তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায়: আট
এই শীতল মরুভূমির পার্বত্যাঞ্চলের জলবায়ু চরম ভাবাপন্ন, দুটি ঋতুর প্রকটতাই প্রকাশিত হয়। একটি হল ভারতীয় গ্রীষ্মকাল, যা জুন মাসের মধ্যভাগ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে আগস্ট মাস থেকেই শীতের দাপট শুরু হতে থাকে। তার আগের মাসগুলিতে, অর্থাৎ গ্রীষ্মে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পনের ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে শূন্যে নেমে যায়, একথা আগেই বলা হয়েছে। তবুও সেটাই গ্রীষ্মকাল, ইউরোপ মহাদেশের অনেক অনেক দেশের মত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি বা শেষসময়ে এই পার্বত্য মরুপ্রান্তরের হিমশীতলতায় যুক্ত হয় অন্য বিপদ, স্পিতি নদীর নিম্নধারায় সমতলীয় প্রান্তরে বা আরও পরে এই উপনদী যেখানে গিয়ে মিলেছে শতদ্রুর সঙ্গে সেই কিন্নর জেলাতে প্লাবন ডেকে আনে এবং তাতে অনেক জীবন ও সম্পদহানি ঘটে। তাছাড়া শতদ্রুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিও বিপর্যস্ত হয়। তবুও এই সময়টাতেই উপত্যকা বাসযোগ্য এবং তখনই মেষপালকরা চলে আসে এখানে, আসে শৈবাঙ্কনও কাছাকাছি কোন না কোন জনবসতির শীতকালীন আশ্রয় ছেড়ে। গ্রীষ্মে বন্যা হয় হিমবাহগুলি বা কাছেপিঠের অন্যান্য দীর্ঘদেহী পার্বত্য চূড়াগুলির বরফ গলতে থাকে বলে, সেই বরফগলা জল স্পিতির নিজস্ব উপনদী বা খালগুলি বয়ে আনে, স্পিতি নিজেও তার উৎস বা দু’পাশের প্রাচীন হিমবাহগলা জলে পুষ্ট হতে থাকে। শীতকালটা বেশ লম্বা হয় এখানে, ব্যাকরণগত ব্যাখ্যায় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। গ্রীষ্মে বৃষ্টি হয়না যেহেতু এটি হিমালয়ের বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে জাঁস্কার পর্বতমালার শেষভাগে অবস্থিত। তবে গ্রীষ্মে বা শীতে দুটি সময়েই এই উপত্যকায় চলে পশ্চিমি ঝঞ্ঝার প্রবল দাপট এবং শীতে প্রচণ্ড তুষারপাতও ঘটে। এ সমস্ত কিছুই এই নদীমাতৃক উপত্যকাটিকে শৈত্য পার্বত্য মরুভুমিতে পরিণত করেছে।
এখানে আসার পর তার একদিন স্পিতি নদীর সঙ্গে কথা বলার সাধ হয়েছিল। মানুষের সঙ্গে আর নদীর সঙ্গে কথা বলার উপায়টি মোটামুটি অভিন্ন হলেও প্রক্রিয়াগত কিছু পার্থক্য আছে। প্রথম বিষয় হল এই যে নদীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা যায় না, তার সঙ্গে টেক্সট করে বা মেসেজ পাঠিয়েও কথা বলার ভাবনা হাস্যকর। বৈদ্যুতিন মাধ্যম বাদ দিয়ে লোকের সঙ্গে কথা বলি যখন সেই গোটা লোকটি সামনে উপস্থিত থাকে, তার গোটাটাকেই দেখা যায়। কেউ কেউ গাছ বা পশুদের সঙ্গে কথা বলে জানি যদিও এ দু’টি বস্তুরই কোন ভাষা নেই। ভাষা থাকে বা না থাকে, কোন বড় গাছের সঙ্গে কথা বলতেও কিছু আটকায় না, কারণ যত লম্বাই হোক না কোন গাছ তার গোটাটাকেই এক জায়গায় স্থির হিসেবে পেতে পারি। কিন্তু বহু গাছে ভরা বিশাল জঙ্গলের সঙ্গে কথা বলা যায় কি ? যায় না, কারণ তার ব্যাপকতা একটা ব্যাপার, পুরো জঙ্গলের সমস্তটা মানুষ কোন এক নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাবে না। তেমনি ব্যাপার ঘটবে কোন একটি নদীর ক্ষেত্রেও। নদী তো অনেক লম্বা। তার সর্বাঙ্গ গল্প করার সময় কিভাবে গোটাটা সামনে হাজির থাকবে ? তাই নদীর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হলে তার চলার পথ ধরে চলতে হয়। তাহলেই জানা যাবে তার উৎস বা শেষ এবং তার গতিপ্রকৃতি। নদীর সঙ্গে তার গতিপথ ধরে চলতে চলতে যত খুশি গল্প করা যেতেই পারে, তাতে গোটা নদীটাকে চেনা যাবে, জানা যাবে তার স্বভাবচরিত্র ও মনের কথা। সেটি করা যেতে পারে দু’ভাবে, হয় কেউ উৎস থেকে নদীর পার ধরে হেঁটে হেঁটে যেতে পারে তার সমাপ্তি পর্যন্ত আর নয়তো জলযানে চেপে কেউ চলতে পারে নদীর বুক ধরে, তার সঙ্গে গল্প করতে করতে দিনরাত। তবে স্পিতি নদীর ক্ষেত্রে এ দু’টি পদ্ধতির দু’টিই অসম্ভব। শতদ্রুতে মেশার আগে স্পিতি তার উৎস থেকে গোটা উপত্যকা ধরে ও তার বাইরে চলেছে প্রায় একশ’ চল্লিশ কিলোমিটার, যেখানে উপত্যকাটির দৈর্ঘ্য মোটামুটি একশ’ ত্রিশ কিলোমিটার। সমগ্র পরিক্রমায় সে নেমেছে প্রায় ছ’ থেকে সাত হাজার ফিট, প্রতি কিলোমিটারে এই নামা গড়ে প্রায় ষাট ফিট। এই পরিস্থিতিতে নদী এতটাই খরস্রোতা যে নৌপরিবহনের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। আর নদীর পার ধরে চলা যাবে না কেন ? তার প্রধান কারণ, উর্দ্ধগতিতে কিছু অঞ্চল বাদ দিলেও এই নদীর দু’পারে রয়েছে খাড়া কঠিন পাহাড়ের গা, শক্ত পাথরের গা প্রবল ধারায় কেটে স্পিতি নিজের চলার পথ করে নিয়েছে সুগভীর গিরিখাত বানিয়ে। নদীর কাছে যাওয়া তাই গোটা পরিক্রমায় অল্প কিছু এলাকা বাদ দিলে অসম্ভব।
তবুও একটা কথা সত্যি। বনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সারা বন ঘুরে বেড়ায় খুব কম লোক, অধিকাংশ মানুষ বনের এক ছোট এলাকায় ভ্রমণ করতে করতে বা বনের কোন এক সীমান্তে তার আয়ত্তাধীন অংশটুকুতে দাঁড়িয়ে গোটা বনের সঙ্গে আড্ডা মারতে পারে, সেখানে আড্ডা আরও জমবে যদি মানুষ পড়ে জেনে নেয় বনটির ভৌগোলিক চরিত্র বা বর্ণনা। নদীর ক্ষেত্রেও এমনটাই করে অধিকাংশ লোক। তারা নদীর নাব্যতার খানিকটা অংশ ঘুরে বেড়ায় গল্প করার প্রক্রিয়ায় আর নয়তো নদীর পারে তার মুখোমুখি বসে কোন এক বা একাধিক অঞ্চলে, তার আগে নদীটির বিবরণ যদি সে গবেষক বা অভিযাত্রীদের লেখা থেকে জেনে নেয় তো আরও উত্তম। এভাবেই নদীর সঙ্গে গল্প করে সাধারণ মানুষ, গোটা নদীর দৈর্ঘ্য হেঁটে বেড়ায় না, সেসব অভিযাত্রীদের কাজ। শৈবাঙ্কনও তার উদ্দেশ্য সফল করার জন্য এমনটাই ভাবল। সে ঠিক করল, তার নাগালে যেসব অঞ্চল পাবে সে স্পিতি নদীর সেসব অঞ্চলে গিয়েই দেখবে নদীকে। আর নদীটির বিবরণ তো তার জানা গবেষকদের কল্যাণে। এই উদ্দেশ্য সামনে নিয়েই সে বেরিয়ে পড়ল একদিন।
কোথায় কোথায় গেল সে ? নদীর উৎস থেকে শতদ্রুতে পতন, এই দু’টি স্থানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে লিও গ্রামের কাছে যেখানে তার উর্ধগতি এবং সেখান থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত প্রান্তরের পথে, যে অঞ্চলে নানান জনবসতির মানুষ নদীর জল নিয়ে তৈরি করেছে কৃষিজমি। তাবো অঞ্চলে তাবো উপনদীর সঙ্গমস্থলে এবং তারও আগে নদী যেখানে যেখানে সমতল ভূমি ধরে বয়ে চলেছে। সমতল হলেও জনশূন্য অনেক অঞ্চল্য যেহেতু চাষযোগ্য নয় জমি।
এখানে দেবতাত্মার সন্ধানে এসে বাসস্থান বানাবার আগে সে এলাকার ভূতত্ত্ব আর ভূগোল জেনে নিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে এসবই ছিল দেবতা ও দেবচরিত্র সমান জনতার বিচরণ ক্ষেত্র। কৈলাশ পর্বতমালায় তখন ছিল শিবলোক যেখানে দেবাদিদেব থাকতেন তপস্যামগ্ন, কাছেই ছিল মানস সরোবর। এখন সেই ভারতবর্ষ কল্পকাহিনীর বিষয়বস্তু, শিব কোথায় আছেন কেউ জানে না। কোথায় আছেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বা স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখার দেবতা বিষ্ণু তাও জানা নেই করোও। আধুনিক মানুষ মনে করে, এসবই উপকথা।শিবধাম কৈলাশ পর্বতমালা ভারতবর্ষের সীমানার বাইরে। হিমালয়ের অন্তর্ভুক্ত সেই শিবলোক কৈলাশ চির বরফের রাজ্য, প্রাচীন ও স্থায়ী হিমবাহ তার ভিত্তি। কিন্তু এই স্পিতি উপত্যকার মালভুমি থেকে স্থায়ী হিমবাহের রাজত্ত্ব অনেক অনেক দূরে। এখানেও সুউচ্চ পাহাড় চূড়াগুলি শীতকালে আগাগোড়া বরফে ঢেকে যায়, তবে গ্রীষ্মের আগমনে আবার বরফমোচন ঘটে। তাই বছরের কিছু সময় মানুষের পক্ষে এখানে বসবাস কল্পকথা নয়। আর মানুষ কোথায় না থাকে ? চিরস্থায়ী তুষাররাজ্যে এস্কিমোরা সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।
প্রকৃতির বুকে নিজের অবস্থানে নিশ্চল থেকেও পাহাড়, পাথর, মালভূমির ঢাল, নদী, গিরিখাত ইত্যাদি বস্তুসমূহ নীরবে কোন ভাষা বোঝায়। একান্ত মনোযোগী যে প্রকৃতিপাঠক তার পক্ষেই এই ভাষার মর্মার্থ উদ্ধার করা সম্ভব। প্রথম প্রথম এখানে থাকা শুরু করার পর শৈবাঙ্কনের কিছুই মাথায় ঢুকত না, সে জানতই না এমন কোন ভাষা আছে কিনা। থাকতে থাকতে এখন তার কাছে কিছুই আর দুর্বোধ্য নয়। সে জানে, প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব অবস্থানে ওভাবে থাকার কারণ বা রহস্য। দেখলেই বুঝতে পারে কেন ঢেউখেলানো সমতলীয় মালভূমির বুকে একগুচ্ছ শিলারাশি ওই ভঙ্গিমায় বিছিয়ে আছে, কেন এই একই ভঙ্গিমা তার একটু দূরে বিছিয়ে থাকা শিলারাশির দলবদ্ধতায় নেই, পরিবর্তে সেখানে এক অন্য আয়োজন। প্রাকৃতিক সদস্যরা এভাবে নানারকম অবস্থানগত সজ্জা রচনা করে এবং তা যে বিশেষ এক লিপিমালায় লিখে রাখা মহাকাব্য বা উপন্যাস তা ইদানিং বুঝতে পারে সে। তাই সে যাত্রা করেছিল স্পিতি নদীর সঙ্গে আলাপ জমাতে, শুনতে তার দৈনন্দিন জীবনকাহিনী। তার এই উদ্যোগ অবশ্যই একদিনের ছিল না, তার জন্য গ্রীষ্মকালে প্রায় মাসখানেক সময় দিতে হয়েছিল। দিনেই চলত অভিযান, কখনও রাতের কিছুটা সময়ও চলার ইচ্ছে থেকে যেত আর সে মেনে নিত সেই মনোভাব। চড়াই-উৎরাই পথ, পাকদন্ডী বেয়ে ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে ওপরে বা নেমে এসেছে সমতলে। রাতে চলাচল অবশ্যই বিপজ্জনক অনেক জায়গাতেই। সেসব সে এড়িয়ে যেত। কয়েকবার গাড়িতেও চলেছিল ওই পরিক্রমায়। এই জাতীয় সড়ক পাঁচের একটি উপপথ, নাম জাতীয় সড়ক পাঁচশ’ পাঁচ, পুবে-পশ্চিমে চলে গেছে স্পিতিভ্যালির বুক চিরে। সেই রাস্তার একধারে উঁচু উঁচু আকাশছোঁয়া পাহাড়চূড়া ও তাদের দুর্বিনীত ঢাল এবং অন্যধারে স্পিতি নদী। সেই পথের পুরোটাই যে এমন দৃশ্যপট সাজিয়ে রেখেছে তা নয়। তাবো ভ্রমণকেন্দ্রের আগে থেকে গেছে সে প্রান্তরের বুক ধরে, অবশ্য আগেও রয়েছে স্থানে স্থানে এমনই সমতলের আভাষ। তাদের কিছু এলাকায় জনবসতি রয়েছে, কিছু আবার জনবিহীন প্রদেশ। তেমনিই কোন এক জায়গায় সে স্পিতি নদীর কাছাকাছি এলো। এখানেও নদী অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছে নিজেকে। প্রান্তর যদিও বেশ কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছে উন্নত পাহাড়চূড়োগুলিকে, তবুও সে স্বাভাবিক ঢালে নদীর সঙ্গে মিশতে পারেনি যেমন হয় প্রকৃত সমতলভূমির নিম্নগতিতে। পলিমাটির চত্বর বা সোপান সর্বত্র প্রস্তরীভূত, সেই পাললিক শিলা গতিধারার ফলায় কেটে খাত বানিয়ে চলছে স্পিতি, তাই তার পার এখানেও যথেষ্ট উঁচু এবং পাথুরে। সেখানে পারে যতটা সম্ভব ধারে দাঁড়িয়ে নিচ দিয়ে দ্রুতলয়ে বয়ে চলা স্পিতি নদীর উদ্দেশ্যে সে প্রশ্ন তুলল,
‘আচ্ছা স্পিতি বলতো, তোমার ছোঁয়া পাই কী করে ? তোমার সঙ্গে যে কথা বলার অনেক সাধ আমার। বল স্পিতি, কাছাকাছি না হতে পারলে তা সম্ভব কিভাবে ?’
তখন ভরা গ্রীষ্ম। বেলা চলেছে বিকেলের দিকে। প্রান্তরের রোদ এখনও যথেষ্ট উজ্জ্বল যদিও শীতলতা মাখানো। এই পর্যন্ত বেলায় সেই রোদ গায়ে আরাম এনে দিলেও একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে শরীর উত্তপ্ত হয়ে যায়। তবুও সে প্রশ্ন পাঠিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নদীর পারে। তার আশা, অবশ্যই নদী উত্তর দেবে। এবং দিলও। চপল ছন্দে প্রকাশিত হল তার ভাষা যা শৈবাঙ্কন বুঝতে পারল অনায়াসে। স্পিতি জানাল,
‘কী করব বলতো ? আমি চলেছি মালভূমির কঠিন পাথর কেটে। যত চলছি ততই খাত গভীর হচ্ছে। আমি তো সমতলের নদী নই। তবে তুমি কথা বলনা, ওখানে ওই উঁচু পাহাড়ি সোপানের ধরে দাঁড়িয়ে, উচ্চতা থেকে। আমি যতই নিচে থাকি না কেন তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারব, উত্তরও দেব, কারণ তুমি আমাকে বন্ধু ভেবেছ।’
শুনে সে আনন্দিত হয়। আবার তাই প্রশ্ন করে,
‘আচ্ছা ভাই, তুমি এই মালভুমি সদৃশ উপত্যকার বুক চলার পথ হিসেবে বেছে নিলে কেন ? কত কষ্ট করে তোমাকে যেতে হচ্ছে। অন্য কোন সহজ অবস্থানেও তো তুমি থাকতে পারতে ?’
শুনে স্পিতি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘তুমিই বা এখানে এলে কেন ? জগতে তো আরও সহজ সুন্দর বাসস্থান ছিল ?’
সে একটু হকচকিয়ে গেল প্রশ্ন শুনে। সে ভাবল, সত্যিই তো ! স্পিতি তো তার জন্য ন্যায্য প্রশ্নই তুলেছে। কী বলা যায় ভাবতে ভাবতে সে উত্তর দিল,
‘আসলে আমি মনে করি এখানে থাকলে দেবসান্নিধ্য পাওয়া যায়। এই নীরব উপত্যকা বুকে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে দেবতাদের ভাষা। আমি তা শুনতে পাই, অনুভব করি। আর সোজাকথা, আমি এই উপত্যকাকে ভালবাসি।’
স্পিতি তার বুকে পড়ে থাকা স্খলিত শিলাসমূহের আওয়াজে শোনাল তার ভাষা,
‘আমারও ঠিক এমনটাই মনের কথা। এই উপত্যকাকে আমি ভালবাসি, আর তাই এখান দিয়েই চলছি। এখানে একদিন আমি দেবতাদের আলাপ শুনতে পেতাম, দেখেছিও তাদের জীবনযাপনের আড়ম্বর। এখনও আমার গায়ে শোনা যাবে তাদের ভাষা। তুমি জানোনা, আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অনেক বৌদ্ধমঠ কী ভাবে ? তারা মনে করে, প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে যে ধর্মীয় শক্তি তা আমার জল বহন করে এবং তারা তার ছোঁয়া পায় আমার পবিত্র জলে। তুমি এই বিশ্বাসটাকে অমান্য করতে পার না। অভিজ্ঞতার মূল্য নেই ? তুমি তো জান, ধারে ধারে গড়ে উঠেছে যেসব জনপদ তারা সবাই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। সেইসব বাসস্থানে বা অন্যত্র রয়েছে বহু বৌদ্ধ মঠ। তাবো, ধনকর, রংরিক, কাজা—- কত নাম করব ? হিমালয়ের এই উপত্যকার গায়ে যত জনবসতি, তার প্রায় সবই গড়ে উঠেছে আমার ধারে। এদের মধ্যে কোন কোনটি হাজার বছরেরও বেশি পুরনো।’
নীরবে চলার ছন্দে মনের ভাষা ব্যক্ত করে স্পিতি। সে শোনে চুপ করে, বোঝে সব। সে আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করে নদীকে,
‘আচ্ছা স্পিতি, তোমার গোটা চলার পথে কোথায় তুমি সবচেয়ে সুন্দর ?’
স্পিতি সদামুখর, আত্মমগ্ন থাকলেও নীরব থাকতে জানে না। প্রশ্ন শুনে বালিকাসুলভ চাপল্যে বোধগম্য ভাষায় সে জানাল,
‘সেটা কি আমি বলতে পারি ? বলবোই বা কিভাবে ? আমি কি দেখতে পাই আমাকে ? নানা জনে দেখে তা, দেখে কে কী মনে ভাবে সেসব তাদেরই মতামত। দেখোনা, নিম্নগতিতে আমি চলেছি গভীর গিরিখাত বানিয়ে। পাকদন্ডী বেয়ে রাস্তা সেখানে উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। পাহাড়চূড়ো ঘুরে ঘুরে ওঠে রাস্তা। বহু নিচে আমি চলতে থাকি আমার মত। কেউ মনে করে, সেটাই সুন্দর। আবার এই যে পাহাড় দূরে সরিয়ে বয়ে চলেছি আমি সমতলীয় নদীর মেজাজে, তুমি শুনতে পাচ্ছ আমার নূপুরনিক্কন, দেখছ আমার জলে সৌররশ্মির ঝিকিমিকি, কারো চোখে বেশি সুন্দর এখানে এই আমি। তবে অনেকেই বলে, কাজা অঞ্চলের কী মনাস্ট্রি থেকে আমার শোভা বেশি নয়নবিমোহন, কাজা ও রংরিক অঞ্চলদুটির মধ্যবর্তী অংশ দেখা যায় সেখানে বহু দূর থেকে। তুমি সেখানে দেখতে পাবে আমার বিশাল অববাহিকা, ছোট-বড় নানা শাখা ও উপশাখা মিলিয়ে বেণীপাকানো, মনে হবে যেন জমাটবাঁধা রয়েছে।’
‘হ্যাঁ, তা আমি দেখেছি।সত্যিই তা অপূর্ব সুন্দর। একবার শীতে আমি কাজার ওই বৌদ্ধমঠে আশ্রয়ও নিয়েছিলাম। দেখতাম তোমাকে রোজই প্রায়।’
‘তবে হ্যাঁ, একথা যদিও জানো তবুও বলছি। শীতে কিন্তু সত্যিই আমার জল জমে যায়। জমাটবাঁধা নদী হয়ে থাকি আমি তখন। গ্রীষ্মেই আমার যত উল্লাস। প্রাচীন সব হিমবাহরা গলে গলে জল আনে আমার জন্য। আমার খাতে অত জল ধরে না প্রায়ই। আমি উপচে উঠি।’
‘তাতে কী বিপদ হয় তুমি সব জানো ?’
‘জানব না কেন ? খুব জানি। নিম্নগতিতে বন্যা আসে, সমভূমিতে থাকা তোমাদের জলবিদ্যুৎপ্রকল্পগুলি বেসামাল হয়ে যায়। দেখ, এই যে উপত্যকা, এ তো পশ্চিম থেকে পুবদিকে প্রসারিত। আমি চলেছি এই উপত্যকার দৈর্ঘ্য বরাবর প্রায়, মোটামুটি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। হিমালয়ের আদিম ও মূল বিচ্যুতি কারাকোরাম বিচ্যুতির সঙ্গে প্রায় সমরেখায়। এই যে জাতীয় সড়ক, মূল এন এইচ ফাইভের একটি উপশাখা, এও চলেছে আমার প্রবাহের সঙ্গে সমান্তরালে। এখানে এই যে দেখছ আমাকে প্রান্তরের বুকে, এখানে এই উপত্যকা বুঝি সবচেয়ে বেশি চওড়া, অন্তত দু’-তিন কিলোমিটার। বলতে পার, এই অঞ্চলে আমি উর্ধগতি কাটিয়ে নিম্নগতিতে এসে যাচ্ছি। প্রকৃত নিম্নগতি আমার মধ্যে আরও পরে। সেখানে উপত্যকা মাত্র এক-দুশ’ কিলোমিটার চওড়া, আমিও গভীর গিরিখাত ধরে সরুরেখায় চলেছি উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। তার আগে এখানে বা ঊর্ধ্বগতিতে আমি যাচ্ছি পুব থেকে পশ্চিমে, চওড়া বেণীপাকানো ইংরেজি অক্ষর ইউ-আকৃতির উপত্যকা ধরে। তারপর আমার মধ্যে রয়েছে একটি মৃদু সমকোণীয় বাঁক এবং তারপর প্রায় সরলরেখায় উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে এগিয়ে গিয়ে সবশেষে হয়েছি উত্তর-দক্ষিণগামী। আমার একটি উপনদী আছে পারাচু নাম। আমার মোট বিধৌত অঞ্চল ন’হাজার ছ’শ ষাট কিলোমিটার যার পঞ্চাশ শতাংশ পারাচু অববাহিকাতে।পারাচু আর আমার অববাহিকা মিলিতভাবে দৈর্ঘ্যে একশ’ পঁচাশি কিলোমিটার। নিম্নগতিতে পারাচুর সঙ্গে মিলনের পরই আমি প্রবাহিত দক্ষিণ থেকে উত্তরদিকে এবং নামগিয়া বা খাব অঞ্চলে গিয়ে ঢুকেছি কিন্নর জেলাতে। সেখান থেকে আরও চোদ্দ কিলোমিটার উজান বেয়ে পড়েছি শেষে শতদ্রু নদীতে পুঃ এলাকায়। এই যে জাতীয় সড়ক চলেছে আমার সঙ্গে এটি পৃথিবীর এক অন্যতম অত্যুচ্চ জনপথ, এর প্রধান অংশ পশ্চিম সীমার গ্রামফু থেকে পূর্ব সীমার খাব পর্যন্ত দু’শ পঁচাত্তর কিলোমিটার লম্বা। শীতকালে ছ’ থেকে ন’মাস এই রাস্তা বরফাবৃত হয়ে বন্ধ থাকে। ভ্রমণশিবির তাবো থেকে চব্বিশ কিলোমিটার দক্ষিণে সুমদো, ওখানেই খাব যেখানে আমি ঢুকেছি কিন্নর জেলাতে।’
বলেই চলছিল স্পিতি। তার কথা থামাবার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। এসব কথা সবই প্রায় জানে সে। তবুও বলতে দিচ্ছিল নদীকে, কারণ তাকে যেন কথায় পেয়েছিল। নিজের কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিল নদী, এক কথা থেকে চলে যাচ্ছিল অন্য কথায়, এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে। অগোছালো ছাপ ছিল কথা বলায়। তবুও বাধা না দিয়ে শুনছিল সে, বাধা পেলে নদী যদি আহত হয় এই ভাবনায়। শেষপর্যন্ত অবশ্য আর চুপ করে থাকা গেল না। কিছু বলার জন্য উসখুস করতে করতে একসময় বলতে বাধ্য হল সে,
‘এসব কথা সবই আমি জানি স্পিতি। তুমি বলছ অত আগ্রহ করে, তাই শুনছি আবার। কিন্তু তুমি যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলে সেখান থেকে যে সরে গেছ সেই খেয়াল আছে কি ? তুমি বলতে যাচ্ছিলে তোমার নিম্নগতিতে বন্যার কথা।’
বাধা পেয়ে থামল স্পিতি। চলছিল যেমন চলতে লাগল, কথা বলা কেবল বন্ধ রাখল কিছুটা সময়। বোঝা গেল, সে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। বলছিল খলবল করে যত তার বুকের কথা উদ্দাম আবেগের বশে, বালিকাসুলভ চপলতায়, রাশ টানা হল তাতে। চুপ করে সে কিছু ভাবছিল। তার প্রতিফলন দেখা গেল নদীর পরবর্তী ভাষায়,
‘ঠিক, আমি একটু বেশিই বলে ফেলছিলাম। খেয়াল ছিল না কী বলছি না বলছি। তুমি বলে ভালোই করলে। তবে কী জানো, যা বলছিলাম এতক্ষণ তা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক এমন নয়।তুমি জানো, সবাই তো জানে না।’
‘সেটাও ঠিক। তোমাকে থামাতে চাইনি, তোমার উচ্ছ্বলতাকে। তবুও কেন বাধা দিলাম জানো ? তুমি বন্ধু বলে। তুমি একতরফা বলে গেলে আড্ডা জমবে কী করে ? আমারও তো কিছু না কিছু বলতে হয়, তাই।’
পৃষ্ঠতলে দুরন্তগতি জলমুকুরে পড়ন্ত রোদ ঠিকরে ছটায় প্রতিফলিত, হাসল স্পিতি। হাসি তার সারা গায়ের চলনে বিচ্ছুরিত, তার দিকে না তাকিয়েও তা বোঝা যায়। হাসতে হাসতেই জানাল সে,
‘কেন আমার জলপ্রবাহ প্লাবন ডেকে আনে সেটা বুঝতে হলে এখানকার ভূপ্রকৃতি তোমাকে জানতে হবে। আমার তো মনে হয় তুমি সেসব অনেকটাই জানো। তবুও শোন। এই যে বন্যার কথা বলছ, এটা কিন্তু প্রাচীন যুগেও হত। এইসব বিপর্যয়ের প্রমাণ এখনও দেখতে পাবে উপত্যকার নানা অঞ্চলে, বিশেষ করে নিম্নগতিতে। উপত্যকার এখানে-ওখানে রয়েছে স্তূপাকৃতি পলির স্তর, পাথর হয়ে গেছে থেকে থেকে। ওগুলি আসলে প্রাচীনকালের হ্রদসমূহের সঞ্চয়। এ দেখেই বোঝা যায় কেন বন্যা হত প্রাচীনকালে। এখনও সেই ধারাই চলছে, পলিমাটির হ্রদ তৈরি হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয়। এত কথা কি একদিনে বলা যাবে ?’
নদী কথা থামিয়ে নীরবে চলতে লাগল। তার উচ্ছ্বল চলাচল ঝংকার তুলছিল তার বুকের বড় বড় বোল্ডার আর শিলাসমূহে। সে দেখছিল তার দামালপনা, নিরুচ্চারিত ভাষা শুনতে শুনতে। নদী থামলে সে বলল,
‘সেসব কথা আমিও কিছু জানি। অবশ্যই তা তোমার চেয়ে কম। তবুও যা জানি তা অনেকের চেয়ে বেশি। আমি জানি যে তোমার অববাহিকা গাঠনিকভাবে এখনও অস্থির। এখানে আছে এখন নিওটেকটোনিক বা নব্যগাঠনিক চঞ্চলতা, কারণ ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেট কাছাকাছি হয়েই চলেছে এবং তাদের সংঘাত লেগেই আছে।এই চলন মূল উত্থান বা বিচ্যুতি ব্যবস্থা বরাবর ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়াতে প্রমাণিত, তাতেই এই বিচ্যুতি রেখা বরাবর উর্দ্ধমুখী মাথা তোলা বা পুনর্গঠনের কাজ দেখা যাচ্ছে।’
‘ঠিক বলেছ।’ দুরন্ত ছন্দে চলতে চলতে স্পিতি ভাষা খুঁজে পেল, ‘তাতে কী হচ্ছে শোন।ভূমিকম্প দেখা যাচ্ছে হামেশাই, আর থাকছে ধ্বংসাত্মক ধস বা ভূমিস্খলন। এতে ধ্বংসস্তূপ পাহাড়ের খাড়াই ঢাল বেয়ে উপত্যকার তলদেশে নেমে জমে যাচ্ছে। যেসব হ্রদের কথা বললাম সেসব এভাবেই তৈরি হচ্ছে।ধসের বস্তুসমূহ এইসব হ্রদের খাতে পুরু ও মিহি পলি হিসেবে জমে খাত থেকে হিমবাহ গলা জল উপচে দেয় আর তাতেই বন্যা সৃষ্টি হয় নিম্নগতিতে। আমার হাত নেই এখানে।’
‘সঙ্গে রয়েছে আবহাওয়া জনিত প্রভাব।’ সে কথার পিঠে কথা সাজাল, ‘সেটাও আমার জানা। ঋতুকাল দু’টি, দু’টিই চরম ভাবাপন্ন। এই অস্বাভাবিক ঋতুকালে প্রকট ঋতুগত চাপও সমস্যা তৈরি করে।’
‘এখানেও আমার কিছু করার নেই।বললাম না, সুদূর বা অদূর অতীতেও এমন ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের প্রমাণ রয়েছে স্তূপাকৃতি পলিস্তরে যা প্রাচীন হ্রদের অবশিষ্ট জমাবস্তু হিসেবে উপত্যকার স্থানে স্থানে সংরক্ষিত। গঠনগতভাবে সক্রিয় এই উপত্যকার ভূপৃষ্ঠ আলগা ও অসংহত পলিজনিত ঢাকনার স্তর যা এখানকার জলবায়ু ও ক্রিয়াশীল গাঠনিক শক্তির সামান্য পরিবর্তনে ধ্বংসাত্মক হতে পারে। তেমনটাই হয়েছে শতদ্রুর নিম্নধারায় ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণে, যেখানে বর্ষাকালে জলস্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত চল্লিশ ফিট উঁচু হয়ে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এখানে এই উপত্যকার বুকেও আমার জলপ্রবাহ সবকিছু ভাসিয়ে দিয়েছে। আমাকে এখন দেখলে কি তোমার মনে হবে আমি এমন কাণ্ড ঘটাতে পারি ?’
উচ্ছ্বল আর চঞ্চল স্পিতির চলাচল, কলহাস্যে মুখরিত তার সারা অঙ্গ, চপলতা প্রকাশিত শুভ্রধবল ফেনিল সরোষ উল্লাসে—- দুরন্ত দুর্নিবার স্রোত যখন বাধাহীন চলমান থাকতে গিয়ে বাধা পায় বুকে জমা বড়-মাঝারি বোল্ডারে, খণ্ডবিখণ্ড ছোটখাট নুড়ি পাথরকে তো মুঠো মুঠো করে গুচ্ছে গুচ্ছে স্রোতপ্রাবল্য ছুঁড়ে ফেলে এদিকে-ওদিকে যেদিকে খুশি, তারা দলবদ্ধভাবে চলন্ত গতিধারার দু’পাশে জমতে জমতে অলংকৃত হতে থাকে। স্পিতি চলে আপন খেয়ালখুশিতে ভ্রূক্ষেপহীন, তাকিয়ে দেখে না কোনোকিছু—- কী শোভা তার চলাচল অঙ্গভূষণ করে তুলল নিজের বা উপত্যকার বুকে সামগ্রিক কী আবেশ কী প্রভাব রচনা করল। স্পিতি সেসব দেখে না, নীরব থাকে, চলে উন্মত্ত প্রবল ধারায় আপন মনে আপন আনন্দে। কিন্তু জানে না কি ? অবশ্যই জানে আর জানে যে তার প্রমাণ পেল সে এখন নদীর সঙ্গে আত্মগত কথোপকথনে। সে ধ্যানস্থ হয়ে উপবিষ্ট স্পিতির উঁচু পাথুরে পারে পড়ন্ত বেলার সৌরসম্ভাষণের আদরে এবং বলে,
‘আমি কিন্তু জানি স্পিতি তুমি এসব বিপর্যয়ের জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী নও, লোকে যদিও তোমাকেই হয়তো দায়ী করে। আমি জানি যে উপত্যকার ভূত্বক ভঙ্গুর, চূড়াগুলির খাড়াই ঢাল ও গায়ে জমে থাকা আলগা পলিমাটির বিশাল স্তূপের কারণে বরফ গলার সময় ভূমিক্ষয় প্রবল হয়। শীতকালে সমস্ত পাহাড়চূড়া হয়ে যায় অস্থায়ী হিমবাহ, গ্রীষ্মে তারা গলে যায় পুরোপুরি। খাড়াই নদীর পারে জন্য পাহাড়চূড়ার বরফ ও ভূমির ধস নদীপ্রবাহের চাপ বাড়িয়ে দেয়, আর এসব ধস ভূমিক্ষয় বাড়িয়ে পাঁক জমায় থরে থরে নদীর বুকে। তাতেই নদীর নিম্নগতিতে এবং উপত্যকার বুকে ফ্ল্যাশ ফ্লাড তৈরি করে। ঋতুজনিত চাপ ও অঞ্চলটির কাঠামোগত পুনর্গঠন তাই এভাবে নদীপ্রবাহ বাড়িয়ে দেওয়ার কারণ। অবশ্যই ঋতুজনিত চাপ একটা বড় ব্যাপার স্পিতি, তাতে রয়েছে জলবায়ুর বিশেষ উপাদানগুলি। যেমন হিমায়ন ও অবহিমায়ন এবং গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন বৃষ্টি অথবা তুষারপাত ভূত্বকের ভিত্তীগঠনে মূল কাজ করে আর তাতে নদীজ উপত্যকা বা গোটা উপমহাদেশে ভূমিক্ষয় ঘটে, শুধু এখানেই নয়। সঙ্গে রয়েছে এখানকার এই ভঙ্গুর অঞ্চলের ক্রমাগত উত্থান ও বিকৃতিজনিত অস্থিরতা এবং উপত্যকা গাত্রের স্খলন নিত্যঘটনা হিসেবে। এই উপত্যকার এসব স্পর্শকাতর এলাকাগুলি নিম্নগতিতে যে ভয়ানক ঘটনা ঘটায় তারা ক্রিয়াশীল হয় এমনই সমস্ত ঋতুজনিত বা গঠনাত্মক বিপর্যয়ে, অথচ দোষ চাপায় সবাই সবকিছু না জেনে তোমার ঘাড়ে।’
দীর্ঘসময় ধ্যানস্থ শব্দোচ্চারণের পর নিশ্চুপ হয় সে, আত্মমগ্নতায় কান খাড়া করে রাখে, শোনে স্পিতির আপন ছন্দে আপন বেগে প্রবাহিত হওয়ার সবল ধারার কলহাস্য। নদীও কথা বলে না, কেবল হাসে, কারণ তার সব কথা বলে দিয়েছে তার পাশে উপবিষ্ট ওই তপস্যাতপ্ত পুরুষটি। কিছুটা সময় অপেক্ষা করে নদীকে কিছু বলতে সে প্রশ্ন তোলে,
‘সেসব কথা ছাড় স্পিতি, অন্য প্রসঙ্গে চল। তুমি এই উপত্যকায় আছ দীর্ঘদিন। বললে দেবতাপুরুষদের সংশ্রবও পেয়েছ। চলনে-বলনে যতই তোমার বালিকাসুলভ চপলতা থাকুক না কেন, বয়সে তুমি খুব একটা নবীনা নও। বরং তুমি যথেষ্ট প্রাচীনা এমনটা বলাই ঠিক তোমাকে। তাই যদি হয় তো তুমি নিশ্চয় জানো অনন্ত জীবন বা অমরত্বের ব্যাপারটা কী বোঝায়। আমি প্রশ্নটা রাখলাম তোমার কাছেই এবং এই কারণে যে ব্যাপারটা নিয়ে ইদানীং আমি কিছুটা বিব্রত। তুমি নিশ্চয় জীবাক্ষকে চেন ? তোমারই অববাহিকায় তোমার সান্নিধ্যে থাকা বৌদ্ধ মঠগুলিতে ঘুরে বেড়ায় সেই সর্বজন প্রিয় সন্ন্যাসী। সে এই রহস্য অনুসন্ধানে আত্মনিবেদিত আর আমাকে তার সহচর ও সহযোগী করতে ইচ্ছুক। আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে সে। কিন্তু আমি কী উত্তর দেব ? আমার কোন কৌতূহল নেই, নিজেই কিছু জানিনা এই বিষয়ে। তবুও আমি তাকে বিরূপ করতে চাই না, তার সখ্যতা আমারও এই নির্বান্ধব মরুপ্রদেশে প্রয়োজন। তাই প্রশ্নটা রাখলাম তোমার কাছেই। সত্যিই তুমি কিছু জানো কি অনন্ত জীবন প্রসঙ্গে ?’
প্রশ্নটি জানিয়ে সে চুপ করল। স্পিতি চঞ্চল শব্দে হাসে। নূপুরনিক্কনধ্বনিতে বলে,
‘কিছু তো নিশ্চয় জানি, কারণ ওই অমর দেবতাদের সান্নিধ্যে আমি ছিলাম এবং এখনও আছি। তবে সেসব কথা কি এখানে এই একাসনে বসেই তুমি শুনবে ? তাহলে তো দিনের পর দিন তোমাকে একসনেই এভাবে বসে থাকতে হয়। আমাকে আরও জানা আরও চেনা দরকার তার আগে। এই একটি জায়গায় বসে সেটা কিন্তু সম্ভব হবে না। সেটা আর তোমাকে কী বলব, তুমি নিজেও সেটা জানো।’
‘জানি তো। তাই কী করব তোমার কাছেই জানতে চাইছি।’
‘চল তাহলে আমার সঙ্গে, আমার গতিধারার সঙ্গে। আমার ছোঁওয়া সবসময় পাবে না, দুর্গম হবে তা তো আগেই বলাবলি হয়েছে। যেখানে যেখানে পারবে আমার কাছাকাছি হতে তাই যথেষ্ট, যতটা যেতে পারবে তাতেও হবে। চল আমার সঙ্গমে, সেই খাবে অথবা লিও গ্রামে, চল কুঞ্জুম পাহাড়ে আমার উৎসের কাছাকাছি। আমার সঙ্গে চলতে চলতে আমাকে আরও জানতে পারবে, কথা বলতে বলতে উত্তর পাবে আরও অনেক রহস্যের। সেখানে অনন্ত জীবনের রহস্য থাকলেও থাকতে পারে। এস, আমার সঙ্গে চলতে শুরু করে দাও এইবেলা।’
নদী ভাষা থামাল, কেবল কলহাস্যে মুখরিত থাকল। শৈবাঙ্কন ধ্যান ভেঙ্গে চোখ খুলল।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)