সোমনাথ ঘোষাল

সেবকের রেলগেটের সামনে বাসটা দাঁড়িয়ে। একদম শেষ জানলার ধারের সীটে মাথা নিচু করে ঘুমে ঢুলছে ফারহানা। বালুরঘাটের মেয়ে। এখন শিলিগুড়িতে থাকে। একটা ভাড়া বাড়িতে। ওদলাবাড়ির একটা স্কুলে ইংরেজি পড়ায়। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। কোনো এককালে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ফারহানা ঠিক বিয়ের জন্য নয়। ভালো কিন্তু ভালো না গোছের! বিয়েটা টেকেনি। এইসব নিয়ে ওর যে বিরাট চাপ আছে তা নয়। কিন্তু লোকজন নানারকম কথা বলে। এই সব গল্পে এটা নতুন নয়। 

ফারহানা বেশ অন্যরকম দেখতে। কলেজে পড়তে পড়তে বাড়ির অমতে বিয়ে করে। কয়েকবছর সংসারও করে কিন্তু তারপর সেই একই গল্প!  বাচ্চাটা পেটে আসার পর বেরিয়ে আসে। নতুন করে পড়াশোনা শেষ করে ওখানেই একটা স্কুলে চাকরি জোটায়। না, বাপের বাড়ি ফেরেনি। একটা ভাড়া বাড়ি। ছাদের ঘরে ছোট্ট নাতাশাকে নিয়ে ফারহানার বেঁচে থাকা। 

পাটক্ষেতের আল ধরে ফারহানা এগিয়ে যায়। মোস্তাফাপুর শরৎচন্দ্র বিদ্যাপীঠের ইংরেজির দিদিমণি। সাড়ে আটহাজার টাকা মাইনে। নাতাশা থাকত এক মাসীর কাছে। স্কুল ছুটি হলেই বাচ্চাগুলো পাটক্ষেত থেকে সাপ, মাছ, ব্যাঙ ধরে ধরে ফারহানাকে দেখাত। আবার সেই আলপথে যাওয়া। বর্ষায় ডুবে থাকতো। তখন সাপের ভয় আরও বেশি। মাঝে মধ্যেই কারেন্ট থাকত না। ছোট্ট নাতাশাকে নিয়ে জড়সড় হয়ে বিছানার ওপর বসে থাকত। কোথাও যেন একটা স্বর ভেসে আসে। বিকেলের শেষে। ফারহানা ভাবত সমাজ বিপ্লব ফিরবেই। কিন্তু কখন যে নিজেই রাস্তা থেকে সরে বিয়ের সই করে ফেলল। তারপর নাতাশা। দুঃখের সিনেমার মতন একচিলতে জীবন! ফারহানা দেয়ালে থাকা টিকটিকির মতন টিকে থাকে। 

আজকে শনিবার। নিয়ন মিরিক থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে শুকনা স্টেশানের সামনে দাঁড়াবে। এখনও চল্লিশ হয়নি। অনেক প্রেম করেও বিয়ে হয়নি। একটা হোমস্টে চালায়। আর ফারহানার সঙ্গে প্রেম করে। কলকাতার সব পাট চুকিয়ে সেন বাড়ির একমাত্র সলতে নিয়ন এখন মিরিকে। কলকাতায় আর কেউ নেই। কাঁচাপাকা দাড়ি। বাঁ কানে দুটো দুল। নিয়ন বেশ ভালো। যদিও সেটা ফারহানা বলে না। বিকেল হয়ে আসে ফারহানা পাতা ঝরার শব্দের মতন আলতো স্বরে নিয়ন বলে ডাকে। সঙ্গে সিগারেটের ধোঁয়া। নিয়নের গা শিরশির করে ওঠে। ফারহানার হাতে আঙুল বুলিয়ে বলে তোর স্বরটা খুব পাতার শব্দের মতন। নিয়ন এককালে কবিতা লিখত। এখন লেখে না। ফারহানার সঙ্গে শুধু কবিতার মত করে কথা বলে। গাড়িতে বসে সোজা রংটং এর দিকে চলে যায়। চেনা দোকান। 

কফিতে চুমুক দিয়ে ফারহানা বলে, আচ্ছা নিয়ন এই পাহাড়ের শরীরে অনেক গাছ কিন্তু সেই গাছের স্বর তুই শুনতে পাস? 

নিয়ন চুপ করে থাকে। 

আচ্ছা জানিস এই পাহাড়ের বয়স কত? আমি আব্বুকে বলেছিলাম। আব্বু বলেছিল দাদিআম্মি জানে। কিন্তু দাদিআম্মি তো ছিল না। এখন আব্বুও নেই। নিয়ন, ওই, কি রে? জানিস! 

নিয়ন এখানে এলেই চুপ করে যায়। কথা বলে না। পাতার শব্দ শোনে। ফারহানার কথাগুলোও পাতার শব্দের মতন। ঝিরঝির করে হাওয়ার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করে পড়ে যাচ্ছে। যে গাছে পাতা নেই সেই গাছ নিয়নের খুব পছন্দের। সামনেই একটা ঝরাপাতার গাছ নিয়ন মোবাইল বন্দী করছে। 

ফারহানা এই সময়ের মধ্যে দুকাপ কফি আর তিনটে সিগারেট খেয়েছে। তারপর গাড়িতে বসে আছে। বিরক্ত হয়ে। প্রথম দিন থেকেই নিয়নের এই অদ্ভূত আচরণটা দেখেছে। প্রত্যেক শনিবার ওরা এই একই জায়গায় আসে। ফারহানা একই প্রশ্ন করে। নিয়ন ঝরাপাতার শব্দ শুনতে পায়। তারপর ওরা চলে যায়। শিলিগুড়িতে ফারহানাকে নামিয়ে মিরিক চলে যায় নিয়ন। 

সেবকের রেলগেট খুলতেই বাসটা গতি বাড়িয়ে পাহাড়ে পাক খেতে খেতে মহানন্দার জঙ্গলের রাস্তা ধরে। এখানে নেটওয়ার্ক থাকে না। ফারহানা নিয়নকে বারবার চেষ্টা করতে থাকে। কারণ আজকে রংটং যাওয়া হবে না। বাড়ি ফিরতেই হবে। হঠাৎ পিরিয়ড হয়ে গেছে। তলপেটে খুব যন্ত্রণা। কিন্তু ফারহানার মিসক্যারেজ হওয়ার কথা নয়। ডাক্তার তো বলেছিল এইবার সব ঠিক আছে। কিন্তু একে সাদা লেগিংস। রক্তে মাখামাখি। সালুগড়া আসতেই নিয়নকে কল করে। 

হ্যালো … হ্যালো… নিয়ন নিয়ন… আমি বলছি। 

শোন না, আমি জঙ্গলে। এখানে নেটওয়ার্ক নেই। আমি ওইখানে দাঁড়াচ্ছি। 

একটা সাদা আলোর টেবিলে ফারহানা শুয়ে আছে। একটা সদ্যোজাতকে বুকে নিয়ে। সে পাহাড়ি জলে তলিয়ে গেছে। হাতদুটো শূন্য হয়েও তার গন্ধ আকার অনুভব করছে ফারহানা। তার স্বর শুনতে পাচ্ছে। ফারহানার গায়ে রক্ত মাখা। একটা নীল রঙের পোকা বারবার কানের কাছে এসে কী যেন বলে যাচ্ছে। ফারহানা পোকাটাকে রক্তের মধ্যে ফেলে দেয়। 

বালুরঘাটের সরকারি হাসপাতালে শুয়ে ফারহানা একটা ঘুমন্ত পাখার ঘুরে যাওয়া দেখতে থাকে। গতকাল রাতে অ্যাবর্শন হয়েছে। ফারহানা ওই নীল সুন্দর পোকাটাকে মারতে চায়নি। কিন্তু আবারও যদি ভুল হয়। একটা ভুল হয়ে গেছে। এই বালুরঘাটে একটা বাচ্চাকে বড় করে যাচ্ছে ফারহানা। রোজ নতুন নতুন ঘটনা আর সেইখান থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ফেরা। তাই যতই আইনত বিয়েটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হোক না কেন, ফারহানা আসলে সরেই গেছে।  ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছে না ওর। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হল আবার।

নদীর ধারে শুকনো পাতার সঙ্গে মেঘগুলো ঝরে পড়ছে। নিয়নের হাত থেকে কয়েকটা প্রজাপতি উড়ে গেল। ফারহানা একটা সাদা চাদরে শুয়ে আছে। গাছেরা কিছুটা আড়াল করছে। গায়ে অনেক নীল পোকা। যেন নীল জলভরা শরীরের ভেতর। খুব উজ্জ্বল। ফারহানা আকাশের দিকে তাকায়। মুখে ঝুরঝুর করে পাতা পড়ছে। নিয়ন একটু দূরে। আবছা। ফারহানার স্বরে নিয়ন। কেউ যেন ঘোরের মতন ডেকে যাচ্ছে… 

  না হওয়া একটা প্রেম ফারহানার মাথার ভেতরে টিকে গেছে। মাঝে মধ্যে স্বপ্নে হানা দেয়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবকিছু একটাই টাইমজোনে ঢুকে পড়ে। 

ফারহানা নিয়নের স্বপ্ন দেখতে থাকে।

2 thoughts on “স্বর

  1. একটা নিখুঁত ছবি এঁকে তুলির ডগা দিয়ে অল্প ধেবড়ে দিলে যে মায়াটা তৈরি হয়, সেটাই যেন মাখামাখি হয়ে লেগে আছে এই গল্পের গায়ে। পাতা ঝরে নি:শব্দে, কিন্তু নিয়নের মাথায় থাকা তার শব্দের মতোই এই গল্পটার অনুরণন মাথার ভেতর কোথাও রয়ে গেল।

  2. স্বপ্নের স্বাধীনতা লেখায় ব্যবহৃত হয়েছে, অথচ বাস্তব রচিত হয়েছে মুহূর্ত আশ্রয়ের সম্বলটুকুর স্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতায়। ভালোবাসা সোমনাথ, বন্ধু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *