সাদিক হোসেন

ফোনটা সাইলেন্ট থাকায় বুঝতে পারেনি অনুপমা। টিচার্সরুমে এসে ফেসবুক খুলতে গিয়ে দেখল ইতোমধ্যে চারটে মিসকল রয়েছে মীরার। একটু বিরক্তই হল সে। ক্লাস  টুয়েলভে পড়ে মেয়েটা। কিন্তু প্রতিদিন চার-পাঁচবার ফোন করবেই। সে রিংব্যাক করতেই মীরা চেঁচিয়ে উঠল, মা পাস্তার প্যাকেটগুলো কোথায়?

ব্যাগ গোছাতে গোছাতে অনুপমা জানাল, ওভেনের ডানদিকের তাকে সবুজ রঙের কন্টেনারটা দেখতে পাচ্ছিস?

— হ্যাঁ।

— সবসময় ওখানেই তো পাস্তার প্যাকেটগুলো রাখা থাকে।

— আচ্ছা দেখছি।

কোনো সাড়াশব্দ নেই। কন্টেনার খোলার আওয়াজও পেল না সে। অনুপমা বুঝতে পারল মেয়েটা এমনিই ফোন করেছে। পাস্তা সে বানাবে না। হয়ত মা এখন কোথায় সেইটাই জানবার ছল।

মীরা বলল, পেয়েছি। কখন ফিরছ?

ফোনটা কেটে দিতে লম্বা শ্বাস ফেলেছিল অনুপমা। তখনি মীরা তার মোক্ষম চালটি চালল, তুমি সবসময় আমার উপর বিরক্ত থাক কেন?

উত্তর করল না সে। 

মাস ছয়েক ধরে এই ব্যাপারটা খেয়াল করছে অনুপমা। মেয়েটা কি বাপের মতোই সন্দেহবাতিক হবে! ভাবনাটা মুহুর্তে মাথায় এসে মিলিয়ে গেল। অনুপমা ঠিক করল শীঘ্রই রজত সম্পর্কে সে মীরার সঙ্গে কথা বলে নেবে। তখনি কে যেন তার নাম ধরে ডাকল – অনুদি!

অনুপমা ফিরে দেখল দরজার সামনে রজত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রজত বলল, পেয়ে গেছি।

— কোথায়?

— পাটুলি।

— যাদবপুরে পেলেন না?

— পেয়েছিলাম। কুলোলো না। 

— বাপ্রে। আপনার কুলোলো না? এদিকে খবর পাচ্ছি যে রজত দাশের নোটস দেদার বিকোচ্ছে কলেজস্ট্রিটে। 

— হ্যাঁ। নোটস ছাপিয়ে ফ্লাট কিনব।

— কিনতেই পারেন।

— ওসব রটাবেন না। রজত হাসতে হাসতে বলল, জানতে পারলে লজ্জায় পাবলিশার গলায় দড়ি দেবে।

— যাই বাবা। পাল্টা হেসে অনুপমা বলল, এবারের নাইনের ব্যাচটা যা খাজা না। যোগ-বিয়োগও ভুল করছে। 

— সবই আমাদের দোষ।

— তা যা বলেছেন। সরকারি শিক্ষক শুনলেই লোকজন ভাবে আমরা শুধু স্কুলে মাইনে নিতে আসি।

রজত আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল।

তাকে সুযোগ না দিয়ে অনুপমা মজা করল, অবশ্য কেউ কেউ নোটসও লিখতে আসেন।

পালাবার আর পথ পেল না রজত। বলল, আমার এখন ফার্স্ট ফ্লোর। ক্লাস এইট।

মুচকি হেসে অনুপমা ক্লাসে ঢুকল।

রজত বছর তিনেক হল অনুপমাদের স্কুলে জয়েন করেছে। থাকে স্কুলের কাছেই একটা ভাড়াবাড়িতে। গোসাবার ছেলের ভাঙড়ে এসে থাকতে অসুবিধা হবার কথা না। কিন্তু রজতকে যেন কলকাতার নেশায় পেয়েছে। উচ্চারণ আর হাবভাবে সে কলকাতার ছেলে হয়ে উঠতে চায়। এদিকে স্থায়ী ঠিকানা ছাড়া কী তা সম্ভব? রজত বুঝে গেছিল গোসাবাকে লুকোতে গেলে আগে দরকার কলকাতার একটা স্থায়ী পিনকোড।

স্কুলের পর প্রায়দিন সে অনুপমার সঙ্গে ফিরত। অনুপমা থাকে যাদবপুরে। রজতও ওখানে ফ্ল্যাট কিনতে চায়। এইট-বিতে নেমে রফুর রিক্সায় ওঠে অনুপমা। রজতও মাঝে মাঝে রিক্সায় উঠে খানিকটা এগিয়ে যেত। 

সেদিন রাত এগারোটার দিকে হঠাৎ রজতের ফোন। অনুপমা ভেবেছিল ফ্ল্যাটের চক্করে ফেঁসে গেছে বুঝি। রজত জানাল তার মাসিমাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে। মনে করেছিল তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ভর্তি করানোর ঝামেলা মিটল এই সবে।

অনুপমা জিজ্ঞেস করল, আছেন কোথায়?

— এইট-বিতে।

— আচ্ছা আমি রফুকে ফোন করে দিচ্ছি। ও আপনাকে নিয়ে আসবে।

কোভিডের সময় অ্যাপ বানানোর একটা অনলাইন কোর্সে ভর্তি হয়েছিল মীরা। কোর্সটা শেষ করেনি। এদিকে ভোর অব্ধি ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বাঁধা উত্তর – অ্যাপ!

অনুপমা মেয়ের দরজায় নক করল। বিরক্তির সঙ্গে মীরা বলল, কী!

অনুপমা জানাল তাকে আজ মায়ের সঙ্গে শুতে হবে। 

স্ট্যান্ডে রফু ছিল না। রজত এলো প্রায় এগারোটা চল্লিশ নাগাদ। এসেই হেসে বলল, আপনাকে ঢপ দিয়েছি। 

রজতের মুখ দিয়ে মদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। 

অনুপমা বলল, নিঃশ্বাসে তা বোঝা যাচ্ছে।

আরেকবার হাসল রজত। ততক্ষণে মীরা রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। রজতকে দেখে মায়ের দিকে তাকাল। 

রজত বলল, আসলে গেছিলাম সব্যসাচীর বাড়ি। আমরা একসঙ্গে বি-এড করেছিলাম। ওর স্কুল এদিকেই। লাকি খুব। 

মাঝখান থেকে মীরা বলল, আমি শুতে গেলাম। 

আবহাওয়া গরম। রজত বুঝতে পেরেছিল। বলল, আমি সোফাতেই একটু লটকে নেব। খেয়ে এসেছি। নো প্রবলেম। কাল তো রোববার।

— বাহ্‌, খেয়ে এসেছেন বললেই হল? অনুপমা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল।

রজত তাকে বাধা দিল, প্লিজ অনুদি। একদম খেতে পারব না। 

অনুপমা পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, জল ছাড়া আর কী খেয়ে এসেছেন?

রজত চশমাটা খুলে নিয়েছিল। রুমালে কাচ মুছতে মুছতে বলল, ড্রাই চিলি চিকেন।

— এ বাবা! তাহলে তো খিদে পেয়ে গেছে?

— প্লিজ অনুদি!

অনুপমা চোখ বড়ো করে বলল, একদম চুপ!

— আপনি অংকের টিচার হয়ে কিন্তু বাংলার টিচারের মতো রাগ দেখাচ্ছেন।

অনুপমা হেসে বলল, অংকে বুঝি ব্যথা ছিল? তা এখন খাবেনটা কী?

এবার দুহাত জোড় করে রজত বলল, ক্ষমা দেন।

ফ্রিজে পর্ক সসেজ ছিল। সেটাই সামান্য ফ্রাই করে রজতকে দিল অনুপমা। 

সসেজের টুকরোটা মুখে পুরেই সে হেসে ফেটে পড়ল। কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপর বলল, একটা জিনিস হয়েছে। 

— সেতো বুঝতেই পারছি।

— প্ল্যান ছিল সব্যর বাড়িতে আজকে থাকব। অনেকদিন ধরেই ডাকছে। যাওয়া হচ্ছিল না। আজকে গিয়ে দেখি ব্যাটা সব রেডি করে রেখেছে। সটাসট শুরু করে দিলাম। হঠাৎ দরজায় নক্‌। ওমা, কে এলো বলুন তো?

রজতের কথা বলার ভঙ্গিতে অনুপমাও হেসে ফেলছিল। বলল, তা আমি কী জানব। 

— রূপা ম্যাম! ব’লেই রজত থেমে গেল। সে যেন অনুপমার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে।

— আমাদের রূপা?

— আজ্ঞে, আমাদেরই রূপা। রূপা ঘোষাল। হিস্ট্রি। 

অনুপমা কী বলবে বুঝতে পারছিল না। 

রজত বলল, রূপা ম্যাম জানতেন না আমি সব্যর বন্ধু। সব্যও জানত না আমরা একই স্কুলে চাকরি করছি। কী কেলেঙ্কারি বলুন তো? কে আগে পালাব সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। রূপা ম্যাম দেখি আমার থেকে পেছন ফিরে রয়েছে। সব্য তখনো কিছু বুঝতে পারেনি। আমার সঙ্গে আবার রূপা ম্যামের পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিল। আমার হাত থেকে তো গ্লাসটা পড়েই ভেঙে গেল। ইশ! যাতা। তারমধ্যে আবার বিরিয়ানি নিয়ে স্যুইগি  হাজির। 

— তখনি মাসিমার গল্পটা বানিয়ে নিলেন? অনুপমাও হেসে ফেলল, তা ভালোই হয়েছে। আপনার বন্ধুর হিল্লে হল তাহলে।

— রূপা ম্যাম ফর্টি সিক্স।

— তো?

নিজের ভুল বুঝতে পেরে রজত বলল, কিছু না। 

সেদিন আড্ডা দিতে দিতে প্রায় ভোর হয়ে এসেছিল। দূর থেকে আজানের সুর ভেসে আসতে অনুপমা হাই তুলল। 

রজত বলল, আমি এবার লটকে নেব। কাল আটটায় ডেকে দেবেন প্লিজ।

অনুপমা উঠতে উঠতে বলল, খেয়ে যাবেন।

সে ঘরে ফিরে দেখল মীরা তখনো জেগে। বুকের উপর ল্যাপটপটা নিয়ে কোনো সিরিজ দেখছে হয়ত। মাকে দেখে বলল, উনি তোমার কলিগ?

অনুপমা বালিশে মাথা রাখল, হ্যাঁ।

— আগে ওর কথা শুনিনি তো।

— রজত বেশ ফাজিল ছেলে। 

— হ্যাঁ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ও কি তোমার খুব ভালো বন্ধু? আমার ওরকম ছেলেদের ভালো লাগে না।

অনুপমা মেয়ের দিকে ফিরে বলেছিল, তুই খুব জাজমেন্টাল হয়ে যাচ্ছিস। 

আর কোনো কথা বলেনি মীরা। ল্যাপটপটা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল। 

রজত অবশ্য এতোটাও ফাজিল নয়। তার সবকিছুই মেপে চলা। অনুপমা ভাবে ছেলেটার সবকিছুই শুধু যেন কলকাতায় সেঁধিয়ে যাবার লক্ষে করা। একাডেমি তে নাটক দেখল। সীমা আর্ট গ্যালারির এগজিবিশনে গেল। ক্যাফেতে বসে চুমুক দিল কালো কফিতে। বিয়ার খেল অলিপাবে। নেটফ্লিক্সে ব্ল্যাক মিররের শেষ সিজনটা দেখে ফেসবুকে লিখল –  ওয়েস্ট অফ টাইম। তারপর বন্ধ হয়ে যাওয়া ফেভারিট কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেও ভুলল না। তার সবকিছুই কলকাতা। চক্রাকারে, বক্রাকারে, সোজাসুজি বা ভণিতায় – শুধুই কলকাতা। বুঝি ফেভারিট খোলা থাকলে সে শক্ত টোস্ট আর চা-এ চুমুক দিয়ে লিটিলম্যাগ নিয়ে আলোচনা করত? অনুপমা স্কুলের করিডর দিয়ে হাঁটবার সময় এইসব ভাবছিল। তখনি রূপা ম্যামের সঙ্গে দেখা। সে হেসে ফেলল নিজের ভাবনায়, কিন্তু রূপা ম্যাম বুঝল উল্টো! কটমট তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অনুপমা গম্ভীরভাবে ক্লাসে ঢুকে টেবিলে ডাস্টার ঠুকে চকের গুড়ো ঝাড়তে লাগল। 

রোল নং – ২। রেহানা সুলতানা আজকেও আসেনি। অথচ মেয়েটি রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কী সুন্দর গানটাই না গেয়েছিল। ও যে কোনোদিন গান শেখেনি – তা একটুও বোঝা যায়নি। 

— রোল নং – ১৬। সালমা খাতুন।

সালমা ‘ইয়েস ম্যাম’ বলে উঠে দাঁড়িয়েছে। 

অনুপমা জিজ্ঞেস করল, রেহানার খবর জানো? কী হয়েছে ওর?

সালমা দু-দিকে মাথা নাড়ল। 

টিফিন পিরিয়ডে সালমা চুপিচুপি এলো টিচার্সরুমে। 

অনুপমাকে বলল, ম্যাম একটা কথা।

— বল?

— রেহানার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কোরবানি ইদের পরেই ওর বিয়ে। সেজন্য স্কুলে আর আসবে না। 

— তোর কাছে ওর মোবাইল নম্বর আছে?

— ম্যাম, আপনি কিন্তু আমার কথা বলবেন না কারোকে প্লিজ।

— ধুর বোকা। তুই তো আমাকে কিছুই বলিসনি।

বেশ কয়েকবার রেহানাকে ফোন করল অনুপমা। কেউ ফোন ধরল না। আবার সালমাকে ডাকল সে। রেহানার ঠিকানাটা নিয়ে নিল। 

রজতকে জানালে রজত বলল, পাগল নাকি আপনি! ওদের বাড়ি যাবেন বিয়ে বন্ধ করতে? জীবনের প্রতি ভালোবাসা উঠে গেছে বুঝি?

অনুপমা আর কথা বাড়াল না। 

রজত বলল, ইয়ার্কি করছিলাম।

অনুপমা তবু কথা বলল না। 

পরের দিন স্কুলে ঢোকবার আগে রজতের সঙ্গে দেখা। ভাড়াবাড়ি থেকে স্কুলটি বেশি দূরে নয়। সে একটা স্কুটি কিনে নিয়েছে। 

রজত বলল, অনুদি যাবেন?

— স্কুলেই তো যাচ্ছি।

— ওখানে নয়। রেহানাদের বাড়ি। 

— আগে স্কুলে গিয়ে তারপর বেরোলে হয় না?

— আমার মনে হয় এটা আনঅফিসিয়ালি করাটাই বেটার। 

অনুপমা আর কিছু ভাবল না। সটান উঠে পড়ল রজতের স্কুটিতে।

রেহানার বাড়িটা বেশ দূরে। রোজ মেয়েগুলো এতোটা রাস্তা পেরিয়ে স্কুলে আসে তার জানা ছিল না। 

টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর। ঘরের পাশে নারকেল গাছে একটা ছোটোমতো গরু বাঁধা। সামনের দাওয়ায় রেহানার মা রান্না করছিল। 

অনুপমা তার কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিল। 

রেহানার মা সঙ্গে সঙ্গে আঁচলে হাত মুছে তাদের ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। রেহানা এখন নেই। জল আনতে গেছে। তার মা চা করে দিল। 

অনুপমা বলল, রেহানা খুব ভালো মেয়ে। মাধ্যমিক দিলে প্রথম ডিভিসন পেতে পারে। ও স্কুল যাচ্ছে না অনেকদিন। তাই খোঁজ নিতে এলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই রেহানা হাজির। 

স্কুলের টিচারকে দেখে অবাক। 

রেহানার মা ঘর থেকে বেরিয়ে কাকে যেন ডাকতে গেল। 

রজত উসখুশ করছিল।

অনুপমার কানে কানে বলল, তাড়াতাড়ি। 

রেহানা মুখ নীচু করে রয়েছে। 

অনুপমা তার দিকে তাকাল, তোমার খবর পেয়েছি। বিয়ে করতে চলেছ? আর পড়বে না?

রেহানা মুখ তোলে না। বোঝা যায় তার চোখ ছলছল করছে। 

রজত জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবা কোথায়?

রেহানা কোনোরকমে জানাল, কেরালায়।

— কোনো ভাইবোন নেই?

— দুই দাদা আছে। ওরা দিল্লিতে। ইদের সময় আসবে। প্রতিবছর শীতকালে চলে যায়। বর্ষার সময় ওখানে কাজ থাকে না তো। তখন চলে আসে। 

— কী কাজ করে?

— যা পায়। 

রেহানা মুখ তুলে অনুপমাকে বলল, পরিযায়ী শ্রমিক।

তার উচ্চারণ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে এই শব্দটি কোভিডের সময় নতুন শিখেছে। 

খানিক পর রেহানার মা একজন বয়স্ক মানুষকে নিয়ে এলো। লোকটি রেহানার দাদু। 

অনুপমা লোকটিকে বলল, আপনারা মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দেবেন? ওর তো সবে ১৫ বছর বয়েস। ভালো পড়াশোনা করছে। সামনেই মাধ্যমিক।

রেহানার দাদু থেমে থেমে কথা বলল, কী করব বলুন। ভালো ছেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। দু-তলা বাড়ি। ব্যবসা বোঝে। এর তো বাপ দাদারা থাকেই না। সব ভিনরাজ্যে চলে যায়। মেয়েটাকে একলা সামলাতে হয় ওর মাকেই। 

অনুপমা জানাল সেও তার মেয়েকে একলাই সামলায়। 

— আপনাদের কথা আলাদা। আপনাদের অনেক সুযোগ। একটা ফস্কে গেলে আবার সুযোগ আসবে। আমাদের তো ওসব নাই। ছেলেটা ফস্কে গেলে হয়ত পরে যার সঙ্গে বিয়ে হবে তাকেও অন্য রাজ্যে গিয়ে কাজ করতে হবে। এখানে বিয়ে হলে নিজের ঘর পাবে। স্থায়ী আস্তানা পাবে। একজন মেয়ের আর কী চাই?

— তা বলে পড়াশোনা করাবেন না? মাধ্যমিকে ও কিন্তু ভালো রেজাল্ট করতে পারে। 

— মাধ্যমিক দিয়ে কী হয় দিদি। এরপর তো আবার ১২ ক্লাস। তারপর কলেজ। তারপর? তারপর যদি কোনো কিছুই না করতে পারে। 

কী উত্তর দেবে অনুপমা বুঝতে পারছিল না। 

রজত উঠে বলল, তাও একবার ভেবে দেখবেন। 

স্কুলে এসে গোটা ঘটনাটা বলতেই হেডস্যার ক্ষেপে গেলেন, করেছেন কী আপনারা? এখন যদি দলবল নিয়ে স্কুলে চড়াও হয়? আপনি অন্তত আশরাফ স্যারকে নিয়ে যেতে পারতেন। ও নিজেদের কমিউনিটির সঙ্গে কথা বলতে পারত। ইশ। এবার তো যাতা ব্যাপার হতে চলে চলেছে। 

অনুপমা বিরক্ত হল, আপনি বিডিওকে খবর দিন। এমনিতেই আন্ডারএজ বিয়ে। পুরোটাই বেআইনি। 

— আমাকে পাগল ভেবেছেন?

রফুর রিক্সায় বাড়ি ফিরছিল অনুপমা। রফুকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কত বছর রিক্সা চালাচ্ছ?

রফু জানাল, তা প্রায় ধরুন ২৫ বছর। 

— ছেলেমেয়ে কটা?

— ছেলে দুটো। মেয়ে নেই।

কেন জানি অনুপমার মনে হল ভাগ্যিস মেয়ে নেই রফুর।

— ছেলেরা কী করে?

— বড়োটা রঙের মিস্ত্রি।

— এখানেই কাজ করে?

— হ্যাঁ। কলকাতাতেই কাজ করে। বছর পাঁচেক আগে বোম্বে গিছিল। থাকতে পারেনি। বলে শোবার জায়গা দেয় না। একটা ঘরে জনা আটেক থাকত। ঐ একবারই গিছিল। এখন এখানেই কাজ করে। 

—বিয়ে করেছে?

রফু হেসে ফেলল, না করেনি। গ্রামে ভাগাভাগির পর এককাটা জমি পেয়েছি। বলছে ওখানে পাকা ঘর করে তবে বিয়ে করবে। তখন আমরাও গ্রামে চলে যাব। 

— আর ছোটোটা?

— সে আউলাটাইপের। কিছুতে মন নেই। 

— বকেন না?

— আমার কথা সে শুনবে কেন?

অনুপমার ঘর এসে গিয়েছিল। সে নেমে পড়ল। 

মীরা তখনো ফেরেনি। 

মীরা ফিরল রাত ন’টা নাগাদ। 

ডিনারের পর অনুপমা মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।

মোবাইল থেকে মুখ সরাল না মীরা, কী?

— মোবাইল থেকে মুখ না সরালে কী বলব?

— আমি একটা পোস্ট পড়ছি। বলো না তুমি কী বলবে। আমি শুনছি। 

টেবিল থেকে থালাগুলো সরিয়ে নিল অনুপমা। 

মীরা সেইভাবেই বলল, মা আমার অ্যাপের টেস্টিং-এর জন্য একটা আইফোন লাগবে। বাপিকে বলেছি। তোমার আপত্তি নেই তো?

বেসিনে থালা ধুতে ধুতে অনুপমা বলল, আমাকেও বলতে পারতিস। 

মীরা আর উত্তর দিল না। নিজের ঘরে চলে গেল। 

রাতে হঠাৎ বৃষ্টি নামল। সঙ্গে জোর হাওয়া। মীরার ঘরের দরজা বন্ধ। ব্যালকনিতে কাপড় শুকোতে দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো তোলা হয়নি। অনুপমা ব্যালকনিতে কাপড়গুলো তুলতে গিয়ে থেমে গেল। বৃষ্টির ছাট তার গায়ে এসে পড়ছে। মেয়ের প্যান্টি, ব্রা, নাইটি হাওয়ায় দুলছে। নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছিল অনুপমার। শরীর জাগছিল। মেয়েকে জন্ম দেওয়ার মুহুর্তের ঠিক বিপরীত অনুভূতি যেন এটি। তখন মেয়ের মুখ দেখে তার কান্না পেয়ে গেছিল। বুঝে গেছিল তার জীবন এবার বাঁধা পড়েছে। এই শেকল ভেঙে সে বেরোতে পারবে না। অতটুকু একটা বাচ্চা। সে যদি মরে না যায়, তবে কি সে নিজেই বেঁচে থেকে মরে যাবে না? মীরা মরেনি। স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠেছিল। এখন তার যৌবন দোল খাচ্ছে ব্যালকনিতে। অনুপমা মেয়ের প্যান্টিটা নাকের কাছে তুলে ধরল। তারপর সেটি বাইরে ছুঁড়ে আবার নিজের ঘরে এসে শুলো। তার শরীর তখনো জেগে ছিল। ভোর অব্ধি ঘুম এলো না। 

যাদবপুর থেকে ভাঙড়ের দূরত্ব বেশ অনেকটা। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে আটটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হয় অনুপমাকে। তাড়াহুড়োয় খেয়াল করা হয়নি। রফুর রিক্সায় বসে সে দেখল গতরাতে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল রজত – কাল লিভ নিতে পারবেন প্লিজ! 🙂

অনুপমা চমকে উঠল। রজতকে ফোন করতে জানাল আজ তার ফ্ল্যাটে রঙের লোক আসবে। 

অনুপমা বলল, সেখানে আমি কী করব।

— আহা, আপনার এস্থেটিক্সের উপর আমার অগাধ বিশ্বাস।

— আপনি সাহিত্যের লোক হয়ে আমার এস্থেটিক্সের উপর বিশ্বাস রাখছেন?

— প্লিজ। আসুন না। আপনার বাড়ি থেকে তো বেশিদূর নয়। 

না করতে পারল না অনুপমা। নতুন ফ্ল্যাট। এখনো ফার্নিচার আসেনি। রঙ হয়নি। হয়ত বা জানলার কাচগুলোও লাগানো হয়নি। নিজের মধ্যেই কেমন শিহরণ টের পাচ্ছিল সে। যেন খোলা চারদিক, লোকজনের কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, মেঝেতে ধুলোর সঙ্গে বালি মিশে আছে – উপরে তাকালে বুঝি ছাদটাও উধাও হয়ে যাবে… অনুপমা রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। 

রফুকে বলল, এখানেই নামিয়ে দাও। 

হাউজিং কমপ্লেক্স নয়। একটা চারতলা বিল্ডিং-এর তিন তলায় ফ্ল্যাট নিয়েছে রজত। বড়ো রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পাড়ার ভেতর।

রজত জানাল, খবর নিয়ে রেখেছি। বর্ষায় জল জমে না। 

ডাবল বেডরুম। কিচেন আর দুটো ওয়াশরুম ছাড়াও ছোটোমতো বৈঠকখানা রয়েছে। তবে অনুপমার সবথেকে পছন্দ হল ব্যালকনিটা। ছোটো হলেও সামনে পুকুর। গাছপালাও রয়েছে বেশ। 

— চা খাবেন তো?

উত্তরের অপেক্ষা করল না রজত। সে কিচেনে গিয়ে ইন্ডাকশানে জল বসাল। অনুপমা উঁকি দিয়ে দেখল বেডরুমে একখানা ডিভানও পাতা রয়েছে। 

ট্রে-তে চা নিয়ে রজত বলল, এদিকে আসুন।

ব্যালকনিতে দুটো চেয়ার ফেলা। 

চেয়ারে বসতে বসতে রজত বলল, ভোরের দিকে পাখির আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। 

অনুপমা বলল, এখানে একটা দোলনা টাঙাবেন। কিছু অর্কিডও রাখতে পারেন। 

— ফাটাফাটি। রজত একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছে।

— বেতের দোলনা। আপনি দক্ষিণাপনে পেয়ে যাবেন। 

— আহা চাঁদের আলো। হাতে স্কচ। তারউপর দোলনা। ভেবেই নেশা ধরে যাচ্ছে। 

— ভোরের বেলা পাপিয়া ডাকবে না?

রজত আকাশের দিকে তাকিয়ে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল, ঐ দেখুন!

— কী?

— প্লেন উড়ছে।

অনুপমা রজতের ইয়ার্কিতে হো-হো করে হেসে উঠল। কাপ থেকে চা ছলকে পড়ল রজতের পাজামায়। 

কিছুক্ষণ পর রঙের লোক এলো। তার হাতে দুটো ক্যাটালগ। রঙের অজস্র শেডস তাতে। 

অনুপমা বলল, ব্যালকনির জন্য স্নো-হোয়াইটটাই বাছুন। কোল্ড কালার। বৈঠকখানার যেদিকের দেয়ালে পেন্টিং বা ফটোগ্রাফ রাখবেন, সেখানে হবে জিনিয়া ব্লুম। দরজাগুলো কি পালিশ করবেন? না হলে ইন্ডিগো ব্লু ভালো মানাবে।

— ফলস সিলিং করব? রজত জিজ্ঞেস করল।

— একদম নয়। প্লিজ।

— তথাস্তু। 

রঙের লোকটি চলে গেলে অনুপমা বলল, আপনি কি এখানে থাকতে শুরু করেছেন?

— মাঝে মাঝে আসি। তাই খানিকটা ব্যবস্থা করে রেখেছি। এখনো এলপিজি কানেকশান নেওয়া হয়নি।

— রান্নাও করেন?

— হ্যাঁ। ম্যাগি অথবা খিচুড়ি। আপনি কী খাবেন?

—কিছু না।

রজত শুনল না। ম্যাগি নিয়ে এলো। সঙ্গে এবার চা নয়; কফি। 

রোদ কমে গেলে অনুপমা বেরিয়ে গেল। ভেবেছিল রজত হয়ত থাকতে বলবে। সেই ধুলো, বালি, ডিভান, ইন্ডাকশান সব যেন তাকে থেকে যেতে বলছিল। 

রজত বলল, লিফট নেই। এটাই সমস্যার। 

— আমার পায়ে বাত নেই। অনুপমা শ্লেষের সঙ্গে জানাল। 

রজত তা বুঝতে পারল না।

মীরা সত্যিই একটা নতুন অ্যাপ বানিয়ে ফেলেছে। তবে এই কাজটা সে একা করেনি। মোট চারজন মিলে অ্যাপটা বানিয়েছে তারা। সেই উপলক্ষে আজকে বাড়িতে পার্টি।

অনুপমা জিজ্ঞেস করেছিল, কী রাঁধব?

— কিছু না। মীরা জানাল, স্যুইগি থেকে অর্ডার করব। তুমি কিন্তু বিরক্ত হয়েও না।

— বিরক্ত হব কেন?

— না। এমনি বলছি। সুজয়কে তো তুমি চেনো। শ্রীতমা আর সাগ্নিকের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়নি। আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। ওরা আসবে। 

— ভালোই তো।

মীরা যেন কিছু লুকাতে চাইছে। মাকে বলল, অ্যাপটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে না তো।

— তুই নিজেই তো কথা বলতে চাস না এটা নিয়ে।

মীরা জানাল, তারা মেয়েদের সেফটি নিয়ে এই অ্যাপে কাজ করেছে। অ্যাপটা ইন্সটল করলে জিপিএস থেকে নিয়ারেস্ট পুলিশস্টেশনের নম্বর চলে আসবে। এছাড়া, ধরো তুমি কোথায় রয়েছ, সেটার জিপিএস আমাদের ক্লাউডে স্টোর হয়ে থাকবে। এখন তুমি জাস্ট একটা ট্যাপেই পুলিশের সঙ্গে কনট্যাক্ট করতে পার। আবার সেই সঙ্গে কোনো বিপদ বুঝলে নিজেই তোমার লোকেশনটাতে রেড এলার্ট জারি দিতে পার। সেটা তোমার কাছাকাছি থাকা ফ্রেন্ডের ম্যাসেজবক্সে চলে যাবে। ডেমো দেখবে?

অনুপমার ফোনে মীরা তাদের অ্যাপটা ইন্সটল করে দিল। 

অনুপমা অ্যাপটা অন করলেই স্ক্রিনে যাদবপুর থানার নম্বর দেখতে পেল। 

মীরা বলল, এবার তুমি তোমার জিপিএস লোকেশনটা রেড এলার্ট কর। এই যে এখানে ট্যাপ কর। 

অনুপমা সেটাই করল। 

কয়েক মিনিট বাদেই দেখা গেল মীরার ফোনে অনুপমার লোকেশন চলে এসেছে। 

অনুপমা অবাক হয়ে গেল। 

কিছুক্ষণ পরে রজত ফোন করল। রজত উদ্বিগ্ন, কী হয়েছে?

অনুপমা তখনো বুঝতে পারেনি।

রজত বলল, কোনো বিপদ হয়েছে? আমি কাছাকাছিই রয়েছি। এখুনি চলে যেতে পারব। 

এবার অনুপমা বুঝতে পারল। সে হেসে ফেলল।

মীরা জিজ্ঞেস করল, রজত বুঝি এখানে থাকেন?

— হ্যা। এদিকেই ও ফ্ল্যাট কিনেছে। এখনো সেটলড হয়নি এখানে। তবে মাঝে মাঝে আসে।

— ওহ্‌। মীরা কেমন মুচকি হেসে চলে গেল। 

সন্ধের দিকে কেউ এলো না। সাগ্নিক এসে গিয়েছিল আটটা নাগাদ। বাকিরা এল আরও পরে। 

মেয়ের ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে লাউড মিউজিক শোনা যাচ্ছে। সেইসঙ্গে চারজন প্রায় চীৎকার করে কথা বলে যাচ্ছে। সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। অনুপমা নিজের ঘরে ঢুকে লাইট অফ করে দিল। 

দরজায় কলিংবেল। সে এগিয়ে যেতেই মীরা আগে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। দরজাটা সামান্য খুলে বিয়ারের পেটিটা ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। অনুপমা এক ঝলক দেখতে পেয়েছিল লোকটাকে। লোকটা রফু। 

অনুপমা জিজ্ঞেস করল, তুই রফুকে এগুলো আনতে পাঠিয়েছিলিস? প্যাথেটিক। একদিন পার্টি করছিস। বিয়ার খাচ্ছিস তাও কিছু বলছি না। কিন্তু রফুকে দিয়ে এই জিনিস আনানোটা নিতে পারলাম না। কিডনাগার্ডেন অব্ধি তুই ওর রিক্সায় যেতিস!

মীরা ঘরে যেতে যেতে বলল, মা, তুমি প্লিজ জাজমেন্টাল হয়ে যেও না। রফু কাকাকে আমরা ২০০টাকা দিয়েছি। ও কিন্তু খুশি। 

অনুপমা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। 

ঘরে ফির কপালে অম্রিতাঞ্জন দিল। সন্ধে থেকেই মাথাটা ধরেছিল। এখন মনে হচ্ছে মীরাকে কথাগুলো না বললেই হত। রোজ রোজ একই ঝামেলা পোহাতে তার আর ভালোও লাগে না। 

সে অ্যাপটা ওপেন করল আবার। জিপিএসে নিজের লোকেশন দেখছিল। পাশেই দুটো বটন। একটা ট্যাপ করলে থানায় ফোন যাবে। অন্যটিতে নিকটবর্তী বন্ধুদের কাছে চলে যাবে ম্যাসেজ। সেখানে আবার অপশনও রয়েছে। এই অপশন থেকে ফ্রেন্ড চুজ করা যেতে পারে। মানে লোকেশনটা রেড এলার্ট হলেও ম্যাসেজ সবার কাছে যাবে না। যাকে চুজ করা হবে শুধু তার কাছেই যাবে। 

অনুপমা ফ্রেন্ডলিস্টটা দেখতে দেখতে কী ভাবছিল। তারপর নিজের লোকেশনে রেড এলার্ট বসিয়ে রজতকে ম্যাসেজ করল। 

রজত ফোন করল না। হোয়াটস-অ্যাপে লিখল, বড়ো বিপদ বুঝি?

অনুপমা একটা হাসির ইমোজি পাঠাল। 

এবার বুঝি রজতের সাহস বেড়ে গেছে, যাব?

— এসে কী করবেন? অনুপমা পাল্টা ইমোজিও দিল।

— পর্ক সসেজ নেই?

— না।

— তাহলে গিয়ে লাভ নেই।

অনুপমা স্মাইলি পাঠাল। 

রজত জিজ্ঞেস করল, ভিডিও কল করব?

বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল অনুপমার। কী করবে বুঝতে পারছিল না। খাট থেকে উঠে আগে দরজায় ছিটকানি দিল। তাও পাশের ঘর থেকে ওদের আওয়াজ এখান অব্ধি চলে আসছে। সে লাইট জ্বালাল। আয়নায় দেখে নিল মুখটা। খানিকটা চুল কপালের উপর টেনে নিল। আলনা থেকে একটা শড়ি নিয়ে দরজার নিচে রেখে দিল যাতে ঘরে যে আলো জ্বলছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা না যায়। 

খাটে ফিরে বালিশে হেলান দিয়ে বসল। হোয়াটস-অ্যাপে লিখল, করুন। 

রজতকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। বারবার স্ট্রিমিং থেমে যাচ্ছে। মুহুর্তে পরিস্কার, মুহুর্তে পিক্সেলেটেড। 

রজত হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলছিল। একসময় বেডরুমে গিয়ে দেখাল সে একটা অর্কিড কিনেছে। কিন্তু বেশ ঝামেলার জিনিস। সরাসরি সূর্যের আলোয় রাখা যাবে না। তাই আপাতত জানলাতেই সেটার আস্তানা। ভাগ্য ভালো জানলাটা দক্ষিন-পূর্বমুখী। 

অর্কিড নিয়ে আরও ইনফরমেশন দিতে থাকল রজত। 

অনুপমা চুপচাপ শুনছিল। সে ভেবেছিল রজত বুঝি সাবধানী হতে চাইছে। নিজে থেকে এগোতে পারছে না তাই। 

অনুপমা কথা বলতে বলতে বাম হাত দিয়ে তার নাইটিটা একটু টেনে নামাল। এখন তার ক্লিভেজ স্পষ্ট। 

রজতের দিকে তাকিয়ে বলল, খাওয়া হয়ে গেছে?

— হ্যাঁ। খিচুড়ি।

— আজ বুঝি রঙীন জল খাবেন না?

রজত মোবাইলটা ঘুরিয়ে দেখাল একটা রমের বোতল রাখা রয়েছে। জিজ্ঞেস করল, আপনার তো চলে না নিশ্চয়?

— কীভাবে জানলেন?

— দেখে বোঝা যায়।

— কী বুঝলেন? চলে না?

রজত ভেবে বলল, না, চলে না। চলে বুঝি?

— বলব কেন? বুঝে নিন। এখন তো দেখছেন আমাকে।

রজত শুধু মুচকি হাসল। তারপর যেন তার জরুরি কিছু মনে পড়েছে, এইভাবে বলল, আপনাকে একটা খবর দেওয়া হয়নি। রেহানার বিয়ে হয়ে গেছে গত সপ্তাহে। আমি গতকাল খবর পেলাম। 

রেহানার যে বিয়ে হয়ে যাবে সেটা তো অনুপমা জানতই। এখনই খবরটা দিল কেন রজত? সে কি তাকে এভোয়েড করতে চাইছে। 

ফোনটা কেটে দিল অনুপমা।

তার সারারাত ঘুম এলো না। ভোরের দিকে চা বানাতে গিয়েছিল। তখনি দেখল মেয়ের ঘরের দরজাটা আধখোলা। সে উঁকি দিয়ে দেখল শ্রীতমা আর মীরা খাটে শুয়ে রয়েছে। বাকি দুজন মেঝেয়। মেঝেতে বিয়ারের বোতল আর সিগারেটের টুকরো ছড়ানো। একটা বোতল ভাঙা। অনুপমা সাবধানে চলে গেল কিচেনে। চায়ের কাপটা নিয়ে আবার মোবাইলে চোখ রাখল। 

মিড-ডে মিলে ডিমের বরাদ্দ এসে ঠেকেছে সপ্তাহে একদিন। বাকি দিনগুলোয় ডাল আর সোয়াবিনের তরকারি। বেশিরভাগ টিচাররাই টিফিন নিয়ে আসেন। রজত বরাবর মিড-ডে মিল খায়। তার পাতে এখন একখানা আস্ত ডিম। সে ডিমটা নিয়ে মজা করছিল। অনুপমাকে দেখিয়ে বলছিল, আহা, এটা কিন্তু যে-সে ডিম নয়। একেবারে সরকারের ডিম। এই ডিম খেলে ফ্রিতে মাসখানেক এসএসকেএমে চিকিৎসা পাবেন। 

রূপা ম্যাম বললেন, কদিন কষ্ট করে নিন। এরপর থেকে তো আপনিও টিফিন আনবেন।

অনুপমা রূপা ম্যামের দিকে তাকাল।

রূপা ম্যাম হেয়ালির সুরে বললেন, সেকী রজতবাবু আপনাকে জানাননি?

রজত মুখ নীচু করে নিয়েছে। 

অনুপমাও কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।

তবু রূপা ম্যাম জানিয়ে দিলেন, রজতবাবু কিন্তু ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন। কী রজতবাবু কিছু বলুন।

রজত অনুপমার দিকে তাকাল।

অনুপমা বুঝতে পারছিল কিছু একটা ঘটেছে যা সে জানে না। 

— এতো লজ্জা রজতবাবু? রূপা ম্যাম কিছুতেই ছাড়বেন না। বললেন, বিয়ে করতে চলেছেন আমাদের ইংরাজির টিচার। আমার কাছে পাক্কা খবর রয়েছে।

অনুপমা ঢোক গিলে জলের বোতলটা টেনে নিল। 

ছুটির পর রজত স্কুটি চালিয়ে অনুপমার পিছুপিছু আসছিল। অনুপমা একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না।  

ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না তার। মাঝপথে মীরা ফোন করে জানাল তাদের অ্যাপটা এবার থেকে প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করা যাবে। মীরার গলায় অদ্ভুত আনন্দ ঝরে পড়ছিল। সংসারে ইচ্ছা না থাকলেও কখনো কখনো হাসিমুখে সবার সামনে আসতে হয়। অনুপমা স্পেন্সার থেকে এক বোতল ওয়াইন কিনে নিল। 

ঘরে ফিরে আরও চমক। মীরা নিজে হাতে পাতুরি বানিয়েছে। 

অনুপমা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল। ওয়াইন খেতে খেতে মীরা বলল, মা আমার মাথাটায় জাম্পি করে দেবে?

মেঝেয় বসে পড়ল মীরা। তার চুল ছিল কোমর অব্ধি। কবে যে চুলটা কেটে ঘাড়ের কাছে নামিয়ে এনেছে অনুপমা খেয়াল করেনি। সে চুলে তেল মাখিয়ে মেয়ের মাথায় জাম্পি করে দিচ্ছিল। ওয়াইনের নেশায় দুজনারই ঘুম এসে গিয়েছিল। একসময় সে বুঝতে পারল মীরা তার হাঁটুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। 

রজত হোয়াটস-অ্যাপ করে যায়। অনুপমা সাধারণত কোনো উত্তর দেয় না। ঘরের ছবি পাঠালে একটা হয়ত ইমোজি দিয়ে ছেড়ে দেয়। এখন টিচার্সরুমেও তাদের মধ্যে আগের মতো সখ্যতা নেই। রূপা ম্যাম হাসেন। তিনি সব্যসাচীর সঙ্গে বিয়ে করতে চলেছেন। খবরটা নিজেই সবাইকে দিলেন একদিন। 

বোর্ড এক্সামের তিন মাস আগে সবকটা টিউশন ছেড়ে দিল মীরা। বাড়ির বাইরেও বেরোয় কম। মাঝে মাঝে অঙ্কে কোনো সমস্যা হলে মায়ের কাছে এসে বুঝে নেয়। একদিন তার বাবা এলো। অনুপমা সেদিন ঘরেই ছিল। মীরাকে ডেকে দিয়ে সে ঘরে ঢুকে পড়েছিল। মীরা বাবার সঙ্গে বেশি সময় কাটাল না। 

আশ্চর্যজনকভাবে বোর্ড এক্সামে নাইন্টি ফোর পার্সেন্ট পেল মীরা। সঙ্গে আইআইটিতে র‍্যাঙ্ক করল। 

আত্মীয়স্বজনদের ফোন আসতে শুরু করেছে। মীরাকে চলে যেতে হবে ভোপাল। সে বলল, মা একটা কাজ করলে হয় না?

— বল।

— চলো না কাছাকাছি কোথাও বেরিয়ে আসি। সমুদ্রের ধার। মন্দারমণি যাবে?

রিসর্টটা বুঝি সী-বিচের উপরেই রয়েছে। জোয়ারে জল চলে আসে অনেকটাই। কী একটা ইমেইল করতে হবে মীরাকে। সে রুমে ছিল। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো সমুদ্রের জলে ঝিকমিক করছিল। দূরে দুজন ছেলে-মেয়ের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। তারা পরস্পর ঘন হচ্ছে। তাদের হাসির মৃদু শব্দ এদিকে আসছে। আবার সমুদ্রের গর্জনে হারিয়ে যাচ্ছে। 

অনুপমা তাদের থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না। ছায়া ছায়া শরীরের উত্তাপ তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। তার কান্না পাচ্ছিল। সে মুখ ঘুরিয়ে নিতে চাইছিল। কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। 

সে পা থেকে চটি খুলে খালি পায়ে সমুদ্রের দিকে চলছিল। ঢেউগুলো ভেঙে পড়ছে পায়ের কাছে এসে। হাঁটু ভিজছে। হাঁটুর উপর জলের ঝাঁপট লাগছে। আচমকা সব শব্দ যেন বন্ধ। ছায়া ছায়া শরীর দুটোও ফিরে আসছিল। সে চোখ বন্ধ করে নিল। মুহুর্তে মনে হল বঙ্গোপসাগর বুঝি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নাছোড় টান। সে ভয় পেয়ে গেল। 

রাতে রিসর্টের রেস্তোরাঁতেই খেতে গিয়েছিল। সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে অনুপমা হঠাৎ উঠে পড়ল। মীরা বুঝতে পারছিল না।

অনুপমা টেবিলটার সামনে গিয়েই গম্ভীর গলায় ডাকল, রেহানা!

রেহানাও অবাক হয়েছে। সে তার বরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিল।

অনুপমা চেঁচিয়ে উঠল, আপনিই রেহানার বর? ১৫ বছরের মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন? জানেন কি আপনাদের বিয়েটা অবৈধ? শুধু অবৈধ না আপনি ওকে রেপ করেছেন। 

রেহানার বর উঠে দাঁড়িয়েছে।

মীরা ছুটে এসেছে মায়ের কাছে। 

রেহানা কাঁদছে। কথা বলতে পারছে না। 

মীরা রেহানার বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল।

রেস্তোরাঁর ওয়েটারগুলো সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে অনুপমাকে বলল, ম্যাম আপনি কিন্তু আমাদের গেস্টের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করছেন।

রেহানা তখনো কেঁদে চলেছে। 

রেহানার বর পাল্টা চেঁচাল, মুখ সামলে কথা বলুন।

মীরা আবার সামাল দিল।

সে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। 

অনুপমা মেয়ের কাঁধে ভর দিয়ে রুমে ফিরে যাচ্ছিল। মীরা তার মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ তার সবকিছুর প্রতি ঘেন্না হতে শুরু করল। মেয়েটার হাতটাকে মনে হচ্ছিল জল্লাদের দড়ি। সে যেন ঝুলে রয়েছে। মৃতদেহের মতো। তারপর সে নিজেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু দিল।

মীরা তার মাকে বুঝতে পারছিল না। 

রুমে ফিরে অনুপমা সোজা বাথরুমে চলে গেল। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠান্ডা করতে চাইছিল সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *