পাবক উপাধ্যায়

প্রথম পর্ব 

দিনটা ছিল ১১ই আগস্ট। বেরিয়ে পড়লাম ব্যাগ প্যাক করেই। রিটার্ন সমেত এসি টু টায়ার-এর টিকিট অনেক আগেই কেটে নিয়েছিলাম হাওড়া থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত। কিন্তু ঠিক করিনি কোথায় যাব। কোনো পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনাও ঠিক সেভাবে ছিল না। শুধু এটা জানতাম যে, নিজেকে টেনে নিয়ে একবার হরিদ্বারে ফেলতে পারলে হয়। ওখানে কয়েকদিন কাটিয়ে পরে না হয় ভাবা যাবে। এমনটাই ভেবে বেরিয়ে গেলাম।

হরিদ্বারে পৌঁছলাম ১২ই আগস্ট সন্ধ্যায়। অলকানন্দার তীরে পরিস্কার -পরিছন্ন একটি হোটেলে উঠলাম। তারপর, গামছাটা কাঁধে নিয়েই ওই হোটেলের নীচেই একটি ঘাটে নামি। হীমগলা নদীর জল শরীরে লাগতে ঠাণ্ডায় কলজেটা জমে গেল মনে হল। কথিত আছে যে এই হরিদ্বারে আসলেও নাকি অলকানন্দায় স্নান সকলের ভাগ্যে থাকে না। সুযোগ যখন পেয়েছি আমায় কে আর আটকায়। এক নিঃশ্বাসে বিশটা ডুব দিয়ে নিলাম। শরীর যেন অবশ। আর চলতে পারছি না। কোনোমতে ঘাটের শিকল ধরে ওপরে উঠে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিষ্ণু ঘাটে একটু বসলাম। চাঁদ তখন মাথার উপরে, একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছে। তার সারা দেহ থেকে যেন মুক্তো খসে খসে অলকানন্দাতে পড়ছে, এক একটা ঢেউ নিমেষেই সেই খসে পড়া মুক্তোগুলোকে নদীর বক্ষমাঝে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখছে। এ যেন এক লুকোচুরির খেলা। মাঝে মাঝে আলোর ঝলকানি বাড়ছে, আবার স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। কে জানে, জীবনের মতো চাঁদও বুঝি আমাকে দেখে ভেঙ্গচি কেটে যাচ্ছে। খুব ভোরে গোবিন্দঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে ভেবেই তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম ওখান থেকে। ফেরার পথে বিখ্যাত দাদা বৌদির হোটেল থেকে দেরাদুন রাইস, সোনা মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, পনির আর  চাটনি দিয়ে উদরপূর্তি সেরে ঘরে ফিরে ফোন টা চার্জে দিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমে মগ্ন হয়ে গেলাম তার কিচ্ছুটি টের পাইনি।

ঘুম ভাঙল ভোর তিনটায়। চারটের বাস ধরতে হবে। নইলে পরের বাস ধরলে পৌছতে রাত হয়ে যাবে। ভাগ্যিস গিজার ছিল। নইলে, কনকনে ঠাণ্ডা জলে স্থান করতে হত। অগত্যা স্নান সেরে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বাসও পেয়ে গেলাম সময় মত। মনটা একটু বিষণ্ণ ছিল, কারণ জানালার কাছে সিট পাইনি। অবশেষে বাস ছাড়ল ঠিক চারটে দশে। সারাদিন ধরে বাস চলল। দুপুরে চামোলিতে লাঞ্চের জন্য আধাঘণ্টা হল্ট করল। তারপর আবার বাস চলতে লাগল। মাঝে মাঝে যখন জানালার বাইরে তাকাচ্ছিলাম হৃৎপিণ্ড তখন বাইরে বেরিয়ে আসছিল। কী ভয়ানক দৃশ্য। গাড়ী চলে যাচ্ছে কি দুর্গম পথ। মাথার ওপর ভয়ানক ভাবে পাথরের ঢিবীগুলো হা করে আছে। পাথরের সর্বত্র ফাটল। মাথার ওপরে ভাঙা পাথরগুলো কী বিভীষিকার ন্যায় দাঁত বের করে আছে। এই বুঝি সকলকে গ্রাস করল বলে। মনে হয় কেউ একটা লাঠি দিয়ে গোতা মারলেই বিরাট পাথরের চাঁই ভেঙে পড়বে। তার ভিতর দিয়েই গাড়ি চলছে ৫০ থেকে ৬০ কিমি বেগে (গুগলে স্পীড মেপে)। কিছু কিছু জায়গায় তো পাথর কেটে মাঝখান দিয়ে রাস্তা বানানো। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই বুঝি হুড়মুড়িয়ে পড়ল বলে। এ তো গেলে ওপরের কথা। জানালা দিয়ে যেই নীচের দিকে তাকাতেই হা হয়ে গেলাম। পাহাড়ের গা বেয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। নিমেশেই এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় অতিক্রম করে চলেছে। নীচে গভীর খাত। আন্দাজ মতো মাটি থেকে ১৬ থেকে ১৭ হাজার মিটার ওপরে। বিরাট কলেবর বিশিষ্ট অলকানন্দাকে ঠিক সাদা সুতোর মত দেখাচ্ছিল। খোলা জানালার বাইরের দৃশ্যটা ছবির বইয়ের মত লাগছিল। কী অপরূপ দৃশ্য সে বলে বোঝান যাবে না। চারিদিকে বরফে ঢাকা মেঘের পাহাড়, মাঝে মাঝে তুলোর মত ভেসে চলেছে মেঘেদের দল। রোদের আলো পড়তেই মুক্তোর চাঁইয়ের মত মনে হচ্ছিল। জানালার কাছ দিয়ে মাঝে মাঝে বয়ে যাচ্ছিল শুভ্র উদাস মেঘের দল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এ কোন রূপকথার জগতে চলে এলাম।

ঘড়িতে তখন সাতটা বেজে চল্লিশ মিনিট হয়েছে গোবিন্দঘাটে নামলাম। গোবিন্দঘাটেই বেশ কয়েকটা থাকার হোটেল ছিল কিন্তু আগে থেকে বুক না করলে রুম পাওয়া চাপের। সেই অর্থে আমি আগে থেকে থাকার ব্যবস্থা না করেই বেড়িয়েছিলাম। এদিক সেদিকে ঘুরে ফিরে ব্যর্থ হয়ে রাস্তাতে দাঁড়িয়ে সামনের অন্ধকারে ঢাকা বিরাট পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি একদৃষ্টিতে। হঠাৎ, পেছন থেকে কেউ একজন শান্ত অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন- “ আপ কা ইতনা সোচ রহে হো, আগে জায়য়েগা গুরুদ্বারা মিলেগা। ওহি পর ঠেহের লিজিয়েগা। আচ্ছা জাগা হ্যাঁয়। আচ্ছা জী চলতা হুঁ ম্যায়।” আমি তো পুরো থ হয়ে গেলাম। এই অচেনা দেশে কাউকে চিনি না জানি না, কে আবার আগ বাড়িয়ে উপকার করতে আসে। আমি এসব নিয়ে ভাবছি আর আগন্তুকের চলে যাওয়া দেখছি। কিন্তু আজব ব্যাপার তিনি কিছুটা যেতেই আর তাঁকে দেখতে পেলাম না। আমি চোখে জোর দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না সত্যিই সামনে কেউ নেই। সামনের রাস্তা পুরো ফাঁকা। সোজা একটা রাস্তা দূরে গিয়ে বাঁক নিয়ে চলে গেছে। আগন্তুকের কথা অনুযায়ী ওই দিকেই আমি হাঁঠতে থাকলাম। পাঁচ মিনিট হাঁটার পর তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছালাম। বামদিকে লেখা আছে গুরুদ্বারা ২০০ মিটার, ডানদিকে লেখা ঘাঙারিয়া ৭.২ কিমি।

এসবের মাঝখানে, চোখের অগোচরে একটা দৃশ্য ঘটে গেল তার কিচ্ছুই টের পাই নি। গোবিন্দঘাটে নেমে হোটেলের সন্ধান করতে করতে রাস্তার পাশে থাকা পাহাড়ি বিছুটী গাছের পাতায় অজান্তেই ঘষা লেগে যায়। এমনকি খেলার ছলে দু’চার টে পাতা ছিঁড়ে হাতে বুলিয়ে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ সাঙ্ঘাতিক রকমের চুলকানি শুরু হয়। সে কি চুলকানি বলে বোঝানো যাবে না, পাগলের মতো আঁচড়াতে থাকি। মজার বিষয় হল যখন আগন্তুকের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম তখন ভুলেই গেছিলাম যে পাহাড়ি বিছুটী লেগেছিল। শোনা গেছে যে, এই পাহাড়ি বিছুটী গাছের পাতা যার একবার ঘষা লাগে, টানা সাত দিন ধরে নাকি তাকে চুলকে যেতে হয়। অদ্ভুত ব্যাপার আমার আর কিছুই হচ্ছিল না।

আমি বামদিকের রাস্তা ধরে আরও বেশ কিছুটা এগোতেই দেখি সামনেই বিশাল এক অট্টালিকা। পাহাড়ের এত ওপরে এত বড় বাড়ি হতে পারে বিশ্বাস হচ্ছিলই না। সেই বিশাল প্রাসাদের ফটোকের সামনে হিন্দি বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘গোভিন্দঘাট গুরুদ্বারা’। মনে মনে বললাম অবশেষে তাহলে গুরুদ্বারাতে পৌঁচ্ছালাম। ঘড়ি তুলে দেখি তখন সময় আটটা বেজে গেছে। অদ্ভুত বিষয় তখনও আমার কানে সেই আগুন্তকের কথাগুলোই বাজছে – “ আগে জায়য়েগা গুরুদ্বারা মিলেগা…..”

খিদেতে তখন অবসন্ন। পেটে ছুঁচো ডন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। গুরুদ্বারার ঠান্ডা জলের ছ্যাঁকা লাগতেই মনে হল ছুঁচোর ঘুম ভেঙেছে। স্নান করে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ খুলে শুকনো খাবার খেলাম। সাথে ছিল কাজুবাদাম, খেজুর, কিসমিস, আমণ্ড, ডার্ক চকোলেট, ড্রায়েড ব্লাক গ্রেপস্‌, কিছু বিস্কিট, চিপস্‌ ইত্যাদি। কিছু খাবার খেলাম আয়েস করে। পা ছাড়াতে গিয়ে দেখি পায়ের কাছে মোটা উলিকটের কম্বল। সন্ধ্যে যত বাড়তে লাগল তাপমাত্র তত কমতে লাগল। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগতেই হাঁচি শুরু হল। শীতের পোষাক জড়িয়ে নিয়ে হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে একমনে সারাদিনের কথা ভাবছি। ধীরে ধীরে কলমুখরতা কমে গিয়ে কানে কেবল প্রবল জলপ্রবাহের আওয়াজ আসতে লাগল। আমি উদগ্রীব হয়ে কান পেতে আওয়াজটা পর্যবেক্ষণ করলাম। মনে হল পাশেই বিরাট ঝরনা, তার জলপ্রবাহের শব্দ কানে ভেসে আসছে। গোবিন্দঘাট গুরুদ্বারার পাশেই বিরাট এক পাহাড়ের দুদিক দিয়ে ভ্যুন্দর এবং পুষ্পবতী নদীদুটি তীব্র বেগে ধেয়ে এসে হুড়মুড়িয়ে গোবিন্দঘাটের কাছে অলকানন্দা নদীতে মিশেছে। সেই জলপ্রবাহের আওয়াজ এত তীব্র যে মনে হচ্ছিল নদীর পাড় ভেঙে সর্বত্র জল প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। যা দেখলাম তা ভাষাই প্রকাশ করা যাবে। পূর্ণিমার আলোতে অলকানন্দার জল রূপোর ন্যায় ঝলমল করছিল। মনে হচ্ছিল যেন কেউ বিরাট এক রৌপ্যস্তম্ভ গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে। মেঘমুক্ত আকাশের তারা নক্ষত্ররা যেন সেই ফুটন্ত রূপোর মধ্যে পড়ে চিকচিক্‌ করছে আর হাবুডুবু খেয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

বহুক্ষণ একদৃষ্টিতে সেই রূপোলি খেলা দেখতে দেখতে কখন যে রাত দশটা বেজে গেল বুঝতেই পারিনি। একটা পাথরে ঠেস দিয়ে বসে বসে অলকানন্দের জলধারার সৌন্দার্য উপভোগ করছিলাম। মাঝে মাঝে দূরে পাহাড়ি গাছ থেকে ঝিঁ ঝিঁ-র ডাক ভেসে আসছিল। তবে বোধহয় ওটা ঝিঁ ঝিঁ ছিল না কোনো বন্য পাখী বা ওই জাতীয় কোনো কিছুর ডাক ছিল। হঠাৎ দেখি সেই বাবাজী নদীর পাড়ে একটি উচুঁ পাথরের কাছে বসে নদীর ঢেউ দেখছে। আমি তাঁর সাথে কথা বলব বলে উঠে তার কাছে যেতেই বুঝলাম আমার মনের ভুল। সেখানে কেউই ছিল না। একটা সাদা পেঁচা নীচে কোনো পোকামাকড় শিকার করছিল বোধহয়, আমি কাছে যেতেই সে উড়ে গেল। কিন্তু এতটা চোখের ভুল তো আমার হয় না। কিছু আগেই লোকটিকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মাথায় পাগড়ী বাঁধা, কোমরে সেই লম্বা তরবারি ঝুলছে। আমার সাথে এসব কি ঘটে চলেছে, কোনো যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছি না।

ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে এলাম। জীবনে কখনো গুরুদ্বারাতে থাকিনি। বলতে গেলে গুরুদ্বারাতে রাত কাটানর সৌভাগ্য হল এই প্রথম। অনেক রাত হয়েছে, গুরুদ্বারাতে থেকে বাইরে আমিষ খাওয়াটা শোভা পায় না। রাতে ভোজন লঙ্গুরখানাতেই করার সিদ্ধান্ত নিলাম। গুরুদ্বারাতে যে সকল শিখ তীর্থযাত্রী আশ্রয় নেন তাঁরা সকলে মিলে রান্না-বান্না করেন এবং ঐ খাবার সকলকে বিতরণ করেন। তবে সেখানে নিয়ম, মাথায় পাগড়ী অথবা ঐ জাতীয় কিছু বেঁধে তারপর খেতে হবে। মূলতঃ শিখেদের জন্য এই গুরুদ্বারার ব্যবস্থা করা হলেও বর্তমানে যেসকল তীর্থযাত্রী বা দর্শনার্থী হেমকুণ্ড ট্রেকিং কিংবা ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স এ বেড়াতে যান, হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্টান নির্বিশেষে সকলেই প্রায় এখানে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। সকলের জন্যই ভোজনাদির ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

আমি মাথায় রুমালখানা পাগড়ীর ন্যায় বেঁধে নিয়ে লঙ্গুরখানায় প্রবেশ করতেই চক্ষু চড়কগাছ। একি দেখছি। বিশাল এক হলঘর, যেখানে কমপক্ষে একবারে দু’শ তিনশো লোকের খাওয়ার আয়োজন। সেখানে বিরাট বিরাট পাত্রে রান্না হচ্ছে। ফাও খাবার অভ্যেস কখনোই ছিল না আমার। লঙ্গুরখানাতে প্রবেশ করে ইতস্তত করছিলাম, বিবেকে বাঁধছিল। খেতে গিয়ে দেখি তাঁদের অধিকাংশই শিখ। বোধহয় আমিই কেবল বাঙালী। আরও কিছু অবাঙালীও সেই বৈকি। কিছুক্ষণ বসে অবজার্ব করলাম আদতে কি ঘটছে। অবশেষে সংকোচ দূরে সরিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমার মনের ভাব বুঝে একজন শিখ জিজ্ঞের করে বসলেন, “পাজী, আপ হাত বাটায়েঙ্গে? আইয়ে দিল খোলকে খিলাইয়ে।” আমি লাইসেন্স পেয়ে ভীষণ খুশী। তাছাড়া পাড়ার অনেক বড়বড় অনুষ্ঠানে দওয়া থওয়া করার পারদর্শীতাও কম নয়। কাজে লেগে গেলাম। কখনো রুটি সার্ভ করি, তো কখনো রাজমা ডাল, আর একটা ডালনা ছিল, আজো বুঝতে পারি না যে ওটা কিসের ছিল। কখনো আতব চালের ভাতের মতো জড়ানো ভাত। এক এক করে তিন চার ব্যাজ বসানোর পর দেখছি আমার কাজের পটুতা দেখে একবার পেছন থেকে ডাক আসে, “পাজী অ্যাপ দিজিয়ে”, একবার সামনে থেকে, “পাজী ইধর আইয়ে, অ্যাপ দিজিয়ে।” একঘণ্টা কেটে গেলে, দেখছি আমরা তিন চার জন ছাড়া সকলে খেয়ে চলে গেল। এভাবে আরো ত্রিশ চল্লিশ মিনিট গেল, আমরা তিন চার জনেই সব লাইন ম্যানেজ করে সেবা দিচ্ছিলাম। এদিকে আমার খিদেই চোঁ চোঁ করছে। তাঁদের মধ্যে থেকে একজন বললেন “ পাজী অ্যাপ ব্যাঠ জাইয়ে। লোগ আনা কম্‌ হো গয়া। ” একদিকে খিদেই পেট চোঁ চোঁ করছে। অন্যদিকে বারবার উঁচু নীচু হতে হতে কোমর ধরে গেছে। শেষমেশ বসে পড়লাম বাহে গুরু বলে।

খাওয়া সেরে রুমে ফিরে দেখি ঘরের বাকি সিটগুলো বুক হয়ে গিয়েছে। পরিচয় হল সকলের সাথে। কেউ পাঞ্জাব, কেউ হরিয়ানা, কেউ দিল্লি, কেউ বা আবার হরিদ্বার, কেউ কেউ গুজরাট থেকে, কেউ কর্ণাটক-মহারাষ্ট্র থেকে এসেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক আসলেও সকলের গন্তব্যস্থল ঐ হেমকুণ্ড সাহেবই। হিন্দি-ইংরেজিতে কয়েকজনের সাথে ভবের আদান-প্রদান হল। ওরাঁ খুব প্রসন্ন হল এবং আমারও খুব ভাল লাগল। অদের মধ্যে থেকে একজন আবার আমাকে পাগড়ী বাঁধা শিখিয়ে দিল।

সারাদিন এত ধকল গেল যে বিছানাতে শুয়ে পা ছাড়াতে না ছাড়াতেই গভীর ঘুম আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। মাঝরাতে একটা অপ্রীতিকর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় উঠে বসলাম। বাইরে বাতাস সাঁ সাঁ করে এত জোরে বয়ে চলেছে যে একমাত্র বাতাসের সাঁ সাঁ এবং নদীর জলস্রোতের প্রবল কুলু কুলু আওয়াজ ছাড়া কোনো আওয়াজ কানে আসছে না। বাইরে বেরিয়ে গেলাম। গুরুদ্বারার সামনে দিয়েই বয়ে গেছে অলকানন্দা। অলকানন্দার তীরে যেতেই নদীর অভ্যন্তর হতে কেউ যেন আমাকে নদীর গভীরে যেতে আহ্বান করছে। আমি তীর বরাবর হাঁটতে লাগলাম। যেন কোনো এক মায়াবী শক্তি আমাকে সম্মোহিত করে নিয়ে যাচ্ছে তাঁর উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে।

এভাবে কতক্ষণ ধরে হাঁটছি তার হিসাব নেই। হাঁটতে হাঁটতে একটা বিরাট পাথরের সামনে পৌঁছালাম যেখান থেকে নদী ঝরনার মতো নীচের দিকে নেমে গেছে। একদৃষ্টিতে নদীর জলপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে আছি, চোখ সরাতে পারছি না অন্যত্র। যেন কোন অপার্থীব শক্তি আমাকে গ্রাস করেছে। বারবার নদীর অভ্যন্তর থেকে কেউ যেন বারবার ডেকে চলেছে “ আয়, দে লাফ! ভয় কিসের! ” আমার সারা শরীর অসাড়। কেউ যেন আমাকে বশ মানিয়ে নিয়েছে। আর কিছু ভাবতে পারছি না। খুব লাফ দেওয়ার বাসনা জাগছে। নদীর জলস্রোত যেন আমাকে তার কাছে যেতে বলছে। জলস্রোতের আওয়াজ কানে বাজছে “দে লাফ! ভয় কিসের!” এত উঁচু থেকে কেউ নদীতে লাফ দিলে বেঁচে থাকবে কিনা সন্দেহ আছে। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। লাফ দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে লাফ দিলাম অলকানন্দার জলে। নদীর জলে পড়তেই বরফসমান ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ পেলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতে জল কাটিয়ে ওপরে আসার সাধ্য নেই। শীতল জলে শরীর অবসন্ন হয়ে গেল কিছুক্ষণ নিজের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। না পারলাম না। হার মেনে নিতে হল অবশেষে। নিজের অবসন্ন দেহকে অলকানন্দের শীতল সলীলে তলিয়ে যেতে দেখছি। চিৎকার করবার শক্তি নেই। জলে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। একবার নিজের প্রিয়জনদের ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে এল। সমগ্র দেহটা আস্তে আস্তে জলে তলিয়ে যাচ্ছে এমন সময় একজনের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, “পাজী, চলিয়ে নিকালতে হ্যাঁয়।” চোখ খুলে দেখি আমি তখন গুরুদ্বারার সেই কক্ষে যেখানে রাত্রে আশ্রয় নিয়েছিলাম। স্মার্ট ঘড়িটা বের করে দেখলাম ভোর তখন আন্দাজ চারটে বেজে ত্রিশ মিনিট হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্ব 

ট্রেকিং টুওয়ার্ডস্‌ ঘাঙারিয়া 

ঋতুচক্রানুসারে বর্ষাকাল তখন মধ্যগগনে। তবে বর্ষার বৃষ্টির কোনো দেখা নেই। কলকাতাতে বরাবরই প্রচণ্ড গরম। এখানে কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, সারাবছরই বাতাসে আগুন ঝরতে থাকে। সারাবছরই কলকাতাতে আবহাওয়া খুব গরম, উত্তপ্ত। এবছর ও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। দিন দিন প্রবল তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টির অভাবে লোকজনের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠছিল। এসময় একটু চেঞ্জ না হলে জীবনটা বড্ড শুক্‌নো, তিতকুটে বেমানান লাগে। এইজন্যই বোধহয় হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে পড়ে; কেউ বা চলে যায় নদীমাতার কোলে, কেউ বা বজ্রসম পাহাড়ের বুকে, আবার কেউ জঙ্গলে জঙ্গলে খুঁজে বেড়ায় বেঁচে থাকার রসদ। এভাবে প্রকৃতির সন্ধানে বেরিয়ে কত রোমঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী হয় তারা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকৃতির খুব কাছে গিয়েও তার দেখা পায় না, কেউ বা আবার না চাইতেই পেয়ে যায় প্রকৃতির গুপ্তধনের রহস্য। আজ, এরকমই একটি গল্প শোনাব।

সেবার কোথাও কাওকে কিছু না জানিয়ে হরিদ্বারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে, একরাত কাটনোর পর মনে ট্রেকিং এর বড়ই বাসনা জেগেছিল। ভালো ভালো জায়গা কিছুতেই মাথাতেই আসছিল না। কয়েকঘণ্টা চিন্তা ভাবনা করার পর বদ্রীনাথ যাবার জন্য মনস্থির করেছিলাম। সেই অনুযায়ী ভোরেই রওনা হয়ে গিয়েছিলাম হরিদ্বার থেকে। শুনেছিলাম বদ্রীনাথ যেতে গেলে গোবিন্দঘাটের ওপর দিয়ে যেতে হবে। গোবিন্দঘাট থেকে প্রায় ষোলো থেকে আঠারো কিমি দূরে হেমকুণ্ড সাহেব, ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স নামক সুন্দর সুন্দর দর্শনীয় স্থান যে আছে তা আগে থেকেই গুগল করে দেখে নিয়েছিলাম। কিয়ৎ বিচার বিবেচনা করে ভাবলাম ট্রেকিং এর সুযোগ যখন পাচ্ছি তা হাতছাড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কাজেই মনের রসনা তৃপ্তির জন্য ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা লাভ করতে চাইলাম। গোবিন্দঘাট থেকে হেমকুণ্ডের দূরত্ব খুব বেশি না হলেও পথ এত চড়াই-উতরাই যে একদিনে ট্রেকিং সম্ভব ছিল না। সেকারণে, সকলেই গোবিন্দঘাট থেকে হেমকুণ্ড এবং ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সের উদ্দেশ্য যাত্রা করলেও আলটিমেটলি ঘাঙারিয়াতেই বেস ক্যাম্প করে থাকে। বদ্রীনাথ যাবার পথে, তাই, গোবিন্দঘাটেই নেমে পড়লাম। সেখানে গুরুদ্বারাতে একরাত আশ্রয় নিয়েই পরদিন ভোর চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ পাড়ি দিয়েছিলাম ঘাঙারিয়ার উদ্দেশ্যে।

বলা প্রয়োজন যে, ঘাঙারিয়া উত্তরাখণ্ডে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম, যেটির অবস্থান ভ্যুন্দার গঙ্গা এবং পুষ্পবতী নদীদুটির সঙ্গমস্থলে এবং সেখান থেকেই নদীটি লক্ষ্মণ গঙ্গা নামধারণ করে বয়ে গিয়ে গোবিন্দঘাটের কাছে মিশেছে অলকানন্দা নদীতে। ভ্যুন্দর উপত্যকার সর্বশেষ গ্রাম যেখানে মানুষের বাস আছে, তা হল এই ঘাঙারিয়া। আয়তনে গ্রামটি এত ক্ষুদ্র যে একে পাড়া বলতে গেলেও দশবার ভাবতে হয়। সে যাইহোক, অতি ক্ষুদ্র হলেও এটি উত্তরাখণ্ডের একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ স্থান এই কারণে যে, এশিয়া মহাদেশের একটি বিশেষ স্বনামধন্য গুরুদ্বারা (হেমকুন্ড সাহেব) তা এই ঘাঙারিয়া থেকে মাত্র ৭ কিমি দূরেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই গুরুদ্বারাতে তীর্থ করতে আসে, আবার ট্রেকিং এর আনন্দ উপভোগও করে। যাকে বলে একযোগে রথ দেখা কলা বেচা। তাছাড়া, উত্তরাখণ্ডের ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স জাতীয় উদ্যান নামক অন্যতম আরও একটি প্রসিদ্ধ স্থান এই পথেই। ঘাঙারিয়া থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে পুষ্পউপত্যকার প্রায় ৮৮০০ হেক্টর জুড়ে এই ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স জাতীয় উদ্যান অঞ্চলটি বিস্তৃত হয়ে রয়েছে। সেকারণে, হেমকুন্ড সাহেব এবং ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্ক ট্রেকিং এর বেস ক্যাম্প হিসাবে ঘাঙারিয়া বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছে।

যাইহোক, ট্রেকিং-এর পরিকল্পনা আগে থেকে ছিল না, তাই ট্রেকিং এর সরঞ্জামও কেনা ছিল না। ভোরে গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়ার দিকে রওনা হতে হবে ভেবে রাতেই গোবিন্দঘাটে ট্রেকার্স স্পট থেকে ট্রেকিং-এর জন্য সূচালো একটি বেতের স্টিক (যাকে ট্রেকিং পোল বলে থাকে), রেইন কোট এবং শীতের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ভালো একজোড়া দস্তানা কিনে নিয়েছিলাম। শুনেছি ট্রেকিং এর পথ এত দূর্গম, ঢালু আর পিচ্ছল যে ট্রেকিং পোল না নিলে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। জীবনের প্রথম ট্রেকিং যে এরকম দুর্গম ট্রেকিং পথ দিয়ে শুরু হবে তা কখনও ভাবিনি। তবে ছেলেবেলা থেকে এত কঠিন, কষ্টসাধ্য, ভয়াবহ জীবন পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি, তাই কোনো কিছুর আর পরোয়া করি না।

গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়ার দুরত্ব দশ কিমি। প্রথম দিকে সকলকে ট্রেক করেই গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়াতে পৌঁছাতে হত। কিন্তু বেশ কয়েকবছর হল উত্তরাখণ্ড সরকারের দৌলতে গোবিন্দঘাট থেকে পুলনা গ্রাম পর্যন্ত চার কিমি রাস্তা পিচ দিয়ে সুন্দর করে বাঁধাই করা হয়েছে। ইদানিং সেখানে শেয়ার ট্যাক্সি, টাটাসুমো ইত্যাদির বহুল প্রচল হয়েছে। সেকারণে, প্রথম চার কিমি রাস্তা কেউ চাইলেই টাটাসুমো কিংবা মারুতি করে অতিক্রম করতে পারেন। কেউ চাইলে পায়ে হেঁটেও যেতে পারেন। ভোর তিনটে থেকেই সেখানে কমপক্ষে প্রায় একডজন গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রী পারাপারের জন্য।

এমতাবস্তায়, ইতস্তত করছিলাম যে ট্রেকিং করে যাব নাকি গাড়িতে করে পুলনা পর্যন্ত যাব, পিছন থেকে একজন বলে উঠলেন, “পাজী চলিয়ে না, হামলোক ভি যা রহে হ্যাঁয় হেমকুণ্ড।” পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম সেই ভদ্রলোক যার সাথে আমি গুরুদ্বারার লাঙ্গুরখানাতে খাবার বিতরণ করেছিলাম। আমি আর কিছু ভাবলাম না। চেনা হাসিমুখ দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম যে যতটা গাড়িতে যাওয়া সম্ভব ততটা না হয় গাড়িতেই যাই। ট্রেকিং রুট শুরু হয়েছে যেখান থেকে সেখান থেকে না হয় ট্রেকিং শুরু করব। তাছাড়া, বাইরে ঘন কালো অন্ধকার আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসের এত উপদ্রব যে হয়তো অল্পতেই কাহিল হয়ে যেতাম।

অবশেষে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে উঠছিল সন্মুখে পাহাড়ের ওপরে। কি সুন্দর অভিভূত দৃশ্য। বাইরের নিস্তব্ধ শীতল প্রকৃতিও যেন আমাদের সাথে সঙ্গ দিয়ে চলছিল। শুধু গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই পাওয়া যাচ্ছিল না। বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস খোলা জানালা দিয়ে ছুটে এসে বরফের টুকরোর মতো মুখে ধাক্কা মারছিল। ড্রাইভার, যাত্রীদের অনুরোধে গাড়ির জানালাগুলো সপাট করে বন্ধ করে দিলেন। সামনের রাস্তা এঁকেবেঁকে অজগর সাপের মতো পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠে গেছে। ঘন কুয়াশার আস্তরণ চারিদিকে এমনিভাবে ঢেকে দিয়েছে যে দেখলে মনে হয় এ এক ঘুমন্তপুরী- এক রূপকথানগরী।

মিনিট দশ পনেরো লাগলো পুলনা গ্রামে পৌঁছাতে। ভোরের আলো তখনও স্পষ্ট ফোটেনি। তীর্থযাত্রীদের চাপে খুব ভোরেই দোকানীরা দোকান লাগিয়ে দেয়। আয়েস করে চায়ে চুমুক লাগিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন চারপাশের পাহাড়গুলির দিকে তাকাতেই মনটা ঝরঝরে হয়ে গেল। কে জানে কোটি কোটি বছর ধরে তারা এভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আমদের দেখবে বলে। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেও কোনো চূড়া ঠাওর করে উঠতে পারলাম না। দোকানীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি যে সারাবছরই পাহাড়গুলি বরফে ঢাকা থাকে। জুন-জুলাইমাসের দিকে কেবল পাহাড়ের নিম্নাংশ দেখা যায়, বাকি সারাবছর চূড়াগুলি গগনভেদ করে মেঘেদের সাথে বন্ধু জমায়। সে এক গগনচুম্বী দৃশ্য ঠিক যেন পাহাড়েরা লুকোচুরি খেলাতে মত্ত হয়েছে। রৌদ্রের আলো পড়লেই কি অপরূপ শোভা, সাদা ধবধবে তুলোর মতো লাগে তাদের। যেতে যেতে কোনো আম জনগণও যদি তাদেরকে দেখতে না চায়, তারা অবশ্যই ডেকে নেবে নিজেদের শোভার টানে।

পিঠে দুটি ভারী ব্যাগ ছিল বলে একটা পিট্‌ঠূ নেওয়া বুদ্ধিদীপ্ত হবে ভেবে এদিক ওদিক তাকাতেই একটি পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের লোক কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “পিট্‌ঠু লাগেগা?” আমি বললাম- “হ্যাঁ জী! লাগেগা।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “চার্জ কিতনা লাগেগা?” লোকটি আমার মুখের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। সম্ভবত তিনি বুঝতে পারেন নি। তাই, লোকটির কাছে গিয়ে একটু চেঁচিয়ে বললাম, “মেরেকো কিতনা দেনা পড়েগা?” লোকটি তৎক্ষণাৎ বললেন “জী স্যার! তেরাশো পচাস।” আমি বললাম, “ইতনা জ্যাদা কিউ? আপ তো মুজে লুট রহে হো?” লোকটি সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, “নহি নহি সর জী ! এহি ভাড়া ফিক্সড্‌ হ্যাঁয়। গরমেন্ট নে এহি রেট ফিক্স কিয়া হ্যাঁয়।” অগত্যা তর্ক না করে ব্যাগ দুটো লোকটির মালবাহী ঝুড়িতে তুলে দিলাম। সঙ্গে একটি পিঠ ব্যাগ খালি করে সেটাতে ফোন, চার্জার, একটা ছোটো টাওয়াল আর একটা জলের বোতল নিয়ে পিঠে চাপিয়ে দিলাম। বাকি সব মালপত্র পিট্‌ঠুর পুঁটলিতে তুলে দিলাম।

আমাদের যাত্রা শুরু হয়ে গেল। লোকটি বয়সে অনেক প্রবীণ হলেও গায়ের শক্তিতে যেকোনো তরুণকে যে মিনিটে ধরাশায়ী করে দিতে পারে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। এত ভারী বোঝা নিয়ে যে কেউ এত দ্রুত হাঁটতে পারে তা একে না দেখলে বিশ্বাস হত না। পাহাড়ে চড়তে না চড়তে প্রচুর জলটান হতে লাগল। ব্যাগে থাকা জল শেষ হয়ে গেল। তৃষ্ণার্থ হলে লোকটিকে ডেকে বোঝা নামিয়ে জল পান করতে হচ্ছিল। আমি লোকটিকে বাবা বলে সম্বোধন করতে লাগলাম। কিছু দূর একসাথে পথচলার পর জিজ্ঞেস করলাম, “বাবা, চায়ে পিয়েঙ্গে? চলিয়ে আগে ধাবা পে রুকতে হ্যাঁয়?” পাহাড়ে দশ মিনিট ট্রেক করার পর বুঝলাম আমার হাঁটার গতিবেগ কমাতে হবে নইলে কষ্টের শেষ থাকবে না। আমার সঙ্গে থাকা পিট্‌ঠু আমাকে সচেতন করে দিয়ে বললেন, “সর! ট্রেকিং কে টাইম হড়বড়িসে মত যাইয়েগা। গালতি সে প্যার রাং ইস্টেপ হো যায়েগা তো বহুত মুসীবত আ যায়েগা। তব চলনা হি মুশকিল হো যায়েগা।” আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে মনে করিয়ে দিলাম যে সামনের ধাবাতে যেন তিনি দাঁড়ান।

আরো মিনিট পনের যাবার পর সামনে একটা ধাবা দেখে মালপত্র নামিয়ে দোকানীকে বললাম চা দিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে দোকানী স্টীলের দুটো গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “অর কুছ চাহিয়ে স্যার?” আমি বললাম “বাবাজি কো থোড়া বিস্কিট খিলাইয়ে জী।” দোকানী তাই করলেন। চা খেতে খেতে আমি কৌতুহলবশতঃ জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আপ কনসা গাঁওসে হো বাবাজি?” তিনি চা’য়ে চুমুক দিয়ে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, “মেরা নাম বাহাদুর হ্যাঁয়। মে নেপাল সে হু সর।” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা! ইধর আপ কাহা রেহেতে হো?” তিনি বললেন, “হোটেল মে রেহেতা হু সর। খানেকা টাইম উধর সে হি খা লেতে হু।” কিছুক্ষণ কথোপকথন হল। জানতে পারলাম যে তার পরিবার নেপালেই থাকে। বছরের যে তিনমাস এখানে বরফ থাকে না সেই তিনমাসে পর্যটকদের মালবহন করে মাসে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশহাজার টাকা কামিয়ে দেশে ফিরে যায়। শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমদের দেশে বিএ এমএ পাশ করে হাজার-হাজার, লাখ লাখ ছেলে মাসে দশ পনেরো হাজার টাকার চাকরি পাচ্ছে না, যে কোনো কাজের জন্য তারা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইনি বলেন কি মাসে ত্রিশ-চল্লিশ হাজারেরও বেশি টাকা কামিয়ে থাকেন। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম।

কিছুপর, দোকানীকে বিল জিজ্ঞেস করতেই বললেন ষাট(৬০) টাকা। আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না। দুটো চা আর দশ টাকার এক প্যাকেট বিস্কিট বলে কি ষাট টাকা। যাইহোক, দোকানীকে চায়ের মূর্ল্য দিয়ে আবার চলতে লাগলাম দুজনে। নিঃশব্দে দুজনে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা চড়াই উতরাই পথ চলছি। অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙে বাবাজির কথাতে, “সর! ইহাঁ পে আইসাহি চলতা হ্যাঁয়। হামলোগোসে এ লোক জিতনা লেতে হ্যাঁয়, বাহার সে আয়ে হুয়ে লোগো সে উসকে ডবল লে লেতে হ্যাঁয়। জ্যায়সে কি চায়ে হামলোগে সে দশ করকে লেতে হ্যাঁয়।” আমি বললাম, “ঠিক হ্যাঁয়! চলিয়ে।”

দশ মিনিট করে হাঁটি আর একটু করে রেস্ট নিচ্ছিলাম। সঙ্গে যেসব শুকনো খাবার ছিল সেগুলোই দুজনে খাচ্ছিলাম। তবুও কিছুতেই খিদে মিটছিল না। লোকটিকে বললাম, “আপ কুছ খায়েঙ্গে বাবাজি? রোটি সবজী কুছভি?” তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন, “জী সর! আপ জো বোলে। লেকিন আভি ত বহুত রাস্তা বাকি হ্যাঁয়। এক কাম করতে হ্যাঁয় অর থোড়া চলতে হ্যাঁয় উসকে বাদ আগে মেরা জান প্যাইচান এক ধাবা হ্যাঁয়, ওহি পে খায়েঙ্গে।” আমি বললাম, “ঠিক হ্যাঁয়।”

আবার পথ চলা শুরু হল। যত সামনের দিকে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম তত পথযাত্রীদের ভীড় কমতে লাগল। পাহড়ের চূড়ার মেঘ ভেদ করে অল্প অল্প করে রৌদ্রের কিরণ আসতে লাগল। কি সুন্দর দৃশ্য তা ভাষায় বর্ণিত করা সম্ভব নয়। সূর্যের আলো সবুজ গাছে পড়তেই মনে হচ্ছিল যেন চারিদিকে কেউ বিশাল সবুজের পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে যে ঝরনা ধারা নিম্নে সমভূমির দিকে ধাবিত হয়েছে রৌদ্রের পরশে তা স্বচ্ছস্ফটিকের চেয়েও স্বচ্ছ লাগছিল। ঠিক যেন হাস্যোজ্জ্বল হিরে। মনে হচ্ছিল যেন ওপর থেকে কোনো ঐশ্বর্যের দেবতা নলাকার বিশাল হিরের চাঁইগুলোকে ছুঁড়ে দিয়েছে নীচের দিকে। পাথরের আঘতে সেই হিরে ভেঙে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ঝরে পড়ছে আর তা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে হাজার মশালের অসম্ভব সূন্দর এক জ্যোতিপ্রভা। পাখি-পক্ষীসব মুগ্ধ হয়ে সেই রূপোলী আলোর দিকে তাকিয়ে। সবুঝ ঘন জঙ্গলও যেন অবিভূত হয়ে সেই অপরূপ সৌন্দার্য উপভোগ করছে কোটি কোটি বছর ধরে।

বেশ কিছুক্ষণ একটানা পাহাড় চড়ার পর প্লাস্টিকের ছাউনি করা একটা খাবারের হোটেলে পৌছালাম। বাবাজি হাত নেড়ে নেপালি ভাষায় একে অপরকে অভিবাদন জানাল। দোকানী তাঁর ইশারাতে অভ্যস্ত। অতঃপর, তিনি আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার! ক্যা লেঙ্গে আপ?” আমি বাবাজিকে জিজ্ঞেস করলাম “বাবাজি আপ ক্যা খানা চাতে হো?” তিনি বললেন, “সর! আপ জো বোলে।” আমি তাকে আবার শুধালাম, “নুডলস্‌ চলেগা তো?” বাবাজি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে দোকানীকে দু প্লেট নুডলস্‌ আর দুটো করে ডিম সেদ্ধ ওর্ডার দেওয়া হয়। টিফিন শেষে যখন বিল দিতে যাই তখন জানতে পারি যে সামান্য ৬ টাকার নুডলস্‌ এখানে ৬০ টাকা এবং এমনকি ডিম সেদ্ধ প্রতি ত্রিশ টাকা। জিনিসপত্রের দাম পাহাড়ে অত্যধিক বেশি। আসলে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, তাদেরকে মালপত্র নিয়ে যেতে হলে গোবিন্দঘাট কিংবা তারও নীচে থেকে ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে ক্যারিং কস্ট দিয়ে কিনে নিয়ে যেতে হয়। আমাদের বরং তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থকা উচিত এই ভেবে যে পাহাড়ের এত ওপরেও, সমতলভূমি থেকে অন্তত সতের থেকে আঠারোহাজার ফিট ওপরেও তারা সর্বপ্রকার রসদের ব্যাবস্থা করে রেখেছে।

গোবিন্দঘাট থেকে ঘাঙারিয়ার দিকে প্রায় তিন ঘণ্টা পথ অতিক্রম হয়ে গেছিল। সামনে একটা সুন্দর ব্রীজ, খুব সম্ভবত নতুন বানানো হয়েছে। ব্রীজের নীচ দিয়ে উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলেছে ঝরনা ধারা। সম্ভবত সেটি লক্ষণ গঙ্গারই স্রোতপ্রবাহ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোনো নদীর বাঁধ ভেঙে হুড়মুড়িয়ে জল ছুটে চলেছে কোনো গ্রামকে গ্রাস করবে বলে। কি ভয়ানক সুন্দর দৃশ্য। ঝরনারূপ নদীটির কলেবর তেমন প্রশস্ত ছিল না। কিন্তু জলপ্রবাহের স্রোত এত বেশি যে, চারিদিকের গভীর শূন্যতা ভেদ করে শুধু একটাই আওয়াজ আসছে- কুলুকুলু। চারপাশের পাহাড়ের গায়ে সেই আওয়াজ ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন জলপ্রবাহ একই ছন্দে বলে চলেছে “বাহে গুরু! বাহে গুরু!” একটা উঁচু পাথরের টিলা দেখে বসে পড়লাম সেই রাক্ষুসীবেশী নদীর মাঝেই। খুব কাছে থেকে নদীর কুলুকুলু ধ্বনিকে আবিষ্কার করে বাবাজিকে বললাম, “বাবাজি! আপ আগে বাড়তে রহিয়েগা। যাহা পে একঠো ধাবা মিলেগা ওহি পে ঠেহেরিজিয়েগা।” তিনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলেন।

A picture containing outdoor, water, stream, river

Description automatically generated

কতক্ষণ কেটে গেছিল ঠিক মনে নেই। তবে, একটা ভয়ানক হিংস্র চিৎকারে মোহ ভাঙল। প্রায় হাত দশ-পনের দূরে দেখলাম একটি ভাল্লুক নদীর জল পান করতে এসে আমাকে দেখে গর্জন করতে শুরু করেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শুনেছি ভাল্লুক, চিতা, হায়না এরা এই জঙ্গলে আছে। তবে দিনের বেলায় তেমন বেরোয় না। কিন্তু এ আমি কি দেখছি। দম আটকে আসছে। প্রাণবায়ুটা যেন মুখের কাছে এসে থমকে আছে। আমি একদৃষ্টিতে ভাল্লুকটির দিকে তাকিয়েছিলাম। সেও আমার দিকে তাকিয়ে। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না যে কে কাকে দেখে ভয় পেয়েছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেল। ভাল্লুকটি মনের সুখে উদরভরে জলপান করল। তারপর জড়িয়ে জড়িয়ে, সম্ভবত ওর ভাষায়, কিছু বলল আমার দিকে চেয়ে তারপর একটা মৃদু গর্জন করে চলে গেল। ভাল্লুকটি চলে গেলে প্রাণের স্পন্দন অনুভব করলাম। এ যাত্রায় প্রণটা রক্ষে হয়ে গেল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর বাবাজিকে ছেড়ে নয়; এ পথ একা চলা প্রাণহানির কারণ হতে পারে। নদীর জল চোখে মুখে দিয়ে বাবাজির উদ্দেশ্যে সামনের রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের জঙ্গলে প্রবেশ করলাম।

বাবাজি বোধহয় এতক্ষণ বহুদূর এগিয়ে গেছে। সামনের রাস্তাটা খাড়া পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে। এমন দুর্গম পথে সঙ্গে জলও ছিল না। যা কিছু খাবার পানীয় ছিল বাবাজির বড় ঝোলাটার মধ্যে। কিছুটা ওপরে উঠে আর উঠতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে। সঙ্গে জলও ছিল না। ধারে কাছে কোনো ধাবা ছিল না। রাস্তাতে কাউকে পাব সে আশাও ছিল না। দূরে একটা ঝরনা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ঝরনার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রাণ থাকবে না তা নিশ্চিত। আমি আর পথ চলতে পারছিলাম না। ভাবলাম আর একটু এগিয়ে গিয়ে সামনের বড় গাছটির ছাউনিতে আশ্রয় নেব। চোখ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সামনের সবকিছু আবছা হতে থাকল। একে একে বাড়ির লোকজনের মুখ চোখের সামনে ভেসে এল। কয়েক মুহুর্তেই মনে পড়ল এযাবৎ সঞ্চিত কিছু ভাল স্মৃতি। হঠাৎ সামনে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, সবকিছু ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। চারিদিকে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার দেখছি। পা এগোতে পারছে না, সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। মাথা কাজ করছে না। কোনোমতে অন্ধকারে হাতড়ে সামনে বড়গাছটার নীচের রেলিং ধরলাম। মুহূর্তেই গাঢ় অমানিশা নেমে এল। সবকিছু থেমে গেল চোখের সামনে…..

তৃতীয় পর্ব 

হেমকুণ্ড অভিযান

কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম মনে নেই ঠিক। যখন চোখ খুলি, তখন দেখি এক সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী আমার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছেন। তাদের হাতে একটা জলের বোতল। আমার চোখে মুখে জল। সম্ভবত ওরাই আমাকে অজ্ঞান দেখে চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা মেরে আমার সংজ্ঞা ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিছু বলবার আগে তাঁদের হাত থেকে জলের বোতলটা চেয়ে নিয়ে এক নিঃশাসে শেষ করে দিলাম বোতলের বাকি জলটুকু। তারপর যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। আমাকে দেখে তাঁরা জিজ্ঞেস করেলেন, “Why didn’t you carry water? You should carry water while trekking. Without water don’t travel even a single step in the hills.” আমি তাদেরকে শান্তস্বরে বললাম, “I was carrying water Sir. It was drained. I had adequate water, but it was with the Pittu and he was with me a few minutes before. I told him to go fast so that I could enjoy every corner of the hill and he went on. Anyway, thanks a lot to both of you.” মনে মনে ভগবানকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। এ যাত্রায় প্রাণটা কোনোক্রমে রক্ষে হয়ে গেল।

কিছুটা এগোতেই সামনের বড়ো বাঁকটা পেরিয়ে ছোটো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা ওপরে উঠে গিয়েছে পাহাড়ের বুকে। সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই ঘাঙারিয়া। প্রসঙ্গত বলে রাখি, কেউ ট্রেকিং এর দীর্ঘ পথ অতিক্রম না করেও ঘাঙারিয়াতে পৌঁছতে পারেন। তাঁর জন্য সরকার হেলিকপ্টার এর ব্যবস্থা করে রেখেছে। মাত্র পাঁচ মিনিটেই গোবিন্দঘাট থেকে যে কেউ চাইলেই পৌঁছে যেতে পারেন ঘাঙারিয়াতেই। ঘাঙারিয়া প্রবেশের মুখেই বড়ো করে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা ‘হোটেল প্রীতম’। আমার পি এইচ ডি গাইডের কথা মনে পড়ে গেল। আগে থেকে বুক করা না থাকায় মাথা গোঁজবার মতো কোনো হোটেল পেলাম না। অবশেষে ঘাঙারিয়ার গুরুদ্বারাতেই আশ্রয় নিলাম। রাত্রিটা সেখানেই খাওয়া দাওয়া করে তাড়াতাড়ি শুয়ে গেলাম। পরের দিন হেমকুণ্ড যাবার পরিকল্পনা। খুব ভোরেই রওনা হতে হবে নয়তো হেমকুণ্ডের গুরুদ্বারা বন্ধ হয়ে যাবে। এতকাছে এসেও যদি এই সুযোগ হাতা ছাড়া হয় তাহলে খুবই খারাপ লাগবে। সারাদিনের ধকলে একেবারে পরিশ্রান্ত। বিছানাতে শুতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এল।

বলে প্রয়োজন, উত্তরাখণ্ডের চমোলি জেলার অন্তর্গত এই হেমকুণ্ড সাহেব। বুৎপত্তিগত দিক দিয়ে শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়- ‘হেম’, যার অর্থ বরফ এবং ‘কুণ্ড’, যার অর্থ তালাব বা জলাশয়। অর্থাৎ হেমকুণ্ড বলতে বোঝায় বরফাবৃত জলাশয়। শিখধর্মের দশম গুরু গুরু গোবিন্দ সিং-কে উৎসর্গ করে এখানে হেমকুণ্ড সাহেব নামক গুরুদ্বারাটি স্থাপন করা হয়েছে। হেমকুণ্ড সাহেবর চারিদিকে সাতটি পর্বতশৃঙ্গ বেষ্টন করে রয়েছে। এটি গাড়োয়াল হিমালয়ের অংশ। এর উচ্চতা প্রায় ৪৬৩২ মিটার অর্থাৎ ১৫,১৯৭ ফুট। হাতি পর্বত এবং সপ্তর্ষিশৃঙ্গের বরফ গলে নিম্নে ধবিত হয়ে এই হ্রদের সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে এই ক্রিস্টাল ক্লিয়ার জল নীম্নে ধাবিত হয়ে ঘাঙারিয়ার কাছে পুষ্পবতী নদী নামধারণ করে অলকানন্দার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল এখানে একটি বরফগলা জলে সৃষ্ট হ্রদ আছে যেটিতে প্রায় সারাবছর জল জমে বরফ হয়ে বরফের হ্রদ রূপ ধারণ করে থাকে। কেবল জুলাইয়ের শেষ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত এই তিন মাস এখানে জল দেখতে পাওয়া যায়। তাও আবার জলের ওপরে হাল্কা একটা বরফের স্তর থাকে প্রায়শই। শিখধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস এই হেমকুণ্ডে দুব দিলে সব পাপ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। কথিত আছে যে মহাদেবের জটা থেকে গঙ্গা ধাবিত হয়ে হেমকুণ্ডে মিশেছে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এই স্থানটি প্রসিদ্ধ হবার পিছনে আরো একটি কারণ হল এখানে লোকপাল লক্ষণ মন্দির অবস্থান করছে যেটি হিন্দুধর্মাবলম্বীমতে অন্যতম পবিত্র স্থান। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে এই স্থানের উল্লেখ আছে। হিন্দুশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, লক্ষণ যখন যুদ্ধকালে মেঘনাথের দ্বারা নিহত হন তখন রাম, সুগ্রীব এবং বজরং-এর সহায়তায় তাঁকে এই স্থানেই লুকিয়ে চিকিৎসা চালিয়েছিলেন। অমর সঞ্জীবনী দিয়ে লক্ষণকে বাঁচিয়ে তোলা হয়েছিল এই স্থানেই। কখনও কখনও এমন বলা হয় যে লক্ষণকে হত্যা করার পর মেঘনাথ এই লোকপাল হ্রদেই তপস্যায় মগ্ন হয়েছিলেন তাঁর প্রায়শ্চিত্ত করতে। আবার পুরাণ অনুসারে বলা হয় যে সত্য যুগে স্থিত চরিত্র যে শেষনাগ তিনি এই লোকপাল লেকেই বাস করতেন। রাজা পাণ্ডুর যোগাব্যাসের স্থল হিসাবেও এই স্থান প্রসিদ্ধ। এছাড়াও লোকপাল হ্রদকে কেন্দ্র করে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর নানা যুগে নানাবিধ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় হিন্দু শাস্ত্রাদিতে।

রাত তখন ১টা হবে বোধহয়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। গুরুদ্বারার টিনের চালে ছপছপ করে বৃষ্টি পড়ছিল এক অদ্ভুত আওয়াজ করে। বুঝলাম আর ঘুম হবে না। দেখলাম সব তীর্থযাত্রীরাও জেগে গিয়েছেন। অনেকের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রস্তুত। তাপমাত্রা প্রায় ৬/৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। বৃষ্টিতে ঠাণ্ডাটা আরও বেড়ে গেল। আমি তাদের মনের জোর এবং দৃঢ়তা দেখে ভীষণভাবে বিস্মিত হলাম। এই হিমেল রাতে অন্ধকার জঙ্গলের পথ দিয়ে ভোরের মধ্যে গুরুদ্বারাতে পৌঁছাবে বলে তাঁরা যাত্রা শুরু করে দিয়েছেন। এদিকে বৃষ্টি থামারও কোনো লক্ষণ নেই। টানা একটা বা তার আগে থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখে চলেছি। বাবার সাথে ভিজে ভিজে মাঠে কাটানো শৈশবের অনেক স্মৃতিই এসে ভিড় করে বসছিল। কিন্তু, মনে চিন্তার কোনো ছাপ নেই এই ভেবে যে হয়তো ভোর ৩ টা বা ৪ টায় বৃষ্টি থেমে যাবে এই আশস্ত বোধ করে।

ভোর তিন টায় অ্যালার্ম বাজতেই সজাগ হয়ে গেলাম। মুষলধারে তখনও বৃষ্টি পড়ে চলেছে অনবরত। থামবে বলে তো মনে হচ্ছে না। গতিবেগ ক্রমশ বেড়েই চলেছিল। মনে মনে ভাবছিলাম আজ বোধহয় আর বেরোনো যাবে না। একটা দিন পুরো নষ্ট হয়ে যাবে। আবার ভাবলাম এই বৃষ্টির রাতে ষাট-সত্তর বছরের বৃদ্ধারা যদি যেতে পারেন তাহলে আমি কেন পারবো না। পঞ্চুটা(রেইন কোর্ট) চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অবশেষে। ভোর তখন আন্দাজ মত তিনটে বেজে ত্রিশ বা চল্লিশ হয়েছে। গুরুদ্বারা থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। আমি বৃথা ভয় পাচ্ছিলাম। কয়েক শ তীর্থযাত্রী ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। কেউ কেউ চলেছেন খচ্ছরের পিঠে। কেউ বা পিটঠুর পিঠে। বাইরে অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে দেরিতে সন্ধ্যে হয় ঠিকই, কিন্তু সকালের অলো ফুটতে দেরি লাগে না। ভোর চারটে থেকে সোয়া চারটের মধ্যে সকালের আলো মুখ তুলে চেয়ে ওঠে। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে হেমকুণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। ঘাঙারিয়া থেকে হেমকুণ্ড ৭ কিমি। রাস্তা প্রচণ্ড চড়াই। বেশিরভাগ জায়গা খাড়া ওপরে উঠে গেছে হেমকুণ্ডের দিকে। বৃষ্টিতে ছপ ছপ করে পা ফেলে সামনের দিকে এগোচ্ছি। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে চলেছে একই ছন্দে। মাঝে মাঝে দূরে ঘোড়া বা খচ্ছরের চিঁহি চিঁহি আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দই পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও ঝরনার জলের আওয়াজ কানে আসছে।

দিনের আলো ক্রমশ অনাবৃত হচ্ছে। তীর্থযাত্রীদের ভিড়ও ধীরেধীরে বেড়ে চলেছে। এই কনকনে শীতের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যেতে দেখা যাচ্ছে দু একজনকে। বুকের পাটা আছে বলতে হয়। কতটা ওপরে উঠলাম তা ভালোভাবে ঠাওর করতে পারলাম না। নীচে পুষ্পবতী নদী বয়ে চলেছে একমনে, একপ্রবাহে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছি কতটা পথ অতিক্রান্ত হল। সম্ভবতঃ বেশি পথ অতিক্রম হয়নি। সবেমাত্র মিনিট চল্লিশ কি পঞ্চাশ হল হাঁটছি। রাস্তা প্রচণ্ড চড়াই। খাড়া হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। সূর্যিমামার দেখা পেতে আর বেশি বাকি নেই বোধহয়। মনে হচ্ছে যেন রাস্তা শেষ হবার না। এদিকে বৃষ্টির কারণে ঠাণ্ডা বাড়তে শুরু করছে। হাত জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে। আঙুলগুলো হাল ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। ভাগ্যিস সঙ্গে একজোড়া দস্তানা ছিল। আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা গাছের ছাওনি তে ব্যাগ নামিয়ে দস্তানা দুটো আঙুলে ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। দু একটা খেজুর, কিসমিস, কাজু, আখরোট খেয়ে আবার হেমকুণ্ডের অভিমুখে পা চালোনা শুরু হয়ে গেল। যত সামনের দিকে চড়ছি রাস্তা তত বেশি খাড়া। জুতো মোজা ইতিমধ্যে ভিজে ছপছপ করছে। রাস্তা খাড়াই হলেও পাথর বিছানো, কাজেই রাস্তা বানানোর হ্যাপা নেই। তবে বৃষ্টিতে পাথরে একবার কেউ পিছলে পড়লে একেবারে গভীর খাতে। সম্পূর্ণ ধীর সন্তর্পণে ধৈর্য সহকারে চলতে হবে।

হেমকুণ্ড যাবার পথে ঘাঙারিয়া থেকে দু কিমি অন্তর অন্তর খাবারের হোটেল অর্থাৎ ধাবা পাওয়া যায়। সমস্ত তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে এই কল্যাণময় পদক্ষেপ। প্রায় ১৪০০০ থেকে ১৫০০০ ফিট ওপরেও ধাবা। কল্পনা করতে পারছেন? এত ওপরে উঠে ও কেউ চাইলে মনের ইচ্ছে মতো নুডলস্‌, বাটার টোস্ট, ওমলেট, চা, কফি ইত্যাদি খেতে পারেন। তবে অবশ্যি মূল্য তিনগুণের থেকেও বেশি। দু ঘণ্টা পথ চলার পর খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করতে লাগল, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। বৃষ্টির মধ্যে ডার্ক চকোলেট বের করে খেয়েছিলাম তা বেশিক্ষণ পেটে টিকলো না। মজার বিষয় হল, পানীয় জলের কোনো অভাব নেই। যত্রতত্র ক্ষুদ্রবৃহৎ ঝরনা বয়ে গিয়েছে। ক্রিস্টাল ক্লিয়ার জল। অত্যন্ত সুস্বাদু, পানের যোগ্য। পিপাসা পেলেই ঝরনার জলে চুমুক লাগিয়ে মন ভরে মিষ্টি জল পান করছি। অবশ্যি একজন প্রৌড়কে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম পূর্বেই।

এদিকে বৃষ্টি একই ছন্দে গেয়ে চলেছে “টুপটাপ…..”, “টুপটাপ…..”। জানি না আজ হয়তো আর থামবে না। সকালের আলো ফুটলেও চারিদিক মেঘের চাদরে ঢেকে আছে। বেশি দূরে সামনে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রৌদ্রের আলো মেঘের আড়ালে খেলা করছে হয়তো। পঞ্চুর গরমে ভিতরের পোশাকআশাক ভিজতে শুরু করেছে। এভাবে আরও ১ ঘণ্টা কেটে গেছে। ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটা বাজে। সামনের টিলার ওপরের ধাবা থেকে ডিমটোস্টের গন্ধ সজোরে নাকে এসে ধাক্কা মেরে খিদেটা বাড়িয়ে দিল। খাবারের সুঘ্রাণে শরীরও হাল ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। কোনোক্রমে অর্ধজব্দ শরীরটাকে সামনের ধাবা পর্যন্ত টেনে তুললাম। চেয়ার গুলো সারি সারি পাতা। খাবারের মেনু কার্ড ধরানো আছে প্রত্যেকটা টেবিলে। রেইন কোর্ট খুলে উলের জ্যাকেটটা ব্যাগে নিয়ে নিলাম। ভেতরের গেঞ্জিটা ভিজে ছপছপ করছে। সেটা পালটে নিলাম। দু মিনিট ধাতস্থ হয়ে নিয়ে দোকানী কে বললাম, “পাঁ জী ফটাফট দো বাটার টোস্ট অউর চা লাগা দিজিয়ে। জলদি কিজিয়ে বহত ভুক লগা।” দোকানী বলল, “ জী স্যার, দো মিনটো মে দে রহা হু মে। আপ ব্যাঠিয়ে। বাস দো মিনিট।” খেয়ে দেয়ে শরীর চাঙ্গা অনুভব করলাম।

বিশ ত্রিশ মিনিট পর যাত্রা শুরু হল পুনরায়। বৃষ্টি স্তিমিত হয়ে এসেছে। পথযাত্রীদের আনাগোনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বৃষ্টির মধ্যে কেউ ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছাতা মাথায় চলেছে হেমকুণ্ড সাহেব। কেউ বা “বাহে গুরু, বাহে গুরু” ধ্বনি দিতে দিতে নগ্নপদে একাগ্র চিত্তে হেঁটে চলেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে একদল মানুষের সাথে আলাপ হল। তারা পাঁচ ভাই বৃদ্ধা মাকে কাঁধে তুলে নিয়ে চলেছে। কথা বলে জানতে পারলাম যে তাদের মায়ের ইচ্ছে মৃত্যুর আগে যেন তিনি হেমকুণ্ড দর্শন করতে পারেন। কিছু চ্যাঙ্‌ড়া ছোঁড়া স্পীকারে সজোরে গান শুনতে শুনতে পথ অতিক্রম করছে। এক শিখ পরিবারের সাথে পরিচয় হল। তাঁদের মধ্যে থেকে একজন বৃদ্ধা পিটঠুর পিঠে চলেছেন, বাকিরা পায়ে হেঁটে। ওদের থেকে জানতে পারলাম তার বাবার শেষ ইচ্ছে হেমকুণ্ড সাহেবের হেমকুণ্ডে স্নান করে পূজো দেওয়া।

মেঘ কেটে যেতেই দেখতে পেলাম তখনও বহু পথ বাকি। বৃষ্টির কারণে বহুবার থামতে হচ্ছে। প্রায় সকলেই তাই করছেন। কিছু মানুষ যাঁরা রাত্রে বেরিয়েছিলেন তাঁরা একে একে ফিরছেন। এদিকে যত ওপরে ওঠছি ততই এবড়ো খেবড়ো পাথার। কয়েক সেকেণ্ডের ভুল জীবনহানির কারণ হয়ে উঠতে পারে। একমনে হেঁটে চলেছি তখন। মনে হল যেন কেউ আমাকে পেছন থেকে ডাকছে। কিন্তু এই অচেনা শহরের ভিড়ে আমাকে আবার কে ডাকবে। আমি তোয়াক্কা না করে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এবার স্পষ্ট কানে এল, “ও বাঙালী বাবু, থোড়া রুকিয়ে তো।” গলাটা চেনা চেনা লাগছে যেন। ভিড় কাছে আসতেই দেখলাম রাম। ঘাঙারিয়া আসার পথে আলাপ হয়েছিল ওর সঙ্গে। হেমকুণ্ডের পথেও সঙ্গী জুটে গেল। রামের বাড়ি হরিদ্বারে। একটা প্রইভেট অফিসে সে চাকরি করে, যখন মনে হয় নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। ভীষণ ভ্রমণপ্রেমিক মানুষ। আমাকে বলল, “I was calling you when I saw from the down. But you didn’t see me for a single time. Well, tell me how are you walking so fast in the hill?” সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বাহে গুরু সব দেখ লেঙ্গে। ইস টাইম থোড়া ধিরে সে চলিয়েগা। পেহেলে চা পি লেতে হ্যায় আগে ধাবা সে। উসকে বাদ ফোটো খিচতে খিচতে সাথ মে জায়েঙ্গে।” আমি বললাম “ঠিক হ্যায় জী। লেকিন মে বচপন সে হি অ্যাইসা; থোড়া ফাস্ট ওয়াকার।” সে আমার পিঠে হাত চাপড়িয়ে বলল, “বহত বড়িয়া, লেকিন পাহাড়োমে হামেসা ধিরে চলনা চাহিয়ে।” আমি সম্মতি জানিয়ে মৃদু হাসলাম। দুজনে বৃষ্টিতে গল্প করতে করতে হেমকুণ্ডের উদ্দেশ্যে হাঁটছি। যেখানে শর্টকার্ট পাচ্ছি দুজনেই সেই পথ ধরছি। শর্টকার্টের রাস্তা বড় ভয়ানক। একেবারে খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। পাথরগুলো আলগা, অত্যন্ত পিচ্ছিল। এখানে যেকোনো মূহুর্তেই লেগ ফ্রাকচার, কিংবা লিগামেন্ট ক্রাক ইত্যাদি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বৃষ্টিতে এসবের সম্ভবনা আরো ব্যাপক। বৃষ্টির মধ্যে বাইরের দৃশ্য আমাকে আকৃষ্ট করছিল। ফোনটাকে যতটা বাঁচিয়ে ছবি তোলা যায় সেই প্রয়াসই করছিলাম। কোথাও দুই বন্ধু ছুটে পথ অতিক্রম করি, কোথাও আবার ভীষণ সন্তর্পণে আলগা পাথরের ওপর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে চলি। কি সুন্দর দৃশ্য। এ যেন মেঘেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলা। কখনও চারিদিক মেঘে ঢেকে ফেলে তো আবার কিছুটা উঠতেই সব পরিষ্কার। পাহাড়ি পাখিরা মিষ্টি সুরে গান গেয়ে চলেছে সারাদিন। না আছে কোনো পিছুটান, না আছে কোনো কাজের প্রেসার।

ভাগ্যিস হাতকভার ছিল সঙ্গে, নয়তো এতক্ষণে হাত ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে যেত। মোজা-জুতো ভিজে চপচপ করছে। পা দিয়ে ঠাণ্ডা ওপরে উঠছে। তারই মাঝে মাঝে দমকা হাওয়ার বেগ ঠাণ্ডাটা বাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। দুই বন্ধুতে একটু চা খেয়ে বিশ্রাম করে নিলাম। আবার পথচলা শুরু। নীচে পুষ্পবতী নদীটিকে সাদা সরু সুতোর মতো লাগছিল। সামনে তখনও অনেক পথ। তবে আন্দাজমতো অর্ধেকের বেশি পথ অতিক্রম করে গিয়েছি। সামনে দূরে একটা দীর্ঘ সাদা প্যাচ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বড়সড় ঝরনা নীচে নেমে গেছে। জলের ফ্লো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সাদা চাদরের বিছানা লাগছে। ছ রাউণ্ড দিয়ে ওপরে উঠলে তারপর বোঝা যাবে ওটা আসলে কি।  কিছুপর সেই স্থানে পৌঁছালাম। এতক্ষণে পথচলা সার্থক। যেটিকে দূরে থেকে ঝরনা মনে হচ্ছিল তা বিরাট এক গ্লেসিয়ার। কী অপূর্ব আনন্দ হচ্ছিল সে বলে বোঝানো যাবে না। সমস্ত কষ্ট সার্থক। খুব কষ্ট হচ্ছিল এতক্ষণ। সাদা চাদরের বিছানার স্পর্শ পেয়ে কি অপার তৃপ্তি। এই অনুভূতি কেবল যে আমার একার তা নয়। সকলেই যারা এতটা পথ অতিক্রম করে এখানে আসছেন আবেগে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছেন। সেটা তাদের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে। সকলে চিৎকার করতে করতে ছবি তুলছে। বিভিন্ন পোজে ছবি নিচ্ছে। কেউ বা গ্লেসিয়ার এর ওপর রেইন কোর্টসমেত শুয়ে পড়ে ছবি তুলছে। শত আনন্দের মূহুর্ত ছেলেমানুষি বোঝে না, শুধু বোঝে আনন্দই। ট্রেকিং পোল দিয়ে বরফের ওপর মেরে দেখলাম একটা অন্যরকম আওয়াজ। জল জমে পাথরের থেকেও শক্ত হয়ে আছে। এরই নীচে দিয়ে একটা ঝরনা ব্যাপক উচ্চস্বরে আওয়াজ তুলে নীচে ধাবিত হয়ে গিয়েছে। সকালের রৌদ্রের হাল্কা হাল্কা যতি গ্লেসিয়ারে পড়তেই এক অন্যরকম দৃশ্য। চোখে না দেখলে এই সৌন্দার্যকে বিশ্বাস করা যায় না। সে এক দারুণ অনুভূতি, ভাষায় প্রকাশ করা প্রায়শই অসম্ভব। পাহাড়গুলো যেন সাদা চাদর পেতে তোমাকে আহবান করে অপেক্ষা করে যাচ্ছে কোটি কোটি বছর ধরে। গ্লেসিয়ার থেকে ধোঁয়া (বাস্প) বেরিয়ে যাচ্ছে ওপরে, ঠিক যেন ছেলেবেলার ধোঁয়া ধোঁয়া খেলছে।

যাইহোক, পথ যেন শেষই হচ্ছে না। প্রাকৃতিক সৌন্দার্য উপভোগ করতে করতেই পথ চলছি। কিছুপর গুরুদ্বারার আওয়াজ কানে আসতেই মনে খুশির ফোয়ারা বয়ে গেল। কিছু পথিক কে জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা বললেন আর মিনিট দশ পনের লাগবে। আমরা আনন্দে ছুটতে লাগলাম। খানিকটা পথ গিয়ে একটা শর্টকার্ট নিলাম। ত্রিশ মিনিট হয়ে গেল। নীচে থেকে মনে হচ্ছে এই তো এসে গেছি। কিন্তু কৈ ? কোথায় গুরুদ্বারার ফটক ? কোথায় হেমকুণ্ড সাহেব? অধৈর্য হয়ে একজন পথিককে শুধালাম, “স্যার জী হেমকুণ্ড সাহেব আউর কিতনা বাকি হ্যায়?” তিনি বললেন, “আ হি গয়া, বাস দশ মিনিট চলতে রইয়েগা।” বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। তবে, আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। কলকলিয়ে বৃষ্টি এল বুঝি। হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম পাথরের মধ্যে দিয়ে সাদা সাদা অদ্ভুত ফুলগুলো উঁকি দিচ্ছে। সব পথচারী ঝুঁকে পড়ে ছবি তুলছে, ফুল ছিঁড়ছে। জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম যে ওগুলো ব্রহ্মকমল ছিল। পথের দুদিকে হাজার হাজার ব্রহ্মকমল ফুটে রয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে এদের উল্লেখ আছে। ব্রহ্মের নাভি থেকে সম্ভবত এদের জন্ম হয়েছে বলে এঁরা ব্রহ্মকমল। তবে, এবিষয়ে বিজ্ঞানীরা ভিন্নমত পোষণ করেন।

বেশ খানিকটা পথ অতিক্রম করতে গুরুদ্বারার পূজার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এল। সামনের বড়ো বাঁকটা অতিক্রম করতেই দেখা গেল দুদিকে দুটি রাস্তা চলে গিয়েছে হেমকুণ্ড সাহেবের দিকে। একটি খাঁড়াই সিঁড়ি আর একটি পাথুরে পথ। কয়েক হাজার সিঁড়ি হবে। সিঁড়ির মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেক। কোনো পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিকে এইদুর্গম পথে দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ সকলেই পাশের পথটি দিয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছেন। সচরাচর শক্তিসামর্থ্য যুবক ছাড়া বেশি কেউ এই পথ আরোহণ করেন না। আমি আর রাম ঠিক করলাম যতই কষ্ট হোক আমরা সিঁড়ি বেয়েই উঠব। একটি সিঁড়ি থেকে দ্বিতীয়টির উচ্চতার ব্যবধান প্রায় দু থেকে আড়াই ফুট। রীতিমতো বিরতি নিয়ে নিয়েই অতিক্রম করতে হচ্ছিল। মেঘের আবরণে চারিদিকে ঢাকা। যেন শেষই হচ্ছে না আর। এদিকে দুজনে কাউন্ট করে চলেছি। অবশেষে প্রায় নয় নয় করে নশ ছিয়াত্তর ( মতান্তরে তিরাশী) টা সিঁড়ি টপকে অনেক কষ্টে হেমকুণ্ড পৌঁছালাম।

পাগড়ী ছাড়া কোনো গুরুদ্বারাতেই ঢোকা নিষিদ্ধ। একটি রুমাল সংগ্রহ করে মাথায় বেঁধে নিলাম। রাম শিখধর্মাবলম্বী হলেও তার কোনো পাগড়ী ছিল না। সেও একটি রুমাল সংগ্রহ করে মাথাতে জড়িয়ে নিল। হেমকুণ্ডে পৌঁছানোর পর প্রত্যেকে প্রথমে হেমকুণ্ডের লোকপাল লেকের বরফগলা জলে স্নান করে পবিত্র হয়, তারপরে পূজাদি কাজকর্ম সারে। এই বৃষ্টির দিনে তাপমাত্রা কমে ৫/৬ ডিগ্রিতে এসেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম স্নানাদি কর্ম থেকে বিরত থাকব, কিন্তু আয়নার মত স্বচ্ছ জল দেখে লোভ আর সংবরণ করতে পারলাম না। একে সারাদিন ভিজছি, তারওপর এই বরফগলা জলে স্নান। ভবিতব্যে কি অপেক্ষা করছে না ভেবেই গামছা পড়ে নেমে গেলাম সেই কনকনে ঠাণ্ডা বরফগলাজলে। একসাথে পাঁচটা ডুব দিয়ে চোখ খুলতে দেখি সামনে ভীড় উপচে পড়েছে। তারা আমার স্নান করা দেখছে আর বাহবা দিচ্ছে “বাহে গুরু। বাহে গুরু।” আমি উৎসুক হয়ে আরো পাঁচটা ডুব দিয়ে উঠে আসি। জল থেকে ওপরে আসতেই প্রচণ্ড কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। সে ভয়ানক রকমের কাঁপুনি। টাওয়াল দিয়ে গা মুছে নিয়ে তিন চার দফা গরম পোষাক পরেও কোনো মতেই কিছু হচ্ছিল না। যতদূর মনে পড়ে এরকম অবস্থা আমার জীবনে আগে কখনও হয় নি। কাঁপতে কাঁপতেই গুরুদ্বারার ভেতরে প্রবেশ করলাম। রাম যে কোথায় গেল তাকে আর দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ কেটে গেল। শরীরের বাহ্যিক কম্পন সম্ভবত থেমে গেছে। ঠাণ্ডাতে মাথাটা প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। গুরুদ্বারা থেকে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, দেখে খুব ভালো লাগছে। খুব সম্ভবত চমোলি জেলার কোনো একটি স্থানীয় চ্যানেল রোজই সকাল দশটা থেকে বারটার পূজো কভার করে থাকে।

পূজো সেরে গুরুদ্বারার ভেতরটা ভালো করে একবার ঘুরে নিলাম। পাশেই প্রাচীন লোকপাল লক্ষণ মন্দির ছিল। প্রণাম সেরে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলাম। সন্ধ্যে নামার আগেই ফিরে যেতে হবে। অনেক পথ অতিক্রম করে জাঁকিয়ে ক্ষিধে পেয়েছে। লঙ্গুরখানাতে তীর্থযাত্রিদের প্রসাদ বিতরণ পর্ব চলছে। গরম গরম খিচুড়ি। একবাটি খিচুড়ি প্রসাদ খেয়ে একটু চাঙ্গা বোধ করলাম। গায়ে তখন সম্ভবত ১০৩/১০৪ জ্বর। কিন্তু নীচে নামতে হবে। সারাদিন বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। ১টার মধ্যেই সকলকে গুরুদ্বারা থেকে রওনা দিতে হবে। দুপুর একটার পর আর কারও থাকার নিয়ম নেই। কারণ গুরুদ্বারাতে কোনো তীর্থযাত্রীকে থাকার অনুমোদন নেই। অগত্যা গায়ে জ্বর নিয়ে নামার পথে রওনা দিলাম।

চতুর্থ পর্ব 

ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের দেশে

হেমকুণ্ডের বরফগলা জলে গোটা দশেক ডুব দেওয়াতে সাঙ্ঘাতিক কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। সেকারণে একদিনে দুটো ট্রেক করার মনোবাঞ্ছা ত্যাগ করতে হল। তবে, হেমকুণ্ড সেরে একদিনেই ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স ট্রেক করা সম্ভব। আমার সাথে যাঁরা রাত্রে হেমকুণ্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই গুরুদ্বারের পূজো সেরে সকাল সকাল নীচে নেমে ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের দিকে রওনা হয়েছেন। সম্ভবতঃ সন্ধ্যের মধ্যেই তাঁরা ফিরে আসবেন। ঘাঙারিয়া থেকে উত্তরের দিকে দুদিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে- বাঁদিকের টা ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স এবং ডানদিকের টা সোজা ওপরে উঠে গেছে হেমকুণ্ড সাহেব। ঘাঙারিয়া থেকে ৫কিমি দূরে ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স। যেখান থেকে ভ্যালির রাস্তা শুরু হয়েছে তা থেকে প্রায় ৭ কিমি জুড়ে ভ্যালির সর্বত্র বিস্তৃত হয়ে আছে রংবেরংয়ের সুন্দর সুন্দর হরেকরকম ফুলে। গায়ে এত জ্বর নিয়ে আমার যাওয়া উচিত হবে না ভেবে দুপুর-বিকালের দিকে নেমে এক নিঃশ্বাসে গুরুদ্বারার আশ্রয়গৃহে পৌঁছালাম। কোনো মতে কাঁপতে কাঁপতে ফ্রেশ হয়ে একটু গরম চা খেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম কিছুতেই আসছে না। কাঁপুনি বাড়ছে। সঙ্গে মেডিসিন ছিল। দু একটা বিস্কিট খেয়ে একটা প্যান ফর্টি, একটা পি ৬৫০ আর একটা মন্টিকোপ-এ ট্যাবলেট খেয়ে আবার কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙতে দেখি বাকি শরণার্থীরা খেয়েদেয়ে নাক ডাকাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে কেঊ কেঊ ফোন ঘাটছে, কেউ বা আবার ফোন করে পরিবারের বাকিরা যাঁরা আসতে পারেননি তাঁদেরকে হেমকুণ্ড অভিযানের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ ইতিমধ্যে ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স ঘুরে এসেছে, হেমকুণ্ড সাহেব ট্রেকের পরিকল্পনা করছে। ফোনটা অন করে দেখি ঘড়িতে তখন রাত নটা তেইশ। ততক্ষণে গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেছে। খিদেই পেট চোঁ চোঁ করছে। ভালো রকমের আহার দরকার। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে তখনও। ছাতাটা নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখি বেশিরভাগ ধাবা ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। পাহাড়ের জীবন এক্কেবারে অন্যরকম। পাহাড়ে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যায় আর অনেক কাকভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সূর্য্যিমামা জাগার অনেক আগেই প্রায় সকলেই জেগে যায়। পাখিরাও খুব ভোরে ভোরে নিজেদের গলার রেওয়াজ শুরু করে দেয়। ওদের মধ্যে কেউ কেউ আবার খুভ ভোরেই একে অপরের সাথে ঝগড়াঝটি আরম্ভ করে দেয়, কেউ আবার ভোরেই প্রেমালাপ শুরু করে দেয়, কেউ বা নতুন নতুন বন্ধু পাতায়। সত্যিই সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। শহরে বাবুরা এই অপার আনন্দের কিই বা বুঝবে। যাদের ৮ টা বা ৯ টা না বাজলে ঘুম ভাঙে না তারা এই সুন্দর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হবে কী করে।

মিনিট দশ-পনেরো এদিক ওদিক করে যখন তেমন কিছু পেলাম না, তখন অগত্যা গুরুদ্বারার সামনের রেস্তোরাঁ থেকে গরম গরম কেশর মালাই দুধ, গোটাকয়েক গোলাপজাম আর রাবড়ী দিয়েই রাত্রভোজন সেরে নিলাম। পেটে খাবার পড়তেই চোখ ঘুমে ঢুলে এল। এবার একটা লম্বা ঘুমের দরকার। গুরুদ্বারের মন্দিরের ভেতরটা তখন ফাঁকা কেবল দু একজন একমনে ধ্যান-আসনে বসে আছেন। আমি লোভ সামলাতে পারলাম না। এর আগে যতবার ভেতরে যাবার চেষ্টা করেছি অসম্ভব রকমের ভীড় ছিল। এখন একেবারে ফাঁকা। চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে নানারকম সুগন্ধাদি দ্রব্যের সৌরভে বাতাস ভরে আছে। সামনে একটা সমাধি বানানো সেটাই গুরু গোবিন্দ সিং এর বেদী। মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে তাঁর অমৃতবাণী, শৈশব, কৈশর ও যৌবনের কতকগুলি চিত্র, শিখ ধর্মের মূল্যবান কিছু গ্রন্থাদি প্রদর্শন করা। ভিতরে প্রবেশ করতেই পরম শান্তি অনুভব করলাম। সে এক অকল্পনীয় শান্তি। সে শান্তি যে কেবল নিস্তব্ধতাময় শান্তি তা ঠিক নয়; সে যেন এক সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ অনুভূতি, সে যেন এক চাওয়া-পাওয়া বিযুক্ত শান্তি, সে এমনি শান্তির অনুভূতি যে শান্তি প্রতিটি মানুষের কাম্য, সে যেন এক বিশ্বজাগতিক শান্তি। মন্দিরের ভেতরে এতকিছুর মধ্যেও যেন কিছুই নেই, সবকিছু থেকেও না থাকার অনুভব হচ্ছে। বোধহয় বাকিরাও এমনই অনুভব করছেন। গুরু গোবিন্দ সিং এর মূর্তিতে প্রণাম করে আসনে বসলাম। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে তা ঠিক মনে নেই। মন্দির থেকে যখন বাইরে বেরিয়ে আসলাম তখন শুধু অলৌকিক অপারজাগতিক স্বজ্ঞাবোধের কিছু সংস্কার উদ্বুদ্ধ হচ্ছিল। অনেক রাত হয়েছে। পরের দিন ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের উদ্দেশ্য রওনা দিতে হবে। সুতরাং বেশি রাত না করে নিদ্রামগ্ন হওয়ায় বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ভ্যালির উচ্চতা প্রায় ৩৬৫৮ মিটার। চমোলী জেলার পশ্চিম হিমালয়ের ভ্যুন্দর উপত্যকার এবং পুষ্পবতী নদীগর্ভের প্রায় ৮৭.৫০ স্কোয়ার কিমি স্থান জুড়ে বিস্তৃত হয়ে আছে এই ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স ন্যশনাল পার্ক। দৈর্ঘ্যে ৮ থেকে ৯ কিমি এবং প্রস্থে ২ থেকে ২.৫ কিমি বিস্তৃত। ১৯৩১ সালে তিনজন ব্রিটিশ পর্বত আরোহী নিয়ে ফ্রাঙ্ক এস. স্মাইথ, এরিক শিপ্টন এবং আর. এল. হোল্ডস্‌ওর্থ এই পথেই পাড়ি দিয়েছিলেন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দার্যে অবিভূত হয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে এই স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং পরে স্থানটিকে “ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স” নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তীকালে ‘ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স’ স্থানটিকে জাতীয় উদ্যানরূপে ঘোষণা করা হয় ১৯৮২ সালে। “এটি এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট” নামে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছে। অসংখ্যা ছোটোবড় ঝরনা আর দু একটা রূপোলী সাদা হিমবাহ চাদরের মতো জড়িয়ে রেখেছি ভ্যালিকে। স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস একসময়ে এই ভ্যালিতে পরীরা বাস করতেন। তাঁরা এখনও বলে থাকেন যে, কেউ একবার ভ্যালিতে গেলে আর ফিরে আসে না; পরীদের দ্বারা বন্দী হয়ে যায়।

ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্কে কম করে ৭০০ থেকে হাজার প্রজাতির ফুল ফুটে থাকে। প্রাকৃতিক উপায়েই সৃষ্ট তারা। বছরের কেবল কয়েকসপ্তাহেই তারা ঝরে যায়। মূলতঃ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ফুলেদের দেখা পাওয়া যায়। সেসময় সমস্ত ভ্যালি আসম্ভব সুন্দর বিচিত্র লাখো লাখো কোটি কোটি ফুলে ভরে থাকে। এই সৌন্দার্য পৃথিবীর অন্য কোথাও কেউ পাবে না। এই স্থানকে ওয়ার্ল্ড অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স বললেও ভুল বলা হবে না। এখানে Blue Poppy, Doggy face flowers, Thyme, Cheerful Senecio, Cinquefoil, Cosmos flaunts, Wild Rose, Cobra Lilly, Brahma Kamal, Lax Willowherb, Bog Star, Inula Grandiflora Grey stem spirea, Himalayan knotweed, Erigeron (sunflowers type) ইত্যাদি হাজার হাজার ফুলের সমাবেষ দেখতে পাওয়া যায়। কেবল কয়েক দিনের জীবনশৈলী নিয়ে তারা আবির্ভূত হয় এই ধরণীতে।

 একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলাম পরের দিন। তেমন কোনো তাড়াহুড়োর দরকার নেই। কারণ, ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের পথ শুনেছি তেমন দুর্গম নয়। তেমন চড়াই-উতরাইও পাওয়া যাবে না বোধহয়। সকাল ৬টাই বিছানা ছাড়লাম। বরফের মতো ঠাণ্ডা জলে স্নানাদি ক্রিয়া সেরে বেরিয়ে পড়লাম তৎক্ষণাৎ। সঙ্গে ডার্ক চকোলেট আর ড্রাই খাবার তো আছেই। ঘাঙারিয়া থেকে যাত্রা শুরু হয়ে গেল ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্কের দিকে। ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্স ন্যাশনাল পার্ক পরিদর্শনের জন্য টিকিট মূল্য ১৫০ টাকা। প্রবেশের পথেই লম্বা ভিড় দেখে শঙ্কা হল ঠিক টাইমে ফিরতে পারবো কি না। হাজারে হাজারে মানুষ চলেছে ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের শহরে। বিশ ত্রিশ মিনিট লাইন অতিক্রম করে টিকিট সংগ্রহ করে যাত্রা শুরু করলাম। প্রবেশদ্বার থেকেই রকমারি অপূর্ব সুন্দর ফুলেদের ভিড় শুরু হয়ে গেল। প্রবেশের মুখে এবড়োখেবড়ো পাথরের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে ভ্যালির দিকে।

ব্লু পপি থেকে শুরু করে বগ স্টার ইত্যাদি ফুলেদের হাট চারিদিকে। মৃদুমন্দ বাতাসে তারা আন্দোলিত হচ্ছে। হাওয়ার সুরের ছন্দে নিঃশব্দে তারা গান গেয়ে নেচে চলেছে। কি অপরূপ দৃশ্য, কি আবেগী সে নৃত্য। এমনকি পিচ্চি সাইজের ফুলগুলোর শোভা এতই আকর্ষণীয় ছিল যে দুদণ্ড তাঁদের না দেখে পথ অতিক্রম করলে মনে হচ্ছিল বিশাল কিছু মিস করে যাচ্ছি। মনক্যামেরাতে বন্দী করে চলেছি একের পর এক ফুলগুলোকে। মোহান্বীত হয়ে যেন তাঁদের পিছনেই ধেয়ে চলেছি। কাউন্টার থেকে বেরিয়ে একটা টিমের সঙ্গী হয়ে গেছিলাম কিন্তু ভ্যালির সৌন্দর্যে এতই অবিভূত হয়ে পড়েছিলাম, কখন যে তারা এগিয়ে গেছে তাঁর কিছুটি টের পাই নি। পথে অবশ্যি বন্ধুর অভাব হয় নি। নেদারল্যাণ্ড থেকে আগত একটি টিমের সাথেও পরিচয় হয়। তারা কেবল ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সেই জন্যই সুদূর পথ অতিক্রম করে এসেছে। আমার তোলা ছবিতে তারা মুগ্ধ হয়ে আমাকে তাঁদের টিমের সঙ্গী করে নিল। ময়ূখ নামের একটি ভারতীয় যুবক, সেও অবশ্যি নেদারল্যাণ্ডেই থাকে, তার সাথে গভীর সখ্যতাও হয়ে যায় খুব অল্পসময়য়েই। কিন্তু যতই ছবি তুলি না কেন ছবি তোলা আর শেষ হয় না তাঁদের। “Sir please take a photo of mine.”, “this side once more……….” ছবিগোলো এত সুন্দর এতই চোখে লাগার মত ছিল যে একটা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললেই প্রত্যেককেই ঐ একই স্থান থেকে ছবি তুলতে হচ্ছিল। তবে আমি ফোটোগ্রাফার হিসাবে একেবারেই খারাপ নয়। আমার ক্ষুদ্র ফোনেই এত সুন্দর ছবি তুলি যে কেউ দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবেনা যে সেগুলি ফোনক্যামেরাতে তোলা। মজার বিষয় হল তাঁদের মধ্যে থেকে ময়ূখ নামক যুবকটির আই ফোন ফোর্টিন প্রো ছিল। কিন্তু তবু ও সে আমার কাছে এসে বার বার জিজ্ঞেস করছিল কিভাবে কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললে ছবি সুন্দর হয়। আমি তাঁকে ছবি এবং ছবি তোলা সম্পর্কে যা জানতাম রীতিমতো বিশ্লেষণ করতে থাকলাম। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক অতিক্রান্ত হল। বেশ বিরক্ত বোধ করতে থাকলাম এবার। পরীর দেশে এসে ছবি নিয়ে এত মাতামাতি করলে ভ্যালির অপরূপ মাধূর্য উপভোগ করবো কখন। আমি তাঁদের বললাম, “Guys you people carry on. I shall join you later. I’m going ahead, please excuse me.” ময়ূখ বলল “Sure Bro. You please. But you must send me all the photos you would capture.” আমি প্রত্যুত্তরে বিদায় জানিয়ে বললাম “Definitely. I will. See you later.”

সদ্য গড়ে ওঠা বন্ধুবর্গকে পিছনে রেখে ভ্যালির দিকে যাত্রা শুরু করলাম অবশেষে। সামনে বিরাট এক ঝরনা। ঝরনার জল যেন হুড়মুড়িয়ে ছুটে পড়ছে মাটিতে। এত স্বচ্ছ, এত ক্রিস্টাল ক্লিয়ার মনে হচ্ছিল যেন অগোচরে কেউ স্বচ্ছ-শুভ্র কাঁচের পাতগুলোকে ছুঁড়ে ফেলছে নীচের দিকে। সেগুলোই ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে আলোকবিন্দুর ন্যায়। এমন লাবণ্যময় দৃশ্য দেখে যে কেউ মোহান্বিত না হয়ে থাকতে পারবে না। দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। যেন এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে বেঁধে রেখেছে, ঘাড় ঘোরাতে দিচ্ছে না। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে তার হিসাব নেই। মোহের তন্দ্রা ছোটে একটা আওয়াজে— “পাঁ জী আগে চলিয়ে। আগে ভি সান্দার নজারা মিলেগা।” দর্শনার্থীদের মধ্যে থেকে কেউ আমাকে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সম্ভবত এমন মন্তব্য করে চলে গেলেন। একটু এগিয়ে যেতেই একটা অতিব সুন্দর লোহার সেতু চোখে পড়ল। সেতু অতিক্রম করেই ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের দেশে পৌঁছাতে হবে। সেতুটির নীচে প্রবাহিত হয়েছে ভ্যুন্দর গঙ্গা যেটি ঘাঙারিয়ার কাছে পুষ্পবতী নদীর সাথে মীলিত হয়ে লক্ষণ গঙ্গা নাম ধারণ করে বয়ে গেছে গোবিন্দঘাটের দিকে। সেতুটি অতিক্রম করে জঙ্গলের পথে প্রবেশ করলাম। সামনের পথ খুব চড়াই-উতরাই। বড়ো বড়ো করে হিন্দি হরফে লেখা ছিল “আগে সে রাস্তা চড়াই হ্যায়।” পরবর্তী দু থেকে প্রায় তিন কিমি রাস্তা এমন চড়াই। একজন স্থানীয়কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে রাস্তা নদীর তীর বরাবরই ছিল, সে রাস্তা এত চড়াই-উৎরাই ছিল না, বিগত বছর ল্যাণ্ডস্লাইড হওয়ার কারণে সে রাস্তা এখন বন্ধ। কয়েক মাস ধরে নতুন রাস্তা বানানো হচ্ছে এবং সমস্ত দর্শনার্থী সেই পথেই চলেছে। পাথরগুলো ভালো করে আঁকড়ে বসেনি তখনও। একটু ভুল হলেই গড়িয়ে যেতে হবে গভীর খাতে। পরবর্তী কয়েক কিমি খুবই সচেতনতার সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। কিছু আগেই স্থানীয় পিটঠুদের একজন বলে গেল কয়েক দিন আগেই বনদপ্তরের কর্মীরা চীতা, হায়না আর একটা বাঘ ছেড়ে গেছে ঐ জঙ্গলে। গা ছম ছম করছে। কেমন একটা অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার ফীল হচ্ছে। মনে মনে চাইছি কোনো একটা বন্য প্রণীর দেখা পেতে। কিন্তু নিরাশ হতে হল। একটু এগিয়ে যেতেই লক্ষ্য করলাম এক অদ্ভুদ তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। আমার খুবই কাছে থেকে আওয়াজ ভেসে আসছিল, খুব সম্ভবত কোনো পাখির আওয়াজ টাওয়াজ হবে হয়তো। আশেপাশে, সামনে-পিছনে হন্যে হয়ে খুঁজলাম। কিন্তু না, কোনো পাখী তো দূরের কথা, কিছুই চোখে পড়ল না। হতাশ হয়ে বসে পড়লাম রাস্তার একপাশের পাথরের ওপর।

ব্যাগ থেকে ড্রাই ফ্রুট আর ডার্ক চকোলেট বের করে খেয়ে নিলাম। দু মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার পথচলা শুরু হয়ে গেল। দুপাশে অতীব সুন্দর ছোট বড়ো ফুলের সারির মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি। পৃথিবীতে এত সুন্দর সুন্দর ফুলও যে হয় তা ভ্যালিতে না আসলে বিশ্বাস হত না। এত বিচিত্র ফুলের হাট বসেছে। এ যেন পরীর দেশে চলে আসলাম। যতদূর চোখ যায় শুধু চারিদিকে ফুল আর ফুল, হাজার হাজার রংবেরঙ্গের ফুলে ছেয়ে আছে সর্বত্র ভ্যালি। এদের একটিও আগে কখনো দেখিনি। কোনো কোনো ফুলের সাথে সদৃশ কোনো ফুল দেখে থাকলেও ভ্যালিতে যে ফুল গুলো কয়েক দিনের জন্য ফোটে সেগুলো পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে তো মনে হয় না।    

কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম সেরে পাশের ঝরনা থেকে মন ভরে জলপান করে নিলাম। যাত্রা শুরু হল আবার। ভ্যালিতে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ছে। পাশাপাশি দুজন যাওয়া যাচ্ছে না। ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। দূরে থেকে মনে হচ্ছে সামনের দিকে একটা জায়গা লোকজমায়েত হয়েছে। কাছে যেতেই দেখতে পেলাম একদল লোক হুমড়ি খেয়ে নীচে একটা জিনিসের দিকে তাকিয়ে আছে। খুব সম্ভবত কিছু একটা পড়ে গিয়েছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম স্থানীয় পিটটু একজন ভদ্রমহিলাকে কাঁধে করে ওপরে তুলে নিয়ে আসছে। ভদ্রমহিলাকে দেখে বুঝলাম বাঙালী। সপরিবারে ভ্যালি দেখতে এসেছিলেন ওঁরা। আলগা পাথরে পিছলে পড়ে খাতের দিকে গড়িয়ে পড়েছিলেন। নীচে একটা গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আটকে গেছিলেন বলে রেহাই। নয়তো বেঘোরে প্রাণ হারাতে হত। ভালো রকম আহত হয়েছেন তিনি। সর্বাঙ্গে তাঁর ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে। কয়েকজন মিলে হাতাহাতি করে টেনে তুললেন তাঁকে। আমার ব্যাগে ভলিনি স্প্রে ছিল দিয়ে দিলাম এবং তাঁকে রেস্ট নিতে বললে ভ্যালির দিকে এগিয়ে গেলাম।

ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের যাত্রাপথে বহু বাঙালীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। নানা কথোপোকথনের মাধ্যমে জানতে পারি যে কেউ জীবনের শেষ ইচ্ছে পূরণের লক্ষ্যে এসেছে এই ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের দেশে। তাছাড়া কোলকাতা থেকে আগত বেশ কয়েকটি টিমের সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিচয় হয়ে যায়। এক অন্যরকম অনুভূতির সাক্ষী হয়ে থেকে যায় ভ্যালির উদ্দেশ্যে যাত্রা। হয়তো কিছুদিন পর ব্যস্ত শহরে নিমজ্জিত হয়ে যাবো, কাজের প্রেসার মাথার ওপরে আসবে, অথবা হয়তো নতুন কোনো স্থানে নতুন কোনো ভ্রমণের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ হবে, কিন্তু ভ্যালি অফ্‌ ফ্লাওয়ার্সের সৌন্দার্য চির জীবন অন্তরে থেকে যাবে, থেকে যাবে হৃদয়ের মণিকোঠায়, থেকে যাবে মনের গহিনে।

ঘণ্টাখানেক এভাবে ওপরের দিকে উঠতে থাকি, কখনো পাথরের মধ্যে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করতে হয়, তো কখনো অচেনা অজানা গাছের মধ্যে দিয়ে রাস্তা বানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছিল। বেশখানিকটা পথ অতিক্রান্ত হবার পর রাস্তা নীচের দিকে ধাবিত হয়ে গেছে। পাহাড়ে নীচে নামাটা শারীরিক দিক দিয়ে তেমন কষ্টকর না হলে ও হাঁটু বা গোড়ালি ক্রাকের সম্ভবনা প্রবল। খুব সন্তর্পনে না নামলে যেকোনো মুহূর্তেই পা খোইয়াতে হবে। ধীরে ধীরে পা মেপে রাস্তা অতিক্রম করে অবশেষে ভ্যালিতে পৌছালাম। চারিদিকে লাখো লাখো লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা ফুলের মেলা বসেছে। মৌমাছি থেকে শয়ে শয়ে প্রজাপতির দল ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে চলেছে। তাদের আর কোনো অভাব নেই। যেফুলে ইচ্ছা সেই ফুলেই মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য, চোখ জুড়িয়ে গেল। এত প্রজাপতি একসাথে জীবনে কখনো দেখিনি। নাকে এক অপরিচিত গন্ধ অনুভব করলাম। খুব সম্ভবত বিচিত্র ফুলের বিচিত্র শোভা একসাথে মিশে গিয়ে এই অদ্ভুত রকমের সুঘ্রাণের সৃষ্টি করেছে মনে মনে বললাম-

তুঝে জিতনা তারীফ করু বহ ভী কম পড় যায়ে

চাঁদনী কী খুব সুরতী ভী তেরে পাস ফীকে হো যায়ে…

সমাপ্ত

1 thought on “গোবিন্দঘাটে একরাত

  1. বাহ্ সুন্দর লেখা এবং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা মন ছুঁয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *