তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

চন্দ্রকান্ত তর্ক লঙ্কার

প্রাচ্যবিদ্যায় পারদর্শী বেশিরভাগ পণ্ডিতদের মতোই মহামোহপাধ্যায় চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারও কৌলীক পদবীর পরিবর্তে প্রাপ্ত উপাধিতে সমাজে পরিচিত হতেন। অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার সেরপুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে আবির্ভুত হন। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত রাধাকান্ত বিদ্যাবাগিশ। বাল্য বয়সে পিতৃবিয়োগ হলে তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র নবদ্বীপে চলে আসেন। সেখানে তিনি বিখ্যাত পন্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের কাছে স্মৃতি, শ্রীনন্দন তর্ক বাগিশের কাছে ন্যায়,  কালীনাথ শাস্ত্রীর কাছে বেদান্তের পাঠ শেষ করে চন্দ্রকান্ত ‘ তর্কালঙ্কার’ উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন। 
   এরপর তিনি নিজ গায়ে ফিরে গিয়ে একটি চতুস্পাঠী স্থাপন করে সেখানে অধ্যপনা শুরু করেন। এখান থেকেই তাঁর খ্যাতি সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৭৯ সালে সংস্কৃত কলেজের এক্সটার্নাল স্টুডেন্টদের পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরই ফাঁকে তিনি একটি দুরূহ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ‘গোভিল গুহ্য সূত্রের’ অনুসন্ধান করে তার একটি ভাষ্য রচনা করেছিলেন। ১৮৮০ সালে তাঁরই সম্পাদনায় ‘বিবলিওথিকা ইন্ডিকা’ গ্রন্থমালায় প্রকাশিত হয়। এর পাঁচ বছর পরে জার্মানি থেকে ড:ডোরপ্যাটের সম্পাদনায় এর জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮৮৬ সালে বিখ্যাত পন্ডিত ম্যাক্স মুলার সম্পাদিত ‘সেক্রেড বুকস অফ দা ইস্ট ‘ গ্রন্থমালায় স্থান লাভ করেছিল। এইভাবে তাঁর খ্যাতি দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বে খাতি লাভ করেছিল।
   ইতিমধ্যেই তিনি সংস্কৃত কলেজের আধ্যপনার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। এই পর্বে তিনি বঙ্গ দেশের প্রাচ্য বিদ্যা চর্চার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এশিয়াটিক সোসাইটির সংস্পর্শে আসেন। সেখানকার বিবলিওথিকা ইন্ডিকা গ্রন্থমালা তে তাঁর সম্পাদনায় পর পর প্রকাশিত হতে থাকে তিন খন্ডে ‘পরাশর স্মৃতি’ , দুই খন্ডে ‘কুশুমাঞ্জলি প্রকরনম’ খন্ডদেবের ‘ভট্ট দীপিকা’ , ‘গোভিল পরিশিষ্ট’ এবং ‘সূত্র গৃহ্য’ সংগ্রহ প্রভিতি।
   ভারত বিদ্যাচর্চার প্রতিটি পরিসরকে তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন। আমাদের যে সকল ধ্রুপদী রচনা তার বেশ কিছুকে তিনি সম্পাদনা করে সহজবোধ্য ভাবে সাধারণের সমক্ষে আনেন। তিনি আলোকপাত করেছিলেন প্রায় অজ্ঞাত সাহিত্য সম্ভারের। প্রাচ্য বিদ্যাচর্চায় তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ভারত সরকার ১৮৮৭ সালে তাঁকে
‘মহামোহপাধ্যায়’ উপাধি প্রদান করে সম্মানীত করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যপনার পদ থেকে অবসর নেন। উনিশ শতকের একদম শেষার্ধে তিনি আরো কিছু গ্রন্থ প্রণয়ন করে ভারত বিদ্যাচর্চা কে আরো প্রসারিত করেছিলেন। গ্রন্থগুলি ছিলো, ‘প্রবোধ প্রকাশ’, ‘সতী পরিণয়’, এবং ‘অলঙ্কার সুত্রম’।
   ১৮৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চন্দ্রকান্ত মহাশয় কে পঞ্চাশ হাজার টাকা দক্ষিণায়  পাঁচ বছরের জন্য সদ্য প্রবর্তিত ‘ শ্রী গোপাল বসু ফেলোশিপ লেকচার’ প্রদানের জন্য  আমন্ত্রন জানান। তিনি ১৯০২ সাল পর্যন্ত সেখানে মোট ৪২ টি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন হিন্দু দর্শনের জটিল বিষয় গুলির বিচার ও মীমাংসার উপর। এ কাজে তিনি দর্শন শাস্ত্রের জটিল – কঠিন পরিভাষা গুলিকে সহজ বাংলায় প্রকাশ করার জন্য যে মেধা ও অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। এই বক্তৃতাগুলি পরে গ্রন্থাকারে ‘লেকচারস অন হিন্দু ফিলোসফি – হিন্দু দর্শন ও বেদান্ত ‘ নামে পাঁচ খন্ডে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বাংলা ভাষায় হিন্দু দর্শনের যে মণি মাণিক্যের যে ভান্ডার উন্মোচিত করেছিলেন তা এককথায় তুলনাহীন। ভারত বিদ্যাচর্চার নানান দিক নিয়ে যেমন, অলঙ্কার, স্মৃতি, ব্যাকরণ, ন্যায়, দর্শন, নাটক বিষয়ে ৪০ টি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছিলেন। এছাড়া সমসাময়িক পত্র পত্রিকায় কিছু লিখেছিলেন, যে গুলি পরে:শিক্ষা’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
   অতয়েব, চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার যে অসম্ভব মেধা ও ধী-শক্তির পরিচয় দিয়ে একের পর এক গ্রন্থ প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে ভারত বিদ্যাচর্চার যে নব দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন তাতে আমাদের মনে যুগপৎ শ্রদ্ধা ও বিস্ময় জাগে। এই বিরল প্রতিভার অধিকারী মানুষটি ১৯১০ সালে কাশিধামে প্রয়াত হন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁকে বাঙালী প্রয়াণের একশ বছরের মধ্যেই বিস্মৃত হয়েছে 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *