শশবিন্দু
লোকে বলে মেয়েটি সব বোঝা বয়ে উদাসিনী হয়েছে। আর নদীটা! সে-ও নাকি সমান অভিশাপের বোঝা কাঁধে নিয়ে পথ হারিয়েছে। পথের পাশেই নদীটার বাস। ঘর বেঁধেছে মেয়েটি আড়ে বহরে জলা জঙ্গলে। পথটা যখন জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘরবাড়ি ছেড়ে সমতলের ছোঁয়ায় মেতে উঠল, একটুও ভাবা যায় নি, কোথায় গেলে দেখা হবে সেই প্রিয়জনদের মুখ। ঝিকি অচেনা মানুষ দেখে দাঁত নখ বের করে তেড়ে আসবে এমনই ভাবনায় ছিল। কিন্তু তাহা হলো না, লেজ দুলিয়ে প্রভুভুক্তির প্রমাণ দিয়ে গা ঘেঁষে ঘর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেল। কে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘বলতো ‘ঝিকি’ এরা কারা?’ ও কিছু বলল না, একটু পরেই চোখ দুটো তুলে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল। ঝাঁকড়া কালো কালো লোমে ঘেরা শরীরটাকে দুলিয়ে দুলিয়ে সকলকে বসতে বলল যেন। ঘরের অন্দরে গিয়ে ডেকে নিয়ে এলো পথ সঙ্গিনী যুবতীকে। আমাদের পথ চলার ক্লান্তিকে নিমেষে দূর করিয়ে দিয়ে যখন মেয়েটি হাসি হাসি মুখ করে পা ছড়িয়ে মুখোমুখি বসল, বোঝা যাচ্ছিল নানা প্রশ্ন এসে ওর মুখে ভিড় করেছে। এক পক্ক কেশ বৃদ্ধা এসে কথার সূত্র ধরে কথার জালে জড়িয়ে দিল। কথার জোয়ার তাঁর এত প্রবল ছিল, একটু আগে বুঁদ হয়ে দেখা দু’পাশের খটখটে হয়ে যাওয়া সরু সুতোর মতো বয়ে চলা নদীটাকে বারবার করে মনে করিয়ে দিল। আরো স্মৃতি উসকে দিল ওই দূরে, আরো দূরে শুকনো নদীর বুকে, ন্যাড়া গাছ গুলোর মুখ। ওরা কার দিকে চেয়ে বসে আছে। তবুও কোথা থেকে দু’একটা নাম না জানা পাখি এসে মরা ডালে বসে জানান দিল, ওরা মরেনি, বাঁচতে চায়। পাখি দুটো দু’এক কলি গানও গাইলো যেন। আমাদের পথের সঙ্গী হওয়া সেই চেনা মেয়েটাও সুরে সুর মেলালো।
সুরের রসে ভিজল দু’চারজন ভ্রমণ পিপাসু নানা বয়সের মানব-মানবীরা। মেয়েটা তখনও গান থামায়নি। পাখি হতে চাইল সে। সুরে সুর টেনে ভেসে যেতে চাইল দূর থেকে দুরান্তে। কয়দিন আগেই তো তার সেই দুরন্তপনা সকলকে অবাক করেই দিয়েছিল। একজন মানুষ তো লোভ সামলাতে না পেরে বলেই ফেলল, ‘এই মেয়েটাকে চেনেন?’ এই হল সেই মেয়ে যে মানুষ খুঁজে বেড়ায়। মানুষের দরবারে যে কখনও কোন নালিশ জানায়নি। বরঞ্চ সুযোগ পেয়ে কেউ যদি বলে, তুমি এরকমটা হলে কেন? মেয়েটা ঠোঁট টিপে হেসে বলে – জানি না তো! কেমন হলে তোমরা খুশি হতে? এই ধরো, তোমার কৈশোর গেছে তো অনেকদিন, যুবতী হয়েছ সে-ও তো কবে, মনে তো পড়ে না। মেয়েটি বলল, ‘ছাড় তো, এসব কথা। তোমরা কি জানো কে কখন জেগে উঠবে, কে কখন ঘুমোবে?’ এইতো সেই নদীটা, কবে থেকে ঘুমিয়ে আছে মরার মতো। জ্যান্ত ময়াল সাপটা পথ হারিয়েছে। পাহাড়ের কোলে ঘুরে বেড়াবে বলে নদীপথটা জাপটে ধরেছে। শেষ রক্ষা হয়নি। কেউ বলল,’ও পাহাড়ের রানী গো।’ মেয়েটি সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। সেও তো পাহাড়ের রানী হতে চায়।
মেয়েটি চুলবুলিয়ে পথ থেকে চলল আর এক পথে। গা এলিয়ে দিল নদীর বুকে। দূরে নাকি ময়াল সাপটা শুয়ে ছিল, একটুও ভয় পায়নি যে। কেন ভয় পাবে সে? সকল ভয়াল রক্তচক্ষু মেলা মানুষদের ও আমন্ত্রণে নিমন্ত্রণে ওর উৎসবেই তো আহ্বান করেছে। ভেবেছিল ওদের ডাকে ও হারিয়ে যাবে। কিন্তু না, এমনটা হয়নি।
আর একজন মাঝবয়সীর আর তর সইলো না। ‘হ্যাঁগো, তোমার গল্পটা বল না?’
কোন গল্পটা বলবে সে? ওর যে অনেক গল্প। মেয়েটা ভঙ্গিটা পাল্টে আড়াআড়ি হয়ে বসল। এবার যেন কথা চালাচালি ছেড়ে নতুন কথা বলবে।
ধর্মের প্রসঙ্গ ট্রেনে বলল, তোমরা ঈশ্বরকে চেন?
বৃদ্ধা বলল, কোন ঈশ্বর? লালন ফকিরের ঈশ্বর?
সে আবার কেমন দেখতে? কৃষ্ণ কালো, যমুনার পাড়ে পাড়ে যে ঘুরে বেড়ায়?
আরে না।
ত্রৈলঙ্গ স্বামী, না ঈশ্বরপুরি?
মেয়েটির চোখ দুটোতে তখন আগুন রাঙানো দৃষ্টি। সরু নদীটা হবে হয়তো তোর্সা কিংবা জয়ন্তী যেমন খুশি তেমন তাদের চলন। দু’পাড় জুড়ে নুড়িপাথর, পায়ের গোড়ালিতে এসে চুমু খায়। এই আত্মীয়তা ভোলার নয়। শুকনো ডালপালা মেলে মর্মর শব্দে কাঁদছে – আমাকে শাখা দাও, পাতা দাও, আমার রংটা ফিরিয়ে দাও।
মেয়েটির চোখে চাপা কান্নার ভার হিলহিলিয়ে ওঠে।। ও তো আত্মীয়তার বাঁধনে সুতো গেঁথে জীবন কাটাতেই চেয়েছে। যে দিকে দু’চোখ যায় সবুজ সবুজ একটি কুঁড়ি দুটি কচিপাতা। দিগন্তে ছড়ানো তার চাওয়া পাওয়া। মেয়েটি ছুটছে, পাতার পর পাতা সরিয়ে খুঁজছে পথ। তাকে তো যেতে হবে অনেকটা দূর। হ্যাঁ, কত লম্বা পথ, নেই কোন সীমানা। পথ হারানো, পথ মাড়ানো মাটি ছোঁয়ার গান যেন গাছগুলো গায়। ওরা যে রসদ খুঁজতে চায়। না হলে বাঁচবে কেমন করে? এক যুবা পুরুষ অনুরোধ করল মিনতির সুরে, তোমার গল্পটা বল না?
আমার আবার গল্প কি?
লোকে বলে ফিসফিসিয়ে, তোমার নাকি অনেক গল্প? মায়ের গল্পটা এরকম আর কি।
মাকে কাঁধে নিয়ে যেতে হবে অনেকটা পথ। বাঁধভাঙ্গা জল আসছে তেড়েফুরে। এই নাকি হাঁ করে গিলে নেবে। নিরুপায় হয়ে পেছনের পৃথিবীকে শেষবারের মতো দেখে নিল। একে একে হারিয়ে গেল গন্তব্যে পৌঁছানোর সব রাস্তা নিমিষে। কী করতে পারে ও এখন? ন্যুব্জ হয়ে থাকা, ভয়ে কাবু হয়ে যাওয়া মায়ের ছেঁড়া শরীরটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বলে, ‘চলো জোয়ান হ্যাঁইয়ো।’ মায়ের চোখ দুটো দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আধারের আলোতেও যার কোন ঠাঁই নেই। কিন্তু তাকে যে পৌঁছতেই হবে। মায়ের শরীরটা যে ঝুলছে।
অভিশাপ কুড়িয়েই চলেছে নদীটা।
যুবাপুরুষটি বলল, ‘কী হলো, থামলে কেন নদীর মেয়ে ‘নাগরি’? নামটা এমনিতেই মুখে এসে গেল বুঝি। নামের মধ্যে জড়িয়ে গেছে অনেক জাদু।
তুমি কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ ‘নাগরি’?
এর অর্থ কী!
বাপরে কত তার অর্থ ।
সবকিছুর অর্থ খুঁজতে যেও না। কিছু শব্দে মিশে থাকে অর্থহীন, গোত্রহীন ভালোবাসার গল্প। আগে বল, তুমি কার অপেক্ষায় দিন গুনছ?
আমার অমর ঈশ্বর। সে আমার পড়ন্ত বেলার ঈশ্বর।
গোধূলির ছায়া এসে পড়েছে তার গায়ে। একে একে সরে গেছে জলের তোড়। ওদের বাঁধন ছেঁড়া গান বাজছে ওর বুকে।
আমাকে কি কেউ ডাকছে?
হ্যাঁ ডাকছে। মূর্ছা যাওয়া, অভিশপ্ত নদীটা আমায় ডাকছে। চিৎকার করে আমায় ডাকছে। বলছে, ‘আমায় জল দাও, আমায় প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার মন্ত্রটা মনে করিয়ে দাও। আমি প্রাণহীন গাছের শরীরে প্রাণ ফিরিয়ে দেব। ওদের কষ্ট উধাও হয়ে গেলে আমার শাপমুক্তি ঘটবে।
‘নাগরি’ বেশ করে কাঁদতে চায়। কাঁদলে তো হবে না। কে ওর চোখের জল মোছাবে? মোচন করার দায় যে সম্পূর্ণ ওর নিজের।
এরা কেউ কেউ সোফা-কাম-বেডে বসেছিল, কেউ বা চেয়ারে, কেউ নরম বিছানায়, কেউ ‘নাগরি’র ভেতরে বয়ে চলা নদীটাকে খেয়ালই করেনি।
‘নাগরি’ নিজের শরীরটাকে ধরে নাড়িয়ে দিলো – দেখতে চাইল কোথায় বাসা বেঁধেছে সব মারণ রোগ।
কিচ্ছু নেই কোথাও নেই।
নদীটা ক্রমশ ঢেউ তুলে আসছে ওর কাছে। জাপটে ধরতে চায় দু’হাতের বেড়িতে।
ধরা যে দেওয়ার কথা নয় ওর, ঢেউয়ের বুকে মিশে যাওয়াতেই ওর আনন্দ। অভিমানী, ‘নাগরি’ এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। নিজের বাহনে নিজেই চেপে চলে যায়।
মরা গাছগুলোতে প্রাণসঞ্চার হবে যে। সে দৃশ্য বড় মায়াবী। ‘নাগরি’র গল্পটা বলাই হলো না। হয়তো অনেক গল্প, আগামীতে বলবে। এখন এই কথাটি বলে ক্ষান্ত হয়। জীবনের সঙ্গে আলিঙ্গন করতে চায় – ‘আমি বাঁচতে চাই ঈশ্বর, আমাকে বাঁচতে দাও। আমার দিন ফুরোয়নি যে এখনো। আমি যে এই নদীরই মেয়ে।’
নদী আছড়ে পড়ে জবাব দেয় – ‘চলে এসো, এসো, আমি তোমাকে অনেকদূর নিয়ে যাব। কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না। তুমি তো তাই চাও, বল চাও তো?’
‘নাগরি’ কি শুনতে পেল নদীর কথা, কী জানি, সে কেবল ‘নাগরি’ই জানে। মানুষজন ‘নাগরি’কে উদাস হয়ে বোবা হয়েই দেখল।
নদী তুমি শুনতে পাচ্ছ তোমার গর্ভকোষের ধ্বনি – ‘নাগরি’ মোর নাম।
‘নাগরি’ ঝিকিকে কোলে তুলে নেয়, আদরে আদরে ভরিয়ে বাহনে চড়ে বসে। ‘ঝিকি’ আহ্লাদে আটখানা হয়ে গুলগুল চোখে চেয়ে থাকে – ‘নাগরি’ ঘর ছাড়ে, নদী যে ওকে ডাকে, মোজনাই-এর আত্মীয় সাজার আকাঙ্খা পুরণ হবে কেমন করে! ও যে গাছেদের কথা দিয়েছিল ‘ও একদিন গাছ হবে।’ মরতে চলা মোজনাই-এর শেষবলার দিনগুলোর সাক্ষী হবে। প্রশ্ন যদি কেউ কোনদিন করে ‘ সে কী তোমরা কেউ দেখতে পাওনি?’ ও তখন শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে বলবে ‘দেখেছি আমি মরার আগে ও কাঁদছিল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।’
যুবাপুরুষটি আর একবার নাগরি’র কন্ঠস্বর শুনতে চেয়েছিল, নদীর কলকল শব্দে, ডালপালাদের কান্নায়, নিজেদের নির্জনতায়। জনে জনে জানতে চাইল। ওরা বলল, ‘কেউ ওর টিকিটিও দেখেনি।’
কোথায় গেল ‘নাগরি’? এতটা অভিমান মানুষের হয়!