শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’ উপন্যাস।)
হুক্বাহুয়া শব্দ ভাসে বনবাদাড়ে
গুমরায় কারা যেন অলি আর গলি
কিচিরমিচির শব্দটা হুইনছিলাম কবের তুন মনে তো হড়েন না, কিন্তু একী হইলো কেউ যেন কন্নাইও নাই, চোয়ের নিমিষে চুপ মারি গেল, এ কেমন কথা! কারও ডাক আঁই চিনি, আপন লাগে, কারোগে চিনিনা। এরা আঙ্গ ঘরের হাশেই থাকে। মনে কয় ডাকি আনি কোলে তুলে লই। রোদের তেজে গা হুড়ি যায়, তবু কী ওরা ডাক থামায়! মনের সুখের তুন ডাকে। কত তো মনে আনন্দ। দুনিয়া ভাঙিচুরি চুরমার হই যাক, গাঙের কলকল শব্দ থামি থাক, গাছগাছালির হাগলামি শান্ত হই যাক, ওরা উরি উরি যাইব, শক্ত ঠোঁট দুইটা ঘষি ঘষি জানান দিব, ওরা আছে, ওরা থাইকব, এই ভবে কারা এমন আছে ওদের ঠেকায়। মাইনষের মুখ তুন এমন কথা আর হুনিনা, মুখটা কেমন হুকনা হুকনা, মুখের চোয়াল ভাঙি কেমন ভিতরে ঢুকি গেছে, কথা কইতে চাইলেও কইতে হারে না, কেন এমনটা হইল? আমার স্বামী কয়, ‘ কী হইল পাঞ্চালী তুমি আজকাল ভালা করি কথা কও না কেন? খালি কাম আর কাম। ধান সিদ্ধ করি রোদে শুকাও, বৃষ্টি বাদল আইলে সাততাড়াতাড়ি গোটাইবার লাই ছুটি যাও আর গোলা ভর্তি কর।’ ‘আমনে বুঝি কিচ্ছু হুইনতে হান না?’ আঁর স্বামী কথা হুনি অবাকও হন না, চমকাইও যান না, এমন একটা ভাব করেন এ আর এমন কী কথা। কী আশ্চর্য রোজ রোজ ঘটি যাওয়া গল্প আঁই ওনার মুখ তুন হুনি আর ভাবি কী হইতেছে এইসব। মাইনষে তো এরকম ছিল না। ভাবখানা তো অন্যরকমই ছিল, কত সুন্দর কথা কইত, আজ কেন এত ফিসফিসানি, গুনগুনানি। কত কথাই না নদীর জলের উপরে কাঠের টুকরার মতন ভাইসতে ভাইসতে চলি আয়ে, মনের মাঝে আই ধাক্বা খায়। ঘরে ঘরে এর আঁচ লাইগতে শুরু হই গেছে। এক গ্ৰামের তুন আর এক গ্ৰামে দলে দলে লোক আইসতে লেগেছে। আঁর মামাহৌর মামাহৌরি হোলামাইয়া নাতি নাতকুর লই যেদিন আঙ্গ বাড়ি উঠল, বুইঝতে হারলাম অভাবের সংসারে আগুন লাইগছে। পেছনের ঘরখান ওদের জন্য হকলের সঙ্গে হলা পরামর্শ করি ছাড়ি দিলাম। এই দুঃসময়ে বেচারিরা যাইব আর কোথায়। কেন এমন দশা হইল ভাইবলে গা শিউরে উঠে। কি আর কইমু, মুখের দিকে চাওন যায় না। আঁই আগ বাড়াই কইলাম, কোন কিছু চাইতে সংকোচ করিওনা। সম্পর্কে বড় হইলেও বয়সে আঁর ছোট। ঘাড় নাড়ি মাথা নাইড়ল। কোন কিছু কইবার আগেই ঘরদোরের কামে লাগি গেল। বুইঝলাম সুসময়ে আগে ওরা কতবার অতিথির মতন আইছে আর গেছে, এমন ভাবটি হয় নাই। নিজেরাও ভাইবল সময়টা পালটি গেছে, এখন ওরা একটুখানি ঠাঁই পাবার লোভেই আইছে, দুইবেলা দুমুঠো যদি জুটে যায়। ঘরে পা দিই কইল, ‘বৌ আঁর হোলামাইয়াগুনরে বাঁচা।’ আঙ্গ জ্ঞাতি উত্তর দিকের বাড়ির দরজায় জড় হইল গরীবগুরবো আত্মীয়স্বজনরা। এমন একটা দশায় মাথায় বাজ ভাঙি পইড়ল যন দেইখলাম আঁর খুড়তোতো জা’র মাসীরা পোটলাপুটলি লই ঘরের চৌকাঠে পা রাইখল। দু’একদিন যাইতে না যাইতেই হক্বল খালি ঘরগুলো ভরতি হই গেলে চিন্তা কইরলাম, কেমন করি এই অবস্থার সামাল দিমু। আঁর প্যাটে ছয় মাসের বাচ্চা। নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়ব এই ভাবি মুঠো করি ধইরলাম। আঁর স্বামী বেগতিক বুঝি আঁর মাথায় আচমকাই এতগুন আত্মীয়ের সামনে মাথায় হাত রাইখল। আরে করতেছ কী! এরা কী কইব। হক্বলে চোখ টাটাই তাকায় আছে। ‘এদিকে আইও, একখান কথা আছে।’ স্বামীর পকেটের অবস্থা আঁই জানি। কিছু টাকা আঁর হাতে গুঁজি দিই কইল, ‘হপ্তাখান এই কটা টাকায় চলি যাইব। তারপরে হালাতবরাত করি কিছু যোগারপাতি করছি পারি কিনা দেইখছি। কিছু চিন্তা করিও না।’ জীবন যে এমন শিক্ষা দিই যাইব, সে কি আর এমন করি ভাইবছি কখনও। আঁর স্বামী কইছিল বটে, ‘জীবনে দেইখবা এমন সময়ও কখনও আইব, সকল হিসাবকিতাব সকল পালটি দিই চলি যাইব। তুই হয়ত মনে কইরবা, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।’ ঠিকই কইছিল বটে। এটাও কথা বটে আঙ্গ স্বামীরা কোনো খোঁজ রান না সংসারটা চইলছে কেমন কইরে, ঘরে চাইল ডাইল আনাজপাতি তেল সাবান সিঁদুর আছে কি নেই। ধারনা এমনই বাড়ির বউরা যা হোক করি চাইলে নিব। কী আর করি ! লক্ষ্মীর ঝাঁপিটা হাড়ি ধপাস করি মাটিতে আঁছাড় মাইরলাম। চার আনি, দশ আনি, পাঁচ আনি গড়াই গড়াই সারা ঘরের কোণাই কোণাই যাই থামি গেল। বাড়ির বড় গিন্নির ভাঁড়ারে যে এত জমানো পয়সা ছিল কে জানত। হক্বলে মুড়ে কিছু কইল না বটে, কিন্তু মনে মনে অনেক কথাই কইল।
আগুন নাকি আইয়ের ঝড়ের মতন। কেন আইয়ের, কীসের জন্য আইয়ের আঙ্গ মতো গ্ৰামের মাইনষের জানার কথা নয়। এত দূর তুন আইয়ের যে চোয়ে দেইখছিনা ঠিক কথা কিন্তু মনের ভেতরে যে ডেগচিতে ভাত ফুটানোর মত শব্দ হর, সেটুকুনি টের হাইয়ের। আঁর স্বামীরে জিগাইলে যেমন করি উত্তর দেয় মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে হারি না। তবে কিছু একটা গন্ডগোল যে হর, বাতাসের ফোঁসফোঁসানি কানের কাছে আই ধাক্বা মারের। আঙ্গ ওনার চোখমুখ যে ভালা ঠেইকছে না, হারাক্ষন ভার হই তাই মুখটা দেই বুইঝতাম হারিয়ের। হুইনতে আছি আঙ্গ হাসের গ্ৰামের মাইনষের জীবনেও নামি আইছে বিপদের উপর বিপদ, খালি নাই আর নাই। এক বেলা দানাপানি জোটে তো, আর এক বেলা উপোস। রোজে কাম করি যে দু’পয়সা কামাই করে, তাতে আর সংসার চলে না। কোনদিকে যে যাইব বুঝি উঠতে হারেন না। কুতুব মিঞা ওর ছোট হোলারে পাঠাইছে আঁর কাছে বড় আশা করি যদি সের খানিক চাল আর একখান লাউয়ের বন্দোবস্ত করি দিতে হারি। এদিকে আঙ্গ ঘরে এতগুন বাড়তি লোক, কোন দিক যে সামলাই। হোলামাইয়াগুলার মুয়ের দিকে চাইতাম হারি না। গামছা লই আছিল, চালের কোলার তুন পোয়ায় মাপি দিলাম পুঁটলি বানাই। কী খুশি যে হইল, নাইচতে নাইচতে চলি গেল। মাইনষে কখন যে কীয়ের লাই কন খুশি হয় কে কইব। জনে জনে জিগাইছি, কেউ ঠিক করি উত্তর দিতে হারে ন। এত চেষ্টা করিও আঁই মাইনষের দুঃখ কষ্টের হিসাবনিকাশ কইরতাম হারি না। আঁর হেটের ভেতরে বাচ্চাটা নড়েচড়ে। এত অসময়ে বাইর হইত চায়, কি জানি ওর মনের গতি। পেটের মধ্যে হাত বুলাইলে ফের শান্ত হই যায়। হায়, বিধির কী খেলা! এ যেন নতুন এক খেলা, গোটা গ্ৰামটায় থমথমে ভাব, দেশের কথা বুইঝব কেমন করে, আপন লোকের যন্ত্রণাই হজম কইরতে হারছি না। বিদেশের সরকার আঙ্গ দেশটারে কব্জা করি রাইখছে। হুইনতেছি জমিদার জোতদাররা ওগো তাবেদারী করে রাতদিন। চাষীভুষা মাইনষে ভাতে মরুক, তাতে কি আর আইল গেল। ওগো কে আর মানুষ জ্ঞান করে। যদ্দিন চাইল ডাইল ঘরে ছিল দিছি, দুঃখ যন্ত্রণা আর কত সহ্য করা যায়। মাগ্গিগণ্ডার বাজারে ঘরদোর ছাড়ি হালাইতে পারলে বাঁচে। জেলে, কামার, কুমোর, তাঁতিরা পয়সাকড়ি আছে এমন আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা খোঁজে, যদি সাতকুলে কেউ থাকে আর কি। এমনও হুইনতে আছি মাঝিমাল্লারা শেষ সম্বল নৌকাখান বিক্রিবাটা করি ঘর ছাড়ের। জাতপাত হিন্দু মোছলমান কে আর অত বাছাবাছি করে, পেটের জ্বালা, বড় জ্বালা, এই জ্বালায় যে জ্বলিপুড়ি মরে, তার কি মান ইজ্জত বলি কিছু থাকে! ঘরের বউঝিরাও লাজ শরমের মাথা খাই হুইনতেছি হরিল বিকাই দের। নিজেরে ওই জায়গায় বসাই দেইখলে গা-টা রি রি করে। আঙ্গ ঘরেও তো যুবতী মাইয়া আছে। গ্ৰামের এই মাইনষে কত সময় আদর করি ডাইকত মা-মাসী-জেঠি-কাকি বলে। ভাবি আর কাঁদি আসমতিরমা, রাজিয়া, মোস্তানের বাপ, হারান অধিকারী, অজয় শীলরাও ওই দলে আছে। অর্ধেক লোক গ্ৰামছাড়া হয়েছে। খাঁ খাঁ কইরছে চারধারে। মাঠে চাষা নাই, লাঙ্গল নাই, বলদ নাই, হাঁস মুরগির ডাকাডাকি নাই। আঁর জা আই কয়, ‘দিদি গো এত চিন্তা আর কিয়ের লাগি করো, যে আসতেছে তার কথাও তো ভাইবতে হইব, নাকি।
হাতা ঝরের, মানুষও ঝরের, হুকনা পাতা, মরা মানুষ। ঝইরতে ঝইরতে কন্নাই যে চলি যাইব, কেউ জানে না। পথের মধ্যিখানে হড়ি মরি থাইকব, না আরও অচেনা হথের খোঁজে চইলতে চইলতে কত ঠিকানার ভাঙচুর হইব, এই কথা আঁই শুধু ভাইবতে থাকি আর মনের আঁকিবুঁকি চেহারার লগে মেলাই। কালা ধলা শ্যামলা লম্বা বাইড্যা, নাক বোঁচা ধ্যাবড়া চোখা হক্বলে নিজের মতন চলে, কনডাই এই পথচলা শেষ হইব কেউ জানে না, খালি জাইনত চায় কোথায় গেলি হেট ভরি ভাত খাইত হাইরব। খবর আইয়ের পথের মধ্যিখানে কাহিল হই গড়াই হড়ি মাইনষে নাকি কাতরায়। কী যে উপায় হইব, কী জানি। তেনার রোজগারপাতি গেছি কমি। কি কইব আর কি না কইব বুঝি উইটত হারে না। নিজের দুঃখের লাইও চোখ দিই জল হড়ে, অন্যের দুঃখেও হরান কাঁদে। কতগুলান নতুন নতুন শব্দ কানে ভাসি ভাসি আইয়ে। আগে তো কোনদিন হুনি ন। আঁর স্বামী কথায় কথায় ওই শব্দগুলান মুখ দিই বার হই যায়। ‘আমনে এগুলা কী কন, একটু বুঝাই কন চায়। কারফিউ, কামান, বোমা, ব্ল্যাক আউট ঘুরি ফিরি আইয়ে। এই তো দেখছি গোদের উপর বিষফোঁড়া। কখন যে কার সব্বনাশ হইব, কেউ কইত হাইরত ন। কে যে কাম দিব, কার কাছে যে কাম চাইব! সুযোগ বুঝি জমিদার জোতদাররা ওই ছাপোষা লোকগুলারে টাকাপয়সা দেওয়া দূরে থাক, একবেলা খাওয়ানের শর্তে গুদাম ভর্তি করি রায়। মনে মনে কি কারসাজি করের ওরাই জানে। তবে একটা সার কথা বুঝি ফালাইছি আঙ্গ দেশের মাথাওয়ালারা গরীবগুরবোদের মানুষ বলি গন্য করে না। আঙ্গ গোটা হরিবারের কেউ কেউ যারা ব্যবসাবাণিজ্য করে, তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। দশ বার মাইল দূর দূর তুন বড় বড় নৌকা ভর্তি করি কাপড়চোপড় লই আনে। মনের ভেতরে দাগ লাগে। হোলা কোলে নি উদোম গায়ে ছেঁড়া কাপড় হরি থালা লই দোরে দোরে ঘোরে, আঙ্গ ভাসুর দেওররা যন মজুত করে বুকটা হাঁডি যায়। আঁর হেডের ভেতরে যেটা পরে পরে বাড়ের ওকি হোনের হক্বল কথা। অভিমুন্যের মতন হয়ত জাগে আর ঘুমায়। ওর আর দোষ কেমনে দি। দামড়া দামড়া লোকগুলান রে জাগি ঘুমায়। এখন আবার ঘরের এমাথা ওমাথা ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ি।
কী বলে যে লোকে দু’একঘর লোকের পোলারা মাষ্টার হইছে। ওরাই কয়,’ জেঠি মিত্রশক্তি অক্ষশক্তির নাম হুইনছেন? অত হুনি আঙ্গ কাম নাই। অত দূর লাগত ন, চল না চল ওই মাঠে চল, ঘাসের বুকে বই থাই কান পাতি হুন, কী হুইনবি কত কথার কচকচানি, গ্যাতিগুষ্টির উঠানের ঝগড়া হুন, এক হাত জমির লাই দিনেরাতে মাথা খোঁড়াখুঁড়ি, রক্তারক্তি চইলছে, কে কার মাথা ফাটাইব, কারে এক ঘরে করি রাইখব, বামুনের হোলার পা ধরি পাধোয়া জল খাইব, ষোল আনা লাভ লোকশানের ভাগ বসাইব, বংশে নিব্বংশ কইরব, কেইবা তখন কার শত্তুর, কে দোসর কেমনে কইবি ক তো ? কার কাছে আঁই উত্তর হাইয়ুম, জীবনটা আসলে কী? সম্পর্কটাই বা কেমন করি দানা বাঁধে। ওই যে বনবিহারী আর রসিকলালের আঁকচাআঁকচি তিন পুরুষ ধরি চইলছে, ওরা কি জানে হুতাটা কোন হুঁইচের, সোনামুখি না কাঁথা সিলাইয়ের হুঁইচের ফুটোয় কেন্নে গাঁথা আছে। কোন গাছের গোড়ায় কত মাটি ছিল, মূলটা ছড়াই কত নিচ দিই এঘর ওঘর করেছে কেউ জানে না। খালি কয় কিল ঘুসি চড়থাপ্পর যত খুশি মার, ভিটে দখল করি ঘর ছাড়া কর, হায় হায় রে, কোন দিকে গেলে, কোন পথ দিই হাঁইটলে মাইনষের ঘর খুঁজি হাইয়ুম, কইতি হারস ? মগজের মধ্যিখানে খালি গিজগিজ করে শয়তানি বুদ্ধি, কে কারে টপকাই যাইব, এদিকে কত মাইনষের পেটে ভাত জুটছে না, সে খেয়াল আছে ? সব রসাতলে চলি যাইব, আইজ না হয় কাইল, অনও সময় আছে খুঁজি বার কর না, তোরা তো মাষ্টার, কোন পথ দিই গেলি হা’র মধ্যে কাঁটা ফুইটত ন। মাষ্টার তো আঁর কথা হুনি খেই হারায় হালায় ‘জেঠি এইসব কী কয়!’ ও মাষ্টার এদিকে আয়, দেখ দেখ, দেখতি হাইরচস, ঢেঁকি ঘরের হামনের রাস্তায় গোখরো আর বেজির লড়াই দেইখবার লাই কত লোক জড় হইছে, মজা দেইখছে হক্বলে, এই নাচন বড় মজার নাচন, কেউ জানে না কে জিইতবে, আর কে হাইরবে, সোন্দর তো লাইগছে, কারও মনের মধ্যে এই কথাটা তো একবারের তরেও জাইগছে না, কেউ না কেউ তো মইরব। মাইনষের মরাটাই মরা, আর সাপ বেজির মরাটা মরা নয়। গরু ভেড়া মোষের লাই চোয়ের জল হড়ুক, তাতে কষ্টে মন হুড়ুক, মাইনষের লাই হরান কাঁদি উইটত ন, হেইডা কেমন করি হয়। কথাটা হাঁচা, এই বিশ্বাসে আঁইও চলি। তাইর লাগি ফোঁপাই ফোঁপাই কাঁইদিছিলাম তো কিছুক্ষণ, আঁর দুধেলা গাঁইটা যন মরি গেল, পুরা হরিলটা কনডিয়ার হুইরের হারের এক কোনে হরিছিল, কাঁকেরা ঠোকরাই ঠোকরাই মাংস খাই শেষ করি দিছে, খাঁচাটা যে হরি আছিল, বুকের মোচড়টা কত কথা কই উইঠল, সেদিনই বুইঝলাম, চোয়েরও অন্যরকম ভাষার জন্ম হইছে গোপনে গোপনে। ভাষার কথা এইভাবেই উঠি আসে কিনা। ওর কত দুধের স্রোত তো বইছে আঁর হোলামাইয়ার হরীলে, সইতে হারি ন, ওর জ্যান্ত হরীলটা বসাই দিলাম হাড্ডির কোনায় কোনায়। মাষ্টাররে কইলাম বাপ আঁই তো কিছু বুঝিনা ওগো শক্তির দাপট, কে রে এমন নামগুন বানাইছে, ওরা কি আঙ্গ দেশের চাষাভুষার মতন না জুড়ি গাড়ি চড়ি বাবু লোকরা আয় যায় ওগো মতন। ওরা কি কাতারে কাতারে মরে, না নাখাই মরে, মরার আগেই যদি মরি যায়, তাইলে তো আর মরার ভয় থায় না। যা মাষ্টার ইস্কুলে যা, ছাত্ররগুনেরে তোর অনেককিছু হড়াইত হইব। ঝমঝম করি বৃষ্টি হড়ের, আকাশের মেঘেরা উড়ি উড়ি চলি যার। তোর তো মাথায় ছাতিও নেই, যাইবি কেমন করি। ‘জেঠি, আমনেরে যে কত কিছু কওয়ার ছিল, কিছুই বুঝাইতে হারালাম না, দেশটা যে হুড়ি যার।’ মাষ্টারের কথা খান হুনি হাসিখানা আর চাপি রাখতে হাইরলাম না।
চিল্লাচিল্লি কইরব না শব্দের গোঙানি কোনটা কইলে ভালা হয় না বুইঝতে হারি কান হাতি রইলাম। কেউ কয় জাপান, কেউ কয় রাশিয়া আরও কত কত কত নাম, অধ্বেক বুঝি তো অধ্বেক বুঝি না। ওদের গলার জোর এত বেশি, মাইল খানেক দূর তন, খেলার মাঠে মাচা বাঁধি লম্বাচওড়া বক্তৃতা মারে, মাঝখানে বিয়াল বিয়াল হাঁট বইয়ে, লোকে লোকারণ্য, কথাগুলান উড়ি উড়ি চলি আইয়ে তবুও গা’র রোম খাড়া হই যায়। কেন যায় আঁই নিজেও জানি না। ওরা নিজেরাও কি জানে, কেন বক্তৃতা মারে! মন কয় জিগাই আই, কোথা তুন শিইখল ওরা এমন কথার বাঁধন? কেউ কি কানে ওদের ফুসমন্তর দিছে। ওরা কি মাইনষের ভালা কইরত চায়, ভালা কইরবার লাই এত লোভ কিসের লাই? ফয়জল মিঞা ধানের গাঁইট মাথায় চাপি কাস্তে বোঝার মধ্যে গুঁজি আনমনে কোমর নাচাইতে নাচাইতে মাঠ তুন কাঁচারিবাড়ির দিকে ছোটে, ধুত্তরি কা ওর খাই দাই কাম নাই ওগো গরম গরম কথা হুনি মাথা চুইলকাইব। একটা গাঁইট নামাই রাই আবার মাঠের দিকে ছোটে। কত ধানের গাঁইট না মাঠ জুড়ি ছড়াই রইছে ঠাঁ ঠাঁ রোদ্দুরে। গায়ের তুন ঝরি ঝরি হরে ঘাম হই। মাথায় পেঁচানো গামছা দিই মুখচোখের ঘামটা মুছি নি লুঙ্গিটা গুটাই আর এক বোঝা মাথায় চাপায়। এইভাবেই সূর্যের আলো যন ডুইবতে লাগে, মাঠের পর মাঠের চেহারাটা কেমন পালটি যায়। ফয়জল মিঞা, আনারুল, মুকবুল মিঞারা গলাগলি করি মাঠের আইল ধরি হাঁইটতে থায়। বলাবলি করে, ‘কিছু বুঝিস, ওরা কী কয়?’ ‘ওই সকল ঢঙের কথায় আঙ্গ কী কামে আইব, কও দেখি!’ ‘এই দিন দুনিয়ায় কত কিছুই না ঘটে, সকল কথায় কান দিলে চলে!’ ‘আঙ্গ পেটে ভাত জোটে না, কত লোক চাষবাস ছাড়ি বাঁচার লাই মাথা চাপড়ার, বালবাচ্চার মুখে কী করি ভাত তুলি দিব, সেই চিন্তায় ঘুম নাই। আচ্ছা ক চাইন, এমন গজব লাগিল কেমন কইরে, হক্বল জিনিসের দাম এত মাঙ্গা, এমনটা আল্লাহ তাআলার কারসাজি হইতে পারে! শয়তান লোকজনেরা হরের ধনে পোদ্দারি করের, আঙ্গ ভাত মারের। নিয়ামত আলী কাইল্লা বোঁচকা বাঁধি হোলামাইয়া লই হৌরবাড়ি চলি গেছে।’ আঙ্গ তো যাইবার মতো জায়গাও নাই, কনডাই যাইমু। ঘরেই হড়ি হড়ি মইরত হইব। মালিকদের গোলায় ধান আছে, আঙ্গ গোলাও নাই, ধানও নাই’ । ‘জিল্লুরের মন ভাঙ্গি গেছে, বেয়াল হালাই মাছ যা ধরে, বিক্রির হয়সায় সংসার টাইনত হারেন না। মুদি দোকানদার বাগাদা আর কত বাকিতে নুন, ডাইল, মরিচ, পেঁয়াজ রসুন দিব। চক্ষুলজ্জায় না বইলত হারে না।’ ওদের কথা আর কে কানে তোলে। ওরা খালি কয়, দেশ নাকি স্বাধীন হইলে হক্বল দুঃখকষ্ট দূর হই যাইব। আরে ওরা তো জানে না, হক্বলে যা জানে , সেইসব কথা হোনাই কোন কামে আইব, যা জানে না সেই সকল কথা কও, যে পথ মানুষ চেনে না সেই পথ দেখাও।
আইজকাল আবার মাইনষের মনটা কেমন জানি হই যার। যুদ্ধ যুদ্ধ খেইলতে চায়। এইসব ভাবনাচিন্তা আঁর স্বামী আঁর কানে ঢোকায়। কত নতুন নতুন কথা কয়। কোর্টে মুসাবিদা করার সময় আইনের কচকচানির ফাঁকে দেশের হালচাল লই চিন্তার একশেষ নাই তেনার। ধর্ম আনে, ইতিহাসও টানি আনে, জাতপাতের কথাও আনে। নেতাদের লগে পুরান পুঁথির নায়কদের লগে মিলাই দেয়। ওনার মুখে বারে বারে গান্ধী, নেতাজি, নেহেরু, জিন্নাহ’র কাহিনী হুনি। জানার সাহস করি নি এনারা কন্নাই থায়। অবশ্যি এসব জানি আঁর কি কামে আইব। গাঁয়ের বউ ঘরদোর উঠোনবাড়িতে দিন চলি যায়, রাত ফুরায়। এত্ত বিরাট দেশের বিরাট লোকেরা কীসব লই ঘাটাঘাটি করের আঁর মাথা ঘামাই কী হইব। হারাক্ষণ মনের মধ্যে সেই এক চিন্তা গোটা সংসারটারে হর্মূলের আঁটির মতো বাঁধি সাঁধি রাখতে হারুম তো! কে যে কন কোনদিকে ছিটকে যায় কে কইতে হারে। মন প্রাণের টানটায় চির ধইরলে এমনটা হইলেও হইতে পারে। মনের ভাঙনটা ঘরের কোনা তুন হুরু হয়। বেড়ার ভাঙনটা এক চিলতে সরু সুতার মতো আলগা হইতে থাকলেও দেখা যায় না, কারও মুখ দিয়ে কথা সরে না, একদিন এমন আইয়ে কথার ঝাঁঝ ফুলকির মতো চারধারে সরায়, যত জল ঢাল, সেই কথার আগুন নিভতেয় চায় না। এই বুঝি এতদিনের জমানো ভালোবাসার খড়কুটো হুড়ি ছাই হই যায় চোয়ের নিমিষে। তন আর হুশ থায় না, কারে কি কইয়ুম, কারে কোন কথার মলম মাখাইয়ুম। তুচ্ছ ঘটনা, কার হোলার ভাগে দুধের সর কম হইরছে, এই লই যত রাজ্যের কথা কাটাকাটি। হিয়ান তুন হুরু হই কোথায় যাই থাইমল জানেন, ছোট জায়ে আর বড় জায়ে কথা বলা বন্ধ, ভায়ে ভায়ে মুখ দেখাদেখি নাই, ভেতরের কথা ঘরের বার হইল, চার কাইন হইল দুই কান তুন, বাতাসে বাতাসে ভাইসতে ভাইসতে এই বাড়ির তুন ওই বাড়ি গেল, এই গ্ৰাম তুন ওই গ্ৰাম গেল, রসিয়ে রসিয়ে একখান দুইখান গালগপ্পো হই এমন টক ঝাল মিশল, এমন হইল মাইনষের কাছে মুখ দেখানো যায় না। কুমোর পাড়ার জগার মা আগবাড়ি জিগাইল, ‘এমনটা যে হইব, কোনদিন ভাবি নাই, আমরা আরও কইতাম, আকাশ ভাঙ্গি দুইভাগ হইব বিশ্বাস করন যায়, নতুন বাড়ির চুলোচুলি এইটা হইত হারে না, বাদি গাছের আঠা যে, ছাইড়ব কেমন করি! উপায়ন্তর না দেখি কি হইলে ছিপ ফেলি বরইয়ে গাঁথা যায় সেই চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়লাম। হক্বলেরে ডাকি কইলাম, তোঙ্গ মনের ভাবখানা কও দেখি। ওমা উল্টি এক দেবর আঁরে গালভরা যুদ্ধের গালগপ্পই হুনাই কত বাহাদুরি মাইরল। আঁই কইলাম, আগে নিজেদের ঘরের যুদ্ধ সামলাও, তবে না হয়….। ওমা ফিরতি উত্তরখানা মন্দ দিল না। কত কিছু যে চটকাই ইংরেজদের ভারত ছাড়ো, যুদ্ধের লগে বিশ্ব জুইড়ল, দুর্ভিক্ষের কথা কইল, হুনছি তো আঁই । হক্বলকথা জগাখিচুড়ি হই সদর দরজায় আই যে হাজির হইব ভাইবতই হারি ন।
দেশ স্বাধীন হইব ভালা কথা। কাদের লাই স্বাধীন হইব? পরাধীন কারে কয় এর অর্থটাই তো জানি না। কই আঙ্গ গ্ৰামের কুমারবাড়ি, কুমোরবাড়ি, তাঁতিবাড়ি, অধিকারী বাড়ি, জেলেহাড়া, মোছলমান ধোপা নমঃশূদ্র কারও মুখ দেই তো বুইঝতে হারি না চারদিকে এমন ঝড়তুফান লাইগছে। কালবৈশাখী’র তান্ডবে চারদিক ভাঙিচুরি সব একশেষ করি দেয়, সে কথা আর কে না জানে। গরীব মানুষদের ঘরবাড়ি উড়াই লই যাই। সনের চালের বাড়িঘর, চেনার কোন জো নাই। খড়বিচালির লাই আঙ্গ জ্ঞাতিগুষ্টিদের কাছে আই হাত পাতে। আঙ্গ নিকট আত্মীয়স্বজন দু’একঘর ঢাকা, কুমিল্লা আর কইলকাতা শহরে থায়। কামকাজ হড়ালেখা করে। ওরা উৎকন্ঠায় চিঠিচাপাটি করে, চিন্তায় ঘুম চলি যায়। নদীর কাছে ঘর, দূরে দূরে চর, চিন্তায় চিন্তায় মর, বাঁচার এমন বহর। নেতারা নাকি গ্ৰামে গঞ্জে গোপনে ডেরা বাঁইধছে, যুবক পোলাদের তাঁতার, কানে কানে গোপন মন্তর দের বিয়াল্লিশের আন্দোলনে ঝাঁপাই হড়ার লাই। ওদের না তাড়াইলে নাকি দেশের মুক্তি হইত ন। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, কে কইব। হেটে ভাত নাই, এই কথাখান অস্বীকার কইরব, কার সাধ্য আছে। কারো মুখ দিই ত কথা বার হয় না, আকাল আইছে, কেমন কইরে বাঁইচব ছাপোষা মানুষগুন। হঠাৎ চাইল ডাইল উধাও হইল ক্যান? এই দেশটা কি খালি বড় বড় শহরের লোকজনের, বাকিরা কি বানের জলে ভাসি আইছে। কারা এই অবস্থার লাগি দায়ি, শুধুই ব্রিটিশরা, আঙ্গ দেশের বাবু লোকরা কী মুখে ঘোমটা হড়ি বই রইছে? রাস্তাঘাটের মানুষ গরু ছাগলের কঙ্কালরা এরা কী চোখে দেখতে হায় না? নাকি ইংরেজ তাড়াই কখন গদিতে বইসব সেই ফন্দি আঁটছে। আঁর স্বামী আঁরে কয়, ‘ তুমি এসব লই শুধু শুধু মাথা ঘামাও ক্যান? পূজাআচ্চা কর, ঘর সামলাও, দেশের এখন টালমাটাল অবস্থা, অনেক গোলমাল, এসব মাথার তুন তাড়াও।’ তিনি তো বুঝছেন না, স্বাধীন হইবার তাড়া আঙ্গ ঘরের মাইনষের মধ্যেও লাইগছে, ভালা কি মন্দ আঁই বুঝি উইঠতে হারছি না, কোনটা আগে চাই ? হোলাপাইনদের মুয়ে মুয়ে ভাসে কত কথা। দ্বীপান্তর, জেল, ফাঁসি, স্বদেশী গান, কেমনে কেমনে চলি আইয়ের! বুঝি না এই অবস্থাটারে কী কয়? হাগলামি! ভালোবাসারে হাগলামিই তো কয়। মাটির টান, এমন টান পেটে ধরা মায়ের মুখটা ভুলাই দিত হারে! এমন শক্তি! আচ্ছা, দেশের সীমানা বাঁধব কেমন করি? কোন রঙ আছে নি তার ? পূবের লোক পশ্চিমের মাইনষেরে কেমন চেহারায় দেখে? উত্তরের মাইনষে দক্ষিণের মাইনষেরে কেমন করে মেলায়? কোন মন্তর জানেনি এরা, নাকি চাপিচুপি বস্তায় পুরছে? দেশটা ভাঙ্গিভুঙ্গি কোনদিন টুকরো টাকরা হই যাইত ন ত?
চুপিচুপি কথা আয় আর যায়। গুঞ্জন ভাসে। কে কয় আর কে না কয়, কে জানে। কারা যেন ভাসাই দিই চলি যায়। ওগো চেহারার মিলও নাই, আবার অমিলও নাই। এই বড় কষ্টের কথা, মন জুড়ি থায়, এমন করি, পাথরচাপা দিই রাইখছে বুকের উপর। হক্বল কথার অর্থ তো বুঝি না। তবে কিনা একদিকে লই যাইত চাই কিছু লোক, এই তো হাডুডু খেলা, আর এক দলের ভাবখানা যাইতান ন, দেই না কেমনে নি যাস। আন্ধার জমাট বাঁধি আয়, আলোরা ভয়ে ছুট লাগায়, হামনে হাজার ছায়ার চু কিত কিত খেলা। এই খেলায় জাত বেজাত হয়, রঙ বেরঙ হয়, ডাকনের ঢঙ পাল্টি যায়। ক্যান যে গোপন শলা পরামর্শ! আঁচ কইরতাম হারিয়ের। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ লসাগু গসাগু অঙ্কের নিয়ম কোন কিছু মাইনত ন ওরা। ধম্মেরে লই লোফালুফি কইরব। আহা কী আহ্লাদ! দে উচিত শিক্ষা। দেশ জমি লই টানাটানি। আঁর স্বামী কয়, ‘কইও না কারো কাছে। লোকে বলাবলি করের ওরা আঙ্গরে হত্তুর ঠাওরাইছে। সহজ হইব না। জল গড়াইব অনেক দূর। নেতাদের কথার হুইলঝুরিতে দল পাকার এক দল। মোতালেব মিঞা কইল, বাবু সাবধানে থাইকবেন, বউঝিদের ঘরের বাইরে হইত দিয়েন না। কানাঘুষা যা চইলছে পুলের গোড়ায়, হাটে বাজারে, ভাব ভালোবাসা আর আগের মতো রাখা যাইত ন। উস্কানি দের ধর্মের নামে।’ তবে কী মুসলমান হই যাইত হইব ইয়ানের থাকতি গেলে। হক্বল কথাই হোনা। ‘হক্বলটা নেতাদের হাতে। ইংরাজরা এইসব লই খেইলতে আছে।’ কই আলাউদ্দিন, খলিল, চাঁদেদের হাবেভাবে তো টের হাই না। একবার জিগাইব নাকি? ‘খবরদার কইতে যাইও না, মনের কথা মনেই রাখ। সবে বীজতলা তৈরি করছে সাহেবসুবোরা, নেতারা, আগের তুন জল ঢালি লাভ আছে। কত পুরুষ ধরি হাশাহাশি বসবাস, ওরা আঙ্গ জমি চাষবাস করে, এত সহজে বেঈমানি কইরত ন।’ মাইনষের স্বভাবচরিত্র কন যে কোনদিকে মোড় নেয়, কোন ভাবের কাছে মাথা ঝোঁকায়, কে কইত হারে। হায়রে জীবন, তোরে লই যে এত জনের যে এত ভাবনা, তুই নিজেও তো জানস না, যদি জানতি মাইনষে এত চক্বর খায়! কয় কেমনে, ‘আমরা যেমন করি দেই, তেমন করে দেহ, যেমন করি শিখাইতে চাই, তেমন করি শিখ, বুইঝলা না। তাইলেই ইহকাল পরকাল দুটাই সমান তালে চইলব। অন্য দলে নাম লিখাইয়া লাভ নাই, তোমার জ্ঞানগম্মি আর কতটুকুন, ঐটুকুনির উপর ভরসা করি বাঁচা যায় না। আঙ্গ পথেই যত মুক্তি, গিয়া পড়, বাকি পথে চইললে ঠ্যাং ভাইঙ্গব, হুইনচ মুখ ভ্যাংচানি, জাত বেজাতের কুকাম, আঙ্গ ইয়ানের হক্বলে হমান হমান, ভালা কথা কইচি, যদি না হোন, অন্য দাওয়াই।’ কেউ কেউ হুইনচে, কেউ হোনেন। নিচু জাতের মগজে চলে জিন পরির খেলা। তাই বলে মান সম্মান নিয়া টানাটানি, ফুসলানি! ‘ যায় যাক হরান, ধম্ম পালটাই অন্য ধম্মে নাম লেখাইব, তা হইত ন।’ যুগি পাড়ার দু’এক ঘর মুসলমান হইছে, হিন্দুর মাইয়া ভালোবাসা করি, মোসলমানদের পোলারে বিয়া করি ধম্ম পালটাইছৈ, কার কি কন আছে, মাইয়ারে বাপ মা ত্যাজ্য কইরছে, হিন্দুর দোকান তুন কেনাকাটি বন্ধের ফতোয়া দিই দেশ ছাড়া কইরব, কান হাতলেই এসব কথা হিন্দুদের গ্ৰামে গ্ৰামে ঘোরে। এসকল কথা আঙ্গ মুসলমান বদললাইরাই হোনাই যায়, কানাকানি করে। কথায় কথায় ভালোবাসি কয় না লীগের নেতাদের চমকানিতে ভয় দেখাইবার লাই কয় কে জানে। উঁচু নিচুদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগাই দিতে হারলি তো ষোল আনা মজা। সম্পত্তি দখল করার লোভ কার না আছে, তন কি হিন্দু কি মোসলমান অত বাছাবাছি কইরলে চলে, হক্বলে তন ভাই ভাই। আঁর স্বামী কয়, ‘ আসল খেলা চইলছে অন্য জায়গায়। দেশটা মোসলমানদের কইরত হাইরলে তবে না মজা।’ মোয়াজ্জেম মিঞা কয়, ‘দিদি গো, মাইনষের মন বিষাইবার লাই কন তুন যে কোন কথা গুলি খাওয়ার কে জানে, ভাষাটাও বুঝিনা, উদ্দেশ্যও বুঝি না। তবে এটা বুঝি, দেশটা ভাগ হইল বলে, আর বেশিদিন নাই।’
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)