রঞ্জন দত্তরায়
লেখক পরিচিতি
(জন্ম ১৯৫৯ সালে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর থানার নড়িদানা গ্রামে। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত পরিবারের সন্তান হলেও লেখকের এই গ্রামেই বেড়ে ওঠা। কর্মসূত্রে একটি বেসরকারি কলেজে যুক্ত ছিলেন। ছোট থেকেই লেখালিখির ঝোঁক। ছোট বড় নানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গল্প কবিতা প্রবন্ধ।গল্পগ্রন্থের নাম ক্যাকটাস ও অন্যান্য।)
বিষয় পরিচিতি
(দখিনের সমুদ্দুর থেকে হু হু করে ছুটে আসে নোনা বাতাস। গভীর সুন্দরবনের জংগলে মউলিরা যায় মধু আহরণে। মাছমারার দল গহীন খাঁড়িতে যায় কাঁকড়ার খোঁজে। কেউ কেউ ফেরে। কেউ আর ফেরেনা। ছেঁড়া গামছার নিশেন পোঁতা থাকে গরানের বনে। বনবিবির হাজতে হিন্দু রমনীর হয়ে মানত মানে মাজার থেকে ছুটে আসা মুসলমান পীর। বন্দুক হাতে বড় মিঞাকে চোখ রাঙায় দক্ষিণরায়। আয়লা,ইয়াশে, আচমকা প্লাবনে বাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে যায় চাষভূমিতে। মাটি হয় লবনাক্ত।
ওদিকে উত্তর থেকে শহর ক্রমশ এগিয়ে আসে নিম্নভূমির দিকে। হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। দু চাকা চারচাকা ধোঁয়া আর ধুলো উড়িয়ে ছুটে যায় বিস্তীর্ণ বাদার বুক চিরে। জমি..জমি। জমি দখলের যুদ্ধে লাল নীল সবুজ হলুদ নানা রঙের পতাকা ওড়ে পতপত করে। জিন্স টিশার্ট টাঙানো মলগুলির জেল্লায় ক্রমশ বিবর্ণ হতে থাকে দু তিন পুরুষের দোকানদারি। বহুজাতিক কোম্পানির সম্ভার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় ডেলিভারি বয়।
আর এই টানাপোড়েনের মধ্যিখানে বসবাস এই কলমচির। কানে আসে কতশত ভেসে আসা কথা। শহরের,আবাদের,জঙ্গলের নানা লবজের কথা। অটোয় নৌকায় ট্রেনে মটোরভ্যানে কথারা ধাক্কাধাক্কি করে। হাওয়ায় ভেসে যায় কথা। আবার কিছু কথা চুপিসারে ঢুকে পড়ে গোপন কুঠুরিতে। থেকে যায়। কিছু বলতে চায়। তাদের নিয়েই কথকতার জাল বোনার প্রয়াস এই লেখকের। নোনামাটির শোনা কথা।)
বুড়ো অমাবস্যা
কালীপুজোর রাত। তাকে বলে বুড়ো অমাবস্যা। সে অমাবস্যার গা ছমছমে গল্প কম নয়। বছর দশের দুবলা এক বালকের পক্ষে তা চাপের ছিল বইকি। তার বাড়িতে যতই পাত্তা না দিক, বাড়ির বাইরেই তো আসল দুনিয়া। ফিসফিস কত কথা, এই অমাবস্যায় কারা নাকি তুক করে কেটে নেবে মাথা থেকে একগোছা চুল। ব্যাস। দিনে দিনে রক্ত শুকিয়ে যাবে। পরদিন সকালে দেখাও যেত কাঁচারাস্তার তেমাথায় পড়ে আছে কলাপাতায় সিঁদুর মাখানো মাটির ঘট। আমের পল্লব। আরো কি সব। দেখেই সে বালকের বুক ধড়ফড়।
সন্ধে হলেই বাড়ির পাঁচিলে মোমবাতি জ্বেলে দেওয়া, কলার ভেলায় জ্বলন্ত বাতি পুকুরে ভাসানো, বেশ খুশিয়াল মন। কিন্তু সেইসংগে একটা বিষন্নতা। খেলার সঙ্গীরা যে শুকনো গাছের ডাল আর পাতা দিয়ে বানিয়েছে বুড়ির ঘর। ডালপাতা সংগ্রহে সে ও তো অংশ নিয়েছিল। একটু পরেই আগুন লাগানো হবে সে ঘরে। দাউদাউ আগুনের আঁচে নাচ করবে ওরা। সেখানে যাওয়ার জন্য মন উচাটন। কিন্তু তার যে সন্ধের পর বেরুনো বারন।
রোদে সেঁকা বাজিগুলো সে একা ফাটাবেই বা কি করে? ভয় লাগে যে। তার এলেম তো তারাবাজি, রং মশাল আর চরকি পর্যন্ত। খবরের কাগজ পাকিয়ে দূর থেকে দোদমায় আগুন লাগিয়েই ছুট্টে পালিয়ে আসা। একা ভাল লাগে!
তাহলে কি ঠাকুর দেখা হবেনা? সহায় ছবিদি।বাড়িতে সে দুধ দেয় রোজ। মা ডাকে ছবিদি। আমিও। তার দাপট খুব। আমায় নিয়ে চলল ঠাকুর দেখাতে। বিজলি আলো তখন কোথায়! ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছবিদির সাদা থান। ছবিদিও তুকতাক কম জানেনা। নানা মন্তরে আমায় সুরক্ষিত করে হাত ধরে হাঁটে। দূরে আকাশ চিরে চলে যায় হাউই। এঁদো ডোবাটা কেমন রহস্যময় লাগে। খেলার মাঠটা মনে হয় সদ্য পড়া ভুশণ্ডির মাঠ। ওই তো পুজোর প্যান্ডেল। হ্যাজাক জ্বলছে। বেদিতে প্রতিমা। একপাশে কজন বউ ফল কাটছে। ওরা ছবিদিকে কেমন আড়ে আড়ে দেখছে। কেমন চুপচাপ। একটা খুঁটিতে বাঁধা একটা ছাগল। পাতা চিবুচ্ছে। ছবিদি বলল, ওটা বলি হবে রাতে। আমি প্রতিমার দিকে দেখি। দেখি একটা শিয়াল বসে আছে নিচে। আমার ভয় লাগে। বলি, ছবিদি বাড়ি চল।