মহাদেব মণ্ডল
লেখক পরিচিতি
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের চূড়াভান্ডার গ্রামে ১৯৯২ সালের ৪ মে মহাদেব মণ্ডল জন্মেছেন। বাবা মঙ্গল মণ্ডল, মা ভাগ্য মণ্ডল। গরুমারা অভয়ারণ্য এবং লাটাগুড়ি জঙ্গলের খুব কাছের গ্রামেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন। তাই প্রকৃতির প্রতি এক গভীর টান তাঁর ছোটবেলা থেকেই। তাঁর চর্চা এবং বিশেষ পছন্দের বিষয় মূলত কথাসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতি। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ থেকেই তিনি কিন্নর রায়ের উপন্যাসে পরিবেশ ভাবনা নিয়ে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে রচনা করেন ‘কিন্নর রায়ের কথাসাহিত্যে পরিবেশ প্রসঙ্গ’ নামক নিজস্ব গ্রন্থ। এর আগে যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘বাংলা ছোটগল্প : বিষয় ও নির্মাণ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘প্রাজক্তা’ সহ নানা পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বর্তমানে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণারত।
বিষয় পরিচিতি
( পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বর্তমানে রীতিমত নানা আন্দোলন যেমন হচ্ছে তেমনি পরিবেশ রক্ষার জন্য সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণাও করে চলেছেন। এ বিষয়ে পরিবেশবিদরা বর্তমানে ভীষণভাবেই চিন্তিত। এই মর্মেই নানারকম প্রবন্ধ নিবন্ধন প্রকাশিত হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। পিছিয়ে নেই সাহিত্যও। তাইতো বর্তমানে পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য রচিত হচ্ছে। কবি সাহিত্যিকরা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করছেন পরিবেশ সম্পর্কে তাদের ভাবনা-চিন্তা। পাঠককে সচেতন করতে সমসাময়িক পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যাকে সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন তাই তাঁরা। এই ধরনের সাহিত্য পরিবেশ সচেতন সাহিত্য, পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা পরিবেশবাদী সাহিত্য নামে পরিচিত। এই ধরনের সাহিত্যের সাহিত্যমূলক ছাড়াও একটি পরিবেশগত বা পরিবেশবাদী মূল্য আছে। সাহিত্য সমালোচনায়, সাহিত্য পাঠের তাই নতুন এক প্রস্থান তৈরি হয়েছে পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা বা ইকোক্রিটিসিজম। এই আলোচনায় মূলত বাংলা সাহিত্যের পরিবেশবাদী গল্প নিয়ে আলোচনা করা হবে, দেখার চেষ্টা করা হবে গল্পগুলি কীভাবে ইকো টেক্সট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের লেখকরা কীভাবে তাঁদের গল্পের মধ্যে পরিবেশ ভাবনা সম্পৃক্ত করে পরিবেশবাদী সাহিত্য রচনা করে চলেছেন এবং পাঠককে পরিবেশ ভাবনায় মগ্ন করে পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য সচেতন করে চলেছেন সেই দিক নির্দেশ করার চেষ্টা করা হবে মূলত এই আলোচনায়। )
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ছোটগল্পে পরিবেশচেতনা
স্বপ্নময় চক্রবর্তী বিশ শতকের সাতের দশকের কথাশিল্পী। তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্যে সমকালীন তাপ-ছাপ সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়েছে। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর প্রথম কর্মজীবন শুরু বিহারে দেশলাইয়ের সেলসম্যান হিসেবে। কিন্তু কাজে গরহাজিরার দরুন অর্থাৎ বিহার শরিফে ঠিকমত কাজ না করে নালন্দা দেখতে চলে যাওয়ায় তাঁর চাকরি চলে যায়। পরে তিনি পেইন্ট ভার্নিশ টেকনোলজি পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক টানাপোড়নে গল্পকার বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কানুনগোর চাকরি গ্রহণ করেন। কানুনগোর চাকরিতে থাকাকালীন তিনি গ্রামকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাই গ্রাম্য মানুষের জীবন, ভূমি, ভূমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সামন্ত ও ভূমিদাস, উঁচুজাত-নিচুজাত বিষয়গুলিকে তিনি দরদ দিয়ে অনুভব করতে পেরেছেন। ভূমি রাজস্ব দপ্তরের চাকরি ছেড়ে তিনি আবহাওয়া দপ্তরের চাকরি গ্রহণ করেন। বেশ কিছুদিন আবহাওয়া দপ্তরে চাকরি করার পর তিনি আকাশবাণীর ডিরেক্টর পদ গ্রহণ করেন। বিচিত্র কর্মজীবন লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীকে সুযোগ করে দিয়েছে জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের। এই অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবেই তিনি বহুমাত্রিক কাহিনি, ঘটনা ও বিষয়কে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাঁর লেখায়। তাই তাঁর সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছে সমাজ জীবনের নানা বাস্তব দিক। তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান বিষয় যা তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেয়েছে তা হল পরিবেশ দূষণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায়। তিনি তাঁর গল্পগুলিকে নির্মাণ করেছেন ইকো-টেক্সট হিসাবে। সাহিত্য সমালোচনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা সাহিত্যতত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে, তাই পরিবর্তন হয়েছে সাহিত্য সমালোচনার বিভিন্ন তত্ত্বের। বলা যায় অ্যারিষ্টটল ও আচার্য ভরত থেকে সাহিত্য বিচারের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তা আজও বহমান। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নানা তত্ত্বের উদয় যেমন ঘটেছে তেমনি বিলোপও ঘটেছে হয়তো অনেক। এই ধারার নবতম সংযোজন ‘ইকো-টেক্সট’, পরিবেশবাদী সাহিত্য’ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যতত্ত্ব ‘ইকো-ক্রিটিসিজম’ বা ‘পরিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্ব’ নামে পরিচিত। ইকোক্রিটিসিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন উইলিয়াম রাকার্ত তাঁর— Literature and Ecology An Experiment in Ecocriticism প্রবন্ধে ১৯৭৮ সালে। ইকোক্রিটিসিজম এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গল্টফেন্টি বলছেন–“Ecocriticism is the study of the relationship between literature and the physical environment।” ১ কিন্তু এই ইকোক্রিটিসিজম সাহিত্য সমালোচনা তৈরির অনেক আগেই পরিবেশের বিপন্নতার কথা নিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করে গেছেন ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯) উপন্যাস। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি জগতে পরিবেশ ভাবনার নানা দৃষ্টান্ত রেখেছেন ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’ নাটকে ‘বলাই’ গল্পে এবং সবচেয়ে বেশি তাঁর পরিবেশ ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে। পরিবেশ সম্পর্কিত নানা পদক্ষেপ বিভিন্ন দেশে নানা ভাবে গ্রহণ করা হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিবেশ-বিষয়ক প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের জুন (৫-১৬) মাসে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। এরপর ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে পরিবেশ সংক্রান্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন জুন ১৪, ১৯৯২ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনটি বসুন্ধরা সম্মেলন নামেও পরিচিত। এই বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে যখন সর্বস্তরে ভাবনা শুরু হয়েছে ঠিক সেই সময় কথা সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী পরিবেশ ভাবনা নিয়ে যুগান্তকারী কিছু গল্প লিখলেন। এই গল্পগুলিতে পরিবেশ দূষণ এবং তার ভয়াবহতার চিত্র লেখক তাঁর সুনিপুণ লেখনীগুনে সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। যার ফলে এই গল্পগুলো ইকো-টেক্সটের মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছে।
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘শনি’ (অনুষ্টুপ, ১৯৮৭) গল্পটি চেরনোবিলের পারমাণবিক চুল্লির দুর্ঘটনার কিছুদিন পরেই প্রকাশিত হয়। বিগত শতাব্দীর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা হল এই চেরনোবিল গ্যাস দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার ফলে আজও চেরনোবিল ভুতুড়ে নগরী হয়ে আছে। এই পারমানবিক দুর্ঘটনায় পরিবেশের ভয়ঙ্কর ক্ষতি সাধিত হয়। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমায় যা ক্ষতি হয়েছিল তার থেকেও… পাঁচ গুণ বেশি ক্ষতি হয় এই দুর্ঘটনায়। তেজস্ক্রিয় ভস্ম ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এই দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত পারমাণবিকভাবে সক্রিয় মেঘ ইউক্রেন রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে গ্রেট ব্রিটেনে এমনকি পূর্ব আমেরিকার উপর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘শনি’ গল্পে সেই কথাই ব্যক্ত হয়েছে তাজু মিয়া ও তার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার ঘটনার মধ্যেদিয়ে। গল্পে বলা হয়েছে হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ডের পশুচারণভূমিতেও ছড়িয়ে পড়ে এই তেজস্ক্রিয় ছাই। পশু দুধে দেখা দেয় তেজস্ক্রিয়তা। গল্পের প্রধান চরিত্র তাজুউদ্দিন, তার গর্ভবতী স্ত্রীকে সস্তার দুধ খাওয়ায়। তাই ভাজুউদ্দিন যখন জানতে পারে বাংলাদেশ সরকার গুঁড়োদুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাই হাজি সাহেবের সতর্কতা শুনে আর্তনাদ করে উঠেছে তাজুউদ্দিন, ‘এই দুধ খেলে গর্ভবতীর কী হয়?’ তার উত্তরে হাজি সাহেব বলেছেন— ‘সন্তান বিকলাঙ্গ হয়’। একথা শুনে জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে তাজুউদ্দিন, কারণ অনেক কষ্টের পর তাজুউদ্দিনের স্ত্রী গর্ভবর্তী হয়েছে। মুসলমানের পীর শুধু নয় তিনি সন্তান লাভের আশায় হিন্দু দেবতা শনি ঠাকুরের পুজাও করেছেন। প্রতি শনিবারে তাজুউদ্দিন চাঁদপাড়া বাজারে পাঠিয়ে দেয় শনি পূজার জন্য পাঁচ সিকে করে টাকা। এত কিছুর পর তিনি পিতা হতে চলেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজারের সস্তা গুঁড়ো দুধ খাইয়ে তার যদি বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মায় সেই ভয়ে এবং কষ্টে সে অস্থির হয়ে ওঠে। ছুটে যায় বিপ্রদাসবাবুর চেম্বারে। বিপ্রদাসবাবু তাকে বলেন-‘আমার মেয়ের তো বাচ্চা হবে, সে তো আমার কাছেই আছে। সেও তো কম গুঁড়ো দুধ খাইনি, কিসসু হবে না, গুজবে কান দিতি নাই।’ কিন্তু কিছুদিন পর বিপ্রদাসবাবুর মেয়ে সন্তান প্রসব করে মৃত এবং বিকলাঙ্গ। তাজুউদ্দিনের চিন্তা আরো বৃদ্ধি পায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে আসেন। তিনি ভাবেন— ‘বিশ্বচরাচরে এক্ষনি সর্বাত্মক হরতাল হয়ে যাওয়া উচিত।’ যদিও একটি খবরের কাগজে খবর বের হয়েছিল বাংলাদেশ গুঁড়ো দুধ পোল্যান্ড থেকে আমদানি করে। বেশ কিছুদিন আগে রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেই দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক ছাই-এর কিছু অংশ পোল্যান্ডের চারনক্ষেত্রের উপর পরে। সেই অঞ্চলের গরুর দুধে তেজস্ক্রিয়তার চিহ্ন পাওয়া যায়। সেই দুধ থেকে তৈরি হয় গুড়ো দুধ যা পোল্যান্ড বাংলাদেশে রপ্তানি করে দেয়। কিন্তু ভারত পোল্যান্ড থেকে দুধ আমদানি করে না, তাই ভারতে গুঁড়ো দুধ খেয়ে ক্ষতি হওয়ার কোন ভয় নেই। তবুও যখন বিপ্রদাসবাবুর মেয়ে মৃত সন্তান জন্ম দেয় তখন চাঁদপাড়া হাইস্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক ভরসা দেয় তাজুউদ্দিনকে, বলে হাজার কারণে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে। তিনি জানান–‘চেরনোবিল কি একটা? এরকম কত আছে ভারতবর্ষেও।’ লেখক এখানে আমাদের দেশের পারমাণবিক দূষণ, কলকারখানার দূষণ, যানবাহনের দূষণ সমস্ত কিছুর প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। এছাড়াও লেখক বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যই যে পরিবেশ আজ এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ‘শনি’ গল্পটিতে। গদাধরের কথায়-‘ছাইনছ মারাচ্ছে না সব ছাইনছ। সারদেচ্ছো মোটা মোটা মুলো খাচ্চো, রেডিও শোনচো, ঘরে ঘরে রেডিও। টিভিও কতগুলো এসিছে গ্রামে, বাতাসে ইলেকটিরিক ঘুরিয়েছে না।’ একথা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে আমাদের সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে যানবাহন, কলকারখানা যেমন বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। তাই লেখক এই দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে পাঠককে সচেতন করেছেন। ‘শনি’ গল্পের শেষে আমরা দেখি লেখক হতাশার মধ্যেও প্রবল সংশয় বুকে নিয়েও আশার আলো দেখাতে চেয়েছেন। তাজুউদ্দিনকে ভয়ের শনি তাড়া করে। চেরনোবিল কতদূরে তাজুউদ্দিন জানে না। আতঙ্কের ‘ইবলিশ’ ওকে তাড়া করে বাতাস। বাতাসে রেডিও বিষ। মেঘের ওপারে আল্লাতালা? কেমন জানি না। পরম আকুতি ভরে আত্মজাকে বিশ্বাস দিতে দিতে ডাকে—”সমস্ত চেন্নোবিল, সমস্ত শনি, সাতঙা-দেওদের কেরদানিকে নাথি মারতি মারতি, নাথি মারতি আয়রে আমার আহ্লাদ। তুই কেমন জানি না।’ লেখক এই গল্পে পরিবেশের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও সন্তান জন্মাবার আশাই প্রকাশ করেছেন। সমস্ত দূষণকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে এক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের বসবাসযোগ্য পরিবেশের স্বপ্ন দেখেছেন। ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা (১৯৮৪) চেরনোবিল গ্যাস দুর্ঘটনার (১৯৮৬) কিছুদিন পরেই লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর ‘ক্যারাক্কাস’ (শারদীয় বর্তমান: ১৯৯২) গল্পটি লেখেন। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের পৃথিবীতে বৃদ্ধি ঘটছে কল-কারখানার আর কলকারখানার বৃদ্ধির ফলে দূষণের মাত্রাও বেড়েছে সবদিক থেকে। বায়ু দূষণ, জল দূষণ এর পাশাপাশি কারখানাগুলোতে গ্যাস দুর্ঘটনার চিত্রও এখন দেখা যায় অহরহই। সেই বিষয় নিয়ে লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর ‘ক্যারাক্কাস’ গল্পটির কাহিনি নির্মাণ করেছেন। এই গল্পের কাহিনির মূল উপজীব্য বিষয় হল কল কারখানার বর্জ্য পদার্থ ও রাসায়নিক পদার্থ জলকে কীভাবে বিষাক্ত করে তুলছে সেই চিত্র। গল্পে দেখি—“নালায় কালো জল ছরছর বইছে। আহা। জল তো নয়, অ্যাসিড।। শুধু কি অ্যাসিড? অ্যালডিহাইড-কিটোন- আর্সেনিক-সোডা।’ এই জল থেকে বের হয় নানা রঙের ধোঁয়া। ঝাঁঝালো তার গন্ধ, কাশি আসে। কারখানার এই দূষণ শেষ করে দিতে পারে এক-একটি প্রজাতিকে। এই গল্পে একটি পুকুরে কারখানার বিষাক্ত জল জমা হয়। বিষাক্ত সেই জল শোষণ করে নেয় পাতার সবুজত্ব। পুকুরের আশেপাশের গাছগুলি মারা যায়। সেই বিষপুকুরে একদিন কারখানার এক কর্মচারী মাছ দেখতে পায়। সেই মাছ দেখার খবরটি কারখানার মালিককে দেয়। তিনি ছিপ দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করেন। ছিপে চিংড়ি মাছ গেঁথে দিলে মাছটি কালো হয়ে কুকড়ে যায়। অবশেষে মাছ ধরতে সক্ষম হলে দেখা যায়-‘এ এক নতুন প্রজাতির মাছ হাতখানিক লম্বা। ড্যাবা ভ্যাবা চোখ। সারা গায়ে আঁশ নেই একটুও। খরখরে গা। গিরগিটির মতন।’ এই নতুন মাছ আবিষ্কার করে লাফিয়ে উঠেন কারখানার স্যার। তিনিই এই নতুন স্পেসিস আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিতে চান। তাই কর্মীটিকে ধাক্কা দিয়ে বিষপুকুরের জলে ফেলে দেন। এই পুকুরের জলের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল এই জলে পড়ে কর্মীটির শরীরের জামা কাপড় পুড়ে যায়। গায়ের চামড়া গিরগিটির চামড়ার মত খরখরে হয়ে যায়। তাকে দেখে কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে নিজের স্ত্রী পর্যন্ত ভয় পায়। ঐ পুকুরের মাছের চামড়া দিয়ে অ্যাসিড প্রুফ, রেডিও অ্যাকটিভিটি প্রুফ গ্লাভস তৈরি হয়। ফলে চামড়ার জন্য ক্যারাক্কাসের চাহিদা বাড়তে থাকে। হঠাৎ একটি দুর্ঘটনায় কারখানায় সমস্ত শ্রমিক আহত হলেও নায়েকের কিছু হয়না। রহস্যটা আমাদের কাছে স্পষ্ট। কারখানায় নোটিশ জারি হয় সবাইকে বিষ পুকুরে ডুব দিয়ে আসতে হবে। মালিকের অভিপ্রায় দুর্ঘটনা প্রুফশ্রমিক শ্রেণি তৈরি করা। এদিকে নায়েকের স্ত্রী একদিন সেই পুকুরে স্নান করে পুনরায় স্বামীর দোসরে পরিণত হয়। তাদের সন্তান হয়-‘বউ কাতরাচ্ছে। আমি বাপ হচ্ছি।… একটু পরেই কান্না শুনলাম। শিশুর কান্না। আমার বুকের মধ্যে কারখানা ছুটির ভো বাজলো। বললাম, ছেলে না মেয়ে? ধাই বললে, জেবনে এই পরথম ভুতের জন্ম করালুম। পেত্নীর গর্ভতে ভূতের জন্ম। ছেলেটার চামড়া ঝোলা ঝোলা। সারা চামড়ায় গুড়িগুড়ি কাঁটা। মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছে ড্যাবা ভ্যাবা চোখ।’ দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসে এই অদ্ভুত শিশু দেখতে। একদিন আসে কারখানার মালিক ছেলেটিকে দেখতে –‘স্যার মন দিয়ে দেখছেন। স্যার চামড়া টিপে টিপে দেখছেন, শিশুর চামড়া। স্যার স্যাম্পল দেখছেন, স্যাম্পল। স্যার হাসলেন। বললেন বা। তারপর স্থির হলেন। চোখ স্থির, দেহ স্থির। মন্ত্র পড়ার মতন বলতে থাকলেন— ইউরেকা… ইউরেকা নতুন প্রজাতি। নিউ স্পেসিস। ক্যারাক্কাস নিউ ক্যারাক্কাস।’
২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে জলপাইগুড়ির করলা নদীতে প্রথম মাছের অকস্মাৎ মৃত্যু শুরু হয়, নদীর জলে বিষক্রিয়ার ফলে প্রচুর মাছ মারা গিয়েছিল। ২০১৫ সালে আবার করলা নদীতে মাছের মৃত্যু হয় অতিরিক্ত কীটনাশক বা রাসায়নিক বিষক্রিয়ার ফলে। ২০১৯ সালে করলা নদীতে বিষক্রিয়ার ফলে শুধু চিংড়ি মাছের মৃত্যু হয়। প্রাকৃতিক অবস্থায় ব্যবহারযোগ্য জল যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে বিশ্বজুড়ে পানীয় জলের সংকট তীব্র। এই দূষিত জল পান করার ভয়ংকর পরিণতি কী হতে পারে তার নিদর্শন ফুটে উঠেছে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘জল তিমির’ উপন্যাসে। মানুষ বাধ্য হয়ে দুষিত জল পান করছে। আর এই দূষিত জলের প্রধান উৎস কলকারখানার বর্জ্য। তার সঙ্গে রয়েছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত নানা রাসায়নিক সার। ফলস্বরূপ জল দূষণে বিচিত্র শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত জল উত্তোলনের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে জলে আর্সেনিক সমস্যা। সেই চিত্র ফুটে উঠেছে, ‘জলতিমির’ উপন্যাসে। গবেষণায় জানা গেছে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ভূস্তর যা আর্সেনিক পুষ্ট এবং কাদা পলি দ্বারা গঠিত ভূতল থেকে ৭০ এবং ২০০ ফুট গভীরের মধ্যে অবস্থান করছে। এই স্তরটি সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ছিল। কিন্তু আগে তো আর্সেনিক সমস্যা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে মানুষের খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই কৃষিক্ষেত্রে ফসল বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত সেচের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ বিপুল পরিমাণ জলের ব্যবহার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাচ্ছে, ফলে গরমকালে আর্সেনিক সমস্যা বেশি দেখা যায়। এই আর্সেনিক সমস্যা নিয়েই লেখা স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ফুল ছোঁয়ানো (শারদীয় বর্তমান ২০০১) গল্পটি। গল্পের প্রধান চরিত্র হীরক ট্রেনে তার সিরিয়ালের স্কিপ লেখা খাতা ভুল করে ফেলে রেখে চলে যায়। সেই খাতা আসগর আলি যত্ন করে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে এবং নিজের টাকা খরচ করে আসগর বাবু টেলিফোন করে হীরককে সেই খাতা নিয়ে আসতে বলে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে হীরক পৌঁছে যায় গাইঘাটার বাঁশপোতা গ্রামে। সেখানে হীরক দেখে আসগর আলির নখের রং কালো, হাতের চামড়া গিরগিটির গায়ের মতো খরখরে। চামড়া মোটা ফাটাফাটা, আঙুলগুলো মোটা ফাটা, শুকনো রক্ত, ভ্রুতে চুল প্রায় নেই। হীরক প্রথমে ভেবেছিল আসগর আলি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার ভুল ভাঙে। যখন হীরককে জল খেতে বলে হীরক যেন আঁতকে ওঠে, তখন আসগর আলি জানায়-‘আছেনিকের ভয়? এক গ্লাস খালি কিছু হবেনে। আমরা তো রোজ খাই।’ শুধু আসগর আলি নয়,এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ আর্সেনিক আক্রান্ত। সেই আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে একটি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে গিয়েই হীরকের খাতাগুলি পেয়েছেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানের খবর প্রকাশিত কাগজটা আসগর হীরককে দেখতে দেয়। তাতে জানা যায়-পশ্চিমবাংলার ৮টি জেলায় ৩২ লক্ষ মানুষ বিপদমাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকযুক্ত জল খেতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের গ্রামবাংলায় চারপাশে জলের অভাব নেই ঠিকই কিন্তু পানীয়জলের বড়ই অভাব। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও গভীর নলকূপ গ্রামগুলিতে নেই বললেই চলে। সরকারের তরফ থেকে যে রানিং ওয়াটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে তা আজ পর্যন্ত অধিকাংশ গ্রামগুলিতে পৌঁছায়নি। আর যেসব গ্রামে জলের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জল পৌঁছায় না। এই ঘটনার করুন চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘জলতিমির’ উপন্যাসটিতে। লেখক জানিয়েছেন সরকার যদিও ৪০ পাইপের কল অর্থাৎ ৮০০ ফুট গভীর কল নির্মাণের টাকা দেয় কিন্তু সেই কল নির্মাণ করা হয়নি। রাজনৈতিক টানাপোড়নে তা অনেক কম গভীর যুক্ত কল নির্মাণ হয়। তাই এই গল্পে দেখি আসগর আলি নিজেই আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে কবিতা রচনা করেন-
‘পৃথিবীর বক্ষ হতে অমৃত তুলিল
আর পৃথিবীর ভিতরেতে বিষ জন্মে গেল
সে বিষ কে সরাবে, কে ঘুচাবে ভাই
কালীয় সৰ্প আছে শ্ৰীকৃষ্ণ তো নাই।’
সাধনবাবু ‘জলতিমির’ উপন্যাসে যেমন মিথের ব্যবহার করেছেন তেমনি লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীও এখানে কালীয়র প্রসঙ্গ এনে মিথের ব্যবহার করেছেন। লেখক এখানে বলতে চেয়েছেন কালীয় যেমন কালীদহের জল বিষ দিয়ে বিষাক্ত করে তুলেছিল। কিন্তু সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ ছিল তাই শ্রীকৃষ্ণ কালীয়কে হত্যা করে কালীদহের জল মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছিল। কিন্তু বর্তমানে শ্রীকৃষ্ণ নেই। কী করে এই আর্সেনিক দূষণ থেকে মুক্তি সম্ভব সেই বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। লেখক শ্রীকৃষ্ণের কালীয়র ফনা ভেঙে মটকে দেওয়া প্রসঙ্গে সাধনবাবু ‘জলতিমির’ উপন্যাসে জানিয়েছেন-“এগুলো যেন কালিয়র ভগ্ন ফনা নয়, জলের ব্যাকটেরিয়া, আর্সেনিক সিসা বা লোহার গ্রেডিয়েন্টের এক-একটি শক্ত অস্তিত্ব। চুন, ফিটকিরি, ক্লোরিন, থেকে শুরু করে এক একটি পরিশোধক ছড়ানো হচ্ছে, জল হয়ে উঠছে টলটলে।”২ তাইতো গল্পে দেখি গ্রাম বাংলার মানুষদের বিশুদ্ধ পানীয় জলের আর্তি।
এভাবেই জল দূষণ থেকে মুক্তির কথা ভেবে লেখক ভাবান্বিত হয়েছেন। পৃথিবীর বিরামহীনতার কারণে আরও দূষণের চিন্তায় লেখক গভীর সংকটের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন-‘বসুন্ধরার তো বিশ্রাম নেই; কতবার ফসল দিতি হয়। আউশ, আমন, বোরো। হাইবিরিড ধান পানি টানে বেশি আর ওই পানিতে আর্সেনিক। ধানের ভিতরেও কি আর্সেনিক মেশে না।’ আজ খাবারে ভিটামিনের অভাব, খাবার থেকে নানা রোগের সৃষ্টি, তার মূল কারণ এই দুষিত জল ও রাসায়নিক সারের প্রচুর পরিমাণে কৃষিকাজে ব্যবহার। লেখক সেদিকটি আমাদের সামনে দেখিয়েছেন আসগর আলির কথার মধ্য দিয়ে। ‘ফুলছোঁয়ানো’ গল্পের শেষে আমরা দেখতে পাই কীটনাশক ব্যবহারের ফলে অবলুপ্তি ঘটেছে প্রজাপতি, ফড়িং সহ নানা কীটপতঙ্গের। তাই ফুলের পরাগ মিলন বর্তমানে প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে না। এদিকে আর্সেনিকের প্রকোপে জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ রিকেট আক্রান্ত শিশু। তারপর হীরক জানতে পারে এই আক্রান্ত শিশুরা তাদের কচি কচি আঙুলে ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরাগ মিলন ঘটায়। ফসল ফলে- পটল, করলা, ঝিঙ্গে। কচি কচি আঙ্গুল কোনোদিন আর পুষ্ট হবে না। আরো বড় সামাজিক সংকট হল এই গ্রামে কেউ নতুন করে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে না। পরিবেশ কীভাবে আমাদের সামগ্রিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তা কী ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে লেখক ‘ফুল ছোঁয়ানো’ গল্পটিতে তাই দেখাতে চেয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে প্রতি লিটার জলে ০.০১ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে তাকে আর্সেনিক দূষিত জল বলে ধরা হয়। আর্সেনিক পৃথিবীর ভূত্বকের গঠনগত উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম একটি উপাদান। প্রকৃতিতে আর্সেনিক মুক্ত মৌল হিসেবে পাওয়া যায় না। আর্সেনিক এক প্রকার ধাতব পদার্থ। এটি জলে দ্রবীভূত অবস্থায় থেকে জলের ধাতব দূষণ ঘটায়। সাধারণত প্রতি কেজি পাললিক শিলায় ৫-১০ গ্রাম আর্সেনিক থাকে। এছাড়া যেসব শিলায় লোহার পরিমাণ বেশি সেই সব শিলায় আর্সেনিকের পরিমাণও বেশি। এই শিলা মধ্যস্থ আর্সেনিক ভূগর্ভস্থ অ্যাকুইফারের সাথে যুক্ত হয়ে ভৌমজলকে দূষিত করে। আর এই ভৌমজল আমাদের পৃথিবীর এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ এই ভৌমজলকে আমরা পানীয় জলের একমাত্র স্বচ্ছ উৎস হিসেবে ব্যবহার করে থাকি।জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও তার সাথে সাথে আধুনিক প্রাম্পীয় সিস্টেমের আবিষ্কারের ফলে মানুষ অতি সহজেই অবিবেচনা প্রসূত প্রচুর পরিমাণে ভৌমজল উত্তোলন করে ফেলছে। ফলে ভূগর্ভস্থ জলে অক্সিজেন মিশে গিয়ে আর্সেনিকের সংস্পর্শে এসে জলে আর্সেনিক দূষণ ঘটাচ্ছে। সেই দূষিত জল পানীয় হিসেবে সেচের কাজে ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমেও মানুষের শরীরে আর্সেনিক প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। তাইতো কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা নির্ভর গল্প রচনা করতে গিয়ে আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে রচনা করলেন ‘আর্সেনিক ভূমি’ নামে অমূল্য এক গল্প। লেখক নিজে গল্পটি লিখে আরো ভালো হতে পারতো বলে আক্ষেপ প্রকাশ করলেও গল্পটি স্প্যানিস ও জার্মানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও আর্সেনিক বিষয়ক এক ইন্টারন্যাশনাল ওয়েবসাইটে গল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই ইছামতি নদীর দুরবস্থার চিত্র। বর্তমান সময়ে নদী সমস্যা ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। অতীতে যেসব নদীগুলিকে নির্ভর করে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেই নদীগুলি আজ হারিয়ে গেছে। অনেক নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে আবার অনেক নদী পুরোপুরি মরে গেছে। চিহ্নমাত্র নেই। আর যেসব নদী এখনো আছে সেগুলি দূষণে পরিপূর্ণ, সেইসব নদীর জলে মাছ বসবাস করতে পারে না, মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। গল্পকার বলেছেন–‘ইছামতি ওর ইচ্ছামতো সরে গেছে দূরে, পুরনো খাতে জল রয়ে গেছে কিছু, নোনা জল, খাওয়া যায় না, কিন্তু পাখি আসে।’ এভাবেই নদী তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে এবং পুরোনো খাতের জল আস্তে আস্তে শুকিয়ে গিয়ে নদীর বুকে গড়ে উঠেছে বাড়ি-ঘর, বাজার। তবে গল্পের ভরকেন্দ্রে জল-জলদূষণ এবং তজ্জনিত সতর্কতা গুরুত্ব পেয়েছে। গল্পকথক আমেরিকা প্রবাসী রামপ্রসাদের কলকাতার সল্টলেক নিবাসী স্ত্রী যখন আমেরিকা থেকে নিজের শহরে আসে তখন সেখান থেকে কয়েক লিটার জল নিয়ে আসে। কলকাতার মিনারেল ওয়াটারের প্রতি ভরসা করতে পারে না পৃথা, তাই ভয় পায় সে। রামপ্রসাদের উচ্চারণে উঠে আসে–‘ইস কী যে হলো আমাদের জলভীতি।’
রামপ্রসাদের বাবা তাকে দেশের জন্য কিছু করতে বলেছেন। দেশ বলতে এখানে রামপ্রসাদের জন্মস্থান বা বাকালির কথা বলা হয়েছে। তাই বাবার মৃত্যুর পর রামু তার দেশের বাড়িতে যান। যাবার পথে রাস্তায় বাদুড়িয়ার মোড়ে তার চোখে পড়ে–‘একটা নীল বোর্ডে লাল হরফে লেখা দেখলাম সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া নলকূপের জলে বিপদসীমার বেশি আর্সেনিক আছে। ওই জল পান করিবেন না।’ এদিকের জলে আর্সেনিক আছে বুঝতে পেরে সঙ্গে নিয়ে আসা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা আঁকড়ে ধরে রামপ্রসাদ। এই সাইনবোর্ড দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার বিশ্ব পরিবেশে আর্সেনিক সমস্যার চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ইন্টারনেটে রামু দেখেছে শুধু ভারত নয়, ব্রাজিল, মেক্সিকো, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও আর্সেনিক সমস্যা এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। আর এই সুযোগে বেশ কিছু দেশ আর্সেনিক মুক্ত জল বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। আমেরিকান কোম্পানিগুলি এই কাজ করে যাচ্ছে। আর্সেনিক ফ্রি জল বিক্রি করে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। তাই কোম্পানিগুলি মুখিয়ে থাকে কোথায় আর্সেনিক দেখা দিল তার অপেক্ষায়। তিনি নিজেও এরকম একটা কোম্পানির কনসালট্যান্ট ছিলেন কিছুদিন। রামপ্রসাদ তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে নিজের স্কুলে যায় যেখানে তিনি ছোটবেলায় পড়েছে। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় কলের মুখে বস্তা বাঁধা। তা দেখে সে বুঝতে পারে আর্সেনিকের জন্যই টিউবয়েলে বস্তা জড়ানো। হেডমাস্টারের সাথে কথা বলে জানতে পারে ছাত্ররা এই জলে পান করে, কারণ বাড়িতেও একই সমস্যা। তাই এই জল খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। জলে আর্সেনিক দূষণের জন্য বর্তমানে অত্যাধিক হারে জল সেচকেই দায়ী করেছেন কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফসল উৎপাদনের প্রয়োজন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত জল, যার ফলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচ থেকে জল তুলে নেওয়া হচ্ছে। যার ফলে ভূগর্ভে ফাঁকা স্থানে অক্সিজেন প্রবেশ করে সেই অক্সিজেন আর্সেনিকের সঙ্গে বিষক্রিয়া করে জলে আর্সেনিক দূষণ ঘটাচ্ছে। গল্পকার তাই বলেছেন–‘এমনিতে মাটির তলায় আর্সেনিকের যে পিরাইটস থাকে, সেটা জলের সঙ্গে থাকতে পারে না। অক্সিজেন মিশলে আস্তে আস্তে জলে মিশতে পারে। মাটির ভিতর থেকে জল তুলে নেওয়া হচ্ছে বলে মাটি একটু করে ফোঁপড়া হচ্ছে, ফলে অক্সিজেন ঢুকছে।’ এই অক্সিজেন আর্সেনিকের সঙ্গে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে জলকে করে তুলছে বিষাক্ত। এই অতিরিক্ত জলসেচের করুন চিত্র লেখক তাঁর অপর গল্প ‘ফুল ছোঁয়ানো’-তেও উল্লেখ করেছেন। আসগর আলি বলে–‘মাটির তলার পানি বের করি, মা বসুন্ধরার তো বিশ্রাম নাই, কতবার ফসল দিতি হয়। আউশ, আমন, বোরো…। হাইব্রিড ধান পানি টানে বেশি, আর ওই পানিতে আর্সেনিক।’
গল্পে দেখি পঞ্চায়েত নির্বাচিত মেম্বার নিজেও আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। তার ভুরুর চুল পড়ে গেছে, নখের রং কালচে হয়ে গেছে। গ্রামগুলো আজও নোংরা রাজনীতিতে আক্রান্ত। সরকারি প্রতিনিধিদের কাছে ভোটের মূল্য ছাড়া আর কোন মূল্যই নেই গ্রাম বাংলার মানুষদের। গল্পকার তাই বলেছেন–‘জানেন আমাদের বে-থা হয় না। কে আমাদের গাঁয়ে মেয়ে দেবে মরার জন্য? আমাদের কিচ্ছু নেই? ঘর সংসার, জেবন, খালি ভোট আছে। একটা করে ভোট আছে।’ গ্রামের মানুষের শুধু ভোটই থাকে,আর কিছুই থাকে না। তাইতো আটত্রিশ বছরের ছেলে আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মরে গেলেও সরকারের কোন যায় আসে না। তাতে কোন প্রভাব পড়ে না সরকারি আমলাদের জীবনে। ভোটের আগে বারবার বিশুদ্ধ জলের প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোট শেষে অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটে না। যে গ্রামে রামপ্রসাদ বড় হয়ে উঠেছে সেই গ্রামের সবাই চোরে পরিণত হয়েছে। এমনকি তার নিজের কাকা ভাইরাও। কারণ তাদের জীবনে কিছুই নেই, বিয়ে পর্যন্ত হয় না। তাই মরতেই যখন হবে তখন আর জীবনের ভয় নেই। গ্রামের মানুষের আর্সেনিকে কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখি রামপ্রসাদের ভাই খাদুর বাচ্চা হয়েছে বিকলাঙ্গ, আর্সেনিকের প্রভাবে জিনের পরিবর্তন ঘটেছে, প্রমাণ দেখা যায় তার প্লাস্টিকের বাচ্চা জন্মানোর মধ্যেদিয়ে। আর্সেনিক আক্রান্ত বাচ্চারা কখনো বড় হয় না, একই অবস্থায় থাকে। গল্পে তা লেখক বর্ণনা করেছেন–‘আমার বাচ্চা তো বড় হবে না কখনও …বউটা আরও কিছুদিন বাচ্চা নিয়ে থাকতে পারবে।’ এভাবেই আর্সেনিক গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে নিচ্ছে। মানুষকে যেমন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি নব্য শিশু জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ হয়েই।
শুধু ভূগর্ভস্থ জল নয়, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবাও এখন আর্সেনিকে জর্জরিত। নলকূপের জলে আর্সেনিক পাওয়া যায় যেসব জায়গায়, সেখানে নদীর বহমান জলই ভরসা ছিল মানুষের। কিন্তু নদীর জলেও এখন আর্সেনিকের সন্ধান মিলছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমীক্ষা উদ্ধৃত করে মন্ত্রকের রিপোর্ট জানাচ্ছে- দেশের অন্তত ১২০ টি নদীর জলে আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত ধাতু রয়েছে যা সত্যি আশঙ্কার। স্বাধীনতার এতদিন পরেও দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। প্রতিবছর বিশ্বে ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ জল সংক্রান্ত অসুখে মারা যায়। জলের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে, বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ ঠিক তেমনি দ্রুতগতিতে কমছে। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরেজেলডিন আশঙ্কা করেছেন-পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ হবে জলের জন্য। আমরা চাইবো তাঁর এই আশঙ্কা যাতে সত্যি না হয়। তাই সকল স্তরের মানুষকে জল দূষণ রোধ করতে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি জল অপচয় রোধ করতে হবে। জল দূষণ রোধ করা সম্ভব হলে জল বাহিত রোগগুলি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অনিয়ন্ত্রিত ভূগর্ভস্থ জল ফসলের কাজে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। তাহলে আর্সেনিকের মতো বিষক্রিয়া থেকে মানব সমাজ মুক্তি লাভ করতে পারবে এই আশা করা যায়।
পরিবেশ দূষণের মারাত্মক চেহারা উঠে আসছে বিভিন্ন সমীক্ষায়। ভূপালের গ্যাস দুর্ঘটনার প্রভাব আজও মানুষ ভোগ করছে। চেরনোবিলে আজও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। করলা নদীতে রাসায়নিক বিষক্রিয়ার প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মাছ। সাঁতরাগাছি ঝিলে দূষণের জন্য শীতে পাখিরা আসে না। এই বিচিত্র ভাবনার বহুমাত্রিক রূপপ্রকাশিত হয়েছে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্পের আকাশে। তাঁর লেখা এই পরিবেশ ভাবনা সমৃদ্ধ গল্পগুলি পাঠকদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতে খণ্ডকাল এবং অখণ্ডকাল ধরে সাহায্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস ।
তথ্যসূত্র:
১. Cheryl Glotfelty and From Harold (eds.), The Ecocriticism Reader: Landmarks in Literary Ecology, University of Georgia, 1996, P. XVI ২.স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শ্রেষ্ঠগল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ-কলকাতা পুস্তকমেলা-২০০৩, পুনঃমুদ্রণ জুন- ২০১৭, কলকাতা- ৭৩,পৃ-৭৯
২. সাধন চট্টোপাধ্যায়, জল তিমির ও মাটির অ্যান্টেনা, গাঙচিল, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর- ২০১৬,
কলকাতা, পৃ.৪০
asadharan sb galper adhar.🙏🙏🙏