সুবিমল মিশ্র

আমি রোজ রাতে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন না-দেখতে আমার ভালো লাগেনা। যেদিন দেখিনা সেদিনটা আমার কেমন খালি খালি লাগে। বুকের ভেতরটা ফাঁকা মনে হয়। সারাদিন আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। রাত্তিরে স্বপ্ন দেখে তবে শান্তি পাই। আমার স্বপ্নেরা সব অদ্ভুত রকম। কোনদিন স্বপ্ন দেখি মানুষের হাড় চিবিয়ে খাচ্ছি। আমার দু’কশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টাটকা তাজা রক্ত। আমার বুকে ঝোলানো আছে  সোনালীপাথর, শক্ত হাতে চেপে রয়েছি হাড়ের গোড়ালি। আমি খুব তৃপ্তির সঙ্গে সেই হাড় চিবিয়ে চলি। অভ্যেস মত দুচোখ বুঁজে খেয়ে যাই সেই হাড়। খেতে খেতে আমার মনে হয় অনন্তকাল ধরে আমি মানুষের হাড় চিবিয়ে যাচ্ছি তবু আমার খিদে মিটছে না। এইরকম-সব ভাবলেই আমার বুক জুড়ে দুঃখ জমতে থাকে। আমি সেই দুঃখ ভুলবার জন্য বার বার বুকে ঝুলিয়ে রাখা সোনালীপাথরটা নেড়েচেড়ে দেখি। কোনোদিন আবার স্বপ্ন দেখি আমার মুখের আদল অন্যরকম হয়ে গেছে। কেউ আমাকে চিনতে পারছে না। পরিচিতরা নিকট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে-সব স্বপ্নের ভেতর আমার চোখ ফেটে জল আসে। আত্মীয়-স্বজনদের ওপর অভিমান হয়। কোনোদিন স্বপ্ন দেখি আমি এক চোখে কানা হয়ে গেছি। পা খোঁড়া। মুখভর্তি বসন্তের দাগ। লুঙ্গির উপর একটা ময়লা শার্ট গায়ে দিয়ে আছি। বাসস্টপে লাঠি হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছি। লোকের কাছে পয়সা ভিক্ষা করছি। সঙ্গে আমার আট বছরের মেয়েটা রয়েছে। লোকেরা আমাকে করুণা করছে। ভালো স্বপ্নও মাঝে মাঝে দেখি। এক নদী তাতে ছোট এক ডিঙি। ওপরে আমি বসে আছি। জোয়ার আসছে। ছলাৎ ছলাৎ ডাঙায় ধাক্কাচ্ছে। নৌকো দুলছে। আমিও দুলছি। সারাক্ষণ জল, নৌকো, নদীর ঢেউ, দুলুনি। কখনো দেখি কোন এক কুড়ি-বাইশতলা বাড়ির মাথায় আমি উঠে গেছি। সেখান থেকে মানুষজনদের পিগমির মতো দেখাচ্ছে। বাস ট্রাম রাস্তা সব কেমন ছোট হয়ে গেছে। আমি তাদের অন্য-আয়তন দেখছি। এই সব স্বপ্ন দেখে আমি খুব মজা পাই। আমার রোজকার দেখার সঙ্গে এ দেখা মেলে না। সেজন্য এসব স্বপ্ন আমার পছন্দ। কিন্তু কোনো কোনো স্বপ্ন আমার কাছে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। হয়তো দেখি ষড়যন্ত্র করে আমার শরীরের যন্ত্রপাতি-সব বের করে নিয়ে সেখানে অন্যরকম-সব জিনিষ পুরে দেওয়া হচ্ছে। অনেক—অনেকক্ষণ ধরে সেই সব স্বপ্নগুলো চলতে থাকে। আমি দেখি রাতারাতি আমাকে কেমন পাল্টে দেবার পরিকল্পনা চলছে। বাইরেটা যেমন আছি তেমনই থাকে। শুধু ভেতরের কলকব্জাগুলো-সব সরিয়ে দেওয়া হয়। এসব স্বপ্নকে আমি খুব ভয় করি। ভয়ে আমার হাত-পা বুকের ভেতর সেঁধিয়ে যায়।  ঘুম ভাঙলে পর অনেকক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকি। হাতের কব্জি বুকের হাড় টিপে টিপে দেখি। মনে হয় সত্যিই কেউ যেন ভেতরের কলকব্জা-সব অন্যরকম করে রেখে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ পরীক্ষা করি। কেমন যেন সন্দেহ হয়। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। মনের ভেতর ঐসব ভাবনা সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে। একমিনিটের জন্যও অন্যকিছু ভাবতে পারি না। সিগারেট খেতে বিস্বাদ লাগে। রাস্তায় মেয়ে দেখতে বিস্বাদ লাগে। খবরের কাগজ পড়তে ইচ্ছে হয় না। দাড়ি কামাতে উৎসাহ পাই না। কাজে বেরোই না। সারাক্ষণ মাথার উপর সূর্য নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে থাকি। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে ফুটপাথ বদল করি। সারাদিন ক্লান্ত পায়ে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে একটা ভালো স্বপ্নের জন্য শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। 

কিন্তু ভালো স্বপ্ন দেখা খুব শক্ত ব্যাপার। এতদিন এতসব স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি বুঝে গেছি ভালো স্বপ্ন সহজে দেখা যায় না। তবু আমি বিছানায় শুয়ে একটা মোটামুটি গোছের স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু যতসব খারাপ খারাপ স্বপ্ন আমার চোখেমুখে ভীড় করে আসে। মানুষের হাড় চিবোনোর স্বপ্নটা আসে। মুখের আদল অন্যরকম হয়ে যাওয়ার স্বপ্নটা আসে। কানা খোঁড়া মুখে বসন্তের দাগঅলা ভিখিরী হয়ে যাওয়ার স্বপ্নটা আসে। আমি বিছানায় শুয়ে কখনো স্থির হয়ে থাকি। কখনো ছটফট করি। কখনো প্রাণপণে অন্য একটা কিছু ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। দূরের স্টেশন থেকে রেলওয়ে–শানটিংয়ের শব্দ ভেসে আসে। পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত দুটো-তিনটে বেজে যায়। রাত্রির নিস্তব্ধতা ক্রমশ জমতে থাকে আমার আশেপাশে। আমি চোখ বুজিয়ে পড়ে থাকি। কখনো চোখ খুলি। আমার চারদিকে অন্ধকার স্থির হয়ে থাকে। আমার হাতের উপর দিয়ে আরশুলা হেঁটে যায়। ইঁদুরেরা এসে আমার শরীরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। চোখ ঠুকরে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কয়েকটা কাক। সূর্যের তাপ আর ভ্যাপসা অন্ধকারে পচন ধরতে থাকে আমার শরীরে। আর সেটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য আশেপাশে কাক–শেয়াল-শকুনেরা অপেক্ষা করে থাকে। আমি আকাশে আমার শরীরের উপর ছায়া ফেলে শকুন উড়তে দেখি। মরা গাছের ডালে দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে কাক। অন্ধকারের ভেতর ওৎ পেতে আছে শেয়ালের দল। তাদের দাঁতে ধার, জিভে বাসি রক্তের স্বাদ। আমার সমস্ত কিছু গোলমাল হয়ে যায়। গা গুলিয়ে ওঠে। আমি একটা কিছু ভালো স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খাই। অন্ধকারের ভেতর থেকে একসঙ্গে মোরগফুল আর সোনালীপাথর ভেসে আসে। পায়ের কাছে ফুর ফুর করে ওঠে মোরগফুলের রক্তাক্ত পাপড়ি। সোনালীপাথরে আমার প্রতিবিম্ব চলকে যায়। একটা আধ-খাওয়া ঘোড়ার কংকাল আমার ডানপাশে ছড়ানো থাকে। নদী পেরিয়ে আসতে থাকে একটা উট। সেই উটের উপর বসে থাকে এক উদম নারী। দেখে আমার গলা শুকিয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে কোন স্বর বেরোয় না। আমি উটের ধূসর রঙ, তার বেঢপ মোটা পেট, কুঁজ সুদ্ধ ঘাড় ও মুখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। নারীর মুখ চেনার চেষ্টা করি। কিন্তু চেনা যায় না। শুধু তার উদোম সোনালী পা-দুটো উটের পেট বরাবর ঝোলানো থাকে। দক্ষিণের নদীর জলে পা ফেলে স্থির আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে সেই ধূসর উট, তার পিঠে সেই উদোম নারী। স্রোতের জলে মোরগফুল একমুঠো রক্তের মতো ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যায়। সোনালীপাথরের রঙ ঝাপসা হয়ে ওঠে। অদূরে মরা গাছের ডালে ধূর্ত কাক ওৎ পেতে থাকে, শকুন উড়তে থাকে আমার শরীরে ছায়া ফেলে। রোদ তাপে পচতে থাকে শরীর। আমি হাত বাড়িয়ে যা পাই ধরে আঁকড়ে রাখতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার হাত নড়ে না। সমস্ত কিছু ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পা নড়ে না। নিরুপায় নিঃসম্বলভাবে পড়ে থেকে থেকে আমি একটা কিছু ভালোর জন্য অপেক্ষা করে থাকি। কিন্তু চোখ ফেটে আমার জল বেরিয়ে আসে। চোখের জলে আমার মুখ ভেসে যায়। টপ টপ সেই জল ঝরে পড়ে এই পৃথিবীর পাথুরে মাটিতে। অভিমানে আমার বুক ভারী হয়ে ওঠে। নির্ধারিত নিয়তির মতো স্থির পা ফেলে নদী পেরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে সেই উট। তার পিঠে উদোম নারী। সেই নারীর মুখ চেনা যায় না, ঝাপসা। শুধু তার পেলব সোনালী পা, উটের ধূসর পেট আমি দেখি। তার স্থির চোখে এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে আসা আমি দেখি। পাহাড়ী নদীর স্বচ্ছ জলে তার ঋজু পা হাঁটুভর ডুবে যায়। সে হলুদ ফুল সবুজ লতা মাড়িয়ে আসে। ভ্যাপসা গরম, রোদ আর অন্ধকার একসঙ্গে জমা হতে থাকে। কাক-শকুনেরা তাদের লক্ষ্য স্থির করে ফ্যালে। এক অতি তীব্র কা কা ডাক এগিয়ে আসে আমার বাঁ কান বরাবর। ডান পাশে আধ-খাওয়া ঘোড়ার কংকাল অস্তিত্বময় হয়ে পড়ে থাকে —ধূসর উট, পিঠে উদোম নারী নিয়ে, দক্ষিণের নদী পেরিয়ে। তার পায়ের শব্দ আমি শুনতে পাই। তার স্থিরচোখের দৃষ্টি আমি দেখতে পাই। কাক শকুন শেয়ালেরা একসঙ্গে ডেকে ওঠে। তিন প্রাণীর ছায়া জমাট বাঁধতে থাকে আমার ওপর। আলোয় আর তাপে দ্রুত পচতে থাকে এই শরীর। মোরগফুল অদৃশ্য হয়ে যায় দূর স্রোতে। ধূসর হয়ে যায় সোনালীপাথর। আমি নিশ্চুপে পড়ে থাকি। আমার চোখ ফেটে আর জল বেরোয় না। সমস্ত অভিমান এক জায়গায় এসে নিস্তরঙ্গ হয়ে যায়। আমার দেখার কিছু নেই, ভাবার কিছু নেই অবশিষ্ট। আমি বৃথাই এখানে, এই সূর্যের নিচে, ভালো কিছু স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।

(পুনর্মুদ্রিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *