শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’ উপন্যাস।)
চোয়ের জলে বুক ভাসি যায়
প্রজাপতির মলিন চেহারা দেই মনে হইল এমন দশা কেমন করে হইল! গলার স্বর দিই কোনও কথা বার হইতেছে না। হরনের ছেঁড়া কাপর দেই বুঝতি হাইরলাম কদ্দিন হইল মনের বেদনায় দিন কাটাইছে। হোলাটারে ঘরে রাই মাইয়াটারে দিই বাপের বাড়ি হাডাই দিছে হোয়রবাড়ির লোকজনেরা। গার রঙ কালা দেই ওরা বোধ হয় মানতি হারে ন। মুখটা তো লক্ষ্মী পিতিমার মতো, তাও কেন এত গোসসা আর অপছন্দ। ওরা নাকি আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ দেখাইতে হারে না। কয়, এ মা কালীরে কত্তুন ধরি লই আইছ? যিয়ান তুন আইনছ হিয়ানে হেরত পাঠাই দাও। কেন বাপু, দেখি শুনি তো মাইয়া নিচ, এয়ন কেন এত রাগ অভিযোগ, মাইয়া কি আঙ্গ হেলনার, রঙটাই কাল হইল, গুনটা নজরে হড়ে নি। ওই হোলাটারে দেইখলে জিগাইতাম, হোলামাইয়া জন্ম দিবার সময় এসব কথা মনে হড়ে ন! একবার আইয়ুক না আঙ্গ বাড়ি, কানে ধরি উঠবস যদি না করাই তো আঁর নামও পঞ্চমী না, এই কই দিলাম, হক্বলে হুনি রাখ। গার রঙ রোদে পুড়ি আরও যেন আলকাতরার মতো হই গেছে। বুকটা কষ্টে দুভাগ হয়। বইঠাকুরঝি দুঃখ হাইস না, এত বড় সংসারে এক কোনে একটা জায়গা ঠিক হই যাইব তোর, ওই রায়ের ব্যাটার যদি মনটা এত পাথরের মতো শক্ত হয়, তুই এত ভাঙি হরতিচস কিয়ের লাই। ঠাউরঝিরে আগে কিছু মুড়ি চিড়া যা ঘরে আছে খাওন দে, হরের কথা হরে হইব। মাইয়াটারে এক গেলাস গরম দুধ দে। তুই যে এতটা পথ ভাঙ্গি আইছস বাচ্চাটার হাত ধরি, কষ্ট হইছে তো। হ্যাঁগো বৌদি। চোয়ের জলে মাটি ভেজে। কোনরকমে তিন মাইল গাঁয়ের পথ ধরি হাঁটি বাকি সাত মাইল নৌকায় করি আবার হাঁটি আইছি।
ন-দেওরের ঘরের হাসে ঘরখানা খুড়ি-শাউরির মরার হরে খালিই হড়ি ছিল। ঘর বইলতে দশ বছরের পুরনো ভাঙা চকি। মচমচ করে। এখনও মরার গন্ধ লাগি আছে। ওই ঘরে ঠাঁই হলো প্রজাপতির। লজ্জাবতী, দূর সম্পর্কের দিদা বিছানা নিছে সেও তো কম দিন হয়নি। তাঁকেই সেবা শুশ্রূষার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলি লইছে প্রজাপতি। লজ্জাবতীর ঘর ছিল হোনাইমুড়ী। হোলাটা অকালে চলি যাইবার পর মাইয়ার বাড়ি ছাড়া যাইবার তো আর কোন জায়গা নাই। বুড়াবুড়িরে কেইবা আর যত্নআত্তি করে। এক গ্লাস জল গড়াই দিব, তেমন কে আর আছে। বুড়ি হারাদিন হড়ি হড়ি চেঁচায়। প্রজাপতি হইছে একমাত্তর ভরসা। তাও কি আর হক্বল সময় ডাইকলে আইত হারে। হরের সংসারে আশ্রয় হাইছে তাই না কত, মাথা গুঁজি কত কামই না করতি হয়। ঘরদোর পয়-পরিষ্কার করা, লেপাপোছা, থালাবাসন মাজা, আরও কত ফাইফরমাস খাটা, নিজের মাইয়াটারেও দেখার সময় নাই। হোলাটার মুখখান তো দিনদিন ঝাপসা হই যাচ্ছে। কার কাছে আর দুঃখের কথা কইব। আঁই হুইরের হাড়ে যাই বসলি ইনিয়ে বিনিয়ে মনের কথা কয়। কারে আর বুঝাই কমু, যে যার তালে চলে, আঁর কথা কে আর হুইনব। প্রজাপতির মাথায় তেল না হড়ি চুলে জট ধরছে, চোখ দুইটা ভিতরে ঢুকি গেছে। তো এক কাম করলি হয় না। হুনছিস কেমন সুন্দর বাজনা বাইজছে। প্রজাপতির কানে যায় নি কথাখান। হুইরের জলে মাছেদের ঘাই মারা দেখছে। রুই কাতলা লাফায় ঝাপায়, ডুব মারে, লেজ উল্টাইলে প্রজাপতি মজা পায়, হাততালি দেয়, হরীরটা নাচায় খুশি মতো। ওইখানে শূণ্য হই তার। শূণ্য কি ভরাট আঁই কিচ্ছুই ভাবিয়ের না, খালি ওর নাচন দেই।
জল ছল ছল, মন ছল ছল, কোন দিকে যাই চল, ঢাক ঢোলের বাজনা বাজে, মাইনষের কথার সাজে, চল যাই চল। প্রজাপতি আঁর ডান হাতটাকে শক্ত মুঠোয় ধরি হুকনা হাতা মাড়াইতে মাড়াইতে কন যে পশ্চিম বাড়ির মঠ মন্দিরের সামনে আনি হাজির কইরল কইতাম হারাতাম ন। কদ্দিন বাদে আইলাম। হক্বল কিছু নতুন লাগে। কত কত ভিটে, আর কত কত ঘর। নেপাপোছা ঘরগুলা এটা ওটার দিকে চাই থাকে। ফাঁকা রাস্তার কোনায় কোনায় ছায়াগুলো দোল খায়। ওরা যেন চুপ করি বই থায়। হাখিরা ডালের ফাঁকে ফাঁকে ডানা ঝাপটায়। কত্ত বড় বাড়ি। গমগম করি ওঠে। ইয়ান তুন ঐয়ানে ঘরের বউঝিরা কান পাতি হোনে কত রাজ্যের কথা। নিজের কথা নিজে কয়, অন্যদের হোনায় ঢঙ করি করি। ওদের কথাগুলা নিজের মতো করি জন্মায়। কখন যে জন্মায়, নিজেরাও জানে না। সকাল সন্ধ্যায় কাজের ঝনঝনানিতে উঠি আসে গল্পগাছার বলাবলি। এমনটা হয়, কারা যেন এক একটা ওই কবে তুন ঝোলায় হুরি রাখইছে, আর বউঝিরা খুলি খুলি বাতাসে উড়াচ্ছে। কেউ কেউ শুনছে, কেউ দলামোচড়া করি কইছে ‘হুশ’। মিলাইতে হারেন না নিজের লগে। নরেন জেঠাহৌরের বয়স আশি হার করি গেছে। উনি কোন পুরুষের বংশধর আঁই কেমন করি জানুম, আঁর হৌউরি জাইনলে জানতি হারে। তবে এইটা কইতি হারি উনি যন আঁরে বৌমা কই ডাকে হরানটা জুড়াই যায়। উনি হাশ দিই চলি যাইবার সময় ঘোমটাটা টানি দি। উনি ঠিক চিনতে পারি কয়, কদ্দিন বাদে দেইখলাম। এই বুড়া হোলাটার খোঁজ তো নিতি পার, মরি আছি, না বাঁচি আছি। দেইখছ প্রজাপতি মাইনষের মনে কত রকমের সাধ হয়, মনের সঙ্গে মন জুড়ি দিতি চায়। নাড়ির টানটা কেমনে যে লতাপাতা ধরি টান মারে এর কোন উত্তর আছে তোর কাছে। মানুষটা চলি যায় আর কবুতরটা পতপত শব্দ করি উড়ে এই ঘরের চাল তুন অন্য ঘরের চালে, আঁই যে ওই ঘরগুন চিনত হারি না, ঘরের মাইনষে তো দূর অস্ত। খুঁইজতে থাকি, খুঁইজতে থাকি, ওরা এই ঘর তুন অন্য ঘরের দিকে দৌড় মারে। দরজাগুনের ফটফট করি আওয়াজ হয়, জানালাগুন খুলি যায়, ওরা আঙ্গরে দেয়, না আমরা ওগরে দেই, কইতে হারিনা, মনটা খালি নাচে। কন যে মনের ভেতর তুন ডাক আয়ে, ওরে তোরা কন্নাই যাস, মুখ ঘুরাই দেখ, ঐটুকুনি দেখছি, কত বড্ডা হই গেছস, ওরা হাখির মতো চিঁ চিঁ আওয়াজ করে, আরও যেন হুনি, আরো যেন হুনি।
কারা যে কীত্তন গায়, প্রজাপতি কান খাড়া করি হোনে। সুরের টানে মজি যায়। কনান তুন আইছে কী জানি। মা মাসীমারা হান সুপারি চিবায়। ওই ঘর তুন এই ঘর তুন ঘোমটা মাথায় শামিয়ানার তলায় দু’পা ভাঁজ করি, কেউ হাঁটুতে মুখ গুঁজি ঘাড় নাড়ে। চোয়ের জল ঝরায়, ঘন হয়ে ডুব দিলে এমনটা হয়। জীবনের রকম সকম সামনে চলি আয়ে। ওরা তালে তাল মিলাই সুরগুন ধরি নিজের নিজের মনটারে ঝাঁকায়। কন্নাই ছিল, কেমনে ছিল কে জানে, মাইনষের কথাগুলো চোয়ের নিমেষে বাতাসে ভাসে। কেউ জিজ্ঞেস করে, তোরা কে লা, কেউ কইতি হারথি ন, খালি না কওয়া কথা কেমনে সামাল দিব, হক্বলে দু’হাতের তালুতে তালি বাজাই ওই কথাই তো ভাবে। ত্রিনাথের আসর জমেছে মাঝ উঠোনে – আম, ক্ষিরাই, ফুটি, কলা, কাঁঠাল দিয়ে ভোগের এলাহি আয়োজন। সিন্নির দিকে হোলাপাইনদের নজর, কন হস্যাদের থালায় হইড়ব, আহ্লাদে আটখানা। বুড়া বুড়িরা মনে মনে ইষ্টনাম জপে। চোয়ে মুয়ের ভাষা হালটি যায়। কোন দিকে যাইব আর কোন ডাল ধরি বৈতরণী হার হইব, ওই চিন্তায় ভাবের ঘরে ডুব মারে। পাঞ্চালী কয় খুড়িমা জেঠিমা আমনেগ হাগুন দেন চাই, নম করি। হাগুন ফাটা ফাটা, ধুলায় আঙুলগুলো ভরি আছে, গুটাই আছে, মেলি আছে। খুড়া, জেঠারা সুরের জোয়ারে ভাসি যায়। হোটা হোটা চোয়ের জল ফেলে। শেষবেলায় আই কৃষ্ণের চরণ ছুঁতি চায়। মনে হড়ে কত কথা, এই বিরাট জগৎ সংসারের কথা। মায়া, হক্বল কথায় মায়া, কেউ আর হিরিও চায় না। কত ঘটনার সাক্ষী হই আছে, কই শেষ করতি হাইরত ন। মাঠ ঘাট জমিন হুকুর ঘরবাড়ি, কত মাইনষের আনাগোনা। কত উল্লাস, কত আনন্দ, সব এক এক করি হারাই গেল। মাথার ঘাম পায়ে হালায়নি, হালাইছে। বরষার জল ফুলিফাঁপি উঠলি হক্বলকিছু কেমন হই যায়। কীরম যে ছিল, এত লোক, এক চালের নিচে জড়াজড়ি। ভাঙি চুরমার হই গেল। ইয়ান তুন হিয়ানে গেল। নতুন নতুন গাছ গজাইল। খালি খালি হূন্য মাঠ মুছি যাই ঘর বানাইল। এক পিঁড়ির লোক যে চলি গেল, কতদিন পার হই গেল, স্মৃতি হই গেল দিনে দিনে। দেশগাঁয়ের ছবিটার অন্য আর এক রূপ আসি পালটাই দিল চেহারাখান। এই হোলাপাইনগুনোর মুখ যেন্ চেনার জো নাই। কীত্তন চইলতে থাকে, খোল, করতাল, কাঁসী বাজাই ওরা নাচি নাচি গান গায় – ও তিন পয়সাতে হয় তার মেলা, কলিতে ত্রিনাথের মেলা। এক পয়সার সিদ্ধি দিয়ে তিন কল্কি সাজাইয়া … …এক পয়সার তৈল দিয়ে তিন বাতি জ্বালাইয়া।
আঁর চেঁচাইয়া গলা ফাঁটে। রতু, বেণী, শিখুরা দৌড়াই দৌড়াই আসে। রসুইঘরের পাশ দিই দলবাঁধি হাঁসের দল প্যাঁক প্যাঁক করি হেছনের হুইলের জলে নাইমবার আগে চোখ পাকাই দেয় বড় বড় লোহার কড়াইগুন ছড়াই বড়াই হড়ি আছে। ওরা আঁর ধমক খাই নাইরকলের ছোবা দিই মাইজত হুরু করি দেয়। হাতও দোলে, মাথাও দোলে। এতগুলা লোকের রান্না হইছে, সময় লাগত না, কন চাই। হক্বলের কামকাজ ভাগ করা আছে। রান্নার ভার রইছে আঙ্গ উপরে। বউঝিরা ঘরদোর, উঠান ঝাঁট দিই, মন্দিরের কামে লাগি হইড়ব। পুরুষ মাইনষে দোকানদারির কামে যাইব, মাঠঘাটে চাষবাস দেখতে বদইলাদের সঙ্গে চলি যাইব। রোজের কাজের জনমজুররা গরুগোতান লাঙ্গল মই লই কেউ বীজতলার কামে হাত লাগাইব। মাঠে যাইবার কালে দলিল মিঞা কয়, বড়ভাবি দুপরের খানাটা দেন। পোটলা বাঁধি পান্তাভাত,আলু সিদ্ধ, ভাজা লঙ্কা। তাই দিনদুপরে খাটুনির পর তৃপ্তি করি খায় হক্বলে মিলি। আউশের বদলে পাট চাষ করে, জলা জমিতে নাইচ্যা, ডাঙ্গা জমিতে বগি পাট। আমনের জমিতে বীজ ছিটাইয়া খেসারীর ডাল চাষ করে। আমন ধান কাটা হলেই মরিচের চারা লাগায়। হাউরিরা, ঠাকুম্মারা, আঙ্গ এক ননদ বেড়াইতে আইলেই উইঠতে বইসতে হানের (পান) ডিব্বা সঙ্গে নিয়া চলে। মনোরঞ্জনদা ছিল আঙ্গ বাড়ির পূর্বদিকে। ওরা হলো বারুই। বিড়া বিড়া হান দিই যাইত। মিষ্টি, ঝাল, ছোট বড় কত রকমের হান। অনেকের হান চাষের সঙ্গে ধান চাষও হয়, ওদের আবার সুখের অন্ত নাই। মুসলমানদের বউ মেয়েরা পুরুষমানুষেরা এক কথায় হানখোর। অঢেল সুপারীর গাছ থাকায় হস্তায় চুন কিনলেই পান চিবান যায়। আবার কেউ আছে গোঁফখেজুরে গোছের, সরকারে খায় ম’জিদে আজান দেয়। একদল লোক তো লাগিহড়ি শুকনা গাঙ সিঁচি হালায়। কম কষ্টের কাজ ন কিন্তু।
কামকাজের খাটাখাটনিতে কন যে সকাল গড়াই দুপর হয়, সূয্য আই মাঝআকাশে পকপক করে, গায়েগতরে জ্বালা ধরে, হাওয়ায় আগুন ছড়ায়। কোথায় গেলে যে শান্তি পামু। হরীলে বড় কষ্ট। হোলাপাইনগুন গরমের জ্বালায় আম জাম বরই(কুল) গয়াম (পেয়ারা) ডেউয়া গাছের নিচে ঘুরঘুর করে, দাপাদাপি করে, ঢক ঢক করি জল খায়, হুক্বাদের (শিশু) তালপাতার পাখায় হাওয়া কইরতে কইরতে পরাণ যায়, কারো কারও হেট (পেট) ছাড়ে। কি আর করুম, আদামননি (থানকুনি) হাতা হুতায় (শিলনড়া) বাটি খাওয়াইলে পেট ধরে বটে, ছেড়ানি কি আর এত সহজে কমে! হক্বল ঘরের বউরা ছুটি আই ভাঙি হইড়লে সন্তোষ কবিরাজের হাতে পায়ে ধরি ডাক করতি হয়। তাও না কইমলে ভরসা সেই হোমিওপ্যাথি রাজেন ডাক্তার আর এলোপ্যাথি ধনঞ্জয় ডাক্তার, ওনারা হইলেন গিয়ে অমাবস্যার চাঁদ। রোগী দেখতি কলে যায় এক গেরাম ছাড়ি অন্য গেরামে, মাঝপথ তুন ধরি লই যাই, কইতে গেলে তুলি লই যাই। এক হপ্তাহ ডাক্তারের দেয়াই হাওয়া যায় না, রোগী তন যমের দূয়ারে। পীরের দরগায়, দরবেশের ডেরায় রোগের তুন বাঁচার লাই মাথা খুঁড়ে মরে। দুঃখের কথা কারে আর কমু, পাঁচ সাত দিন কাতরানি বিছানায় হড়ি হড়ি যেগুন বাঁচি রইল, লোকের মুড়ে মুড়ে ওই এক কথা – কৈমাছের হরান। বিচি-পাঁচড়ার তুন রক্ষা পাওনের লাই ভাদি গাছের গোটা গিলি খায়, মেতী কাঁচা হলুদ আর নিমহাতা মাই সান করে। আম হাঁকে, জাম হাঁকে, কাঁদি কাঁদি কলা হাঁকে, টুক্বুর করি তাল গাছ তুন তাল হইড়লে, হুরু হই যায় কাড়াকাড়ি, কে আগে টোকাই হাইল, কথা কাটাকাটি তো কম হয় না। বৈরাগী বোষ্টমী একতারা খঞ্জনি বাজাই দূর দূর তন আই এই অবসরে মঠ শ্মশানের হাশ দিই সুরে সুরে তালে তাল ঠোকে। কোথায় আর ঝগড়া কোথায় আর ঝাঁটি, ওদের পেছন পেছন ঘোরে সক্বলে। গেরামের পর গেরাম হার করি দুনিয়াদারির খবর লই মন্দিরের সিঁড়িতে পা ছড়াই বসে, জল বাতাসা খাই ঠাণ্ডা হয়,। জিরায়। বউ-মাইয়াদের অনুরোধে দু’চার কলি গানও ধরে – রাধার ঋণে হয়ে ঋণী, হয়েছি ভাই দেশান্তরী,ভাই রে রাধার নামে দন্ডধারী, ভিক্ষা মেগে খাই। …. সাজাইয়ে মা নন্দরানী ননী দেগো খাই; নাচিতে নাচিতে দাদা বলাইর আগে যাই।
এই তো সেদিনও জলে ছিল টলমল। এক বিন্দু জলও চোয়ে হড়ে না অন। এই আছে এই নেই। তেঁতুল গাছের ছায়ায় বসি বসি দেই খাঁ খাঁ কইরছে চারধার, কাউয়ারা কা কা করে, বক কিয়ের লাই চাই বই থায়, চোখ পাকাই পাকাই দেয় কচুরিপানার ফাঁকে কোন মাছ ঘাঁই মারে নি, বই থায় তো, বই থায় শিকারের আশায় আশায়। গাছের তুন পাকা তেঁতুল দুই একটা খসি হড়ে। কাইলা তো টেমবইচা মাছ আর তেঁতুলের হাতা দিই টক রান্না করি খাইচি। পুকুরের তুন লক্ষণ রাম গোপাল কৃষ্ণ ধনারা গামছা দিই তেলচাপাটি, পুঁটি,চাঁদা ধরি এক খলুই হমান উঠানে ঢাললেই কল্পনা চঞ্চলা চলন্তিকারা দুই তিন খান বটি লই মাছ কাটতি লাগি হড়ে। কলমি শাক, মাষকলাইর ডাইল হোলাপাইনগুন পেট ভরি খাইছে, বাড়ির কত্তারাও খাইছে, হাঁড়ি কড়াইতে যেটুক বাকি ছিল মাইয়ালোকের পেটে হইড়ছে। মাইয়ারা খাইল কি খাইল না, কে আর খোঁজ রাখে। ওনাদের আর দোষের ভাগী করি না, নজর দেওনের কি আর সময় আছে? নাই, কারওই সময় নাই। হক্ষিরা মাঠ খালবিলের আকাশ জুড়ি চক্বর মারে, দেইখতে গেলে কত না ভাব, কতনা ডানায় ডানা ঘষা, কত না ভালোবাসা, ছানাপোনার জন্ম দিচ্ছে, যত গণ্ডগোল শিকার নিই কাড়াকাড়ির বেলায়। কত দুঃখ শোকের জন্ম নিচ্ছে মনের ভেতরে। বিলের কচুরিপানা থকথকে মাটির সঙ্গে মিশি যায়, নীলচে রং এর ফুলগুলোও মিলাই যায় অন্য কোথায় কইতে হারি না। মানুষও তো আসি আর যায়। ঋতু হালটাইতে হালটাইতে একদিন রং ঢং সব পালটি যায়, কেউ অকালে হুয়াই যায়, হাড়গোড় নড়বড়ে হয়, ক্ষইতে হুরু করে। বেগ্গাইন আজ হুকনা, পচা গন্ধ ভাসি আসে মাঠঘাট তুন। আঁচল দিই নাক চাপা দিলেও রেহাই মেলে কই। আগুনে বৈশাখ খেলাই তো করে নিজের মনে। এই বুঝি কেউ আই জপটাই ধইরল, গলা টিপি শেষ কইরব,রাস্তা আছে নি যে মিলব। পোকামাকড়ের বিষ, সে আর কম কী! শত্রুর দমন করা তো চাই। বাড়ির সামনে কাস্তে দিই মাটির উপর চৌকণা ছক কাটি চিড়া খই লাবনী খেসারীর ডাইল ছড়াই দেয় কত্তারা আর ছকের মাঝখানে দিই বড় কাঁচা আম হোয়াই এক কোপে দুই টুকরা করি তার হরে কাঁচা আম খায় সক্বলে সঙ্গে খই মুড়ী চিড়া ছাতু দই লাবন গুড় নাইরকল দিই মাখি ফলার করি। ছুরি দা নিই বাইর হয় হোলাপাইনরা হিঞচে, লতি, বনাইটগা কাটি আইনলে কুমড়ার ডাঁটা, কাঁঠালের ইচঁড়, নিম,উচ্ছে, হিয়ালের মুথরা, লাল আলু, নাইরকল কুচি ভাজি, বড়ি মিশাই পাচন রান্না করি। জীবনের কত রঙ। কত গান যে ঘুরি ঘু্রি মুয়ে মুয়ে হেরে। জমির উপর স্বত্ত স্বামীত্ব বজায় রাখার গান। ওই দেইখছনি চেঁয়ডি গাছের টুকরার মাথায় একখান খড় পাগড়ীর মতো বাঁধা কাঠি পুঁতি দেয়। গিরস্থরা মাথায় জল ঢালি কয় – জাগো জাগো জাগো, যাবৎ জীবন তাবৎ থাকো।
আঙ্গ বাড়ির হন্মুখে অশ্বত্থ বট নিম গাছের গোড়ায় হক্বলে মিলি নম কইরত। কিয়ের লাই কইরত জিগাইলে বড়ঠাম্মা পিঠ ঝুঁকাই মাথা নাড়াই কত কথাই মনে মনে কয়, মথামুণ্ড বুঝি উঠতি হারি না, তবুও খোঁচাইতে ছাড়ি না। কয়, আর একবার যদি জিগাইস্ ভালা হইত ন, মাইয়ার বাড় বাড়ছে। আঁই অনও বুঝি উঠতি হারি না, এত লুকাই রায় কিয়ের লাই। এই সংসারে কত গোপন কথাই না আছে, ঝিম মারি রায়। এই ওর কথায় সায় না দিলে বাড়ি শুদ্ধ মাথায় করে। কাইজ্যা শুরু হই যায়, এক কথার তুন আর এক কথায়। ঝুড়ি ঝুড়ি সুয়ারী গাছ তুন হাড়ি লই কাচারিবাড়ির সামনের খালি জায়গায় বস্তায় হোরে। সারা দুপর ভরি হাড়ে, বিয়ালে নাওতে ভর্তি করি হাটের দিকে ছোটে, সঙ্গে পঞ্চাশ ষাটখান ঝুনা নাইরকলও থায়। হাট তো কম নাই, গরু হাটা, ছাগল হাঁটা,ধান চালের হাটা, নৌকা বেচার হাটা, যোগী হাটা, হাস-মুরগী হাঁটা, হাঁটে আবার লাঙ্গল জোয়াল, খড়ম,কামারশালা বাইন্যা পট্টিও আছে। আঁর দেওর ভাসুর আর বাড়ির হোলারা এসব লই নাওয়ে চাপি হাটে যায়। নৌকায় ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করি বৈঠা বাই ছোটে, কেউ কেউ গলুইয়ে বই হাওয়া খায়। দুদিকে চাষের জমি মুখ তুলি চাই থায়। মাইয়ারা মেলইনা ধান হুয়াই ঘরে তোলে। মাটির চুলায় রান্না চাপায়। কেউ কেউ হুজার ঘরে কাঁসর ঘন্টা বাজাই হুজার কামে লাগি যায়। সুর তুলি হাঁচালি হড়ে। পূজার আয়োজন শেষ হইলে কৃত্তিবাসী রামায়ন ব্যাসদেবের মহাভারত লই চইয়ের উপরে বসে। রাম-সীতার বিরহ আর পঞ্চপান্ডবের অজ্ঞাতবাস পর্বে দ্রৌপদীর লাই চোয়ের জল ফালায় আর চোখ মোছে, বুড়ো বুড়িরা ওদের ঘিরে বই থায়, ওদের ভাবনাচিন্তা গুলান মহাকাব্যের গল্পে হাঁটাহাঁটি করে, বুঝতে হারে কিনা তিন কাল যাই, এক কাল ঠেইকছে। উদাস হই যায়, তারপর লাঠি ভর দিই খোড়াইতে খোড়াইতে যার যার বিছানায় যাই লম্বালম্বি হই হুইয়া পড়ে। কেউ ডাইকলে উঠি চাইট্টা ভাত না হয় দুইখান রুটি খাই ঢক ঢক করি জল গিলি হালায়। মাইয়াগুলান রসুই ঘরের দিকে ছোটে। বাবা কাকা জেঠাদের লাই খানা দিত হইব তো। ওরা বিয়ার লায়েক হইছ, পনের ষোল বছর বয়স। দূর দূর গেরাম তুন বিয়ার সম্বন্ধ আয়ে। হণের(পণ) ট্যাঁয়া (টাকা) বাজারের জিনিস দরাদরি করার মতো করিও না পোসাইলে গটগট করি চলি তাই। গা’র রঙ কালা হইলে, মাইয়ার হরিলে কোন খুঁত থাইকলে হণের ট্যাঁয়া চারগুণ বাড়ি যায়। মাইয়া দেখানো তো নয়, এই যেন বাড়িতে এক মোচ্ছব লাগি যাই, সোলার বাপের চওড়া হাসি দেই পিত্তি জ্বলি যাই। শুভপুর, নরোত্তমপুর, বিজয়নগর, লক্ষীপুর কত জায়গার তুন টোয়াই টোয়াই কত্তারা হীরের টুকরা হোলা খুঁজি আনে। জমিদারবংশ হইলে তো কথাই নয়।
কতবার ভাইবছি যে এমন নিয়ম কে বানাইছে। এটা নাকি দস্তুর। তবে আঁর বিয়ার সময় আঁর হৌরমশাই এমন দাবিদাওয়া করে নাই। দেইখতে শুইনতে মন্দ তো ছিলাম না, লোকে বইলত, ফর্সা টুকটুকে কইত, কত বড় ঘরের হোলার লগে বিয়া দিছে। হবু বর আইন নিই ঘাটাঘাটি করে, এসব লই কিছুই মাথায় আসেনি। হুইনছি দূর সম্পর্কের এক মাসীর মুয়ে, হবু স্বামীর আমার গায়ের রঙ কালা হইলেও বিদ্যাবুদ্ধিতে বারো-গেরাম জোড়া নাম, হক্বলের মুয়ে মুয়ে ফেরে, বাঘে গরুতে নাকি এক ঘাটে জল খায়। ডরে কাবু হই গেলাম। কারে আই মনের কথা কই। আঙ্গ বাড়ি ছিল সংরাইশ। পরের ঘরে যাইত হইব। ইসকুলে হেডমাষ্টার মশাই হুনি তো থম মারি গেলেন। হড়াশুনায় পেথথ্ম ছিলাম তো। পাঁচ কেলাসে হড়ি তন। উনি ঘাড় নাড়ি কইলেন, ‘এইটা কি ঠিক হইল। তোর বাপ মা তো ইসকুলে পাঠাইতে চায় না। মাইয়া মানুষের হড়ালেখা করি কী হইব! শেষমেষ বোঝাই সোনাই তো পেথথম কেলাসে ভর্তি করি দিল কিন্তু কিন্তু করি। হুইনতাম আঁই, হক্বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাতে আঁর কিছু মনে হইত না। হড়ালেখা শুধু হোলারাই কইরত, মাইয়াদের ভাগ্যে তো জুটত না। অনও মনে হড়ে যেদিন কেলাস টুতে শ্লেট পেন্সিল লই টেবিলের এক কোনে বই কালা রঙের দেয়ালে সাঁটানো চৌকোনা জিনিসটার দিকে তাকাইলাম, মাষ্টার লিখি লিখি বুঝাচ্ছিল কারে কয় কবিতা। চক ডাষ্টার হাতে লিখছে আর মুইচছে – ওঁর যদি সেই পুতুল নিয়ে ভাঙেন কেহ রাগে, বল দেখি মা, ওঁর মনে তা কেমনতরো লাগে। কইল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম হুইনচস। এইটা হলো ‘শিশু ভোলানাথ’-এর ‘পুতুল ভাঙা’ কবিতার পঙক্তি। পঙক্তি কারে কয় কী জানি! ভেতরটা নড়েচড়ে ওঠে। যত হুনি, মনে হয় আরও হুনি। মাষ্টারটাও তেমন, গড়গড় করি কত কবিতার কত লাইন মুখস্ত কই যায়। এমন করি কেউ কথা কইতে হারে! দুয়োরানী, তালগাছ, পথহারা কতবার করি যে হোনায়, ভুইলতে যেন না হারি। ‘ওই যে রাতের তারা, জানিস কি মা, কারা? সারাটি খন ঘুম না জানে, চেয়ে থাকে মাটির টানে। জ্যোতিষী কবিতা এতবার করি হুইনছি, মনের মধ্যে গাঁথি গেলে হারাক্ষণ ঘুরিফিরি ঘরের মধ্যে আওড়াইলে আঁর মা ভাইবত মাইয়াটার বোধ হয় মাথা খারাপ হইছে, না হইলে এমন বিড়বিড় করে কেন! এর উত্তরখানা আঁরও জানা ছিল না। শুধু কইতাম আমনে বুঝতেন না। ইসকুলে না পাঠানোর ব্যাপারে বাড়ির হক্বলে মিলে মনস্থির কইরল। আঁই তো ইসকুলে যাইয়ুমই, জিদ ধরছি। হক্বলে তাইতে হার মানল। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সবই তো শিখছিলাম, আরও কত কিছু যে শিখা হয়নি এয়ন বুঝি।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)