পাবক উপাধ্যায়

তৃতীয় পর্ব 

হেমকুণ্ড অভিযান

কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম মনে নেই ঠিক। যখন চোখ খুলি, তখন দেখি এক সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী আমার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছেন। তাদের হাতে একটা জলের বোতল। আমার চোখে মুখে জল। সম্ভবত ওরাই আমাকে অজ্ঞান দেখে চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা মেরে আমার সংজ্ঞা ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিছু বলবার আগে তাঁদের হাত থেকে জলের বোতলটা চেয়ে নিয়ে এক নিঃশাসে শেষ করে দিলাম বোতলের বাকি জলটুকু। তারপর যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। আমাকে দেখে তাঁরা জিজ্ঞেস করেলেন, “Why didn’t you carry water? You should carry water while trekking. Without water don’t travel even a single step in the hills.” আমি তাদেরকে শান্তস্বরে বললাম, “I was carrying water Sir. It was drained. I had adequate water, but it was with the Pittu and he was with me a few minutes before. I told him to go fast so that I could enjoy every corner of the hill and he went on. Anyway, thanks a lot to both of you.” মনে মনে ভগবানকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। এ যাত্রায় প্রাণটা কোনোক্রমে রক্ষে হয়ে গেল।

কিছুটা এগোতেই সামনের বড়ো বাঁকটা পেরিয়ে ছোটো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা ওপরে উঠে গিয়েছে পাহাড়ের বুকে। সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই ঘাঙারিয়া। প্রসঙ্গত বলে রাখি, কেউ ট্রেকিং এর দীর্ঘ পথ অতিক্রম না করেও ঘাঙারিয়াতে পৌঁছতে পারেন। তাঁর জন্য সরকার হেলিকপ্টার এর ব্যবস্থা করে রেখেছে। মাত্র পাঁচ মিনিটেই গোবিন্দঘাট থেকে যে কেউ চাইলেই পৌঁছে যেতে পারেন ঘাঙারিয়াতেই। ঘাঙারিয়া প্রবেশের মুখেই বড়ো করে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা ‘হোটেল প্রীতম’। আমার পি এইচ ডি গাইডের কথা মনে পড়ে গেল। আগে থেকে বুক করা না থাকায় মাথা গোঁজবার মতো কোনো হোটেল পেলাম না। অবশেষে ঘাঙারিয়ার গুরুদ্বারাতেই আশ্রয় নিলাম। রাত্রিটা সেখানেই খাওয়া দাওয়া করে তাড়াতাড়ি শুয়ে গেলাম। পরের দিন হেমকুণ্ড যাবার পরিকল্পনা। খুব ভোরেই রওনা হতে হবে নয়তো হেমকুণ্ডের গুরুদ্বারা বন্ধ হয়ে যাবে। এতকাছে এসেও যদি এই সুযোগ হাতা ছাড়া হয় তাহলে খুবই খারাপ লাগবে। সারাদিনের ধকলে একেবারে পরিশ্রান্ত। বিছানাতে শুতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এল।

বলে প্রয়োজন, উত্তরাখণ্ডের চমোলি জেলার অন্তর্গত এই হেমকুণ্ড সাহেব। বুৎপত্তিগত দিক দিয়ে শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়- ‘হেম’, যার অর্থ বরফ এবং ‘কুণ্ড’, যার অর্থ তালাব বা জলাশয়। অর্থাৎ হেমকুণ্ড বলতে বোঝায় বরফাবৃত জলাশয়। শিখধর্মের দশম গুরু গুরু গোবিন্দ সিং-কে উৎসর্গ করে এখানে হেমকুণ্ড সাহেব নামক গুরুদ্বারাটি স্থাপন করা হয়েছে। হেমকুণ্ড সাহেবর চারিদিকে সাতটি পর্বতশৃঙ্গ বেষ্টন করে রয়েছে। এটি গাড়োয়াল হিমালয়ের অংশ। এর উচ্চতা প্রায় ৪৬৩২ মিটার অর্থাৎ ১৫,১৯৭ ফুট। হাতি পর্বত এবং সপ্তর্ষিশৃঙ্গের বরফ গলে নিম্নে ধবিত হয়ে এই হ্রদের সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে এই ক্রিস্টাল ক্লিয়ার জল নীম্নে ধাবিত হয়ে ঘাঙারিয়ার কাছে পুষ্পবতী নদী নামধারণ করে অলকানন্দার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল এখানে একটি বরফগলা জলে সৃষ্ট হ্রদ আছে যেটিতে প্রায় সারাবছর জল জমে বরফ হয়ে বরফের হ্রদ রূপ ধারণ করে থাকে। কেবল জুলাইয়ের শেষ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত এই তিন মাস এখানে জল দেখতে পাওয়া যায়। তাও আবার জলের ওপরে হাল্কা একটা বরফের স্তর থাকে প্রায়শই। শিখধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এই হেমকুণ্ডে দুব দিলে সব পাপ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। কথিত আছে যে মহাদেবের জটা থেকে গঙ্গা ধাবিত হয়ে হেমকুণ্ডে মিশেছে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এই স্থানটি প্রসিদ্ধ হবার পিছনে আরো একটি কারণ হল এখানে লোকপাল লক্ষণ মন্দির অবস্থান করছে যেটি হিন্দুধর্মাবলম্বীমতে অন্যতম পবিত্র স্থান। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে এই স্থানের উল্লেখ আছে। হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, লক্ষণ যখন যুদ্ধকালে মেঘনাথের দ্বারা নিহত হন তখন রাম, সুগ্রীব এবং বজরং-এর সহায়তায় তাঁকে এই স্থানেই লুকিয়ে চিকিৎসা চালিয়েছিলেন। অমর সঞ্জীবনী দিয়ে লক্ষণকে বাঁচিয়ে তোলা হয়েছিল এই স্থানেই। কখনও কখনও এমন বলা হয় যে লক্ষণকে হত্যা করার পর মেঘনাথ এই লোকপাল হ্রদেই তপস্যায় মগ্ন হয়েছিলেন তাঁর প্রায়শ্চিত্ত করতে। আবার পুরাণ অনুসারে বলা হয় যে সত্য যুগে স্থিত চরিত্র যে শেষনাগ তিনি এই লোকপাল লেকেই বাস করতেন। রাজা পাণ্ডুর যোগাব্যাসের স্থল হিসাবেও এই স্থান প্রসিদ্ধ। এছাড়াও লোকপাল হ্রদকে কেন্দ্র করে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর নানা যুগে নানাবিধ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় হিন্দু শাস্ত্রাদিতে।

রাত তখন ১টা হবে বোধহয়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। গুরুদ্বারার টিনের চালে ছপছপ করে বৃষ্টি পড়ছিল এক অদ্ভুত আওয়াজ করে। বুঝলাম আর ঘুম হবে না। দেখলাম সব তীর্থযাত্রীরাও জেগে গিয়েছেন। অনেকের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রস্তুত। তাপমাত্রা প্রায় ৬/৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বৃষ্টিতে ঠাণ্ডাটা আরও বেড়ে গেল। আমি তাদের মনের জোর এবং দৃঢ়তা দেখে ভীষণভাবে বিস্মিত হলাম। এই হিমেল রাতে অন্ধকার জঙ্গলের পথ দিয়ে ভোরের মধ্যে গুরুদ্বারাতে পৌঁছাবে বলে তাঁরা যাত্রা শুরু করে দিয়েছেন। এদিকে বৃষ্টি থামারও কোনো লক্ষণ নেই। টানা একটা বা তার আগে থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখে চলেছি। বাবার সাথে ভিজে ভিজে মাঠে কাটানো শৈশবের অনেক স্মৃতিই এসে ভিড় করে বসছিল। কিন্তু, মনে চিন্তার কোনো ছাপ নেই এই ভেবে যে হয়তো ভোর ৩ টা বা ৪ টায় বৃষ্টি থেমে যাবে এই আশস্ত বোধ করে।

ভোর তিন টায় অ্যালার্ম বাজতেই সজাগ হয়ে গেলাম। মুষলধারে তখনও বৃষ্টি পড়ে চলেছে অনবরত। থামবে বলে তো মনে হচ্ছে না। গতিবেগ ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। মনে মনে ভাবছিলাম আজ বোধহয় আর বেরোনো যাবে না। একটা দিন পুরো নষ্ট হয়ে যাবে। আবার ভাবলাম এই বৃষ্টির রাতে ষাট-সত্তর বছরের বৃদ্ধারা যদি যেতে পারেন তাহলে আমি কেন পারবো না। পঞ্চুটা(রেইন কোর্ট) চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অবশেষে। ভোর তখন আন্দাজ মত তিনটে বেজে ত্রিশ বা চল্লিশ হয়েছে। গুরুদ্বারা থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। আমি বৃথা ভয় পাচ্ছিলাম। কয়েক শ তীর্থযাত্রী ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। কেউ কেউ চলেছেন খচ্ছরের পিঠে। কেউ বা পিটঠুর পিঠে। বাইরে অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে দেরিতে সন্ধ্যে হয় ঠিকই, কিন্তু সকালের অলো ফুটতে দেরি লাগে না। ভোর চারটে থেকে সোয়া চারটের মধ্যে সকালের আলো মুখ তুলে চেয়ে ওঠে। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে হেমকুণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। ঘাঙারিয়া থেকে হেমকুণ্ড ৭ কিমি। রাস্তা প্রচণ্ড চড়াই। বেশিরভাগ জায়গা খাড়া ওপরে উঠে গেছে হেমকুণ্ডের দিকে। বৃষ্টিতে ছপ ছপ করে পা ফেলে সামনের দিকে এগোচ্ছি। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে চলেছে একই ছন্দে। মাঝে মাঝে দূরে ঘোড়া বা খচ্ছরের চিঁহি চিঁহি আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও ঝরনার জলের আওয়াজ কানে আসছে।

দিনের আলো ক্রমশ অনাবৃত হচ্ছে। তীর্থযাত্রীদের ভিড়ও ধীরেধীরে বেড়ে চলেছে। এই কনকনে শীতের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যেতে দেখা যাচ্ছে দু একজনকে। বুকের পাটা আছে বলতে হয়। কতটা ওপরে উঠলাম তা ভালোভাবে ঠাওর করতে পারলাম না। নীচে পুষ্পবতী নদী বয়ে চলেছে একমনে, একপ্রবাহে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছি কতটা পথ অতিক্রান্ত হল। সম্ভবতঃ বেশি পথ অতিক্রম হয়নি। সবেমাত্র মিনিট চল্লিশ কি পঞ্চাশ হল হাঁটছি। রাস্তা প্রচণ্ড চড়াই। খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। সূর্যিমামার দেখা পেতে আর বেশি বাকি নেই বোধহয়। মনে হচ্ছে যেন রাস্তা শেষ হবার না। এদিকে বৃষ্টির কারণে ঠাণ্ডা বাড়তে শুরু করছে। হাত জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। আঙুলগুলো হাল ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। ভাগ্যিস সঙ্গে একজোড়া দস্তানা ছিল। আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা গাছের ছাওনি তে ব্যাগ নামিয়ে দস্তানা দুটো আঙুলে ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। দু একটা খেজুর, কিসমিস, কাজু, আখরোট খেয়ে আবার হেমকুণ্ডের অভিমুখে পা চালোনা শুরু হয়ে গেল। যত সামনের দিকে চড়ছি রাস্তা তত বেশি খাড়া। জুতো মোজা ইতিমধ্যে ভিজে ছপছপ করছে। রাস্তা খাড়াই হলেও পাথর বিছানো, কাজেই রাস্তা বানানোর হ্যাপা নেই। তবে বৃষ্টিতে পাথরে একবার কেউ পিছলে পড়লে একেবারে গভীর খাতে। সম্পূর্ণ ধীর সন্তর্পণে ধৈর্য সহকারে চলতে হবে।

হেমকুণ্ড যাবার পথে ঘাঙারিয়া থেকে দু কিমি অন্তর অন্তর খাবারের হোটেল অর্থাৎ ধাবা পাওয়া যায়। সমস্ত তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে এই কল্যাণময় পদক্ষেপ। প্রায় ১৪০০০ থেকে ১৫০০০ ফিট ওপরেও ধাবা। কল্পনা করতে পারছেন? এত ওপরে উঠে ও কেউ চাইলে মনের ইচ্ছে মতো নুডলস্‌, বাটার টোস্ট, ওমলেট, চা, কফি ইত্যাদি খেতে পারেন। তবে অবশ্যি মূল্য তিনগুণের থেকেও বেশি। দু ঘণ্টা পথ চলার পর খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করতে লাগল, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। বৃষ্টির মধ্যে ডার্ক চকোলেট বের করে খেয়েছিলাম তা বেশিক্ষণ পেটে টিকলো না। মজার বিষয় হল, পানীয় জলের কোনো অভাব নেই। যত্রতত্র ক্ষুদ্রবৃহৎ ঝরনা বয়ে গিয়েছে। ক্রিস্টাল ক্লিয়ার জল। অত্যন্ত সুস্বাদু, পানের যোগ্য। পিপাসা পেলেই ঝরনার জলে চুমুক লাগিয়ে মন ভরে মিষ্টি জল পান করছি। অবশ্যি একজন প্রৌড়কে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম পূর্বেই।

এদিকে বৃষ্টি একই ছন্দে গেয়ে চলেছে “টুপটাপ…..”, “টুপটাপ…..”। জানি না আজ হয়তো আর থামবে না। সকালের আলো ফুটলেও চারিদিক মেঘের চাদরে ঢেকে আছে। বেশি দূরে সামনে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রৌদ্রের আলো মেঘের আড়ালে খেলা করছে হয়তো। পঞ্চুর গরমে ভিতরের পোশাকআশাক ভিজতে শুরু করেছে। এভাবে আরও ১ ঘণ্টা কেটে গেছে। ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা বাজে। সামনের টিলার ওপরের ধাবা থেকে ডিমটোস্টের গন্ধ সজোরে নাকে এসে ধাক্কা মেরে খিদেটা বাড়িয়ে দিল। খাবারের সুঘ্রাণে শরীরও হাল ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। কোনোক্রমে অর্ধজব্দ শরীরটাকে সামনের ধাবা পর্যন্ত টেনে তুললাম। চেয়ার গুলো সারি সারি পাতা। খাবারের মেনু কার্ড ধরানো আছে প্রত্যেকটা টেবিলে। রেইন কোর্ট খুলে উলের জ্যাকেটটা ব্যাগে নিয়ে নিলাম। ভেতরের গেঞ্জিটা ভিজে ছপছপ করছে। সেটা পালটে নিলাম। দু মিনিট ধাতস্থ হয়ে নিয়ে দোকানী কে বললাম, “পাঁ জী ফটাফট দো বাটার টোস্ট অউর চা লাগা দিজিয়ে। জলদি কিজিয়ে বহত ভুক লগা।” দোকানী বলল, “ জী স্যার, দো মিনটো মে দে রহা হু মে। আপ ব্যাঠিয়ে। বাস দো মিনিট।” খেয়ে দেয়ে শরীর চাঙ্গা অনুভব করলাম।

বিশ ত্রিশ মিনিট পর যাত্রা শুরু হল পুনরায়। বৃষ্টি স্তিমিত হয়ে এসেছে। পথযাত্রীদের আনাগোনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বৃষ্টির মধ্যে কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছাতা মাথায় চলেছে হেমকুণ্ড সাহেব। কেউ বা “বাহে গুরু, বাহে গুরু” ধ্বনি দিতে দিতে নগ্নপদে একাগ্র চিত্তে হেঁটে চলেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে একদল মানুষের সাথে আলাপ হল। তারা পাঁচ ভাই বৃদ্ধা মাকে কাঁধে তুলে নিয়ে চলেছে। কথা বলে জানতে পারলাম যে তাদের মায়ের ইচ্ছে মৃত্যুর আগে যেন তিনি হেমকুণ্ড দর্শন করতে পারেন। কিছু চ্যাঙ্‌ড়া ছোঁড়া স্পীকারে সজোরে গান শুনতে শুনতে পথ অতিক্রম করছে। এক শিখ পরিবারের সাথে পরিচয় হল। তাঁদের মধ্যে থেকে একজন বৃদ্ধা পিটঠুর পিঠে চলেছেন, বাকিরা পায়ে হেঁটে। ওদের থেকে জানতে পারলাম তার বাবার শেষ ইচ্ছে হেমকুণ্ড সাহেবের হেমকুণ্ডে স্নান করে পূজো দেওয়া।

মেঘ কেটে যেতেই দেখতে পেলাম তখনও বহু পথ বাকি। বৃষ্টির কারণে বহুবার থামতে হচ্ছে। প্রায় সকলেই তাই করছেন। কিছু মানুষ যাঁরা রাত্রে বেরিয়েছিলেন তাঁরা একে একে ফিরছেন। এদিকে যত ওপরে ওঠছি ততই এবড়ো খেবড়ো পাথার। কয়েক সেকেণ্ডের ভুল জীবনহানির কারণ হয়ে উঠতে পারে। একমনে হেঁটে চলেছি তখন। মনে হল যেন কেউ আমাকে পেছন থেকে ডাকছে। কিন্তু এই অচেনা শহরের ভিড়ে আমাকে আবার কে ডাকবে। আমি তোয়াক্কা না করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এবার স্পষ্ট কানে এল, “ও বাঙালী বাবু, থোড়া রুকিয়ে তো।” গলাটা চেনা চেনা লাগছে যেন। ভিড় কাছে আসতেই দেখলাম রাম। ঘাঙারিয়া আসার পথে আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গে। হেমকুণ্ডের পথেও সঙ্গী জুটে গেল। রামের বাড়ি হরিদ্বারে। একটা প্রইভেট অফিসে সে চাকরি করে, যখন মনে হয় নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। ভীষণ ভ্রমণপ্রেমিক মানুষ। আমাকে বলল, “I was calling you when I saw from the down. But you didn’t see me for a single time. Well, tell me how are you walking so fast in the hill?” সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বাহে গুরু সব দেখ লেঙ্গে। ইস টাইম থোড়া ধিরে সে চলিয়েগা। পেহেলে চা পি লেতে হ্যায় আগে ধাবা সে। উসকে বাদ ফোটো খিচতে খিচতে সাথ মে জায়েঙ্গে।” আমি বললাম “ঠিক হ্যায় জী। লেকিন মে বচপন সে হি অ্যাইসা; থোড়া ফাস্ট ওয়াকার।” সে আমার পিঠে হাত চাপড়িয়ে বলল, “বহত বড়িয়া, লেকিন পাহাড়োমে হামেসা ধিরে চলনা চাহিয়ে।” আমি সম্মতি জানিয়ে মৃদু হাসলাম। দুজনে বৃষ্টিতে গল্প করতে করতে হেমকুণ্ডের উদ্দেশ্যে হাঁটছি। যেখানে শর্টকার্ট পাচ্ছি দুজনেই সেই পথ ধরছি। শর্টকার্টের রাস্তা বড় ভয়ানক। একেবারে খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। পাথরগুলো আলগা, অত্যন্ত পিচ্ছিল। এখানে যেকোনো মূহুর্তেই লেগ ফ্রাকচার, কিংবা লিগামেন্ট ক্রাক ইত্যাদি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বৃষ্টিতে এসবের সম্ভবনা আরো ব্যাপক। বৃষ্টির মধ্যে বাইরের দৃশ্য আমাকে আকৃষ্ট করছিল। ফোনটাকে যতটা বাঁচিয়ে ছবি তোলা যায় সেই প্রয়াসই করছিলাম। কোথাও দুই বন্ধু ছুটে পথ অতিক্রম করি, কোথাও আবার ভীষণ সন্তর্পণে আলগা পাথরের ওপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে চলি। কি সুন্দর দৃশ্য। এ যেন মেঘেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলা। কখনও চারিদিক মেঘে ঢেকে ফেলে তো আবার কিছুটা উঠতেই সব পরিষ্কার। পাহাড়ি পাখিরা মিষ্টি সুরে গান গেয়ে চলেছে সারাদিন। না আছে কোনো পিছুটান, না আছে কোনো কাজের প্রেসার।

ভাগ্যিস হাতকভার ছিল সঙ্গে, নয়তো এতক্ষণে হাত ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে যেত। মোজা-জুতো ভিজে চপচপ করছে। পা দিয়ে ঠাণ্ডা ওপরে উঠছে। তারই মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার বেগ ঠাণ্ডাটা বাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দুই বন্ধুতে একটু চা খেয়ে বিশ্রাম করে নিলাম। আবার পথচলা শুরু। নীচে পুষ্পবতী নদীটিকে সাদা সরু সুতোর মতো লাগছিল। সামনে তখনও অনেক পথ। তবে আন্দাজমতো অর্ধেকের বেশি পথ অতিক্রম করে গিয়েছি। সামনে দূরে একটা দীর্ঘ সাদা প্যাচ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বড়সড় ঝরনা নীচে নেমে গেছে। জলের ফ্লো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সাদা চাদরের বিছানা লাগছে। ছ রাউণ্ড দিয়ে ওপরে উঠলে তারপর বোঝা যাবে ওটা আসলে কি।  কিছুপর সেই স্থানে পৌঁছালাম। এতক্ষণে পথচলা সার্থক। যেটিকে দূরে থেকে ঝরনা মনে হচ্ছিল তা বিরাট এক গ্লেসিয়ার। কী অপূর্ব আনন্দ হচ্ছিল সে বলে বোঝানো যাবে না। সমস্ত কষ্ট সার্থক। খুব কষ্ট হচ্ছিল এতক্ষণ। সাদা চাদরের বিছানার স্পর্শ পেয়ে কি অপার তৃপ্তি। এই অনুভূতি কেবল যে আমার একার তা নয়। সকলেই যারা এতটা পথ অতিক্রম করে এখানে আসছেন আবেগে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছেন। সেটা তাদের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে। সকলে চিৎকার করতে করতে ছবি তুলছে। বিভিন্ন পোজে ছবি নিচ্ছে। কেউ বা গ্লেসিয়ার এর ওপর রেইন কোর্টসমেত শুয়ে পড়ে ছবি তুলছে। শত আনন্দের মূহুর্ত ছেলেমানুষি বোঝে না, শুধু বোঝে আনন্দই। ট্রেকিং পোল দিয়ে বরফের ওপর মেরে দেখলাম একটা অন্যরকম আওয়াজ। জল জমে পাথরের থেকেও শক্ত হয়ে আছে। এরই নীচে দিয়ে একটা ঝরনা ব্যাপক উচ্চস্বরে আওয়াজ তুলে নীচে ধাবিত হয়ে গিয়েছে। সকালের রৌদ্রের হাল্কা হাল্কা যতি গ্লেসিয়ারে পড়তেই এক অন্যরকম দৃশ্য। চোখে না দেখলে এই সৌন্দার্যকে বিশ্বাস করা যায় না। সে এক দারুণ অনুভূতি, ভাষায় প্রকাশ করা প্রায়শই অসম্ভব। পাহাড়গুলো যেন সাদা চাদর পেতে তোমাকে আহবান করে অপেক্ষা করে যাচ্ছে কোটি কোটি বছর ধরে। গ্লেসিয়ার থেকে ধোঁয়া (বাস্প) বেরিয়ে যাচ্ছে ওপরে, ঠিক যেন ছেলেবেলার ধোঁয়া ধোঁয়া খেলছে।

যাইহোক, পথ যেন শেষই হচ্ছে না। প্রাকৃতিক সৌন্দার্য উপভোগ করতে করতেই পথ চলছি। কিছুপর গুরুদ্বারার আওয়াজ কানে আসতেই মনে খুশির ফোয়ারা বয়ে গেল। কিছু পথিক কে জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা বললেন আর মিনিট দশ পনের লাগবে। আমরা আনন্দে ছুটতে লাগলাম। খানিকটা পথ গিয়ে একটা শর্টকার্ট নিলাম। ত্রিশ মিনিট হয়ে গেল। নীচে থেকে মনে হচ্ছে এই তো এসে গেছি। কিন্তু কৈ ? কোথায় গুরুদ্বারার ফটক ? কোথায় হেমকুণ্ড সাহেব? অধৈর্য হয়ে একজন পথিককে শুধালাম, “স্যার জী হেমকুণ্ড সাহেব আউর কিতনা বাকি হ্যায়?” তিনি বললেন, “আ হি গয়া, বাস দশ মিনিট চলতে রইয়েগা।” বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। তবে, আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। কলকলিয়ে বৃষ্টি এল বুঝি। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম পাথরের মধ্যে দিয়ে সাদা সাদা অদ্ভুত ফুলগুলো উঁকি দিচ্ছে। সব পথচারী ঝুঁকে পড়ে ছবি তুলছে, ফুল ছিঁড়ছে। জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম যে ওগুলো ব্রহ্মকমল ছিল। পথের দুদিকে হাজার হাজার ব্রহ্মকমল ফুটে রয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে এদের উল্লেখ আছে। ব্রহ্মের নাভি থেকে সম্ভবত এদের জন্ম হয়েছে বলে এঁরা ব্রহ্মকমল। তবে, এবিষয়ে বিজ্ঞানীরা ভিন্নমত পোষণ করেন।

বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করতে গুরুদ্বারার পূজার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এল। সামনের বড়ো বাঁকটা অতিক্রম করতেই দেখা গেল দুদিকে দুটি রাস্তা চলে গিয়েছে হেমকুণ্ড সাহেবের দিকে। একটি খাঁড়াই সিঁড়ি আর একটি পাথুরে পথ। কয়েক হাজার সিঁড়ি হবে। সিঁড়ির মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেক। কোনো পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিকে এইদুর্গম পথে দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ সকলেই পাশের পথটি দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছেন। সচরাচর শক্তিসামর্থ্য যুবক ছাড়া বেশি কেউ এই পথ আরোহণ করেন না। আমি আর রাম ঠিক করলাম যতই কষ্ট হোক আমরা সিঁড়ি বেয়েই উঠব। একটি সিঁড়ি থেকে দ্বিতীয়টির উচ্চতার ব্যবধান প্রায় দু থেকে আড়াই ফুট। রীতিমতো বিরতি নিয়ে নিয়েই অতিক্রম করতে হচ্ছিল। মেঘের আবরণে চারিদিকে ঢাকা। যেন শেষই হচ্ছে না আর। এদিকে দুজনে কাউন্ট করে চলেছি। অবশেষে প্রায় নয় নয় করে নশ ছিয়াত্তর ( মতান্তরে তিরাশী) টা সিঁড়ি টপকে অনেক কষ্টে হেমকুণ্ড পৌঁছালাম।

পাগড়ী ছাড়া কোনো গুরুদ্বারাতেই ঢোকা নিষিদ্ধ। একটি রুমাল সংগ্রহ করে মাথায় বেঁধে নিলাম। রাম শিখধর্মাবলম্বী হলেও তার কোনো পাগড়ী ছিল না। সেও একটি রুমাল সংগ্রহ করে মাথাতে জড়িয়ে নিল। হেমকুণ্ডে পৌঁছানোর পর প্রত্যেকে প্রথমে হেমকুণ্ডের লোকপাল লেকের বরফগলা জলে স্নান করে পবিত্র হয়, তারপরে পূজাদি কাজকর্ম সারে। এই বৃষ্টির দিনে তাপমাত্রা কমে ৫/৬ ডিগ্রিতে এসেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম স্নানাদি কর্ম থেকে বিরত থাকব, কিন্তু আয়নার মত স্বচ্ছ জল দেখে লোভ আর সংবরণ করতে পারলাম না। একে সারাদিন ভিজছি, তারওপর এই বরফগলা জলে স্নান। ভবিতব্যে কি অপেক্ষা করছে না ভেবেই গামছা পড়ে নেমে গেলাম সেই কনকনে ঠাণ্ডা বরফগলাজলে। একসাথে পাঁচটা ডুব দিয়ে চোখ খুলতে দেখি সামনে ভীড় উপচে পড়েছে। তারা আমার স্নান করা দেখছে আর বাহবা দিচ্ছে “বাহে গুরু। বাহে গুরু।” আমি উৎসুক হয়ে আরো পাঁচটা ডুব দিয়ে উঠে আসি। জল থেকে ওপরে আসতেই প্রচণ্ড কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। সে ভয়ানক রকমের কাঁপুনি। টাওয়াল দিয়ে গা মুছে নিয়ে তিন চার দফা গরম পোষাক পরেও কোনো মতেই কিছু হচ্ছিল না। যতদূর মনে পড়ে এরকম অবস্থা আমার জীবনে আগে কখনও হয় নি। কাঁপতে কাঁপতেই গুরুদ্বারার ভেতরে প্রবেশ করলাম। রাম যে কোথায় গেল তাকে আর দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ কেটে গেল। শরীরের বাহ্যিক কম্পন সম্ভবত থেমে গেছে। ঠাণ্ডাতে মাথাটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। গুরুদ্বারা থেকে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, দেখে খুব ভালো লাগছে। খুব সম্ভবত চমোলি জেলার কোনো একটি স্থানীয় চ্যানেল রোজই সকাল দশটা থেকে বারটার পূজো কভার করে থাকে।

পূজো সেরে গুরুদ্বারার ভেতরটা ভালো করে একবার ঘুরে নিলাম। পাশেই প্রাচীন লোকপাল লক্ষণ মন্দির ছিল। প্রণাম সেরে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলাম। সন্ধ্যে নামার আগেই ফিরে যেতে হবে। অনেক পথ অতিক্রম করে জাঁকিয়ে ক্ষিধে পেয়েছে। লঙ্গুরখানাতে তীর্থযাত্রিদের প্রসাদ বিতরণ পর্ব চলছে। গরম গরম খিচুড়ি। একবাটি খিচুড়ি প্রসাদ খেয়ে একটু চাঙ্গা বোধ করলাম। গায়ে তখন সম্ভবত ১০৩/১০৪ জ্বর। কিন্তু নীচে নামতে হবে। সারাদিন বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। ১টার মধ্যেই সকলকে গুরুদ্বারা থেকে রওনা দিতে হবে। দুপুর একটার পর আর কারও থাকার নিয়ম নেই। কারণ গুরুদ্বারাতে কোনো তীর্থযাত্রীকে থাকার অনুমোদন নেই। অগত্যা গায়ে জ্বর নিয়ে নামার পথে রওনা দিলাম।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *