তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব  চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

অধ্যায়: নয় 

জাদুজগতের বন্ধ দরজাটা খুলল কোটিকল্প। তার দুই বিস্মিত চোখের সামনে ঘটল ঘটনাটা। খোলা দরজা দিয়ে সে ঢুকল এসে অন্য এক আশ্চর্য পৃথিবীতে। ঢুকে সে আরও আশ্চর্য হয়ে গেল। সে দেখল, সে ওই একই মেলার প্রাঙ্গণে থেকে গেছে। সেই একই জনতা, একই পসরা, একই ভিড়। তাহলে কী আর পার্থক্য থাকল ? তাহলে এটা অন্য জগৎ হবে কোন্‌ আক্কেলে ? এত বক্তৃতা দিয়ে এত আয়োজন করে দরজা-টরজা খুলে তাকে একই মেলায় রেখে দেওয়ার কোন যুক্তি আছে ? সে দেখেছিল স্পষ্ট একটা বন্ধ দরজা। মেলাপ্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে এক বিভাজিকার গায়ে। তারা ছিল এধারে। ওধারে কী ছিল জানত না সে। ছিল সবই চোখের অন্তরালে। তারপর সে ক্রমশ বুঝতে পেরেছিল যে সমগ্র মেলাপ্রাঙ্গণই ঘেরা ছিল ওই বিভাজিকার রুদ্ধ ঘেরাটোপে। ব্যাপারটা সে আগে লক্ষই করেনি। এতক্ষণ ভেবেছিল যে মেলাপ্রাঙ্গণ উন্মুক্ত চতুর্দিকে। এবার বুঝল, মোটেই তা নয়, তার চারটি ধারই ঘেরা। আরও দেখতে গিয়ে সে আরও অবাক হল। কেবল ধারগুলিই নয়, মাথার ওপরটাও আচ্ছাদিত। ওরে হরিবোল, পরে সে আবিষ্কার করে হতভম্ব হয়ে গেল। পায়ের তলাতেও পুরু দেয়ালের ঢাকনাওলা ভিত্তি। তার মানে, মেলাপ্রাঙ্গণের সবদিক ঘেরা আচ্ছাদনে। অর্থাৎ এই মেলাপ্রাঙ্গণে উপস্থিত সমস্ত বিচরণশীল জনতা আসলে এক আবদ্ধ জগতের বাসিন্দা। আরও সাদা কথায়, সবাই এক বদ্ধ খাঁচায় ঘোরাফেরা করা মানব সম্প্রদায়। কোন এক চিড়িয়াখানায় থেকে যাওয়া আবদ্ধ প্রাণিকুলের হম্বিতম্বি। অথবা বলা যেতে পারে, গোটাটাই কোন এক তথাকথিত মুক্তমঞ্চে ব্যাপক প্রদর্শনীর আয়োজন যা আসলে খোলা আকাশের তলায় হলেও কোন না কোন প্রান্তে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কোন ক্যাম্পাসের অন্তর্ভুক্ত আর ওই খোলা আকাশটাও এক বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়, কারণ সীমানা তার রচিত বায়ুমণ্ডলের অদৃশ্য প্রাচীর দিয়ে যার বাইরে যাওয়ার বা বেঁচে থাকার কোনও উপায় নেই। সে এতসব বেড়াজালের আবদ্ধ বন্দিদশা আগে কেন বুঝতে পারেনি ঈশ্বর জানে। চোখ তো তার এখন যেমন সর্বদা তেমনই ছিল। তবুও কিছুই দেখতে পায়নি। তখন সে বুঝল, মানুষ সমুদয় তথ্য কেবল চোখেই দেখে না, অন্যসকল ইন্দ্রিয়সমূহের সাহচর্যে উপল্বদ্ধিও করে। দেখাটা সম্পূর্ণ হয় বোধের সমন্বয়ে। মানুষের এই বোধবুদ্ধির জগৎটাই ঘুমিয়ে থাকে সারাজীবন তারই অগোচরে। তাই সে অনেক কিছুই দেখে না, বুঝতে পারে না জীবনভর। তারও হেন্ দোষ ঘটেছিল এখন পর্যন্ত। তাই সে এতদিন বুঝতেই পারেনি যে মেলাপ্রাঙ্গণ বস্তুত একটি সবদিকেই বদ্ধ খাঁচা। প্রত্যক্ষ দেয়ালগুলি অদৃশ্য ছিল চোখের সামনে।    

সর্বদিকের বদ্ধ খাঁচায় দরজা ছিল কেবল কোন একটি দেয়ালেই। নাকি সমগ্র দেয়ালে একাধিক ? কী দেখেছে আর দেখেনি তা তার নিজেরই খেয়াল নেই। নাহলে দেয়ালগুলি চোখ এড়িয়ে গেল কী করে ? এমনিভাবে তাহলে দরজাগুলিও কি দেখা হয়নি ? কেবলমাত্র একটি দরজাই হয়তো চোখে পড়েছিল। হতেও পারে। বিচিত্র কিছুই নয়। একটিমাত্রই বন্ধ দরজা তার নজরে পড়েছিল, যার সামনে সে দাঁড়িয়েছিল। অন্য আর কোনদিকে ফিরেও তাকায়নি, তাই অন্য দেয়ালগুলিতে বন্ধ দরজা আছে কিনা সে তাকিয়েও দেখেনি। যে দরজার মুখে তাকে দাঁড় করানো হয়েছিল সে কেবল সেটাকেই বন্ধ বলে দেখেছিল, অন্য দেয়ালগুলিতে কী আছে কী নেই দেখেনি বারেক। কেবল ওই একটি দরজার গায়েই দেখেছিল তালা ঝুলতে, সেটারই চাবি ছিল কোটিকল্পের হাতে আর সে সেই দরজাটাকেই খুলেছিল। দরজা খুলে পাওয়া গেল সেই বিভাজিকার অন্য ধার, যা আসলে মেলাপ্রাঙ্গণের বহিঃস্থল। সেটাকেই মনে হল জাদুজগৎ যেখানে মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে তাকে নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ঢোকা হয়েছিল। তখন মনে হচ্ছিল বুঝি তা অদ্ভুত কোন বিশ্ব, ঢুকে কিন্তু চমক ভাঙল পরে বুঝল বিস্ময়ের কিছুই নেই। সেটা আসলে মেলাপ্রাঙ্গণেরই অন্য আরেক প্রতিরূপ। তেমনই জমজমাট, তেমনই লোকের ভিড়। তখন তার মনে হল, এখানে এসে কী এমন পরমার্থ লাভ ঘটল। সে প্রভূত হতাশ চিত্তে তখন সেই প্রশ্নটারই উদ্গীরণ ঘটাল নিচের মত করে,                                                                                                                        

‘এ কী অর্থে জাদুজগৎ ? এতো দেখছি সেই মেলাটাতেই থেকে গেলাম ?’                                                                    

কোটিকল্প তাকে আবার দেখল।  দেখতে দেখতে জানতে চাইল,                                                    

‘জাদুজগৎ মানে তুই কী ভেবেছিলিস ? গল্পকাহিনিতে পড়া রূপকথার জগৎ ?’                                                    

‘তেমন না হলেও এমন একটা দেশ যেখানে বাস্তব এমন প্রখর নয়। এখানে তো দেখছি সেই রুক্ষকঠিন মেলাটাই হাজির রয়েছে। এখানে জাদু কোথায় ? তুমি যাকে বলেছ মায়াপ্রকল্প, সেটাকেই তো দেখছি। জাদু কি ওই মায়াতেই ? তাহলে মূল মেলাটা কী দোষ করল ? জাদু তো সেখানেও আছে !’                                                                                            

তার সমস্ত জিজ্ঞাসা মনোযোগ দিয়ে শুনে কোটিকল্প উত্তর দিল,                                                                

‘যাক, মনে যে তোর প্রশ্ন জেগেছে সেটাই অনেক। প্রশ্ন না থাকলে মানুষ কিছু শেখে না। শোন্‌, বলছি, তোর আরও দেখার দরকার আছে। কোথায় এসেছিস বুঝতে পারছিস না এখনও। এটা যেখান থেকে এলি সেই মেলার মাঠ নয় একদমই। এটা এক অন্য জায়গা। এর চরিত্র একেবারেই  অন্যরকম। তোর চোখ ধাতস্থ নয় বলে ধরতেই পারছিস না।’                       

শুনে তার চেতনা ফিরল। মেলার ওই আবদ্ধ খাঁচার বাইরে গিয়ে আবার এক জনসমাবেশ দেখেই সে ভেবে নিয়েছিল যে সেই একই মেলার মাঠে আছে। সত্যিই জাদুজগৎ শুনে সে একটা কল্পলোকের পরিবেশ দেখার আশায় ছিল। পরিবর্তে একই জনসমাগম, একই পসরারাজি দেখে এখানে কিছু অন্য আয়োজন থাকতে পারে একথা মাথায় আসেনি। প্রথম দর্শনেই অভাবনীয় কোন চমকের মুখোমুখি হবে এমন ভাবনায় থেকেই তার আশাভঙ্গ ঘটেছিল। তাই কী কেমন কিভাবে কোথায় আছে কিছুই আর ধৈর্য ধরে দেখতে যায়নি। মানুষ এমনই করে, এটাই তার চরিত্র। কোনকিছু দেখে না সময় নিয়ে, অপেক্ষা করতে জানে না। সবসময় সে তাড়ায় থাকে, কী যেন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আসলে জন্মের পরপরই পরিবার, সমাজ, সভ্যতা তার মাথায় একথা গেথে দেয় যে জীবন বড়ই ছোট। যা করার তা করতে হবে দ্রুত। ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’—- এই সারকথা সে দেখতে দেখতে বড় হয় বলে জীবনটা তাড়াহুড়ো করে কাটায়। অর্থাৎ ওই সারকথার নেতিবাচক দিকটা মূলধন করে জীবনে, ইতিবাচক দিকটা দেখেও দেখে না। এ বড়ই আক্ষেপের কথা যে জগৎ সবসময় সমস্ত বিষয়ের নেতিবাচক প্রভাবে বেশি প্রভাবিত। শুভ আর অশুভের দ্বন্দে সর্বদা শুভকে পশ্চাদগামী হতে দেখা যায়, অশুভের দাপটে ঝংকৃত সভ্যতা। কেন যে এই প্রভাবের বাড়াবাড়ি কেউ জানে না। এভাবেই সভ্যতার চলন হয়ে গেল বর্তমান পথে, বিকল্প কোন পথ যদি বা ছিল তা ধৈর্য ধরে দেখার চেষ্টাও করল না।                          

আসলে দিগদর্শক সঠিক থাকা চাই। উপযুক্ত পথপ্রদর্শক পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার। সামনে সবসময় এগিয়ে যাওয়ার অন্তত দু’টি পথ থাকে। সবাই বিভ্রান্ত হয় সেই সন্ধিস্থলে এসে। কোন্‌পথটা নেওয়া সঠিক কেউ না দেখলে আপাতদৃষ্টিতে যে পথ সহজ মনে হবে সেটাই মানুষ বেছে নেয়। তাতে পরে কী হবে তা নিয়ে এখন কেউ মাথা ঘামায় না। শয়তানের বুদ্ধি যেমন, ‘আগে সুখ করে নেওয়া যাক, দুঃখের কথা পরে ভাবা যাবে।’ বিবেক থাকে প্রতিটি মানুষেরই, কারো সবল কারো দুর্বল, কিন্তু সে আজকাল সর্বক্ষেত্রেই উপেক্ষিত পথপ্রদর্শক। এমন পরিস্থিতিতে কী আর করা যাবে ? নিয়তিনির্ভর হওয়া ব্যতীত উপায় নেই। চলুক সভ্যতা তার পথে, মদমত্ত গৌরবে ভ্রূক্ষেপহীন। বিবেক থাকুক ঘুমন্ত নিষ্ক্রিয়। সভ্যতা মানুষকে দাম্ভিক আর অহংকারী বানিয়েছে, এখানেই যত মুশকিল। সে যদি বিনীত হত তাহলে নিজের অসহায়ত্ব দেখতে পেত। দেখত প্রতি পদে পদে সে অসহায় পার্থিব, প্রাকৃতিক ও মহাজাগতিক শক্তি ও দুর্ঘটনার মুখে। সে বিপন্ন তারই আরোপিত বিধিনিষেধ, সংস্কার এবং তারই দম্ভ ও শক্তির কাছে। যদি এই জ্ঞানচক্ষু এই দিব্যদৃষ্টি পেত সে তখন তাকে পথ দেখাবার সুযোগ থাকত বিবেকের। নেই বলেই বিবেক তার পেশা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সৌভাগ্যক্রমে মেলাপ্রাঙ্গণে সে হারিয়ে গিয়ে নিজেকে আগাগোড়া অসহায় বলে ভাবতে পেরেছিল, আর তাই তার গাইডের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে কোন আপত্তি দেখাবার কথা ভাবেনি কোনদিন। মেলায় তো সকলেই হারিয়ে যায়, কোটিকল্প সবার জন্যই তার হাতটা বাড়িয়ে রাখে। ধরে না তো সবাই। কেউ বা ধরলেও ধরে রাখে কিছুদিন। নিজেকে ‘সাবালক হয়েছি’ ভেবেই ছেড়ে দেয়। যে হাতটা ধরে রাখে আজীবন, তার বিবেক সক্রিয় থাকে। জীবন ও জগৎকে দেখার তৃতীয় নয়ন তার ক্ষেত্রেই উন্মোচিত হতে পারে কোন একদিন। এটাও কিন্তু একটা লোভ। যে হাত ধরে রাখতে চাইবে সারাজীবন তার মনে এই লোভ থাকা চলবে না। সে হবে সরল শিশুর মত, রামকৃষ্ঞায়িত হবে তার মনোভাব। জাগতিক কোন মোহ, দুঃখকষ্ট, সাধ-আল্হাদ সবই সে শোষিত ও সমাহিত দেখবে কালিরূপিণী অসীম তমসাচ্ছন্ন মহাজাগতিক অন্ধমায়ায়। তাহলেই কোটিকল্প তার হাত ধরে তাকে পৌঁছে দিতে পারবে জাদুজগতে, যে জগতে গিয়ে সে খুঁজে পাবে নিজের আপন মনোরম আবাস যেখান থেকে দেখতে পাবে তার প্রাক্তন বাসস্থান মেলার মাঠ মায়াপ্রকল্পটির জনসমাগম ও তাদের অযৌক্তিক, হাস্যকর ও অবাস্তব যত কাণ্ডকারখানা। সে তখন বুঝবে কেন এই জনতার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে উলঙ্গ চলে যেতে পেরেছিলেন শুকদেব।                                                                                                                                          

প্রথমে সে তাই নিজের উত্তেজনা প্রশমিত রাখতে পারেনি অন্যজগৎ শুনে, সে ভেবেছিল সেটা বোধহয় স্বর্গ না হোক কোন রূপকথার দেশ হবেই হবে। এখন সে পরামর্শ অনুযায়ী নিজেকে শান্ত করল। তার ভিতরের অস্থিরতা সে নিজেকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে দিতে পারল। সে ভাবল, সত্যি নিজে বেশি বুঝতে গিয়ে অনেক কিছু হারাবে। সবাই তাই করে, কেউ ধৈর্য রাখতে জানে না শেষপর্যন্ত। নিজেকে পথপ্রদর্শকের হাতে রেখে শান্তি পায় না। সে তখন সব নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার ভিত্তিতে বিচার করতে যায়। নিজেকে সাবালক আর সবজান্তা ভাবতে শেখে। সেভাবেই চলতে চায় বাকি জীবন, স্বাধীনচেতা মনোভাব তার কখনো কারো অধীনস্থ ভাবতে দেয় না। আর কী করবে অন্য কেউ যদি সে নিজেই নিজের চলাচল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার নেয় ? দু’ নৌকায় পা দিয়ে চলা মুশকিল বলেই কোটিকল্প তার হাতটা ছেড়ে দেয়। সে তখন নিজেই নিজের চালক বা অধিকর্তা হয়ে যায়। যে হাতটা ছাড়ল সে আর কোনদিনও সেই হাতটা ধরতে পারে না। জীবন কাটে এভাবেই। তারপর মৃত্যুর আগের মুহূর্তে সে আবার নিজেকে ফিরে দেখতে যায় যেমন দেখেছিল প্রথমদিন। শেষ সময়ে তাই অনেকে বোঝে কী ভুল করে গেছে সারাজীবন। তখন কিন্তু সে উপায়হীন। শোকগ্রস্ত অবস্থায় হাহাকার সঙ্গী করে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে কোটিকল্প সেসময় তাকে দেখে হতাশ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। তারও কিছু করার থাকে না যেহেতু সে নিজের নিয়ম কোন অবস্থাতেই নিজে ভাঙ্গে না।                                                      

পরামর্শ মেনে সে তাই এবার স্থিতধী হয়ে মেলাপ্রাঙ্গণের বাইরের এই জগৎটাকে দেখার চেষ্টা করে। ক্রমশ সে আসল মেলাটার সঙ্গে এই নতুন মেলাটার অনেক পার্থক্য খুঁজে পায়। সে বুঝল, দেখতে এ জগৎটা এক মনে হলেও সেটা কিন্তু নয় একেবারেই। এটা সেই মূল মেলাটার প্রতিচ্ছবি বা প্রতিরূপ। কে যে কার প্রতিরূপ বুঝতে তার গোলমাল পাকিয়ে যায়। পরামর্শ অনুযায়ী সে তখন ভাবে, এই নতুন জগৎটারই প্রতিরূপ হবে ওই মেলার মাঠ, যাকে বলা হয়েছিল আসলে ওটা এক মায়াপ্রকল্প। আসলটা এই অন্য জগৎ, থাকে সেটা মেলাপ্রাঙ্গণের আবদ্ধ খাঁচাটার বাইরে।                                    

সে তখন বোঝে, এই অন্য মেলাটাতে মানুষ আর পসরারাজি থাকলেও তা চরিত্রে অনেকটাই মায়াপ্রকল্পাধীন মেলার তুলনায় ভিন্ন। এই মেলাতে যারা আছে তারা কেউ ছুটছেও না কাজকর্মও করছে না। সবাই নিশ্চল অবস্থাতে আছে, মেলাপ্রাঙ্গণটা পর্যন্ত। এটা দেখে সে এবার সত্যিসত্যিই অবাক হল। তাকে দেখিয়ে না দিলে সে নিজে এই ব্যাপারটা বুঝতেই পারত না সারাজীবন। সেও তখন অন্য আর সবার মতোই ভেসে যেত গড্ডালিকা প্রবাহে আর তারও হাতটা একসময় ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াত কোটিকল্প। যেমন করে সে অন্যদের বেলায়। সে ভাবল, ভাগ্যিস সে হাতটা ছেড়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্ব দেখায়নি। তাই সে এমন অনেককিছু দেখার সুযোগ পাচ্ছে যেটা অন্যরা পায় না।                                              

সে তখন পূর্ণচোখ মেলে তাকিয়ে দেখল এই নতুন নিশ্চল মেলাটাকে। কোটিকল্প বলল,                             

‘দ্যাখ্, এই নতুন মেলা বা জাদুজগৎ, যাই বলিস না কেন, এটার নিয়ম সম্পূর্ণ আমি নিজের হাতে চালাই প্রত্যক্ষভাবে।আমি চলতে বললে এটা সচল হয়, আমি না চাইলে এটা নিশ্চল অবস্থাতেই পড়ে থাকে। এই মেলাটাকে আমি নিজের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি বলেই এটা আসল মেলা। তুই যে মেলাটা থেকে এলি সেটা চলে নিজের ভরবেগে, আড়ালে থাকি আমি। আসলে এই মেলাটার কিছু না কিছু বাছাই করে ওই মেলাটা চলছে, তাই ওটা মায়াপ্রকল্প।’                                         

বলেই কোটিকল্প হাত তুলল। সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল নতুন মেলাটা চলতে শুরু করেছে। সেখানে প্রচণ্ড ব্যস্ততা আর প্রচুর কাজকর্ম দেখা গেল। আবার সে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। আবার সব নিশ্চল পড়ে রইল।                      

‘এবার দ্যাখ্ কী করি।’                                                                                                                                      

সে আবার হাত তুলল। মুহূর্তের মধ্যে ভোজবাজি ঘটে গেল। নতুন মেলা থেকে সমস্ত লোকজন, তাদের কাজকর্ম ও পসরারাজি উধাও নিমেষের মধ্যে। কেবল থাকল একজন, সে ওই গায়ক। আর কেউ নয়।                                          

‘এই মেলাটাতে তুই কাউকে দেখতে পাচ্ছিস না আমি সরিয়ে দিয়েছি তাই। কেবল গায়ককেই রেখেছি, কারণ তুই তার গোটা জীবনটা দেখবি বলে। সে কিন্তু বুঝতে পারবে না তার সঙ্গী কেউ নেই। সে সবাইকে তার চারপাশে দেখতে পাচ্ছে তার নিজস্ব মেলার মাঠে, যেখান থেকে তুই এলি। আসলে এই নতুন মেলাটাতে তুই যা দেখছিস তার সবই আমার পরিকল্পনা। এখান থেকে কী আর কিভাবে যাবে ওই মায়াপ্রকল্প বা মেলার মাঠে তা আমিই ঠিক করি। তাই এই জাদুজগৎটা আমি চালাই সম্পূর্ণ নিজের হাতে। এখানেই আমি ঠিক করি কোন্‌ বিষয় বা ব্যক্তি যাবে ওখানে এবং কী তার বর্তমান ও অতীত বা ভবিষ্যৎ। সবাই ওখানে ভাবে সে চলছে তার স্বাধীন ইচ্ছেমত। আসলে এই বিভ্রম একেবারেই ঠিক নয়। আমি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী যেভাবে ভাবাই তারা ঠিক সেভাবেই ভাবে। এটাকে তুই তাই বলতে পারিস ওটার ব্লু প্রিন্ট। দু’টো মেলা তাই কোন অবস্থাতেই এক নয় একেবারেই।’                                                                          

বাপরে, সে ভাবল। ভিতরে ভিতরে যে এত সে বুঝতেই পারত না কস্মিনকালেও। এখন সে বিশ্বাস করল, কোটিকল্প আসলে সত্যিই এক জাদুকর। তার মত বড় জাদুকর সত্যিই আর কেউ নেই এই জগতে। সে একটা দু’টো নয়, একাধিক জগতের নিয়ন্তা হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে প্রথম দর্শনে কে ভাবতে পারবে যে এত দায়িত্ব তার হাতে। নানা জগতের পরিকল্পনা আর পরিচালনা সে করে, যদি সে না চালায় সব থেমে যায়। সে চললে জগৎ চলে, সে থামলে জগৎ থামে। তার জঠরে জগৎসমূহের ইতিহাস, ভূগোল, বর্ণনা, বর্তমান, ভবিষ্যৎ আর পরিকাঠামো। জগতের প্রতিটি বস্তুর হিসেব-নিকেশ তারই নখদর্পনে, তাকে ভিত্তি করেই চলাচল আর ঘটনাসমূহের ঘটনা হয়ে ওঠা। জাদুজগতের অধীশ্বর সে এবং অন্য জগৎগুলিও তারই আয়ত্তাধীন। সে-ই সর্বত্র শেষকথা।  

‘এবার নিশ্চয় তুই বুঝতে পারছিস যে জাদুজগৎটা তোর ওই মেলাপ্রাঙ্গণ নয় যেখান থেকে তোকে এখানে নিয়ে এলাম দরজা খুলে এবং যেটাকে আমি বলছি মায়াপ্রকল্প ?’ 

তার জন্য প্রশ্নটা রাখল কোটিকল্প, উত্তর শোনার উদ্দেশ্যে নয় যদিও সে তবু ঘাড় কাৎ করল। সেটা খুব একটা নজরে না এনেই কোটিকল্প তাকে বোঝাতে লাগল, 

‘এই যে জাদুজগৎ, এটা আমার কারখানা অথবা খেলাঘরও বলতে পারিস। জগৎটা যখন তৈরি হয়েছে তাকে তো চলতে হবে ? বসে থাকার জন্য তো কিছু থাকা উচিত হবে না। তুমি যদি থাকলেই কোন না কোন দেহধারণ করে, সে তুমি জীবই হও আর জড়ই হও, তোমার চলন-বলন থাকতেই হবে। আমার এই জাদুজগৎটাতে বসে আমি কী কী বস্তু কেন কিভাবে বানাবো, কোথায় কিভাবে কেন রাখব, কী কেন কেমন হবে তাদের চলন-বলন সেসব পরিকল্পনা করি এবং সেই পরিকল্পনার বাস্তব রূপদান ঘটাই। জাদুজগতের কারখানায় বস্তুসমূহ বানিয়ে রাখি পরিকল্পনামাফিক, তাদের কার্যকলাপের ব্লু প্রিন্ট ও ডিটেল নকশা কষে মজুত করে রেখে দিই। তারপর পছন্দ অনুযায়ী তাদের প্রেরণ করি বহির্জগৎটার যেখানে যেমন দরকার হয়। তাদেরই কিছু চলে যায় তোদের ওই পৃথিবী ও সভ্যতার মায়াপ্রকল্পে।’ 

শুনতে শুনতে তার মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কেমন একটা পাগল-পাগল ভাব হতে লাগল। যথেষ্ট ঘাবড়ে গিয়ে সে নিজেকে বুঝিয়ে শক্ত করল, এত দ্রুত পাগল হলে চলবে না। জীবনে পাগল হওয়ার আরও বড় সুযোগ আসবে, তখন ভেবে দেখা যাবে নাহয়। আপাতত সে পাগল হবে না কোনক্রমেই। তাই সে প্রশ্ন তুলল,   

‘বাপরে, তুমি কি ভগবান ?’                                                                                                                              

কোটিকল্প হাসল, সেই আবর্তনশীল হাসিসদৃশ ঘূর্ণি। অন্তর্ভেদী অথচ বিবশ স্বরক্ষেপণে জানাল,                     

‘তুই যদি তাই ভাবিস আমার আপত্তি নেই। তবে আমি ঠিক ভগবান নই। যতই জাদুজগৎটা থাকুক না কেন আমার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আমি কিন্তু মাঠে নেমে নিজের হাতে করি না কোনকিছুই। আমাকে নির্ভর করে সব হয়ে যায়। এখানেই আমার সঙ্গে ভগবানের মৌলিক পার্থক্য। ভগবান সব নিজে করেন, আমাকেও দরকারে চালান। ভগবান বলতে এমনই এক অস্তিত্ব বা চেতনাশক্তি রয়েছে তোদের ধারণাতে।’                                                                                            

সে চুপ করে সব শুনল, কথা বলল না। কী বুঝল সে নিজেও জানে না, তবে কিছু তো একটা বুঝল ঠিকই। আর নিজেকে নিজেই বার্তা পাঠাল সবকিছু বোধগম্য হয়েছে বলে। সে সমস্ত অন্তরাত্মা একত্র করে ভাবল, বোঝার আর কিছু বাকি নেই। তখন কোটিকল্প আবার বলল,                                                                                                     

‘আয়, এবার ওই গায়কটাকেই দেখি আমরা। এখানে তুই গায়ক মানুষটার ভুত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সবই জানতে পারবি। দেখতে পাবি তার জন্ম-জন্মান্তর পর্যন্ত। শুনবি তার অন্তরের কথা—- তার বাসনা, তার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য এবং পরিকল্পনা। দেখবি তার কার্যকলাপের অনুপুঙ্খ বিবরণ, কী কেন কেমন কোথায় ইত্যাদি সমস্তকিছু। সঙ্গে থাকবে তার অন্যান্য জীব ও জড়ের সঙ্গে আচার-আচরণ, অবশ্যই অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সমস্তরকম মেলামেশা। তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য জানতে হলে তার অন্তরঙ্গ আলাপের দ্বারস্থ হতে হবে। সেটা কিভাবে সম্ভব? চিন্তা নেই, আমরা তার সমস্ত অন্তরঙ্গ আলাপ জাদুদণ্ডের অঙ্গুলিহেলনে দেখতে পাব। সে সেসব উচ্চারণ করবে তার কোন একাকিত্ব অবকাশের দুর্বলতায় নিজের সঙ্গে অথবা প্রকাশ করবে কোন আপন মনে করা সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে। আমরা সবাইকে পেয়ে যাব জাদুজগতে যেভাবে পেতে চাই, চিন্তা নেই।’                                                                                                    

বলতে বলতে কোটিকল্প তার হাত তুলল। সে এবার এতক্ষণে বুঝল, ওই হাতটাই আসলে জাদুদণ্ড যার মৃদু নড়াচড়ায় সমস্ত কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। এবং তেমনই কাণ্ড ঘটল এবারও। সে দেখল, ওই গায়ক সচল হল ও তার পাশে এল এক সঙ্গিনী। দুজনেরই পোশাক-আশাক বহুমূল্য রত্নখচিত। নিঃসন্দেহে খুবই দামি, কোটি কোটি টাকা হবেই হবে। আর তারা উপস্থিত প্রাসাদোপম অট্টালিকার রমণীয় এক প্রকোষ্ঠে, যেখানে তারা উপবিষ্ট রাজকীয় আসবাবের আরামে এবং সম্মুখে অতীব সুস্বাদু পানীয় ও দুর্লভ খাদ্যবস্তু। সেই গায়কের হাতে যদিও তার অতি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র যাকে সে ভাবে নিজস্ব দেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তার ওষ্ঠাগ্রের মুখোমুখি ধরা রয়েছে লোভনীয় পানীয়ের স্বচ্ছ সুদৃশ্য গ্লাস সেই সঙ্গিনীর হাতে। সে তাতে মৃদু চুমুক দিয়ে তার হাতের তারযন্ত্রে অঙ্গুলি সঞ্চালনে অস্পষ্ট আন্দোলন তুলতে তুলতে বলছিল,                

‘মাজেনা, আমার অমর হওয়া দরকার। আমার এই কণ্ঠ, এই সঙ্গীতের স্বার্থে। আমি কিভাবে মৃত্যুকে পরাস্ত করব, বলতে পার কি ?’                                                                                                                                                      

তার সঙ্গিনী মাজেনা মধুর হাস্যে তাকে বোঝাল,                                                                                  

‘তুমি যে গান গেয়েছ তাতেই তুমি অমর হয়ে গেছ। তোমার সঙ্গীত তোমাকে ইতিমধ্যেই অমর করে দিয়েছে। তুমি তোমার ভক্তদের উন্মাদনা দেখ। পৃথিবীর কে না তোমাকে চেনে ? অমর হওয়ার কী বাকি আছে আর তোমার ? পৃথিবী না থাকলেও তুমি থেকে যাবে।’                                                                                                                           

গায়ক এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নয়। সে বলে,                                                                                                   

‘কিন্তু আমি আমার দৈহিক সত্ত্বাকে অবিনাশী দেখতে চাই। আমার সৃষ্টির মধ্যে অমর হয়ে থাকা তো পরোক্ষভাবে বাঁচা। আমার এই শরীরের মধ্যে যে আমি সে অমর হবে কিভাবে ?’                                                                             

‘সেটা কি সম্ভব ? নয় নিশ্চয়। এক হতে পারে যদি তোমার সন্তানের জন্ম দিই আমি বা অন্য কেউ। তোমার সন্তানের মধ্যে তুমি তখন বেঁচে থাকবে।’                                                                                                                      

‘এটাও একটা ধারণা। আমি নিজে কিন্তু থাকছি না।’                                                                                         

‘ওটা বোধহয় সম্ভব নয়। শরীরগতভাবে তুমি থেকে যাবে চিরকাল এটা ভাবা যায় না। হতে পারে তোমার জীবনকাল বেড়ে গেল, দীর্ঘজীবন পেলে তুমি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পার।’                                                                      

‘আমার ক্লোন করে রাখা যায় না মাজেনা ? আমার ক্লোন বডির মধ্যে আমি তো অমর হয়ে থাকতে পারি ?’                    

‘ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। তুমি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলতে পার।’                                                                

এখানেই কোটিকল্প হাত তুলল আবার। জাদুদণ্ডের কারিকুরিতে জাদুজগৎ থেমে গেল। গায়ক থাকল তার সেই সুরম্য প্রাসাদে নিশ্চল হয়ে। তার সঙ্গিনী উধাও। বাক্যহীন স্তম্ভিত জাদুজগতে সেই গায়ক ছাড়া কেবল তাদের দু’জনের উপস্থিতি। এই যে দৃশ্যপট বসে দেখল এতক্ষণ তার যে কী উদ্দেশ্য সেটা তো মাথায় ঢুকল না কিছুই। ওই গায়কের মনোগত বাসনা জেনে তার কী লাভ হল ? ধনকুবের ও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের এমন কোটি মনোবাঞ্ছা থাকতেই পারে। এমন বিখ্যাত ব্যক্তিরা তো ভাবে জগৎ তাদের করতলগত। ভাবলে ক্ষতি কী ? সম্পদ ও যশ রয়েছে যাদের, শখ বিচিত্র ও বহুমুখী যদি না হয় তো দোষ কোথায় ? সাফল্য তাদের হাতে, তারা যা খুশি পেতেই পারে। তার মনের প্রশ্ন বা অসন্তুষ্টি মেটাতে উত্তর এল,                                                                                                                                        

‘তুই তো বুঝতে পারলি না কেন দেখলাম গায়কের এই অন্তরঙ্গ আলাপ ? এতে তার জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বোঝা যাচ্ছে। সে কী চায় ? বলবি, চাইতেই পারে। আসলে এই চাওয়াটাই সমস্ত ব্যাপার। এটাই তার মৌলিক চাহিদা। এতেই চালিত হয় সে।’                                                                                                                                              

তার শুনে বেশ অবাক লাগল। প্রশ্ন তুলল,                                                                                            

‘চাইলেই পেয়ে যাবে ? থাক না তার যশ বা অর্থ। তাতে কি কেউ অমর হয় ?’                                                            

‘সে অন্তত তাই ভাবে। আর কে কী ভাবে পরে দেখবি। এই গায়ক ভাবে, তার সম্পদ তাকে অমর বানাবার জন্য যথেষ্ট। দ্যাখ্, সে তার জন্য কী করে।’ 

পরবর্তী অঙ্গুলিহেলনে স্তব্ধ পুরীতে আবার শুরু হল চলাচল। গায়ক সচল হতে এবার এসে হাজির হল অন্য আরও কয়েকজন ব্যক্তি। সেই সুরম্য প্রাসাদ নয় এখন, বোঝা যাচ্ছে খুবই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন অত্যাধুনিক কোন এক চেম্বার, সেখানে ঝাঁ চকচকে দীর্ঘ টেবিলে মধ্যমণি হয়ে বসে সেই গায়ক আর তাকে ঘিরে রেখেছে যে ব্যক্তিবর্গ তারা নামী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও চিকিৎসক। তারা সবাই গম্ভীর, কারণ এক প্রবল সংকট যার উত্তর চিকিৎসাশাস্ত্রে নেই আজ পর্যন্ত। এই গায়ক অমর হতে চায়, তার সত্ত্বাকে নিয়ে শারীরিকভাবে।                                                    

‘আধুনিক বিজ্ঞান য়্যান্টি-এজিং বিষয়টা সম্পর্কে কিছু জানে। তাতে দেখা গেছে জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় কঠোর নিয়মানুবর্তী হলে এবং তার সঙ্গে বাইরে থেকে কিছু বিধান প্রয়োগ করলে জীবনকাল বেড়ে যায়, এই পর্যন্ত। এখানে নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাসও দীর্ঘকাল অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা প্রয়োজন। তাতে সুস্থও থাকা যায়। তারুণ্য কতটা থাকবে সন্দেহ আছে।’                             

চিন্তিতভাবে বলল একজন। গায়কের ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলল,                                                       

‘তারুণ্য বজায় রাখার জন্য অনবদ্য উপায় সার্জারি। তাতে ব্যক্তির চেহারা সতেজ-সুস্থ দেখাবে সবসময়। আর তাতে রিস্কও প্রায় নেইই।’                                                                                                                                         

‘তা ঠিক। তবে শরীরের ভিতরে ধকল কিন্তু যাবে অনেকটাই।’                                                                               

অন্যজন মতপ্রকাশ করল। ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলল,                                                                       

‘আমি ভাবছি শরীরের অভ্যন্তরস্থ ধকল সামলাবারও উপযুক্ত পদ্ধতি হাতেই আছে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির নবীকরণটা নিয়ে ভাবলে কেমন হয় ? এখন তো বিজ্ঞান কিডনি, লিভার, ফুসফুস, হার্ট সবই প্রতিস্থাপন করতে পারছে। সেগুলি ক্ষয় পেতে পেতে নিঃশেষ হয়ে গেলেই তো মৃত্যু হয় মানুষের। যদি সেসব নতুন বসানো যায় ?’                                                 

প্রথমজন জানাল,                                                                                                                                   

‘যাই হোক, সেসব কিন্তু আসল বা মূল প্রত্যঙ্গগুলির মত কর্মক্ষম হয় না। তাছাড়া এসব প্রতিস্থাপন কতটা সংকটমুক্ত তাতেও সন্দেহ আছে।’                                                                                                                                   

ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রতিবাদের সুরে জানাল,                                                                                

‘আপনার এত হতাশ ও নেতিবাচক মতামত না দিলেও হবে। আমার হাতে যা তথ্য আছে তাতে আমি দেখেছি, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিস্থাপন দীর্ঘকাল কোন গ্রহীতাকে সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক রাখে। অবশ্য তা নির্ভর করে এ কাজ কোথায় কারা করবে তার ওপর। এই যে তালিকা, দেখুন।’                                                                                                          

বলেই সে পড়তে লাগল কোথায় কত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে একশ’ শতাংশ সাফল্যের সঙ্গে। সবাই শুনল তার বিবরণ। এবার প্রথম কথা বলল সেই গায়ক,                                                                                           

‘আমি শুনেছি ভারতীয়, আমি বোঝাচ্ছি এশিয়া মহাদেশের ভারতবর্ষকে, রেড ইন্ডিয়ানদের নয়। শুনেছি ভারতবর্ষে সাধু-সন্ন্যাসীরা অমরত্ব পেতে পারত। শুনেছি সেখানে এখনও হিমালয় পর্বতমালার কোথাও অমরত্বের অনুশীলন চলে এবং শুনেছি যে তিব্বতেও নাকি প্রচলিত আছে এমন ধারণা, বিশেষ করে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মধ্যে ?’                              

সবাই শুনল তার কথা। এবার তৃতীয় একজন বলল,                                                                            

‘ওটা একটা বিশ্বাস মাত্র। তাতে কোন বাস্তবতা নেই। অন্তত চিকিৎসাবিজ্ঞান তাকে স্বীকৃতি দেয় না।’                     

‘কিন্তু শুনেছি হিমালয়ে তপস্যারত সাধুরা শ’য়ে শ’য়ে বছর বেঁচে থাকে ?’                                                               

গায়কের জিজ্ঞাসার উত্তরে দ্বিতীয়জন জানাল,                                                                                  

‘ওটার কোন প্রমাণ নেই। যারা এমন দাবি করে তাদের অনেকেই চিকিৎসকদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। দেখা গেছে, তারা ঠগ ও প্রতারক।’                                                                                                                    

‘তাহলে ভারতীয় যোগীদের সম্পর্কে এসব রটনা মিথ্যে ?’                                                                                       

হতাশ গলায় প্রশ্ন তুলল গায়ক, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। তৃতীয়জন বলল,                                                              

‘একশ’ শতাংশ। সমস্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন রটনা মাত্র।’                                                                                          

তবুও গায়ক হাল ছাড়ল না। সে প্রশ্ন করল,                                                                                           

‘কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যাপারটা ? তাদের হাতে তো দীর্ঘজীবন রয়েছে শুনেছি ?’                                                

‘সেটাও সন্দেহাতীত নয়। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ কতদিন বেঁচেছেন ? তাঁর ভক্তকুলও কেউ তেমন দীর্ঘায়ু নয়। তেমন রেকর্ড নেইও। সবচেয়ে বড়কথা, বৌদ্ধধর্মের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে জন্মান্তরবাদের ওপর। বৌদ্ধদের বিশ্বাস, কোন ব্যক্তি অমর হয় জন্ম-জন্মান্তরে। একটিমাত্র জীবনে অমর হতে পারে না কেউ।’                                                                            

দ্বিতীয়জন উত্তর দিল। সমস্তটা পরিবেশ জুড়ে হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস। ব্যক্তিগত চিকিৎসক আবার আশার সঞ্চার ঘটাল,  

‘তাহলে আমরা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপরই ভরসা রাখতে পারি। তারুণ্য বজায় রাখবে সার্জারি। আর ক্ষয় যাওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অটুট রাখবে প্রতিস্থাপন। এখনই তার প্রয়োজন নেই, আসলগুলি যতদিন কর্মক্ষম আছে। তবে আমাদের তৈরি থাকতে হবে। তার জন্য সর্বোত্তম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দাতাদের হাতে মজুত রাখা সবচেয়ে ভাল উপায়। আপনাদের কী মত ?’                                                                                                                                    

এখানে সবাই আর সহমত না হয়ে কী করে ? তাদের মতামত প্রদানের ক্ষমতাও তো কিনে নেওয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে।                                                                                                                                             

তারপর একটি দাতাব্যাঙ্ক তৈরি করা হল। বেছে নেওয়া হল এমনসব মানুষকে যাদের প্রত্যেকে কিছু না কিছু নিখুঁত ও সক্ষম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মালিক। কারো কিডনি, কারো ফুসফুস, কারো লিভার, কারো রক্ত, কারো হৃদপিণ্ড ইত্যাদি। তাদের সবাইকে মাসমাইনে দিয়ে কিনে রাখা হল যাতে তারা প্রয়োজনে তাদের বিশেষ প্রত্যঙ্গ দান করবে সেই গায়কের নিজস্ব ক্ষয়ে যাওয়া ও অক্ষম প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে। এবার সে নিশ্চিন্ত হল কিছুটা হলেও, কারণ তাকে বোঝানো হল যে এভাবে যদি সে আরও পঞ্চাশ-একশ’ বছর বেঁচে থাকতে পারে তো ততদিনে চিকিৎসাবিজ্ঞান সত্যিসত্যিই জীবন অনন্ত রাখার কোন মোক্ষম উপায় হাতে পেয়ে যাবে।                                                                                                                  

হাত তুলল কোটিকল্প। নিশ্চল করে দিল জাদুজগৎকে। বলল,                                                              

‘দেখলি তো ওই গায়কের কাণ্ড ? তার অমরত্ব লাভের উপায় ?’                                                                          

‘তাতে কি সে তার চাহিদা পূরণ করতে পারল ?’    

তার প্রশ্ন শুনে হাসল কোটিকল্প, ঘূর্ণায়মান হাসি। সে আবার হাত তুলল। একই বিন্দুস্থিত থেকে এগিয়ে গেল বেশ কিছু বছর। দেখা গেল, সেই গায়ক শায়িত অন্তিম শয্যায়। তার তারুণ্যদানের প্রক্রিয়াকালীন অস্ত্রোপচারের পর পরই। তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দাতাদের ব্যাঙ্ক থেকে গেল যেমনকে তেমনই। লোকগুলি চাকরি হারালো। কোন কাজেই লাগল না কিছু।

এটাই তাহলে জাদুজগতের ভাষ্য, সে ভাবল। এখানে দেখা যাবে, মানুষ চাইবে এমনকিছু পেতে যেখানে তার নিজেরই কোন হাত নেই। কিন্তু এতো খ্যাতিমান আর বিত্তশালী লোকদের চাহিদা। সাধারণ মানুষের চাহিদা নিশ্চয় এমন হতে পারে না ? ভেবে সে সান্ত্বনা খুঁজতে চাইল। সাধারণ মানুষ তার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে এতো উচ্চাকাঙ্খা দেখায় না। তাদের সীমিত চাহিদা সীমিত সামর্থ অনুযায়ী। সাধারণ মানুষকেও নিশ্চয় দেখা যাবে জাদুজগতে, কারণ মেলাতে সবই তো সাদাসাপটা মানুষের ভিড়। এই মানুষরা জাদুজগতে গিয়ে কেমন দেখতে হবে সেটা জানার বড় আগ্রহ হল তার। অন্তত সে ভাবল, মেলার আর পাঁচটা অসাধারণ মানুষেরও এমন উদ্ভট বাসনা থাকতে পারে না, যতই মায়াপ্রকল্পে থাকুক না কেন সবাই। সে এখন সেটাই জানতে চায়, মেলায় থাকা অন্য লোকদের চাহিদা কী বা কেমন। বললও তাই,                          

‘আমি সাধারণ লোকদের জীবনযাপন প্রক্রিয়া দেখতে চাই।’

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *