তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
রামদাস সেন
উচ্চ শিক্ষার তথাকথিত শিখর স্পর্শ না করেও স্বীয় শিক্ষা, অধ্যাবসায় ও আপন জ্ঞানদীপ্তির বিচ্ছুরণে ভারতবিদ্যা অন্বেষণে ব্যাপৃত হয়ে যশস্বী হয়েছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে ১৮৪৫ সালে। পিতা লালমোহন সেনের ছিল বিস্তৃত জমিদারী। তবে অতি শৈশবে পিতৃ বিয়োগ হলে মা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের কাছে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। ছোটো বেলা থেকেই তিনি অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। সেকালের বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার দুই দিকপাল পন্ডিত যথাক্রমে, রামগতি ন্যায়রত্ন ও কালিবর বেদান্ত বাগিশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ গ্রহণ করেন। কিছুদিন স্থানীয় কে. এন. কলেজেও পড়াশোনা করেছিলেন।
রামদাসের সাহিত্য সাধনার অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ ঘটে কবিতা চর্চার মাধ্যমে। তাঁর কবিতা গুলি প্রকাশিত হতো সেই সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘সঙ্গীত লহরী ‘ প্রকাশিত হয়। অল্প বয়সে স্ত্রী বিয়োগ ব্যথায় কাতর রামদাস লেখেন ‘বিলাপ তরঙ্গ ‘ কাব্যগ্রন্থ, তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ বছর।
এরপর তিনি ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, দর্শন, শাস্ত্রগ্রন্থ, বিশেষত হিন্দুশাস্ত্র ও বৌদ্ধ শাস্ত্র তে গভীর ভাবে আকৃষ্ট হন। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৯ সালে বহরমপুরে ডেপুটি ম্যাজি্স্ট্রেট হয়ে এলে তাকে কেন্দ্র করে এক বুধমণ্ডলী গড়ে ওঠে, যার মধ্যমনি ছিলেন রামদাস সেন। প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও ইতিহাস – সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর লেখাগুলি ‘বঙ্গ দর্শন ‘ পত্রিকাতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ১৮৭০ সালে বহরমপুরে লিটারারি সোসাইটির উদ্যোগ অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সভায় তিনি ‘On Modern Buddhist Researches’ নামে একটি নিবন্ধ পাঠ করেছিলেন। সেই বক্তৃতায় ভারততত্ত্ব বিষয়ে তাঁর গভীরতা প্রকাশ পেয়েছিল। পরে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে তা দেশী – বিদেশী পন্ডিতদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল। ইতিমধ্যে তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ নিয়ে পালি ভাষা চর্চা করেন। যার ফলে বৌদ্ধগ্রন্থ গুলি তিনি মূলে পড়ে ফেলতে পেরেছিলেন।
ভারতবিদ্যাচর্চার অমোঘ আকর্ষণে তিনি ইউরোপে সফরে বেরিয়ে পড়েন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালিতে নানা সারস্বত প্রতিষ্ঠান ঘুরে তথ্য আহরণ করেন। সেখানে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর রচনাগুলি সম্পর্কে সেখানকার পন্ডিতবর্গের দ্বারা অবহিত হওয়ার মধ্যে। ইতালির ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ওরিয়েন্টাল অ্যাকাডেমি তাঁর সামগ্রিক বিদ্যাবত্তার স্বীকৃতি স্বরূপ সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। ১৮৭৪ সালে লন্ডন শহরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ওরিয়ান্টলিস্টিস নামক সম্মেলনে আর্য বিভাগে সভাপতির ভাষণে বিখ্যাত পন্ডিত ম্যাক্সমুলার সাহেব ভারতবিদ্যা আলোচনায় রামদাস সেনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছিলেন। মাত্র তিরিশ বছরের মধ্যে এত বড় এক পণ্ডিতের কাছ থেকে অগাধ স্বীকৃতি চারটে খানি ব্যাপার ছিলো না।
রামদাসের ভাবনার মূল সুরটি নিহিত ছিল এই যে ভারতের গৌরব বর্তমানে কিছুটা ম্লান হলেও ব্যাস, বাল্মীকির মতো মহাকবিদের কীর্তিকাহিনী এখনও বিরাজমান। ভারতবর্ষের মানুষের জ্ঞানের ক্ষেত্রটি মহীয়ান। তিনি লন্ডনের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সন্মানীয় সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বিশ্বের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বল্পায়ু জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে তিনি প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি শাস্ত্র থেকে আহরিত নানা তথ্যকে অবলম্বন করে মহামানব বুদ্ধকে নিয়ে একটি বৃহৎ গ্রন্থ ‘ বুদ্ধদেব ‘ রচনা করেন। কিন্তু ১৮৮৭ সালে তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটলে, কয়েক বছর পর তাঁর পুত্র মনিমোহন সেন গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সাংস্কৃতিক গবেষণা কার্যের সুবিধার জন্য তিনি নিজ অর্থ ব্যয় করে একটি মূল্যবান লাইব্রেরী তৈরী করেছিলেন। সেখানে বিদেশের নামী দামী বই সংগৃহীত হয়েছিল। বাংলা বই তো বটেই, ভারত চর্চা সম্বন্ধীয় বহু পত্র পত্রিকা তিনি এই লাইব্রেরীর জন্য সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর পৌত্র অনুত্তম সেন এই অমূল্য গ্রন্থরাজি ন্যাশনাল লাইব্রেরীকে দান করেন। ভারতবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে রামদাসের পাণ্ডিত্য , ত্যাগ আজকের দিন দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।