শরদিন্দু সাহা

কারা যেন সকাল থেকেই  চার পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলে গেল ‘জানালা দরজা বন্ধ করে দিন।’ শব্দগুলো বেশ স্পষ্ট, কারণগুলো অস্পষ্ট ছিল। ওরা যে এক দঙ্গল ছিল একথা অস্বীকার করবে কার সাধ্য। এমন উচ্চারণ কষ্মিনকালেও শোনা যায় নি। কন্ঠস্বর কর্কশ,  মিষ্টত্বও ছিল, কিন্তু মিষ্টিভাসি বলা যায় কিনা, এই খচখচানি সকাল থেকেই দানা বাঁধছিল। কথার ছলে যে গল্পগুলো ছড়াচ্ছিল, বিশ্বাসযোগ্য মোটেই মনে হল না। হয়ত অরণির রোজকার অভ্যস্ততার বাহিরে গিয়েই কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল বলেই নিজের মনকে প্রবোধ দিতে খানিকটা কষ্টই হচ্ছিল। ওদের উচ্চারণের মহিমা তো ছিল, গল্পও ছিল। ওরা বলে সেই যে চলে গেল আর তো ফিরল না কিন্তু সময়টাকে যে বেঁধে দিয়ে গেল, খোলার সময়টা তো শোনাল না। গোটা ঘটনা প্রবাদ বাক্যের মতো শোনালেও গল্প ছিল না, এমন তো নয়। তবু ইচ্ছেটার বাঁধ মানল না, দরজা জানালার একটু ফাঁকফোকর ছিল, সাবধানবাণী উপেক্ষা করেও সাহস করে দেখার চেষ্টা করতেই দেখতে পেল দু’একটা মৌমাছি ভোঁ ভোঁ শব্দ করে পিছুটান দিচ্ছে। হুল ফোটালেই শিরায় শিরায় ঝিম ধরিয়ে দেবে, এমন আশঙ্কায় পিচবোর্ডের টুকরো, প্লাষ্টিকের প্যাকেট চটজলদি খুঁজে এনে গুঁজে দিল ফুটোফাটায়। কানে বাজতেই লাগল নিচুস্বরে কথার কচকচানি। কী তাদের অন্ধিসন্ধি, কে জানে। ফিসফিসানিতে কথার বোলে খানিকটা আন্দাজ করা যায় মাত্র।  যেই দলটা একটু আগেই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছিল, ততক্ষণে ঘুরে গেল অন্য একটা গলির মোড়ে। আবছা শোনা যাচ্ছিল ‘দরজা জা না লা ব..ন..ধ…।’একসময় সব শব্দই থেমে গেল।  এইরকমটা প্রথম হয়েছে এমন নয়। ঘোষণা হয়েছিল অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে। কখন যে আর একটা দল ঘোঁট পাকাচ্ছিল নিজেদের পছন্দমতো শব্দের জাল বিস্তারে – ‘দেব নাকি তেড়ে খিস্তি’। ‘সব শালা এক। জোরে আরও জোরসে, দুই ঘুষিতে ঠুসো দিবি।’ ‘ইজ্জতের গুলি মার। পোঁদে রুল ঢুকিয়ে দিবি হিসেব করে।’ ‘ওরে ও কুত্তার বাচ্চারা ঘরে মুখ লুকিয়ে আর কদ্দিন শুয়ে বসে থাকবি।’ মৌমাছিটা কোন ফাঁকে যে এই ঘর থেকে ওই ঘরে গিয়ে সকল নির্জনতাকে ভেঙে ফালাফালা করে দিল, দুমদাম শব্দও হল, ভয়ডরে সকলে অতিষ্ট হয়ে উঠল। ‘সে কী! আরো একটা মৌমাছি  ঢুকে পড়ল কোন ফাঁকতালে!’ অরণি ফুলঝাড়ু দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দেয়ালে পিষে দেওয়ার মরণপণ চেষ্টা চালাল। মৌমাছিটা দেয়ালে সেঁটেই রইল, নট নড়ন চড়ন।  

কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছিল বিশেষ একটা সন্ধিক্ষণে যদিও, কোনো পারিবারিক গণ্ডিতে শত চেষ্টাতেও সীমাবদ্ধ রাখতে পারেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল অগোছালোভাবে এঘর ওঘর,এপাড়া ওপাড়া, অন্তত সর্তক বাচনভঙ্গি যতদূর গিয়ে গ্ৰাস করেছিল। একটা দল ওদের বাক্যবানে জর্জরিত করবে বলে যখন প্রস্তুত হচ্ছিল, দ্বিতীয় দল এসে ওদের আসন দখল করে নিয়েছিল স্বচ্ছন্দে। অরণি বোঝার চেষ্টা করছিল প্রথম দলটির সঙ্গে দ্বিতীয় দলটির দূরত্বটা ঠিক কতখানি। ওদের কথা ছোঁড়াছুঁড়িতে কত কি তফাৎ ধরা পড়ে। মৌমাছিটা  এতক্ষণ ওদের ড্রয়িংরুমের ফুটো খুঁজে বেড়াচ্ছিল, অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি। পাড়ায় তো আরো ঘর রয়েছে, অনেকবারই হয়তো ঢুঁ মেরেছিল, ধাক্কা খেয়ে চোট পেয়ে ফেরত চলে এসেছে, অরণি কী তার খোঁজ রেখেছে! ওর বান্ধবী সৃজনী সাবধান করে দিয়েছিল, ‘মাথা নিচু করে চলিস না খোকা, চারপাশ একটু ঘুরেফিরে নজর ঘুরিয়ে দেখিস, তুই যেমনটা  ভাবছিস, তেমনটা না-ও তো হতে পারে। তুই ভাবছিস কুকুর, হয়ে গেল নেকড়ে।’  ‘নেকড়ে! বনবাদাড় ছেড়ে লোকালয়ে আসতে যাবে কোন দুঃখে!’ ‘ আসবে রে আসবে। দেখিস না সব হচ্ছে উল্টোপুরাণ। শুনিস নি, এই পাড়া কি পাড়া ছিল? ছিল তো বনজঙ্গল। বন সাফ করেই না মানুষের জঙ্গল।’ জঙ্গল শব্দটা অরণিকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মৌমাছির আনাগোনা দেখে প্রশ্নটা জেগে উঠল। অরণি দেয়ালের উপরের খাঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখল মৌমাছির একটা ডানা ছেঁড়া, তবু অনেক কষ্টে ও ঝুলে আছে। তবে কী ওরা সত্যি ঘরে ঘরে ঢুঁ মারতে মারতেই এসেছে। ওদের কি কোনো বদ মতলব আছে, কি জানি! আর একটা দল উল্লাসে মত্ত হয়ে  এলাকার সমস্যার লিখিত ফেস্টুন উড়িয়ে নিজেদের জয়ধ্বনির বুলি কপচিয়ে এদিকেই আসছে, দুপাশের লোকজনের মনোযোগ দাবি করার সদিচ্ছায় উপদেশ বিতরণ করছে দক্ষিণা ছাড়াই। এতক্ষণ যে দুটি দল আগেভাগেই মানুষের মন জয় করবে বলে পরস্পরকে লক্ষ করে খিস্তি খেউর করে আসছিল, মুখ বন্ধ করেই ফেলল নিজের মতো করে, ভয়ে জুজো হয়ে কি অন্য কোন কারণে বোঝাই গেল না। ওদের হঠাৎ পরিবর্তনের ডামাডোলে অরণি খানিকটা ভাবনার দরজায় ঠোকাঠুকি করল ক্ষণেক। এই আবার কোন ধরনের দলের ইস্তাহার? বোমার শব্দে একটু পরেই ঝাঁকিয়ে দিল গোটা শরীর। তিনটি দলই নিজেরাই ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজেদের গুণকীর্তন করল। কিল ঘুসি চড় মেরে প্রত্যেকেই নিজের নিজের শক্তি প্রদর্শনে মনোনিবেশ করল। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই যারা সাবধানবাণী শুনিয়েছিল এখনও তো ফিরে এল না। অরণি সৃজনী আর অরণ্যকে  হোয়াটসঅ্যাপ করে জানতে চাইল ওরা দরজা জানালাগুলো খুলছে কি খুলছে না। সকলে এক কথায় জানিয়ে দিল, ‘গুণগুণ শব্দগুলো জড় হচ্ছে আশপাশে।’ গুঞ্জন  তো বেড়েই চলেছে। সারা এলাকার আকাশ ছেয়ে গেছে, সঙ্গীন দশা, ওরাও সিন্ধান্তহীনতায় ভুগছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।

অরণি কিন্তু কিন্তু করেও জানালার কাছে এগোয়, ছিটকিনিটা খুলতে গিয়ে হাত দুটো কেঁপে ওঠে। গুঞ্জনটা টের পায়। সতর্কতা জরুরি কিনা। কী জানি  যদি মৌমাছিগুলো হুল ফোটাতে তেড়ে আসে! নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এখন প্রশ্নের পর প্রশ্ন এসে জোরে জোরে ধাক্কা মারে। না না জন্ম মৃত্যুর হিসেব ও কষছে না। কোথাও গিয়ে পৌঁছনোর তাগিদটা বড্ড জ্বালাতন করে। করবে না, এটা হলফ করে কেউ বলতে পারে! রাস্তায় হাঁটতে গেলে ভাসা ভাসা কথায় বুড়ো আঙুলে হোঁচট খায়নি এমন তো নয়। মনে তো হয়েছিল, শরীরের জন্মের কথা, কোটি কোটি মানুষের ওই মুহূর্তে ওঠাপড়ার কথা। ওদের ভঙ্গি অজানা, গড়ন, চেহারা লম্বা বেঁটে কালো ফর্সা শ্যামলা। ফর্সার ওতো কত রকমফের। ফর্সা শব্দটাই বা কেন মাথায় এলো! ওরা কি হোঁচট খায় না? পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া লোকটা আলটপকা মন্তব্যও ছুঁড়ে দিল, ‘ দেখে চলতে পার না? কিচ্ছু হবেনা।’ ঠোঁটটা বেঁকিয়েই দিল। কেউ কী গবেষণার থিসিসে ওর মনের কথাগুলোই লিখে চলেছে, বিষয়টা ভারি গোলমেলে, অস্তিত্বের সঙ্গে অধিকারবোধের লেপটালেপটি। ও দ্রুত হাঁটল, লোকটার মুখোমুখি হওয়ার ঘৃণাবোধটা ও জয় করতে পারে নি। কষ্ট হবে নাই বা কেন? লোকটা ব্যঙ্গ করেই বলল, ‘ দার্শনিক হওয়ার সাধ জেগেছে বুঝি? কত তো জন্মে মহান হয়েছে, কী কাঁচকলাটা হল মানুষের? যুদ্ধটা কী থামল? হিংসে দ্বেষ ভোগের আকাঙ্খা কী কমল? হু হু করে বাড়ছে, রক্তবীজ যেন।’ কথাগুলো শোনাল  শুধুই কী অরণির মগজ ধোলাই করবে বলে। ইচ্ছে করলে আগুনটা ও নিজেই জ্বালাতে পারত একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার লেজুর টেনে। কিন্তু জ্বালায় নি। পুড়লে তো এঘর ওঘর কেউই ছাড় পাবে না, স্ফুলিঙ্গ দানা বাঁধতে শুরু করতেই জল তো ঢালতেই পারতো, করল কি! কত বোঝে কত জানে দোকানদার। ‘পড়ে নিতে পারেন না? কোম্পানি তো জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছে। নাকি পড়তে শেখেন নি?’ ধাঁই করে অরণির ইগোতে ছুরির ফলার মতো বিঁধল। জবাবটা দিয়েই দিল কড়া করে। মাথার স্নায়ুগুলো এলোমেলো হয়ে দপদপ করল। 

অরণি ভাবল ওর সংকটটা ঠিক কোথায়? মাথায় বিশ্বচিন্তার পোকাটা নড়েচড়ে উঠে। পুতিন আর জেলেনিস্কির দ্বান্দ্বিক চিত্রটাই প্রকট হয় । ভূমির অধিকার নিয়ে তীব্র রেষারেষি রক্তস্নান হয়ে চলেছে ইউক্রেনের মাটিতে। শুধু ঘটনামাত্র নয়, প্রবৃত্তির এক অভিনব জ্বলন বই তো নয়, দাউদাউ করে জ্বলছে।  অরণি আর দোকানির বাদানুবাদের গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে সেই বিষ্ময়। অরণির ডান পায়ের নখটা উল্টে গেলেও অসাড় হওয়ায় বুঝতেই পারেনি, দোকানি ওর মনের কোন জায়গায় বিষ ঢালতে চেয়েছিল । মনের অন্তর্জগতে ঘটে চলেছে অস্তিত্ব সংকটের জ্বালা। লোকটা ওর চিন্তার ওঠাপড়াকে ছুঁতে না পেরে আলটপকাই নানা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। অরণির ভাবজগতে কত তো আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তা দমন করে কোনো জবাব দেওয়া যায় কিনা, সাতপাঁচ সেসব কথা নিয়ে নাড়াচাড়া করল কিছুক্ষণ। ‘বুঝলে অন্যের চরকায় তেল দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করো না। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হজম করতে জানতে হয়, তবে না।’ অরণি এখন মানুষটাকে সমুচিত জবাব না দিয়ে অন্তর্জগতকেই অনুঘটক হিসেবে বেছে নেয়। চিন্তার প্রতিবিম্ব হাজির হতে থাকে সারিবদ্ধভাবে। কত তো উত্তর প্রতিউত্তর জন্ম নেয়। কোন একটাকে বেছে নিয়ে ওঁর অসংলগ্ন বিচারের জন্য সাবধান করে দেয়। ওর আঙুল থেকে রক্ত গড়াতে থাকলে লোকটা কাছে এসে বলতে থাকে ‘তোমার আঙুলটা ছুঁতে পারি?’ কথাটা বেদবাক্যর মতো চেপে বসেছিল কিছুদিন, এভাবে যে কাজে লেগে যাবে বুঝতেই পারেনি। মুহূর্ত নিয়ামক হয়ে যায়। ভয়টা যে চেপে বসে থাকে। এটা কি মৃত্যুভয়! বেঁচে থাকার অদম্য তাগিদ তিল তিল করে এতদিন ধরে যে জমিয়ে রেখেছিল তা হারিয়ে ফেলার যাতনা ভয়কে জমাট বাঁধতে উঠেপড়ে লাগে। জানালাটা খুলবে খুলবে করেও খুলতে পারে না। আহা, এই সময়টা ওরা যদি এসে ঘোষণা করে দিত – ‘কোন শত্রু নেই, কোন বিদ্বেষী নেই, কোন বিদ্রোহী নেই, কোন জাতশত্রু নেই, কোন ঘরের শত্রু বিভীষণ নেই, সমাজের শত্রু, সে তো কবে নিপাত হয়েছে, দেশের শত্রু, চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, আমরা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। অরণির মনটা কি এমন ডাক শোনে, মনটা তাতেই কিনা ধেই ধেই করে নেচে ওঠে। একোনা ওকোনা সেকোনা ধরে ঝুলতে থাকে। রাশের উৎসব লেগেছে, এ কোন লীলা! অরণি ডেকে ডেকে  সকলকে এমন একটা উৎসবের সাক্ষী করতে চায়। কেউ শুনলে তো! ঘরে ঘরে শূণ্যতার জাল বিছিয়ে রেখেছে কেউ কেউ। ঘরগুলোর অন্দরমহল থেকে চিৎকার ভেসে আসে, অল্পস্বল্প ভাঙচুরও শুরু হয়। কতক্ষণ, আর কতক্ষণ ওরা ঘরবন্দী হয়ে থাকবে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন এসে গিলে খায়। ওরা কি নিছকই ভয় দেখিয়ে গেছে? নাকি নিজেদের অবস্থানকে মজবুত করার নয়া কৌশল কিংবা কোনো ফাঁদ। এই প্রশ্ন ওরা কাকে ছুঁড়ে দেবে! এত মনোযোগী শ্রোতা কোথায় যে শুনেই জবাব দেবে। 

অরণি কীসের শব্দ শুনতে পায়! অন্তরমহল জাগছে বুঝি। এত আলো, আলোময়, তবু কেন নিঝুম সারা পাড়া। পাখিদের ডাকাডাকি কত যে বেসুরো শোনায়, হল কী! এমন খচখচানি স্বর বাপের জন্মেও তো শোনেনি। চুপিসারে কথাগুলো বাতাসে ভাসতে ভাসতে সকলের জানালায় উঁকি মারে। তবে কী মৌমাছির গুঞ্জন মিথ্যে! সব আওয়াজ একই সরলরেখায় এসে মিলেমিশে যাচ্ছে? এর গূঢ় রহস্যটা কী? ওরা কোথায় পৌঁছতে চাইছে, এর উত্তর অরণি কী জানে! সকলে কি নিশ্চুপ হয়ে আছে এই ভেবে অন্যদের ভাবনার বৃত্তটা ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কারা যেন উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে হাঁকাহাঁকি করে জানতে চায় –’কেন গো তোমরা এমন নিদান দিয়ে গেলে? আর কতক্ষণ? সময় গময় বলে তো একটা ব্যাপার আছে। একথা তোমরা বিশ্বাস কর কি কর না।’ অরণির ভাবনার অভিমুখটা অন্যদিকে ঘুরে যায়। ওরা কি শুনেও না শোনার ভান করছে! সত্যিই কী ওরা আমাদের এমন কিছু কথা বলতে চেয়েছিল যা আমরা আগে কখনও শুনি নি। ওরা  সুযোগ দিতে চেয়েছিল এমন কথা ভাববার  যা আমরা আগে কখনও ভেবে দেখিনি। দরজা জানালা বন্ধ করার কথা আসলে কোনো উপদেশই নয়, নির্দেশ ছিল, না কোন বিপদের আগাম সংকেত! কোন স্বার্থসিদ্ধি নয় তো! সন্দেহটা পাকাপাকিভাবে জাঁকিয়ে বসে। অরণি হঠাৎই কোন শব্দ শুনতে পেল। শব্দটাকে উলঙ্গ করে কাটাছেঁড়া করবে নাকি!

শব্দটা আধাআধি হয়ে ভেঙেই গেল! ওরা আবার ফিরে এসেছে ! এই উচ্চারণ কাদের? কন্ঠস্বরের মধ্যে টক ঝাল মিষ্টি কিছুই তো নেই, শুধুই অহমিকা, আস্পর্ধা, দেমাক শব্দগুলো জড়াজড়ি করে আছে। সময়টাকে কি নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে চায়। ওরা জোরে চড় কষিয়ে মগজের দফারফা করতে পারে, কোন মার্গ দর্শন করাতেও পারে। যত সময় গড়াচ্ছে, আসন্ন বিপদের সংকেত আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মৌমাছির দল ছড়িয়ে পড়ছে অঞ্চলের ঘরবাড়ির কোনায় কোনায়। ওরা হঠাৎ এমন করে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে কেন?  রক্ষক শব্দটা তড়িঘড়ি করে অরণি যুক্ত করে দিল। ওরা ফিরে আসতে চাইছে কিন্তু কারা যেন এক রাশ কালো মেঘে ঢেকে দিচ্ছে ওদের প্রবেশ পথ। এই দূর্ভাগ্যের কথা কাদের জানাবে? এই সুযোগেই কি মৌমাছিরা ঠিক করে ফেলেছে প্রতিশোধ নেবে। ওরা চেয়েছিল মৌচাক ভেঙে মধুর ভাণ্ডার এনে একটু বিলিয়ে দিক। মৌমাছিরা শত্রু মিত্র চিনতে ভুল করবে কে জানত। মধু  ছিনিয়ে নেবার জন্য সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্রস্তুত থাকবে ওরা অনুমানও করতে পারেনি। লড়াইটা বহুমুখী চেহারা নিল সামান্য সময়ের ব্যবধানে।ওরা  চায়নি এমন নয়, মানুষগুলো পুষ্ট হোক, অমৃতের বার্তা পৌঁছে যাক ঘরে ঘরে। সেই গন্ধ ফুলের বাগানে, কদম আর কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে ছড়িয়ে দিয়ে বলেছিল পৌঁছে দিতে মানুষের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। এই সবই ছিল পরিকল্পনা। লোকজন সেই গন্ধ পাওয়ার আকাঙ্খায় যেই না দরজা খুলতে যাবে তক্ষুনি ভোঁ ভোঁ শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল মৌমাছিরা না চিনে, না বুঝে। এরকম একটা ঘটনা ঘটে যাবে অরণি, সৃজনী ও অরণ্যরা কেউ অনুমান করতে পারেনি, ভাবছিল ওই দূর্গ ভেদ করে তো এই ঘরের পর ঘরের অন্দরমহলে ঢুকে পড়া অসম্ভব, অন্তত ওদের কথার পরিকল্পনায় আঁচ পেয়েছিল। ওরা অন্যদের বোঝাবার মতো অবস্থায় ছিল না।

মৌমাছিরা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল, আর সুযোগ খুঁজছিল অন্তর্দন্দ্ব কেমন করে বাড়িয়ে দেওয়া যায়। কত জ্বালা সব গুমড়ে গুমড়ে মরছিল। এমনও দিন দেখেছিল, ইচ্ছে হয়েছিল এ ওর দাড়ি টেনে ধরে লম্বা করে দেয়। তাই বলে কি ওবাড়ি থেকে ভেসে আসা সুরের মোহ এবাড়ির হৃদয়কে কাঁদায়নি, ফেলেনি কি চোখের জল। সেই মানুষগুলো খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই সুর। অরণ্য যে জানালায় মুখ ঘষেনি এমন তো নয়। মৌমাছিরা আজ সব অলিতে গলিতে, বাড়ির ছাদে, ক্লাবঘরের কোনায় কোনায়। মৌমাছিদের ওরা আটকাতে চেয়েছিল। শেষ চেষ্টা করেছিল মশালের আগুনে তাড়িয়ে পাড়াছাড়া করবে। না তারা করেনি তা। বরঞ্চ আরো বেশি করে পাড়ামুখো করার এক অভিনব কৌশল খুঁজেছিল। সাবধানী স্বরের দলটা দেখে ফেলেছিল আরও যে কত দল, ফন্দি আঁটছিল কেমন করে ওদের মগজ ধোলাই করা যায়। লোকগুলোকে কব্জা করে ওদের কথায় ওঠবস করাতে পারে। ওদের কারা লাগিয়েছিল, কেন লাগিয়েছিল সেকথা নাহয় থাক। ওরা যে এসেছে সেকথা অস্বীকার করবে কার সাধ্য! ইচ্ছে কি তাই ছিল ভেজালের বাজারে আসল মধুর স্বাদ চেনাবে। মানুষগুলো চেখে দেখবে কাছেপিঠেই জমা হচ্ছে কত না অমৃত। বলা তো যায় না অমরত্বের কল্পনা ধরা দিলেও দিতে পারে। এমন করে মৌমাছিরা দিক পরিবর্তন করবে কে জানত। মনের সুখে ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে ওরা গান ধরবে আর ওই ঘর দোরে বন্দী হয়ে ওরা বের হবার পথ খুঁজে বেড়াবে। তবে কী ওরা মানুষ চিনতে ভুল করে ফেলেছে! এমনও হতে পারে  নিঃশেষ হতে হতে ওরা একে অন্যের গায়ের গন্ধ শুঁকতে চাইবে, একে অন্যের ঠোঁটে মুখে লাগিয়ে বলবে, ‘চলো মোরা স্নানে যাই, এক সঙ্গে সাঁতার কাটি, দাপিয়ে বেড়াই গোটা পৃথিবী। ওরা বলছে বলুক, হাতের পুতুল বানাতে আসুক, একবার সদলবলে দেখিনি।’ মৌমাছিরা চেয়েছিল এই ইচ্ছেটা চাগাড় দিক, তাই কী! ওই দলের সর্দার তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। মৌমাছিরা গোটা পাড়া প্রদক্ষিণ করেছিল এই ভেবে। তারা কোনায় কোনায় বসে পথ খুঁজছিল কীভাবে ওই বুদ্ধির খেলুড়েদের জব্দ করা যায়। ওরা শলাপরামর্শই করছিল কীভাবে টোপ দেওয়া যায়, একটা দল ফন্দি আঁটছিল কীভাবে লেজে আগুন দেওয়া যায়, আর একটা দল ভাবছিল কীভাবে আপনজন সেজে বারোটা বাজানো যায়। এই বুদ্ধিমান লোকেরা কোথায় কি কি পরিকল্পনা করে সেখানে ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরনো। মৌমাছিরা ভাবল, ‘এই বেটার শালারাই তবে  সমাজবন্ধু সেজে গায়ে তকমা সেঁটে ঘুরে বেড়ায়! ভারী মজা তো। এই বেটাদেরই জঞ্জাল সাফাইয়ের আগে সাফাই অভিযানে নামতে হবে।’ ওই বৃত্তগুলো ওদের পাত্তাই দেয়নি। ভাবছে গুনগুন করছে করুক, সুযোগ বুঝে সায়েস্তা করা যাবে। মৌমাছিরা যে দলে দলে ভাগ হয়ে ঘাপটি মেরে বসেছিল ওরা কি থোড়াই কেয়ার করেছে!  ওই দলগুলো মনের সুখে যা মুখে আসে তাই বলে গেল। ওদের ইচ্ছেগুলো কী আর থেমে থাকতে চায়, আগুনের ফুলকির মতো ছোটে, কখন যে কাকে পোড়াবে, তার ঠিক আছে। ‘কচুপোড়া করবি। এলাকা দখল করে কী লোমটা ছিড়বি’ ‘ শালা, তখতে বসে এমন পাঁই পাঁই করে ছড়ি ঘোরাব না,কুল কিনারা খুঁজে পাবি না।’ ‘ নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে ভাবছিস, এমন আওয়াজ তুলব না, বুদ্ধির ঘট নড়ে উঠবে, ওরা তখন তোদের মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে।’ কথাটা কি ওদের কানে গেল? যাবেই যদি, তবে কি আর মনের সুখে গানের তালে এমন বিচ্ছিরি ভাবে কোমর দোলায়! মৌমাছিদের দল সমস্বরে বলে উঠল, ‘মার দিয়া কেল্লা। মাথামোটা কুচক্রীরা এমনি হয়।’

সাবধানী স্বরের দলটা দেখে মৌমাছিরা আবার এলাকায় ঢুকছে দলে দলে ভাগ হয়ে। অরণি জানালার কাঁচটা ফাঁক করে দেখে, ওরা আসছে। ওর এখন কি করা উচিত, এই প্রশ্নের উত্তরে দু’চারবার পায়চারি করে নেয়। অরণ্যকে এদিকে ছুটে আসতে দেখে ও হতভম্ব হয়ে যায়। বুঝতে চেষ্টা করে কী ঘটতে চলেছে। মৌমাছিরা আসছে ওদের মতো করে শব্দ করে। অরণ্যর পেছনে বাকি সব মানুষজন নেশাগ্ৰস্তের মতো ছুটতে আরম্ভ করে। অরণি বুঝতেই পারে না এই দুঃসময়ে ওরা ঘরের নিরাপত্তার বলয় ছেড়ে খোলামেলা আকাশের নিচে হাজির হচ্ছে কেন? তবে কী ওরা মৌমাছিদের চলন বুঝে ফেলেছে! ওরা এমন কী সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনের সুইমিং ক্লাবের শেডটাকেই আশ্রয়ের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। ওরাও কি এটাও ভেবে নিয়েছে, মৌমাছিরা যে কোন প্রকারেই যদি সদলবলে ঢুকে যায়, তখন যন্ত্রণায় দগ্ধে দগ্ধে মরা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না!  নিজেকে নিয়ে অরণি বড্ড বিড়ম্বনায় পড়েছে।  সমাজের ভীরু প্রকৃতির মানুষের দলে ফেলে নিজেকেই ঘৃণা করে স্বস্তি খুঁজে মরছে। দরজাটা চোখ মুখ নাক বন্ধ করে ধপাস করে খুলে ফেলল। কই একটাও তো মৌমাছি নেই। ওরা বোধ হয় ভোল পাল্টে ততক্ষণে দলে ভিড়েছে। অরণি এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে শেডের দিকেই ছুটতে থাকে। কোথায় গেল অরণ্য, কোথায় গেল সৃজনী? শয়ে শয়ে লোক জড় হয়েছে। কোথায় খুঁজবে অরণি ওদের? সকল মুখেই একই চিন্তার মুখগুলো জড়ো হওয়ায় পার্থক্য খুঁজে বের করা বড়ই দুষ্কর । মৌমাছির দল ঘুরে বেড়াচ্ছে বৃত্তাকারে। মেঘেদের উড়ানি স্বভাবের সঙ্গে তাল রেখে মৌমাছিদের খেলা। কখন এসে যে হূল ফোটাবে, কেউ অনুমান করতে পারছে না। মুক্তির উপায়টা নিয়ে বলাবলি করে। মৌমাছির দল হো হো করে হাসতে শুরু করে। ওদের কাজ কতটা হাসিল করতে পেরেছে জানে না। সেই শব্দগুলোই কম জোরালো নয়। সেই ভয়ে কিনা কি জানি, আবারও গতি পরিবর্তন করে। সম্মিলিত শব্দের জোর পৌঁছে যায় উল্টো দিকে যেখানে বৃত্তগুলো খেলা করছে আপনমনে। পাড়া আর বেপাড়ার দূরত্বটা কমতেই থাকে।

এমন উদাসীন আর অবহেলার যে এত রঙ তা তো আগে বোঝা যায় নি। মৌমাছিরা মনে হচ্ছে উৎসবে মেতেছে, তা কিন্তু নয়, রক্তের দাগ লেগে আছে চাতালে, পাঁচিলে, কে কাকে আগলে রাখবে? মৌমাছিদের চলন বলন কত কথা জানান দিচ্ছে আর ওই দলাদলিতে সৈন্য সামন্তরা হাত পাকাচ্ছে। নিয়ম শৃঙ্খলা! সে আবার কী! ওরা গুলে খেয়েছে। এত যে পাণ্ডিত্য রাখবে কোথায়? ময়দানে সাজো সাজো রব। বোমা বন্দুক গুলি ভোজালি কমতি তো কিছু নেই। ঔদ্ধত্য তো কম নয়! কামড়াকামড়ি দেখে তো আন্দাজ ও করা যায় না, কার দৌড় কত দূর। একদল বলল, ‘আসুন আমরা আলিঙ্গন করি, চোখের জল মুছিয়ে দিই।’ ‘সব ভড়ং, একবার বাগে পেলে হয়।’ হাডুডু খেলা চলছে কিনা। ‘আয় দেখি, বেটার ছেলে আমার দোরে, দেখব তোর মুরোদ কত।’ ‘ তাই তো বলি, কেন এত কুমিরের কান্না।’ ‘ ছুঁয়ে দেখবি তো সিংহাসন খানা, সে গুড়ে বালি।’ ওরা একে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে মুখ ভ্যাংচাল। ‘ এরকম করতে নেই বাপ, লোকে নিন্দে করবে যে।’ ‘ নিখুজি করেছে তোর নিন্দের। বুক ফুলিয়ে যখন চলব না, বাপ বাপ করে সব ভেড়ার দল পালিয়ে যাবে।’ ‘ছি ছি ওসব বলতে নেই, চার পেয়ে জন্তু বই তো নয়।’ ‘তোদের ভাবনার কেঁথায় আগুন।’ মৌমাছির দল অবাক হয়ে শুনল, ‘ ওরা বলে কীরে!’ ‘ কলিযুগের যুদ্ধে ডায়লগ আর বোমাবাজি, গুলিগালা সমান তালে চলে, অত ভাবনার কী!’ তাথৈ তাথৈ। 

 মধু নিয়ে ওরা তরতর করে এগোতে থাকে। ওদের এগিয়ে যাওয়াটাই ভীষণই জরুরি। সামান্য দেরি হলেই সমূহ সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে। ওরা অনুমান করার চেষ্টা করে সংর্ঘষটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে কিনা, নাকি অনিবার্যই ছিল।‌ ওরা তো এমন কোনো আশ্বাসবাণী শোনাতে পারে নি যার অপেক্ষায় ওরা সময় গুণছিল – ‘ দরজা জানালা সব খুলে দাও।’ মৌমাছিরা ওদের সীমানা ছেড়ে এগিয়ে যাবে অনেকদূর, সবটাই ছিল কল্পনা বিহীন। কত কিছুই না ঘটে যাচ্ছে, যা ঘটার কথা ছিল না। দলের সর্দার আদেশ দেয় ‘সাবধানে পা ফেল, এত নিরাপদ ভাবার কোন কারণ ঘটেনি, ওরা আমাদের কথায় আস্থা রাখবে, এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই। এমনও তো ভাবতে পারে, দৃশ্য ও অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা হাত মিলিয়ে ওদেরই সর্বনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি।’  অরণি সৃজনীরা পারস্পরিক কথা চালাচালি করে। এত লোকের কোলাহলে অনেক বাক্যই অসম্পূর্ণ থেকে যায়,  কেউ কেউ প্রশ্ন করে, ‘ওরা ঘরে ফিরে যাবে না সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হবে?’ অন্যরা উচিত অনুচিতের প্রশ্ন তুলে বিভ্রান্ত করে দেয়। সাবধানী স্বরের দলটি নিজেদের গাছের আড়ালে লুকিয়ে শুনতে চায় ওদের মতলবখানা আসলে কী। দলের মধ্যে একজন বলে ফেলে ‘মধু চাই গো মধু, সরস মধু, জ্যান্ত মধু।’ ‘ ও তাহলে এই মতলবখানা! মধু আবার কবে থেকে জ্যান্ত হলো!’ ওরা বুদ্ধিতে শান দিয়ে অনুমান করতে চায়, ‘আসল শত্রু কে, ধান্দাবাজই বা কে? ওই লুম্পেনরা, না মৌমাছিরা?’ ওই কন্ঠস্বরই বা কাদের ?

(চালচিত্র পত্রিকায় প্রকাশিত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *