সৌমিতা রায় চৌধুরী

লেখক পরিচিতি 

(প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বড়িশা গার্লস হাইস্কুল (দ্বাদশ)-এ পড়াশোনা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে ভর্তি। সসম্মানে সেখান থেকে স্নাতক হয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রাপ্ত হয়ে সাংবাদিকতা পাঠক্রমে প্রবেশ। সসম্মানে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা প্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা। আকাশবাণী কলকাতায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা। লেখিকা সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের ৩৫ তম বংশধর।)

ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারা ‘শ্যামাসংগীত’। শাক্ত কবিরা শাক্ত পদাবলির অনুসরণে ‘শ্যামাসংগীত’ রচনা করেছিলেন। পৌরাণিক দেবী কালীমাকে মাতৃরূপে বন্দনা করে ভক্তপ্রাণ শাক্ত কবি প্রাণের আবেগ গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সাধনতত্ত্ব এবং আধ্যাত্মবোধের সংমিশ্রণে এক কাব্যময় ভক্তির সারল্য ফুঁটে ওঠে ‘শ্যামাসংগীত’-এর মাধ্যমে। 

‘শ্যামাসংগীত’-এর ধারাটি বঙ্গদেশে বিকাশ লাভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ধর্মীয় ক্ষেত্রে এসময় বৈষ্ণব ধর্মাচরণের পরিবর্তে শাক্ত ধর্ম ও ভক্তিপূজা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গদেশেই বেশিরভাগ শক্তিপীঠ গুলি অবস্থিত। তাই শক্তিসাধনা বঙ্গদেশের একটি প্রাচীন বিষয়। এর হাত ধরে শাক্ত সাহিত্য তথা ‘শ্যামাসংগীত’ বঙ্গদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। 

শাক্ত পদাবলির জগতে প্রাঙ্গন তরফদার, রামপ্রসাদ সেন এবং কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের নাম প্রথম সারিতে উঠে আসে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শাক্ত সাহিত্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যেসব পদকর্তা ও সংগীতশিল্পী শক্তিসাধনাকে জনপ্রিয় করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়, শম্ভুচন্দ্র রায়, নরচন্দ্র রায়, হরু ঠাকুর এবং অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি। 

পরবর্তী সময়ে রামনীধি গুপ্ত (নিধুবাবু), দাশরথি রায় (দাশু রায়) ‘শ্যামাসংগীত’-কে জনপ্রিয় করেছেন। অনেক মুসলিম কবিও শ্যামাসংগীতে নিজেদের কৃতিত্ব স্থাপন করেছেন। কালী মির্জা ছাড়াও জনপ্রিয়তম নামটি হল কাজী নজরুল ইসলাম। শ্যামাসংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পীরা হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। 

বাংলায় শক্তিসাধনার ইতিহাস প্রাচীন হলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে (১৭২০-১৭৭৫) রামপ্রসাদ সেন শাক্ত সংগীতের নবতম ধারার সূচনা করেন। রামপ্রসাদ ছিলেন মূলত কালী সাধক। তিনি আদি শক্তি দেবী কালীকে যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন তারই প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে। দৈব শক্তির কাছে নিজেকে সেবক রূপে প্রতিষ্ঠিত করার সনাতনী ভক্তিবাদকে ভেঙে দেবী কখনো মাতৃ রূপে আবার কখনো কন্যা রূপে রামপ্রসাদের গানে উপস্থিত হয়েছেন। মা ও সন্তানের ভালবাসা, অভিমান, আনন্দ নানানভাবে বর্ণনা করা হয়েছে রামপ্রসাদী শাক্ত সংগীতে। 

রামপ্রসাদ তাঁর গানকে একটি বিশেষ সুরের চলনে বেঁধেছিলেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে লোকসুরের সংমিশ্রণে এক অনবদ্য সুরের সৃষ্টি করেছিলেন রামপ্রসাদ। যার ভাষা ছিল সহজ, সরল ও একই সাথে গম্ভীর। কালীকে আধ্যাত্মিক দর্শনে উপস্থাপন করলেও অতি সাধারণ উপমায় প্রকাশ করার জন্য রামপ্রসাদী গানগুলো জনমানসে আদৃত হয়েছিল। 

শ্যামাসংগীতের উদ্ভব হয়েছিল প্রধানত রামপ্রসাদের হাত ধরে। বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ভক্তপ্রাণ রামপ্রসাদ কালী ঠাকুরের প্রতি নিজস্ব ভক্তিকে নিবেদন করেছিলেন। পাঠশালার খাতায় এমনকি পরবর্তীকালে কর্মক্ষেত্রে হিসেবের খাতাতেও কালী মায়ের নাম স্মরণ করে কিছু পংক্তি রচনা করেন যা বর্তমানে রামপ্রসাদী শ্যামাসংগীত হিসেবে আমরা জেনেছি। যেমন, “মন রে কৃষি কাজ জানো না”, ” দে মা আমায় তবিলদারি”, “বল মা আমি দাঁড়াই কোথা”, “চাই না মাগো রাজা হতে”, “চিন্তাময়ী তারা তুমি” এইসব জনপ্রিয় গানগুলি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। 

রামপ্রসাদী সুরগুলি ছিল ইমন, ইমন কল্যাণ, গৌর মল্লার, খাম্বাজ, ছায়ানট, জয়জয়ন্তী, পিলু, বসন্ত বাহার, বাহার, বিভাস, বেহাগ, ভৈরবী, ললিত এবং সোহিনী রাগের ওপর ভিত্তি করে। 

রামপ্রসাদ সেনের পরে অনেকেই শাক্তসংগীত রচনা করেছিলেন। এঁদের মধ্যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (১৭৭২-১৮২১)। তিনিও ছিলেন কালী সাধক। তাঁর রচনার মূল বৈশিষ্ট্য হল রামপ্রসাদী সুরের সাথে টপ্পার চলন মিশিয়ে নতুন সুরের প্রবর্তন করা। দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙালির গান’ গ্রন্থে তাঁর ৭৯ টি গানের নমুনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, “অপার সংসার নাহি পারাবার”, ” আমার অন্তরে আনন্দময়ী”, “একবার ডাকো রে কালী তারা বলে”, “এবার কালী তোমায় খাব”, “কালী নাম বড় মিঠা”, “ডুব দে মন কালী বলে”, “মা হওয়া কি মুখের কথা” ইত্যাদি। 

রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের পরে শাক্তসংগীত রচনায় বিশেষ স্বাক্ষর রেখেছিলেন মহারাজ নন্দকুমার (১৭০৫-১৭৭৫), রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬), পাঁচালিকার দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭), রসিক চন্দ্র রায় ও আরো অনেকে। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রসার ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাবে শাক্ত সংগীতের চর্চা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই সময়ে টপ্পা, ঠুমরী জাতীয় আধা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, থিয়েটার ভিত্তিক গান, কলের গান বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কালী সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের হাত ধরে শাক্ত ধর্ম নবশক্তি লাভ করে। 

এই সময়ে শাক্ত সংগীতের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। নজরুলের সংগীত রচনার প্রথম পর্বের সূচনা হয়েছিল লেটো গানের মধ্য দিয়ে। এই পর্যায়ে লোটো পালার জন্য রচনা করেছিলেন ভক্তিগীতি। নজরুল রচিত শাক্ত সংগীতের সবচেয়ে বড় সংকলন হল ‘রাঙাজবা’। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *