শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে  তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘পঞ্চমীর বারমাস্যা’  উপন্যাস।)

বুক ফাঁটি যায় কথায় কথায় 

সংসারের জোয়াল টাইনতে টাইনতে দিন গুজরান হয়, দিন আলগা হয়। কোথাও যাবার কথা মনে হলেই কোন ফাঁকে যে আঁর মনটা ঘরের মাঝে আটকা হড়ি যায়, মন টানাটানির খেলায় মাতি ওঠি, দিনক্ষণ ঠিকই করতি হারিনা। গরু-গোতান  দেখার ভার দিয়ে গেলি তো হইত ন, দলিল মিঞা এমনিতে জুতসই লোক, তবু হরান মানে না। মাঠের ধান ঘরে উঠবে, বৃষ্টিবাদলার দিনে ঝক্কি তো কেবল কম নাই। গৃহস্থের চোখ হরালেই গোলমালটা বাড়বে বই কইমবে না। তাই বলে কি আত্মীয় স্বজনেরে একবার চোয়ের দেয়া দেই আইসব না, তাও কী হয়! ঘরদোর যেমন সত্যি, জলা-জঙ্গল তেমন সত্যি, মানুষের মুখগুলোও তো ফেলনার নয়, আজ আছে কাল নাই। মরি আছে না বাঁচি আছে, কে আর কইব, হালসন যাইতাম হারি ন, মনটা আনচান আনচান করতি লাগের। কত দূরের হত(পথ), চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল কি মুখের কথা নি। ইনাই-বিনাই কত কথাই না হুনাইব। আনারস আর হুয়ারি(সুপারি) বাগানটা যেন চোখ বড় বড় করে চায়। বড় পুকুর ঘাটে যাওয়া আসার পথে একবারের জন্য চোয়ের দেয়া দেখে। কাঁচা সবজে গায়ের রঙটা পেকে টসটসে হয়ে উইঠলে কেমন হলদে হই যায়,  চোখ না জুড়াই কী হারে! ভালো লাগার লগে কষ্টটা যে লেপটাই থাকে। ফল ছিঁড়তি গেলেই মায়ের মতো মন তো, উথলাই ওঠে। উঠানের ধুলাগুলা পায়ে পায়ে লাগি থাকে। নৌকায় উঠলেই ভেতরটা ধুকপুক করে। কত যতন করেই না লম্বা সবুজ লাউটাকে জলার ধারে মাচার উপর পাতার পর পাতা দিয়ে ঢেকেঢুকে রাখা। হাড়ি আর বাসন-কোসনে লাগি টন করি শব্দ হলি মনে হয়  ‘ আহারে লাইগল বুঝি।’ মেঘনার খালের জল তির তির করলিই মনে ঘোর নামে। রসুই ঘরের কিনারে গাছের গুঁড়ির সিঁড়ি টপকালেই জল আসি পাড় ছুঁই যায়, খাবার লোভে হুঁটি (পুঁটি) মাছগুলো ঘুরিফিরি আঁর হাতের কাছে চলি আয়ে। থালা গ্লাসগুলো জল ঠেলে ঠেলে ধুয়ে নিতি গেলেই আঁইঢা (এঁটোকাটা) খাইতে ছুটি চলি আয়ে দলে দলে। কী গাঢ় যে আত্মীয়তা, সে কী আর মুয়ে কওয়া যায়! বাসনকোসন ডান হাতের তালুতে নিই ধাপে ধাপে উপরে চলি আসলেই গয়াম (পেয়ারা) গাছের ডালে বসে হালিখ (শালিখ), চড়াই, টিয়ারা ডাক দিলেই আঁই দাঁড়াই দাঁড়াই খোঁজার চেষ্টা করি কোন ছায়ার ফাঁকে ওদের শরীর দোল খার। ওদের ঠোঁট নাড়ানো, লেজ দোলানো দেইখলে মনটা উচাটন হয়। বেলা হড়ি আইলে একা হই যাই, অন্ধ মাইনষের মতোই চুপ থায়নই চেনাজানার সম্বল হই ওঠে, বনবন করি চিনচিনে বাতাসে দোলা লাগলেই বাসা ছাড়ি আঁর দিকে বোলতারা ছুটি আসে। নাতিনাতকুর হোলাপাইনদের কান্দন চেঁচানি লম্বা উঠোনটা টপকে কানের কাছে আইলে হূন্যতা ভাঙি খান খান হয়, পরক্ষণেই শব্দ নিঃশব্দ আড়ি করি দেয়। আঁর আঙুলগুলো জলে জলে হাজার মতো হইলে  কই ফেলি কী সব্বনাশ! অন আঁই সংসারের কামকাজ সামলাইয়ুম ক্যান্যে! নিজের ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে জাগানো, খাওয়ানো দাওয়ানো, কাপর-চোপর কাঁচাকাচি করে ভাশুরের হোলা, দেওরের হোলাদের মাষ্টারি সারি তবে না ডেগমাষ্টারি। কত কথাই না মনের মধ্যে আনাগোনা করে। এতগুলা মানুষজন নিয়ে ঘর করা কি চাট্টিখানি কথা! এই গোস্সা হয় তো ও চুপ মারি যাই। ও ডাক হুনি কয় যদি ‘আইয়ের’, তবে গিয়ে গরু ছাগলের লেজ ধরি নাচে। কেউ আবার দিনদুপুরে মনের সুখে গান ধরে। এমনও অবস্থা হয়, ঘর গেরস্তি নিই টান মারে।  ছুটি চলি যাই দেখি চার পুরুষ আগের পুরান বাড়ির দুই ঘরের জোয়ান হোলাপাইনরা করে কিলাকিলি, লাঠিসোটা নিয়ে তাড়ি আয়ে, ঘুসোঘুসি, রক্তারক্তি। এই পুকুর আর ওই পুকুরের মাঝামাঝি খালের ঘোলা জল দু’বাড়ির লোকজনকে চোখ পাকাই দেখে। এক জনমের কথা কইলেই তো সব কথা হুরোয় যায় না, কত কথা বাকি থাকি যায়। রাজেন ডাক্তার  বড় রাস্তা বরাবর হাঁক দিয়ে যায় ভরদুপুরে, কীগো বড়বৌদী কী কাম করেনের, আমনেরে যন দেখি, খালি ঘাড় গুঁজে কাম করেনের। কন্নান তুন আয়েনের ঠায়ুরপো। আর কইয়েন না, শীলবাড়ির ছোট হোলাটার হেট ছাড়ছে। অবস্থাখান ভালো নয়। পথ্যি দি আইছি, ঈশ্বর জানে। অন চইললেন কনডাই? অধিকারী বাড়ি যাইত হইব, ডাক হইড়ছে।  যান যান, সাবধানে যাইয়েন, জলাজমি ডিঙাই যাইত হইব। হুইনলাম,  ওদের বাড়ির পোয়াতি বৌয়ের মাথা ঘুরি হড়ি গেছে, তড়িঘড়ি সন্তোষ কবিরাজ গেল, আমনেরেও দেখাইব আর কি। আমনে এত খবর হান কত্তুন বড়বৌদী।  কী যে কন, নিজের লোকজনের খবর না রাখলি চইলব কেমন করি।

ঘন মেঘ শাদা হই গেলে আলগুলো আস্তে আস্তে কথা কই ওঠে। ওরা আঁর সঙ্গে চুপি চুপি কথা কয়। কষ্ট হয়, বুক ফাটি যায়। বোরো ধানে  পোকা ধইরলে  ছিবড়ে হয়ে যায়। মাথার ঘাম পায়ে হেলি ধানের ছড়ার গজানোর পরে যদি এই দশা হয়, তখন মাথা খুঁড়ে মরা ছাড়া আর কি কোনো উপায় থাকে! কড়া রোদে মাঠঘাট ফেটে চৌচির হয়। তবুও রোদের প্রতি আঁর মায়া কমে না। কত দূরের ওই আকাশ, চাই চাই দেখি। এমন যে ভাবনা হয় না, কই কেমন করে। আহা, সূয্যিমামাটা যদি তাল-সুপুরির মগডাল ছুঁয়ে লম্বালম্বি হয়ে সদর দরজা থেকে ভেতরবাড়ির খড়ের গাদা অব্দী ছুঁয়ে থাকত। দু’হাতে জাপটে ধরে কইত, চলি যাও কেন, দুদিন থাকতি হারো না বুঝি, যা চাও তাই দিমু, ধান-দূব্বা-কলা দিই হুজা দিমু। সূয্যিদেব আঁর কথা হুনি হাসে, নিজের খুশিমতো চলি যায়। আঁর ঘরবাড়ি নিজের মতো হড়ি থাকে। খেঁজুর গাছের আগাটা যে চাঁছা হয়েছিল, কেমন শুঁকিয়ে আমসি হয়ে যায়। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কত কষ্টই না ওরা সহ্য করে। মাইনষের এত্তুন মায়াদয়া নেই গো। নিজের জীবনের সঙ্গে মিলাই মিলাই দেখি। হইলা যেদিন গভ্ভে কেউ আইল, হোলা না মাইয়া এত ভাইববার অবসর কোথায়। সন্তান সুখের মায়ায় মজে থাকি। চন্দু রসিয়ে রসিয়ে গল্পের পর গল্প ফাঁদে। রামায়ণ মহাভারতের গল্পগুলো হুনাই হুনাই আঁর আনন্দের ভাগটাকে কয়েক গুণ বাড়াই দেয়। ঢেঁকিতে ঘিগজ ধান ভাঙে ওর শাউরি। হুনি তো আহ্লাদে আটখানা। হাতের কাজ টেনে নিয়ে গোছগাছ করে।  বউরে, পাইগলামি করতি আছে, যে আইতে আছে তার কথা ভাইবতে হইত না। ফিক করে হাসি ফেলাই, শরমও লাগে। স্বামী হপ্তাহ ফুরলে বাড়ি ফেরে। ধানে ভাপ দিও নি বউ, আগুনের তাপের তুন বিপদ হইলে ঘোর বিপদ। ধানের গোলা তুন ধান বাইর না করলি ভাঙাইবতো হইব তো, এতজন লোক খাইব কী? আসমতির মা শাড়িটা কোমরে পেঁচাই খুঁটি খুঁটি উঠান তুন ধান তোলে, ঝাঁট দিই এত্ত বড় উঠোনটার ধানগুলো কুইরে বাইরে আনে।

বাড়ির পাশে বাড়ি। এঁকেবেঁকে চলি গেছে খালের পরে খাল, বিলের পরে বিল। বাঁশের পাশে বাঁশ ফেলে সাঁকোর উপরে পা ফেললেই নড়েচড়ে ওঠে, ভয়ে বুক ধরাশ ধরাশ করে। এই বাড়ি পার হয়ে ওবাড়ি এলেই  ছমছম করে গা। জঙ্গলের পাশ কাটাই ডান দিকে ঘুরলেই অঘোরি, শান্তি, মৃদুলারা বালতি বালতি কাপড়চোপড় নিই খালের ধারে যায় নাঙ্গা হায়ে। কাঠের গুঁড়িতে ধপাস ধপাস আওয়াজে কান ফাঁটে। ওরা পরস্পরে সুখ দুঃখের কথা কয়। মরতে কেমন করি হয়, বাঁচার মন্তর কোনোটাই যে জানা অজানার বাইরে। কী একটা যেন জলে ভেসে আসলি মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। দূরহ পাগল, কোনটা দেখতে কোনটা দেখস। জলে তো কত কিছুই ভাসে, অত ভাবলি কেমনে হয়, অত তাকাতি নাই। ধোপার বাড়ির মাইয়াদের সময় গময়ের বালাই নাই। বড় বাড়ির মেজো কত্তার মাইয়ার বিয়া সামনের হপ্তাহে, যেমনে হোক, দিতে তো হইবোই। নতুন বাড়ির বড় গিন্নি হলি না ক্ষমা ঘেন্না করি নিত, মায়ার শরীল, পরের দুঃখে জ্বলিপুড়ি মরে। এমন ব্যাটি চক্ষে হড়ে না। জলের মধ্যে ডোবে আর ভাসে। শাড়ির আঁচলটার একটুখানি ঢেউয়ের তালে তালে দোলে যেন। শান্তি, মাইয়া মাইনষের শরীল, বাঁচাইত হইব, ঝাঁপ দে, কাদের মাইয়া কি জানি। ওরা যত আগায়, শরীরটা ঢেউয়ের ধাক্কায় জলে মাথা ডোবে তো পিঠ ভাসে, পায়ের গোড়ালি নাচায়। কেমনে ভাসল কি জানি। তাল সামলাইতে হারেন ন। শান্তি আর আঘোরি জোরে জোরে সাঁতার কাটে। হানাগুলো (কচুরিপানা) গায়ে পিঠে মুখে লাগি গেলেও ওরা থামে না। আঁই রোজকার নিয়মেই গরীবগুরবোদের খবরাখবর নিব বলেই বাঁশ বাগান ডিঙিয়ে সজনা ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সাঁকোর দিকে আগাই। এমন দৃশ্য দেখে তো হকচকিয়ে যাই । দুইজন মেয়ে কসরত করছে আর একটা মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর লাগি। আঁর এখন কী করা উচিত ও বুঝে উঠতে হারি না। আম গাছের গোড়া পাড়েই পড়েছিল। গায়ের জোরে ঠেলতে শুরু করি মৃদুলাকে সঙ্গে নিয়ে। অঘোরি আর শান্তি শরীরটাকে গোড়ার উপর আগাপাথালি হুইতে দিই ঠেইলতে ঠেইলতে হাড়ে নিয়ে আসে। ও মা এ তো নাপিত বাড়ির বউ। অসজ হড়ইলে নখ কাটি দি যাই। কেন রে মরতে গেছিলি নাপিত বউ? রূপা বেবোল হয়ে চোখ পিটপিট করে, উদাস হই আঁর দিকে চাই থাকে। মনের কথা মনেই থাকে, ঠোঁটের ফাঁকে কথাগুলো ফেটে বের হয়। আঁর সান্ত্বনা বাক্যগুলো গায়ে মাখি নেয় নিজের মতো। এত অসময়ে মরণেরে ডাকি আনার ফল দেইখচস। এত দুঃখ কীসের লা। আঙ্গ বারো বাড়ির লোকজন তো বেঁচে আছে নাকি। রূপার চোখের জলে গোধূলির আলো হইড়লে চিকচিক করে। হোলামাইয়ার মার এত কাইনলে চলে, শক্ত করি সংসারটাকে আঁকড়াই ধরতি হয়, তবেই না নিজেও বাঁচবি, অন্যেরেও বাঁচাবি, ঠিক কথাকান কইছি নি,ক?

জোকারের (উলুধ্বনি) শব্দ পুরো বাড়িটার আনাচে কানাচে ছড়াই যায়। সকাল না হতেই যে আয়োজনের ঘটা শুরু হয়েছিল, তা যেন দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই বেড়ে চলে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে পূজার বাসনকোসন এক এক করে মাইয়াগুলানরে বলি নামাই আইনতে। বাড়িময় হৈ চৈ, আজ যেন বাকি কামকাজের ছুটি। কে কাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে কে জানে। ওরা গান জানে, ওরা অন্তরের খোঁজ করে। আঁই ওদের নাম ধরে ডাকি ডাকি হয়রান হয়। ওদের মুখগুলো ঘিরে পূজার ডালা সাজাই। আঁই আসন পেতে বসি। হরির লুটের বাতাসা বিলায়। আঁধারের শরীরে আলোর পরীরা আসি ভিড় করে। সকলে মিলে যখন গান ধরে ‘হরি হে মাধব,গৌর নিতাই বলো হে, কানহা মিলবে যবে রাধার সনে, চলো সকলে মথুরাতে কৃষ্ণ সকাশে। কাঁসর ঘন্টা তো বাজে, করতাল বাজে, বাঁসির সুরে মন দোলে, শাঁখ বাজাই, হৃদয়ের দরজাগুলো খুইলতে খুইলতে যায়। প্রদীপের সইলতে সারি সারি আলো ছড়ালে কোথায় ছায়া কোথায় মায়া এসে বাসা বাঁধে। ঘরের আনাচে কানাচে যারা ছড়াই ছিটায় ছিল কাজের ফিরিস্তি সাজিয়ে, পাইলটে দেয় তুবড়ি মারি, এ যেন নাটকের আর এক অঙ্ক, মুখের আদল ভক্তিতে লুটাই যায়। আঁর চোখে জল গড়ালে আড়ালে ঘটে চলে ভাবসমাধি। মুখগুলো এক এক করে সামনে চলি আয়ে। মুহূর্তগুলোকে ঘিরে নতুন নতুন মানুষের জন্ম হচ্ছে। আঁর চোখ খুলি যায়। ইচ্ছে হয় ও়দের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। জড়িয়ে ধরি জিগাই, কন্নাই ছিলি তোরা এদ্দিন? হক্বলে যে যার ঘরে হিরি গেলে একলা হই আঁই ভাইবতে থাকি কত কিছুই না দিতে হাইরত। ওরা একটু পরেই ঘুমের দেশে চলি যাইব। কত স্বপ্নরা ওদের ঘিরে ধরি সৃষ্টি করে চইলবে নতুন জগত। আঁর উপস্থিতি হইব হিয়ানে নগন্য, সম্পর্কের নিবিড় বন্ধনগুলা ভাঙিচুরি যাইব। 

আঁর কত কথাই তো মনে হড়ি যায়। নিজের কথাখান নিজের মুয়ে বলার জন্য মনে ছটফটানি শুরু হয়। স্বপ্নে ঘুরে বেড়ায় সে সব কথা। দিনগুলি চলি যায় নিজের মতো, সময় কী কারো জন্য হড়ি থায়। খুড়তোতো দেওরের অংশটা শক্তপোক্ত ছিল। এত্ত বড্ডা ঘরের দেয়াল ছিল টিনের, চালখানাও টিনের। খুঁটি ছিল শাল কাঠের, আলকাতরায় মোড়ানো। দু’তিন বছর পার হলে রঙ করা হইতো। এমন বাস বের হইতো, ঘরের কোনায় কোনায় লেগে থাইকত হপ্তাহ খানেক। হোলামাইয়া নাতিনাতকুররা দৌড়ি চলি যাইত, খেইলত সকলে মনের সুখে। ওদের মুখে কথার ফুলঝুরি ফুইটত। ওই জা ছিল একবারে অন্যরকম। এমনিতে কম কথা কইত। চুপ করি বারান্দায় টুলের উপর বসি থাইকত। হক্কলে যে তাকাইব সে সময় কনডাই। কোন সাতেপাঁচে থাইকত না। মাছির মতো কানের কাছে ভ্যান ভ্যান কইরত, কুমন্তর দিত। দিচ্ছে দিক, অমন কথায় কান দেওয়ার দরকার কী! মনের আনন্দ আর ধরে না। আনন্দটা নিজের মনেই পুষে রাখত। অত উল্লাসে ফাটি পইড়তে মন চাইত না।  তিন সাড়েতিন মাইল দূর তুন রিকশা করি  স্বামী আই সরাসরি বাড়ি না ঢুকি সদর দরজায় পাক খাইত। জমির পর জমি। এক দেড় মাইল পথ ঘুরি ঘুরি পরখ কইরত কোন ক্ষেতে ফসল কী অবস্থায় আছে। পোকায় কাইটছে কিনা, জমিতে সার লাইগব কিনা। চাষীদের কথা মন দি হুইনত। কয় বাবু ওই কনডিয়ার হুরের লাগোয়া জমিনে পাট চাষ করলি মন্দ হয় না। তাহলি এক কাম কর লাগাই হালাও। জেলেরা জাল ফালাই মাছ ধরে। দেইখলে দু’চোখ জুইড়ে যায়। কত রকমের মাছ – চাঁদা, পুঁটি, কাচকি,তেলচাপাটি, কৈ, খলসে, চিংড়ি, মেনা, বেলে, টেংরা, সিং, মাগুর গজার, আরও কত। বাবু পছন্দ হইছেনি। ফজল যাই আমনের বাড়ি হৌঁচাই দিব। চন্দনের বাপ ঘাড় নাড়ে। গট গট করি হাঁটি চলি যাই আর এক জমির দিকে।

জলমতির সেইদিকে নজর নাই। পঞ্চমী জিগাই ‘তুই এত বেখেয়ালি কেন রে। হোলামাইয়াগুলা যে গোল্লায় যার, সেইদিকে খেয়াল আছে। দিদি, তুঁই তো পড়ালেখা শিখছ, কত সোন্দর গোটা গোটা হাতের লেখাখান তোমার, ও তুমি শিখাও আঁর ছোট হোলা আর মাইয়াডারে। এইটা কোন কথা হইল। চন্দন আর চন্দনার বাপও তাতে সায় দিল। দুনিয়াশুদ্ধ লোক একদিকে আর আত্মভোলা জলমতি একদিকে। কেউ কেউ তো ডাকে, দিদি, একটু সাজগোজ কর, কত সোন্দর লাগে তোমারে সাইজলে গুইজলে, ছোট-ঠাকুর বাড়ি আইছে, নজর দিবা না? মানুষটা জমিজমা দেখভাল করি ঘরে আইছে, একটুখানি যত্নআত্তি তো কর।  জলমতির ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। আঁই ওদের বকাঝকা করি। ওরে ওর মতো থাকতি দে লা, তোরা কেন মস্করা করতি লাইগচস। চন্দন আর চন্দনা আঁর কোলের কাছে পাটিতে শ্লেট পেন্সিল নিয়ে বসি হড়ে। অ আ ক খ এক দুই মুখে মুখে হড়ি ফালায়। চোখের আনন্দ মনের আনন্দে যোগ হইলে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাই দে ছুট। ওদের ওই কান্ডকারখানা দেখি হাসুম না কাঁদুম বুঝি উঠতি হারি না। পরের হোলারে নিজের করি লওয়া এত সহজ কথা নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় যেদিকে দুচোখ যায় চলি যামু। সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। কদ্দিন হইল সেজো জায়ের ছোট মাইয়াটার ধনুষ্টংকার রোগটা যেন সারছেই না। কত বদ্যি কবিরাজি তাবিজ জলপড়া তুকতাকও করেছে, শেষমেষ পাশ করা ডাক্তার ধনঞ্জয় ছদ্রিকে ডাক কইরছে। হপ্তাহে একদিন বাজারের ঔষধের দোকানে বসে। রোগীর লম্বা লাইন লাগি যায়। হাতেপায়ে ধরি বাড়িতে আনা। কইল এই রোগ নাকি সাইরবার নয়। হক্কলে মিলি আঁরে আসি ধইরল। আঁর ধনেশ পাখির ঠোঁট দিই ঝারফুকে জাদু আছে, চার গ্ৰামের লোকের মুখে মুখে হিরে। আঁর নিজের বিশ্বাসটার চেয়েও ওদের বিশ্বাসটা চতুর্গুণ বেশি। অগত্যা মাইয়াটার মাথা কোলে নিই মাথার চুলে হাত বুলাই নিজের বিদ্যা জাহির করি। কোনও সুরাহা হইল না, যেই কে সেই। এত বড় রোগ কী আর মন্ত্রে হারে! সাঁঝের বেলায় কান্নার রোল। গ্ৰামশুদ্ধ লোকের চোখের জলে বুক ভাসল। কচি মাইয়ার দেহ তো আর পোড়ানো যায় না, মাটির নিচেই চাপা দিল। কদ্দিন ধরি মনের জ্বালায় জ্বলি পুড়ি মইরলাম। শ্মশানের দিকেই চোখটা হড়ি ছিল। নাওয়া খাওয়া ছিল এই কথা কই কী করে, শত হইলেও মাইয়ারই তো মতো, চোখের জল সামলানো কী আর এত সোজা কথা!

 যে ঘরে মাইয়াটা খেলনাবাটি লই ঘুরি ঘুরি বেড়াইত, সবকিছু কেমন ঝিম মারি আছে। ভাই বোনরা তেমন আর উঁকিঝুঁকি মারে না। ওরা ঘরের দরজায় পা রাখতি যাই চোদ্দবার চিন্তা করে। শিউলি ফুলের গাছটাও মাটিতে ফুল ছড়ায় না। ডালগুলো মাথা নোয়াই হড়ি থাকে। গাছটা দিনের মধ্যে একবার অন্তত জড়াই ধরি আদর কইরত। বড়রা, খুড়তোতো, জেঠতুতো দাদা দিদিরা নরম নরম হাত ধরি পুকুর পারে দুই তিনটে ঘাটের কাছে লই চটকাইতো, ওরা আর আদুরে কথায় ডাকাডাকি করে না। দুই দিন হইল মামা মামি আইছে। ওর ঘরের পাশে ঘরটায় কোন শোয়ার মতো চই নাই, মেঝেতে পাটি পাতি বই থায়। খোঁজ করি দেইখলো মাইয়াটার একটাও ফটো নাই। বড় আপশোস কইরল, মনের দুঃখে কাঁদাকাটিও কইরল, স্মৃতি উস্কাই নানা কথা বিলাপের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরি আওড়াইল। ঘরের জানালার পাশে একটা গলি, পেছনের রসুইঘর থুন রান্নার ছ্যাঁতছুঁত আওয়াজ আইতে লাগল, সঙ্গে গলগল করি কাঠের জালের ধোঁয়া দুটো ঘরের দখল নিয়ে নিল, ফাঁকফোকর দিই আঙ্গ ঘরেও ঢুকল। টিনের চালের লম্বাচওড়া ঘরে বাইশ চব্বিশখানা ঘর। কোন ঘরের কোনায় কত কিছু লুকাই আছে, কেউ খবর রাখে না। কত পুরুষের হালাইনা ছড়াইনা জিনিস অনাদরে অবহেলায় হড়ি আছে, খোঁজ তো হড়েনি অনেককাল। বড়বাড়ি, উত্তরবাড়ি,নোয়াবাড়ির নোকজন যন পাত পাড়ি খায়, রক্তের সম্পর্কটা তখন গা ঘেষাঘেষি করে। মেয়েটার ছেরাদ্দ হইল, মৎসমুখি হইল, উঠোন জুড়ে লম্বালম্বি কলাপাতার পাত পইড়ল। পুকুরে জাল ফেলাইলে ধরা পইড়ল রুই কাতলা। তাইতে এত বড় ভোজ হইল, মিষ্টি দই রসগোল্লা হক্কলে চেটেপুটে খাইল। ইনাইবিনাই অনেক কথা কইল, ঢেকুর তুলি যে যার ঘরে ফিরি গেল। খাওন তো দূরের কথা, মাইয়াটার মুখটার ছবি ভাসি ভাসি চোখের কোনায় এমনভাবে ধাক্বা দিতে লাইগল, মনের যন্তণাটা ঘাই মাইরতে মাইরতে সিং মাছের আল ফুটাইল যেন। বেহুঁশ হইলে ওরা নাকি ও পঞ্চমী ও পঞ্চমী করি ডাইকল, সাড়া না পাই ধরাধরি করি বিছানায় শোয়াই দিল। দুনিয়াটা এমন করি বানাইছে ঈশ্বর।

একথা ওকথায় দিন কাটি যায়। স্বামীর জেঠতুতো দাদার বড় হোলা সাদাসিধে শান্তিপ্রিয় লোক। একেবারে কোনার ঘরে কোনরকমে থাকে। রোজগারপাতি তেমন নাই। বাজারের মধ্যিখানে ভাড়া লই মুদি দোকান দিছে। দোকানের সামনে লেখা ‘বাকির নাম ফাঁকি’। সেই যে সক্বাল সক্বাল ঘর তুন বার হই যায় হন্ধ্যের পরে ঘরে ফিরি আয়ে। নতুন বউ, নরোত্তমপুরের মাইয়া। বাপের বাড়ি এলাহি কারবার। দিনেরাতে দু-কুড়ি পাত পড়ে। কাপড়ের ব্যবসা করি ফুলিফাঁপি উঠছে। সে মাইয়ার ইয়ানে কি মন টেঁকে। আঁই কত করে বুঝাই, মন খারাপ করি কী লাভ, ধীরে ধীরে সব মানানসই হই যাইব। মাইয়া আঁরে ধরি খালি কাঁদে। খালি কয় বাপের বাড়ি চলি যাইব। বাপের এত বড় বাড়ি, একসঙ্গে এত লোকজন দেই বিয়া দিছে। বাপ আই বুঝাই গেছে, পাগলামি করতি নাই। হইলা হইলা এমন লাগে, কোলে খোকা আইলেই তারে লই দিন কাটি যাইব। পঞ্চমীদি একটু বুঝাইয়া কইবেন তো। শেফালির মা বউয়ের এমন অবস্থা দেখি চিন্তাই হড়ি যায়। ভাবে, বড়লোকের মাইয়া বউ করি আনি কী ভুলটাই না কইরছে। মাইয়া দিন দিন শুকায় যার। মাইয়ার বাপ কী ছাড়ি কথা কইব। জগা দোকান তুন আইলে একটা হেস্তনেস্ত করি ছাইড়ব। মাইয়ার মুয়ে হাজার জিগাইলেও রা বার হয় না। ঘরের হিছনে একটা ঢেঁকির ঘর, দুইটা জোড়া কাঁঠাল গাছ ঢিপির উপরে। ওই দিকে তেমন কেউ একটা সচরাচর যায় না। কাঁঠাল গাছ তুন মুচি বার হইছে। সবুজ সবুজ গা’র তুন কেমন সোন্দর ঘ্রাণ। মাইয়াটা কিয়ার লাগি হিয়ানে যায় আর আয়। গাছের সঙ্গে কথা কয়। জগারে কইলাম, বউটার দিকে নজর দে, কি হইতে কি হয় কওয়া তো যায় না। কাকিমা, ব্যবসাপত্তরের গতিক ভালা ন। চড়া দামে মাল কিনি জলের দরে বিক্রি করি কদ্দিন আর চলে, পুঁজিতে টান ধরছে। চিন্তায় চিন্তায় রাইতের বেলা ঘুম আসে না। হক্বলে একলগে আছি বলে চলি যাচ্ছে, না হইলে যে কী দশা হইত। পরের মাইয়ারে বিয়া যখন করি আইনছস, তেল সাবান স্নো পাউডার তো কিনি দিত হইব, এই কথাখান তো বোঝস। জগা হুনিও যেন হোনে না। বোগলের নিচে চামড়ার থলিটা নিই গুটি গুটি পায়ে চলি যায়। বাড়ির কুকুর কালু তালগাছ পয্যন্ত আগাই দিই আসে। তাকাই থাকে যতক্ষণ জগার যাওয়ার রাস্তাটা বাজারের দিকে বাঁক না নেয়। জগার বউ দু-এক কলম পড়ালিখা জানে। কইলাম তুই আইও না আঁর ঘরে, চন্দন আর চন্দনার সঙ্গে বই হইড়বা। বই হড়ার যে কী মজা, যে হড়ে সেই জানে।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *