শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’ উপন্যাস।)
হৌরবাড়ির গুণকীর্তনে নিজের ঘর বাঁধি
হরে মুরারে মধুকৈটবারে, গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ সুরে – এই লাইনগুলো উনি আওড়াতেন বার বার। কী সুখ যে লাইগত শব্দগুন হুইনতে, ভেতরটা কেমন করি উঠত। চাই থাকতাম কন ঘরে ফেরে। বুইঝতাম হক্বল কিছু। কোর্ট-কাচারির ঝক্বি সামলাই, শহরের বাসা গোছাই-গাছাই হাঁটি হাঁটি যন গাড়ি ধইরবার লাই ইস্টিশনে আইত, রেলগাড়ি চোয়ের সামনে দিই বারৈ যাইত। তীর্থের কাকের মতো বই থাইকত, কন হরের ট্রেন আইব। ডাউন ট্রেনটা যাইলে এনা আপ ট্রেনটা আইব। ডিগির ডিগির করি আয় ট্রেন। কত নিচে প্ল্যাটফর্ম। তেনারে হক্বলে চেনে। মর্জিমাফিক চলে। ছোটোমোটো ষ্টেশন। কেউ যেন গেরাহ্যি করে না। স্টেশনমাস্টার কইতও হারে না, কোন ট্রেন থাইমব, আর কোন ট্রেন থাইমত ন। চাই থায়। বাবু দৌড়ান, জোরে দৌড়ান। উনি কাঁধে ব্যাগ লই ছুটি যায়। জেলা কোর্ট পেছনে হড়ি তাই। তেনার কথা যত কই শেষ হইত ন। গিজগিজ করে লোকজন। গেরামের বাড়িতে হিরনের লাই হপ্তাহের হেস হইলেই মন করে আনচান। দুনিয়েটা কেমনে যেন ক্ষণে ক্ষণে হালটি যায়। তাকাই দেহেন মাইনষের তেমন আনাগোনা নাই। যে যার ঘরে চলি গেছে। সওয়াল জবাব নাই, জেল জরিমানাও নাই, পুলিশের হাতকড়াও নাই, উকিল মোক্তারদের মুসাবিদা নাই, জজ সাহেবদের হুকুম জারি নাই, রায় নাই। অন্যদিন কত আশা ভরসা লই চর জমিনের গেরস্তরা কত দূর তুন আই মামলা লড়ে। জোর জবরদস্তি করি ওদের জমি কাড়ি লই পথে বসাইছে শত্রুহক্ষের লোক। হাতে পয়সাকড়ি নাই, ধারদেনা করি আইছে বিচারের আশায়। পায়ে চটি নাই, গায়ে ফতুয়া, ধোয়াফালা হয়নি, গায়ের তুন ঘামের গন্ধ বের হয়। হাত জোড় করি আই কয়, বাবু বাঁচান। চোয়ের কোনায় জল গড়ায়। বাঁচি থাকার কষ্ট ওদের কথাবার্তায় বার হই আসে। আঁর স্বামীর চেহারাটা উপর উপর দেইখলে মনে হইব ফুটিফাটা জমিনের মতো হুকনা, উল্টা কথা কইলে দুটো ধমক খাই যাইতে হারেন, বুঝাইয়া যদি কওন যায়, আমনের কথাগুন মনে হইব হুইনতেছে না, আসলে আমনে যদি জিগাইন, বেগগাইন আমনেরে গড়গড় করি কই দিব। মুসাবিদার ফিটাও লইত ন। শহর আর গেরামের লোকগুলোর মধ্যে আকাশ পাতাল হারাক। ওরা ওই তেলচুলোহীন চাষিভুষা নোকগুনোর দিকে আড়চোখে চায়। ওরাও অত ভাবাভাবির ধার ধারে না। নিজের মতো ওই ইসকুলবাড়ি, ডাক্তারের ঘর, খাজনা অফিস, কোতোয়ালির দারোগার দিকে ডরে ডরে হাঁইটতে হাঁইটতে মুহুরির টুলের কাছে যাই কাকুতি মিনতি করি কয়, বাবু কিছু করেন। ওরা কতরমের ফন্দিফিকির করে, টুপি হরানোর মাষ্টার, হক্বলে নয়। মক্বেলরা আইতেই থায়। জেলা ত কম বড়া নয়। দেওয়ানী ফৌজদারি মামলা নিই কাইজ্জা তো লাগিই আছে। হারজিতের খেলা। মামলায় হারি তাই কারও চোয়ের জল হড়ে, কেউ রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়ে, কারও জেতার আনন্দে মাটিতে হা হড়ে না। গাছের নিচে জিরাইবার লাই বইলে কারও মাথায় কাউয়া হাগি দিলে ভাবে আজ একটা সব্বনাশ হইবই হইব। এ হকল কাহিনী আঁর স্বামীর কাছ তুন হোনা।
আঁর স্বামীর জীবনটা আঁর পাঁচজন মাইনষের তুন ভেন্ন। হকাল সন্ধে নিজেরে নিয়মের সুতায় যেন বাঁধি রায়, একটুও নড়চড় হয় না। নিয়ম ভাইঙলে কয়ালে সে ব্যাটার দুঃখ আছে। ভাগ্যে জুটবই জুটব দু’চারটা কানমলা, বেতের বাড়ি আর উঠবস। তেনার তর্জন গর্জনে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। এলাহার হোলাপাইনরা ডরে হলায়। একটু যদি কামকাজের সময়ের নড়চড় হইছে, তাইলে আর রক্ষা নাই। এমন মাইনষের সঙ্গে ঘর করতি গেলি তটস্থ থাকতে হয়, কি জানি কন ভুল ধরি বসে। হাখির ডায়ে ঘুম যন ভাঙ্গি যায়, চিকচিক করি রোজ আই ঘরের দুয়ারে হড়ে, গাছেরা জাগি যাইবার আগেই উনি জাগি যায়। ঝড় বাদলের তোয়াক্বা না করি হাঁটা হুরু করে, থামাইতে কইলেও থামায় না, চইলতেই থায়। নিজের হাতে ছই, আলু, বেইগুন, মরিচের গাছ লাগায়। এমন মানুষ জন্মে দেই নাই। সময়ের আগে উনি ছোটেন না। সময় ওনার হঙ্গে হঙ্গে চলে। সময়কে ডাক দিই কয়, নিজেরে নিই এত ভাঙচুর কি তোমারে মানায়! কইতে চায় মাইনষের মতো মানুষ হইত হইব। জগতটাকে একবারের লাই খেয়াল করি চা, কনডাই যাই থাইমবি, আর কনডাইরতুন হুরু করবি। মাইনষে যন মাইনষেরে গলা টিপি ধরি কথা বন্ধ করি দিতি চায়, আঁর স্বামী তন গর্জি উঠি কয় সত্যি কথা কও, গলা ফাটাইয়া কন, হোজা হথে চল, বাঁকা কথা কইও না। দেশটার কথা ভাইবতে ভাইবতে দিন যায়, কী হইব এ দেশের! রসাতলে যাইব। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে ভাইকে গরাদে ঢুকাইছে, ছোড়াই আইনল। কিন্তু মনে মনে প্রশ্ন জাইগল মাইনষের উপর এই অত্যাচার কবে থাইমব ? কোন দিকে যাচ্ছে? গাড়িতে উঠি বসে। কয়লার ইঞ্জিনের গাড়ির ধোঁয়া গলগল করি ছাড়ে। গন্ধটা নায়ের কাছে আই ঘুরঘুর করে। ভোঁ ভোঁ করি গাড়ি এক ইষ্টিশন তুন অন্য ইষ্টেশনে দৌড়য়। চাই থায়, গাছের আগাগুন নড়ে, সিটের হাশে শক্ত করি থলিটা ধরি রায়। ছইয়ে ভর্তি, আলু, কাঁচামরিচ তো কম নাই। কত কষ্ট করি লই আইয়ের। নিজের হাতে লাগাইনা গাছ তুন ছিঁড়ি ছিঁড়ি আইনছে। এমন ভালোবাসা জম্মে দেখিনি। ওর ভেতরের মানুষটার হদিশ হাইতে কম চেষ্টা তো করি নি। হাইলাম কই। কত কষ্টই তো করে। মুখ বুজি সহ্য করে। কাউরে বুইঝতে দেয় না। মাইনষের লাই কত দরদ। কোনগাইন আঁই জানি, কতগাইন আঁই জানি না। মাইনষের মুয়ে মুয়ে আঁই হুনি। ঘরণী হই বুকটা ভরি যাই। এমন দিনে বাড়ি আইলে হকল দুঃখ ভুলি তীর্থের কাকের মতো বই থাই, কন মানুষটার মুখ দেখুম। ইষ্টেশনের পর ইষ্টেশন যায়, জলা জমিন কত কিছু পার হই যায়। মানিক আঙ্গ শহরের বাড়ির কাজকাম দিনরাত দেখভাল করে, মাসের পর মাস যায়। নিজের হোলাদের চাই কম তো নয়ই, বেশি বেশি করে দেয়, হুধু কি মাণিক, ওর ঘরের লোকদের লাইও তেনার চিন্তার শেষ নাই। ভালা ভালা জামাকাপড়গাইন ওদের লাই তুলি রাখে, কেউ জাইনতে চাইলে কয়, তোঙ্গ লাই তো আঁই আছি, বাপ মরা মাণিকের মা বইনের কে আছে। এমন কতার পরে আর কতা হয়। যেমন ভাবি চলি মনের শান্তি হায় চলুক না, হক্বলেরে তো সমানতালে বাঁধন যায় না। নদীর জলের স্রোত তেমন করি চলে আর কি।
গাছ চলি যায়, ঘর চলি যায়। কন্নাই যে যায়, কেউ কইত হারেন না। গাড়ির যাত্রীরা দু’চোখ মেলি চাই থায়। আঁর স্বামীও চাই থায়। কী জানি কিসব ভাবনাচিন্তা করে। গরু-গোতান ছাগলগুলোর দিকে তাকাইলে মনে হয়, ওগো চোখ দিয়ে কত যে জল হড়ে, গাছের ডালগুন হেলিদুলি কত যে পাগলামি করে, খালবিলের জলের কথা আর কইয়েন না, এট্টু এট্টু ঢেউ তুলি বিলের হর বিল ধরি নাচে, কেউ তো হিরেও চায় না। মাঠের ধারে বিল, বিলের ধারে মাঠ, ইঁদুর ছুঁচোর গোল গোল খেলা, তাল খেজুরের কথা বলাবলি, কেউ হোনে তো কেউ হোনে না, ঝোঁপঝাড়ের ফিসফিসানি, সুখ দুঃখের কথা কয়, রোদে হুড়ি খাঁক হয়, ইচ্ছাটা গলগলিয়ে ওঠে, দৌড়ে ফালাইতে চায়, বিধির বিধান, কন্নাই আর যাইব, মাটি কামড়াই হৌড়ি থান ছাড়া আর কি কোন উপায় আছে! ওরা গাড়ির যাত্রীগুনেরে চোখ পিটপিট করি দেখে, পাখির মতো যেন উড়ি চলি যায় হক্বলে, মুখগুলো এই দেয় তো এই নাই। একবার কথায় কথায় কইছিল, হক্কলে রোজ রোজ কত মাইনষের মুখ দেয়ে, আছা মাইনষের মুখ কয়জন দেয়ে। উনি মানুষটা কেমন হক্বলেরে ধরা দেন না, কারো কাছে সোয়াভাগ, কারো কাছে আধা, হের লাগি আসলে বুঝতেই হারেনা, পুরা মানুষটা কেমন। আঁইও তো এতদিন ঘর কইরলাম, অনও বুইঝতাম হারি ন, ওনার দুনিয়াটা চাইরপাশে কেমন করি ঘুরের – বনবন করি না সোজাসাপটা। কি যে কইতে চাই, আর কি কই হালাই, তার কোন হিসাব আছে আঁর কাছে, আমনেরাই কন, এর মধ্যে আঁর কোনো দোষ ! ভাবের ঘরে মজি থাকলে এই জীবনটার সকল কথা ভেন্ন ধরনের হই যায়। উনি তো চাই থায়, স্টেশনের হর স্টেশন চলি যায়। গাড়ি থাইমলে কাঁধের থলিটা দোলাইতে দোলাইতে বুট জুতা পা দিই হাঁইটতে হাঁইটতে কন যে নদীর ঘাটে চলি আয়ে নিজেও জাইনতে হারে না। এই যন অবস্থা, মাঝি কয়, ‘বাবু একখান কথা কই, বাকিরা আইয়া পড়ে, আমনের কেন এত দেরি হয়?’ উনি ঠোঁট দুইটা নাড়েচাড়ে, কথা আর কয় না। মাঝি কয়, ‘ আচ্ছা কথা আর কইত হইত না, আমনে বয়েন। আমনে হইলেন গ্যারামের মাথা, হক্বলের তুন সেরা হড়াশোনা জানা বিদ্বান লোক, এসব কথা কওয়া কী আঁর সাজে!’ নৌকার ভেতরটা গামছা দিই মুছি দেয়। ‘সেই আঁধার রাইতে নৌকা লই বাইর হইছি, ঘাটে খুঁটি পুঁতছি, গাড়ির তো আর দেখা নাই।’ নৌকাখান চলে তেনার প্রানটা আনচান করে, কন ছোট ছোট হোলাপাইনগুনের মুখ দেইখব। মাঝি নৌকা বায় আর খালের জল ছলাৎ ছলাৎ করে। মাঝি বেয়াল জাল বালাই বই থায়, কন হুটি, খৈলসা, টেমবৈচা, মেনা, ভেদা, বাইলা, টেংরা, বাইন মাছ আই জলে ধরা দিব। সূর্য ঢলি হড়ে হুব আকাশে, আলো খাবি খাইতে খাইতে আঁধার নামে। ঘরের জানালার ফাঁক তুন হ্যারিক্যান আর কুপির আলো ছিটকাই আই আম, বরই, জাম্বুরা, হাইঙ্গল গাছের আগায় হড়ি হাওয়ার খেয়ালে লাফানি ঝাঁপানি হুরু করে। উনি দেখনের লাই মন টানে। ছইয়ের তুন বারৈ আই গলুইয়ের কাছে বয়। সময় গড়াইলে, গ্যারামের পর গ্যারাম চলি যাই, নিজের গ্যারাম যত কাছে আসে, মনে মনে কয়, ‘ওই তো জমি, ওই তো আল, ওই তো হসল, ওই তো পুল, ওই তো বাজার, ওই তো ইসকুল, একটু হরেই তো মঠ মন্দির, খেজুর আর তাল গাছ, সদর দরজা, কী আনন্দ ! কী আনন্দ!
আঁরও তো খেমতার একটা সীমানা আছে! শুধু মাঝে সাঝে কীসের যেন গন্ধ পাই, খুব পচা পচা বাসি বাসি গন্ধ, ভেতর থেকেও ঠেলে, বার তুনও ঠেলে। ভাবি ওই নিই আবার মাথা ঘামানোর কী আছে! যা ঘইটবার তা তো ঘইটবেই, দুনিয়াদারি যে কোনদিকে চইলছে, কোনদিকে যে যাইব, কে জানে! সময়টা যে আগাই যার, পাক খার, এইটুকুনি বুইঝতে হারি, দিনগুন তো চলি যার, হকাল হয়, আঁধার নাইমতে নাইমতে জগতের ভেতরে ভেতরে চলে কত খেলা। আঁই যন এই ঘরের জিনিস ওই ঘরে লই যাই, ওই ফাঁকেই আঁর এসব কথা মনে হয়। বুকের ভেতর ঠনঠন করি আওয়াজ হয়। না জানি কখন কি ঘটে। ঘর বার করি খালি। অস্থির অস্থির লাগে। রসুই ঘরের দিকে যাওনের সময় হাতের তুন থালা গেলাস হড়ি গড়াই গড়াই বড় ঘরের তুন মাঝের ঘরের দিকে চলি যায়। মনটা উসখুস করে ওঠে, কী জানি কী হয়! মেঘনার খালে তেমন তো উথাল পাথাল ঢেউ তো নাই, দখনে বাতাসে একটু আধটু পাগলামি আছে। নৌকাটা দুলতে দুলতে না কোন সব্বনাশ না হই যায়। জালের হোলামাইয়াগুলান এদিক তুন ওদিক দৌড়ায়। ঘরের চৌকাঠের কাছে জল ভর্তি বদনা রাখি দিই। এতদূর পার করি আই হাত-পা ধুই তবে না ঘরে উঠইব। হুরা বাড়িটার মধ্যে থমথম করে। কোন বেচাল দেইখলে কখন যে কে ধমক খাবে কে জানে ! নিজের সোয়ামিরে আঁই তো ভালা করি জানি। ওই কয় না নাইরকলের মালার মতো, ভেতরটা ঢক ঢক করি নড়ে, উপরটা দেইখলে মনে হয় ঊরি বাপরে এই মাইনষের ছাল ছাড়াই ভেতরে ঢোকা তো সহজ ব্যাপার নয়, চল চল হলাই যায়। কিন্তু আঁরে তো হলাই গেইলে চইলত ন। মাটি কামড়াই হড়ি থাইকত হইব, হৌড়বাড়ির ঘর কইরত হইরত ন! ভাঙ্গনের একটু আধটু বাজনার আবাজ কানের কাছে ঘুসঘুস করতি হুরু করি দিছে। কেন, কেমন আবাজ, এটা বুইঝবার লাই কত চেষ্টাচরিত্রই না কইরছি, কে দেবে তার সন্ধান? সোয়ামিরে জিগাইলে কয়, এইসব আবাজে কান দিও না, এর অর্থখান বুঝতি গেলে অনেক বিদ্যেবুদ্ধি লাগে, বইপত্তরের পাতা উইলটাতে হয়। মাথাটারে ঝাঁকাই নিজেরেই নিজে কইলাম, হায় ভগবান তুমি আঁরে বেশি করে হড়াশুনার সুযোগ করি দিলাম না কেন, তাহইলে তো দুনিয়াদারির হালচাল ধরি ফালাইতে হাইরতাম সহজে। কী ভালাটাই না লাইগত, মনের মধ্যে এতকিছু ভাবনাচিন্তা আই বাসা বাঁইধত না। ঘরও চিনতাম, বাহরও চিনতাম। ঘরের ফিসফিসানি বড় তিতকুটে। চারধারের মুখগুলো কেমন করে। হক্বলকিছু কেমন আলগা আলগা। একটা এত্ত বড় রসুইঘর, জায়ে জায়ে মিলেমিশি পাক করে, ভাড়ার ঘরে মজুত থাকে দুই মাসের চাইল ডাইল, চিন্তা নেই, ধান্তা নেই, গল্পগাছা করি সুখদুঃখের কথা কই জড়াজড়ি করি থাই, এঘর তুন অন্যঘরে যাইবার লাই কত দরজা, লোহার শিক আর কাঠের কপাট বিয়াল হইলে বন্ধ করার লাই কম বয়সী মাইয়াগুলার তোড়জোড় হুরু হই যায়। আহা কত তো ভাব ভালোবাসা। এ ওর চুল বাঁধি দেয় তো আর একজন উকুন বাছি দেয়, শোলক বলার ধূম লাগি যায়, আর ধাঁধার উত্তর লই বাজি ধরা, এক পয়সা লই কাড়াকাড়ি লাগি যায় ত্রিশ চল্লিশটা মাইয়ার, চুলোচুলি খামচাখামচি তো কম হয় না। ওরা ফিসফিস করি কানে কানে কত গোপন কথা কয়। মাইয়াবেলার কথা। দাদু ঠাকুরমার রসিকতা ‘ আঁরে পছন্দ হইছে নি?’ ‘ থুড়থুড়ে বুড়া বিয়া করার সখ হইছে। জলে ডুবি মরুম।’ ‘ আচ্ছা, বিয়া না করিস না করিস, দু’একখান হাঁকা চুল বাছি দে।’ আমনের ফোকলা দাঁত, চোয়ে ছানি হইড়ছে দেখতি হাও না।’ ওদের কথা হুনি হাসিতে পেট ফাটি যায়। কদ্দিন বাদেই তো বিয়া হইব, পালকি চড়ি হৌরবাড়ি যাইব। এই বাড়িটা তো আঁর হৌড়বাড়ি, হত্তম দিনের কথাটা ভুইলতি তো হারি না। আইছি তো একলা, নিজের আর অন দেঅর ভাশুরদের হোলাপাইন লই ভরা সংসার।
সময়ের কি আর মা বাপ আছে। ঘড়ি আর কই? সময় তো গুনি আন্দাজে আন্দাজে। খাওনের সময় অন। ছেঁড়া কাপড় দুই ভাঁজ করি লম্বালম্বি পাতি আগে বাড়ির ছেলে আর কাকা জেঠা আর দাদুরা বই যায়, হক্বলের শেষে ঘরের বউঝিদের খাওয়ার পালা। হাড়ি কড়াইয়ে ভাত তরকারি কিছু হড়ি রইল কি রইল না, কে আর ভাবে। কেউ আধপেটা খায়, কারো পেট খালি রাখি জল গিলে শোয়ার ঘরের দিকে দৌড়ি চলি যায়। দিনভর খাটাখাটনি করি এন্নেই চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু। মাটির মেঝেতে মাইয়ারা চাটাই পাতি দিলে এমাথা ওমাথা ছেলেগুলা সটান হুই পড়ে, মাইয়াগুলা চলি যায় যার যার ঘরে। ঘরের তুন অনেক দূরে পায়খানা, রাত বিরেতে দাস্ত বমি হইলে সেই কষ্টের কোন মা বাপ নাই, মাইয়াদের নাজশরম কইরলে চইলব কেমন করি, ওদের কষ্টের বহর চার গুণ বেশি। কইত তো হারে না কারো কাছে, গুমড়ে মরে। শাড়ি ব্লাউজ ছিঁড়ি গেলে সেলাই করি করি হলে, সে আর কদ্দিন চলে। বছরে দুই প্রস্ত কাপড় চোপড় কিনি দেয়। আলতা সিঁদুর কাজল দূর দূর তুন এ গেরাম তুন হে গেরাম ফেরি করি যারা ঘুরি ঘুরি আয়, ওদের ঘিরে ধরি কথার ঝর তুলি দেয়, মনে হয় যেন আকাশের চাঁদ হাতে হাইল। এক দল মাইয়া লাগি হড়ি এত্ত বড় লম্বা উঠোনটা ঝাড় দেয়। হোলাদের লগে খেলছি গেলে কেউ কেউ তো কই হালায় ‘ দামড়ি মাইয়ারা ওই দামড়া ছেলেগুনের লগে সমান তালে চলে, একটুও লাজশরম নেই। মাসিকের যন্ত্রণা সে তো আর কহতব্য নয়। কি আর কইমু সময়টা কত না কষ্টের। হড়াশুনা মাথায় উঠছে। মাইয়াদের ওই পাঠ কোনমতেই থাকতি নাই। শুধু হোলাদের হড়ার ঘরে কেউ উঁকিঝুঁকি মারে আর তাড়া খায়। তবে কিনা একটা জিনিস চোয়ে হড়ার মতো। হক্বাল না হইতেই দলে দলে গাছে গাছে মাইয়াগুলা ছুটি বেড়ায়, কত জাতের ফুল তোলে, টগর, জুঁই, মালতি, করবি, শেফালি সাজি ভর্তি করি লয়, কে কত বেশি তুইলতে পারে, হেই নিয়া ঝগড়াঝাঁটিও কম হয় না। দু’একজন আবার গানের কলি ছোটায় – ওই ফুলেরা ঘরে আয়, সুগন্ধীতে মন ভরায়। ঠাকুর আমার মনের কোনে, হৃদয় হরণ ভক্তি ভরে। যাব আমরা পরের ঘরে, কাঁটার বোঝা সঙ্গে করে….।
কালা আর ধলা আসি ঘেউ ঘেউ করে। আঁর আঁচল ধরি টান মারে। আঁই বুঝি ফেলাই উনি সদর দরজায় হা রাইখছেন। মন্দিরে প্রণাম সারি গুটি গুটি হায়ে ঘরের সামনে উঠানে পা রাখেন। উনি পাঞ্জাবি আর কুঁচি দিই ধূতি হরেন, ফিতা ছাড়া কালা রং এর জুতা হরেন। ওই কালা ধলার মতলবখানা বুঝি উঠতি হারি না। ওরা ওনার হায়ের নিচে লুটাই হড়ি কুঁই কুঁই করে। আঁর হোলামাইয়ারা ওগো বাবা আয়নের খুশিতে ওনার হাতের তুন ছাতা টানি লই চলি আয়ে। এবার শহর তুন গ্ৰামে ফিরতে দেরি করি ফালাইছে। তাই বাবার সঙ্গে হাইবার লাই তীর্থের কাঁকের মতোই দিন গুইনছিল কবে ঘরে আইব। ওদের তাড়া মারনের জ্বালায় আঁই নিজেই অস্থির হই যায়। আঁর ছায়েরা উচাটন হই দেই ঠাট্টা মশকরা তো কম করে না – এবার ভাশুর তোমারে হারাদিন ধরি নাচাইব চড়কির মতো। ওদের কথায় আঁই হাসি আর থামাইতে হারি না। আঙ্গ জায়ে জায়ে কথা কাটাকাটি হয়, ভাব ভালোবাসা ওতো কম নাই। ভালো মন্দ খাওনের ইচ্ছা হইলে ওদের আবদারের শেষ নাই। মাথায় ঘোমটা টানি ওনার সামনের তুন ফলাই যায়। কী জানি কখন কী জিগাই, না কইত হারলি লজ্জার কী শেষ আছে। আঁরে আই কইব কত কথা। সেসব কথা একবার সুরু হইলি কোনমতে শেষ হতি চায় না। দিনরাত তো কাটি যায় ঘরবার করতেই। কামকাজ তো ছড়াই আছে আনাচে কানাচে, আমোদ আহ্লাদ যে একটুখানি করি মনের শান্তি কইরব, ভাইববার অবসর কোথায়। যেমনি পা চালাবার তেমনি পা চালায়, রসকস কারে কয় কেউ জানে না। তবে এতদিনে আঁই বুইঝছি জীবনের যে একটা ধম্ম আছে, এটা বুইঝতে তেমন আর কষ্ট হয়না। ওরা ভাবে দু’এক কলম পড়ালিখা শিখছি ভুগলে গোটা দুনিয়াটা আঁর হাতের মুঠোয়। ওরা ভাবে আঁই যেরকম ভাইবতে পারি, ওরা সেরকম করি ভাবতি হারে না। ওরা কয়, কত নাকি মণিমুক্তা আছে আঁর জীবনের গল্পে। আসল কথা হইল নতুন নতুন কথা হোনার ওগো আগ্ৰহ দেখি আঁইও স্মৃতির হুকুরে ডুব দিবার সুযোগ পাই। তাই তো ইনিয়ে বিনিয়ে কত গালগল্প করি। ওরা ভাবে আঙ্গ বড়জা কন্নাই পায় এসব গল্পকথা! তাই আঁর স্বামী বাড়ি ফিরলেই ওদের জানার ইচ্ছাটা বাড়তেই থাকে। আর ওইটা লই সপ্তাহের পর সপ্তাহ নাড়াচাড়া করে। কামকাজ ফেলি থালাবাসনের ঝনঝন শব্দ করি ছুটি চলি আয় আঁর চারধারে জড় হয়। গনগনে লাকড়ির আগুন ধোঁয়া ছড়াইলেও ওদের ভ্রূক্ষেপ থাকে না। গোগ্ৰাসে হক্বল কথা গেলে। হুই ছিল মাইল দশেক দূর, মনে হইতে হারে এই তো কাছে কিনারে, আসলে তো নয়, মনের দরজাটা বন্ধ করি রাখি দিছে কতকাল। চারদিকের রঙটা সাদা না কালো জানতি তো হারে না। শোনাই যখন গল্পটা, চমকি উঠি কয়, ওরে বাপরে, এর কন্নাই শুরু, কন্নাই শেষ কে কইব, এত্ত বড় লম্বা একটা অজগর, মানুষ ছাগল খপ করি গিলি নেয়, কোন দেশ তুন আইল, না কে আনি ছাড়ি দিল, কেউ জানে না। ওরা দিনরাত খালি চোখ কচলায় আর স্বপন দেখে। সাহস করি কয় না ‘ আঙ্গরে একবার দেখাইতে নিয়া যাইবা গো দিদি।’ কী ভয়ঙ্কর কথা, গণ্ডি কাটি যে রাইখছে বাড়ির কর্তারা, ওরা কী সব ভুলি বসি আছে! হাউড়ি, ঠাকুরমা- হাউড়ি, বড় ঠাকুরমা, ঠানদি ওরা যে উঠানবাড়ি করি করি পরকালে ঘর বাঁইধছে, সে জীবন কী বাসি হই গেছে। তবু কত আশা, গল্প হুনি হুনি জগতের সন্ধান লইব, নিজেদেরও চিনব, হরেদের লগে নিজেদেরও মিলাইব। হায়ে হা মিলাই। ওঁয়া ওঁয়া শব্দ হুনি ঘরের মাঝখান দিই ছুটি চলি যায়। আঙ্গ খুড়তোতো জা পোয়াতি কিনা, তার আবার প্রসববেদনা উইঠল, তাই তো আঁতুড়ঘরের বাইরে মাইয়া বউদের এত কানাকানি জানাজানি। নতুন জীবনের গন্ধ। যেন দাইয়ের হাতে জীবনের নতুন রঙ লাইগছে, সে রঙ বাতাসে ছড়ায়, আকাশের রামধুনর কাছ তুন ধার করি মাইয়া মানুষের গভ্ভে চলি আয়ে। কেন চলি আয়ে কেউ একবারও জিগাই না।
আঁর উনি হত্যেকবার যন বাড়ি আয়ে, মানুষটারে যেন আর এক রকমের চিনি। নিজেরেই নিজে প্রশ্ন করি কেমনে এটা হয়! মানুষটা নিজেরে এমন পাল্টায় কেমন করে, কে রসদ জোগান দেয়। শত হইলেও আঁর স্বামী তো, আঁর জানার অধিকার তো আছে। কতবার ওনার মুখের দিকে চাই বসি রই, কয়, ‘কী এমন দেখো? তোঁর বয়স বাইড়ছে না কইমছে?’ না, হাইসতে তো আর হারি না। মানুষটা আঁর মনের ভাবখানাই বুঝল না। আসলে ওনার দোষের কিছু নাই, রোজের নিত্যনতুন ঘটনা ওনারে ধাক্বা মাইরছে, সে তো আর আঁর গায়ে আই আঁচ লাগছে না। উনি ওনার মতো করি হাল্টার, আঁই আঁর মতো করি কেমন যেন হই যাইয়ের। সংসারের হক্বলে যেন কয় তুই আগের মতো থাকছি হারথি ন, হরির আর মনের ভারটা যেন হমানতালে ভার হই যার, যত নিজেরে হালকা কইরতে চাই না কেন, ভারটা যেন চাপি বসে। আঁর স্বামী আঁরে কত কিছু শিখাইতে চায়, আবার আঁর বুদ্ধির তারিফও করে। উনি আবার নিয়মের গোঁসাই, সামনে কইবার সাহস নাই, ওনার স্বভাব নিই কথা কওয়াটা মানানসই নয়। কেউ হুনি ফেইললে লজ্জার মাথা কাটা যাইব। তবু জায়েরা যত নষ্টের গোড়া, খুঁটি খুঁটি জাইনত চায়, মানের কথা টানি বার করে। এমনিতে হারাদিনে কামকাজ করি ফুরসত পাই না, তবুও ওনার ফাইফরমাইস তো হুনতি হয়। সাহস করি ওনার কামকাজ নিই জিগাইব আঁর ঘাড়ে কটা মাথা। তবে কিনা সময় লই বড় কড়া। হাঁটা শোয়া বসা কবিতার ছন্দের মতো চলে, এইটা আঁর মন্দ লাগে না। কড়া কড়া কথায় আঁর হোলারা মাইয়ারা তটস্থ হই থায়। বাপের কাছে আবদার কইরব সেই জো নাই। শাসনের খড়গ হস্ত যন তন নামি আইত হারে একটু এদিক সেদিক হইলেই। আদর ভালোবাসাটা উনি দেয়াইতে চান না, কর্তব্যের আড়ালেই লুকাই রায়। মানুষটার লাই আঁর গর্ব হয় যন চার গ্ৰামর লোক ওনার জমি জিরেত লই সমস্যার লাই হারা দুপুর ধরি কাঁচারি বাড়িতে ভিড় করে, মুসাবিদা করে। পায়ে হাত দিই নমষ্কার করি কয়, ‘ মোক্তারবাবু আমনে আছেন বলেই এই যাত্রায় বাঁচি গেলাম’। হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ তো করেন না। ডাক্তার বদ্যি, ঔষধ পথ্যি না কিনত হাইরলে এক দুটাকা হাতে দিয়ে কন, ‘যাও এইটা লই যাও, হরে দেইথুই একটা বন্দোবস্ত হবে।’ গ্যাতিগুষ্টি ঝগড়া লাইগলে উনি তো মুশকিল আসান। নিয়ামত আলি চোয়ের জল ফেইলতে ফেইলতে পা দুখান জড়াই ধরি কয়, ‘ আঁরে বাঁচান বাবু মায়ের পেটের ভাই হুমকি দিছে, ঘরের তুন বার হনের রাস্তাখান নাকি বন্ধ করি দিব। সালিশি সভায় আঁরে কী অপমানটাই না কইরল’ ‘শওকত রে কও গিয়া, আঁর কথা যেন হুনি যায়। চিন্তা করিও না, সমাধান একটা হইবই হইব। ঘর যাও অন।’ এমন স্বামীরে লই গর্ব কইরতে কার মন চায়। ভালা তো লাগে, যন বড় গলায় কয়, ‘ কৈ মাছের হাতুরি আর কাঁচকি মাছের ঝাল যা রান্না করছ কমলের মা, হারা হপ্তাহ ধরি যা মধু খাওয়ায়, মুখে রোচে না।’ হুনি মনটা কাঁদি ওঠে। মন চায় রোজ শহরে যাই ওনারে ভালো মন্দ খাওয়াই। ইয়ানে এত্ত বড় সংসারের গিন্নির দায় সামলাইব কে। আর স্বামী এই কথাখান ভালো করে বোঝেন। উনি নিজেই যে গোটা সংসারটারে শক্ত হাতে ধরি রাইখছেন বাপ মারা যাওনের হরে, সেও তো কম দিন হয় নি। তবুও মনের সান্ত্বনা হাইবার লাই সেই যাইবার বেলায় থলিতে হুরি বেগুন, মূলো, লাউ, কাঁচকলা লাউ নৌকায় তুলি দিই এমন করি তাতে দেখতি না হায়। রাখি গেলেও হলে মনটা ঠাণ্ডা হই যায়, এক সময়।
মনের হদিস মেলা তো এত সহজ কথা নয়। উনি যখন বাড়ির সদর দরজা ছাড়ি ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হই যান, মনের ভেতরটা কেমন মোচড় দিই ওঠে। আই হ্যারিক্যানটা লই খালের হাড় হর্যন্ত আই, গাছগাছালির পাতারা মনের সুখে ঘুমায়, আঁধার লেপটি থায় গায়ে গায়ে। হিয়ালরা বনেবাদাড়ে ছোটাছুটি করে মনের সুখে। গরুগোতানরা ছানাপোনা লই লেজ মুড়াই গুটিসুটি মারি হুই থায়। ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ হোনা যায়। গাইগরুরা শরীর মোচড়ায়। দিনেমানে লাঙ্গল দিই জমি চষার লাই গায়েগতরে টান ধরে। কাঁকেরা ডাল নাচাই হকলেরে কয় ‘উঠি যাও গো উঠি যাও’। সাপেদের হামির ঘ্রাণ নাকের হাশে আই ঘোরাফেরা করে। বাড়ির লোকজন জাইনতেও হারে না, আঁর স্বামীর নৌকাটা বাঁশের সাঁকোর হর সাঁকো পার হই ততক্ষণে অনেকদূর চলি গেছে। মেঝ দেঅর, সেঝ দেঅর, ছোট দেখার, না দেয়ার, খুড়তোতোরা মিলিমিশি অনেকে আছে বটে, ওদের হারাদিনে কত কাজ। নিজের বল ভরসা নিজের ভিতর তুন যোগাড় করি লইতে হয়। একা একা হাঁইটতে হাঁইটতে আকাশের দিকে তাকাইলে মনে হয় রঙ পাল্টাইবার লাই ওরাও কেমন তাড়াহুড়া করি লেগেছে। ঘরে ফিরতি হবে, জানালা কপাট গুলতি হবে। হাঁকডাক তো করছি হবে – ও মাইয়ারা ওঠ, গোবরের জল ছিইটাতে হইত না ঘর দূয়ারে। আঁইডা বাসনকোসন গুন মাজি হালাইতে হইব তো। ওরা চোখ কচলাই সাড়া দেয়, বিছানা গোটায় – ‘ আই গো দেখি, হাতমুখখান ধুই আয়। কচি কচি হোলামাইয়ারা চাটাই বিছাই আঁর বলার আগেই আদর্শলিপি, বাল্যশিক্ষা, নামতার বই, ছড়ার বই লই আঁর ভয়ে চেঁচাই চেঁচায় হড়তি লাগে। ওদের হড়ার ঢঙ দেখি মজাও লাগে। সারা বাড়ি গমগম করে। বাড়ির তুন একটু দূরের ইসকুলটায় চৌদ্দ গাঁয়ের হোলারা হড়ে। মাইয়াদের হড়ার কোন ইসকুল নাই। ওরা বাঁইচল কি মইরল, বিদ্যেবুদ্ধি হইল কি হইল না, তাতে কার কি আয়ে যায়, বোকা মূর্খ বানাই রাইখলে হক্বলের মঙ্গল। বিদ্যাসাগর জন্মেছিল বলেই না মাইয়ালোকদের লই প্রাণপাত করেছিল, না হয় এই হোড়া দেশে কে আর এমন করি ভাইবত। হোলাদের ইসকুলটার চারধারে জঙ্গল। মশারা ভ্যান ভ্যান করে, রোগের ডিপো, কত যে হোকামাকড়ের বাসা, সে আর কইবার নয়। পাশ দিই চলি যাওয়া খালটায় পাল তৌলা নৌকা, ডিঙি নৌকা, গুণ টানা নৌকা কলকল শব্দে চলি গেলে মাষ্টারের কথা না হুনি ওই খাল আর খালের হাশে মাটির ঢিপির দিকে চাই থায়। দূর তুন দেয়া যায় বড় বড় গ্ৰাম, সবুজের মেলা বইছে যেন। এইসকল কথা ওদের মুখেই হোনা। ইসকুলের হাশেই পুল, পুলের হাশে দোকান। হিয়ানে লজেন্স, ছোলা ভাজা, বাদাম ভাজা, চানাচুর – টক মিষ্টি ঝাল। রাস্তার উপর নাড়া পাতা। মচর মচর শব্দে মাড়াইতে মাড়াইতে ওরা ঘরে ফেরে। কত তো ভাবনা হয় বাপের দেশের মতো হৌড় বাড়ির দেশেও যদি একখান ইসকুল থাইকত আর ঘরের বউদের হড়ার অনুমতি থাইকত একবারের লই হলেও ইসকুলে ভরতি হই যাইতাম।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)