তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায় : ছয়
হিমালয় এক অনন্য পর্বতমালা। এখানে জড়িয়ে আছে আধ্যাত্মিকতা। পৃথিবীর দু’টি সেরা ধর্মের পীঠস্থান। এখানকার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়েছিল বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণে, এখনও তার সেই রেশ বর্তমান। বৌদ্ধ ধর্মের কলরব এই অঞ্চলের রঙবাহার। দুর্গম উপত্যকায় বা পাহাড়ের স্নেহবিধৌত কোলে এই পর্বতমালায় জন্ম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবনের বর্ণাঢ্য সমারোহ, বিকশিত সেইসব জনবসতির মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির রুদ্ররূপ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যুক্ত, তারা জানে দেবতার কী ব্যাখ্যা। ঐশ্বরিক শক্তির উপস্থিতি তাদের জীবনে কিছুমাত্র আশ্চর্য নয়। তারা মনে করে, জীবন মানে লৌকিক আর অলৌকিক বিষয়সমূহের সমাহার। তাদের জীবনযাপনের স্তম্ভ হল বিশ্বাস এবং এই বিশ্বাস দ্বিমুখী, যতটাই অন্তর্মুখী ততটাই আবার বহির্মুখী। আর দৃশ্যমান কোন অবয়বের যেমন ছায়া থাকে, তেমনই এই পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের উজ্জ্বল জীবনযাপনের একধারে লেগে রয়েছে অনিবার্য কিছুটা অন্ধকারও। তারা তন্ত্র-মন্ত্র-জাদুবিদ্যা ও সমগোত্রীয় আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক ছলাকলাও বেঁচে থাকার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে বিশ্বাস করে। সারল্য যেমন তাদের চরিত্রভূষণ তেমনি রুক্ষ প্রকৃতি তাদের মধ্যে সময়বিশেষে হিংস্রতা ও অন্যান্য মানবিক অপগুণগুলির প্রকাশ ঘটায়। সামগ্রিক বিচারে তবুও হিমালয় তাকে ঘিরে রাখা ধার্মিক ও মানবিক বিকাশ নিয়ে সমতলভূমির তুলনায় একেবারেই অন্য জগৎ যেখানে রয়েছে প্রাণের আরাম আর নির্মল অনুভব।
এখানে কি সত্যিই এক কালে দেবতারা বসবাস করত ? বা এখনও আছে তারা লোকচক্ষুর আড়ালে ? থাকুক অথবা না-থাকুক এখানকার আকাশে-বাতাসে উপলব্ধি করা যায় তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের নীরব অথচ সপ্রাণ প্রকাশ। তাদের উৎস নাহয় পুরাণ বা লৌকিক উপকথায়, স্বচক্ষে বর্তমান সভ্যতার মানুষ দেখেনি কোনোদিন, কিন্তু বুদ্ধ ও তাঁর বিকাশ এখানে ঐতিহাসিক তথ্যানুযায়ী স্বীকৃত। হিন্দুধর্মের দেবদেবীরা জীবন্ত আছে সেই ধর্মানুসারীদের বিশ্বাসে। রুদ্রদেব শিবের প্রিয়স্থান এই পর্বতমালা এবং স্বর্গভূমি ও গোলোকধাম বোধহয় এই অঞ্চলেরই ভূপৃষ্ঠে নাহলেও আকাশে কোন অবস্থানে বলেই সবার ধারণা। হাজার হাজার বছর ধরে লক্ষ লক্ষ উপাসক সাধু-সন্ন্যাসীরা এখানে অভাবনীয় দুর্গমতার কোলে আত্মগোপন করে তপস্যায় মগ্ন থাকতে অভ্যস্ত এবং এখনও অনেকে সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। কিসের আকর্ষণে ? কিসের মোহে ? তার অনেকটাই সূত্র পাওয়া যায় হিন্দুধর্মের আকরিক বেদ-উপনিষদ ও অন্যান্য পৌরাণিক মহাকাব্যিক ধর্মগ্রন্থে। সেখানে অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, তপস্যা ছিল ঈশ্বরদর্শনের বাসনায়। কিন্তু তারও পিছনে ছিল অন্য লক্ষ্য, ছিল অপার শান্তির সন্ধান। সেই অপার শান্তি কিভাবে পাওয়া যাবে ? যদি পরমব্রহ্মের সন্ধান পাওয়া যায়। তখনই মিলবে অখণ্ড স্বর্গবাস ও অমৃতের সন্ধান। আর যে পাবে অমৃতের সন্ধান সে পাবে অপার আনন্দ ও অনন্ত জীবন। অথবা, এই সমস্ত উদ্দেশ্যগুলি একটু এদিক-ওদিকও হতে পারে। স্বর্গের দেবদেবীরা অমর যেহেতু অমৃত রয়েছে তাদের অধিকারে। তাই অমরত্ব পেতে গেলে অমৃত হস্তগত করা অবশ্যই দরকার, তার জন্য প্রয়োজন স্বর্গের অধিকার এবং সেই বরলাভের জন্যই দেবদেবীর তপস্যা। অথবা, অপার শান্তি ও অপার আনন্দ মিলবে যদি ঘটে মোক্ষলাভ, আর তাই পরমব্রহ্মের সন্ধান অবশ্য প্রয়োজন। তার জন্য দরকার দীর্ঘকালীন তপস্যা ও প্রতীক্ষা যা একজীবনে কোনমতেই পাওয়া সম্ভব নয়। তাই অনন্ত জীবন লাভের আকাঙ্খায় দেবদেবীর আরাধনা। যাই হোক না কেন, অনাদিকাল ধরে তপস্যার কেন্দ্রভূমি এই হিমালয় পর্বতমালার নানা অঞ্চল। ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, সংস্কার ও কুসংস্কার, ইতিহাস সব মিলেমিশে একাকার এই সুবিশাল ভাণ্ডারে।
মৌনী তপস্বী হিমালয়ের আশ্রয়ে এসে নিজেও প্রায় মৌনব্রত নিয়েছে শৈবাঙ্কন। কথা বলতে নিতান্ত বাধ্য হলেই বলে, কেবল শোনে কে কী বলতে চায়, মানুষই কেবল নয়, সমগ্র জীবজগৎ ছাড়া জড়জগতও অবশ্যই। মানুষে মানুষে কথা বলার অভ্যেস ক্রমশ প্রায় স্থগিত হয়ে যাচ্ছিল যখন তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবোত্তর অভিনব কলাকৌশলশাসিত সমাজভূষিত নগরভিত্তিক সভ্যতায় মোবাইল ফোনে তড়িৎগতিসম্পন্ন আঙুলের ডগার দুরন্ত সঞ্চালনে মনের কথা মুখের ভাষা বৈদ্যুতিন পর্দার গায়ে বার্তাবহ প্রকাশব্যবস্থার দৌরাত্মে, সেসময় থেকেই তার অন্তরে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছিল বাক্যবিনিময়কারী সঙ্গীদের অভাবজনিত ক্ষোভ আর অভিযোগ ও অভিমান। সেখান থেকেই তার কথা না বলার অভ্যেস তৈরি হয়ে আসছিল যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে এখানে এই হিমশীতল পার্বত্য মরুভূমির কোলে বসবাস শুরু করে। ধওলাধর পর্বতমালার অনেক উত্তরে এই স্পিতি অববাহিকা। ডিম্বাকৃতি এই শীতল পাহাড়ি মরু উপত্যকায় জীবনের স্পন্দন কোথায় ? হিমালয়ের বৃষ্টিচ্ছায় ঢালে রয়েছে এই অঞ্চল, সারা বছরে তাই এক ফোঁটাও বৃষ্টি নেই। তাপমাত্রার তীব্র ওঠানামা চলে সবসময়, গ্রীষ্মে কোনোকালে সর্বোচ্চ পনের ডিগ্রি সেলসিয়াস হতেও পারে, অধিকাংশ সময় থাকে শূন্যঙ্কের তলায়। রয়েছে প্রচুর সূর্যকিরণ আর বরফাচ্ছাদন। বাদামি পর্বতগাত্র গড়ে তুলেছে অত্যাশ্চর্য স্বর্গীয় ভূদৃশ্যাবলী, অপার্থিব যে সৌন্দর্য বিশ্বে দুর্লভ ও বিরলপ্রায়। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ ছাড়াও আছে প্রবল হওয়ার দাপট, আবহাওয়াতে অত্যুচ্চ এলাকার চরিত্র এবং স্বল্প আর্দ্রতা—- এ সমস্ত কিছু একসঙ্গে মিলে মাটিকে করে তুলেছে শুষ্ক ও জৈব উপাদানবঞ্চিত। এটাও এক মরুভুমি, নাম তাই কোল্ড মাউন্টেন ডেজার্ট। শৈত্যপ্রবাহজনিত প্রবল বায়বীয় গর্জন যেমন তার কানে শিবের রুদ্ররূপ ও ভীমনাদ হয়ে আছড়ে পড়ে, সে তখন শোনে মহেশ্বরের গুরুগম্ভীর স্বরের ভাষণ, যা বর্ণনা করে কেমন তার চরিত্র, তেমনি ঝলমলে সূর্যকিরণ বরফমুকুট সুউচ্চ শৈলচূড়াতে প্রতিফলিত হয়ে ফুটিয়ে তোলে তার বুকের শান্তশীতল ভাষা। সে শোনে সেই অব্যক্ত কণ্ঠস্বর বলছে,
‘এখানে তোমাকে আমারই মত স্থিতধী আর উদার হয়ে যেতে হবে।’
হিমালয়ের সর্বনিম্নাংশ ভারতবর্ষের উত্তরাংশে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে একটানা চলে গেছে শিবালিক পর্বতমালা নামে। এই অঞ্চল নবীন এবং ঘন বনভূমিতে আচ্ছাদিত অত্যুচ্চ চূড়াসমূহের সমাহার যা জীবাশ্মের ভাণ্ডার। তার উত্তরে রয়েছে ধওলাধর পর্বতমালা যেখানেও আছে দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এর উত্তর-পশ্চিমে পীর পাঞ্জাল পর্বতমালা জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে। এই দু’টি পর্বতমালা নিয়ে লেসার হিমালয়। তার উত্তরাংশের নাম গ্রেটার হিমালয় আর এখানেই আছে জাঁস্কার পর্বতমালা, স্পিতি উপত্যকা গড়ে উঠেছে যার আশ্রয়ে। গ্রেটার হিমালয় হল একেবারেই উত্তরের অঞ্চল আর এখানে রয়েছে ট্র্যান্স হিমালয় এলাকা যার অন্য নাম তিব্বতীয় হিমালয়। এই তিব্বতীয় বা টিবেটান হিমালয়ের অধিকাংশ অবস্থিত তিব্বতে। এর অন্তর্গত পর্বতমালাগুলি হল জাঁস্কার, লাদাখ, কৈলাশ ও কারাকোরাম। পূর্ব-পশ্চিমে এক হাজার কিলোমিটার এর বিস্তৃতি। তিব্বতীয় হিমালয় ও ট্র্যান্স হিমালয়ের সুপরিচিত নাম টেথিস হিমালয়। এই টেথিস হিমালয় জম্মু ও কাশ্মীর এবং হিমাচল প্রদেশ জুড়ে অবস্থিত, চলে গেছে তিব্বতে। এখানেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে ছিল টেথিস মহাসমুদ্র। তারপর একদিন ভুগর্ভস্থ গাঠনিক থালায় হঠাৎই দেখা দিল মহা আলোড়ন। ইন্ডিয়ান প্লেটের সঙ্গে চায়না প্লেটের সংঘাতে সমুদ্র উধাও হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উপস্থিত হল হিমালয় পর্বতমালা। টেথিস হিমালয়েরই অন্তর্ভুক্ত জাঁস্কার পর্বতমালা, যা তৈরি করেছে স্পিতি বেসিন বা স্পিতি অববাহিকা।
সন্নিকটে দেবাদিদেবের বাসস্থান কৈলাশ পর্বত, তারই দোসরপ্রতিম জাঁস্কার পর্বতগুচ্ছ। আদিদেবের ধ্যানমগ্নতা পরিবেশের বহিরঙ্গে ও অন্তরে। শৈবাঙ্কন এখানে এসে সেই দৈবী মহিমা আবিষ্কার করতে পেরেছে। তার মনে হয় যে এখানেই কোথাও সুরক্ষিত আছে অমৃতভাণ্ডার, জরাজীর্ণ জীবন যার সংস্পর্শে প্রাণিত পারে। স্বর্গ যে পৃথিবীর কোন এক স্থান এতে আর কোন সন্দেহ নেই। সমতলে থাকার সময় সে জানত না হিমালয়ের পরিচয়। হয়তো স্কুলপাঠ্য ভূগোলের বইতে সে জেনেছিল জাঁস্কার পর্বতমালার কথা, কৈলাশ তো নানাভাবেই সুপরিচিত। সে আরও জানত যে এখানেই স্মরণাতীত কালে ছিল টেথিস মহাসমুদ্র। কিন্তু সে জানত না টেথিস হিমালয়ের জাঁস্কার পর্বতমালার চেহারা ও চরিত্র কেমন। তারই সযত্ন প্রাচীরের ঘেরাটোপে যে জন্ম নিয়েছে অপরূপ স্পিতি উপত্যকা সে কথা জানা ছিল না। আসলে জাঁস্কার পর্বতমালার সুখ্যাতি তার সুউচ্চ সুন্দর শিখরগুচ্ছ ও চিত্ত বিমোহন ভূদৃশ্যাবলীর জন্য। এখনও তা বলতে গেলে অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে। আর এখানেই লে-লাদাখ অঞ্চলের তুলনায় সে স্বতন্ত্র, তার জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি তেমন নয় বলে। তবে তার আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে ক্রমশ বাড়ছে এই অঞ্চলের মনোরম জলবায়ু, বরফাচ্ছাদিত পর্বতশিখর, খরস্রোতা নদীগুলির জন্য।
গ্রেটার হিমালয়ের টেথিস অঞ্চলে একগুচ্ছ পর্বত নিয়ে জাঁস্কার পর্বতমালা উত্তর ভারত থেকে তিব্বতের পশ্চিমাংশ পর্যন্ত ছ’শ চল্লিশ কিলোমিটার প্রসারিত দক্ষিণ-পূর্বে, হিমাচল প্রদেশের কিন্নর উপত্যকায় আছে এর শিল্লা চূড়া আর চাম্বা জেলাতে পাঙ্গি চূড়া। জাঁস্কার পর্বতমালা কিন্নর ও স্পিতি থেকে তিব্বতকে আর পাঙ্গি চাম্বাকে লে-লাদাখ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। হিমাচল প্রদেশের উত্তর-পূর্বাংশ বোঝায় তিব্বত ও ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী অংশ, স্পিতি কথাটির মানেই হচ্ছে তাই। পনের হাজার ঊনষাট ফিট উচ্চতাবিশিষ্ট কুঞ্জুম পাস লাদাখ আর স্পিতি উপত্যকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
থমসন স্পিতি উপত্যকার চরিত্র জানার জন্য এক বড় অভিযানে গিয়েছিলেন। সে আঠেরোশ’ সালের কথা। সমগ্র উপত্যকার মাটিতে তিনি তিন জাতীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছিলেন। একটি হল জমাটবাঁধা মিহি কাদামাটি। দ্বিতীয়টি ত্রিকোণাকার পাটাতন, যা পর্বতগাত্র থেকে শিথিল ঢালে নেমে এসেছে নদীর দিকে আর শেষ হয়েছে তীব্র খাড়াই দিয়ে। আর তৃতীয়টি নদীগর্ভের ওপরে চারশ’ থেকে ছ’শ ফিট উচ্চতায় বিপুলাকার গভীর গহ্বর। স্পিতি নদী এই পাটাতনগুলির মধ্যে দিয়ে সুগভীর গিরিসংকট সৃষ্টি করে বয়ে চলেছে। শেষ দুটি বৈশিষ্ট্যের গাঠনিক উপাদান কাদামাটি, নুড়ি পাথর আর বোল্ডার। থমসন অনুমান করেছিলেন, অতীতে এই উপত্যকা ছিল নিশ্চয় কোন বিশালায়তন হ্রদ। কিন্তু তিনি কোন নিশ্চিত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, কিভাবে এই উপত্যকার আবির্ভাব ঘটল তারও কোন উল্লেখ ছিল না তাঁর বিবরণে। এখন ভূবিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রমাণ করেছে যে ভূগর্ভস্থ গাঠনিক প্লেটগুলির আলোড়নে ও সংঘর্ষে আদিম যুগে এই অঞ্চলের সমুদ্র সরিয়ে উপত্যকার উদ্ভব ঘটেছে।
এসব তথ্য সবই জানে শৈবাঙ্কন। এখানে আসার পাকাপাকি সিদ্ধান্তে এসে পড়াশুনা করেছে এই উপত্যকা নিয়ে সে অনেকটা সময়, জেনে নিয়েছে অনেক বিবরণ। যেখানে সে জীবনের বাসভূমি বানাবে তার স্বভাব-চরিত্র জানবে না ? তার আগে ঘুরে বেড়িয়েছিল দেশের সম্ভাব্য অনেক জায়গায়। মানুষ আছে বা নেই এমন অনেক স্থানে। আরও অনেক সৌন্দর্য্যমন্ডিত জায়গা তার বাসস্থান হতে পারত। তাদের অনেকেই কিন্তু নির্জন বা স্বল্প জনবিশিষ্ট। দৃষ্টিনন্দন ফুলের উপত্যকা ছিল কিছু পাহাড়ে ঘেরা যেখানে কেবলই উৎসবের আয়োজন সারা বছর। কিন্তু সে চেয়েছে সবসময় অন্যকিছু, একেবারে নির্জন কিছু হবে এমন কোন শর্ত ছিল না তার। আনন্দ থাকবে কি থাকবে না তারও ধার ধারত না সে। তবে এমন কোন স্থানে সে যেতে চায়নি যেখানে থাকবে উৎসবের পরিবেশ বা চপল আনন্দ। তার চাহিদা ছিল গুরুগম্ভীর কোন প্রদেশ, যেখানে আনন্দ বিরাজমান মৌনতামগ্ন প্রশান্তি নিয়ে। তার কারণ কিছুটা ভিন্ন, কেবলমাত্র তথ্যপ্রযুক্তিপোষিত আধুনিকতার ওপর বীতরাগ নয়। এই বীতরাগ তাকে জনকোলাহল থেকে দূরে বসবাসের ইচ্ছে জাগিয়েছিল, অত্যাধুনিক জনসমষ্টি বর্জন করার মনোভাবও এনেছিল তার মধ্যে ঠিক, কিন্তু তাকে একেবারে শুরুতেই ঘরছাড়া করেনি বা এমন শান্ত-সমাহিত গম্ভীর প্রদেশে বাসস্থান বানাবার কথা ভাবায়নি। তাকে ঘরছাড়া করার কারণ ছিল অন্য। তার জীবনের প্রধান শোক। আধুনিক জনসমাজের ওপর বীতরাগ হল তার বিদ্বেষ, শোক নয়। দু’টোই আঘাত যদিও চরিত্রে ভিন্ন। তার জীবনের কী সেই শোক ?
ভারতবর্ষে ইংরেজ আমলের আগে কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যব্যবস্থা যখন ভাঙ্গনের মুখে তখন লাহুল ও স্পিতি স্বাধীন অস্তিত্ব হয়ে ওঠে। স্পিতিভ্যালির স্থানীয় শাসকদের উপাধি ছিল নোনো। তারা হয় দেশজ কোন বংশের বা লাদাখ অঞ্চলের শক্তিশালী শাসকদের স্পিতিকে দেখাশোনা করার জন্য পাঠানো ব্যক্তিদের উত্তরপুরুষ। দশম শতাব্দীতে স্পিতিকে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হয় লাদাখের রাজার তিনটি ছেলের মধ্যে একজনের হাতে। তারপর থেকে দীর্ঘকাল স্পিতির ইতিহাস লাদাখের ইতিহাসের সঙ্গে একই ধারায় প্রবাহিত হয়ে এসেছে। স্পিতি স্বায়ত্ত্বশাসন ক্ষমতা ফিরে পায় লাদাখের শাসকরা কালের নিয়মে দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর। তখনও স্পিতিকে নিয়মিত মাশুল পাঠাতে হত লাদাখ, চাম্বা ও কুলুতে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে লাদাখ-তিব্বত যুদ্ধের পর স্পিতি সত্যিসত্যিই স্বাধীন হয়ে যায়। কুলু উপত্যকার রাজা মান সিং স্পিতি দখল করে এই অঞ্চলে গা-ছাড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নিয়ন্ত্রণ আবার ফিরে যায় লাদাখের হাতে। লে থেকে গভর্নর হিসেবে এই অঞ্চলের দেখভালের জন্য একজনকে পাঠানো হয়, কিন্তু সে এখানে থাকত কেবল ফসলের মরশুমে। অন্যসময় সে স্থানীয় প্রশাসনের ভার ওয়াজির বা নোনোদের তত্ত্বাবধানে রেখে চলে যেত। দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য বেশ কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে একজন গ্রামপ্রধান বা নেতা বাছাই করা হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত স্পিতি থাকে ডোগরা সম্প্রদায়ের অধীনে, তারপর শিখরা পর্যুদস্ত হওয়ার পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। বুশারদের পুরুষানুক্রমিক ওয়াজির বা উজির মনসুখ দাসের তত্ত্বাবধানে রাখা হয় অঞ্চলটিকে। সমগ্র স্পিতি এলাকার জন্য উজিরকে বছরে সাতশ’ টাকা খাজনা হিসেবে দিতে হত ব্রিটিশদের। বছরখানেক পরই স্পিতি সরাসরি কুলুর সহকারী কমিশনারের অধীনে চলে আসে। স্বাধীনতার পর নতুনভাবে লাহুল ও স্পিতি জেলা গঠিত হয় এবং পাঞ্জাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে একে জুড়ে দেওয়া হয় হিমাচল প্রদেশ রাজ্যের সঙ্গে।
তার অতীত জীবনকে সে ফিরে দেখে প্রায়ই। বিশেষত কোন নিশ্চুপ রাত অবশ করে রাখে যখন অন্ধকারের আচ্ছাদন। শৈত্যপ্রবাহ থাকে তখনও, বরং আরও প্রবল হয়ে ওঠে তার বিচরণ, আর মহাকাশ নিশ্ছিদ্র করে রাখে তারকারাজির কথোপকথন। সে কান পেতে থাকে তারা কী বলে শোনার আকুল আগ্রহে।যদি তাদের বাক্যালাপে সে তার মায়ের কণ্ঠ শুনতে পায় ! আর সে খোঁজে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ওই তারকাদলের ভিড়ে কোনোটিতে তার মায়ের মুখ দেখা যায় কিনা। সে স্থিরনিশ্চিত এই বিশ্বাসে যে ওখানে অবশ্যই তার মা কোথাও কোন না কোন তারকা হয়ে তাকে দেখছে স্নেহাতুর চোখে। প্রত্যেকটি মানুষ যেহেতু একেকটি স্বাধীন সত্ত্বা এবং যেহেতু তা প্রাণিত থাকে অফুরন্ত চেতনাবোধে, দেহ বিনষ্ট হলেও সেই চেতনা সেই বোধ হারাতে পারে না। এটাই সে মনে করে অমরত্ব, যা কোন মানুষকে তার ক্ষুদ্র জীবনের পরিসরেও অনন্ত করে দেয়। বৈদিক ঋষিরা নাহলে কিসের সন্ধানে নিয়োজিত থাকত হিমালয়ের নির্জন গুহায় বা অরণ্যে দিনের পর দিন জনবর্জিতভাবে ? তারা কি কেউ কখনও তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে আসুরিক অভিপ্রায়ে দৈহিক অমরত্বের বর চাইত ইষ্টদেবতার সম্মুখে ? তারা সেই অমরত্ব, সেই অনন্তের সন্ধানে ব্যস্ত থাকত যা কোন সত্ত্বাকে তার সীমানা দিয়ে ঘেরা সুনির্দিষ্ট জৈব কাঠামোর অতিক্ষুদ্র অবয়বের মধ্যে অমৃত আর অনন্তকে উপলব্ধি করতে শেখায়। সেই অনন্তের সন্ধান যে পায় সে নিজেও জীবন যে সত্যিই অনন্ত তা বুঝতে পারে। সে এই দর্শন সমগ্র প্রাণমন দিয়ে বিশ্বাস করে যেহেতু সে বেদ-উপনিষদ-গীতা এবং অন্যসব সমগোত্রীয় রচনাসমূহ নিবিড় মনোযোগে অন্তরস্থ করে জানতে পেরেছে বৈদিক মুনিঋষিদের ব্যবহার, কার্যকলাপ ও অভিপ্রায়। তাই সে জানে, তার মা-ও হারিয়ে যেতে পারে না। সে তাই রাত্রির অন্ধকারে আকাশ-অলংকৃত তারকাদলের ভিড়ে খোঁজে সেই নির্দিষ্ট তারাটিকে যে তার দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে। কোন্ তারকাটিতে তেমন স্নেহ ঝরে পড়ছে সে তাকে খোঁজে ক্লান্তিহীন বিরামহীন, কারণ সে জানে ওই তারাটিই তার মা। তার নাগরিক মানুষজন ফেলে এমন এক পাহাড়ি নির্জনতায় চলে আসার এটাও একটা বড় কারণ, যেখানে এলে রাতে আকাশের সমস্ত তারাদের পাওয়া যায়। সভ্য সমাজের কৃত্রিম আলোকমালায় তেমনটি সম্ভব নয়, কারণ সেখানে বহু তারকা মুছে থাকে নাগরিক আলোর অত্যাচারে। নগরকেন্দ্রিক স্থানে তাই সব তারাদের দেখা যায় না। সে তাই এখানে এসেছে সব তারাদের একসঙ্গে আকাশে খুঁজে পাওয়ার বাসনায় যেখানে সে জানে তার মা উপস্থিত, যত দুর্বলই হোক না কেন তার প্রকাশ। সে তাই চেয়েছে এমন একটি নিষ্কলুষ আকাশ যেখানে সে তার মায়ের সন্ধান পাবে।
সে তার বাবাকে হারিয়েছিল অনেক ছোটবেলায়। তার কাছে বাবার স্মৃতি তাই অস্পষ্ট অনেকটাই। পূর্ববঙ্গে ছিল তার পূর্বপুরুষের বাসস্থান। গ্রামে ছিল পিতৃপুরুষের বংশানুক্রমিক সম্পত্তি আর প্রাসাদ। বাবা পরে জেলার মূল শহরের কেন্দ্রস্থলে বিশাল এক বাড়ি তৈরি করেছিল মায়ের কথা ভেবে, কারণ মা শহরের মেয়ে, দাসদাসী পরিবেষ্টিত হয়েও গ্রামের জীবনে অনভ্যস্ত। শহরে এসে সুবিশাল জমি কিনে বাবা বাড়ি বানাবার পর মা তাকে সন্তানস্নেহে সাজিয়েছিল বছরের পর বছর ধরে, বাগান গড়ে আর গাছপালা লাগিয়ে। তারপর দেশভাগ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাব, বাংলা দ্বিখণ্ডিত। কার কী স্বার্থপূৰ্ণ ঘটল কে জানে, তবে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছাড়া অনিবার্য হয়ে পড়ল। স্বদেশ হয়ে গেল বিদেশ, তারা হয়ে গেল উদ্বাস্তু। শহরের বাড়ি ফেলে দিয়ে প্রায় পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাদের, তবুও রক্ষে এটাই যে দেশের বাড়ি আগেই ত্রিপুরাতে এক ভিন্নধর্মী পরিবারের জমিজমার সঙ্গে বিনিময় করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ত্রিপুরাতে পাহাড়-জঙ্গল-জলাভূমিতে ঘেরা অনুন্নত প্রায় আদিম বাসস্থানে এসে বাবা মানসিকভাবে চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয়ে প্রায় বিছানা নিল আর শেষপর্যন্ত এটাই হল তার বছরখানেকের মধ্যেই মৃত্যুর কারণ। তারপর সে কয়েক দশক ধরে সঙ্গে থেকে দেখেছিল মায়ের সংগ্রাম, শূন্য থেকে তাদের জীবনে মাথা তুলে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার অক্লান্ত একনিষ্ঠতা। তা কি সে ভুলতে পারে ?
সেই ছোটবেলায় মায়ের কোলে চেপে চোরাপথে পাহাড়-জঙ্গল-জলাভূমি ধরে উদ্বাস্তু হিসেবে ভয়তাড়িত জন্তুর মত পালিয়ে ভারতসীমান্তে প্রাণ হাতে করে ঢোকার দৃশ্যাবলী এখনও তার চোখে ভাসে।কয়েক কিলোমিটার নির্জন জলাভূমির হাঁটুজল পার হওয়ার সময় মা একহাতে তাকে কোলে আঁকড়ে অন্যহাতে কাপড় তুলে রেখেছিল হাঁটুর ওপর। গোটা পথ হেঁটে অতিক্রম করতে লেগেছিল হয়তো দু’-তিনদিন। রাতগুলি কেটেছিল গোপন আশ্রয়ে, যারা ছিল পাসিংদার তাদের কোন চেনা ব্যক্তির বাসস্থানে এবং সেই সেই বাড়ির মালিকরাও ছিল গোটা প্রক্রিয়াটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। অর্থের বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দেওয়ার দায়িত্বে যারা ছিল তাদেরই বলা হত পাসিংদার। তারা ভারতে ঢুকেছিল ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া মহকুমা দিয়ে।
এখানে এই জনবর্জিত প্রদেশে বসে সে শোনে নিরাকার দেবতাদের নির্বাক স্বর আর স্পিতিভ্যালির আত্মার সংলাপ। মৌখিক বাক্য বিনিময়েরও সুযোগ হয় তার—- পর্যটক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, গ্রামবাসী ও মেষপালকদের সঙ্গে যখন দেখা হয়। ইচ্ছে হলেই সে চলে যায় তাবো, সেখানে আছে দালাই লামার প্রিয়স্থান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম মুখ্য গবেষণাকেন্দ্র তাবো মনাস্ট্রি। ওখানকার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে রয়েছে তার প্রীতির সম্পর্ক। কখনো সে চলে যায় সুমদো, ধনকর, গিউ বা আরও দূরে কাজা পেরিয়ে কি মনাস্ট্রি। পিন ভ্যালি জাতীয় অরণ্যেও সে গেছে একাধিক বার। কাছে-দূরের এমন অনেক ছোটবড় গ্রাম ও বৌদ্ধ গুম্ফাতে তার যাতায়াত লেগেই থাকে। গ্রামবাসী ও সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মৌখিক বাক্যালাপ তো চলে বছরের প্রায় আট-ন’মাস, কারণ প্রবল শৈত্যপ্রবাহের জন্য উন্মুক্ত অঞ্চলে বসবাস তখন কোনমতেই সম্ভব নয়। তবে যখন সে একেবারেই একা থাকে তখন সে নির্বাক অন্তরের ভাষায় কথা বলে নিরাকার দেবতা ও উপত্যকার প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের সঙ্গে। তখনই সে বেশি ভাবে তার ফেলে আসা জীবনের কথা।
শহর জীবনে থাকার সময় অনেকদিন আগে অখ্যাত এক বাঙালি লেখকের একটি গল্প পড়েছিল দৈবক্রমে, গল্পটির নাম ‘মায়ের খোঁজে ‘। সেই লেখক নিজেও ছিল মা-অন্ত প্রাণ। আত্ম্ভাষণ লিখেছিল সে মায়ের মৃত্যুর পর একটানা কয়েক দশক। তার দৈনন্দিন জীবনে রুটিন ছিল ঘুম থেকে উঠে সে অন্তত চার লাইন লিখবেই জীবনীর একাংশ যাতে ‘মা ‘ শব্দটির উল্লেখ থাকবে। হাজার হাজার পাতা সে লিখে রেখেছিল। সেইসব লেখার কিছু অংশ হাতে পেয়ে সে জেনেছিল যে শিশুবয়সে পিতৃহীন তাকে ও তার ভাইবোনদের মানুষ করতে গিয়ে তার মা জীবনপাত করে দিয়েছিল। সেও ভাবত মাকে সুখী করতে সে একদিন বিশ্ববিখ্যাত হবে, মায়ের জন্য অমরাবতী রচনা করবে। কিছুই সে করতে পারেনি। তবে মায়ের জন্যই উচ্চশিক্ষা, চাকরি, শহরের বুকে বাড়ি, এমনকি বিয়ে ও সন্তানলাভ ঘটেছিল। তবুও সে খ্যাতি পেল না লেখা বা অন্যসব কলাচর্চার জন্য। তার মায়ের মৃত্যু হল। তার জীবন থেকে তারপর পনেরটি বছর হারিয়ে গিয়েছিল, শৈবাঙ্কন যেমন বাড়ি ছেড়ে পরিব্রাজক হয়ে স্পিতিভ্যালিতে তার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। সেই লেখক তারপর বিতৃষ্নায় লেখা ও অন্যসব রচনা বর্জন করেছিল, তার জীবনে আর খ্যাতির মোহ ছিল না। তারপর সে লিখতে ভুলে গিয়েছিল। প্রায় কুড়ি বছর পর আবার লিখতে গিয়ে সে দেখল আর লিখতে পারছে না। আপাদমস্তক অবসাদাচ্ছন্ন হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে আবার একদিন লেখনী সচল হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারল এবং বাকি জীবনে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখে ফেলেছিল। ইতিমধ্যে জীবনের হারিয়ে যাওয়া প্রায় দু’দশকের একসময় উদাসীন থাকার সুবাদে তার লেখা প্রায় দু’-তিনশ’ গল্প, কয়েকটি উপন্যাস ও কল্পবিজ্ঞান কাহিনী বাড়িতে রাখা কাজের লোক কিলোদরে কাগজওয়ালাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। তাই ষাট বছর বয়সের পর আবার লেখার ইচ্ছে ও ক্ষমতা ফিরে যখন পেল তখন তাকে আবার সব নতুনভাবে শুরু করতে হল। প্রথমেই সে লিখল, ‘ইট’স মাই আইল্যান্ড ‘ বলে একটি উপন্যাস ইংরেজি ভাষায়। তারপর আরও এমন সব।
‘মায়ের খোঁজে ‘ গল্পটি কল্পবিজ্ঞানের আর সেটি ওই লেখক লিখেছিল তার মায়ের জীবদ্দশাতেই, নিজের মায়ের জন্য ভালোবাসা থেকে। যদিও সেই গল্পটি পরবর্তী সময়ে কাজের লোক গোপনে কাগজওয়ালাকে বিক্রি করে দিয়েছিল টাকার জন্য, শৈবাঙ্কন তার কথা জেনেছে লেখকের আত্মজীবনী থেকে। গল্পের মূল চরিত্র এক কিশোর বিজ্ঞানী, নাম ক্রোমি। সে থাকে ভীনগ্রহে, পৃথিবী থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। তার গ্রহে কোন রাজনৈতিক প্রশাসক নেই, জানে না কেউ রাজনীতি কাকে বলে। তাদের গ্রহে সবাই জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী এবং তাঁদেরই আয়ত্তে গ্রহ পরিচালনার ভার। গ্রহের বাসিন্দারা সবাই চেহারায় মানুষেরই মত দেখতে এবং কেন তার অকাট্য কারণ দেখিয়েছিল লেখক বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বিচার করে। গ্রহের উন্নয়ন ঘটেছিল বিকল্প ধারায় যাতে পৃথিবীরও উন্নয়ন ঘটতে পারত। তারা সবাই বস্তুনির্ভর পথে উন্নয়ন ঘটায় নি আর তাই যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসে, খুনোখুনি কাকে বলে জানতই না। তাই কোন যুদ্ধাস্ত্র বানায়নি কোনদিন। তবুও তারা সবাই অসম্ভব ক্ষমতাশালী ও প্রত্যেকেই বিকল্প শক্তির অধিকারী, যা কোনোমতেই শারীরিক নয়। তারাও মহাকাশে সন্ধান চালাত অন্য কোন প্রাণিসভ্যতার। সেই সন্ধানে সামিল ছিল ক্রোমিও।তখনও পর্যন্ত তেমন কোন সন্ধান না পেয়ে তারা সবাই হতাশ ছিল। বিকল্প উপায়ে সভ্যতার উন্নয়ন ঘটাবার প্রক্রিয়ায় বিকল্প শক্তির অধিকারী হওয়ার সুবাদে তারা প্রত্যেকেই ছিল অনন্ত জীবনের অধিকারী, তবু মৃত্যু তাদের জন্যও অনিবার্য ছিল। এই কারণেই ক্রোমি যখন ভিনগ্রহী জীবন সন্ধানে ব্যস্ত তখন তার মা একদিন হঠাৎ মারা গেল। ক্রোমি মাকে অসম্ভব ভালোবাসত, আর তাই সে এখন সবকিছু ছেড়েছুড়ে মাকে খুঁজে পাওয়ার বাসনায় মৃত্যুর পর সবাই কোথায় যায় তারই অনুসন্ধানে নিজেকে উৎসর্গ করল। তার গ্রহের জ্ঞানীগুণীরা তাকে আর কী বলেন, তার কাজে কেউ বাধা দিলেন না যেহেতু সবাই জানতেন যে সে অকল্পনীয় প্রতিভার অধিকারী। মাকে খুঁজতে খুঁজতে সে একদিন অসাধ্যসাধন করে ফেলল, সে খুঁজে পেল তাদের গ্রহের অবিকল প্রতিরূপ এক অন্য পৃথিবী। আর অবিশ্বাস্য প্রতিভার সাহায্যে সে একটি আশ্চর্য উপায় আবিষ্কার করল যা দিয়ে ওই বিকল্প প্রথিবীতে যাওয়া যায়। আর সেখানে গিয়ে সে দেখল যে তার মা মৃত্যুর পর অন্য পরিচয়ে হলেও সেখানেই উপস্থিত রয়েছে। ক্রোমি যে বিকল্প পৃথিবীটাকে খুঁজে পেয়েছিল সেটা আসলে আমাদেরই পৃথিবী অন্যরূপে।
বৈকালিক অবসন্নতায় শিলাখণ্ডে উপবিষ্ট শৈবাঙ্কন স্পিতিভ্যালির পাহাড় চূড়াগুলির দিকে উদাসীন চোখ ফেলে ভাবছিল, সেও যদি এই পৃথিবীর বিকল্প তেমন এক পৃথিবীকে খুঁজে পেত যেখানে মৃত্যুর পর তার মা এখন বসবাস করছে ! নেই কি সেই পৃথিবী ?
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)