পাঠক মিত্র
মানুষের যন্ত্রণার রূপ ও রূপান্তর
গল্পের কথা উঠলেই সচরাচর কল্পকাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয় । তাই হয়তো ‘গল্পের গোরু গাছে ওঠে’ বলে প্রবাদের কথা প্রচলিত আছে । কিন্তু গল্পের কাহিনী যখন মানুষের কাহিনী হয়ে ওঠে, সমাজের কাহিনী হয়ে ওঠে, তখন সেই গল্প পাঠকের মর্মে প্রবেশ করে । আবার কোনো গল্প শুধু পাঠকের মর্মে প্রবেশ করে না, পাঠককে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় । প্রশ্ন মানুষের জীবন ঘিরে । প্রশ্ন সামাজিক নান শাখাপ্রশাখা ঘিরে । সব প্রশ্ন সমাজ-চরিত্র বিশ্লেষণে । বিশ্লেষণের প্রতিফলন কাহিনী বিন্যাসে । এমন বিন্যাসে কাহিনীকার অনিল ঘোষ মহাশয়ের গল্প কথা বলে । একুশ শতক থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘পঁচিশটি গল্প’ প্রকৃত প্রান্তিক মানুষের জীবন যন্ত্রণার কথা বলেছে । সমাজের কোন পরিবর্তনেই তাঁদের এই যন্ত্রণার পরিবর্তন হয় নি । কাহিনীকার অনিল ঘোষ তাঁর এই গল্প সংকলনের অধিকাংশ গল্পে নদীমাতৃক প্রান্তিক জীবনের কথা বলেছেন । নদীমাতৃক সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের জীবন-যে সুন্দর নয় সে-কথাই তাঁর গল্প । তাঁদের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের লড়াই । সে লড়াই জীবন হাতে বাঁচার লড়াই ।
দিনমজুর হাসিরাম সর্দার ও তার পরিবারের অনিশ্চিত জীবনের ছবি তাদের কঙ্কালসার শরীর । রোজগারহীন এক দিনে সর্দারের এ শরীর লড়াই করে মৃত গোরুর শরীরে । মৃত গোরুর চামড়া ছাড়িয়ে যদি কিছু রোজগার হয় । যে লড়াইয়ে বুভুক্ষ শকুনির দল ও কুকুরের লোভে শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় । ভয় গাজীসাহেবের মত মানুষদের যাঁরা নানা অছিলায় এই কঙ্কালসার মানুষদের হাতে রেখে ভাতে মারার খেলা করে । ‘রণক্ষেত্র’ গল্পে হাসিরামের এই লড়াই শকুনি ও কুকুরের কাছে । কিন্তু গাজীসাহেবের কাছে নয় । তার সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতার কাছে এককভাবে এদের লড়াই করার সাহস কোনোকালেই নেই । সামাজিক বৈষম্যের অন্ধকারে থাকা এই মানুষদের মেরুদণ্ড হারিয়ে যায় এই ক্ষমতার কাছে । মৃত গোরুকে নিয়ে শকুনি ও কুকুরের সাথে হাসিরামের লড়াইয়ের গল্প ‘রণক্ষেত্র’ সামাজিক বৈষম্যের এই অন্ধকারের এক প্রতিবিম্ব ।
‘রণক্ষেত্র’ গল্পের গাজীসাহেবের মত আর এক ভিন্ন চরিত্র ‘উজান যাত্রা’ র দীনু সরকার । অন্নহীন মানুষদের লোভের রসনা দিয়ে এই দিনুরা নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করে । সেই পাতা ফাঁদে মহীন্দ পা দিয়ে দীনুর হাতে নিজের প্রতিবেশীর ক্ষতি তুলে দেয় । দীনুর মতলবের বিরুদ্ধে যখন একে একে মহীন্দসহ প্রতিবাদের চেহারা তৈরি হয়, তখনই গুনীনের চরিত্রকে কাজে লাগায় দীনু সব প্রতিবাদকে খতম করে দিতে । জীবিকার নামে সুন্দরবনের জঙ্গলে গুনীনকে দিয়ে মহীন্দদের পাঠায় । এ মতলব মহীন্দরা জানে না । এই অজানা তাদের কাছে পরিষ্কার হয় বাঘে আক্রান্ত গুনীনের দেহ নিয়ে উজান বেয়ে ফেরার পথে । বাঘ বশ করার মন্ত্র যার কাছে, সেই গুনীনকেই বাঘের আক্রমণে বেঘোরে প্রাণ দিতে হল । সূচী থাকার কুসংস্কার নিয়ে নিজেদের মধ্যে চর্চা থেকে মৃত গুনীনের মতলব কি ছিল তা বুঝতে পেরে যায় মহীন্দরা । তাদের জঙ্গল যাত্রার সব দায়িত্ব হাভাতে গুনীনের ছিল । কিন্তু কেন ? জীবিকার কথা ভেবে তখন কেউই খেয়াল করে নি । ফেরার পথে বিদ্যাধরীর বুকের অন্ধকার যত সরে যাচ্ছে, মৃত গুনীনের রক্তাক্ত ও কাদামাখা দেহের দিকে তাদের নিবিড় দৃষ্টি সে প্রশ্নের উত্তর তত দিয়ে যাচ্ছে । হাভাতে গুনীনের বিশ্বাসঘাতকতা তার হাভাতে প্রতিবেশীদের জীবনকে পুরোপুরি অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে তাদের পরিবারকে ভাতে মারতে । তার বিশ্বাসঘাতকতা দীনু সরকারের স্বার্থকে সমৃদ্ধ করতে । কিন্তু নিজেই চলে গেল চির অন্ধকারে । নদী ও জঙ্গলের বুকে জীবন হাতে বাঁচার লড়াই যাত্রায় মানুষগুলোর জীবনে নদীর মত জোয়ার ভাটা নেই। শুধু স্বার্থপর লোভী মানুষের জীবন জোয়ারে উজান ঠেলে তাদের বেঁচে থাকার গল্প ‘উজান যাত্রা’ ।
‘নোনাজলের রূপরেখা’ গল্পে মাদার মন্ডলের দৈহিক অসহায়তায় বাঁচার লোভে তার স্ত্রী হাজরা’র লোভে পড়ে । অসহায়তার এই সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে আছে আজও হাজারো হাজরা । এ কাহিনী শুধু নোনাজলের রূপরেখা নয় । এই রূপে জলছবির মত হাজরারা গভীর জলে লুকিয়ে থাকে ।
হাসিরাম সর্দার, মহীন্দ, নেজাম, ধনা’দের মত প্রান্তিক চরিত্রের জীবনযন্ত্রণার কাহিনী অনিল ঘোষের কলমে এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে । শুধু এমন চরিত্র নয় । ‘মানদা’ গল্পে মানদা কচি, ‘নানুষ’ গল্পে নানুষ গদাই, ‘ভাসান’ গল্পের ভানুমতী, ‘মহীষ সংক্রান্ত একটি অ-প্রাচীন’ গল্পে ঘন্টু’র চরিত্র প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বেড়াজালে ব্যক্তিত্বহীন বা ব্যক্তি-স্বাধীনতাহীন সব চরিত্র যাদের প্রকট বা প্রচ্ছন্নে থাকে মালিক বা প্রভু’র প্রভুত্ব । এমন চরিত্রের মাধ্যমে কাহিনীকার সাধারণ সমাজের মধ্যে এক শ্রেণী বিভাজনের কথা তুলে ধরেছেন । আজকের সমাজজীবনে যদিও এই চরিত্রের রূপান্তর ঘটেছে কেবল । তবে ‘নানুষ’ গল্পের নানুষ গদাই, ‘অন্ধকার ও আদিম পুরুষ’ গল্পের ডোমার চরিত্রদের মানসিক শোষণে বশ করে রাখার কাহিনী রাঘব দত্তের মত নেতা ও ভট্টদার মত নায়করা আজও সমাজে রাজত্ব করছে । মানসিক শোষণের নানা হাতিয়ারের প্রধান অস্ত্র তাদের ক্ষমতায়ণ । যা আর্থিক বা রাজনৈতিক বা দুভাবেই । যেখানে প্রচ্ছন্নভাবে মানুষকে না-মানুষ ভাবার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে । কাহিনীকার এই ‘না-মানুষ’ শব্দের ‘মা’ বাদ দিয়ে যার সুন্দর নামকরণ করেছেন ‘নানুষ’ । শুধু বেঁচে থাকার জন্য বহু মানুষকে নানুষ থাকতে হয় । ‘নানুষ’ গল্পে গদাইয়ের ঘোষিত বউ ললিতা ও ‘নোনাজলের রূপরেখা’ গল্পে মাদারের বউ বাণী’র চরিত্র দিয়ে লেখক সমাজের বৈষম্য-ব্যধি’র কুৎসিত রূপের এক চেহারা দেখিয়েছেন যার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায় ।
অনিল ঘোষ তাঁর গল্পের ক্যানভাসে প্রান্তিক মানুষের জীবন-যন্ত্রণার মধ্যে প্রান্তিক পরিবারের নারীর মর্যাদা ও নারীত্বের অপমানের করুন চিত্রের বর্ণনায় মনকে নাড়িয়ে দেয় । সংসার ও সংসার বহির্ভূত কারণে এমন পরিবারের নারীর নারীত্বকে ধ্বংস করার চক্রান্তের মধ্যেই পুরুষ তার পুরুষত্ব খুঁজে পায় । এক্ষেত্রেও সেই লোভের ক্ষমতায়ণ বা ক্ষমতায়নের লোভ । সে চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন ‘জলযাত্রা’, ‘তামস যাত্রী’, ‘হরিণমারী সমীক্ষা’ গল্পে । ‘হরিণমারী সমীক্ষা’ গল্পটির আঙ্গিক নতুনত্বের দাবি রাখে । নারীর যৌন নির্যাতনের সমীক্ষা ও সমীক্ষার রিপোর্ট গল্পের আঙ্গিক । এই আঙ্গিকে লেখক তুলে ধরেছেন যে সত্য কিভাবে অসহায়তার নিঃশব্দে ডুবে থাকে । অসহায়তা সেই ক্ষমতার কাছে । আর এই অসহায়তা নিয়েই মানুষকে ঘর ছাড়তে হয় অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে । এই অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশ্যে অন্ধকার রাতে নদীর বুকে রওনা দেয় মতিয়া, চাঁপা, মালতী, বিজা, ময়না আর গর্ভবতী আশমানী । তাদের পুরুষদের প্রতি ঘৃণা ও অভিমানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে তারা । এদের যন্ত্রণার গল্পই ‘জলযাত্রা’ । ‘তামস যাত্রী’ গল্পে হাজরা সর্দার, নাদন আর গোলাম রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অন্ধকারে তাদের পরিবার নিয়ে আঁধার রাতে বেরিয়ে পড়ে আর এক অন্ধকারের উদ্দেশ্যে । প্রতিটি গল্পের উপস্থাপনা পরস্পরের সত্তাকে কখনো একসূত্রে বাঁধতে পারেনি । এটাই গল্পকারের বৈশিষ্ট্য ।
জলভরা সুন্দরবন । মানুষের যন্ত্রণায় জলভরা চোখ । যন্ত্রণার জীবনে বেঁচে থাকার জন্য জল না-পাওয়ার যন্ত্রণা । এই যন্ত্রণার গল্প ‘মহাযুদ্ধের পটভূমি’ । পানীয় জলহীন গ্রামে জল সংগ্রহ-যাত্রা । আর সে যাত্রায় জল লুট হয়ে যাওয়ার ঘটনা জলরাশির মাঝে জলসংকটে মানুষের যন্ত্রণা সভ্যতার এক অন্ধকারের ইঙ্গিত ।
ব্যক্তি ক্ষমতার প্রতিপত্তি থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার যাঁতাকলে প্রান্তিক পরিবারের যন্ত্রণার কাহিনীর কেবল রূপান্তর ঘটেছে । এই রূপান্তরে অনুঘটক হিসেবে জ্বলে ওঠে কখনো সাম্প্রদায়িকতা আবার কখনো গুন্ডারাজ । যার প্রতিফলন যথাক্রমে ‘গোয়ালপোতা যাত্রা’ আর ‘মারসিন’ গল্পে । মারসিনের চেহারা আজ রূপান্তরিত হয়ে ক্ষমতা রাজনীতির সঙ্গে মিশে গেছে । যদিও লেখক দেখাতে চেয়েছেন মারসিনেরও শুভবুদ্ধির উদয় । কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন । এই কঠিন বাস্তব তাঁর ‘বোগলা ভগৎ’ গল্পে । এ গল্পে রাজনীতি, ইতিহাস আর মিথের সংমিশ্রণে গল্পকার ইঙ্গিত দিয়েছেন সমাজের অস্থিরতা সর্বদা চলমান ।
সমাজের অস্থিরতার চলমানতায় যন্ত্রণারত মানুষের মিছিল । যে মিছিল শুধু সুন্দরবনের মানুষের নয় । যে মিছিল কোন এক স্থানের মিছিল নয় । এ মিছিলে লেখকের ‘রেল ভিখিরি’ গল্পে মঙ্গলা, আবুল, রত্না, শিরিনের মত ভিখারিদের যেমন যন্ত্রণার জীবনযাত্রার মিছিল, আবার এ মিছিল কখনো এক দেশ থেকে আর এক দেশে গমন করে । গল্পকার অনিল ঘোষ এমনই এক দেশান্তরের মিছিলের গল্প বলেছেন । তাঁর ‘মাটি’ গল্পে দেশভাগে ঘরছাড়া মানুষের যন্ত্রণার মিছিলে জন্মভিটের একমুঠো মাটির স্পর্শে স্মৃতির মিছিল চলে উজান বেয়ে ।
লেখক তাঁর তিরিশ বছর কাহিনী চর্চার বুননে চারপাশে দৃষ্টির প্রতিফলন এই সংকলনে এমনতর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যা পাঠককে প্রান্তিক মানুষের যন্ত্রণার শরিক না-করে পারে না । গল্পকারের সার্থকতা সেখানেই ।
পঁচিশটি গল্প/ অনিল ঘোষ
একুশ শতক, কলকাতা-৭৩