পাঠক মিত্র

নীল আকাশে আশা-নিরাশার হলুদ মেঘ

সাহিত্য সমাজ-জীবনের দর্পণ । সাহিত্য আলোচনায় এ কথা বরাবরই আসে । অন্যভাবে বলা যায় যে সময়ের স্বরলিপির একটা অংশ হল সাহিত্য । তবে কাল্পনিক কাহিনী সাহিত্যের একটি অংশ হলেও তার সামাজিক প্রতিফলন বা প্রতিসরণে সমাজদর্পণের কোনো প্রতিক্রিয়া থাকে কিনা তা তর্কের বিষয় হতে পারে । কিন্তু লেখকের ভাবনা ও কল্পনা সাহিত্যকে জীবন্ত করে তোলে । লেখকদের মধ্যে যদিও কবিরা কল্পনাপ্রবণ হিসেবেই বেশি পরিচিত। কবি জীবনানন্দর কথায়, ‘যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে…নানা রকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করার অবসর পায় ।’  তবে সাহিত্য দর্পণে কবিতা সমাজ-দর্পণ নাকি কবির শুধুই কল্পনার ফসল, এ কথা প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দর কথাই আবার বলতে হয় । “…সাহিত্যকে যদি যুগের দর্পণ হিসেবেই শুধু স্বীকার করে নেয়া যায়, একটি ক্ষয়িষ্ণু যুগের নির্মম দর্পণ হয়েও সাংবাদিকী ও প্রচারমর্মী রচনার সঙ্গে কবিতার পার্থক্য এই যে প্রথমোক্ত জিনিসগুলির ভিতর অভিজ্ঞতা-বিশোধিত ভাবনাপ্রতিভার মুক্তি, শুদ্ধি ও সংহতি কিছুই নেই, কবিতায় তা আছে ।” 

কবি মানস দলপতি’র ‘নীল আকাশ হলুদ মেঘ’ এমনই এক কাব্যগ্রন্থ যেখানে কবির কল্পনার ভুবনে তার অভিজ্ঞতা-বিশোধিত ভাবনাপ্রতিভার মুক্তি যেমন ঘটেছে, এই গ্রন্থটি তেমন সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতাকে তুলে ধরেছে । কাব্যগ্রন্থের ভুবনে কবির শব্দ কর্ষণ সেই কথা বলে ।

‘একা হতে চেয়ে’ কবিতায় কবি বলছেন, ‘বুকের মাঝে না বলা কথার তরঙ্গ মিলিয়ে যায়–/সব তরঙ্গ যদি ধরে রাখা যেত,/ তবে বালির নীচে ফসিল হয়ে যেতাম এতদিনে ।’ কবির না-বলা কথার তরঙ্গমালা তাঁর বুকের মাঝে পুঞ্জীভূত হয়নি বলেই ফসিল হয়ে একা হতে পারেন নি । তাই শান্তির নিবাস গড়তে চেয়েছেন । শান্তির খোঁজে নিরুদ্দেশের পথে চলতে চেয়েও স্থায়িত্ব চেয়েছেন কোথাও ।  ‘ক্যানভাসে তুমি’ কবিতায় লিখছেন,’ শান্তিনিবাস গড়েছি–/ এ শান্তি অস্থায়ী,/ থাকব না ক্ষণেক পান্থশালায় ।/ স্থায়িত্ব দাও–/ পথ থেকে ক্লান্তি কুড়িয়ে তোমার চোখে জমা রাখা—স্থায়ীত্ব দাও। /পিছনের পথে অবসাদ আছে,/ ভয় পাই !’ আবার ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় বলছেন –‘চলো এবার নিরুদ্দেশের পথে–/কিছু একটা খুঁজে আনি ।/যাকে আমরা শান্তি নামে জানি ।’ কবিরা শান্তি খুঁজে বেড়ান কবিতার আশ্রয়ে । এখানে কবি দলপতি দলছুট নন । নিজের কলমে তা স্বীকার করেন । যেখানে কবি তাঁর কামনা-বাসনার কদর্যতা ঠেলে কবিতার চলমানতাকে অবিচল রাখতে পারে । ‘তেমনি খুঁজেছি আমি আশ্রয়,/ বসন্তের পূর্বাভাসে–বাসনার বিষবাষ্প ঠেলে/ কামনার কদর্যতা ফেলে/ সৃষ্টির আনুপাতিক এক্স ওয়াই ক্রোমোজোমকে/ সাথে নিয়ে– কবিতাকুসুমে লুকিয়ে রাখি/ ইচ্ছার অবিচল চলমানতা–‘ । যে চলমানতায় কবি হয়ে ওঠে নির্ভীক । ‘কবি শঙ্খ ঘোষ স্মরণে’ কবিতায় বলছেন, ” কবির বলিষ্ঠ কলমে তলোয়ারের ধার ।/সমাজ সাফাইয়ের অস্ত্র/ বদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি নির্ভীক–/ চিরকাল–নির্ভীক ।’ নির্ভীক কবি নজরুলকে একসময় পেয়েছে এ দেশ । যাঁর কলমের আগুনে এ দেশের যুবকরা বাঁচার স্বপ্ন শুধু দেখেনি তাঁরা বাঁচার জন্য লড়াই করার সাহস পেয়েছে । তাই কবিতা শুধু কবির কল্পণাপ্রসূত শব্দের খেলায় মনের আরাম নয় । কবিতা বিলাসিতা নয় । কবি দলপতি বলেন কবির নীরবতা একপ্রকার আত্মহনন । যে নীরবতা মানুষের কথার বিরুদ্ধে সায় দেয় । তখন কবিতা যেন বশ্যতা স্বীকার করে কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতার কাছে । কিন্তু কবি দলপতি বলছেন, ‘কবির কলম কালের শাণিত তলোয়ার–/নিজস্ব রিভলবারে ফৌজীর আত্মহননের মতোই/ কবির নীরবতা যেন আত্মবলিদান ।’ তিনি বলতে পারেন, ‘ কবি যদি নীরব থাকো-/তবে অমরত্বের দুরাশা ছাড়ো,/ মানুষের মাঝে ঘৃণাটুকু নিয়ে/ যে-কদিন বাঁচলে বাঁচো । কবিকে নির্ভীক হতে হয়–।’ কবি দলপতি কোন রাখঢাক না রেখে তাই বলতে পারেন, ‘ কালো কালিতে লেখা হচ্ছে ইতিহাস–/ তোমার ক্যানভাস ধ্বংসের ছবি আঁকে/ লোভের রঙ-তুলি ।’ এই রঙ-তুলিতে মানুষের দুর্ভোগ ফুটে উঠছে প্রতিনিয়ত ক্ষমতা নামক ফাঁদে । ‘পাথর চাপা সত্য’ কবিতায় কবি লিখছেন, ‘একই অন্ধকারের নীচে আমরা সবাই/ যুগ যুগ ধরে আমরা সবাই /ক্ষমতার উলঙ্গ বাসনার ফাঁদে–/ …..’ভাগের অঙ্কে মানুষ ভাগফল/ যোগের অঙ্কে ধর্ম বহুদূর–/ক্ষমতার অঙ্কে স্বার্থের মহাজোট/ ভাগশেষে মানুষের দুর্ভোগ–।’ এই কথাগুলি কবি বলতে পারেন তখনই, কবি যখন নির্ভীক হয় ।  কবিকে নির্ভীক হতে হলে কবিকে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সুখ আর স্বীকৃতির লালসা থেকে দূরে থাকতে হবে । যদিও কবি ব্যক্তিগত সামাজিক লাভালাভের প্রশ্নে কখনো কবিতা লেখে না । কবিতা সৃষ্টিই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য । এ বিষয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের কাছে আর একবার আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে । তিনি বলেছেন, “কবিতার সৃষ্টি করবার সময় আসে জীবনে । কবিতাটি যাতে সার্থক হয়–সেই দিকেই কবির দৃষ্টি । এমন কোনো সমাজ থাকতে পারে যেখানে মোটা কাঞ্চনমূল্যে কবিতা কেনা হয়, কিংবা তেমন কবিতা লিখতে পারলে নানারকম সামাজিক সুবিধা পেতে পারা যায় । কিন্তু কবিতা সৃষ্টির জন্যে নিজেদের অভিজ্ঞতার ব্যবহার করতে গিয়ে ও সেই কবিতা সৃষ্টি করবার সময় উপরোক্ত সামাজিক লাভ-অলাভের প্রশ্ন কবির বড় চেতনায় বিশেষ কোনো ছায়াপাতই করে না, তার চৈতন্য ও অনুচেতনা ঐকান্তিকভাবে সক্রিয় হয়ে থাকে কবিতাটিকে সৎ, সার্থক করে তোলবার জন্য ।” কবির চৈতন্য ও অনুচেতনার সক্রিয়তায় কবি দেখতে পান সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতা, অনুভব করতে পারেন মানুষের বেদনা । মানুষের বেদনা ও দুর্ভোগ ক্ষমতার উলঙ্গ বাসনার ফাঁদে আরো-যে জটিল হয়ে পড়ছে তা কবি দলপতি দেখিয়েছেন । সেই অবস্থার আরো জটিলতর ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর ‘সহন’ কবিতার শরীরে ।  ‘মাটিতে যখন ডঙ্কা বেজে ওঠে/ বাতাসে তখন শঙ্কা ভেসে বেড়ায়–/একেই কি তবে ভবিতব্য বলে ?/ ধর্মের কল বাতাসে যখন নড়ে !– ধৈর্য ধরে ভরসা রাখতে হয়–/ বাণীতে তখন বিচারের হবে জয় ।/সত্য থাকে নীরব গরিমায়/ মিথ্যা নাচে হিংসার মহিমায়–‘ আর এক কবিতায় বলছেন, “কাদের সৌজন্যে বিকৃত পোশাকে/ অসত্যের নগ্ন নৃত্য–।” এ নৃত্যের একটা অংশের সংকেত বটে যা কবি তাঁর ‘অসম যুদ্ধ’ কবিতার কথায় বলেছেন । ‘কংক্রিটের মোটা দেওয়ালে আটকে গেছে/ মন্দিরের ঘন্টা/ গির্জার প্রার্থনা/মসজিদের আজান ।/ মঞ্জুর হচ্ছে না অসহায় প্রার্থনা–/ জ্ঞান আর বিজ্ঞানের অন্ধ উন্মাদনায়/ ত্বরান্বিত ধ্বংসলীলা–/…সৃষ্টি-স্থিতি-লয় চক্রে একদিন ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী–/এ যেন তারই আসন্ন সংকেত ।’ এই সংকেতের মধ্যে কবি থাকতে ভয় পান । কবি বলছেন, ‘এখানে আকাশে বাতাসে বিষ,/এখানে থাকতে ভীষণ ভয় । এখান থেকে/ পালিয়ে যাব যে, সেখানে শুধু ঘৃণা আর অবহেলা ।/ আলোর আশাভঙ্গ বারে বারে/ এখানে কেবলই রাত আতঙ্ক খেলা—।’ এমন আতঙ্ক নিয়ে কবি মৃত্যুবোধহীন পথে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যুর অন্বেষণে বেরিয়েছেন । ফিরে ফিরে কখনো জন্মান্তরে ফিরেছেন । কবি লিখছেন, ‘ নদীর মতোই ঠিকানাবিহীন গন্তব্য–/কখন যে সে সাগরে বিলীন হবে জানে না/ তেমনই হেঁটে চলা মৃত্যুবোধহীন পথ-/ রাত্রি আর ভোরের ব্যবধানে/ এক জনমেই ফিরেছি অসংখ্য জন্মান্তরে ।’ অন্য একটি কবিতায় অসংখ্য জন্মান্তরে জীবন্ত মৃত্যুর গ্লানিতে অন্তিম মৃত্যু চেয়েছেন–‘মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েকবার/জন্ম একবারই।/ ..সেই অন্তিম মৃত্যুর জন্য/আজ আর কোন ভয় নেই। / সেই বোধের কাছাকাছি পৌঁছে/ বারবার জীবন্ত মৃত্যুর গ্লানি/ তাড়া করে বেড়ায়–মৃত্যু যেন একবারই হয় ।’ একবার জন্মে মৃত্যু বার বার ঘটে যখন বিবেকের ডাক বুঝতে পারা যায় না । আর তখনই সকল হাঁক-ডাকের সারবত্তা বোধগম্য হয় না । তখন কবি দলপতি’র কথায়-‘আমরাই শুধু বোকার মত/ হাঁক-ডাকে সাড়া দিয়ে/ বেকুব বনে যাই–‘ । মানুষের বেকুব বনে যাওয়ার ইতিহাস ‘হঠাৎ মহাকাল’ কবিতায় আরো স্পষ্ট করেছেন কবি । তবু কবি আশাবাদী । তাই নীল আকাশে সাবধানী হলুদ মেঘ দেখতে পেয়েছেন যা একদিকে আশাবাদের সংকেত দেয়, আবার নিরাশারও সংকেত হতে পারে । কবি আশাবাদী বলেই নিরাশার সংকেতকে উপেক্ষা করতে পেরেছেন ।  কবি তাই বলতে পারেন, ‘নাভিমূল হতে ছড়িয়ে দাও কস্ত্তুরী সুধা–ধ্বনিত হোক—অমৃতস্যঃ পুত্র ! প্রতিনিয়ত–‘ । আশা নিরাশার বিন্যাসে গড়ে তুলেছেন কবি মানস দলপতি তাঁর ‘নীল আকাশ হলুদ মেঘ’ যা পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যাবে । 

— নীল আকাশ হলুদ মেঘ 

— মানস দলপতি

‐- সন্ধ্যা প্রকাশন, কলকাতা– ৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *