সৌমিতা রায় চৌধুরী
লেখক পরিচিতি
(প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বড়িশা গার্লস হাইস্কুল (দ্বাদশ)-এ পড়াশোনা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে ভর্তি। সসম্মানে সেখান থেকে স্নাতক হয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রাপ্ত হয়ে সাংবাদিকতা পাঠক্রমে প্রবেশ। সসম্মানে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা প্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা। আকাশবাণী কলকাতায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা। লেখিকা সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের ৩৫ তম বংশধর।)
ধর্ম, সংগীত এবং কাব্য সাহিত্য যে ধারাকে একত্রে প্রতিনিত্ব করেছিল, প্রাচীনকাল থেকেই সে ধারাটি ‘কীর্তন’ নামে পরিচিত। সংস্কৃত ভাষায় রচিত জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’ রাধাকৃষ্ণের চিরন্তন লীলাকে উপজীব্য করে রচিত। বারোটি সর্গ, আশিটি শ্লোক এবং চব্বিশটি গীতের সমাবেশ রয়েছে।
প্রথম সর্গে রাধার কৃষ্ণ বিরহের বর্ণনা এবং বসন্তের রাস লীলার বর্ণনা রয়েছে। দ্বিতীয় সর্গে রাধাকৃষ্ণের পারস্পরিক বিরহ ও মিলনের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় সর্গে রাধার জন্য কৃষ্ণের চিন্তান্বিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ সর্গে সখীর মাধ্যমে রাধার মানসিক অবস্থার কথা কৃষ্ণের কাছে নিবেদন করা হয়েছে। পঞ্চম সর্গে অভিসারিকা রাধার জন্য কৃষ্ণের প্রতিক্ষার কথা বলা হয়েছে। ষষ্ঠ সর্গে চিত্রিত হয়েছে কৃষ্ণের কাছে রাধার সংকেত পাঠানো। সপ্তম সর্গে কৃষ্ণের অদর্শনে রাধার বিরহ চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে। অষ্টম সর্গ জুড়ে শ্রীরাধিকার অভিমান বর্ণনা করা হয়েছে। অনিবার্য ভাবে নবম সর্গে বর্ণনা করা হয়েছে কৃষ্ণের রাধার মান ভাঙানোর চিত্র। দশম সর্গে উভয়ের মিলন সম্ভাবনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একাদশ সর্গে আননদঘন বিভিন্ন ভাবের বিলাসের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। দ্বাদশ সর্গে রাধাকৃষ্ণের মহামিলন এবং বিভিন্ন লীলাখেলা স্থান পেয়েছে।
“চন্দনচর্চিতনীলকলেবরপীতবসনবনমালী।
কেলিচলন্মণিকুণ্ডলমণ্ডিতগণ্ডযুগস্মিতশালী।।”
এই শ্লোকটির অর্থ হল, কৃষ্ণের নীল শরীরে চন্দনচর্চা, গণ্ড দুটিতে স্মৃতি হাসি, প্রণয়কালে আন্দোলিত কানের মণিকুণ্ডল আন্দোলিত। অর্থ সম্পূর্ণ বৈশিষ্টহীন। কিন্তু শব্দের ছন্দ তুলনাহীন। আরও একটি এমন শ্লোক হল —
“ললিতবঙ্গলতাপরিশীলনকামলমলয়-সমীরে
মধুকরনিকরকম্বিকোকিল-কূজিতকুকূটীরে।।”
এই শ্লোকটির অর্থ হল, মলয় সমীরে কোমল লবঙ্গলতিকার সৌন্দর্য বেড়েছে, মৌমাছিদের মধুর গুঞ্জনে ও কোকিলের কুহু রবে কুঞ্জকুটীর মুখরিত হয়েছে।
মাঝেমধ্যে যৎসামান্য খাঁটি কাব্যের ইঙ্গিত মেলে। যেমন —
“ত্বমসি মম ভূষণং ত্বমসি মম জীবনংত্বমসি মম ভব-জলধিরত্নম।।”
এই শ্লোকটির অর্থ হল — তুমিই আমার ভূষণ, তুমিই আমার জীবন, এই জীবন সমূদ্রে তুমিই আমার রত্ন। এখানে জীবন শব্দটি আলাদা মাত্রা প্রদান করে ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যকে।
কৃষ্ণের বাঁশি শুনে বাংলা কাব্যে রাধা যা বলেছিলেন,
“কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মনপ্রাণ”
অর্থাৎ কাব্য মানুষ প্রথমে শোনে এবং পরের ধাপে অর্থ বোধের মধ্য দিয়ে মরমে প্রবেশ করে।
কীর্তন গানের ব্যাপ্তি বিশাল। বৈষ্ণব কীর্তন, পদাবলী কীর্তন, লীলা কীর্তন, ভজন কীর্তন, নগর কীর্তন, আসর কীর্তন ইত্যাদি।
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”
এই ষোল পদ কীর্তনই নাম কীর্তন। রাধাকৃষ্ণ, কৃষ্ণ সহ গোপীদের কাহিনী অবলম্বনে যে পালাগান, তা লীলা কীর্তন নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যের কাহিনী অবলম্বনেও লীলা কীর্তনের প্রচলন হয়। কয়েকটি প্রধান লীলা কীর্তন হলো, গোষ্ঠ, মান, মাথুর, নৌকাবিলাস ও নিমাই সন্ন্যাস — এইগুলি পদাবলী কীর্তন নামেও খ্যাত।
বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান অবলম্বন রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলা। চতুর্দশ শতকে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের সময় পদাবলী সাহিত্য বিকাশ লাভ করে। বৈষ্ণব পদাবলীতে আমরা পাঁচ রকম রস দেখতে পাই। সেগুলি হলো — শান্ত রস, দাস্য রস, সখ্য রস, বাৎসল্য রস এবং মধুর রস।
শান্ত রসে শ্রীকৃষ্ণ ভগবান রূপে পাঠকের কাছে ধরা দেন। এরপর ধীরে ধীরে প্রতিটি রসের মধ্যে দিয়ে ভগবান রূপ পরিত্যাগ করে মানব রূপে ধরা দেন। বৈষ্ণব পদাবলীতে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই মুখ্য বিষয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু গান, যেমন — ‘ভানু সিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ বৈষ্ণব পদাবলী দ্বারা প্রভাবিত। এইগুলি ব্রজবুলি ভাষায় রচিত। এরমধ্যে জনপ্রিয় গানগুলি হলো —
“গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে”, “শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা”, “মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান” ইত্যাদি।
এছাড়া ….
“ওহে জীবন বল্লভ”, “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই”, “নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে”, “আমি জেনেশুনে তবু ভুলে আছি” ইত্যাদি গানে বৈষ্ণব পদাবলীর ভাব স্পষ্ট।
কীর্তনের একটি বিশেষ আঙ্গিক হলো ‘ভজন কীর্তন’। ভগবানকে ঘরের মানুষ হিসেবে নিত্যদিন তার ভজনা করার মাধ্যমে এক আধ্যাত্মিক মননের প্রকাশ ঘটে। এমন একটি ভজনের কয়েকটি পংক্তি হলো —
“জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গদাধর
কৃষ্ণচন্দ্র করো কৃপা, করুণাসাগর”।
জয় রাধে গোবিন্দ গোপাল বনমালী
শ্রীরাধার প্রাণধন মুকুন্দ মুরারি
হরিনাম বিনে রে ভাই গোবিন্দ নাম বিনে
বিফলে মনুষ্য জন্ম যায় দিনে দিনে।”
কলিযুগে ‘নাম সংকীর্তন’ উপাসনার একটি মাধ্যম। চৈতন্য যুগে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিত্যানন্দ, অদ্বৈত গদাধর, শ্রীবাস প্রমুখ ভক্তবৃন্দ সঙ্গে নিয়ে নদীয়ার রাস্তায় এই কীর্তন গান করে বেড়াতেন। মহাপ্রভুর সুরে মহিত হয়ে অনেকেই নাম কর্তন সুধা পান করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। আজও বৈষ্ণবগণ বিভিন্ন স্থানে নাম সংকীর্তনের ব্যবস্থা করেন বৈষ্ণব ভক্তগণকে আনন্দ দানের উদ্দেশ্যে।
“তোমরা জয়জয়কারে হরি বলো
প্রেমানন্দে বাহু তুলে, বদন ভরে হরি বলো
হরি বোল হরি বোল হরি বল হরি বল
বলি আজ এর মত এমনি থাকুক
ভাবুক যারা তারা বসে ভাবুক”।
কীর্তন গান ভারতীয় সংস্কৃতির এক বিশিষ্ট সম্পদ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় কীর্তন গানের চর্চায় ভাটা পড়ে। বর্তমানে কীর্তন গানকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।