তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায়: দশ
তারা একবার তাকে বলেছিল,
‘চল আমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রামে, বড়া ভাঙ্গালে। ওখানে নাহয় শীতকালটা থেকেই এলে। আর যদি অতদিন না থাকতে চাও তো তোমাকে আমরা পৌঁছে দেব মানালি বা কুলুতে, চাইলে বির বা ধরমশালাতে আমাদের দায়িত্বে। ওখানে গেলে তুমি বাস পেয়ে যাবে তোমার এখানে আসার। অবশ্য ওই শীতকালে তুমি এখানে আসতেও পারবে না, কারণ এখানে তখন ভয়ানক দুর্যোগের জন্য যাতায়াত বন্ধ থাকবে। তোমাকে থেকে যেতে হবে মানালি বা ধরমশালা বা অন্য কোথাও। সেটা একটা সমস্যা বটে। তার চেয়ে আমাদের সঙ্গেই থেকে যাবে গোটা শীতকালটা। তোমাকে পেলে আমাদের ভালই লাগবে। যদি দু’দিন থেকে ভাল না লাগে তোমার শীতের আগে-আগে সব বন্ধ না হতেই চলে যেতে পারবে। আমরা আবার এখানে চলে আসব এপ্রিল-মে মাসে। চাইলে আসবে আমাদের সঙ্গেই। চল না একবার।’
বড়া ভাঙ্গাল কাংড়া জেলার বৈজনাথ তহশিলে এক প্রত্যন্ত গ্রাম যেখানে আধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থা নেই, ট্রেক করে যেতে হয়। প্রখর গ্রীষ্মে তাপমাত্রা কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি, আর্দ্রতা ষাট শতাংশের মত। মনোরম আবহাওয়া তখন। বৃষ্টি হয় প্রায়ই। উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় তিন থেকে সাত হাজার ফিট বেশি। বড়া ভাঙ্গাল শব্দটির মধ্যে রয়েছে ‘ভাঙ্গ’ শব্দ, যা আসলে শিবের প্রিয় নেশাদ্রব্য। কাংড়া জেলার ধরমশালা, পালামপুর, বৈজনাথে থাকে গাদ্দি উপজাতির লোকরা। চাম্বা জেলার ভারমার ছাড়াও জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যেও থাকে একদল। কৈলাশ পর্বত উচ্চতায় আঠেরো হাজার পাঁচশ’ ফিট। এই পর্বতের চারপাশের অঞ্চলেই তাদের বসবাস দুর্গম এলাকার গ্রামগুলিতে। পীর পাঞ্জাল ও ধওলাধর পার্বত্যাঞ্চলের মধ্যবর্তী প্রতিকূল পরিবেশে ইরাবতী ও চন্দ্রভাগা নদীযুগলে ঘেরা এলাকায় তারা থাকে, শীতে প্রবল বরফপাত সভ্য দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে তাদের। ঘন ও নিবিড় জঙ্গলের প্রাবল্যে ছাওয়া গ্রামগুলি। তাদের নিজস্ব ভাষার নামও গাদ্দি এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা ব্যবহার করে এখনও তাংক্রি লিপি, যদিও আধুনিক প্রজন্ম সেসব ভুলে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে হিন্দি ভাষার জালে। সংস্কৃতে গাব্দিকা বলে একটি উপজাতীয় অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায় পাণিনির বিখ্যাত অষ্টধ্যায়ো গ্রন্থে। তারাই এখন গাদ্দি উপজাতি।
সে প্রস্তাবটা শুনে ভাবল, গাদ্দিদের সঙ্গে তাদের গ্রামে গিয়ে থেকে আসা যেতেই পারে। তার দিনযাপনের চাহিদা নিম্নতম, কোন অসুবিধেই হবে না তাদের গ্রামে কয়েকমাস থেকে গেলে। সে শুনেছে, তারা তাদের গ্রাম থেকে গ্রীষ্মের শুরুতে যে পথ ধরে এখানে আসে তা যথেষ্ট দুর্গম হলেও উত্তেজনায় ঠাসা। পথ চলে পাহাড়ের ঢালে ঢালে সরু ভাঙাচোরা ধার ধরে, খাদের গা ঘেঁষে। খানিক অসতর্কতা জীবন নিয়ে নিতে পারে। একের পর এক খরস্রোতা জলধারা পেরিয়ে যেতে হয়, তারা হয় ঝরনা নয় নালা অথবা সরু পাহাড়ি নদী। গোটা পরিক্রমার পথ প্রায় জনশূন্য, প্রকৃতির নিজস্ব কোল ধরে এগিয়ে চলা, গিরিশৃঙ্গের গা ঘুরে ঘুরে অথবা পাকদণ্ডী বেয়ে। দিনের পর দিন চলা, রাতে বিশ্রাম। এখান থেকে যেতে বেশ কয়েকটি গিরিসংকট বা পাস্ পেরিয়ে যেতে হয়। গাদ্দিদের সঙ্গে আলোচনায় সে জেনেছিল পথের বিবরণ। তার মনে হয়েছিল, ওই দুর্গম পাহাড়ি পথ কষ্টদায়ক হলেও উন্মাদনায় ভরপুর।
সে রাজি হয়ে গেল, তাদের আন্তরিকতা দেখে। এমন প্রাণিত নিমন্ত্রণ কি অগ্রাহ্য করা যায় ? খানিকটা কুণ্ঠা থাকলেও তা দমন করে সে জানাল তার সিদ্ধান্ত। পবন আর ভৈরব দুই ভাই। তাদের বাড়ি বড়া ভাঙ্গালের গ্রামে। শীতকাল বিদায় নিলে গ্রীষ্মের সূচনায় তারা গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ভেড়ার পাল নিয়ে। শুধু ভেড়াই নয়, সঙ্গে থাকে বেশ কিছু ছাগলও। আর থাকে এই বিশাল দলের রক্ষী হিসেবে কুকুর। প্রধান জীবিকা তাদের কৃষি হলেও ভেড়া চরানো হচ্ছে প্রথাগত ও পবিত্র জীবিকা। এই কাজে যুক্ত ছিল তাদের পিতা-পিতামহ ও পূর্বপুরুষ। একটি নির্দিষ্ট পথ ধরে প্রত্যেক বছর আসে তারা এই নির্দিষ্ট অঞ্চলে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এটাই বর্তনদারি অধিকার। আর সেই অধিকার তারা মনে করে জঙ্গলের জমির ওপরও আছে তাদের, যাকে কেড়ে নিয়েছে সরকার। ক্ষোভ খানিকটা আছে ঠিকই তার জন্য, তবুও তারা সদাপ্রসন্ন।
শীত প্রায় দোরগোড়ায়। এখনই এই উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। আর এক-দু’দিনও দেরি করলে ঘরে ফেরার পথ বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে, শৈত্য ঝঞ্ঝা শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। পবন বড়, ভৈরব ছোট। গাদ্দি মেষপালকরা এমনই জোড় বেঁধে বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে। দু’-ভাই ছাড়া পিতা-পুত্র জুটিও হতে পারে। আবার ভাড়াটে সঙ্গী নিয়েও আসে কেউ কেউ। যাই হোক, শীতকাল শুরু হওয়ার মুখোমুখি এইসব প্রান্তরবাসীরা তাদের ভেড়ার পাল নিয়ে ফিরে যায় ঘরে, তুষারপাত ঘটার আগে আগেই।
ভৈরব এসে বিকেলে তাকে জানিয়ে গেল যে পরদিন সকাল-সকাল যাত্রা শুরু হবে তাদের। যেন সেও তার সঙ্গে যা নেওয়ার নিয়ে তৈরি হয়ে থাকে। তখন বিকেলের গা থেকে রং চলে গিয়েছিল। সন্ধে আসার মুখে প্রকৃতি কেমন ধূসরবর্ণ হয়ে ওঠে। একটি ছোট পাথরের ওপর সে বসেছিল। একটু পরই অন্ধকার আচ্ছন্ন করে দেবে গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গিরিশৃঙ্গগুলির সারিবদ্ধতাকে। আকাশের তীব্র নীল তন্দ্রালু হতে হতে লক্ষ তারার কথা বলার প্রাবল্যে হারিয়ে যাবে। যুগ-যুগান্ত আগে যে দেবতারা এখানে ঘুরে বেড়াত তাদের কথা এখনও হাওয়ার শব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তা সে অনুভব করে। ভৈরব এই একটু আগেও ছিল। কথা বলছিল তার সঙ্গে। জানাচ্ছিল তার ও তার বড় ভাই পবনের তরফ থেকে তাদের কৃতজ্ঞতা, যেহেতু সে তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছে। তার বড়োই অবাক লাগে। এদের সঙ্গে কোন জন্মেই তার চেনা ছিল না। অথচ এত অল্পদিনেই এত আপন হয়ে পড়ল তারা কোন্ কৌশলে ? আড়ালে বসে খেলছে কোন্ অদৃশ্য কারিগর কেজানে ? তার দেখা পাওয়া যায় না ঠিকই, তার খেলা অনুভব করা যায়। সে কথা বলায় মানুষ আর প্রাণিদের, কথা বলায় পাহাড়-পর্বত-নদী-পাথরকে। এই কথা বলা যে বুঝতে চায় বোঝে, যার আগ্রহ নেই সে মনে করে সে ছাড়া আর কেউ কথা বলতে জানে না।
তার জিনিসপত্র ? দু’টি গিরিশিরার মধ্যবর্তী বড় বড় পাথরের অন্তরালে যে গুহায় তার নৈশ আশ্রয় সে খুঁজে নিয়েছে সেখানে আছে অবশ্য কিছু একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। সে ভাবল, আর বসে না থেকে বরং সেসব ভরে নেওয়া যাক ঝোলাতে। এমনিতেও আর কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে এই গুহাগৃহ ছেড়ে চলে যেতে হবে কোনও গ্রামে বা মঠে, যেখানে শীতকালটা কাটানো যাবে। এবার নাহয় হলোই বা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। চলে যাওয়া যাক বড়া ভাঙ্গালে তার এই গাদ্দি বন্ধুদের গ্রামে। পাথরের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হল গুহার মুখে। পাথরের আড়াল কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ঢুকল গুহার ভিতর। অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে সর্বত্র। সে অবশ্য অভ্যস্ত, রাতের অন্ধকারকে পছন্দই করে। সেখানে সে দেখতে পায় লুকিয়ে থাকা নানান সম্ভাবনার বীজকে। হাওয়ার অদৃশ্য চলাচলে শোনা যায় দৈববাণীর ফিসফিসানি। আর থাকে আকাশভর্তি তারারা, মনে হয় তারা এত কাছাকাছি যে হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যাবে। তারা নিজেরা নিজেরা আলাপচারিতায় মগ্ন থাকে। সেও তাদের সঙ্গে অন্তরের ভাষায় আলাপ করে নিঃশব্দে। তাদের সাড়া স্পষ্ট সে শুনতে পায়। তবে এখন সে গুহায় গিয়ে একটা মোম জ্বালাল। তার একমাত্র ঝোলাটির মধ্যে ভরে নিল যা যা সম্বল—- বাড়তি পোশাক, মোম-দেশলাই, কিছু শুকনো খাবার ইত্যাদি। সব গুছিয়ে নিতে দশ মিনিটও লাগল না। তারপর সে মোম নেভাল। আবার গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এল খোলা প্রকৃতির বুকে।
পরদিন খুব ভোরে যাত্রা শুরুর তোড়জোড়। সে তার আগেই চলে গিয়েছিল পবন আর ভৈরবদের ডেরায়। গিয়ে দেখে, ভেড়াদের তৈরি করছে দু’ভাই মিলে। কুকুরগুলি ছুটে ছুটে সাহায্য করছে তাদের কাজে। যেসব ভেড়ারা তখনও ঘুমিয়ে তাদের কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে ঠেলে তুলল কুকুরেরা এবং যারা এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তাদের বাধ্য করল সারিবদ্ধ হতে। এভাবে সমস্ত ভেড়া আর ছাগলেরা মিলে একটি লম্বা সারি তৈরি হল। সে যেতে দু’ভাই এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানাল তাকে এবং বলল যে আজ অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। লক্ষ্য দিনে দিনেই হামতা গিরিপথে পৌঁছে যাওয়া। ভেড়ার দলকে তৈরি করার পর প্রাতঃরাশ সেরে নিল সবাই মিলে। তেমন কিছু আহামরি নয় খাদ্যোপকরণ, সাধারণ বার্লিচূর্ণ মাত্র। তাই খেল তিনজনে। আর সে তার ঝোলা থেকে কিছু শুকনো ফল বার করল সবার জন্য। তারপর যাত্রা শুরু। তখনও সূর্যের দেখা নেই। আবছা দেখাচ্ছে চারপাশ। হুইসেল বেজে উঠল ভোরের নিস্তব্ধতা খান খান করে। এবার ভেড়ার দল নিয়ে কেবলই এগিয়ে যাওয়া। যেতে যেতে কথাও হচ্ছিল। পবন বলল,
‘কত পুরুষ ধরে আমরা এখানে আসছি সে হিসেবে নেই আমাদেরও। শুনেছি অনেক আগে আমাদের পূর্বপুরুষ তিব্বতেও চলে যেত। এখন আর ওখানে যাওয়ার উপায় নেই, কারণ তিব্বত এখন বিদেশ।’
কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলা। সূর্য ওঠার আগে পর্যন্ত ঠাণ্ডার প্রকোপ যথেষ্ট ছিল। গায়ে চাদর জড়িয়ে নিয়েছিল তারা। ভেড়ার দল যাতে চলার পথে বিশৃঙ্খলা না সৃষ্টি করে কুকুরের দল সেই পাহারায় ছিল। দুপুরে পাহাড়শৃঙ্গে ঘেরা এক চাতালে বসে আবার খেয়ে নেওয়া এবং বিশ্রাম। খাবার মানে সেই বার্লিচূর্ণ আর তার ঝোলা থেকে বার করা শুকনো মিষ্টি। খেতে বেশি সময় নেওয়া হল না। আবার চলা শুরু। পবন বলছিল,
‘আমাদের ছেলেরা আর এই পেশাতে থাকতে চায় না।’
তার হতাশ গলায় আক্ষেপের সুর। সে কারণটা জানতে চাইল। উত্তরে পবন জানাল,
‘আসলে কী জান, আমাদের ছেলেরাও শহরে গিয়ে সেখানকার চাকচিক্য দেখে ওইরকম শহুরে জীবনকেই পছন্দ করছে। তারা আর ভেড়ার পাল নিয়ে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে চায় না। তারা চায়, পড়াশুনা শিখে চাকরি করবে। সবাই অন্য সব পেশায় চলে যাচ্ছে। কেউ হচ্ছে গাইড, কেউ টিচার, কেউ লেবার এমনই সব। শহুরে হাওয়া ঢুকেছে গ্রামেও। আমাদের পুরোনো দিনগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে এসে গেছে কথা বলা যন্ত্র, ওই যাকে বলে মোবাইল।’
তার গলায় কি দুঃখের আভাষ ? বোধহয় সে মেনে নিতে পারছিল না গ্রামে আধুনিকতার প্রবেশ, পিতৃ-পিতামহের সযত্নলালিত জীবনযাপনের নিয়ম তাতে হারিয়ে যাচ্ছে। তার ভাই ভৈরব বলল,
‘সরকারও চায় না আমাদের এই পেশা থাকুক। জঙ্গল ছিল আমাদের, সরকার এসে তা কেড়ে নিয়েছে। সরকারি লোক বলে দেয় আমরা কোন্ পথ ধরে যাব, আমাদের চালু পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। কোন্ ঘাসজমিতে যাব, গিয়ে কতদিন থাকব তাও ঠিক করে দেয়। বনদপ্তর আবার প্রত্যেক ভেড়া ও ছাগলের জন্য ট্যাক্স নেয়। আবার ওই যে একদল লোক হয়েছে, যারা পরিবেশবিদ, তারা বলে আমাদের জন্য পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সেই সুদিন আর নেই তাই এখন। ছেলেরা তাই অন্যকিছু করতে চায়।’
তাদের সুখদুঃখের আলাপের সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে যায়, তাদের আক্ষেপ সে নিজের মনে করে। এই অঞ্চলের ইতিহাস থেকে সে জানে যে ব্রিটিশ রাজত্বে আঠেরোশ’ পঁয়ষট্টি সালে চালু হয়েছিল ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট যে আইনবলে কাংড়া জেলার জমিবন্টন ঠিক হয় এবং সংরক্ষিত বনভূমির কথা ঘোষণা করে বিদেশী সরকার ভূমিপুত্রদের জানিয়ে দেয় যে সরকারই বনাঞ্চল, জমিজমা, নদীনালা, পাহাড়-পর্বতের প্রকৃত মালিক। কোন ঈশ্বর বা প্রাকৃতিক শক্তি অথবা কোন মানবপ্রজাতি কিংবা উপজাতির পিতৃপুরুষ কোনকালে এ সমস্ত কিছুর অধিকারী ছিল না বলে তাদের উত্তরপুরুষেরও এসবে কোন নিজস্ব অধিকার নেই। পৃথিবীর একেকটি দেশ একেকটি ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে নির্ধারিত এবং সেই দেশের সরকার সেই সীমানাস্থিত সমস্তকিছুর একচ্ছত্র অধিকারী, বাসিন্দাদেরও অবশ্যই। যদি তুমি যে দেশের সীমানায় বসবাস কর তার বিধিনিয়ম না মান তাহলে তুমি দেশদ্রোহী বলে বিবেচিত হতে পার। তুমি কে, কী ছিল তোমার অতীত আধুনিক সভ্যতা তা গ্রাহ্য করে না। যে যুগের যা নিয়ম তাই তোমাকে মানতে হবে এবং এখানে কেউ ভূমিপুত্র নয় ও কেউ কোন অঞ্চলের মালিক হতে পারে না উত্তরাধিকার সূত্রে। গাদ্দিরা ভাবত, এলাকার সমস্ত বনাঞ্চল ও চারণভূমি স্বয়ং দেবাদিদেব শিব তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।এখন তারা ব্যাপার দেখে বোকা বনে গেল। শিব কোথায়, সরকার তো মনে হচ্ছে তাদের পালনকর্তা। এটা মানতে তাদের কষ্ট হলেও না মেনে উপায় ছিল না। মানুষ যত সভ্য হতে থাকে তত তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়, স্বাভাবিক নিয়ম, প্রাচীন প্রথাসমূহ সভ্যসমাজে চলতে দেওয়া যায় না। তাহলে তো আদিমানৰ গোষ্ঠীর নরমাংস ভোজনকেও মেনে নিতে হয় ! নিয়মের বেড়াজাল ও আইনকানুন যত বেশি চালু হবে ততই জগৎ বুঝতে পারবে যে সভ্যতা এগিয়ে চলছে। সেসব আইন কারা বৃদ্ধাঙ্গুষ্টি দেখাবার কৌশল বা ক্ষমতা করায়ত্ত করতে পারছে কি পারছে না তার নিরিখে সভ্যতার অগ্রগমন যাচাই করা অনুচিত। মোটকথা হল, ওই আইনবলে এটাই গাদ্দিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এখন থেকে কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দেবে কে কোন্ চারণভূমিতে যাবে এবং কোন্ কোন্ অঞ্চলে বা কোন্ কোন্ পথ ধরে। বনাঞ্চল বা চারণভূমির ওপর আর তাদের বর্তনদারি অধিকার বা প্রথাগত দখল রইল না। দেশ স্বাধীন হল। দেশে প্রতিষ্ঠিত হল দেশীয় সরকার। কাংড়া জেলা চলে এল দেবতাদের নিজস্ব চারণভূমি হিমাচল প্রদেশের অধীনে প্রাক্তন পাঞ্জাবের অধিকার থেকে। গাদ্দিরা কী আশা করল, কী পেল ? উনিশশ’ বাহাত্তর সালে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে আবার এক আইন জারি হয়ে ভেড়াদের পাল কতবড় হতে পারবে সেই আকার জানিয়ে দেওয়া হল আর বলা হল, যেহেতু সরকারের মালিকানাধীন চারণভূমি তারা ব্যবহার করছে তাই প্রতিটি ভেড়া ও প্রতিটি ছাগলপিছু তাদের কর দিতে হবে সরকারকে এবং প্রত্যেকটি দলকে দেওয়া হবে সরকারের তরফ থেকে পারমিট বা অনুমতিপত্র যা প্রতিবছর পুনর্নবীকরণ না করলে তার সেই পথ বা চারণভূমি সরকার ইচ্ছে হলে অন্যকে দিয়ে দিতে পারে। বিদেশি শাসকদের জারি করা আইন তো তারা চলে যাওয়ার পরও বহাল রইল, উপরন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে এল এই নতুন আইন যাতে ভেড়া চড়িয়ে যে স্বল্প আয় হয় তারও হিস্যা দাবি করল সরকার। তার চেয়েও বড় কথা, এই নতুন আইন গাদ্দিদের মধ্যে লোভী হওয়ার এবং বিভেদ সৃষ্টি করার বীজ গুপ্তভাবে সুকৌশলে বুনে দিল, তাদের সামনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটাবার সম্ভাবনা সৃষ্টি করল যা তারা এতদিন জানত না। মানুষ যতই ভাল হোক, যতই আদিম উপজাতিরা নিজস্ব নিয়মে সৎ ও বিশ্বাসী থাকতে চেষ্টা করুক না কেন সরকার যদি তাদের অসৎ হওয়ার ইন্ধন জোগায়, সভ্য দুনিয়া যদি বিষপানে প্রলুব্ধ করে নতুন প্রজন্মকে নতুন প্রযুক্তির ওপরদেখানো মোহে তারা আর কতকাল খাঁটি থাকবে ? থাকে না কেউ চিরকাল। একটু চোখকান খোলা রাখলেই সবাই দেখতে পাবে কোন পার্বত্য শহর যা সভ্য মানুষের আনাগোনা শিখেছে জীবনের আধুনিক চালচলনে তারা আর কতটা সৎ আছে। হাতের কাছেই এমন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত অনেক দেখা যাবে। এই নতুন আইনের চক্রজালে পড়ে কোন গাদ্দি মেষপালকের মনে হতেই পারে যে তার বন্ধু অন্য মেষপালকের পথ ও চারণভূমি বেশি লোভনীয় এবং সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় রয়েছেই তার বন্ধু বিপদগ্রস্ত হলে আর সে তার পাশে না দাঁড়ালে তার অধিকার সে নিজের দখলে পেতে পারে। তবুও গাদ্দিরা ওই প্রলোভনে এখনও পর্যন্ত প্রভাবিত হয়নি। সরকারের কাজেকর্মে তাদের পিতৃপুরুষ লালিত বিশ্বাসভঙ্গের পরও তাদের মধ্যে আছে কেবল দুঃখ আর আক্ষেপ, রাগ নেই। তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না নিজস্ব রাজ্য বা স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা। এই দৃষ্টান্ত একটাই নয়, দশকের পর দশক ধরে সারা বিশ্ব দেখেছে এবং দেখছে এমনই কিছু উগ্রপন্থীদের রাগ আর হিংসে স্বভূমির দাবিতে। সেসব গাদ্দিরা জানেও না দেখতে যায়ও না। কিন্তু তাদের নতুন প্রজন্ম ? যারা শহরের সংস্পর্শে আসছে অন্যপেশার নেশায়, যারা শিক্ষার অন্তরালে বিষপান করে চলেছে ? যারা আন্তর্জালিক প্রযুক্তি আর কথা বলা যন্ত্রের ভোজবাজিতে মুগ্ধ হচ্ছে ? আসলে জানার পরিধি যত বাড়বে ততই বেশি সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটা সভ্যতার নিয়ম। তবুও গাদ্দিরা এখনও পর্যন্ত নিজেদের সেই নিয়ম থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে এটাই বড় সৌভাগ্যের কথা। কতদিন পারবে, সেই নেতিবাচক চিন্তা ভুলে গিয়ে বরং ইতিবাচক বিষয়টাই দেখা যাক। সভ্য মানুষ তাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের বনাঞ্চল ও চারণভূমি থেকে উৎখাত করার পরও সেই সভ্য পৃথিবীর প্রতিনিধিস্বরূপ যে ট্রেকার বা পর্বতারোহীরা তাদের ভূখণ্ডে যায় তারা সবাইকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাদের সাধ্যমত খাবার না খাইয়ে ছাড়ে না, এতটাই অতিথিপরায়ণ তারা। আসলে একটু আগে কলুষিত যেসব পার্বত্য শহরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হল তা শুধু সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে যে জগতে চিরকালই চোরের মায়ের বড় গলা। যেসব উগ্রপন্থী অধিবাসীরা কোন অঞ্চলকে যখন তাদের স্বভূমি বলে দাবি করে তখন তারা কি দেখে তারা মূলত ছিল কোথায় বা কিভাবে সেখানে তারা এসেছিল ? অথবা তারা তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্য কাউকে তাদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করছে কিনা। কেবল তারাই নয়, এ জবাব দিক তারাও যারা তাদের পক্ষে জনমত তৈরি করে। সারা পৃথিবীকে তাহলে বলতে হবে বলতে হবে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি থেকে রেড ইন্ডিয়ানরা গেল কোথায় বা কেন। এবং একই প্রশ্ন থাকবে আফ্রিকার সাভানা ঘিরে রাখা দেশগুলির কাছে, মাসাই অথবা বুশম্যানদের কী হল। আসলে গায়ের জোর যারা দেখায় তারা একটা কথা জানে না বা জানতে চায় না যে জগতে সবাই উড়ে এসে জুড়ে বসা। গাদ্দিদের প্রাক্তন পুরুষদের অধিকারেও হাত দিয়েছে উড়ে এসে জুড়ে বসা সভ্য মানুষ।
পবন, ভৈরব ও তাদের ভেড়ার পালের সঙ্গে সে চলছিল রুক্ষ, শুষ্ক স্পিতি ভূখণ্ডের গায়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এক রহস্যময় পথরেখা ধরে। খোলা আকাশের বিশুদ্ধ নীল এবং ধারে ধারে পাহাড়ের খাদ বা শৃঙ্গদেশের গা আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বা ঝুলন্ত পাথরের গুহাসদৃশ টানেলে হাওয়ার চলাফেরায় কী কথা কানাকানি চলছিল তা আর এখন বোঝার উপায় নেই, যেহেতু তার সামনে এখন পার্থিব কণ্ঠগুলি সজীব ও সক্রিয়। সে প্রকৃতির গোপন কথা শোনে যখন নিঃসঙ্গ থাকে, যখন অন্য আওয়াজের সংস্পর্শ পায় না। এখন তার কানে থাকছে নানারকম সাংসারিক আলাপ, এমন পরিস্থিতিতে নীরব দেবতাদের অথবা প্রকৃতির কণ্ঠ শোনার পরিবেশ থাকে না। তবে সনাতন শাস্ত্রীয় বাণী অন্তরস্থ করে সে জানে যে কোন শব্দই অগ্রাহ্য করার নয়, কারণ সমস্ত শব্দই মহাজাগতিক আদিতম বিস্ফোরণে জাত, যেখানে রয়েছে অনন্ত ব্রহ্মরূপ শব্দসসমূহের মূল নিনাদ বা প্রতিধ্বনি। তাই সে উপভোগ করছে পার্বত্য ঢালের সংকীর্ণ পথ ধরে চলমান ভেড়ার দলের সম্মিলিত খুরের আওয়াজ, তাদের ঘন ঘন ব্যা-ব্যা ডাক আর গলায় বাঁধা ঘন্টাগুলির টুং-টাং ধ্বনি। আর তাদের পাহারায় থাকা লোমশ গা-ওয়ালা কুকুরগুলির ঘেউ-ঘেউ স্বর এবং নানা কারণে পবন বা ভৈরবের বাজানো হুইসেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। চলার পথ কতটা মনোরম হতে পারে সে তা সমগ্র অন্তর দিয়ে বুঝল যখন সকালবেলা তারা পেরিয়ে যাচ্ছিল হামতা গিরিপথ। ঈশ্বর কী যত্নে কী পরম মমতায় সাজিয়ে রেখেছে তার পার্থিব উদ্যান। হামতা গিরিদ্বার ঘিরে রেখেছে দূরে দূরে স্থায়ী বরফে ঢাকা হিমশৈল, শিশু সূর্যের জন্ম নেওয়া সেখানে ঘোষিত হচ্ছে আগুনরঙা গনগনে আভায়। যাওয়ার পথে এক জায়গায় প্রশস্ত বালির চত্বর বালু কা ঘেরা নাম, আর পার হতে হল উচ্ছ্বসিত শুভ্রধবল হিমশৈলজাত পার্বত্য নালা, বোল্ডারে বোল্ডারে ধাক্কা খেতে খেতে চলেছে যাদের হিমশীতল জলধারা তীব্রবেগে। গিরিদ্বারের ওপর রীতিমত এক বালির সমুদ্র, মরুভুমি বলেই ভ্রম হয়। তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পথরেখা চেনে পবনরা, কেবল তারাই জানে। পাহাড়শৃঙ্গের শায়িত ঢালের গা মনে হয় সবুজাভ এবং প্রস্তরাকীর্ণ সরু উপত্যকার পথে পথে কালচে লাল ঝুঁটিওয়ালা বুনো পার্বত্য ফুলের শোভা চতুর্দিকে। চোদ্দ হাজার ফিট উচ্চতায় গিরিদ্বার দু’টি ভিন্ন জগতের মধ্যে দেয়াল তুলে রেখেছে। একধার তার নগ্ন পাহাড়গাত্র নিয়ে শীতল পার্বত্য মরুভুমি স্পিতি উপত্যকা এবং অন্যধারে রয়েছে সবুজ কুলু উপত্যকা, যেখানে আছে আপেল উদ্যান, দেওদার ও ওক, বার্চ ইত্যাদি গাছের জঙ্গল। ওই কুলু উপত্যকাই পবন ও তার পালের লক্ষ্য। গিরিপথ ধরে শুষ্ক স্পিতি উপত্যকা ছাড়িয়ে তারা সবুজ কুলুভ্যালি যাওয়ার পথে দেখে গেল চন্দ্রতাল লেকের শোভা, নগ্ন ও মৌন রক্তাভবর্ণ হলদেটে ধূসর তরঙ্গায়িত পাহাড়ের ঢাল দিয়ে ঘিরে রাখা নীলবর্ণ জলের গোলাকার বৃত্ত। দেবকন্যারা কি এখানে জলবিহার করে এখনও, ভাবল সে। হামতা গিরিদ্বারের ওপাশে পথরেখা চলে গেছে সবুজ সংকীর্ণ প্রান্তর ধরে, দু’পাশ ছাওয়া সবুজ পাহাড়ি ঢালে। সেই সবুজ জনশূন্য পার্বত্য প্রান্তরের আপন কোলে দেখা গেল মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে বুনো ঘোড়া ও পনিদের দল। এই অপরূপ দৃশ্য আর কোথায় পাওয়া যাবে ?
রাতে উপত্যকার বুকে খোলা আকাশের তারাদের তলায় তাঁবু খাটিয়ে নিল তারা। তাঁবুর সামনে আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে রাখল। ভেড়া এবং তাদের পাহারায় সারারাত সজাগ থাকবে প্রহরী কুকুরগুলি, তাদেরও দেখে মনে হচ্ছিল কতকালের চেনা, বুঝিবা অন্য কোন চেহারার দেবদূত। আগুনের কুণ্ডের পাশে বসে তিনজন। ছাগল দুইয়ে দুধ নিয়ে আসে ভৈরব। বার্লি দিয়ে রুটি বানানো হয়, দুধ আর রুটি খায় তারা। খেতে খেতে গল্প তাদের। পবন বলে,
‘সরকার আমাদের কথা ভাবতেও পারে। কেউ তো ভাবে না। বনদপ্তরের খাকি পোশাক পরা সরকারি গার্ডরা এইসব বনে-প্রান্তরে আমাদের ওপর চোখ রাঙ্গায়। আবার ভেড়ার পাল নিয়ে যেতে হয় মাঝেমধ্যেই সরকারের বানানো পাকা রাস্তা ধরে। সেখানে গাড়ির ড্রাইভাররা বিরক্ত হয় তাদের থেমে যেতে হয় বলে। পর্যটকরা ভাবে, এখানে এসব জংলী আপদগুলি আসে কেন ! খাকি পরা ট্রাফিক পুলিশরা চোখ রাঙ্গায়। আমরা কোথায় যাই বলতো ? তাই ছেলেরা আর এই পেশায় থাকতে চাইছে না। আবার দেখ, ভেড়ার গা থেকে যে উল পাই, যে মাংস পাই, ছাগলরা যে চামরা দেয় তা ভাল দামে বেচার কোন জায়গা নেই। আমরা বাধ্য হই কম দামে স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ী আর দালালদের কাছে তা বেঁচে দিতে। এই তো আমাদের অবস্থা।’
সে নিঃশব্দে শোনে তাদের দুঃখের কথা। কোন শব্দ উচ্চারণ করে না। শোনে নিঃস্তব্ধ রাতের অন্ধ ঢাল, নির্জন ও সংকীর্ণ উপত্যকার গা আর এক আকাশ ভর্তি তারকার দল। হিম হাওয়া খেলা করে যেতে যেতে বুঝিবা একটু চুপ করে থেমে শোনে, কুকুরগুলি কখনো কোন অপার্থিব শিহরণ উপলব্ধি করে সাড়া দিয়ে ওঠে নিজেদের অজান্তে, ‘ভৌ-ভৌ’। জ্বল জ্বল জ্বলতে থাকা শুকনো কাঠের আগুনে আধিভৌতিক দেখায় নিজেদেরই অবয়ব। এক স্বপ্নাচ্ছন্ন মায়াবী রাতের অবিশ্বাস্য প্রহরে তারা গল্প করে। ভৈরব জানায়,
‘আমাদের পূর্বপুরুষ নিজেদের ধর্ম, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য রক্ষার তাগিদে পালিয়ে এসেছিল এই পাহাড়ি জঙ্গলে সমতল থেকে। তখন সরকার কোথায় ? আমাদের অনেকেই আবার ভাবে তাদের পূর্বপুরুষ ছিল আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীতে।’
সে বোঝাতে চায় গ্রিক সাম্রাজ্যপিপাসু সম্রাট আলেকজান্ডারকে। সমতলে যখন ছিল তখন যেমন এখনও তেমনি তাদের মধ্যে রয়ে গেছে জাতপাত। তারা সেই প্রাচীন সংস্কৃতি এখনও লালন করে। তারা কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ রাজপূত ভাট ব্রাহ্মণ, যেখান থেকে এসেছে ভট্টাচার্যরা। পুরোনো এইসব প্রথা ও গৌরব আর কতদিন বজায় থাকবে ?
এই অবিশ্বাস্য পরিবেশে এই রাতকে মনে হয় অলৌকিক, বুঝিবা অন্য কোন গ্রহে উপস্থিত তারা সবাই গল্পে মত্ত। রাতের বুকে ঘুরে বেড়ায় অমানুষিক ইশারা, রাত কথা বলে সেই ভাষায়। তা বোঝা যেত রাত কী বলে যদি সে সঙ্গীহীন হত আর রাতকে পেত সঙ্গী হিসেবে। স্পিতি উপত্যকায় আসার পর প্রথম প্রথম রাত্রির নিঃসঙ্গ নির্জন পরিবেশ তাকে পাগল করে দিত, রাত্রির অন্ধকার নামার কথা ভাবলে তার বুক ভয়ে কেঁপে উঠত। আসলে তা ছিল দীর্ঘদিনের অভ্যেসের ফল, মানুষের সঙ্গ তৈরি করেছিল এই অভ্যেস। নিঃসঙ্গ থাকতে থাকতে মানুষ একদিন নিঃসঙ্গতাকেই সঙ্গী করে নেয়। একা থাকা তখন আর অসহায় মনে হয় না। আজ তো একদণ্ড মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ল্যাপটপ, সমাজমাধ্যমের সাহচর্য না থাকলে জীবন অবহ লাগে। আদিম মানুষ তাহলে কিভাবে কাটাত তার সারাদিন, যখন সে সমাজ তো দূরের কথা, রচনা করতে শেখেনি পরিবারও ? এখানে এতদিন নিঃসঙ্গ থাকতে থাকতে সে ইদানীং সেই পুরোনো অভ্যেস ভুলে গেছে। এখন সে আর রাতকে ভয় পায় না, বরং কখন রাত আসবে তার অপেক্ষাতেই থাকে, কারণ রাত্রি অনেক রহস্যে মোড়া, অনেক তার গোপনীয়তা, কল্পনাকে দিনের চেয়ে রাতেই বেশি প্রশ্রয় দেওয়া যায়। আর রাতের আকাশ ভরে রাখে অন্যান্য সব সুদূর অকল্পনীয় জগতের আন্দাজ, তারকাদলের গায়ে অনুমান করা সম্ভব যাদের বিবরণ।
খাওয়া শেষ করে আগুনের উষ্ণতা নিতে নিতে তারা গল্প করে আর কল্কেতে করে হুকো টানে ভৈরব। সেই তামাকে কিছু পরিমাণ গাঁজাও থাকে। তবে এমন একটু গাঁজা খাওয়া তাদের বিশ্বাসে পাপকাজ নয়, যেহেতু গাঁজা ও ভাঙ্গ পছন্দ করে স্বয়ং শিব। এই যে কৈলাশ পর্বতের পাদদেশে বেষ্টন করে তাদের বাসস্থান রচনা করেছিল পূর্বপুরুষরা, সে তো শিবেরই গ্রীষ্মকালীন প্রিয় বাসস্থান। তারা ভাবে শিব তুষ্ট থাকলেই জগৎ তুষ্ট, শিব রুষ্ট হলে দেখা যায় প্রকৃতির রুদ্ররূপ। আর শিবকে সন্তুষ্ট রাখতে তারা তাকে গাঁজা ভোগ দেয় এবং সেই প্রসাদ নিজেরাও পান করে। এই অর্থে গাঁজা খাওয়া তাই তাদের কাছে পবিত্র কাজ আর তাকেও তারা হুকো এগিয়ে দেয় গাঁজা খাওয়ার জন্য। সে যদিও তাদের কোন আবদার অমান্য করে না, তবুও হুকো খেতে পারে না, গাঁজা খাওয়াতে তার প্রবল আপত্তি বলে। তারা অবশ্য তাকে বিশেষ জোরাজুরি করে না এই ব্যাপারে, কারণ তারা জানে সে তাদের খুবই কাছের মানুষ, বন্ধু। আর তারও কিছু ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে।
আগুন ক্রমশ কমে আসতে থাকে। তা আর বিশেষ বাড়তে দেওয়ার তাড়া থাকে না যেহেতু কুকুরগুলি জেগে থাকবে পাহারায়। এবার তারা তাঁবুতে ঢোকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য, পরদিন আবার ভোরে শুরু হবে যাত্রা। শহরগুলিতে এখন হয়তো সন্ধে, কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে যেন মধ্যরাত। তাঁবুতে ঢুকে তারা মাদুরের ওপর শুয়ে পরে চাদর গায়ে জড়িয়ে। রাত্রি নিঃশব্দ হতে থাকে।
হঠাৎই কুকুরগুলি বড় বেশি ডাকাডাকি শুরু করে। তাদের ঘুম ভেঙ্গে যায় এত হাঁকডাকে। তারা বোঝে, কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। তাই কুকুরগুলি এত চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। তারা তিনজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে আসে তাঁবু থেকে। তখনও আগুনের অবশেষ ধিকি ধিকি জ্বলছিল। কুকুররা কাছেই এসে ডাকছে, যেন তাদের কিছু একটা বলতে চায়। তারা বাইরে এলে কুকুরগুলি হাবভাবে বোঝায় তাদের সঙ্গে যেতে। খানিকটা দূর যাওয়ার পর যা আবিষ্কৃত হল তাতে সে বেশ অবাক। দেখা গেল, কয়েকটি ছাগল কিসের যন্ত্রণায় যেন ছটফট করছে। সে কিছুই বুঝতে না পারলেও পবন আর ভৈরবের অভিজ্ঞ চোখ সব বুঝে নিতে এতটুকুও সময় নিল না। একটু তাড়া দেখা গেল তাদের মধ্যে, আলোর ব্যবস্থা করা হল তৎক্ষণাৎ। ভৈরবের কথা থেকে সে জানতে পারল যে ছাগলগুলির প্রসববেদনা দেখা দিয়েছে। দুই ভাই ধাত্রী হিসেবে কাজ করল, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। কুকুরগুলি এখন শান্ত হয়ে ঘুরছে বা শুয়ে আছে। তারা তাদের দায়িত্ত্ব পালন করে পরিতৃপ্ত। প্রসব হওয়া বাচ্চাগুলিকে পরিচ্ছন্ন করে কম্বলে জড়িয়ে রাখল ভৈরব। মোট ন’টি ছাগল বাচ্চা দিল একসঙ্গে। সব গুছিয়ে-টুছিয়ে শুতে শুতে খানিকটা দেরিই হয়ে গেল। শুতে যাওয়ার আগে পবন তার ভাইকে জানাল,
‘কাল খুব বেশি যাওয়া চলবে না। সদ্য মা হওয়া ছাগলগুলি বেশি হাঁটলে তাদের দুধ শুকিয়ে যাবে। বাচ্চাগুলি তখন দুধ না পেয়ে মারা যাবে। তাতে খুবই ক্ষতি হবে।’
অতএব ঠিক হল, পরদিন আর বেশি পথ অতিক্রম না করে বরং ভাল ঘাসজমি খুঁজে ছাগল আর ভেড়াগুলিকে খাওয়ানো হবে। বিশ্রামও হবে তাদের। আগে ঠিক করা ছিল যে দু’-তিনদিনের মধ্যেই কুলু পেরিয়ে গাদ্দিদের গমনপথ দুপ্পু চলে যেতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব কালিহানি গিরিদ্বার পার হওয়া হবে মূল লক্ষ্য। যেকোন দিন তুষারপাত শুরু হতে পারে। তাতে বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এখন সেই সিদ্ধান্ত একটু ঝুঁকি থাকলেও একটু পাল্টানো প্রয়োজন মনে হল, ছাগল মায়েদের কথা ভেবে। আসলে মানুষ এভাবেই শুরু করেছিল পৃথিবীর বুকে চলাচল,পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। প্রকৃতি ও জীবজন্তুরা বুঝবে আমাকে, আমি বুঝব তাদের। এই পারস্পরিক সহযোগিতা না থাকলে পৃথিবী এমন পৃথিবী হয়ে উঠত না, বুধ বা বৃহস্পতি অথবা নেপচুনের পরিবেশও এখানে থাকতে পারত। মানুষই প্রথম প্রাণি বোধহয় এই পার্থিব জগতে যার মধ্যে এই সহমর্মিতা জীবন্ত ছিল একদিন যে কেউই এখানে আমার শত্রু নয়, বসুধৈব কুটুম্বকম। এই সহমর্মিতা জলাঞ্জলি হল এমন অত্যাধুনিক মানুষের আগমনে যারা ভাবতে শুরু করেছে, তারাও বিশ্বগঠন করতে পারে। কী এক তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব করায়ত্ত করল তারা যা তাদের মদমত্ত করে তুলেছে এবং তারা আক্ষরিক ভাবেই এমন অহংকারে ব্যতিব্যস্ত যে ভাবে তারাই আসলে ঈশ্বর। যখন কেউ নিজেকে ভগবান ভাবতে থাকে সে হয়ে যায় লঙ্কাধিপতি রাবণ, তার পিতৃপুরুষ তার অপরাধে পরিণত হয় রাক্ষসে অথবা দানবে।
পরদিন কাকভোরে ওঠা হল না অন্যদিনের মত। সদ্য প্রসব করা ছাগল মায়েদের কথা ভেবে, তাদের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। সকাল একটু গড়িয়ে যাওয়ার পর শুরু হল যাত্রা। সবুজ উপত্যকার গা ধরে। দু’দিকে পাহাড়ের সারিবদ্ধতা এবং খানিকটা পরে পাশে পড়ল এক ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে ওক, দেওদার, সিলভার বার্চ ইত্যাদি গাছের ভিড়। সেই জঙ্গল এড়িয়ে চলল তাদের ক্যারাভান, তাদের নিজস্ব পথরেখা তারাই চেনে। উৎরাই ধরে নেমে যাচ্ছিল পথ খুবই আলতো ঢালে, নেমে যে যাচ্ছে বোঝার কোন উপায় ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন সংকীর্ণ উপত্যকার সমতল সবুজ বিছানা ধরে যাচ্ছে তারা। চতুর্দিকে ফুলের মেলা। লালচে আবার শুভ্র খয়েরি থোকা থোকা ফুল অথবা মোরগঝুটির মত দণ্ডবিশিষ্ট এবং আরও নানা চেহারার নানান রঙের ফুল ছেয়ে রেখেছে সমস্ত উপত্যকা যতদূর চোখ যায়। এই কাননকে কে সাজাল এমন যত্নে, ভাবছিল সে। বাতাস মুখরিত ছিল সেইসব বুনো পাহাড়ি নাম নাজানা হাজার প্রজাতির পুষ্পরাজির প্রসন্ন সৌরভে। এমন বাগান কেন কে কী উদ্দেশ্যে সাজিয়ে রেখেছে এমন দুর্গম অঞ্চলে যেখানে কোন মানুষ আসে কদাচিৎ ? সে একা থাকলে এই প্রশ্ন রাখত এই আশ্চর্য ফুলবাগানের কাছে, ফুলেদের কাছে এবং সে জানে সে উত্তরও পেত। এখন সেই উপায় নেই বলে সে নিজেই উত্তরটা খুঁজে নিল। আসলে সমগ্র বিশ্বজগৎ তো বটেই, এই অতি ক্ষুদ্র পৃথিবীও সাজিয়ে রেখেছে কোন বিশ্বনিয়ন্তা তার সৃষ্টিসুখে। সেই বিশ্বপিতার নিজস্ব উদ্যান এখানে সুসজ্জিত তার আপন হাতে আপন খেয়ালে আপন আনন্দে। মানুষ তা দেখল কি না দেখল তাতে বয়েই গেল তার। সে তার সৃষ্টিকর্মের জন্য একদল স্বার্থান্বেষী মদমত্ত জনতার কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়নি, তেমন কোন ইচ্ছেও নেই তার। থাকলে সে এই উদ্যান সাজিয়ে রাখত কোন মেট্রো সিটির বুকে, অত্যাধুনিক মানুষের কাছে পিঠ চাপড়ানি আর প্রশংসা পাওয়ার জন্য। সে তা করেনি, সে তার সৃষ্টির সৌন্দর্য্য রেখে দিয়েছে তার অন্তরের গহনে। যদি কারো আন্তরিক ইচ্ছে থাকে তাহলে সে তা উপভোগ করতেই পারে। সে লোক হতে পারে কোটিতে গুটিক, তাতে তার ভ্রূক্ষেপ নেই, কারণ সে জানে জগতে প্রকৃত গুণী মুষ্টিমেয় কয়েকজনই হয়, আপামর জনতা নয়। তাই তার দরকার নেই আপামর জনতার তারিফ বা জনপ্রিয়তা। তাই সে উদ্যান রচনা করে সভ্য মানুষের মেকি কৃত্রিম জনপদের অনেক দূরে। অনেক দূরেই সে সাজিয়ে রাখে জঙ্গল, মরুভুমি, পাহাড়-পর্বত-হিমশৈল বা উপত্যকা। সেসব নাগরিক মানুষের কাছে সহজলভ্য নয়। যে জীবন বাজি রাখবে এবং কষ্টসহিষ্ণু হতে পারবে তারই অধিকার আছে এসব সম্পদ উপভোগ করার। এবং এই নিয়মেই চলে প্রকৃত স্রষ্টা, সে জনপ্রিয়তার কথা ভেবে বা আপামর জনতার প্রশংসাবাণী পেয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপন্যাস লেখে না, সুর বা গান রচনা করে না, বা কবিতা লেখে না। সে সৃষ্টি করে নিজের প্রাণের আনন্দ প্রকাশ করার তাড়নায়। খ্যাতি বা অর্থপ্রাপ্তির প্রলোভনে নয়। তার সৃষ্টি কেউ দেখল কি না দেখল তার বড় বয়েই গেল ! সে নিজেই দেখেছে নিজেই আনন্দ পেয়েছে। যে দেখল না সে সেই সৃষ্টিসুখের উল্লাস থেকে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করল। তাতে স্রষ্টার কোন ক্ষতি হল না।
মোটেই তেমন তাড়াহুড়ো নয়, চলছিল তাদের দলবদ্ধ চলন খুবই মন্দগতিতে। তাতে হয়তো পরে কিছুটা বিপদেই পড়তে হবে, কারণ কালিহানি গিরিসংকট এখনও অনেকটাই দূরে, তুষারবৃষ্টি শুরু হতে পারে যেকোন সময়। হলে বড়োই বিপজ্জনক হয়ে যাবে কালিহানি গিরিদ্বার। ভেড়ার দল নিয়ে তা পেরিয়ে যাওয়ার সময় যে কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ওই বরফের রাজত্বে। তাতে পুরো দলই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এমন দুর্ঘটনা ঘটে না যে তা নয়। সভ্যমানুষ তার খবর রাখে না বিশেষ। তা জানে কেবল তারাই। একবার থামসার গিরিদ্বারে এমন দুর্ঘটনায় হারিয়ে গিয়েছিল তিনজন গাদ্দি মেষপালক ও তাদের আশিটি ভেড়ার দল। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সৌভাগ্যক্রমে থামসার পাস্ তাদের পার হতে হবে না। কালিহানি পাস্ পার হলেই বড়া ভাঙ্গাল যেখানে তাদের গ্রাম। থামসার পাস্ পেরিয়ে যেতে হয় ছোটা ভাঙ্গাল। সেটাও গাদ্দিদের অন্য একটি গ্রাম। তবে এতেও আত্মতুষ্টির কোন জায়গা নেই, কারণ কালিহানি পাস্ তুলনায় থামসার পাসের চেয়ে বেশি উঁচু ও মোটেই কম বিপজ্জনক নয়। হাজার সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে এবং ঘটেও। তবুও ছাগল মায়েদের কথা ভাবতেই হবে। ভাবার কোন উপায় থাকত না যদি তাদের গ্রামে যেতে দু’টো পাস্ই পেরোতে হত, এই যা সান্ত্বনার কথা।
পবন আর ভৈরবদের সঙ্গে যেতে যেতে তার মনে হচ্ছিল, আসলে এই সরল সাদাসিধে গাদ্দিরাই স্বাভাবিক মানুষ, জগৎজোড়া অস্বাভাবিক মানুষের ভিড়ে, তারা নির্ভিক যোদ্ধা যেহেতু তারা চেনে প্রকৃতিকে, তারা জানে কী প্রকৃতির নিয়মকানুন। এই জানাটা পৃথিবীর যে কোনও অতিজ্ঞানী অহংকারী প্রাজ্ঞ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি বরণীয়। এই জ্ঞানকেই ভূষণ করেছিল বলে আদিমানব থেকে তার বংশধররা এমন এক সভ্যতা সৃজন করতে পেরেছে। এখন আত্মগর্বী মানুষ সেই পূর্বপুরুষদের কথা ভুলে গেছে। ভুলে গেছে তাদের জ্ঞান। থামল তারা চলার পথে যেখানে উপত্যকায় রয়েছে লম্বা ঘাসের বন। ইতিমধ্যে পথ পরিক্রমায় দু’দিন কাটতে চলেছে। পবন ঘাসগুলি পরীক্ষা করে দেখছিল। জিজ্ঞেস করতে তার ভাই ভৈরব জানাল যা তা হল সব ঘাস ভেড়া বা ছাগলদের খাওয়ার উপযুক্ত হয় না। কিছু ঘাস বিষাক্ত হতে পারে। সেই ঘাস চিনে নেওয়া জরুরী। বয়স্ক ভেড়াগুলি চেনে, কিন্তু কমবয়সী ভেড়ারা না চিনে খেয়ে ফেলতে পারে। তাতে মৃত্যু অনিবার্য। এভাবে মাঝেমধ্যেই দু’-চারটি ভেড়ার মৃত্যু হয় বিষঘাস খাওয়ার জন্য। ভুল করে বয়স্ক ভেড়ারাও খেয়ে ফেলতে পারে সেসব খিদের তাড়নায়। তাই নিরাপদ ঘাস চিনে নিয়ে তাদের খেতে দেওয়া হয় যেটা তারা দেখে অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারে যে-তৃণভূমিতে ভেড়াদের খাওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে তার ঘাস পুষ্টিকর কিনা। তাহলে আর বিপদ ঘটবে না। সেটাই করছিল পবন আর ভৈরব সতর্কতার সঙ্গে।
ভেড়া আর ছাগলরা তৃণভূমিতে ঘুরে মনের আনন্দে তাদের খাবার খাচ্ছিল। তারা তিনজনেও বসল এক সুবিশাল বোল্ডারের ছায়ায়। দুপুর হতে চলেছে। সূর্য মধ্যগগনে প্রায়। প্রকৃতির কোলে এই উদার তৃণভূমির একপাশে সবুজ পাহাড়ের গা, রয়েছে তার পাশে প্রস্তরাকীর্ণ জঙ্গলে ভরা খাদ, অন্য পাশে তৃণভূমি শেষ হয়েছে অদূরে ঘন গাছের জঙ্গলে। পাহাড়ের গায়েও গাছপালার ভিড় রয়েছে। সে ভাবছিল, এবার তারা কোন্ দিক ধরে চলবে। জঙ্গল শুরু হওয়ার মুখেও রয়েছে আরও সতেজ সবুজ তৃণভূমি। উপত্যকার সেদিকে দেখা যাচ্ছিল বরফাবৃত শৃঙ্গ। অনেকটা সমতল সেদিকে যাওয়ার পথ। ভৈরব তাকে বরফাবৃত পাহাড়ের গা দেখিয়ে জানাল যে ওটাই হল কালিহানি পাস্, সমতল তৃণভূমি গিয়ে শেষ হয়েছে যেখানে তার চেয়ে বড়জোর দু’-তিন ঘন্টার পথ হবে। সে ভাবল, ওই পথেই নিশ্চয় চলবে তারা। তাহলে আর চিন্তার কারণ কী ? আজই তো পেরিয়ে যাওয়া যাবে গিরিসঙ্কট ? কিন্তু পবন জানাল যে ওই সহজ পথে যাবে না তারা। তারা চলবে পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে এবং এই পর্বতগাত্রের ওপরেই রয়েছে প্রায় এগারো হাজার ফিট উচ্চতায় গাদ্দিদের নিজস্ব পথ দুপ্পু। দল যাবে ওই পথেই। কিন্তু এই সহজ পথ নয় কেন ? ওখানেও যেতে যেতে আছে আরও সতেজ তৃণভূমি যেখানে ভেড়ারা আরও খাবার পেত, এখনই চড়াইয়ের কষ্ট ভোগ করতে হত না। পবন জানাল, ওই সহজ পথ আসলে বিষম বিপদে ভরা। ওখানকার তৃণভূমিতে রয়েছে জোঁকেদের রাজত্ব। সেখান দিয়ে যাওয়া একদমই উচিত হবে না, আর পথও শেষদিকে কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। তাই সহজ পথ ছেড়ে কষ্টসাধ্য পথ ধরেই এগোতে হবে। ওই জোঁকের রাজত্ব যদিওবা মানুষের পক্ষে পার হওয়া সম্ভব, ভেড়াদের বিপদ হতে পারে। সে শুনে বুঝল, এটাই হল জীবনের নিয়ম। যে সহজে তোমাকে ধরা দিচ্ছে তাতে সন্দেহ আছে। তুমি কষ্ট আর শ্রম দিয়ে খেটে যা অর্জন করবে সেটাই হবে জীবনের মূলধন। তবে এই পথের পরেও কালিহানি গিরিদ্বারের যত কাছাকাছি যাওয়া যাবে তত বরফগলা জলে পথ কর্দমাক্ত হয়ে উঠবে এবং জোঁকেরাও থাকবে। তবে খুব বেশি নয়, তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যাবে। ভেড়া আর ছাগলদের খাওয়ার সময়ে তারা নিজেরাও দুপুরের খাবার খেয়ে নিল, কুকুরদেরও খাওয়াল। তারপর সদলবলে পাকদণ্ডী বেয়ে সরু পথরেখা অনুসরণ করে চলল তারা দুপ্পুর দিকে। কাছাকাছি অনামা প্রান্তর জুড়ে অপূর্ব ভূদৃশ্য সাজিয়ে রেখেছে অদ্ভুত গঠনের বিভিন্ন আকৃতির বোল্ডার। তখন বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। পবন জানাল যে রাতটা তারা এখানেই কাটাবে। হাতের নাগালেই তো গিরিদ্বার, এখনই তাতে চড়তে শুরু করলে মন্দ কী, ভাবল সে। বললও তার ভাবনার কথা। শুনে ভৈরব জানাল যে রাতে বা বিকেলে ওই গিরিদ্বার পেরোনোর ভাবনা পাগলামি। এমনকি বিকেলের পর বরফাবৃত পাহাড়ের গা বেয়ে ওখানে ওঠার ভাবনাও ঠিক নয়। বরফে ঢাকা গিরিসংকট পেরোলে পার হতে হবে দুপুর নাগাদ, কাল তা হওয়ার সম্ভাবনা যে নেই তা নয়। তার আগে ভাবতে হবে যে প্রায় পনের হাজার আটশ’ ফিট উচ্চতার গিরিদ্বারের মাথায় ওঠা দুপুরের মধ্যে সম্ভব কিনা। গাদ্দিরা পারবে, তাদের ভেড়ারাও পারবে না তা নয়। সে জানাল,
‘আমিও পারব।’
আগে হলে এতটা আত্মবিশ্বাস থাকত না তার গলায়, যখন সে শহরের বাসিন্দা ছিল।কিন্তু স্পিতি উপত্যকায় থাকা তাকে অনেককিছু শিখিয়েছে। তার কথা শুনে পবন ও ভৈরব সেটা অমূলক ভাবল না। পবন বলল,
‘তুমি পারবে জানি। তোমার সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু সদ্য মা হওয়া মা ছাগলগুলির কথা ভাবছি। তবে তারা এখন নিশ্চয় পারবে। তিন দিন আগে তো মা হয়েছে। আর পশু মায়েদের সক্ষম হতে বেশি সময় নেয় না মানুষ মায়েদের মত। প্রকৃতির নিয়ম।’
প্রকৃতির নিয়ম তো অবশ্যই, সে ভাবল। মানুষ মায়েরাও বোধহয় আদিতে এমনই ছিল, তাদের জন্যও এমনই প্রকৃতির সত্যি ছিল একদিন। যত নগরায়ন ও শিল্পায়ন ঘটল ততই মানুষ মায়েদের জন্য আর প্রকৃতির একই নিয়ম বহাল থাকল না। মানুষ মায়েরা চলে গেল ক্রমশ প্রকৃতির নিয়মের বাইরে, এবং আরও চলে যাচ্ছে ক্রমশ। মানুষের ক্ষেত্রে এখন শুধু চালু নাগরিক নিয়ম। প্রকৃতি হাতের বাইরে, অনেক দূরে।
দুপ্পু যেতে মানালি থেকে দিন তিনেক লাগে, সেটাই প্রায় লেগেছে। ছাগল মায়েদের বিশ্রামে রাখার পরও। আর এই ক’দিনে মায়েরা এবং বাচ্চাগুলিও বেশ সবল হয়ে গেছে। প্রথমে জন্মানোর পরদিন সদ্যপ্রসব হওয়া ছাগল শাবকদের চটের থলিতে মুড়ে সঙ্গে থাকা ঘোড়াদের পেটের সঙ্গে বেঁধে যাত্রা করতে হয়েছিল, সেরকম চটের থলি এমন প্রয়োজনের জন্য ছিল তাদের কাছে। এই সুদীর্ঘ ক্যারাভানের সঙ্গে ঘোড়াও ছিল দু’-তিনটে বাহন হিসেবে। কিছু কিছু স্থান এতটাই দুরতিক্রম্য ও দুর্গম যে ঘোড়ার পিঠে চাপতেই হয়। কুকুরদের মত ঘোড়াও তাই গাদ্দি প্রান্তরবাসীদের দীর্ঘ যাত্রাপথের অপরিহার্য সঙ্গী। সেই ঘোড়াদের পেটের তলাতেই চটের থলেতে বাঁধা ছিল সদ্যপ্রসূত বাচ্চাগুলি। এখন তারা ভালোই চলতে-ফিরতে পারছে নিজেদের পায়ে। অতএব কাল ভোরবেলা উঠে দেখতে হবে কতটা কী সম্ভব।
সন্ধে থেকেই আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন।কালিহানি পাস্ বিকেলের পর ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেল। কে আকাশ আর কে পাহাড় বোঝার উপায় ছিল না। পবনের মুখে একটা কথা শুনে সে নিশ্চিন্ত হল যে ইতিমধ্যেই তারা দশ থেকে এগারো হাজার ফিট উচ্চতা উঠে এসেছে গতদিন এবং আজ মিলিয়ে। কালকে থেকে পথ আরও পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হবে। এখন ঠাণ্ডা ও দুর্যোগের হাত থেকে রেহাই পেতে তারা আশ্রয় নিয়েছে বিশাল একটি বোল্ডারের আড়ালে। মেঘেরা সবাই আকাশের গায়ে নিচু স্তর দিয়ে যাওয়ার সময় কালিহানি গিরিদ্বারের গায়ে ধাক্কা খেয়ে যাচ্ছিল। বিকেলের আগেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারপাশে। কালিহানি গিরিদ্বারে আকাশের বৃষ্টিমেঘেরা চলার পথে বাধা পেয়ে থেমে যায় ও যখন-তখন বৃষ্টি নামায়। সেটা বৃষ্টি অথবা তুষারপাত। কালিহানির তলদেশ ও বেয়ে ওঠার পথ তাই সদাসর্বদা কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। একটু তবুও আশ্রয় নেওয়ার ভাল স্থান এইসব বিপুলায়তন বিসদৃশ বোল্ডারে ছাওয়া ভূখণ্ড, বিসদৃশ বোল্ডারগুলিকে এখন মনে হচ্ছিল ঈশ্বরের বানিয়ে রাখা প্রাকৃতিক গৃহ। সন্ধে হওয়ার আগেই কালিহানির গায়ে লেগে থাকা কৃষ্ণাভ ঘন বৃষ্টিমেঘের আচ্ছাদনে তলদেশ অন্ধকার হয়ে এল এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল বৃষ্টি। তাই দেখে পবনের খুব দুশ্চিন্তা। ভৈরবও তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। পাথুরে আচ্ছাদনের আড়ালে বসে বৃষ্টির হাত থেকে তারা রক্ষা পেলেও সঙ্গীদের উদ্বেগ ও দুর্ভাবনার ভাগীদার হতে হচ্ছিল তাকেও।পবন অসহায় গলায় যা বলছিল তা থেকে সে বুঝতে পারল যে ভেড়ারা তিন ইঞ্চির বেশি পুরু নরম বরফ ধরে যেতে পারে না, পা আটকে যায়। যাওয়ার পথে গিরিদ্বারের ওপর জমে থাকা বিস্তৃত বরফপ্রান্তরে বৃষ্টির জন্য যে নতুন বরফ জমবে তা হবে নরম এবং তাতে যেতে যেতে পা ডুবে যাবে। তিন ইঞ্চির বেশি পা ডুবে গেলে ভেড়ার দল আর এগোতে পারবে না এবং এভাবে এগিয়ে যাওয়াও হবে ভয়ঙ্কর কারণ নরম বরফে ঢেকে থাকা অঞ্চলে যদি খাদ থাকে তো সবাই মিলে অতলে তলিয়ে যাবে আর জীবন্ত সমাধি ঘটবে সবার। বৃষ্টি তাই বড়োই দুশ্চিন্তার কারণ।
সন্ধে লাগার মুখে বৃষ্টি শুরু হল। ঝিরঝিরে ধারায় গোড়ার দিকে শুরু হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে চলল কিছুক্ষণ, খানিক থেমে বা খানিক নেমে। ঘন্টাখানেক এমনই খেয়ালখুশি বজায় রাখার পর আরেকটু গাঢ় মেজাজে এবং বিরামহীন। তারা তিনজনেই ছিল সেই বিশাল বোল্ডারের খাঁজকাটা অভ্যন্তরে, গুহাসদৃশ আশ্রয়ে। তবুও বৃষ্টির ছাট ভিজিয়ে দিচ্ছিল, তাছাড়া সেই বোল্ডারটির পৃষ্ঠতলের বর্ষণজল গড়িয়ে অবিশ্রাম জলবিন্দু ধারা হয়ে চলে আসছিল ভিতরেও। সেসব জলবিন্দু আসলে জমাট বরফপাত হয়েই নামছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল হিমশীতল স্পর্শে। পবন আর ভৈরবের গা ঢাকা ছিল হাতে বোনা পশমি শালে যা জলে ভেজে না। বৃষ্টি চলল সারারাত, ক্ষান্তি দিল ভোরবেলায়।
রাতে তারা কেউ প্রায় ঘুমোলোই না। ঘুমোবার উপায়ও ছিল না, যেহেতু মেঝের বাটিসদৃশ পাথরের পাটাতনে আচ্ছাদন বেয়ে নামা জলবিন্দুরা জমে জমে পায়ের পাতা ডুবিয়ে দিয়েছিল, আর সঙ্গী ছিল উৎকণ্ঠা। যদি গিরিদ্বারের বরফপ্রান্তরে নরম বরফ পুরু হয়ে জমে যায় তো ভেড়ার পাল তা ডিঙিয়ে যাবে কী করে ? এখানে অপেক্ষা করাও যাবে না কাল, পিছিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই। বড়া ভাঙ্গাল যাওয়ার এই একটিমাত্র পথই আছে, আর পথ রয়েছে উল্টোদিকের ছোটা ভাঙ্গাল থেকে থামসার গিরিদ্বার ধরে। ওই পথে যেতে গেলে পুরো রাজ্যটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত চক্রাকারে ঘুরতে হবে, কয়েকশ’ কিলোমিটার হবেই তা এবং যে পথ কেউ কল্পনাও করে না কোনদিন।
ভোরের আলো তখনও অস্পষ্ট প্রায়, বৃষ্টি বিদেয় হলেও আকাশ একেবারে মেঘমুক্ত নয়। পবনরা বোল্ডারের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এলো। গিরিদ্বার এখান থেকে আরও চার-পাঁচ হাজার ফিট ওপরে। মুখ তুলে দেখে কিছু বোঝা এখনও দুষ্কর। কিছুটা পরামর্শ করল দু’ভাই মিলে, তারপর যা থাকে কপালে করে উঠে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিল। এমন সিদ্ধান্ত নিতেই হত। ওপরে যাওয়ার পথ পাথুরে শিরা বার করা হলেও বরফ জমে গেছে এবং বরফগলা জলীয় ধারা নামছিল তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে। তাতে পথ হয়ে আছে পিচ্ছিল এবং বরফে আর কাদায় মাখামাখি। সাবধানে উঠছিল তারা দল নিয়ে যদিও প্রতি ইঞ্চি চড়াই ভাঙ্গতে এতটাই পরিশ্রম হচ্ছিল যে গাদ্দিদের মত অভিজ্ঞ আর কষ্টসহিষ্ণু দু’ভাইকেও কাহিল দেখাচ্ছিল। এই কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও গায়ে বুঝিবা ঘাম ঝরছিল। পবন সাবধান করে বলল,
‘বরফের চাঙ্গরে পা দেওয়ার আগে সাবধান, ঠেলে দেখে নিও আলগা কিনা। আমাদের আগে কাল-পরশুও অনেক দল গেছে এখান দিয়ে। তাদের ছাপ আছে ভেড়াদের পড়ে থাকা মলমূত্রে। রাতের বৃষ্টিতে তা মুছে যায়নি পুরোপুরি। সেই মলমূত্রের চিহ্ন দিয়ে যে রেখা সেটা দেখে নিয়ে ওই রেখা ধরেই এগোও। তাহলে তুমি হঠাৎ ডুবে গিয়ে হারিয়ে যাবে না। এসব বরফে ঢাকা পথে এটাই চলার নিয়ম।’
কথাগুলি মূলত তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা, কারণ তার ভাই ভৈরব জানে এসব। তবে তাকেও আবার দাদা হিসেবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতেই পারে, সে যদি ভুলে গিয়ে থাকে এই সম্ভাবনায়। অন্তত চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগল কালিহানি পাসের মাথায় উঠে আসতে। এবার টানা বরফের প্রান্তর। ওটাই বিপজ্জনক প্রদেশ। পবনের আশঙ্কা সত্যি বলে প্রমাণিত হল। পুরু বরফ জমে গেছে রাতের বরফবৃষ্টিতে। এই বরফ সদ্য তৈরি হয়েছে এবং চরিত্রে নরম। ওপরে যে আস্তরণ জমেছে তা তিন ইঞ্চির কম হবে না কোনমতেই। দিনে যদি রোদ ওঠে কিছুটা গলে যেতে পারে, কিন্তু আশা তার খুবই কম। পবন পরীক্ষা করে দেখে বুঝল যে কষ্ট করে হলেও প্রান্তরটা পেরিয়ে যাওয়া যেতে পারে। ভয় একটাই, নরম বরফে মৃত্যুফাঁদ হয়ে কোন খাদ লুকিয়ে আছে কিনা। অতএব পবন প্রান্তরের এধারে ভেড়ার পাল নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল আর ভৈরব নেমে গেল প্রান্তরে। হাতের লম্বা লাঠি দিয়ে বরফের আস্তরণ ঠুকে ঠুকে এধার থেকে ওধার পর্যন্ত পরীক্ষা করে দেখল পেরোনোর সম্ভাব্য চলনপথ কেমন হতে পারে। সেও কাজটাতে অংশ নিতে চেয়েছিল, কিন্তু পবন তাকে নিরস্ত করল। তার এসব পথে চলার কোন অভিজ্ঞতা নেই। তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া যায় না। বেশ কয়েক ঘন্টায় পরীক্ষাপর্ব প্রাথমিকভাবে সাঙ্গ করে খুব সন্তর্পণে যাত্রা শুরু হল। দুপুর পার হতে চলেছে ততক্ষণে। উদ্বেগ আর উত্তেজনায় কিছু আর খাওয়া হয়নি এতক্ষণ। খাওয়ার অবকাশও ছিল না। প্রতিটি মিনিটই অমূল্য। আকাশ এখনও মেঘাচ্ছন্ন আর সেইসব কৃষ্ণকায় হালকা মেঘ গুচ্ছাকারে গিরিদ্বারের ওপর দিয়ে আলস্যে গড়িয়ে চলেছে মন্থরগতিতে, বা বলা যায় জমে আছে। তাতে চারপাশটা দেখাও যাচ্ছে না স্পষ্টভাবে। আবারও বৃষ্টি নেমে যেতে পারে যেকোন সময়। তাতে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। তাই খাওয়ার কথা ভাবা এখন বিলাসিতার সামিল। মেঘাচ্ছন্ন অস্বচ্ছ বৃক্ষহীন এবং গিরিদ্বারের বরফাচ্ছাদিত ঢাল ধরে চলছিল তারা তাদের দল নিয়ে এবং প্রতিটি পদক্ষেপ মেপে মেপে, নরম ফাঁকা বরফের স্তর দলটির ভারবহনে কতটা সক্ষম হতে পারে সেই সন্দেহ মাথায় রেখে। পবনদের ভেড়ার দলও সুশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ আর এটাও একটা বড় নিশ্চিন্ত থাকার বিষয় ছিল। ঘন্টা চারেকের অক্লান্ত চেষ্টায় কালিহানি গ্লেসিয়ার পেরিয়ে সবুজ প্রান্তরের কাছাকাছি নেমে আসা সম্ভব হল। এবার বড়া ভাঙ্গাল আর বেশি দূর নয়, কারণ পিচ্ছিল নিম্নগামী পথেও গিরিশিরার ধার ঘেঁষে পাশে খাদ রেখে নামতে যাওয়ার সময় এতটুকু অসতর্ক হওয়া মানেই গড়িয়ে খাদে পড়ে অতলগামী হওয়া বিচিত্র নয়। পথ মোটেই সোজা নেমে যেতে পারেনি। ভাঁজে ভাঁজে এঁকেবেঁকে নেমেছে পাহাড়ি খাদের সমাবেশ একপাশে আবার অন্যপাশে খাঁজকাটা পাথুরে দেয়ালের বাহারি সজ্জায় ভূষিত হয়ে। খানিকটা পরই দেবী কি মারহী দিয়ে গেছে ওই পথের ওঠানামা গ্রামের দিকে। তার আগে রয়েছে চৌরাশি ধর বলে একটি-দু’টি নয়, চুরাশিটি শৈলচূড়া। বড়া ভাঙ্গাল অনেকটা গামলার মত আকৃতিবিশিষ্ট, ধওলাধর পর্বতশ্রেণীর একপাশে তার অবস্থান, মূলত তিনটি সুউচ্চ পর্বতমালার পাদদেশ হিসেবে এবং এটি একেবারেই দুর্গম। স্থায়ী হিমশৈল তার চতুর্দিকে প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের গা থেকে প্রবল জলধারা খরস্রোতা হয়ে নেমে এসেছে একের পর এক, আর সবগুলো সমবেত হয়ে গড়ে তোলে যে প্রধান জলধারা তাকেই সবাই চেনে ইরাবতী নদী নামে, যার প্রবাহ যাত্রা শুরু করেছে এই বড়া ভাঙ্গালের অন্তর থেকেই। ছোটা ভাঙ্গাল থেকে থামসার পাস্ অতিক্রম করে যেমন বড়া ভাঙ্গালের দেখা মিলবে তেমনি উল্টোদিকে দুপ্পু থেকে কালিহানি পাস্ পেরিয়ে তবেই এখানে আসা যাবে এবং একটু আগে গাদ্দিরাও এসেছে ওই শেষ পথটি ধরেই। তার অর্থ এই হল যে বড়া ভাঙ্গালকে দু’দিক থেকে ধওলাধর পর্বতমালার বিখ্যাত দু’টি সুউচ্চ গিরিদ্বার কালিহানি ও থামসার প্রায় স্যান্ডউইচ বানিয়ে রেখেছে। স্বীকৃত বা সুগম্য কোন পথই নেই, আর চারদিকে আকাশমস্তকে ঠেকানো পাহাড়চূড়া ও খরস্রোতা জলধারা নিয়ে বড়া ভাঙ্গাল এক এমন দুর্গ যা সুরক্ষিত সভ্যজগতের আমুদে আর হুজুগে মানুষগুলির লোকদেখানো বেড়াতে যাওয়ার উৎসব থেকে, ওই কলুষিত ভিড় বা প্লাবন এখানে প্রবেশাধিকার পাবে না তাদের মর্জিমাফিক। তাই গ্রামের নিষ্পাপ সাদাসিধে মানুষগুলি তাদের পিতৃপুরুষের প্রথানুসারী হয়েই থাকতে পারবে আরও অনেকদিন। এভাবেই প্রকৃতির আপন সন্তানেরা তাদের মূল চরিত্র বজায় রাখতে পারবে যতদিন সভ্যতা ততদিন নিরাপদ, পৃথিবীর নিজস্ব প্রাণের উৎসগুলি তাদের স্বকীয় স্বভাবে থাকুক জগৎজুড়ে যত বেশি সম্ভব এটাই হোক মানবিক আত্মার একান্ত কামনা। বড়া ভাঙ্গালে এলে দেখা যাবে কোনদিক থেকে কোন সর্বগামী সড়কপথ উঠে যায়নি কোনদিকে, পরিবর্তে অনেক অনেক সরু সরু পথরেখা চলে গেছে চারদিকের পাহাড়ি দেয়ালগুলির গা বেয়ে এঁকেবেঁকে, এগুলি আসলে একেকটি গাদ্দি মেষপালক দলের একেকটি নিজস্ব পথরেখা, বংশানুক্রমিকভাবে অলিখিত নিয়মে একেকটি পথ নির্দিষ্ট একেক দলের জন্য, এই নিয়ে তাদের মধ্যে কখনও কোন সমস্যা হয় না যেসব আমাদের নাগরিক জীবনে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। বড়া ভাঙ্গালের চারপাশে সুউচ্চ পাথুরে দেয়াল দিয়ে ঘেরা সুরক্ষিত গাদ্দি উপজাতির মানুষেরা তাদের পিতৃপিতামহের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথাসমূহ আন্তরিক মমতায় বুকে লালন করে তাদের দুর্গে জীবন কাটাচ্ছে সভ্য সমাজের কলুষিত ছোঁয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করে। তাদের সম্পদ নেই, শান্তি আছে, আধুনিক প্রযুক্তি নেই, প্রাণ আছে। নাগরিক সভ্যতায় জীবনকে যান্ত্রিক বানিয়ে দিয়েছে যেভাবে তারা সেসব জানে না বলেই তাদের জীবনে রসের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ নানা রসের সুষম বন্টনে এখনও পর্যন্ত যেমন ছিল সৃষ্টির সূচনায়।
এই গ্রাম গাদ্দি উপজাতীয় সম্প্রদায়ের আদিতম বাসস্থান, সমতলভূমি থেকে যখন তারা কয়েক শতাব্দী আগে চলে এসেছিল হিমালয়ের কোলে। এখানে বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে আর আছে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাড়িগুলি কাঠের কাঠামো, গায়ে লেপা গোবর, স্থানে স্থানে কাঠামো জোড়া হয়েছে ইটের বা ঘাসের স্তর সাজিয়ে। পর্বতারোহীরা বা ট্রেকাররা গেলে গ্রামবাসীরা তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় হাসিমুখে, কারণ তাদের কাছে অতিথিরা নারায়ণ। তারা অতিথিদের সেবাযত্নে কোন ত্রুটি রাখে না, তাদের খুশি করতে হাজির থাকে সর্বসময়। খেতে দেয় শুকনো মিষ্টি, শুকনো মাংস, আপেল ও ফলমূল, ঘোল, খাঁটি দুধ, রাজমা ও অন্যান্য শস্য। উপহার দেয় তাদের তৈরি হস্তজাত দ্রব্য। এই আপ্যায়নে প্রকাশ পায় না তাদের জীবনসংগ্রামের দুঃখকষ্ট বা কী বঞ্চনা ও ঔদাসীন্যের শিকার হতে হয় তাদেরকে প্রতি পদে পদে। দুপুর-রাতের খাবার ও আশ্রয় স্বচ্ছন্দে পাওয়া যাবে তাদের কাছে চাইলেই। তাদের সেবা গ্রহণ করলে তারা কৃতার্থ হবে, কেউ তা ফিরিয়ে দিলে তারা ক্ষোভ জানাবে। এটাই রীতি।
তাকে এখানে তাদের গ্রামে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল পবন আর ভৈরব খুবই কুণ্ঠার সঙ্গে, সসংকোচে। সারা পথ আগলে রেখেছিল তাকে পরম যত্নে। তার দিকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি ছিল সবসময়। গ্রামে ঢোকার পর তাকে ঘিরে লোকের ভিড় দেখে সে অবাক হয়ে গেল। সবারই মুখেচোখে কী আত্মীয়তার প্রকাশ, কতটা সম্ভ্রম। পবন আর ভৈরব সবার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল এতটাই গর্বের সঙ্গে যে মনে হচ্ছিল বুঝি তারা তাদের সঙ্গী করে আনতে পেরেছে কোন স্বর্গের দেবতাকে বা পৃথিবীর কোন মান্যগণ্য বিখ্যাত ব্যক্তিকে। দু’ভাইয়ের কাছে তার পরিচয় জানতে পেরে প্রত্যেকে আসছিল কেবল তাকে একপলক দেখে যাওয়ার জন্য, যেন তার দেখা পেলে তারা ধন্য হয়ে যাবে। অনেকে যা বলতে শুরু করল তখনই যে শুনে সে আক্ষরিক অর্থেই বাক্যহারা হয়ে থাকল। তারা বলতে লাগল যে পবন আর ভৈরব খুবই পুণ্যবান ও ভাগ্যবান তাই এমন ব্যক্তি তাদের বন্ধু হয়েছে, এমন ব্যক্তি ওদের সঙ্গে এসে ওদের আতিথ্য গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। প্রত্যেকেই তাকে নিজের কাছে রাখার ইচ্ছে প্রকাশ করছিল।
ইরাবতী নদীর জন্মস্থলে কালিহানি আর থামসার গিরিদ্বারের কোলে দুর্গম বড়া ভাঙ্গাল উপত্যকার গ্রামে তখন পড়ন্ত বেলার আমেজ। শৈত্যপ্রবাহ আগতপ্রায় দরজায়। সন্ধে নামার অপেক্ষা ওই দুই মহান গিরিদ্বারের মাথায়। এখানে এই শেষ বেলাতে এই আন্তরিক শৈব উপাসক গাদ্দি উপজাতির মানুষদের ভিড়ে তাদের হৃদয়ের উত্তাপ প্রত্যক্ষ করতে করতে সে ভাবল, হিমালয় মহান, তাই তার কোলের এই সন্তানেরাও মহান। মহানের সংস্পর্শে মহানেরাই থাকে। এরা সবাই সত্যিইবুঝিবা দেবলোকের বাসিন্দা।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)