মহাদেব মণ্ডল
লেখক পরিচিতি
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের চূড়াভান্ডার গ্রামে ১৯৯২ সালের ৪ মে মহাদেব মণ্ডল জন্মেছেন। বাবা মঙ্গল মণ্ডল, মা ভাগ্য মণ্ডল। গরুমারা অভয়ারণ্য এবং লাটাগুড়ি জঙ্গলের খুব কাছের গ্রামেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন। তাই প্রকৃতির প্রতি এক গভীর টান তাঁর ছোটবেলা থেকেই। তাঁর চর্চা এবং বিশেষ পছন্দের বিষয় মূলত কথাসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতি। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ থেকেই তিনি কিন্নর রায়ের উপন্যাসে পরিবেশ ভাবনা নিয়ে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে রচনা করেন ‘কিন্নর রায়ের কথাসাহিত্যে পরিবেশ প্রসঙ্গ’ নামক নিজস্ব গ্রন্থ। এর আগে যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘বাংলা ছোটগল্প : বিষয় ও নির্মাণ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘প্রাজক্তা’ সহ নানা পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বর্তমানে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণারত।
বিষয় পরিচিতি
( পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বর্তমানে রীতিমত নানা আন্দোলন যেমন হচ্ছে তেমনি পরিবেশ রক্ষার জন্য সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণাও করে চলেছেন। এ বিষয়ে পরিবেশবিদরা বর্তমানে ভীষণভাবেই চিন্তিত। এই মর্মেই নানারকম প্রবন্ধ নিবন্ধন প্রকাশিত হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। পিছিয়ে নেই সাহিত্যও। তাইতো বর্তমানে পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য রচিত হচ্ছে। কবি সাহিত্যিকরা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করছেন পরিবেশ সম্পর্কে তাদের ভাবনা-চিন্তা। পাঠককে সচেতন করতে সমসাময়িক পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যাকে সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন তাই তাঁরা। এই ধরনের সাহিত্য পরিবেশ সচেতন সাহিত্য, পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা পরিবেশবাদী সাহিত্য নামে পরিচিত। এই ধরনের সাহিত্যের সাহিত্যমূলক ছাড়াও একটি পরিবেশগত বা পরিবেশবাদী মূল্য আছে। সাহিত্য সমালোচনায়, সাহিত্য পাঠের তাই নতুন এক প্রস্থান তৈরি হয়েছে পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা বা ইকোক্রিটিসিজম। এই আলোচনায় মূলত বাংলা সাহিত্যের পরিবেশবাদী গল্প নিয়ে আলোচনা করা হবে, দেখার চেষ্টা করা হবে গল্পগুলি কীভাবে ইকো টেক্সট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের লেখকরা কীভাবে তাঁদের গল্পের মধ্যে পরিবেশ ভাবনা সম্পৃক্ত করে পরিবেশবাদী সাহিত্য রচনা করে চলেছেন এবং পাঠককে পরিবেশ ভাবনায় মগ্ন করে পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য সচেতন করে চলেছেন সেই দিক নির্দেশ করার চেষ্টা করা হবে মূলত এই আলোচনায়। )
অমর মিত্রের ছোটগল্পে পরিবেশচেতনা
বিশ শতকের সাতের দশকের অন্যতম কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র(জন্ম ১৯৫১)। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল অন্য আর পাঁচজন লেখকের থেকেও অনেক বেশি প্রখর। লেখাপড়ার পর্ব শেষ করে গল্পকার ভূমি দপ্তরের আধিকারিক রুপে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩-এর নভেম্বরে চাকরি পেয়ে কলকাতা ছেড়ে তাঁকে মেদিনীপুরে যেতে হয়। ১৯৭৪-র এপ্রিলে ট্রেনিং শেষে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হন ডেবরা থানার করন্ডা নামের একটি গ্রামে। বাস থেকে নেমে কংসাবতী নদী পার হয়ে ঘন্টা দেড়েক হেঁটে লোকালয়ের প্রায় বাইরে তাঁকে ক্যাম্প অফিসে পৌঁছতে হত। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং চাষিবাসি মানুষদের সংস্পর্শে থেকে অমর মিত্রের লেখক সত্তায় প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন উপলব্ধির জন্ম হয়েছে, যার সুনিশ্চিত প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর গল্প বিশ্বে। লেখকের আত্মজীবন কথায় গ্রামের প্রকৃতির চিত্র উঠে এসেছে নিজস্ব বর্ণনাতেই–“শহর থেকে দূরে গিয়ে কখনো কংসাবতী, কখনো সুবর্ণরেখা, কখনো ডুলুং, তারপর হলদি নদী, বঙ্গোপসাগরের তীরে বদলি হয়ে হয়ে আমার এক সময় মনে হলো আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমার মতো করে এই পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছে কে? আমি বরং লিখেই যাই। আমি বরং ক্ষুদ্র ক্ষমতাটুকু ব্যবহার করি চাষিবাসী বিপন্ন মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি টের পেলাম কলকাতায় এসে আর বেশিদিন থাকতে পারি না। সুবর্ণরেখা নদী তীরের বংশীধরপুর গ্রাম টানছে।”১ গ্রামকে দেখেছেন তিনি অনেক কাছ থেকে, উপলব্ধি করেছেন গ্রামের শান্ত প্রকৃতি ও পরিবেশকে নিজের শিল্পী সত্তা দিয়ে। তাই শহরে এসে তিনি থাকতে পারেনি। এই অনুভব দিয়েই তিনি বুঝতে পেরেছেন গ্রামের পরিবেশ ধ্বংসের করুণ চিত্র। তাঁর সচেতন দৃষ্টিতে শুধু গ্রামের দূষণ এবং পরিবেশ বিনষ্টের চিত্রই ধরা পড়েনি, ধরা পড়েছে গ্রামগুলি কীভাবে আস্তে আস্তে শহরে পরিণত হয়ে যাচ্ছে সেই চিত্রও। আর এই নতুন শহর পুরোনো পৃথিবীর কথা মনে রাখেনি। মানুষও এই নতুন শহরে স্মৃতিহীন। এখানে পাখি ডাকে না। এখানে গাছেরা নেই। পথে পথে প্লাস্টিক, পলিমার বৃক্ষ। পরিবেশের এই অবক্ষয় কথাশিল্পী অমর মিত্রকে ভাবান্বিত করেছে। এই ভাবনার ফলস্বরূপ গল্পকারের কলমে সৃষ্টি হয়েছে ‘জল ও বায়ু’, ‘কালো জল’, ‘নদী-ভূমি’, ‘কালো নদী’, ‘কলসপুর যাইনি’, ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ প্রভৃতি পরিবেশ সচেতন গল্পগুলি। এই গল্পগুলির মধ্যে লেখক পুরোনো গ্রামীণ পরিবেশ, প্রকৃতি ও পরিবেশ হারিয়ে কীভাবে শহর হয়ে উঠছে সেই চিত্রই মূলত তুলে ধরেছেন। তার ফলে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স। সেই বর্ণনা গল্পগুলিকে করে তুলেছে ইকো-টেক্সট।
পরিবেশ দূষণের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলির পরিমাণ। বায়ুতে যতই কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেন প্রভূতি গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে চলছে। তার ফলে দেখা যাচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। জলবায়ুর পরিবর্তনের সূচনা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। আর এই জলবায়ু পরিবর্তন লেখক অমর মিত্রকে ভাবিয়ে তুলেছে সর্বদা। এই ভাবনার প্রতিচ্ছবি ‘জল ও বায়ু’(১৯৯০)গল্পটি। ফুড ইন্সপেক্টর তলাপাত্রবাবুর বড় পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে পছন্দপুর সেখানকার আদি বাসিন্দা না হয়েও। কিন্তু ভবঘুরে ছাড়া কেউ এই গ্রামে এসে থাকেনি আজ পর্যন্ত। কিন্তু তলাপাত্রবাবুর কাছে পঁয়ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে সব থেকে প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে এই পছন্দপুর। কিন্তু এই গ্রামে কিছুই নেই, তাই এই গ্রামে চাকরি করতে এসে কেউ থাকেনি সবাই বদলি নিয়ে চলে গেছে শহরে। লেখক বলেছেন–‘কেন যে থাকবে তাও বুঝি না। সত্যিই তো, পরিষ্কার বাতাস ছাড়া পছন্দপুরে আর কী আছে?’ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যা, তা হল এই পরিষ্কার বাতাস। পছন্দপুরে বিলাসবহুলতার জন্য কোন কিছু না থাকলেও বেঁচে থাকার জন্য এই পরিষ্কার বাতাস রয়েছে তবুও কোন চাকরিজীবী বা এই গ্রামে কাজের সুত্রে আসা কেউ থেকে যেতে চায়নি, থাকেনি। এই পছন্দপুরের জল, বাতাস তলাপাত্রবাবুর পুরোনো যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছে। তিনি যখন এখানে এসেছিল তখন তার চুল পাকা ছিল, শরীরের চামড়া ঝুলে ছিল। কিন্তু পছন্দপুরে জল ও বায়ুতে পাকা চুল যেমন কাঁচা হয়েছে তেমনি শরীরের চামড়া পেয়েছে যৌবনের উজ্জ্বলতা। তলাপাত্রবাবুর কথাতেই তা আমরা জানতে পারি–‘সেই সময় আমার কত চুল পাকা ছিল, গায়ের চামড়া কত ঝুলে ঝুলেই না ছিল, এক বছরে কত বদলে গেছে বলুন দেখি হেড মাস্টার মশায়।… কী তেল মাথায় দেন? তেল তো দিই না। তবে কি করে হল? পছন্দপুরের জল-হাওয়া, এমন ভালো হাওয়া আমি কোথাও দেখিনি, এমন জলও নয়, ভিতরের কলকব্জার যে সব ময়লা জমেছিল সব ধুয়ে মুছে সাফ।…শুধু হাওয়া কেন, রোদ্দুরও, শরীর সব সময় গরম থাকে, খুব উপকারী।’ কিন্তু এই সুন্দর জলবায়ুতেও থাবা বসিয়েছে সভ্যতার উন্নতি। যে জল-বায়ু বুড়ো মানুষকে যৌবনে নিয়ে গেছে সেই জলবায়ু দূষিত হয়ে গেছে সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে রেলের আবিষ্কার প্রকৃতি ধ্বংসের প্রথম সোপান। লেখক সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছে থেকে। তাই এই পছন্দপুরের মতো জায়গা যখন দূষিত হয়ে যাচ্ছে তখন লেখক হৃদয় ব্যথিত হয়েছে–‘ট্রেন আসা-যাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই।…এসে থেমেই থাকল এখানে সারারাত। শুধু ফোঁস ফোঁস শব্দ আর ধোঁয়া। সারারাত ইঞ্জিনের নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দে ঘুম চটকে যায় হেড স্যারের।’ এভাবে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ পছন্দপুরের জলবায়ুকে বিষাক্ত করে তুলেছে। তা নিয়ে লেখক অমর মিত্র চিন্তিত। সেই চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় আলোচ্য গল্পের আখ্যানে।
গাছপালা দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীতে জল শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত গতিতে। যার ফলে ঋতু পরিবর্তন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। এই সমস্ত কিছু নিয়ে অমর মিত্র রচনা করেছেন ‘কালো জল’(১৯৯৮) গল্পটি। গল্প জুড়ে জল সংকটের চিত্র এবং আবহাওয়া পরিবর্তন, তার ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি প্রভৃতি প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। লেখক জানিয়েছেন–‘আসলে জলের টানটা ক্রমশ বাড়ছে। সবে তো গরম এল। এ বছর বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে শীত অনেকদিন ছিল। গত সপ্তাহেও ঠান্ডা ছিল।’ এই যে অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত। ঋতু পরিবর্তন সঠিক সময় হচ্ছে না, কখনোবা কিছু ঋতু অনুভব করা যাচ্ছে না। ফলে আবহাওয়ার দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এছাড়াও গল্পে জল সংকটের চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে। উষ্ণায়নের প্রভাবে নদীগুলি সব শুকিয়ে গেছে। বৃষ্টিপাত অনিয়ন্ত্রিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান জলের আজ বড়ই সংকট, তা লেখক অমর মিত্র আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এই জলসংকট বর্তমানে আরো অনেক অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় মানবজাতি প্রহর গুনছে।
আধুনিক জাপানের অন্যতম এক সমস্যা নদীর অস্তিত্ব সংকট। মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে ততই ছোট-বড় নদী উন্নয়নের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারি মহলেও নদী নিয়ে খুব বেশি সচেতনতা দেখা যায় না। নদী হারিয়ে যাওয়ার করুণ চিত্রই উঠে এসেছে অমর মিত্রের ‘নদী-ভূমি’ গল্পে। এই গল্পে বর্ণিত হয়েছে নদীর মরে যাওয়ার কথা, মজে যাওয়ার কথা, হারিয়ে যাওয়ার কথা। চব্বিশ পরগনা জেলার নদী ভরাটি গ্রামে জলের সংকট। এই সমস্যা সমাধানে আসতে হয়েছে জেলাশাসককে। শ্রাবনের শেষ থেকে ভাদ্র মাস জুড়ে জল সংকটে ভুগছে এই গ্রাম। তাই গ্রাম জুড়ে ক্ষোভ। ধান চাষ নষ্ট হয়ে গেছে। ফসলের ক্ষেত শুকিয়ে গেছে। বিডিও, পুলিশ চেষ্টা করেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি তাই সমস্যার সমাধানের জন্য আসতে হয়েছে জেলাশাসককে। তিনি রাজস্থানের মানুষ, মরু অঞ্চলের লোক। সেখানে জলের বড়ই অভাব। সেখানকার মানুষ একটু গঙ্গাজল ৪০-৫০ টাকা দিয়ে কিনে নেয়, আর এখানকার মানুষ পবিত্র গঙ্গাজল চাইছে চাষের জন্য, শুনে বিস্মিত হন তিনি। একসময় এই গ্রামের নীচ দিয়ে বয়ে যেত পিয়ালি নদী। এখন শুকিয়ে গেছে। চর হয়ে গেছে। এখন নদীর উপর দিয়ে গ্রাম-ঘর-বাড়ি-জমিজামা-ধানখেত-পুকুর। এই নদীর মরে যাওয়ার চিত্র বর্ণিত হয়েছে সাহিত্যিক কিন্নর রায়ের ‘ব্রহ্মকমল’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক বলেছেন–“লক্ষ্য করেছি সরস্বতী মরে যাচ্ছে।”২ এভাবেই মরে গেছে অনেক নদী। একসময় অনেক নদী ছিল, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সব হারিয়ে গেছে, মুছে গেছে তাদের চিহ্ন। ক্যানেল আছে, কিন্তু সেখানেও জল নেই। তাই জেলাশাসক বলেন ফসল চাষের পদ্ধতি এবং ফসলের প্যার্টান চেঞ্জ করতে হবে। বাঙালির খাবারও পরিবর্তন করতে হবে। মাছ ভাতের দিন শেষ হয়েছে বাঙালির জীবনে–‘ইয়ে হায় বাঙ্গালি, ওদিন চলা গিয়া, হামার এক দেশ, এক হি ভাষা, এক ফুট হ্যাবিট তো হোনা চাহিয়ে, গেহু মকাই বজরা, কালটিভেট করো, পানি লাগবে না।’ জেলাশাসক ধান বাদ দিয়ে যেসব ফসল চাষ করতে জল কম লাগে সেইসব ফসল চাষ করতে বলেছেন এবং সেইসব ফসল খাবার হিসেবে গ্রহণ করতেও বাঙ্গালীকে অভ্যাস করে নিতে বলেছেন। প্রতিটি নদীতে জল কমে যাচ্ছে, নদী হারিয়ে ফেলছে তার পুরোনো যৌবন। নদীর বুকে দেখা দিচ্ছে বড় বড় চড়া। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা। নদীর জল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হচ্ছে। এই করুণ চিত্রই লেখক অমর মিত্র ‘নদী-ভূমি’ গল্পে তুলে ধরেছেন। গল্পটি হয়ে উঠেছে নদীর হারিয়ে যাওয়ার এক অন্যন্য আখ্যান।
নগর সভ্যতা যেমন মানুষকে অনেক কিছু দিয়েছে তেমনি কেড়ে নিয়েছে আরো অনেক বেশি কিছু। পরিভোগের নানা উপকরণ মানুষের জীবনে এখনো ড়ানো, কিন্তু নগর সভ্যতার জঠরে বস্তুভাবের বেড়াজালে মানুষ হারিয়েছে নিঃসর্গ বেষ্টিত জীবনের শান্ত সৌন্দর্য। বর্তমানে মানবজাতি প্রকৃতি সম্পর্কে বড়ই উদাসীন এবং প্রকৃতিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করাটাই লোকে সভ্যতার মাপকাঠি বলে মনে করে। প্রযুক্তির অত্যাধিক উন্নয়নে আর বিশ্বায়নের হু হু করা বাতাসে মানুষের জীবনের গতি বেড়েছে, অনেক সুযোগ-সুবিধা হাতের মুঠোয় এসেছে এটা যেমন সত্য, তেমনি মানুষের উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ এবং সমস্যাও বেড়েছে শরীরে মনে এবং সামাজিক পরিবেশে। অত্যাধিক উন্নয়ন এবং তার প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর তারই প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র রচনা করেছেন ‘কালো নদী’(২০০৭) গল্পটি।
গল্পের শুরুতেই লেখক জমি অধিগ্রহণ করে দিন দিন কীভাবে মল, টাউনশিপ গড়ে উঠেছে সেই চিত্র অঙ্কন করেছেন। ভরত কুইলা জমি হারা এক সাধারণ মানুষ তার জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে উঠেছে নতুন টাউনশিপ। ভরতকে তাই বলতে শুনি–‘টাউনের ভিতরে যদি ঢুকা যেত, আমি দেখে আসতাম জায়গাটা। কি দেখবা বাবা, আমরা কি আর ভাগের জমিন ফিরে পাব?’ নতুন টাউনশিপে সাধারণ মানুষ ঢোকার সুযোগটুকু পায় না, অথচ তাদের জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ ধ্বংস করেই নির্মাণ হয় এইসব বহুতল শহর। এইসব নতুন নগর সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করার কারিগর রূপেই নির্মিত হচ্ছে। অত্যাধুনিক জীবন যাপনের আশায় আমরা আমাদের স্মৃতি ভরা পুরনো গ্রাম্য জীবনের কথা ভুলে নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে মেতে উঠেছি। তাই গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে নিচ্ছে নগর সভ্যতা। এই জমি অধিগ্রহণ করে শহর নির্মাণের প্রসঙ্গ লেখকের ‘সবুজ রঙের শহর’ উপন্যাসেও দেখতে পাই। উপন্যাসে মনোময় আগের গ্রাম হারিয়ে ভারতকুইলার মতই স্মৃতিচারণা করেছে–“আমার আগের শহর, আগের গ্রাম, বাবা-মা ভাই-বোন, আমার দেখা গ্রাম, যে গ্রাম নগরে ঢুকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেই গ্রামের কথা।”৩ মনোময়ের গ্রাম টাউনে ঢুকে গেছে সেই গ্রামের স্মৃতিচারণা করছে। একইভাবে ভরত কুইলা আফসোস করছে তার গ্রাম হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। লেখক গল্পে বলেছেন–‘পুকুরিয়া গাঁয়ের নাম বলতে তারা বলল, ওই গা আর ভূ-ভারতে নেই, টাউনে ঢুকে গেছে।’
আমাদের মানব সভ্যতার উন্নয়নের প্রভাব গিয়ে পড়ছে নদীগুলির উপর। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে নদীগুলি হারিয়ে ফেলছে তার পুরোনো গৌরব। লেখক তাই গল্পে উন্নত পিচ রাস্তাকে কালো নদী বলে উপমিত করেছেন। কারণ নদীর মতই এই পিস রাস্তা গ্রাম থেকে টাউনশিপকে আলাদা করে দিয়েছে। এ রাস্তা পার হয়ে টাউনশিপে যাওয়া বড়ই কষ্টসাধ্য। শুধু তাই নয়, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার আশায় মানবজাতি বনভূমি কেটে, পাহাড় ভেঙ্গে, নদী-জলাশয় বুজিয়ে প্রকৃতির সর্বনাশ করে গড়ে তুলছে এই পিস রাস্তা। তাই আজ কালো নদীতে সভ্যতা পরিপূর্ণ, আর প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষে পরিপূর্ণ। সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে মানুষ নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন উন্নয়নকে সফল করার আশায়। আর এই উন্নয়নের প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশকে ব্যবহার করেছে। মাটি, জল, খনিজ সম্পদ, জলবায়ু, গাছপালা, জীবজন্তু, ফলমূল, নদী-নালা সবকিছু মানুষ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে। প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই উন্নয়ন করতে গিয়ে মানুষ নষ্ট করে দিয়েছে মানবের বাসরত এই পৃথিবীর ভারসাম্য। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে বহুদিন আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছিলেন–
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাস্ট ও প্রস্তর
হে নব সভ্যতা, হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যছায়ারাশি।”৪
বর্তমানে পুণ্যচ্ছায়ারাশির বড়ই অভাব। তাই কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র ‘কালো নদী’ গল্পেও এই পুণ্যছায়ারাশি ফিরিয়ে আনার জন্য মানবজাতির কাছে আহব্বান জানিয়েছেন।
উন্নয়নের নামে বহুজাতিক কোম্পানি গ্রাস করে নিচ্ছে গ্রাম্য প্রকৃতি, বনভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ। তার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানবসম্পদ এবং মানেবতর প্রাণী। গল্পকার অমর মিত্রের ‘কলসপুর যাইনি’(২০১০)গল্পে উঠে এসেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি কীভাবে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে মানবের ক্ষতি সাধন করছে সেই চিত্র। প্রকৃতিকে ঘিরে মানুষের যে আনন্দ ও স্বপ্ন তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ধ্বংসের সাথে সাথেই সে দৃশ্যই আমরা গল্পে লক্ষ করব। গল্পের কথক বিধান কখনো কলসপুর যায়নি কিন্তু কলসপুরকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। সে না গিয়েও কলসপুর তার কাছে আত্মজার মত কিংবা সহধর্মিনীর মতই পরিচিত। বিধান কলসপুরের চন্দনা নদীর রূপ যেমন জানে, তেমনি জানে বসন্তকালে কলসপুরের রূপের ছটা। তাই সে বারবার কলসপুরে যেতে চেয়েছে। কাজে নয়, ঘুরতে, দেখতে। যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত কলসপুর যাওয়া ভেস্তে গেছে তার। কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে থেকে কলসপুরের খোঁজ নিয়েছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেছে কলসপুরের রূপের বর্ণনা। তার আকাঙ্ক্ষা আরো তীব্রতর হয়েছে। স্বপ্ন দেখেছে, স্বপ্ন বুনেছে কলসপুরকে ঘিরে। সেই স্বপ্নের কলসপুর একদিন তছনছ হয়ে গেল তার যাওয়ার আগেই, দেখার আগেই।
কলসপুরের বনভূমি কেটে নির্মাণ হয়েছে শপিংমল। যার ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হ্রাস হয়েছে। গল্পকার বলেছেন–‘কলসপুরে আগে শপিংমল ছিল না, এখন হয়েছে, টুরিস্টরা কেনাকাটা করছে খুব, শপিং করার জন্যই কতজন যাচ্ছে কলসপুর, শপিং করে ফিরে আসছে।’ যেখানে মানুষ একসময় যেত প্রকৃতির রূপ দেখতে, এখন মানুষ সেখানে যাচ্ছে শপিং করতে। অতিরিক্ত টুরিস্টদের আগমন, তাদের খাদ্য, থাকার জায়গার প্রয়োজন বনভূমি এবং বন্য-প্রাণী এবং বন্য-প্রকৃতি হ্রাসের এক অন্যতম কারণ। লাটাগুড়িতে আজ থেকে দশ বছর আগে যে বনভূমি ছিল আজ তা অনেকটাই গ্রাস করে নিয়েছে টুরিস্টদের খাদ্য ও বাসস্থানের যোগান দেবার প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত প্রতিটি বনভূমি ও পাহাড়ে পর্যটকদের থাকার জন্য তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্ট। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোপ পড়ছে বনভূমির উপর। তাইতো নষ্ট হচ্ছে বনভূমি ও পাহাড়ের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য। কলসপুরের অন্যতম আকর্ষণ কুবাই পাখির এখন আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, যে চন্দনা নদীর খরস্রোত ছিল সে হারিয়েছে তার গতি। শুধু তার গতি হারিয়েছে তাই নয়, চন্দনার জল আজ মাছের বসবাসের অযোগ্য। মানুষ স্নানও করতে পারে না–‘জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে, আ্যাসিড কারখানার বিষে।’ কারখানা থেকে নির্গত দূষিত জল সমস্ত জলাশয়গুলির জল দূষিত করে চলছে। কারখানার দূষিত জল সরাসরি জলাশয়ে না ফেলার জন্য সরকার নিয়ম করেছে। কিন্তু সেই নিয়মকে তোয়াক্কা না করেই বেশিরভাগ কোম্পানি তাদের দূষিত জল জলাশয়ে ফেলছে। ফলে জল হয়ে উঠছে মাছের বসবাসের এবং অন্যান্য প্রাণীর ব্যবহারের অযোগ্য। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ক্যারাক্কাস’ গল্পের কথা। সেই গল্পে দেখতে পাই কারখানার দূষিত জল শুধু মানুষের বা প্রাণীর সাময়িক ক্ষতি করে না। কীভাবে জিনগত পরিবর্তন করে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করে তার করুণ চিত্র। গল্পে নতুন প্রজাতির মাছ দেখা যাচ্ছে–“আঠালো জিনিসটা গোল পাকিয়ে বঁড়শিতে গাঁথলেন স্যার। ফেললেন। একটু পরেই নড়ে উঠল ফাতনা। ছিপে লাগালেন টান।… সুতোর তলায় ফড়ফড় মাছ নড়ছে। স্যার লাফিয়ে উঠলেন। মাছটা ঝুলছে চোখের সামনে। ভীষণ আনন্দ আমার। ঝুঁকে দেখতে থাকি মাছটাকে। হাত খানিক লম্বা। ড্যাবা-ড্যাবা চোখ। সারা গায়ে আঁশ নেই একটুও। খরখরে গা। গিরগিটির মতন।”৫ শুধু নতুন প্রজাতির মাছ নয় গল্পকথকের যখন সন্তান জন্ম নিয়েছে তখন দেখা যায় মানব সন্তানেরও এক নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে।
এভাবেই আস্তে আস্তে কলসপুরের পূর্ণকলস ধীরে ধীরে খালি হতে থাকে। গৌরি বলেছে কিছু একটা অভাব হয়ে যাচ্ছে কলসপুরে ছয় মাস, এক বছর, দেড় বছর আগে যে কলসপুর ছিল সেই কলসপুর এখন আর নেই। থাকবে কী করে–‘পাহাড় ভাঙছে ডিনামাইটে, স্টোন ক্রাশার বসে গিয়েছে, ধুলো উড়ছে সব সময়, ফুল ঝরে যাচ্ছে অকালে।’ জঙ্গলে পাতা ঝরছে আর সেই পাতায় আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে আ্যাসিড কোম্পানির লোক। জঙ্গল পুড়ে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে। মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে নদীর সঙ্গে সঙ্গে। পাহাড় ভাঙছে। তার সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে যুবতী মেয়েরা। ফুল, ধুলোয় রং হারিয়ে ঝরে পড়ছে। বিভিন্ন কোম্পানি ধীরে ধীরে কলসপুরকে গ্রাস করে নিচ্ছে–‘আ্যাসিড কোম্পানি জায়গা দখল করতে এবার পোড়া গাছ কাটবে; তারপর না-পোড়া গাছ কাটবে, জঙ্গল ফাঁকা করবে, করাত কল বসেছে কলসপুরে, টিম্বার মার্চেন্টও হাজির।’ এসব কথা শুনতে শুনতে বিধান চূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল ডিনামাইটে ফাটা পাহাড়ের মতোই। এভাবেই গল্পকার বনভূমি ধ্বংসের এবং প্রকৃতি দূষণের চিত্র এঁকেছেন ‘কলসপুর যাইনি’ গল্পের আখ্যানে। যা পাঠ করে সচেতন পাঠক পরিবেশের বিনাশ কীভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়।
নদী জলাভূমি, বনভূমির মতো পাহাড়ও তার পুরনো গৌরব হারিয়ে ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যেতে বসেছে মানুষের আগ্রাসনে। আমাদের দেশের বহু পাহাড় গত কয়েক দশকে হারিয়ে ফেলেছে তাদের পুরনো গৌরব। অনেক স্থানে শুধু পাহাড়গুলি পুরনো গৌরব হারিয়েছে তাই নয়, হারিয়ে গেছে পুরো পাহাড়টাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গের বন-জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকায়। পাহাড়ও বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়, নিজে চোখেই প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে পাহাড় ফাটিয়ে ট্র্যাকের পর ট্রাক ডলোমাইট বোঝাই হয়ে চলে যায় সেই দৃশ্য। বড়দের বলতে শুনেছি এগুলো ডলোমাইট বোঝাই ট্রাক। কিন্তু এই পাহাড় ফাটানোর বিরুদ্ধে কোনো দিন প্রতিবাদ হতে তেমন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ডলোমাইট আকরিকের লোভে কত পাহাড় এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং হয়ে চলেছে প্রতিদিন মানবজাতির আগ্রাসনে তার হিসাব কেউ রাখে কী? আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা করছে মানুষ। বর্তমানে পর্যটনের ভিড় ক্ষতি করছে পাহাড়ি পরিবেশকে। টুরিস্টদের প্রয়োজনে নির্মাণ করা হচ্ছে বড় বড় হোটেল, শপিংমল, রিসোর্ট, রেস্তোরা যা পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। তাইতো পাহাড়ের উচ্চতা কমছে প্রতিনিয়ত। শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝর্না। সবুজ পাহাড় দ্রুত গতিতে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপট নিয়েই অমর মিত্র লিখলেন ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ (২০১১) গল্পটি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু আগেই অনুভব করেছিলেন অরণ্যের প্রয়োজনীয়তা, গাছপালার প্রয়োজনীয়তা, সবুজের প্রয়োজনীয়তা। ‘আরণ্যক’-এর সত্যচরণ জানতেন অরণ্য রক্ষা করা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু চেষ্টা করেছিল এই অরণ্য ধ্বংসের কাজ যতটা সম্ভব পিছিয়ে দিতে। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে সত্যচরণ আক্ষেপ করেছে তার হাত দিয়ে অরণ্য ধ্বংস হয়েছে বলে। উপন্যাসের শুরুতেই তাই তাকে বলতে শুনি–“এই স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি আমার হাতেই বিনষ্ট হইয়াছিল, বনের দেবতারা সেজন্য আমায় কখনও ক্ষমা করিবেন না জানি। নিজের অপরাধের কথা নিজের মুখে বললে ভার শুনিয়েছি লঘু হইয়া যায়। তাই এই কাহিনীর অবতারণা।”৬ সত্যচরণের জবানিতে বিভূতিভূষণ আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অরণ্য ধ্বংসের কারণে। কিন্তু সেই সময় তার নিশ্চিত ধারণা ছিল পার্বত্য অরণ্যগুলি শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। শেষবারের মতো ধনঝরির পাহাড় থেকে নামতে নামতে সত্যচরণ তাই ভেবেছিল–“লবটুলিয়া গিয়াছে, নাঢ়া ও ফুলকিয়া বইহার গিয়াছে কিন্তু মহালিখারূপের পাহাড় রহিল- ভানুমতীদের ধনঝরি পাহাড়ের বনভূমি রহিল। এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে না– শুধুই চাষের ক্ষেত পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেইসব অনাগত দিনের মানুষেরদের জন্য এ বন অক্ষুন্ন থাকুক।”৭ কিন্তু বিভূতিবাবুর এই ভাবনা আজ সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়ে গেছে। এই পার্বত্য অঞ্চল আজ ধ্বংস হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। তাইতো বিভূতিভূষণের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কাহিনি নিয়েই নতুন করে আখ্যান নির্মাণ করেছেন বর্তমানের কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র। যে বনভূমি পাহাড় অনাগত দিনের মানুষের জন্য সুরক্ষিত থাকবে বলে কথাসাহিত্যিক স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সব পাহাড়ে অনাগত মানুষরা খুঁজে পেল ম্যাঙ্গানিজ, লৌহ আকরিক, ডলোমাইট; যা উন্নত মানব সভ্যতার অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস। আর এইসব সংগ্রহ করতে গিয়ে পাহাড়ের পরিবেশ শুধু ধ্বংস করল তা নয়, পুরো পাহাড়টাই নিশ্চিহ্ন করে দিল মানবজাতি। রাজবিহারী সিংয়ের নাতি ধনেশ সিং রাসবিহারীর থেকেও বেশি বেইমান। তাই তিনি ধনঝরি পাহাড় বিদেশি কোম্পানির কাছে ঠিকা দিয়ে দিয়েছে। সেখানকার মানুষদের উৎখাত করে সেই পাহাড় ফাটিয়ে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য। তাইতো দোবরু পান্নার নাতনি রাজকন্যা ভানুমতির মেয়ে রূপবতীকে ধনজুরি থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে ধনেশ সিং–‘…মাটির তল থেকে কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন সব ধাতু উঠবে, পাহাড় ভেঙে স্টোন-চিপ যাবে শহরে, সব পাহাড় আমার নিজের।… ধনেশ সিং মাটিতে লাথি মেরে মেরে বলল, সব পাহাড় আমার, বিলিতি কোম্পানি বরাত দিয়েছে ভেঙে ফেলতে।… পরশু থেকে ডিনামাইট চার্জ করা হবে ধনঝরি পাহাড়ে, তখন এখানে থাকতে পারবি না।… ওই ধনঝরি থেকে মহালিখারূপ পর্যন্ত যত ছোট বড় পাহাড়, সব সে ফাটাবে। ভেঙে শেষ করবে।’ এভাবেই বসবাসরত, বিশেষ করে আদিবাসী সমাজকে উৎখাত করে সেই সব স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে রিসোর্ট, শপিংমল এবং কোথাও পাহাড় ফাটিয়ে সম্পদ উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ফলে হারিয়ে গেছে পাহাড়, শুকিয়ে গেছে পাহাড়ের ঝর্না। বিভূতিবাবু যে পাহাড় ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষের কাছে রেখে যেতে চেয়েছিলেন তা মানুষ ধ্বংস করছে নির্বিচারে। যে বনভূমি পাহাড় মানুষকে সুস্থ সবল স্বাভাবিক জীবন দেয় সেই বনভূমি কিছু মানুষ অর্থের নেশায়, উন্নত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ধ্বংস করে ফেলেছে। পাহাড়ি জল বাতাস মানুষের বাঁচার জন্য উপযুক্ত। মানুষকে আয়ু দেয় এই পাহাড়ের জল ও বায়ু, তার প্রমাণ আমরা পাই অমর মিত্রের অপর এক উপন্যাস ‘হাঁসপাহাড়ি’-র আখ্যানে। উপন্যাসে দেখি রবিলোচনবাবু অসুস্থ তাই অফিসের এক বন্ধু তাকে বলছে–“তুমি হাঁসপাহাড়ি চলে যাও রবিলোচন, ওখানকার জল মানেই আয়ু,”৮ যে হাঁসপাহাড়ি এসে রবিলোচন সুস্থ হয়েছিল সেই হাঁসপাহাড়িকে রবিলোচনের ছেলে সুনন্দ ধংস করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় হাঁসপাহাড়ির বন-জঙ্গল, নিশ্চিহ্ন করে দেয় পাহাড়টিকেই। তাই সুনন্দ যখন বিভিন্ন আকরিকের আশায় পাহাড় এবং পাহাড়ের উপর গাছ ধ্বংস করে দেয় তখন তার বাবা চুপিচুপি দেখতে গেলে সুনন্দ শাসন করে তার বাবাকে। তাই তো রবিলোচনবাবুকে বলতে শুনি–“দেখতে গিয়েছিলাম গাছটা পড়ল কেন, দেখলাম ডিনামাইট দিয়ে তুই তার শিকড় ছিঁড়ে দিয়েছিলি, ওখানে ব্লাস্টিং করতে কে বলেছিল, শুভেন্দু মন্ডল ত অন্য সাইটে করত। আমার মনে হয়েছিল, তাই।…নিচের এদিকে করলে লাভ বেশি, আর, ওই বটগাছ ত কী হয়েছে, গেছে গেছে। পাহাড় ত আমার।”৯ পাহাড়কে মানুষ নিজের সম্পত্তি বলে ধরে নিয়েছে, তাই নিজের ইচ্ছামতো ধ্বংস করছে। যে পাহাড় রবিলোচনের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে সেই পাহাড়ে আজ জল পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবর্তন হয়ে গেছে জলবায়ু। আলোচ্য গল্পেও একইভাবে ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে বিভূতিবাবুর সেই স্বপ্নের নাঢ়া বইহার, ফুলকিয়া বইহার ধ্বংসের চিত্রই চিত্রায়িত।
অন্যান্য পাহাড়ি মানুষদের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় দোবরু পান্নার উত্তরসূরীও। ভানুমতির মেয়ে-নাতনি। আজকের সময়ে টাঁড়বারো, রাজা দোবরু পান্না কেউই আর বাঁচাতে পারে না বিভূতিবাবুর সেই দেশকে। বন্য মহিষের দেবতাকে ভয় পায় না আজকের রাজপুত। শিং চামড়ার লোভে পশু শিকার করে চলে। তাই গল্পে লেখক বলেছেন–‘কেন না বুনো মহিষ আর নেই। তাদের মেরে চামড়া আর শিং পাচার করে দিয়েছে রাসবিহারী সিং-এর নাতি।’ এই ভাবেই অর্থের লোভে মত্ত হয়ে লোভী মানবজাতি বন্যপ্রাণীদের ধ্বংস করে চামড়া ও শিং পাচার করে চলছে। ফলে বনে আজ আর বন্য প্রাণীর দেখা মেলে না। যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে বনভূমির ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স।
গল্পের শেষে দেখা যায় ধনেশ সিং একরকম ব্যর্থই হয়েছে। কোন ধাতুই বেরোয় না মাটির নিচ থেকে। সয়েল স্টেট, সার্ভে রিপোর্ট, কর্পোরেটের কোন হিসাবই মিলাতে পারে না ধনেশ সিং। যেখানে মাটির তলা থেকে পাহাড় ফাটিয়ে বের করার স্বপ্ন ছিল কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আইরন, ইউরেনিয়াম, সেখানে বেরিয়ে আসে–‘বেরিয়ে আসতে থাকে শুধু ক্যালসিয়াম পতিত হওয়া, চুন হয়ে যাওয়া প্রাণীর হাড়গুঁড়ো। বোন ডাস্ট। শুধু তো মানুষ নয়, যুগল প্রসাদ, রাজু পাঁড়ে, মুকুট নাথ পন্ডিত, ধাতুরিয়া, কুন্তা, মঞ্জিরা নয়, ওই বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমির যত প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, পাখ-পাখালি সব নিধন করে ধনেশ সিং আর টহলদার বাহিনী মাটির তলায় চালান করে দিয়েছিল। শবদেহ মাটির তলায় গিয়ে ঢেকে দিয়েছে যত আকরিক। চুনাপাথর ব্যতীত আর কিছু নেই টের পেয়ে ধনেশ সিং ক্ষিপ্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে।’ পাহাড় ফাটিয়ে কোন মূল্যবান আকরিক ধাতু হয়তো অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায় না। কিন্তু পাহাড় অরণ্য তো আর থাকে না, হারিয়ে যায় মানবের লোলুপ দৃষ্টিতে। পাহাড় জঙ্গল না থাকায় হারিয়ে গেছে জঙ্গলের পশু পাখিরাও, সভ্যতার লেলিহান গ্রাসে। তাইতো আজ হারিয়ে গেছে বিভূতিবাবুর রেখে যাওয়া সাধের ধনঝরি সহ সমস্ত ছোট বড় পাহাড় এবং বনভূমি। ধ্বংস হয়ে গেছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বা বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য।
কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র তাঁর ‘জল ও বায়ু’, ‘কালো জল’, ‘নদী-ভূমি’, ‘কালো নদী’, ‘কলসপুর যাইনি’ এবং ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ গল্পগুলিতে সভ্যতার তথাকথিত উন্নয়ন কীভাবে পরিবেশকে দূষণে ভরিয়ে তুলছে এবং এই দূষণ মানবজাতির বাসরত পৃথিবীকে কীভাবে বাসের অযোগ্য করে তুলছে, সেই চিত্রই পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর সব মিলেমিশে গল্পগুলিতে তৈরি হয়েছে এক নতুন সংরূপ। তাঁর এই অভিনব সংরূপ পাঠকের মনে ভালো লাগার পাশাপাশি পরিবেশ সম্পর্কে গভীর বার্তা প্রদান করে যাচ্ছে। যা পাঠককে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ও সতর্কীকরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।‘Eco-criticism’ আনন্দদানের পাশাপাশি সাহিত্যের কাছে ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’ সম্পর্কে দায়িত্ববোধ প্রত্যাশা করে। অমর মিত্রের আলোচ্য গল্পগুলি নিঃসন্দেহে তার নান্দনিক মাত্রা বোঝায় রেখেও বক্তব্য পরিবেশনার কৌশলে পাঠককে পরিবেশ সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের অভিমুখে পৌঁছে দিতে পেরেছে। তাই গল্পগুলি হয়ে উঠেছে সার্থক ইকো-টেক্সট।
তথ্যসূত্র:
১.মিত্র, অমর: শ্রেষ্ঠ গল্প, অলীক এই জীবন, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯,প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০০৩, পৃ-XVI
২.রায়, কিন্নর: ব্রহ্মকমল, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি-২০০৯,কলকাতা-৭৩, ভূমিকা অংশ।
৩.মিত্র, অমর: সবুজ রঙের শহর, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ-জানুয়ারি ২০০৯, পৃ-১২
৪.ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ: রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রথম খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ‘চৈতালি’, সভ্যতার প্রতি, প্রকাশ জুলাই ১৯৮০, পৃ-৬৬০
৫.চক্রবর্তী, স্বপ্নময়: শ্রেষ্ঠ গল্প, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা পুস্তক মেলা ২০০৩, পৃ-১২৭
৬.বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ: আরণ্যক, প্রস্তাবনা, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা-১২, প্রথম প্রকাশ: জৈষ্ঠ্য ১৩৭১,পৃ-৪
৭.বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ: আরণ্যক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা-১২, প্রথম প্রকাশ: জৈষ্ঠ্য ১৩৭১,পৃ-১৬৩-১৬৪
৮.মিত্র, অমর: ‘হাঁসপাহাড়ি’, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯২, প্রথম করুণা মুদ্রণ বইমেলা ২০০৬, পৃ-৮
৯.মিত্র, অমর: ‘হাঁসপাহাড়ি’, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯২, প্রথম করুণা মুদ্রণ বইমেলা ২০০৬, পৃ-৬০
আকর গ্রন্থ:
১.মিত্র, অমর: শ্রেষ্ঠ গল্প, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০০৩
২.মিত্র, অমর: সেরা ৫০টি গল্প, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১২
৩.মিত্র, অমর: নদী-ভূমি, অর্কিড, অক্টোবর ১৯৯৫, গ্রন্থে প্রকাশ-আশালতা গল্প সংগ্রহ, গুরুচন্ডা৯,২০১৬