পাবক উপাধ্যায়
দ্বিতীয় পর্ব
ট্রেকিং টুওয়ার্ডস্ ঘাঙারিয়া
ঋতুচক্রানুসারে বর্ষাকাল তখন মধ্যগগনে। তবে বর্ষার বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। কলকাতাতে বরাবরই প্রচণ্ড গরম। এখানে কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, সারাবছরই বাতাসে আগুন ঝরতে থাকে। সারাবছরই কলকাতাতে আবহাওয়া খুব গরম, উত্তপ্ত। এবছর ও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। দিন দিন প্রবল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টির অভাবে লোকজনের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠছিল। এসময় একটু চেঞ্জ না হলে জীবনটা বড্ড শুক্নো, তিতকুটে বেমানান লাগে। এইজন্যই বোধহয় হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে পড়ে; কেউ বা চলে যায় নদীমাতার কোলে, কেউ বা বজ্রসম পাহাড়ের বুকে, আবার কেউ জঙ্গলে জঙ্গলে খুঁজে বেড়ায় বেঁচে থাকার রসদ। এভাবে প্রকৃতির সন্ধানে বেরিয়ে কত রোমঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী হয় তারা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকৃতির খুব কাছে গিয়েও তার দেখা পায় না, কেউ বা আবার না চাইতেই পেয়ে যায় প্রকৃতির গুপ্তধনের রহস্য। আজ, এরকমই একটি গল্প শোনাব।
সেবার কোথাও কাওকে কিছু না জানিয়ে হরিদ্বারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে, একরাত কাটনোর পর মনে ট্রেকিং এর বড়ই বাসনা জেগেছিল। ভালো ভালো জায়গা কিছুতেই মাথাতেই আসছিল না। কয়েকঘণ্টা চিন্তা ভাবনা করার পর বদ্রীনাথ যাবার জন্য মনস্থির করেছিলাম। সেই অনুযায়ী ভোরেই রওনা হয়ে গিয়েছিলাম হরিদ্বার থেকে। শুনেছিলাম বদ্রীনাথ যেতে গেলে গোবিন্দঘাটের ওপর দিয়ে যেতে হবে। গোবিন্দঘাট থেকে প্রায় ষোলো থেকে আঠারো কিমি দূরে হেমকুণ্ড সাহেব, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স নামক সুন্দর সুন্দর দর্শনীয় স্থান যে আছে তা আগে থেকেই গুগল করে দেখে নিয়েছিলাম। কিয়ৎ বিচার বিবেচনা করে ভাবলাম ট্রেকিং এর সুযোগ যখন পাচ্ছি তা হাতছাড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কাজেই মনের রসনা তৃপ্তির জন্য ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা লাভ করতে চাইলাম। গোবিন্দঘাট থেকে হেমকুণ্ডের দূরত্ব খুব বেশি না হলেও পথ এত চড়াই-উতরাই যে একদিনে ট্রেকিং সম্ভব ছিল না। সেকারণে, সকলেই গোবিন্দঘাট থেকে হেমকুণ্ড এবং ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের উদ্দেশ্য যাত্রা করলেও আলটিমেটলি ঘাঙারিয়াতেই বেস ক্যাম্প করে থাকে। বদ্রীনাথ যাবার পথে, তাই, গোবিন্দঘাটেই নেমে পড়লাম। সেখানে গুরুদ্বারাতে একরাত আশ্রয় নিয়েই পরদিন ভোর চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ পাড়ি দিয়েছিলাম ঘাঙারিয়ার উদ্দেশ্যে।
বলা প্রয়োজন যে, ঘাঙারিয়া উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম, যেটির অবস্থান ভ্যুন্দার গঙ্গা এবং পুষ্পবতী নদীদুটির সঙ্গমস্থলে এবং সেখান থেকেই নদীটি লক্ষ্মণ গঙ্গা নামধারণ করে বয়ে গিয়ে গোবিন্দঘাটের কাছে মিশেছে অলকানন্দা নদীতে। ভ্যুন্দর উপত্যকার সর্বশেষ গ্রাম যেখানে মানুষের বাস আছে, তা হল এই ঘাঙারিয়া। আয়তনে গ্রামটি এত ক্ষুদ্র যে একে পাড়া বলতে গেলেও দশবার ভাবতে হয়। সে যাইহোক, অতি ক্ষুদ্র হলেও এটি উত্তরাখণ্ডের একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ স্থান এই কারণে যে, এশিয়া মহাদেশের একটি বিশেষ স্বনামধন্য গুরুদ্বারা (হেমকুন্ড সাহেব) তা এই ঘাঙারিয়া থেকে মাত্র ৭ কিমি দূরেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই গুরুদ্বারাতে তীর্থ করতে আসে, আবার ট্রেকিং এর আনন্দ উপভোগও করে। যাকে বলে একযোগে রথ দেখা কলা বেচা। তাছাড়া, উত্তরাখণ্ডের ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স জাতীয় উদ্যান নামক অন্যতম আরও একটি প্রসিদ্ধ স্থান এই পথেই। ঘাঙারিয়া থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে পুষ্পউপত্যকার প্রায় ৮৮০০ হেক্টর জুড়ে এই ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স জাতীয় উদ্যান অঞ্চলটি বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। সেকারণে, হেমকুন্ড সাহেব এবং ভ্যালি অফ্ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্ক ট্রেকিং এর বেস ক্যাম্প হিসাবে ঘাঙারিয়া বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছে।
যাইহোক, ট্রেকিং-এর পরিকল্পনা আগে থেকে ছিল না, তাই ট্রেকিং এর সরঞ্জামও কেনা ছিল না। ভোরে গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়ার দিকে রওনা হতে হবে ভেবে রাতেই গোবিন্দঘাটে ট্রেকার্স স্পট থেকে ট্রেকিং-এর জন্য সূচালো একটি বেতের স্টিক (যাকে ট্রেকিং পোল বলে থাকে), রেইন কোট এবং শীতের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ভালো একজোড়া দস্তানা কিনে নিয়েছিলাম। শুনেছি ট্রেকিং এর পথ এত দূর্গম, ঢালু আর পিচ্ছল যে ট্রেকিং পোল না নিলে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। জীবনের প্রথম ট্রেকিং যে এরকম দুর্গম ট্রেকিং পথ দিয়ে শুরু হবে তা কখনও ভাবিনি। তবে ছেলেবেলা থেকে এত কঠিন, কষ্টসাধ্য, ভয়াবহ জীবন পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি, তাই কোনো কিছুর আর পরোয়া করি না।
গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়ার দুরত্ব দশ কিমি। প্রথম দিকে সকলকে ট্রেক করেই গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়াতে পৌঁছাতে হত। কিন্তু বেশ কয়েকবছর হল উত্তরাখণ্ড সরকারের দৌলতে গোবিন্দঘাট থেকে পুলনা গ্রাম পর্যন্ত চার কিমি রাস্তা পিচ দিয়ে সুন্দর করে বাঁধাই করা হয়েছে। ইদানিং সেখানে শেয়ার ট্যাক্সি, টাটাসুমো ইত্যাদির বহুল প্রচল হয়েছে। সেকারণে, প্রথম চার কিমি রাস্তা কেউ চাইলেই টাটাসুমো কিংবা মারুতি করে অতিক্রম করতে পারেন। কেউ চাইলে পায়ে হেঁটেও যেতে পারেন। ভোর তিনটে থেকেই সেখানে কমপক্ষে প্রায় একডজন গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রী পারাপারের জন্য।
এমতাবস্তায়, ইতস্তত করছিলাম যে ট্রেকিং করে যাব নাকি গাড়িতে করে পুলনা পর্যন্ত যাব, পিছন থেকে একজন বলে উঠলেন, “পাজী চলিয়ে না, হামলোক ভি যা রহে হ্যাঁয় হেমকুণ্ড।” পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম সেই ভদ্রলোক যার সাথে আমি গুরুদ্বারার লাঙ্গুরখানাতে খাবার বিতরণ করেছিলাম। আমি আর কিছু ভাবলাম না। চেনা হাসিমুখ দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম যে যতটা গাড়িতে যাওয়া সম্ভব ততটা না হয় গাড়িতেই যাই। ট্রেকিং রুট শুরু হয়েছে যেখান থেকে সেখান থেকে না হয় ট্রেকিং শুরু করব। তাছাড়া, বাইরে ঘন কালো অন্ধকার আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসের এত উপদ্রব যে হয়তো অল্পতেই কাহিল হয়ে যেতাম।
অবশেষে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে উঠছিল সন্মুখে পাহাড়ের ওপরে। কি সুন্দর অভিভূত দৃশ্য। বাইরের নিস্তব্ধ শীতল প্রকৃতিও যেন আমাদের সাথে সঙ্গ দিয়ে চলছিল। শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই পাওয়া যাচ্ছিল না। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস খোলা জানালা দিয়ে ছুটে এসে বরফের টুকরোর মতো মুখে ধাক্কা মারছিল। ড্রাইভার, যাত্রীদের অনুরোধে গাড়ির জানালাগুলো সপাট করে বন্ধ করে দিলেন। সামনের রাস্তা এঁকেবেঁকে অজগর সাপের মতো পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠে গেছে। ঘন কুয়াশার আস্তরণ চারিদিকে এমনিভাবে ঢেকে দিয়েছে যে দেখলে মনে হয় এ এক ঘুমন্তপুরী- এক রূপকথানগরী।
মিনিট দশ পনেরো লাগলো পুলনা গ্রামে পৌঁছাতে। ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট ফোটেনি। তীর্থযাত্রীদের চাপে খুব ভোরেই দোকানীরা দোকান লাগিয়ে দেয়। আয়েস করে চায়ে চুমুক লাগিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন চারপাশের পাহাড়গুলির দিকে তাকাতেই মনটা ঝরঝরে হয়ে গেল। কে জানে কোটি কোটি বছর ধরে তারা এভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আমদের দেখবে বলে। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেও কোনো চূড়া ঠাওর করে উঠতে পারলাম না। দোকানীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি যে সারাবছরই পাহাড়গুলি বরফে ঢাকা থাকে। জুন-জুলাইমাসের দিকে কেবল পাহাড়ের নিম্নাংশ দেখা যায়, বাকি সারাবছর চূড়াগুলি গগনভেদ করে মেঘেদের সাথে বন্ধু জমায়। সে এক গগনচুম্বী দৃশ্য ঠিক যেন পাহাড়েরা লুকোচুরি খেলাতে মত্ত হয়েছে। রৌদ্রের আলো পড়লেই কি অপরূপ শোভা, সাদা ধবধবে তুলোর মতো লাগে তাদের। যেতে যেতে কোনো আম জনগণও যদি তাদেরকে দেখতে না চায়, তারা অবশ্যই ডেকে নেবে নিজেদের শোভার টানে।
পিঠে দুটি ভারী ব্যাগ ছিল বলে একটা পিট্ঠূ নেওয়া বুদ্ধিদীপ্ত হবে ভেবে এদিক ওদিক তাকাতেই একটি পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের লোক কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “পিট্ঠু লাগেগা?” আমি বললাম- “হ্যাঁ জী! লাগেগা।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “চার্জ কিতনা লাগেগা?” লোকটি আমার মুখের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। সম্ভবত তিনি বুঝতে পারেন নি। তাই, লোকটির কাছে গিয়ে একটু চেঁচিয়ে বললাম, “মেরেকো কিতনা দেনা পড়েগা?” লোকটি তৎক্ষণাৎ বললেন “জী স্যার! তেরাশো পচাস।” আমি বললাম, “ইতনা জ্যাদা কিউ? আপ তো মুজে লুট রহে হো?” লোকটি সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, “নহি নহি সর জী ! এহি ভাড়া ফিক্সড্ হ্যাঁয়। গরমেন্ট নে এহি রেট ফিক্স কিয়া হ্যাঁয়।” অগত্যা তর্ক না করে ব্যাগ দুটো লোকটির মালবাহী ঝুড়িতে তুলে দিলাম। সঙ্গে একটি পিঠ ব্যাগ খালি করে সেটাতে ফোন, চার্জার, একটা ছোটো টাওয়াল আর একটা জলের বোতল নিয়ে পিঠে চাপিয়ে দিলাম। বাকি সব মালপত্র পিট্ঠুর পুঁটলিতে তুলে দিলাম।
আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে গেল। লোকটি বয়সে অনেক প্রবীণ হলেও গায়ের শক্তিতে যেকোনো তরুণকে যে মিনিটে ধরাশায়ী করে দিতে পারে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। এত ভারী বোঝা নিয়ে যে কেউ এত দ্রুত হাঁটতে পারে তা একে না দেখলে বিশ্বাস হত না। পাহাড়ে চড়তে না চড়তে প্রচুর জলটান হতে লাগল। ব্যাগে থাকা জল শেষ হয়ে গেল। তৃষ্ণার্থ হলে লোকটিকে ডেকে বোঝা নামিয়ে জল পান করতে হচ্ছিল। আমি লোকটিকে বাবা বলে সম্বোধন করতে লাগলাম। কিছু দূর একসাথে পথচলার পর জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, চায়ে পিয়েঙ্গে? চলিয়ে আগে ধাবা পে রুকতে হ্যাঁয়?” পাহাড়ে দশ মিনিট ট্রেক করার পর বুঝলাম আমার হাঁটার গতিবেগ কমাতে হবে নইলে কষ্টের শেষ থাকবে না। আমার সঙ্গে থাকা পিট্ঠু আমাকে সচেতন করে দিয়ে বললেন, “সর! ট্রেকিং কে টাইম হড়বড়িসে মত যাইয়েগা। গালতি সে প্যার রাং ইস্টেপ হো যায়েগা তো বহুত মুসীবত আ যায়েগা। তব চলনা হি মুশকিল হো যায়েগা।” আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে মনে করিয়ে দিলাম যে সামনের ধাবাতে যেন তিনি দাঁড়ান।
আরো মিনিট পনের যাবার পর সামনে একটা ধাবা দেখে মালপত্র নামিয়ে দোকানীকে বললাম চা দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে দোকানী স্টীলের দুটো গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “অর কুছ চাহিয়ে স্যার?” আমি বললাম “বাবাজি কো থোড়া বিস্কিট খিলাইয়ে জী।” দোকানী তাই করলেন। চা খেতে খেতে আমি কৌতুহলবশতঃ জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আপ কনসা গাঁওসে হো বাবাজি?” তিনি চা’য়ে চুমুক দিয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, “মেরা নাম বাহাদুর হ্যাঁয়। মে নেপাল সে হু সর।” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা! ইধর আপ কাহা রেহেতে হো?” তিনি বললেন, “হোটেল মে রেহেতা হু সর। খানেকা টাইম উধর সে হি খা লেতে হু।” কিছুক্ষণ কথোপকথন হল। জানতে পারলাম যে তার পরিবার নেপালেই থাকে। বছরের যে তিনমাস এখানে বরফ থাকে না সেই তিনমাসে পর্যটকদের মালবহন করে মাসে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশহাজার টাকা কামিয়ে দেশে ফিরে যায়। শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমদের দেশে বিএ এমএ পাশ করে হাজার-হাজার, লাখ লাখ ছেলে মাসে দশ পনেরো হাজার টাকার চাকরি পাচ্ছে না, যে কোনো কাজের জন্য তারা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইনি বলেন কি মাসে ত্রিশ-চল্লিশ হাজারেরও বেশি টাকা কামিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।
কিছুপর, দোকানীকে বিল জিজ্ঞেস করতেই বললেন ষাট(৬০) টাকা। আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না। দুটো চা আর দশ টাকার এক প্যাকেট বিস্কিট বলে কি ষাট টাকা। যাইহোক, দোকানীকে চায়ের মূর্ল্য দিয়ে আবার চলতে লাগলাম দুজনে। নিঃশব্দে দুজনে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা চড়াই উতরাই পথ চলছি। অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙে বাবাজির কথাতে, “সর! ইহাঁ পে আইসাহি চলতা হ্যাঁয়। হামলোগোসে এ লোক জিতনা লেতে হ্যাঁয়, বাহার সে আয়ে হুয়ে লোগো সে উসকে ডবল লে লেতে হ্যাঁয়। জ্যায়সে কি চায়ে হামলোগে সে দশ করকে লেতে হ্যাঁয়।” আমি বললাম, “ঠিক হ্যাঁয়! চলিয়ে।”
দশ মিনিট করে হাঁটি আর একটু করে রেস্ট নিচ্ছিলাম। সঙ্গে যেসব শুকনো খাবার ছিল সেগুলোই দুজনে খাচ্ছিলাম। তবুও কিছুতেই খিদে মিটছিল না। লোকটিকে বললাম, “আপ কুছ খায়েঙ্গে বাবাজি? রোটি সবজী কুছভি?” তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন, “জী সর! আপ জো বোলে। লেকিন আভি ত বহুত রাস্তা বাকি হ্যাঁয়। এক কাম করতে হ্যাঁয় অর থোড়া চলতে হ্যাঁয় উসকে বাদ আগে মেরা জান প্যাইচান এক ধাবা হ্যাঁয়, ওহি পে খায়েঙ্গে।” আমি বললাম, “ঠিক হ্যাঁয়।”
আবার পথ চলা শুরু হল। যত সামনের দিকে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম তত পথযাত্রীদের ভীড় কমতে লাগল। পাহড়ের চূড়ার মেঘ ভেদ করে অল্প অল্প করে রৌদ্রের কিরণ আসতে লাগল। কি সুন্দর দৃশ্য তা ভাষায় বর্ণিত করা সম্ভব নয়। সূর্যের আলো সবুজ গাছে পড়তেই মনে হচ্ছিল যেন চারিদিকে কেউ বিশাল সবুজের পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে যে ঝরনা ধারা নিম্নে সমভূমির দিকে ধাবিত হয়েছে রৌদ্রের পরশে তা স্বচ্ছস্ফটিকের চেয়েও স্বচ্ছ লাগছিল। ঠিক যেন হাস্যোজ্জ্বল হিরে। মনে হচ্ছিল যেন ওপর থেকে কোনো ঐশ্বর্যের দেবতা নলাকার বিশাল হিরের চাঁইগুলোকে ছুঁড়ে দিয়েছে নীচের দিকে। পাথরের আঘতে সেই হিরে ভেঙে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ঝরে পড়ছে আর তা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে হাজার মশালের অসম্ভব সূন্দর এক জ্যোতিপ্রভা। পাখি-পক্ষীসব মুগ্ধ হয়ে সেই রূপোলী আলোর দিকে তাকিয়ে। সবুঝ ঘন জঙ্গলও যেন অবিভূত হয়ে সেই অপরূপ সৌন্দার্য উপভোগ করছে কোটি কোটি বছর ধরে।
বেশ কিছুক্ষণ একটানা পাহাড় চড়ার পর প্লাস্টিকের ছাউনি করা একটা খাবারের হোটেলে পৌছালাম। বাবাজি হাত নেড়ে নেপালি ভাষায় একে অপরকে অভিবাদন জানাল। দোকানী তাঁর ইশারাতে অভ্যস্ত। অতঃপর, তিনি আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার! ক্যা লেঙ্গে আপ?” আমি বাবাজিকে জিজ্ঞেস করলাম “বাবাজি আপ ক্যা খানা চাতে হো?” তিনি বললেন, “সর! আপ জো বোলে।” আমি তাকে আবার শুধালাম, “নুডলস্ চলেগা তো?” বাবাজি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে দোকানীকে দু প্লেট নুডলস্ আর দুটো করে ডিম সেদ্ধ ওর্ডার দেওয়া হয়। টিফিন শেষে যখন বিল দিতে যাই তখন জানতে পারি যে সামান্য ৬ টাকার নুডলস্ এখানে ৬০ টাকা এবং এমনকি ডিম সেদ্ধ প্রতি ত্রিশ টাকা। জিনিসপত্রের দাম পাহাড়ে অত্যধিক বেশি। আসলে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, তাদেরকে মালপত্র নিয়ে যেতে হলে গোবিন্দঘাট কিংবা তারও নীচে থেকে ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে ক্যারিং কস্ট দিয়ে কিনে নিয়ে যেতে হয়। আমাদের বরং তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থকা উচিত এই ভেবে যে পাহাড়ের এত ওপরেও, সমতলভূমি থেকে অন্তত সতের থেকে আঠারোহাজার ফিট ওপরেও তারা সর্বপ্রকার রসদের ব্যাবস্থা করে রেখেছে।
গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়ার দিকে প্রায় তিন ঘণ্টা পথ অতিক্রম হয়ে গেছিল। সামনে একটা সুন্দর ব্রীজ, খুব সম্ভবত নতুন বানানো হয়েছে। ব্রীজের নীচ দিয়ে উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছে ঝরনা ধারা। সম্ভবত সেটি লক্ষণ গঙ্গারই স্রোতপ্রবাহ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোনো নদীর বাঁধ ভেঙে হুড়মুড়িয়ে জল ছুটে চলেছে কোনো গ্রামকে গ্রাস করবে বলে। কি ভয়ানক সুন্দর দৃশ্য। ঝরনারূপ নদীটির কলেবর তেমন প্রশস্ত ছিল না। কিন্তু জলপ্রবাহের স্রোত এত বেশি যে, চারিদিকের গভীর শূন্যতা ভেদ করে শুধু একটাই আওয়াজ আসছে- কুলুকুলু। চারপাশের পাহাড়ের গায়ে সেই আওয়াজ ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন জলপ্রবাহ একই ছন্দে বলে চলেছে “বাহে গুরু! বাহে গুরু!” একটা উঁচু পাথরের টিলা দেখে বসে পড়লাম সেই রাক্ষুসীবেশী নদীর মাঝেই। খুব কাছে থেকে নদীর কুলুকুলু ধ্বনিকে আবিষ্কার করে বাবাজিকে বললাম, “বাবাজি! আপ আগে বাড়তে রহিয়েগা। যাহা পে একঠো ধাবা মিলেগা ওহি পে ঠেহেরিজিয়েগা।” তিনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলেন।
কতক্ষণ কেটে গেছিল ঠিক মনে নেই। তবে, একটা ভয়ানক হিংস্র চিৎকারে মোহ ভাঙল। প্রায় হাত দশ-পনের দূরে দেখলাম একটি ভাল্লুক নদীর জল পান করতে এসে আমাকে দেখে গর্জন করতে শুরু করেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শুনেছি ভাল্লুক, চিতা, হায়না এরা এই জঙ্গলে আছে। তবে দিনের বেলায় তেমন বেরোয় না। কিন্তু এ আমি কি দেখছি। দম আটকে আসছে। প্রাণবায়ুটা যেন মুখের কাছে এসে থমকে আছে। আমি একদৃষ্টিতে ভাল্লুকটির দিকে তাকিয়েছিলাম। সেও আমার দিকে তাকিয়ে। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না যে কে কাকে দেখে ভয় পেয়েছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেল। ভাল্লুকটি মনের সুখে উদরভরে জলপান করল। তারপর জড়িয়ে জড়িয়ে, সম্ভবত ওর ভাষায়, কিছু বলল আমার দিকে চেয়ে তারপর একটা মৃদু গর্জন করে চলে গেল। ভাল্লুকটি চলে গেলে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করলাম। এ যাত্রায় প্রণটা রক্ষে হয়ে গেল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর বাবাজিকে ছেড়ে নয়; এ পথ একা চলা প্রাণহানির কারণ হতে পারে। নদীর জল চোখে মুখে দিয়ে বাবাজির উদ্দেশ্যে সামনের রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের জঙ্গলে প্রবেশ করলাম।
বাবাজি বোধহয় এতক্ষণ বহুদূর এগিয়ে গেছে। সামনের রাস্তাটা খাড়া পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে। এমন দুর্গম পথে সঙ্গে জলও ছিল না। যা কিছু খাবার পানীয় ছিল বাবাজির বড় ঝোলাটার মধ্যে। কিছুটা ওপরে উঠে আর উঠতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে। সঙ্গে জলও ছিল না। ধারে কাছে কোনো ধাবা ছিল না। রাস্তাতে কাউকে পাব সে আশাও ছিল না। দূরে একটা ঝরনা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ঝরনার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রাণ থাকবে না তা নিশ্চিত। আমি আর পথ চলতে পারছিলাম না। ভাবলাম আর একটু এগিয়ে গিয়ে সামনের বড় গাছটির ছাউনিতে আশ্রয় নেব। চোখ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সামনের সবকিছু আবছা হতে থাকল। একে একে বাড়ির লোকজনের মুখ চোখের সামনে ভেসে এল। কয়েক মুহুর্তেই মনে পড়ল এযাবৎ সঞ্চিত কিছু ভাল স্মৃতি। হঠাৎ সামনে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, সবকিছু ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার দেখছি। পা এগোতে পারছে না, সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। মাথা কাজ করছে না। কোনোমতে অন্ধকারে হাতড়ে সামনে বড়গাছটার নীচের রেলিং ধরলাম। মুহূর্তেই গাঢ় অমানিশা নেমে এল। সবকিছু থেমে গেল চোখের সামনে…..
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)