তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন
উনিশ শতকের আরেক ভারতবিদ্যা বিশারদ মহেশচন্দ্র এমনই এক বংশে আবির্ভূত হয়েছিলেন যাদের পাণ্ডিত্যের দ্যুতিতে তাঁরা নিজেদের কৌলিক পদবী ভট্টাচার্যের পরিবর্তে প্রাপ্ত উপাধীতেই সমাজে পরিচিত লাভ করেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৩৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাওড়া জেলার আমতা গ্রামে। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে কলকাতায় চলে আসেন এবং সংস্কৃত শিক্ষা শুরু করেন। এরপর সংস্কৃত কলেজের খাতিমান অধ্যাপক জয়নারায়ন তর্কপঞ্চননের চতুস্পাঠীতে ভর্তি হয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে ন্যায়, দর্শন, অলঙ্কার অর্থাৎ সংস্কৃতের নানান দিকে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। মহেশচন্দ্রের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে অধ্যাপক জয়নারায়ন তাঁকে ‘ ন্যায়রত্ন ‘ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি কিছুদিনের জন্য বারাণসীতে যান আরো কিছু শিক্ষা অর্জনের জন্য। সেখানে থেকে কলকাতায় ফিরে এসে তিনি রাজা কমল কৃষ্ণদেবের সহায়তায় একটি চতুস্পাঠী খোলেন।
অনেকেই হয়তো জানেন না বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত এডোয়ার্ড কাওয়েল। তিনি আবার সংস্কৃত ভাষা চর্চা করেছিলেন মহেশচন্দ্রের কাছে। এজন্য মহেশ চন্দ্র কোনো পারিশ্রমিক নেননি। অবশ্য এর বিনিময়ে তিনি সাহেবের কাছ থেকে ইংরেজী শিখেছিলেন। কাওয়েল সাহেব ‘ কুসুমাঞ্জলি ‘, ‘ সর্বদর্শন সংগ্রহ ‘ ‘ শান্ডিল্যভক্তিসূত্র ‘ সংস্কৃতের বিখ্যাত গ্রন্থগুলি সাহেব মহেশচন্দ্রের সাহায্যে অনুবাদ করেন।
১৮৬১ সালে মহেশচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের অলঙ্কার শাস্ত্রের অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন। কর্ম জীবনের বাকি সময় টুকু তিনি এখানেই অতিবাহিত করে ১৮৯৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজের বিভিন্ন বিভাগের উন্নতি সাধনে নানান পরিকল্পনা রচনা এবং সেগুলির বাস্তবায়ন করিয়েছিলেন। পুরাতত্ত্ব, লিপিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যার মতন বিষয় গুলির শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করে ভারতবিদ্য চর্চাকেই সমৃদ্ধ করেছিলেন। বাংলার বাইরে সংস্কৃত শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখাকে ছড়িয়ে দেবার কাজে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি পঞ্জিকা সংস্কারের মতো একটি দুরুহ কাজে হাত দিয়েছিলেন। তিনি স্ত্রী শিক্ষা প্রসারেও কাজ করেছিলেন। নিজ গ্রামে ন্যায়রত্ন ইনস্টিটিউশন নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯০৬ সালে বঙ্গদেশের এই পন্ডিত, সমাজসেবী, সংস্কারক ইহলোক ত্যাগ করেন। পরিতাপের বিষয় এই যে, মৃত্যুর একশো কুড়ি বছরের মধ্যেই বাংলার এই কৃতি সন্তানকে বাঙালী ভুলে গেছে।