মহাদেব মণ্ডল
লেখক পরিচিতি
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের চূড়াভান্ডার গ্রামে ১৯৯২ সালের ৪ মে মহাদেব মণ্ডল জন্মেছেন। বাবা মঙ্গল মণ্ডল, মা ভাগ্য মণ্ডল। গরুমারা অভয়ারণ্য এবং লাটাগুড়ি জঙ্গলের খুব কাছের গ্রামেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন। তাই প্রকৃতির প্রতি এক গভীর টান তাঁর ছোটবেলা থেকেই। তাঁর চর্চা এবং বিশেষ পছন্দের বিষয় মূলত কথাসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতি। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ থেকেই তিনি কিন্নর রায়ের উপন্যাসে পরিবেশ ভাবনা নিয়ে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে রচনা করেন ‘কিন্নর রায়ের কথাসাহিত্যে পরিবেশ প্রসঙ্গ’ নামক নিজস্ব গ্রন্থ। এর আগে যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘বাংলা ছোটগল্প : বিষয় ও নির্মাণ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘প্রাজক্তা’ সহ নানা পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বর্তমানে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণারত।
বিষয় পরিচিতি
( পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বর্তমানে রীতিমত নানা আন্দোলন যেমন হচ্ছে তেমনি পরিবেশ রক্ষার জন্য সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণাও করে চলেছেন। এ বিষয়ে পরিবেশবিদরা বর্তমানে ভীষণভাবেই চিন্তিত। এই মর্মেই নানারকম প্রবন্ধ নিবন্ধন প্রকাশিত হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। পিছিয়ে নেই সাহিত্যও। তাইতো বর্তমানে পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য রচিত হচ্ছে। কবি সাহিত্যিকরা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করছেন পরিবেশ সম্পর্কে তাদের ভাবনা-চিন্তা। পাঠককে সচেতন করতে সমসাময়িক পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যাকে সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন তাই তাঁরা। এই ধরনের সাহিত্য পরিবেশ সচেতন সাহিত্য, পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা পরিবেশবাদী সাহিত্য নামে পরিচিত। এই ধরনের সাহিত্যের সাহিত্যমূলক ছাড়াও একটি পরিবেশগত বা পরিবেশবাদী মূল্য আছে। সাহিত্য সমালোচনায়, সাহিত্য পাঠের তাই নতুন এক প্রস্থান তৈরি হয়েছে পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা বা ইকোক্রিটিসিজম। এই আলোচনায় মূলত বাংলা সাহিত্যের পরিবেশবাদী গল্প নিয়ে আলোচনা করা হবে, দেখার চেষ্টা করা হবে গল্পগুলি কীভাবে ইকো টেক্সট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের লেখকরা কীভাবে তাঁদের গল্পের মধ্যে পরিবেশ ভাবনা সম্পৃক্ত করে পরিবেশবাদী সাহিত্য রচনা করে চলেছেন এবং পাঠককে পরিবেশ ভাবনায় মগ্ন করে পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য সচেতন করে চলেছেন সেই দিক নির্দেশ করার চেষ্টা করা হবে মূলত এই আলোচনায়। )
কিন্নর রায়ের ছোটগল্পে পরিবেশচেতনা
সাহিত্য সমালোচনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশের পথে নানা সাহিত্যতত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে, তাই পরিবর্তন হয়েছে সাহিত্য সমালোচনার বিভিন্ন তত্ত্বের। বলা যায়, অ্যারিস্টটল ও আচার্য ভরত থেকে সাহিত্য বিচারের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তা আজও বহমান। এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় নানা তত্ত্বের উদয় যেমন ঘটেছে তেমনি বিলোপও ঘটেছে হয়তো অনেক। এই ধারার নবতম সংযোজন ‘ইকো-টেক্সট’, ‘পরিবেশবাদী সাহিত্য’ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যতত্ত্ব ‘ইকো-ক্রিটিসিজম’ বা ‘পরিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্ব’ নামে পরিচিত। ইকোক্রিটিসিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন উইলিয়াম রাকার্ত তাঁর –‘Literature and Ecology : An Experiment in Ecocriticis’ প্রবন্ধে ১৯৭৮ সালে। ইকোক্রিটিসিজম এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গল্টফেন্টি বলছেন—”Ecocriticism is the study of the relationship between literature and the physical environment. “১ কিন্তু এই ইকোক্রিটিসিজম সাহিত্য সমালোচনা তৈরির অনেক আগেই পরিবেশের বিপন্নতার কথা নিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করে গেছেন ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯) উপন্যাস। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি জগতে পরিবেশ ভাবনার নানা দৃষ্টান্ত রেখেছেন ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’ নাটক, ‘বলাই’ গল্প এবং সবচেয়ে বেশি তাঁর পরিবেশ ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে ছিন্নপত্রাবলীতে।
পরিবেশ সম্পর্কিত নানা পদক্ষেপ বিভিন্ন দেশে নানা ভাবে গ্রহণ করা হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিবেশ-বিষয়ক প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের জুন (৫-১৬) মাসে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। এরপর ব্রাজিলের রিও-ডি জেনেইরোতে পরিবেশ সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৪ জুন, ১৯৯২ সালে। এই সম্মেলনটি বসুন্ধরা সম্মেলন নামেও পরিচিত। এই বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে যখন সর্বস্তরে ভাবনা শুরু হয়েছে ঠিক সেই সময় কথা সাহিত্যিক কিন্নর রায় পরিবেশ ভাবনা নিয়ে এক যুগান্তকারী উপন্যাস লিখলেন সেটি হল ‘প্রকৃতি পাঠ’ (১৯৯০)। তারপর তাঁর ছোটোগল্পগুলির মধ্যেও এই প্রকৃতির নানা সংকট ও তা থেকে উত্তরণের প্রয়াস নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন গল্পকার কিন্নর রায়।
১৯৫৩ সালে ৬ নভেম্বর কিন্নর রায় জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সাংবাদিক। তাই তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখার সুযোগ পেয়েছেন খুব কাছ থেকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি প্রকৃতির টানে তিনি গ্রাম থেকে শুরু করে নদী, মাঠ-ঘাট ঘুরে বেড়ান আজও। লেখক কিন্নর রায় তাঁর প্রকৃতি চেতনার কথা বলতে গিয়ে ‘আমার প্রকৃতিপাঠ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন—“এই ব্রত প্রকৃতিকে ভালোবাসা, প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করার স্ত্রী আচার। জল, বৃক্ষ, পাখি, ফুল, মাছ, সাপ, কুমির, বাঘ, কচ্ছপ-সবাইকে বাঁচিয়ে রেখে সুন্দর সবুজ প্রকৃতি সন্ধানী হওয়ার ডাক এইসব ব্ৰততে।”২ ছোটোবেলা থেকে মা-কাকিমা-মাসিমাদের যে ব্রত পালন করতে তিনি দেখেছেন তাতে তিনি প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য তাদের আকুল আবেদন লক্ষ করেছেন। সেই ব্রতকথা থেকেই লেখকের প্রকৃতির প্রতি জন্মেছে গভীর টান। যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সৃষ্ট কথাসাহিত্যের প্রতিটি শাখায়। তাছাড়া তিনি সাংবাদিকতার কাজ করায় সব দিকে তাঁর স্বতন্ত্র দৃষ্টি ছিল। সেই স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই তিনি লক্ষ করেছিলেন বর্তমানে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভয়ংকর চিত্র। মানুষ যতই উন্নত হচ্ছে ততই প্রকৃতির প্রতি বিরূপ হয়ে যাচ্ছে যার ফলে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যের হেরফের ঘটছে। কিন্নর রায়ের গল্প ও উপন্যাসের সংখ্যা অনেক তার মধ্যে তাঁর পরিবেশকেন্দ্রিক গল্পগুলি আমার আলোচনার বিষয়। তাঁর লেখা ‘অনন্তের পাখি’, ‘একা গাছ’, ‘মহাজাগতিক’, ‘আজান গাছ’, ‘অচিন তলা’ গল্পগুলিতে প্রকৃতির চিত্র, প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার চিত্র এবং পশু-পাখিদের সমস্যার কথা তিনি তাঁর সুনিপুণ লেখনীর মধ্যেদিয়ে পাঠকের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মানুষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে। যা জীবন যাপনকে করেছে সহজতর। কিন্তু বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে। প্লাস্টিক বর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আজ পরিবেশ সংকটের অন্যতম মূল উপাদান হল এই প্লাস্টিক। লেখক কিন্নর রায় এই প্লাস্টিক দূষণ এবং পলিব্যাগ সংক্রান্ত মারাত্মক সংকটের কথাই তুলে ধরেছেন তাঁর ‘অনন্তের পাখি’(১৯৯৬) গল্পটিতে। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ অপরিহার্য। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে বিকল্প সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে। ক্যারিব্যাগ থেকে ঔষধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলের টপ সমস্ত কিছুতেই ব্যবহৃত হচ্ছে শুধুই প্লাস্টিক। বাজার থেকে আমরা সমস্ত কিছু পলিব্যাগে ভরে নিয়ে আসি। প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে ততটা আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলিকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে লেখক কিন্নর রায় সেই বিষয়ে গভীর আপত্তি জানিয়েছেন। তাঁর এই ‘অনন্তের পাখি’ গল্পে গল্পকথক অনন্তের দোকানের নাম ‘সর্বমঙ্গলা স্টোর্স’ স্টেশনারি কাম জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার্স। ইচ্ছে না থাকলেও প্লাস্টিক বিক্রি হয় তার দোকানে। কোম্পানির নানা অফার তাকে আরো বেশি করে বাধ্য করে প্লাস্টিক বিক্রি করতে। হারপিকের সঙ্গে প্লাস্টিকের মগ ফ্রি। চায়ের সঙ্গে জার। খদ্দেররা পলিব্যাগে ছাড়া জিনিস নিতে চায় না। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি ব্যথিত করে গল্পকথক অনন্তকেও।
অনন্তের বাড়িতে পেঁচুরাম নামে একটি বিড়াল আছে। টিয়া আছে একটি, তার নাম বুটি। বাড়ির পিছনের মস্ত বড় পুকুরটা আস্তে আস্তে মরে গেছে। তাই এই বিড়াল ও টিয়াকে খেতে দিলে জল ছাড়া ঘর হারানো বক আসে ভাত খেতে। অনন্তের স্বপ্নেও সেই বক সাদা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে কথা বলে। দোলামোচড়া, পলিব্যাগ উড়ে আসে তার মশারির কাছে। সেই পলিব্যাগও কথা বলে–‘এখন কোথায় যাই বলতে পারেন? ছাইমাখা পলিপ্যাগ কে নেবে!… এমনি কাগজের ঠোঙ্গা পচে। শালপাতা পচে। মাটিতে মিশে যায়। আমরা তো সহজে পচি না। আমরা এবার কোথায় যাব অনন্তবাবু?’ তখন অনন্তর মনে পড়ে সন্ধ্যা বেলা তার দোকানে আসা রোগা ফর্সা মেয়েটা পলিব্যাগে ঝাটা দিতে বলেছিল। তাই তার ভাবনা হয়—‘এত পলিব্যাগ যাইব কোথায়?’
সে ঘুমের মধ্যে দ্যাখে—‘বিশাল একটা জল আর জলের বুকে শালুক, পদ্মের বদলে লাল নীল সবুজ সাদা অনেক অনেক পলিপ্যাক। মরা মাছ কিংবা কচ্ছপের পিঠ হয়ে তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে বুঝি। কেউ বা চুপসে মিশে আছে জলের সঙ্গে। সেই সব রঙ চটে যাওয়া পলিব্যাগের গায়ে ভিতু চাঁদের আলো। দু-এক ফোঁটা দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির কান্না।’ গোটা জলাভূমি ঢেকে আছে নানান রঙের পলিব্যাগে। তাদের বাড়িতে ভাত খেতে আসা বাসা হারানো বকটি গম্ভীর মুখে বসে জলের পাড়ে।
গল্পের বর্ণনায়—‘আমি প্রতি রজনীতে ক্রৌঞ্চদ্বীপে উড়িয়া যাই ও প্রভাত সূর্য উদিত হইবার পূর্বেই ফিরিয়া আসি। কারণ আমার প্রতি শাপ আছে, শহরে-নগরে, মনুষ্যের কাছাকাছি থাকিবার ফলে যে ক্লেদচিহ্ন জমিয়াছে আমার সর্ব শরীর ঘিরিয়া, তাহা ক্রৌঞ্চদ্বীপের রমণীয় ঊষাকাল দেখিবার উপযুক্ত নহে। ক্রৌঞ্চদ্বীপের প্রথম আলো দেখিলেই আমি পূর্বোক্ত শাপে ভস্মীভূত হইব। কিন্তু হে মৃত ও অর্ধমৃত পলিব্যাগ সকল—তোমাদের এই ক্লেদ তো আমি ক্রৌঞ্চদ্বীপে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারিব না। হায়! তোমাদিগের কী হইবে–বলতে বলতে বক বড় করে শ্বাস ফেলল।’
ঘুমের মধ্যে অনন্ত শোনে—‘শুধু পেট ফোলা বা চুপসে যাওয়া বাতিল পলিব্যাগেরাই নয়, গোটা জল, যার ওপর জমেছে রঙিন সাদা পলিব্যাগের সারি—বাঁচাও বাঁচাও বলে কেঁদে উঠছে। অনন্ত অনেক চেষ্টা করেও আশেপাশে বকটিকে আর খুঁজে পেল না। জল শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল।’ অনেকদিন আগে লেখা হলেও এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়ের বুকে। আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ। পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরো বিপদ হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা। প্রতিবছর ভারতে ৫৬ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়। এর মধ্যে রাজধানী দিল্লি প্রতিদিন ৯,৬০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন করে। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কঠোর কোনো আইন ভারতে নেই। এই প্লাস্টিক নগরী থেকে বাঁচার উপায়ও যেন আমাদের হাতে নেই। লেখক এই গল্পের মধ্যেদিয়ে পাঠককে প্লাস্টিক ব্যবহার বিষয়ে সচেতন করতে চেয়েছেন এবং সমাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন প্লাস্টিক মুক্ত সমাজ হিসেবে।
গাছ মানুষের সব থেকে পরম উপকারী বন্ধু। কিন্তু এই গাছদের মধ্যেও রয়েছে মানব তথা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভয়ংকর শত্রু। চিকিৎসক ও পরিবেশবিদদের মতে প্রকৃতি ও মানবের ক্ষতিকারক গাছের মধ্যে অন্যতম হল পার্থেনিয়াম গাছ। বিশেষ করে যখন ফুল ফোটে তখন পার্থেনিয়াম গাছ মানুষ ও গবাদি পশুর জন্য হয়ে ওঠে মারাত্মক ক্ষতিকর। এমনকি কৃষি জমিতে যদি পার্থেনিয়াম গাছ বেড়ে ওঠে তবে সেই জমিতে ফসলের গুণগত মান ও পরিমান কমতে থাকে। পার্থেনিয়াম রেনু বাতাসে মিশে ধান, ছোলা, সর্ষে, গম, টমেটো, লঙ্কা ও বেগুন গাছে ব্যাপক ক্ষতি করে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন পার্থেনিয়াম মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকারক এই ফুলের রেনু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে পৌঁছাতে পারে যা থেকে জন্ম নিতে পারে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, এলার্জি হাঁপানির মতো রোগ। গল্পকার কিন্নর রায় এই পার্থেনিয়ামের ফলে মানব ও প্রকৃতির কত ভয়ংকর ক্ষতি হতে পারে সেই চিত্র তুলে ধরেছেন ‘একা গাছ’(১৯৯৬) গল্পের আখ্যানে। গল্পে শান্তিপ্রিয় ও তার ছেলে সন্দীপের কথোপকথনে উঠে এসেছে পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকর সব কুফলের কথা। সন্দীপের ভাবনায় উঠে এসেছে সেই সব ক্ষতিকর প্রভাবের চিত্র— ‘আমায় শুঁয়োয় কিন্তু হাত চুলকাতে পারে। চুলকোয়ও। আমার ডাঁটার কষ থেকে বিশ্রী ঘা পর্যন্ত হতে পারে চামড়ায়। এমনকি স্কিন ক্যান্সারও। আমার গা ছোঁয়া বাতাস উড়ে যাওয়া ফুলের বীজ থেকে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট। বলতে বলতে পার্থেনিয়াম গাছটি আবারও নেতিয়ে পড়ল।’ গাছের এই ভয়ঙ্কর ক্ষতির কথা জানার পরেও কিছু মানুষ সচেতন হতে পারছে না তাইতো বিকাশবাবু বলছেন—‘কত দেখেছি পার্থেনিয়াম সল্টলেকে। কি হয়েছে তাতে! ওতে কিছুই হয় না।’ এই যে সচেতনতার অভাব যার মাশুল গুনতে হচ্ছে মানব সমাজকেই। কারণ আমাদের সমাজ নোংরা রাজনীতিতে আক্রান্ত ভোট আসছে, সরকার পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু আমাদের সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য কোন কাজ হচ্ছে না বললেই চলে। নেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ভাবনা, নেই পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা। তাই সন্দীপ আক্ষেপ করে বলছে—‘আমাদের এখানে ভালো রাস্তা নেই। ড্রেনের মুখ খোলা। পুকুর বুজিয়ে বাড়ি হচ্ছে। খেলার মাঠ সব ভর্তি হয়ে যাচ্ছে ঘর-বাড়িতে। ছড়িয়ে পড়ছে পার্থেনিয়াম।’ এভাবেই দূষনে ভরে যাচ্ছে সর্বত্র। দূষণমুক্ত করে কলকাতার বাতাসকে স্বচ্ছ স্বাভাবিক এবং মানুষের উপকারী এবং উপযোগী করে তোলার স্বপ্ন দেখেছে সন্দীপ—‘আমরা কি পারব সব পার্থেনিয়াম উপড়ে কদমতলার বাতাসকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে।’ আমরা চেষ্টা করলে যে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে দূষণমুক্ত সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি লেখক কিন্নর রায় সেই বার্তাই আমাদের দিয়েছেন ‘একা গাছ’ গল্পটির আখ্যানে।
কিন্নর রায়ের ‘মহাজাগতিক’ (১৪০৫) গল্পটি তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের ব্যতিক্রমী সংযোজন। তিনি পরিবেশ ব্যাখ্যায় সমসাময়িক ইতিহাসকে বিষয় করে নিয়েছেন। দেখিয়েছেন উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশের বিরোধ। কাহিনি উপস্থাপনে দুটি প্রধান চরিত্র দেখা যায় শালিক পাখি, যিনি পূর্বজন্মে পাটলিপুত্রের ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠ সাগর দত্ত, তিনি বিপুল অর্থ সাহায্য করেছিলেন রাষ্ট্রসম্রাটকে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের গবেষণায়। দ্বিতীয় চরিত্র— মেঘ, যিনি পূর্ব জন্মে ছিলেন কবি বসুবন্ধু। তিনি সবসময় মনে করতেন ‘যুদ্ধ আসলে পাপ’; গল্পের পরিণতিতে দেখা যায় বিপন্ন পৃথিবীর জন্য রাষ্ট্রপ্রতিনিধি সগর দত্তের দুই অনুতপ্ত হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ। গল্পের প্রধান বিষয় যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। পারমাণবিক বিস্ফোরণের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্তি দান। বৃহত্তর অর্থে শুধু পারমাণবিক অস্ত্রই নয়, যে কোনো পরমাণু কর্মসূচী বিরোধী জনমত গঠন করা। এসেছে পরিবেশবাদী জৈনধর্মের বিভিন্ন ধরনের কর্মপ্রণালীর কথা। গল্পের সূচনা—‘ঠহরিয়ে। ঠহর যাও… ছায়া নেই কোথাও, বাতাসে আগুন। ছ্যাঁকা দেওয়াার বাতাস গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছিল।’ এর পরই ১৯৭৪ সালের পরমাণু বিস্ফোরণের প্রসঙ্গ। ১৯৭৪ সালের ১৮ তম রাজস্থানের
প্রত্যন্ত মরুপ্রান্তর পোখরানে ভারতের প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। যা “স্মাইলিং বুদ্ধ” নামে পরিচিত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরাগান্ধী। তিনি নীতিগত দিক থেকে পরমাণু বোমার বিরোধী হলেও শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর সমর্থন করেন। চব্বিশ বছর পর আবার এগারোই মে’ অর্থাৎ পোখরান ২। ১৯৯৮ সালে ১১ই মে তারিখে রাজস্থানের পোখরানে সফলভাবে পরমাণু বোমার পরীক্ষা করে ভারত। লক্ষ্য পাকিস্তান। পাকিস্তানকে সতর্ক করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন— এখনো পর্যন্ত আমাদের পরমাণুনীতি প্রথম ব্যবহার নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী ভবিষ্যৎ নীতিও বদলাতে পারে। গোটা দেশ সেদিন এই শক্তির প্রশংশায় জয় জয় করে উঠেছিল। প্রসঙ্গ অবতারণা করে গল্পকার বলেন—‘আকাশে কালো মেঘ ফিস ফিস করে বলে যাচ্ছিল, তিপ্পান্ন বছর আগে তাঁদের স্মরণে হিরোশিমায় বন্ধ করে দেওয়া হয় ঘড়ির কাঁটা। তারপর প্রার্থনা।’ অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর লিটল বয় নামে নিউক্লিয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের উপর ফ্যাটম্যান নামে আরেকটি বোমা ফেলে। যার পরিণতি মানব সমাজ আজও ভোলেনি। কিন্নর রায়ের ভাষায়—‘কালোমেঘ ফিস ফিস করে বলেছিল, আমি হিরোশিমার মেঘ।-তিপ্পান্ন বছর ধরে আকাশে ঘুরছি। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখের জল বুকে বাঁধা। এবার সঙ্গে নিলাম চাঘাই আর পোখরানের মেঘদেরও। উড়ে বেড়াব, ভেসে বেড়াব। বিষ ছড়িয়ে দেব পৃথিবীতে। সভ্যতার বিষ।’
এবার চাঘাই আর পোখরানের মেঘদের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা যাক। দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পালাবদল ঘটলেও উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখনো অপরিবর্তনীয়। কাশ্মীর হয়ে উঠেছে এক অমীমাংসীত অধ্যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির হাতে পড়ে কাশ্মীর ভেঙেছে, গড়েছে কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ২৯ জুলাই রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা যুদ্ধবিরতির রেখা নির্ধারণ করেন। ফলে কাশ্মীর উপত্যকার একটা বড় অংশ ভারত ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হলেও পুঞ্চ, বালুচিস্তান, গিলগিট পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। এরপর পাকিস্তানের সঙ্গে নানা সন্ধি-চুক্তি ঘোষণা হলেও সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। সেই চুক্তিগুলি হল- ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর রাজা হরিসিং ও ভারত সরকারের চুক্তি, ১৯৪৯ সালের ২৯ জুলাই যুদ্ধবিরতির সীমারেখার চুক্তি, ১৯৫২ সালের নেহেরু ও শেখ আব্দুল্লার যৌথ ঘোষণা, ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও আয়ুব খানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি, ১৯৭২ সালে ইন্দিরাগান্ধি ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সিমলা চুক্তি, ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ আবদুল্লাহ Accord, ১৯৯৯ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ী ও নওয়াজ শরীফের লাহোর চুক্তি। আর এই পটভূমিতে দুই দেশ মিলে এগারোটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় পোখরান ও চাঘাই-এ। কিন্নর রায় গল্পের পরিণতিতে দেখিয়েছেন অস্ত্রশক্তির অভিশাপ কোনো গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। ফলে চাঘাই আর পোখরানের মেঘ নিজেদের ভিতর কোলাকুলি করছিল। তাদের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইছিল হিরোশিমার মেঘটিও। অর্থাৎ যে দেশই পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার করুক না কেন তার অভিশাপ পৃথিবীর সকল দেশকেই পোহাতে হবে। গল্পকার শেষে দেখিয়েছেন রাষ্ট্রশক্তির প্রতিভূ শালিক, শান্তি ও সমন্বয়ের প্রতীক মেঘের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। আর বলে–‘আমি এখন সাধনায় বসবো। অনশনে থাকব। যতক্ষণ না তেজস্ক্রিয় বালির বুকে আমার খয়েরি পালক, হলুদ ঠোঁট, হলুদ ঠ্যাঙ, শাদা হাড় সব আলাদা আলাদা করে ফুল হয়ে খসে পড়বে, একটি একটি করে ফুল, যেমন ঝরে যায় গাছ থেকে, ততক্ষণ।’ গোটা বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ দূষণ, নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিচালিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ১৯৯২ সালে জুন মাসে ব্রাজিলের রিওডি জেনোরোতে বসুন্ধরা শীর্ষ সম্মেলন। এর পরও একাধিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রপ্রতিনিধিরা সেই সম্মেলনে তাদের গভীর চিন্তার ফসল পাঁচ পাতার প্রেস্ক্রিপশন পেশ করেন। কিন্তু তাদের পরিবেশবাদী ভাবনাচিন্তায় যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। তারা মনে করেন পরিবেশবাদী ভাবনায় যুদ্ধের প্রসঙ্গ অবান্তর। এ প্রসঙ্গে ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ ‘যুদ্ধের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে পরিবেশ চর্চা সম্ভব?’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন— “পরিবেশ আন্দোলনে যুদ্ধের কথা বলা যাবে না। যদি বলা না যায় তবে সে আন্দোলন বা উপলব্ধি আর যাইহোক, পরিবেশ নিয়ে হতে পারে না। আজকে পরিবেশ বিজ্ঞান, পরিবেশ শিক্ষার, পরিবেশ বিতর্কে সবার মাঝে যুদ্ধের আলোচনা শুরু করতে হবে। যুদ্ধের ভয়াবহতা গভীরভাবে বুঝতে হবে। পরিবেশের উপর তার বিধ্বংসী প্রভাব অন্তঃকরণ দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। নতুবা পরিবেশ আন্দোলন, পরিবেশ বিজ্ঞান, পরিবেশ চর্চা, এ সবেই মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যাবে।”৩
কথাসাহিত্যিক কিন্নর রায় এই মূল সমস্যাকে লক্ষ্য করে তাঁর পরিবেশ ভাবনায় ‘মহাজাগতিক’ গল্পটি রচনা করেন। আমাদের দেশের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে একাধিকবার খণ্ডযুদ্ধ হয় ও হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলির যুদ্ধ, যুদ্ধের সম্ভাবনা ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব সম্পর্কে এ গল্প সচেতনতার বার্তা দেয়। সে দিক থেকে ‘মহাজাগতিক’ গল্পটি পরিবেশবাদী ভাবনার নবতম সংযোজন। আর গল্পের মূল বিষয় হয়ে উঠে— যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।
কিন্নর রায়ের একটি অন্য ধারার গল্প ‘আজান গাছ’(১৯৯৯) লৌকিক এবং অলৌকিকতায় বিভ্রম এবং স্বপ্নের ঘোরে গল্পটি আবর্তিত হয়েছে। গল্পে দেখি গাছ, শালিক, দোয়েল, নদী, ঘোড়া সব কথা বলে। আর এইসব কথার মধ্যেদিয়েই উঠে আসে পরিবেশের কথা, পরিবেশের নানা সমস্যার কথা। গল্পে দেখি পুরোনো আজান-গাছ নামে পরিচিত গাছটি আর নেই। নবু শেখ গাছটি আর দেখতে পায় না। ভাবে গাছটি উড়ে গেছে—‘কিন্তু দেখতে পায় না গাছকে। আজান গাছ কত দিন যে মুছে গেছে।’ এভাবেই বহু গাছ হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দু’বছর আগে যেখানে গাছ ছিল আজ সেখানে বহুতল বাড়ি বা শপিংমল, টাউনশিপ গড়ে উঠেছে। তারই পরিণতিতে আজকের এই পৃথিবী তাপপ্রবাহের পরিমাণ এত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গাছ হারিয়ে যাওয়ায় মাটির যে বাঁধন তা বিঘ্নিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে নদীর পাড় ভাঙ্গনের দৃশ্য। মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে লেখা এই গল্পে বিশেষভাবে এসেছে নদী ভাঙ্গনের কথা। পদ্মা প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসছে। তাই লেখক বলেছেন—‘পদ্মা এগিয়ে আসছে। একটু একটু করে মাটি ঢুকে যাচ্ছে নদীর বুকে। রোজ রোজ এগোয় নদী। মাটিতে দাঁত বসায়।’ আর এই নদীর পাড়ের প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ এলাকায় আজান-গাছ নামে পরিচিত গাছকেও খেয়ে ফেলেছে। এই নদীর জলে ধুয়ে গেছে আজান গাছের গল্প কাহিনি। গাছ কমেছে বন্যা বেড়েছে। আর বন্যার জলে ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। মানুষ প্রকৃতিকে যেমন আঘাত করেছে প্রকৃতিও তেমনি তার প্রতিঘাত ফিরিয়ে দিচ্ছে। বহরমপুর, জিয়াগঞ্জ ভাসিয়ে দিয়ে পদ্মা মিশে যাচ্ছে গঙ্গায় এই আশঙ্কায় লেখক আতঙ্কিত হয়েছে গল্পের আখ্যানে।
গল্পে লেখক দেখিয়েছেন বাঁধ রক্ষার মধ্যেদিয়ে পরিবেশ রক্ষা করার চিত্র। গল্পে বুড়ো মকবুল হোসেন সত্তর পেরিয়ে গিয়েও গায়ের তাগোদ আর মনের জোর দিয়ে বাঁধকে রক্ষা করেছেন। ভাদ্র মাসের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টির ভেতর সে সবাইকে চিৎকার করে ডেকেছে—‘বাঁধ বাঁচাও। বাঁধ বাঁচাও।’ কারণ তিনি জানতেন এই বাঁধের উপরেই তাদের জীবন নির্ভর করছে। বাঁধ বাঁচাতে না পারলে তাদের জীবনও সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। তাই তাদের বলতে শুনি—‘আমরা তো ইঁদুর। জল বাড়লেই ভাসবো। ইঁদুর ভাসলেই বা কি! থাকলেই বা কি?’ কারণ নোংরা রাজনীতিতে এখন গ্রাম বা শহর আক্রান্ত। যে বাঁধ নির্মাণের জন্য টাকা আসে সেই টাকা চলে যায় নেতাদের পকেটে। প্রকৃতি ও পরিবেশও নোংরা রাজনীতির শিকার। তাই শহর জুড়ে জলাভূমি বুঝিয়ে তৈরি হচ্ছে বহুতল বাড়ি, শপিংমল ও টাউনশিপ।
গল্পের আখ্যানে পরিবেশের আরো একটি গভীর সংকটের চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাবার যোগান করতে গিয়ে ফসলে কীটনাশকের ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই কীটনাশক পোকা-মাকড় মেরে দিচ্ছে। দোয়েল মাটিতে খাবার খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু পোকা নয় ব্যাঙ, সাপ সব নিকেশ হয়ে যাচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহারের ভয়ংকর চিত্র আমরা কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ফুল ছোঁয়ানো’ গল্পেও দেখতে পাই। গল্পে গল্পকারকে বলতে শুনি—“ফুলি ফুলি আঙুল ছোঁয়াতি হয়। এখানে ড্যাঙ্গা জমিতে এখন পটল চাষ চলিতেছে। পটলের ফুল এল। এখন তো আর অত প্রজাপতি টজাপতি নেই পোকা মারার বিষে সব শেষ।”৪ এই কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পোকামাকড় সাপ ব্যাঙ হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সার্বিকভাবে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বিনষ্ট হওয়ার চিত্র লেখক ‘আজান গাছ’ গল্পেও তুলে এনে পাঠককে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।
একটি প্রাচীন বৃক্ষকে নিয়ে লেখক কিন্নর রায় স্মৃতিচারণা করেছেন ‘অচিন তলা’(১৯৯৯) গল্পটিতে। গল্পের শুরুতেই লেখক বলেছেন—‘বহরমপুর থেকে তা হবে পঞ্চাশ কিলোমিটার। সেখানে ডোমকলের বাটিকামারি মৌজা। সেই মৌজার ২০৯ নম্বর দাগের ৯৯ শতক জমিতে ডাল পাতা ছড়িয়ে রোদ্দুর বাতাস ক্লোরোফিল নিজের গভীরে শুষে নিতে নিতে অচিন বৃক্ষ দাঁড়িয়ে। সেই যে আদি মা-গাছটি, তাকে বোধহয় এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ এখন আর আমাদের চারপাশে চোখ রাখলেন অনেক পুরনো আদি গাছের দেখা মেলে না। অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমফান, ফনীর মতো সাইক্লোন যেমন পুরনো গাছগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তেমনি আবার মানবজাতির তীব্র লোভ লালসা এবং প্রকৃতির উপর আগ্রাসনে হারিয়ে গেছে এইসব আদিবৃক্ষগুলি। সেই যে প্রাচীন গাছ তার নাম অচিন গাছ। সেই গাছের নিচে অচিন তলা। সারাদিন সেখানে তাস খেলার শব্দে মুখর। এই গাছকে ঘিরে কত শত কিস্যা। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে আলাদা আলাদা গল্প প্রচারিত এই গাছটিকে ঘিরে। এই গাছ এখন মানবের আগ্রাসনের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। কাঁটা পড়বে। তার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে কত শত কিস্যা। এই অচিন বৃক্ষকে বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক যুগল কুন্ডু। ‘অচিন বৃক্ষ বাঁচাও কমিটি’ নামে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির কথা কাগজে ছাপা হয়েছে। যুগল রাতে স্বপ্ন দেখে- কালো কালো অনেকগুলো লোক দা-কুড়ুল হাতে হই-হই, রই রই করে ছুটে আসছে। অচিন তলায় হামলা করবে তারা। কারা হামলা করবে অচিনতলায়। কারা কেটে নেবে গাছ। ভাবতে ভাবতে যুগল বাইরে যায়। তার ভাবনা গুলিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আবার স্বপ্নের লেজটা খুঁজে পায়— ‘চুল খোলা একটি মেয়ে, তার পরনের শাড়িটা শাদা, পিঠের ওপর চুল ফেলে দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে অচিন গাছেদের কোন একজনকে। মেয়েটির দুহাতের বেরের মধ্যে সেই গাছ। দা-কুড়ুল নিয়ে হই হই করে ছুটে আসা লোকেরা এবার ধীরে ধীরে পিছোচ্ছে পিছোচ্ছে…।’ লেখক এই যে গাছ কাঁটা রুখে দেওয়ার কাহিনি বর্ণনা করেছেন তার মধ্যেদিয়ে পাঠকদের বোঝাতে চেয়েছেন মানবজাতিই পারে এই গাছ কাঁটা রুখে দিতে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় চিপকো আন্দোলনের কথা। স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে—“রাজস্থানের বন শহীদদের কথা। চুনাপাথর গলানোর জ্বালানির জন্য রাজ কাঠুরেরা এসেছিল খেজুরির জঙ্গলে। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ১১ই সেপ্টেম্বর সেদিন বিশনোই গ্রামের মানুষরা নিজের সন্তানসম বৃক্ষদের জড়িয়ে ধরেছিল কাঠুরিয়াদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। ৩৬৩ জন মানুষ সেদিন প্রাণ দিয়েছিল। আজ থেকে ৩০০ বছর আগে। কিন্তু আজও আমরা নির্বিচারে বন ধ্বংস করছি। উল্লেখ্য ২০১০ থেকে ওই দিনটি জাতীয় বন-শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।”৫ এই গল্পের আখ্যান পাঠ করতে করতে মনে পড়ে যায় ভগীরথ মিশ্রের ‘মধুবনের বন্ধুরা’ উপন্যাসের সাধারণ মানুষদের বন রক্ষা করার সেই উজ্জ্বল চিত্র। উপন্যাসে কাঠ কারবারী লোকেরা রাতের অন্ধকারে কাঠ কাঁটতে এসে দেখতে পায় গ্রামের মানুষ গোটা বনভূমি ঘিরে ধরেছে তাদের হাতে বর্ষা, লাঠি বল্লম। এভাবেই সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করে বনভূমি রক্ষা করার স্বপ্ন দেখেছেন লেখক কিন্নর রায় তাঁর ‘অচিন তলা’ গল্পটির আখ্যানে।
আমরা দেখি কিন্নর রায় তাঁর বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস গুলির মধ্যে ভয়ানক পরিবেশ দূষণের চিত্র যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তা থেকে উত্তরণের পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন তাঁর লেখায়। লেখক ‘অনন্তের পাখি’, ‘একা গাছ’, ‘মহাজাগতিক’, ‘আজান গাছ’, ‘অচিন তলা’ গল্পগুলিতে প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার চিত্র যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি মানুষকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়ে সচেতনও করেছেন। তেমনি এই গল্পগুলিতে কীভাবে আমরা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পশুপাখি ও বনভূমি বাঁচিয়ে রাখতে পারি সেই দিকটির প্রতিও আমাদের সচেতন করেছেন লেখক। তাই বর্তমানের এই বিশ্বউয়ায়নের দিনে লেখকের পরিবেশ ভাবনাকেন্দ্রিক গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক নতুন পথের দিশা দেখাবে বলেই আমার মনে হয়। সেই সঙ্গে এই গল্প পাঠ করে সাধারণ পাঠক পরিবেশের দূষণ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হবে তেমনি তা থেকে উত্তরণের প্রতি যত্নশীল হবে বলেও আমার বিশ্বাস। ‘Ecocriticism’ সাহিত্যচর্চা পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতার দাবি করে, কিন্নর রায়ের গল্পগুলি সেই দাবি পূরণ করতে সম্পূর্ণভাবে সমর্থ হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. Glotfelty, Cheryll and fromm Harold (eds), ‘The Eco-criticism Reader: Land- marks in Literary Ecology’, University of Georgia, 1996, P.XVII
২. দোলা, দেবনাথ সম্পাদিত : ‘সাহিত্য বিচারে পরিবেশকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, মিত্রম্, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি, ২০১৩, কলকাতা, পৃ. ৭০
৩.http://samay. Indiatimes.com
৪. চক্রবর্তী, স্বপ্নময়: শ্রেষ্ঠ গল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা পুস্তক মেলা ২০০৩, পুনমুদ্রন: জুন ২০১৭, কলকাতা-৭৩, পৃ-২৫৬
৫. রায়, রাহুল: অমৃতা দেবীর স্মরণে, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট ২০১০
আকর গ্রন্থ:
১.রায়, কিন্নর: সেরা ৫০ টি গল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১১, কলকাতা-৭৩২.রায়, কিন্নর: শ্রেষ্ঠ গল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা পুস্তক মেলা জানুয়ারি ২০০৩, কলকাতা-৭৩