড়গড়িয়ে বইলতেই থাইকবে। জীবনের তুন কত কিছুই না শিখনের আছে, এই কথাখান কার কাছে কই, কারেই বা বোঝাই। আঁই তো জীবনের জম্মই দিতে চলছি, বড্ড ভয় ভয় করের, এমন ভয় কোনো কালেই তো করে নাই। এক ভেন্ন ধরনের অনুভূতি।  পরানটা মচর মচর করের কেন মা, ধুকপুকানি বাড়েড় কেন গো, ভেতরটায় এত আনন্দ হর কেন, খুশির ঝমঝমানি থামাইতে হারিয়েন না কেন ? ‘দূর অ পাগলি সকল কতার কী জবাব হয়, সকল ভাবের ব্যখ্যা গাইন দেওয়া কি এত সহজ, কত কঠিন কঠিন আনন্দের ব্যথার সামাল দিতি হয়। যত দিন যাইব, তত বুইঝবি, হক্বল সময়ের সমান ওলটপালট হয় না, কোনটা সোজা, কোনটা বেঁকা, কোনটা মনের আধেক জায়গায় যাই পৌঁছায়, কোনটা আরও গভীরে। কর্তব্যের আড়ালে চাপা হড়ি যায়, আবার কোনটা জাগি ওঠে হঠাৎ হঠাৎ, টেরই তো হাওন যায় না।’ মা আমনে এত কতা শিখলেন কেমনে? ‘ তুইও শিখি যাবি পঞ্চমী, মাইনষের জম্ম দিতি আছস, কতার জম্ম দিতি হাইরতি ন, এ ক্যামন কতা!’ মারে যত দেই আঁই অবাক হই যাই। মাইয়ারা মার কাছ তুন যত শেখে, অন্তরের কাছ তুন তত শিইখতে হারে না, সে যত মুখস্ত বিদ্যা করুক না ক্যান। সাধ হয়, মারে আঁর কাছে চিরজীবনের লাই রাখি দিই, আত্মীয়স্বজনরা যদি নিন্দেমন্দ করে। মা’র হোলাপাইন আছে, নাতি নাতকুর আছে, বৌমারা আছে, চার কথা হুনাই দিব। কী জানি কার মনে কী আছে, কে ক্যামনে নেয়, ভাইবত হইব তো সেই সব কথা।  মাইয়ার হৌরবাড়ির ঝঞ্ঝাটে জড়াইয়া হুদা হুদা মারে কষ্ট দিই লাভ কি। নিজের স্বার্থের লাই এই অনুরোধ আঁই কইরতাম হাইরতাম ন। 

নতুন নতুন মানুষ, নতুন নতুন কতা, টের পাইয়ের । মনটা আঁর আগের মতো নাই। কত কতা আই ভিড় করের। নিজের ভিতর তুন জন্মার, নিজের ভিতরেই মরি যার, কিছু অর্থ ধইরত হারিয়ের, কিছু আবার জ্যান্ত হই উড়ি যার। হরীলটা ভারি হই যার দিনে দিনে। মাঝে মাঝে মনে হয়, হোলাডা হাত পা নাড়ে চাড়ে নিজের খুশি মতো, ধমকাইব তার কি জো আছে। স্বামীর তো আনন্দে হেট ভরে না। আঁর হেটেরটা যতদিন বাড়ে ততদিন উনার উচাটন হয়। ছোট ঠাউরঝি আইছে লক্ষ্মীপুর তুন। আঁর হোলামাইয়ারে জড়াই ধরি কী আদরটাই না কইরল। কতদিন বাদে দেইখছে দাদার হোলাপাইনগুনেরে, চোয়েমুয়ে সেই কী আনন্দ। পোটলাপুটলি ঘরের এক কোনায় রাই আঁর কাছে ছুটি চলি আয়ে। ‘বৌদি  গ, কেননে বুঝামু কত কাম হালাই আমনেরে এক নজর দেইখবার লাই আইছি। আমনেগো জামাইয়ের বাতের ব্যামো, নড়ত চইরত হারেন না।’ ‘তা হইলে এত কষ্ট করি আইছ কেন? “এটা কী কন বৌদী, এক নজর না দেইখলে যে মন মানে না। হাশের ঘরের বৌমারে কইলাম, তোমার হৌরেরে একটু চোখে চোখে রাইখ। মাইয়াটা খুব ভালা ‘কয় আমনে কিচ্ছু চিন্তা করিয়েন না, আঁই আছি তো, আমনের যদ্দিন খুশি বাপের বাড়ি তুন ঘুরি আসেন।’ মাইয়ার কথায় ভরসা করি সংসার হালাই চলি আইলাম।” তোমার হোলামাইয়ারে আন ন। ‘না আইনলে আঁর রক্ষা আছে। কয়, মামাতো ভাই বোনদের সঙ্গে খেলবে। ওই তো উঠানে লাফাইতে আছে। যেই না হুইনছে ভাই হইব, মাথা খাই ফালার কন দেইখব। কইলাম, সে তো অনও মায়ের হেটে।’ ওদের ডাকি আন, একটু আদর করি। ওই তো আইয়া পড়ছে, আর তর সয়। আয় আয়, তোগো সোনামুখখানা দেখি। ‘ আরে, চকি তুন নাইমত আছ কেন, কন কী বিপদ ঘটি যাইব কওন যায়।’ তোমরা আঁর লাগি কত চিন্তা কর। ওই দেখ দিনি আর দেওরের হোলামাইয়াগুনও আইয়া পড়ছে। আয় বয় বয, দূরে দূরে ক্যান, আঁর হাশে বয়। দেখ দেখি কত কতা হোনে। ‘আওনের সময় দেইখলাম কত পাখনা বরই গাছের নিচে বিছাই রইছে। তোমার লাই কুড়াই আইনছি। খাই দেখ, এইসময় স্বাদ লাইগব। আঙ্গ হোলাডাও হৃষ্টপুষ্ট হইব। পাটনাইয়া গরুর দুধের সন্দেশ বানাই আনছি। হত্যেক দিন দুইভাগ কইরে খাইও। কাওরে দিও না। হক্বলরে না দিই তোমার তো খাইবার অভ্যাস নাই। কড়া পাক। টিনের বাক্সখান তোমার বিছানার কাছে ঝুলাই রাখি যাইয়ের, খাইও মনে কইরে।’ খামু, খামু, চিন্তা করিও না।

মনের নাম মহাশয়, তেমন সইছে না, যেমন সওয়াতে চাইছি। মনটা এমন আনচান করে যে তার কুলকিনারা খুঁজি হাই না।  যন হক্বলে নিজের নিজের কাজে চলি যায়, কেউ আর কাছে ঘেষে না, আঁই যেন ভেন্ন জীব, হেঢেরটারে লই একলা থাওনই লাইগব এই সময়। কারা যেন নিয়মের জালে জড়াই দিছে। খোড়াইতে খোড়াইতে ঘরের দূয়ারে আইলাম। কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে কাকটা লেজ দোলার, চোখ ঘুরাই আঁরে দেইখল, কা কা কইরল, তেষ্টা হাইছে বোধ হয়। আঁই নড়চি না চড়ছি না দেইখে বুইঝতে চায় মনের কষ্টটা আঁরে কতটা কাবু করি হালাইছে। মনের কী ইচ্ছা হইল মাটির কলসির তুন এক গেলাস জল আনি শিউলি গাছের নিচে রাখা মালসার মধ্যে ঢালি দিলাম। ঢোক ঢোক করি গিলি খাইল। হায় হায় রে কেউ বোঝে না ওর কষ্টটা। মাইনষের লাই নাকি মাইনষের হরান জ্বলি যাই, সাত সতেরো বন্দোবস্ত যেন সকল মাইনষে পৃথিবীটাকে কব্জা করি রাইখছে, কত মাথা পিটাপিটি করের, জমিজোতের লাই মামলা মোকদ্দমা করের অথচ এই অবলা জীবজন্তু গাছগাছালি এরা আঙ্গ লগে থায়, এদের ওতো হরান আছে, হিরে দেইখত ন একবার। আঙ্গ গ্যাঁতি ভাসুর, হিছনের বাড়িতে পেল্লাই ঘর বাঁধি আছে। বিঘা বিঘা জমি, কত না ফসল হয়। আউস আমন বরো ধান, পাট, নারকেল বাগান, সুপারি বাগান, কোন কিছুর কি অভাব আছে, তবু লোভ যায় না, আরও আরও চাই, খুঁজি খুঁজি বেড়ায় কন্নাই বেনামি জমি হড়ি রইছে, কোনও বেধবার সম্পত্তি ক্যান্নে নিজের নামে করি নিব। তর সয় না, ছলে বলে কৌশলে বেগ্গাইন দখল কইরত না হাইরলে ওনার ঘুম হইত ন। শাগরেদরাও একই গোয়ালের গরু। লাঠি উঁচাই এগ্ৰাম তুন ওগ্ৰাম ঘুরি ঘুরি বেড়ায়। দূর দূর মাঠে যিয়ানে কারো দু’চোখ যায় না, হিয়ানে খুঁইজলে ওনার জমি হাওন যাইব। ঘরে খাওনের লোক নাই, লোভের হাড়িতে টস টস করি রস হড়ে। কারও আইলের সীমানায় এক আঙুল জমি চলি যাইলে মামলা মোকদ্দমা করি জুতার শুকতারা খই হালাইব। কেউ যদি জিগায়, ‘এত যে দৌড়ান, খাইব কেবা।’ তাড়াতাড়ি আই কয়, ‘ তোর বাপেরে খাওয়ামু, তোর চৌদ্দগুষ্টিরে খাওয়ামু, আর বেশি কইলে তোরেও জেলের ভাত খাওয়ামু।’ তবুও মাইনষের কথা মাইনষেরে না কই কারে কমু। যত হুকুম খবরদারি বেবাক ধম্মের দোহাই দিই মাইনষে সান্ত্বনা খোঁজে। মাইনষের উপর দোষ চাপাই আর কি করুম। মাইয়ালোকের কতা কে আর কবে হুইনছে। হোলামাইয়া জম্ম দিই মানুষ করি দিতে হারলেই কত সুনাম, কত ডাকখোঁজ – সুন্দরী বউ, ভালা মা, পাকিয়সী, লক্ষ্মী ঘরনী। বদনাম ও কি কপালে কম জোটে। কতায় কতায় গায়ের রঙ লই খোটা ‘কালুটনি’। আঙ্গ এক মাইয়ারে তো হোলামাইয়ার মা হইতে হারেন বলি ‘বাজা’ বদনাম দিই বাপের বাড়ি পাঠাই দিল, দেইখল না একবারের লয় হেথাগো হোলার খুঁত আছে কিনা। এই জগতে যত দাপট পুরুষ মাইনষের, মাইয়া মাইনষের আর কিয়ের দাম। আঁর কথাই ধরেন না, যেই না দাই কইল আঁর হোলা হইব, দেইখতে না দেইখতে কদর গেল বাড়ি, আদর যত্ম, চোয়ে চোয়ে রায়ন, যেন হোলা তো নয়, সাত রাজার ধন এক মানিক। মাইয়ার জম্মের কথা হুইনলে মরুক ধরুক, যমের দূয়ারে যাক, কার কি এত নজর দিবার সময় আছে, রক্তের ঢেলা ছাড়া আর কি কোন দাম আছে! এমন সব সাতপাঁচ ভাইবতে ভাইবতে দিন যায়। স্বামী আই কইলেন, ‘তোঁর হইছেটা কি? এত যে দুশ্চিন্তা করর, হোলাটার কী দশা হইবে, ভাইবা দেইখছ কি ?’ আঁর স্বামী খালি হোলার কথা চিন্তা করে, একবারও ভাবে না, দুই বাচ্চার পর তিন বাচ্ছার মা হইতে চইলছি, বিপদ আপদে যে কিছুখান হইত হারে, তন কী হইব !

আঁর স্বামী আঁর মনখান শান্ত রাইখতে চায়। বাড়ি আইলে হোলামাইয়ারে লই গোল হই চাটাইয়ের উপর বই জলচকির উপর লাল শালু দিই  মোড়াই কৃত্তিবাস ওঝা’র রামায়ণ না হয় কাশীরাম দাস-এর মহাভারত, সময়ে সময়ে তুলসীদাস-এর রামচরিতমানস হড়ে সুর করি আবার ব্যাখ্যা করি ওদের বুঝাইও দেয়। আঁর মাইয়াটার ধম্মকম্ম আর ধম্মপুস্তকের হতি মন আছে। সরসর করি সপ্তকাণ্ড রামায়ণের চরিত্রগাইন মুখস্ত বলি দেয়। তাই ওর বাবা নিয়ম করি বসায়। আঙ্গ গ্ৰামে মাইয়াদের ইসকুলে পাঠাবার রেওয়াজ নাই। আধা মাইল দূরে ছেলেদের প্রাইমারি আর হাই ইসকুল আছে বটে। কোনরকমে চলে যায়। হিন্দু মুসলমানের কোন ভেদাভেদ নাই। মাইয়ারা ইসকুলে যাইবই বা কেন, যদি বেশি পন্ডিত হই ছেলেদের উপর ছড়ি ঘোরায়, অধিকার চাইয়া বসে। কিন্তু আঁর মাইয়াটার পড়ালেখা শিখবার খুব শখ। আঁর কাছেই হাতেখড়ি, ক্লাস থ্রি ফোরের বাংলা ইংরেজি অঙ্ক আঁই শিখাই দিছি। মাইয়া নিজের আগ্ৰহে সকাল সন্ধ্যায় আঁর হোলার  দেখাদেখি বইপত্র উলটাই পাল্টাই দেহে। পরে কেমনে কেমনে চুপি চুপি বিদ্যাসাগর আর শরৎচন্দ্রের লেখা বই পড়া শিখি হালাইছে। আর বিয়ার আগে যেইটুকানি পড়া শিখছি, সেই শিখনের লাগি অনও বাঁচি আছি। ওদের দেখি থাকি থাকি চাগাড় দেয়। মনের দুঃখটা চাপি রাই, নিজের কথা এত ভাইবলে এগুনরে মানুষ করুম কেমনে। আঁর ঘাড়েই তো সব, কেননে কি করুম। উপরওয়ালারে কই আঁরে শক্তি দাও ঠাকুর, আঁই যেন সংসারের জ্বালা যন্তন্না সামলাই বেগুনের মন রাই চলতি হারি। বইগুলান আঁরে যেন ডাকি কয়  ‘ আয় আয় আঙ্গরে লই নাড়িচাড়ি দেখ, দেইখবি হড়ালেখায় কী মজা।’ আঁই যেন ওদের কথাখান হুনতি হাই। কেন এইকথা কর, কি ওগো উদ্দেশ্য, না বুইঝলে চইলব কেমনে! এই জগতটা নাকি লোকে কয়, জ্ঞানের সাগর। কত মণিমুক্তা ছড়াই রইছে চাইরপাশে, কে আর এমন আছে যে খুঁজি আনি দিব। আঁই তো চাই মুঠো মুঠো করি নি, মন ভরাই আর হাইরলে লোকেরে বিলাই, লইবার লোক তো চাই, খালি দিলে তো হইত ন, উলুবনে মুক্তা ছড়াই লাভ কী আছে! মনে মনে বাসনা জাগে পিথিবী একদিন মাইয়াদের কতা হুইনব, ওদের ঠিক জায়গায় লই বসাইব। আঙ্গ দেশে কবে পুরুষরা মন থেইকে চাইব মাইয়া লোকেরা একই আসনে বসি পাত পাড়ি খাক। কত যে হাজারো উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে, কেন আসে কইতে হারি না, গরম জল ফোটার মতো ফুইটতে থাকে। যদি কথা গুলান লিখি ফালাইতে হাইরতাম, তবে মনের শান্তি হইত। আঁরে কে যে শিখায় এসব কথা! যার হরীল শক্তপোক্ত হর আঁর গভ্ভে, ওই পাগলা শতানটা না তো! ওর তা হইলে একটা মন আছে। তাই কেমনে হইত হারে! জীবনই যে দেইখল না। মন লই ও কী কইরব। হইত হারে মার হেটের ভেতর একটা জীবন আছে, সে খুঁটি খুঁটি জীবন দেইখতে চায়, ঘুমাই ঘুমাই জীবন দেখে, সে জীবনের ভেন্ন মাধুর্য। এই শব্দটা আঁর স্বামীর কাছ তুন শিখছি। আরও কত যে নতুন নতুন শব্দ ওনার কাছ তুন শিখছি। শব্দগুলারে লই খেইলতে আঁর কী যে ভালা লাগে। আঁর স্বামী না বুইঝলে আঁরে ধমকায়। ওই ধমকানির একটা ভার আছে। মাঝে মাঝে জিগাই এই শব্দগুলা আমনে শিখলেন কত্তুন। উনি সচরাচর হাসেন না, গম্ভীর ভাবের লোক। আঁর কথা হুনি হো হো করি হাসি হালায়। হয়তো আঁরে পাগলি ভাবে। কত লোকই তো ভাবে আঁর এসব ভাবসাব দেখি। আঙ্গ বাড়ির হোলামাইয়ারা কয়, ‘ আঙ্গ জেঠি একটি হাগল, কেমন যেন ঘুরে থাকে।’

চরিত্রগুলা কেমন ছবির মতো যায় আর আসে। বড্ড সাধ হয় ওগো ঘরবাড়ি দেখি আসি। উইয়ের ঢিপিটা চোয়ের দেখা দেখি। সরযূ নদীর জল কেমন কলকল করি যায়, টলটলে জল, মন কাড়ি লয়। কবির এলেম ছিল আঙ্গ মনের কথা জানি হালাই চরচর করি লিখছে। আঁর উনি সুর করি করি আওড়ায় আর আই রসুই ঘর তুন হুনতি পাই এমন সোন্দর সোন্দর কথা, নাই বা মিলল আঁর রোজের কামকাজের লগে কিন্তু এমন এক গল্পের জম্ম দেয় মনের ভেতরে যা চেনবার লাই মন উচাটন হয়। কেন যে আঁই কোন উত্তর খুঁজি হাই না। শব্দরা অর্থ হই মনডারে জোরে জোরে ধাক্কা মারে। কোনদিকে যাইয়ুম কোনদিকে যাইতাম ন, বুঝি উঠতি হারি না, হাগল হাগল লাগে। তাই হইলেই বা কী আছে, শব্দের বাঁক কী অস্বীকার করতি হারি! আঁর উনি হড়ি যায় –  অর্জুন কহিলেন:- কর্ম হ’তে জ্ঞান শ্রেয়ঃ হ’লে জনার্দন। তবে কেন ঘোর কর্মে করিছ প্রেরণ।। কেন হে ব্যামিশ্র বাক্যে কর মোহময়। দেখাও একটি পথ যাতে শ্রেয়ঃ হয় ।। হত্যেক শনিবার হইড়তে হইড়তে বইটার বাঁধন ছিঁড়ি ছত্রখান হই গেছে। তবুও কী আনন্দ যে হায়, বার বার করি হড়ে। অত কথার অর্থ তো আঁই বুঝি না, চেষ্টা চরিত্র করিও খেই হারায় হালায়। কিন্তু এ কতা না জানাইলে কেমন করি হয় যে আঁরে ভাবখানা খুবই টানে, অথচ কেউ তার মর্ম বুঝতেই হারে না। হোলামাইয়া আর ভাইয়ের ফোলা মাইয়ারে গোল করি লই বসি রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প শোনায় আঁরে একবারের লই ডায়ে না বলি মনে মনে হুশি রাখছি মেলা ক্ষোভ, ভাইবলাম একদিন না একদিন উগড়াই দিমু, হিয়ের লাই তৈরিও কইরছিলাম নিজেরে। ওমা উনি আঁরে সেই সুযোগ দিলেন না। ডায়ি কয় ‘হোন তোঁর লগে আজ আঁর অনেক কথা আছে, বিয়ালে কোন কাজ রাইও না।’ হুনি তো ভয়ে বুক দূরু দুরু, কি জানি বাবা কি কয়, যা মেজাজ গরমের মানুষ, কোনো অন্যায় কাম করি ফালাইছি না তো! না হয় নিশ্চয়ই কোন গুঢ় কতার খোঁজ হাইছে, আঁর লগে ভাগাভাগি কইরত চায়। ওমা কে আর জাইনত এমন একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটাইব। সময় আর কাটতি চায় না, গোপন কতারও তো সময় গময় থাকে, তাই বলে সূর্যের আলো ডুবু ডুবু হইলে, এই আবার কিয়ের কতা! হ্যারিকেনের দশিখান হরিষ্কার করি কেরোসিন তেল ঢুকাই নিভু নিভু করি জ্বালাই রাইখলাম সামনের ঘরে। উনি কাঁচারি বাড়িতে বই মামলা মকদ্দমার মুসাবিদা করার হরে চার গ্ৰামের মক্বেলরা বিদায় লইলে খড়ম হায়ে ঠক ঠক কইরতে কইরতে ঘরের দিকে আয়ে। ‘ কয়, এতক্ষণ মক্বেলদের হড়াইছি, এবারে তোমারে হড়াইয়ুম।’ কী যে কন আঁই কবে তুন আমনের ছাত্রী হইলাম। ‘ আরে ছিলা না, হইবা। তোঁর কোনও আপত্তি আছে?’ এই অসময়ে আবার কে আইল? নিয়ামত আলির ছোট হোলা আনোয়ার। ‘জেঠি, মা কইছে দুই কেজি চাল উধার দিতে।’  এত ভর সন্ধ্যাবেলায় কেমনে দি, আইছস যখন ফিরাইতে তো হাইরতাম ন। যা তুই ঘর যা, আঁই পাঠাইবার বন্দোবস্ত করুম। ‘কীগো তোঁর হরের উপকার করা হইল ?’ কী যে কন! মানুষ হই মাইনষের কামে না লাগইলে এই জীবন লই কী করুম। ‘ আচ্ছা, তুমি এত কতা শিখলা কোথা তুন! এই আমনেগ মুয়ে হুনি হুনি। ‘তোঁর বুদ্ধির তারিফ করতি হয়। কতাখান কন্নাই তুন কন্নাই লই যাও।’ হক্বলটাই ভাগ্যের খেল, আঁই আর কী করি, কেউ আঁরে দি করাই লয়। ‘ ভারি সুন্দর কথা কইছ তো।’ আমনের ভাল লাইগছে? তাইলে আরো কথা কমু। ‘হোন তবে বিজ্ঞান-যোগের কতা। সহস্র নরের মধ্যে কোন ভাগ্যবান। আত্মজ্ঞান লভিবারে হ’ন যত্নবান।’ আহা এই জ্ঞান কোথা তুন পামু। ‘ তাইলে আরও দুইটা লাইন শোনাই। অসুখে পীড়িত যার অন্তরে কাতর। আত্মজ্ঞান-লাভে তার সাধ নিরন্তর।’ আঁর ইচ্ছা হইল ওনারে একটা পেন্নাম করি। ‘ আহা এই অসময়ে কেন পেন্নাম কর। এই লাইনগুলান আঁর নয়।’ আমনের মুয়ের তুন বার হইছে, এইটা কী কম কথা নি! ‘ কতাখান বড় কথা নয়, এর অর্থটাই বড় কথা। তুঁই কতটা রস নিতে হাইচ্ছ, এটাই হল আসল।’ আঙ্গ মতো বোকাসোকা মানুষ বুঝব এত জ্ঞানের কতা। আঁই হক্বলের আগে আঁর মনের কতা হুইনতাম চাই। যত রকমভাবে হুইনতাম চাই, হারি না তো, কত কিছু আই ধাক্বা মারে, চুরমার করে, তন আঁই হোলামাইয়ার মুখ দেই, আমনেরে দেই সামনে আই দাঁড়াই আছেন। গ্ৰামের মাইনষের মুখ দেই, কারা যে আত্মীয়, কারা যে অনাত্মীয় বুইঝতাম হারি না।

অন খালি ইচ্ছা হয় হক্বল মানুষেরে আপন করি লই,ওদের মনের কথা বুইঝবার চেষ্টা করি। হুরা দুনিয়াটা ওই মাইনষের মনের মধ্যে ঘুমাই আছে। কী আশ্চর্য কেউ তা জানে না। খালি খালি হাত কামড়ায়। শুধুই কী মানুষ, পশু পাখির লইও তো মন কাঁদে। এত কাঁদাকাটির শব্দ কেন যে বুকের মধ্যে বাজে, আমনেরা বিশ্বাস করেন আঁর অস্থির অস্থির লাগে। অন্য কনানে চলি যাইবার লাই মন চায়। এমন যদি হইত হক্বলের দুঃখ দূর করি দিতে হাইরতাম। শাউরি, দিদিশাউরিদের বাক্যি তো হেলাইতাম হারি না। এই সময় ভালা ভালা কথা চিন্তা করতি হয়। হোলাটা আরে অন জ্বালায় না, মার কষ্টটা খুব বুঝতে হারে। হারাক্ষণ খালি ঘুমাই থায়, এধার ওধার করে বটে, আঁধার তুন আলোর দিকে টানে। তাই কী মনের এত উদাস উদাস ভাব। ও আঁর মতো, না আঁই ওর মতো হই যাইয়ের, কে জানে। কিন্তু হরিবর্তন যে একটা হর এটা হাঁচা কথা। আঙ্গ বাড়িতে আঁর এক ননদ আইছে, বাজা বলি তাড়াই দিছে হৌর বাড়ি তুন। মনে বড় দুঃখ, সারাক্ষণ মন মরা হই থায়। আঁর গভ্ভের সন্তানের দিকে চাই থায়। কয়, ‘বৌদি তোঁর হেটেরটারে আঁরে দিবা, আঁই মানুষ করুম। তোঁর তো দুইটা আছে, আঁরে নয় একটা দিলা।’ আবদার কইরল বটে, মনে মনে একটা ভয়ও হইল। লোকে কয় না নজর লাগি যায়। মুয়ে হেথির কিছু আঁটকাল না। নিজের হেটটারে আরও বেশি করি জাইপটে ধইরলাম, আদর করি চুমু খাইলাম। মা’র মুখখানা ওর অনও দেখা হইল না। আঙ্গ অনেকগুলা জমিজমা আছে, ফসলাদি কিচ্ছু হয় না। হারা মাঠে হুধু ইঁদুরের গর্তে নিচের মাটি উপরে। হায় হায়রে আঁর ননদের এরকমই কষ্ট, কইত হারে না, ভেতরটা ছিঁড়ি যায়। কিন্তু আঁই তো এইটা কইতে হারলাম না তোরে দিমু। মাইনষের কত তো হরান কাঁদে, কইত হারে না মন খুলি, নাড়ি কাটি যাই, একবারের লই বিয়োগ হইলে আর যোগ হয় না। জমিগুলার দিকে আঁই চাই থাই, কিছু করতি হারি না, দু চার খান আলের ধারের তুন হিয়ালমুত্রা তুলি আনি মাঝে মাঝে। ননদেরে সান্ত্বনা দিতে যামু, অমনি কান্নার তোড় ভাসি আইয়ে। কী হইল রে বাপু, হঠাৎ করি এমন অঘটন! দাদা শৌউর কদ্দিন ধরি ছিল বিছানায়, সান্নিপাতিক হইছে, কিছু সব্বনাশ হই গেল কিনা কি জানি। ধনঞ্জয় ডাক্তার, সন্তোষ কবিরাজ মিলিই তো চিকিৎসা কইরছিল। পিত্ত বায়ু কফ তো সারবার নয়। কাঁদাকঁটির জোর বাড়ি গেল অল্পক্ষণের মধ্যে। শর্বরী আই খবর দিল চোখ উল্টাই হালাইছে। হক্বলে ওইদিকে হানেপ্রাণে ছুটি চলি গেল। কেন যে আঁর ব্যথাটা ঠিক এই সময়ে মাথা চাড়া দিই উইঠল কে জানে। আগে আগে বেটা বার হই আসতে চায়। গলা ফাটাই জানান দিলাম তোরা কে কোথায় আছস, দাইরে খবর দে। কী আশ্চর্য বেটা আমনে আমনে বার হই আইল, একটুক্ষণ সবুর কইরল না। আঁর শাউরি এত লোকের মধ্যেও বইলতে ছাড়ল না ‘আঁর শৌউর মরেনি গো, ফেরত আইছে, তোরা কাঁদাকাটি থামা, যায় ত ন, ভগবানের খেলটা দেখ।’

ভালা খবর মন্দ খবর দুইটা খবরের বোঝা মাথায় করি আঁর উনি ঘরে ফিরল। চোয়ে জল, ঠোঁট ফুলাই কাঁধে থলে ঝুলাই ঢুকিই দেইখল উঠান ঘিরি লোকে লোকারণ্য। আঁই বুইঝতে হাইরলাম না কোথায় হাসির ফুটকি ছিল কিনা, থাইকবার কতাও তো নয়। শুধু মুখে বইলল, ‘যাইবার সময় হলি কারও কি সাধ্য আছে, ধরি রাখতে পারে।’ বিকাল হলি দাহকার্য করি ঘরে ফিরল। তুলশিহাতা মুয়ে দিল, হুইরে যাই ডুব দিল, লোহা আর আগুন ছুঁইল। শাউরি কইল, ‘হোলার মুখখানা দেইখবি না, তুই কেমন বাপ রে।’ ‘ দেইখব না এই হোলার মুখ, এর লাই আঁর ঠাকুরদা চলি গেল, বাপ তো আগেই গেছে, আঁর মাথার উপর আর কেউ রইল না।’ ‘ তুই কস কীরে?  আক্বেল নাই, কওনের আগে জিবে লাগাম তো দিবি। মাইনছি, তোর দুঃখ হইছে। দুদিনের হোলার ঘরে দোষ চাপাইলি, একটু উল্টা করি ভাইবলে বুঝতি পারবি, তোর ভাবনা ভুলে ভরা। এত জ্ঞানগম্মিয়ালা মানুষ তুই, তোর মুয়ে এমন কতা !’ ‘মন মেজাজ ভালা নাই মা, কী কইতে কী কই ফালাইছি, মাফ করি দিও।’  আঁর কতা হোন, তোর জানা কতা তবুও স্মরণ করাই  ‘অহঙ্কার বিরহিত নিষ্কাম হৃদয়ে। কর্ম যদি হয় রাগ দ্বেষহীন হয়ে ।। ঠান্ডা মাথায় ভাব, জম্ম আর মরণ দুটাই আপন নিয়মে চলে, হিয়ানে কারো হাত নাই।’ কথাখান হুনি উনি খানিক মাথায় হাত দিই বসি হড়ে। আঁতুড়ঘরের দিকে হা বাড়ায়। হোলার ওঁয়া ওঁয়া কাঁদা হোনে। এ যেন সত্যির কাছে মাথা নোয়ানো, নিজের কাছে হিরি হিরি আসা। নিজের কথার লাই নিজেরই লজ্জ্বায় মুখটা লাল হই যায়। হোলামাইয়া আই বাবার কোলে চাপি বসে। শ্মশানের হোড়া কাঠ আর অস্তির চূর্ণ ইয়ান তুন অনেক দূরে। ধোঁয়া তনও কী গলগল করি ওঠে!

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *