তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

রামনাথ সিদ্ধান্ত পঞ্চানন

দেশ ভাগ হবার অনেক আগের কথা। অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার কোটাঁলিপারা অঞ্চলের এক অখ্যাত গ্রামের নাম ছিল পশ্চিমপাড়। সেই গ্রামেই ১৮২৯ সালে রামনাথ এর জন্ম। তার বাবা ছিলেন রামকুমার ভট্টাচার্য। তাদের এক পূর্বপুরুষ কৃষ্ণনাথ  সার্বভৌম এবং তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী দেবী যুগ্মভাবে “আনন্দলতিকা” নামে একটি  অসাধারন কাব্য গ্রণ্থ  রচনা করেছিলেন। এর  থেকেই বোঝা যায় এই পরিবারের সংস্কৃতি চর্চার ধারা।

ছোট বেলায়  রামনাথ কিছুটা স্থুলো  বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। নিজের ভালো মন্দ, লেখাপড়া করা, না করা এ জাতীয় কোনও বোধ বুদ্ধি তার ছিলনা। চিন্তিত বাবা রামকুমার ছেলের ভবিষ্যত ভেবে কোনও কূল কিনারা পান না। শোনা যায় তারপর হঠাৎ ই তিনি কাশী চলে গেলেন। সেখানে তিনি বাবা বিশ্বনাথের শ্রী চরণে পুত্রের সুবুদ্ধি কামনা করে একলক্ষ বেলপাতা সহযোগে পূজা দিলেন।   তারপরেই নাকি দেবতার অনুগ্রহে রামনাথ এর বুদ্ধি এবং প্রতিভার ক্রমবিকাশ শুরু হয়। প্রথমে নিজেদের গ্রামের টোলেই তিনি ব্যাকরণ, সাহিত্য এবং নবন্যায়ের  কিছু অংশ অধ্যয়ন শুরু করেন। কিন্তু তাতে তাঁর মন এবং জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হলনা। একদিন তিনি একা নিঃসম্বল অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন তখনকার বাংলার ন্যায় শাস্ত্র  অধ্যয়ন এর মূল কেন্দ্র নবদ্বীপ ধামে। সেখানে এসে তিনি প্রসিদ্ধ ন্যায়শাস্ত্র  বিশারদ  শ্রীরাম শিরোমণি মহাশয়ের কাছে নবন্যায় শাস্ত্র  অধ্যয়নের ইচ্ছা এবং  আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ছাত্রের আগ্রহে নৈয়াইক শ্রীরাম শিরোমনি রাজি না হয়ে পারলেন না।
পড়াতে গিয়ে রামনাথ এর প্রতিভা  দেখে অধ্যাপক শ্রীরাম শিরোমনি মুগ্ধ হয়ে যান। ক্রমে নবদ্বীপের পণ্ডিত মহলে রামনাথ এর  প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়ে।  এমনকি তখনকার পণ্ডিত সমাজের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ট হরমোহণ  তর্কচূড়ামনির মতো বিদগ্ধ পন্ডিত নিজে উপযাচক হয়ে রামমনাথের অধ্যয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন সময়েই তাঁর প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের খ্যতি বাংলার সীমানা অতিক্রম করে ভারতের অন্যত্র প্রসারিত হয়েছিল।
   একটানা দশ বছর অধ্যয়নের পর তিনি অতীব গৌরব সূচক ‘ সিদ্ধান্ত পঞ্চানন ‘ উপাধিতে ভূষিত হন। এরপর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর নিজের জন্মভূমি ফরিদপুর জেলার পশ্চিমপাড় গ্রামে। সেখানে তিনি অধ্যাপনায় প্রবৃত্ত হলেন। নিজের খরচ চলে না, সেই অবস্থাতেই দশ – বার জন ছাত্রের লেখা পড়ার দ্বায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী সংসারের সমস্যার কথা বলে বলে ক্লান্ত কিন্তু কোনো দিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি সমস্ত  সাংসারিক চিন্তা ঈশ্বরের শ্রীচরণে নিবেদন করে নিশ্চিন্তে অধ্যাপনায় এবং অধ্যয়নে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। তাঁর ছাত্র তথা শিষ্যরা মাঝে মাঝে গুরু গৃহে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করে তাঁর পরিবারের সমস্যা কিছুটা লাঘব করতেন। আসলে তাঁর শিশুর মতো সারল্য, পর্বতের মতো বিশাল পাণ্ডিত্য, সাগরের মতো গাম্ভীর্য দেখে যে কেউ একাধারে মুগ্ধ ও বিস্মিত না হয়ে পারতেন না। ন্যায়রত্ন কেশরী জয়নারায়ন তর্করত্ন, নীলকান্ত তর্কবাগীশ, মাধব চন্দ্র তর্কসিদ্ধান্ত , শশী কুমার শিবরত্ন প্রমুখ সব পণ্ডিতেরা ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ।

একবার নবদ্বীপের বিখ্যাত পাকা টোলের প্রধান অধ্যাপক এর পদ শূন্য হলে তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল পদ টি গ্রহণের। সে সময়ের সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ একথা শুনে তাঁকে নিয়ে শিক্ষা অধিকর্তা ক্রাফট সাহেবের কাছে গেলেন। সব কিছু শুনে মি ক্রাফট খুবই উৎসাহী হলেন। পন্ডিত প্রবর রামনাথ সিদ্ধান্ত পঞ্চাননকে নবদ্বীপের বিখ্যাত পাকা টোলের প্রধান অধ্যাপক নিয়োগ করতে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবার পর পন্ডিতপ্রবোর রামনাথ যখন শুনলেন ওই পদে যোগদান করলে তাঁকে বেতন নিতেই হবে, তিনি তৎক্ষণাৎ সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করে গৃহে ফিরে এলেন। কারণ বিদ্যা তিনি কোনও মতেই বিক্রি করবেন না। ১৮৯৭ সালের ১লা জানুয়ারি সরকার এই নির্লোভ পন্ডিত প্রবর্ কে ‘ মহামহোপাধ্যায় ” উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিল।

তাঁর নিজের জন্মস্থান কোটালি প|ড়া  আর্য শিক্ষা সমিতির তিনি ছিলেন সভাপতি। নির্লোভ এই পন্ডিত কোনও গ্রন্থ রচনা করে যাননি। ঈশ্বর আরাধনা, শাস্ত্র আলোচনা এবং প্রকৃত ছাত্র তৈরি করার মাধ্যমেই তিনি সারা জীবন ভারত – বিদ্যা চর্চার মহৎ কর্ম করে গেছেন।
১৯০৫ সালের মাঘী সপ্তমী তিথিতে বাংলার এই অসাধারণ নৈয়|য়িক পন্ডিত মহামহোপাধ্যায়
রামনাথ  সিদ্ধান্ত পঞ্চানন পরলোক গমন করেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *