পাতাউর জামান

পায়ের বুড়ো আঙুলের নোখটা গেলবার ধানসিদ্ধ করার সময় তুসের আগুনে সেই যে পুড়ে গেছিল, তার কালো দাগ এখনও যায়নি। শাশুড়ি বলেছিল, অলক্ষ্মী না-হয়ে যায় না। লক্ষ্মী আনতে গিয়ে কেউকি পা পোড়ায়! তার উপর মাথার গাছির মতো পা ভর্তি চুল। যেন পুরুষ মানুষের কব্জি। হেতনেতে বসে সাদা টমচিনির থালায় পান্তাভাতে শুকনো লঙ্কা মেখে এক খাবলা ভাত মুখের মধ্যে চালান করে দিতে দিতে কথাগুলো যতটা জোরে বললে মাসকুরা বিবির কানে যায়, ঠিক ততটাই জোরে জোরে কথাগুলো বলেছিল। 

মাসকুরা বিবি তখন ধান থেকে পল আলাদা করছিল। উঠোনের মধ্যে স্ট্যান্ড ফ্যান চালিয়ে দিয়ে কুলো থেকে  সরু করে ঝাড়া ধানগুলো ফেলছিল। পল হাল্কা, বাতাসে এমনিতে উড়ে যাবে, ধান ভারি, সোজা মাটিতে পাতা চ্যাটাতে পড়বে। ঠিক সেই সময়, সেই জন আবার মাসকুরা বিবির কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, এত বেলা হয়ে গেছে তাও তুই পল ঝাড়ছিস। ফাঁকিবাজ একটা। সারা সকালের কাজ এখনো শেষ করতে পারলি নে। আর দ্যাখ তোর শাশুড়ি কাজ শেষ করে হাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করে পান্তা গিলছে। মরতে পারিস না! 

শুধু তার খোটা শুনে যে মরতে ইচ্ছে হত, এমনটাও নয়। সেবার শাশুড়ির খোটা শুনেও মরতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু মরতে পারেনি। পেটে তখন তিন মাসের বাচ্চা। কী করে মরবে! অথচ মাসকুরা বিবির কানে সে সারাক্ষণ ফিস ফিস করে কথা বলত। সে কথার কোনো বাচ-বিচার নেই। যখন যা কিছু হয়, সব কিছুতে সে মাসকুরা বিবির দোষ দেখে। ছপিলা, মাসকুরা বিবির শাশুড়ি ফারুককে বলেছিল, কী এমন বউ বে করে নিয়ে এলি, সারাক্ষণ পাগোলের মতো বিড়বিড় করে আপন খেয়ালে নিজের সাথে কথা বলে। 

মাসকুরা বিবি ও সব কথায় কান দেয় না।  

এই তো সেদিন, ঈদের আগের দিন হবে হয়তো, মাসকুরা বিবির আবার নিজের নাম ভুলে গেছিল। মনে থাকবে কী করে! সারাক্ষণ কাজ আর কাজ, কী করে মনে থাকবে! সে কানের কাছে ফিসফিস করে মাসকুরা বিবিকে বলেছিল, আচ্ছা তোর নাম কী?

মাসকুরা বিবি পল আজড়াতে আজড়াতে বলেছিল, ধানের শিশ।

সে বলেছিল, ও বুঝেছি! তোর হাতে পাকা ধানের গাছ আছে, উঠনে মাড়াই করা ধানের পাহাড় আছে বলে তুই এমন নাম বলছিস!

মাসকুরা বিবি তর্কে যায়নি। বলেছিল, হবে হয় তো।

সে বলেছিল, এ আবার কেমন কথা – হবে হয় তো! তোর নাম জানিস না! তুই কেমন মেয়ে?

মাসকুরা বিবি তখন কোমর থেকে আঁচলের খুট খুলে মুখ মুছিল। মুছতে মুছতে বলেছিল,‎ আঁচল, হ্যাঁ আচল আমার নাম।  

ছপিলা দূর থেকে মাসকুরা বিবিকে দেখছিল, যেভাবে মাছরাঙা পুকুর পাড়ের ডালে বসে জলের দিকে নজর রাখে। নজর রেখে হেঁকে বলেছিল, হেই বউ, কার সাথে কথা বল? পাগল বউ একটা আমার ছেলের কপালে জুটেছে। 

মাসকুরা বিবির তখন মনে পড়েছিল, পাগোল, হ্যাঁ, পাগোল তার নাম। মাসকুরা বিবি তার আশেপাশে তাকে খুঁজছিল। যদিও আজ অব্দি মাসকুরা বিবির কানে যে ফিসফিস করে কথা বলে, তাকে কখনো, কোনো দিন দেখেনি। 

মাসকুরা খাতুন এমনি এমনি এসে জোটেনি। বকজুড়ির আনোয়ার মোল্লার মেয়ে। ক্লাস ইলেভেনে পড়তে পড়তে বিয়ে হয়েছিল। মাসকুরা খাতুনের আব্বা বিয়ে দিতে চায়নি। বলেছিল, মেয়ে সবে ক্লাস ইলেভেনে, উচ্চ মাধ্যমিকটা পড়ুক, কন্যাশ্রীর পুরো টাকাটা পাক, তারপর না-হয় হবেখন। 

ছপিলার স্বামী বেঁচে নেই। করোনাকালে মারা গেছে। ছপিলা নিজে এসে সম্বন্ধ লাগিয়েছিল। বলেছিল, তাতে কী হয়েছে ভাইজান। বিয়ের পর তোমার মেয়ে আমার মেয়ে হয়ে যাবে। পড়ুক না, ও যতটা চায়। কিন্তু বিয়েটা এখনই সেরে ফেলি ভাইজান। দিনকাল ভালো না। তাছাড়া আমাদের কোনো দাবিদাওয়া নেই। 

আনোয়ার মোল্লা আমতা আমতা করছিল বটে। কিন্তু মনের মধ্যে চলছিল অনেক হিসেব। যদি পাকা দেখা, আশির্বাদ আত্মীয়-স্বজন নেমতন্ন করে বে দিতে হয়, সে অনেক খরচ। তার থেকে বরং এই ভালো – ধরা বিয়ে। তা ছাড়া ছেলে ভালো। চালু কাজ করে, যখন যেটা পায়। বসে থাকে না। মাধ্যমিক পাশ করতে পারেনি তো কী আছে! বাপের পাঁচ বিঘে ধানী জমি আছে, দুটো পুকুর আছে। এক তলা বাড়িতে তিন কামরার ছাদ দেওয়া ঘর আছে।  ছেলে তো একা, ওতে আর কে ভাগ বসাতে আসবে। মেয়ে আমার দিব্যি রানী হয়ে থাকবে। 

সে রাতে ধরা বিয়ে হয়েছিল। ছেলেকে আনোয়ার মোল্যার বাড়িতে বসিয়ে রেখে ছপিলা বাজার ঘাট করে, মেয়ের বেনারসি কিনে কাজির খাতায় মাসকুরা খাতুন, এই নামে সে সই করেছিল। কাজি বলেছিল, মেয়ে তোমার বে   হয়ে গেছে। এখন থেকে তুমি মাসকুরা বিবি। খাতুন কাটো, লেখ বিবি। 

মাসকুরা না করেনি। ঘাড় নাড়িয়ে, কানে কাছে হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে কিছু একটা তাড়িয়ে, খাতুন কেটে বিবি লিখেছিল। 

মাসকুরার আব্বা আনোয়ার কিন্তু মাসকুরাকে কিছুই বলেনি। এই যেমন ছেলে পছন্দ কিনা? বা এখন বিয়ে করবে কি না? ইত্যাদি নানান যে সব স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারে, সে সব কিছুই করেনি। শুধু সই করার সময় সে বলেছিল, তুই একটা আইবুড়ো মেয়ে, তোর কোনো মতামত নিল না, আর তুই কিছুই বললি না! তুই মরতে পারিস না! মাসকুরা সে কারণে খাতুন কেটে বিবি লেখার সময় কানের কাছে তাকে তাড়াবার জন্য হাত নাড়িয়ে বলেছিল, পালা পালা। এটা সে ছাড়া আর কেউ শুনতে পাইনি, শুনতে পাওয়ার কথাও নয়।  

  মাসকুরা বিবির বাসর রাতটা ছিল বড়ো বেয়াদবের রাত। সে যেমন কথা শোনেনি, ফারুক, তার স্বামীও তেমনি কথা শোনেনি। মাসকুরা কত কিছু ভেবে রেখেছিল। স্বামীর সাথে সারা রাত গল্প করবে, দুচারটে সেলফি তুলবে, স্বামীকে চিনবে, স্বামী ওকে জানবে। কত সুখ-দুঃখের কথা হবে, তা না, ঘরে ঢুকে দুচারটে কথাবার্তা বলে, একটু হাতটাত ধরে, বাসর রাতের মুখ দেখা আংটি গিফট দিয়েও শুরু করে দিয়েছিল।

সে বলেছিল, দেখলি তো মাসকুরা সবাই এক হয়। বে-এর রাতে ছেলেরা বাঘ, আর মেয়েরা হরিণ। পারলে হাড়-মজ্জা অব্দি চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। মাসকুরার মাথা ঝিমঝিম করছিল। ফারুককে বলেছিল, আমাকে একটু নার্ভের বড়ির পাতাটা দাও। আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি। ডাক্তার বলেছিল, দিনে অন্তত একবার করে খেতে। 

ফারুক তখন ঘোরে ছিল, বেশি কিছু আর প্রশ্ন করেনি। শুধু বলেছিল, তোমার মাথার কোনো প্রবলেম আছে? 

পরের দিন ফিরতে ফিরতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আনোয়ার মোল্যা তো আর এমনি এমনি মেয়েকে বিদায় দিতে পারে না। পাড়ার লোকে কী বলবে! একটা খাট, সে কাঠের না-হোক স্টিলের অন্তত দেওয়া চাইই চাই। সাথে আলমারি, বসার চেয়ার, কাঁসার ডাবর, মিষ্টি, ছেলের হাতের আংটি – কমপক্ষে এসব না-হলে কী মেয়েকে বিদায় করা যায়! 

দুপুরবেলা ফারুকের ঘরে বসে যখন দুজনে কথাবার্তা বলছিল, তখন ফারুক বলেছিল, ফুলবাগানের মেলায় তোমাকে প্রথম দেখেই প্রেমে পড়ে গেছিলুম। আই ল্যাব ইউ মেরি জান – বলে চকাস করে একটা চুমু খেয়েছিল। মাসকুরার হাতের মেহেন্দির লালও তার মুখের কাছে ফিকে হয়ে গেছিল। মাসকুরা মনে মনে হেসেছিল। ঘোর কাটিয়ে ক্রমশ সব ব্যাপারগুলো বোঝবার চেষ্টা করছিল।

ঠিক সে সময় শাশুড়ি ছপিলা এসে মুখ নাড়িয়ে মিষ্টি কথায় ছুরি মিশিয়ে বলেছিল, বাড়ি ভর্তি লোক। আর এই দুপুর বেলায় স্বামীর সুঙ্গে বসে থাকতি সরম পায় না মেয়ে। কী জানি আজকালের মেয়ে। আমাদের সময় এত ধ্যানাচিপনা ছিল না বাপু। 

ছপিলা যখন মসমস করে হাঁটছিল, মাসকুরার মাথা তখন ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছিল। আনোয়ার মোল্যা বলতে ভুলে গেছিল, নাকি ইচ্ছে করে বলেনি যে মাসকুরা মাথায় চাপ নিতে পারে না। ও মাথার ওষুধ খায়। সেদিন দুপুর বেলায়, ছপিলা চলে যেতেই ফারুকের কোলে ঢলে পড়েছিল। জমজমের পানি, সুরার ফু – কিছুতেই কাজ হয়নি। সবাই ভেবেছিল ভূতে পেয়েছে। সকালে ফেরার সময় মাসকুরা হাতে যাঁতি নেয়নি। সুতারং ভূতে পাবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক। খবরটা চাউর হতে খুব একটা দেরি হয়নি। 

ভূত-টুতের ব্যাপারটা হপ্তা যেতে না-যেতেই মিটে গেছিল। বিয়ের পাঁচদিন পর যখন আনোয়ারের জমি বন্ধক দেওয়া টাকায় কেনা বাইকের পিছনে ফারুকে ধরে উঠছিল, শ্বশুর বাড়ি চলে আসলে বলে, সেই সময় আনোয়ার ফারুককে বলেছিল, বাবা মাসকুরার মাথার ওষুধটা বন্ধ কোরো না। ওটা খেয়ে যেতে বলেছে ডাক্তার। ফারুক মাথা নাড়িয়ে বাড়িতে এসে মাকে বলেছিল। মাসকুরাকে ডাক্তার মাথার ওষুধ খেতে বলেছে। ছপিলা বলেছিল, মানে নতুন বউএর মাথার ব্যামো আছে? ফারুক বলেছিল, ছেড়ে দাও ওসব কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে। ফারুক তখন নতুন বাইকে স্টার্ট দিচ্ছিল। চায়ের দোকানে বন্ধুদের না-দেখালে পেটের ভাত হজম হবে ওর!

তিন বছর হয়ে গেছে। একটা বছর খানেকের ছেলে আছে। এখন আর মাসকুরা আগের মতো ফিট হয়ে যায় না যখন তখন। কিন্তু আগে যেটা মাঝে মাঝে হত, এখন সেটা সারাক্ষণ হয়। মাথার মধ্যে একটা ঝিঁঝিঁ শব্দ সারাক্ষণ বাজতেই থাকে। যখন কাজের মধ্যে থাকে তখন শব্দটা মাথার মধ্যে থাকে। কিন্তু না-কাজ থাকলে সে এসে সারাক্ষণ মাসকুরার সাথে কথা বলে। প্রথম প্রথম সে ভুল ভাবত। ভাবত, কেই বুঝি তার সাথে ঠাট্টা করছে। কিন্তু এই তিন বছরে ফারুকও তার সাথে ঠাট্টা করা ছেড়ে দিয়েছে। লকডাউনে কোনো কাজ ছিল না। যা কিছু জমানোছিলো সব বসে বসে খেয়ে ফেলেছে। বছর খানেক হল কাজ পাচ্ছে, কিন্তু আগেকার মত রেগুলার নয়। রেগুলার যে কাজ রাতের বেলা নিউটাউনে ইট খালাস করা। সারারাত কাজ করে, ঠিকাদারকে দিয়ে-থুয়ে চারশো মতো থাকে। হপ্তাতে দুশো টাকার ওষুধের পাতা লাগে। আগে আগে কিনত পিল কেনার সাথে। এখন আর পিল কেনা হয় না, ফলে ওষুধের দোকানে গিয়ে মাথার ওষুধ কিনে ওঠার সময় হয়ে ওঠে না ফারুকের। 

মানুষটা সারা রাত জেগে কাজ করে, দিনে একটু ঘুমাক। এখন কী করে বলবে ওষুধ কেনার কথা। সে হবেখন আজ কাল পরশু। সে বলেছিল, তাই বলে তুমি ওষুধ কেনার কথা বলবে না!   

না, মাসকুরার আর বলা হয়ে ওঠেনি। ছেলে খালাসের সময় হাসপাতালের ডাক্তার বলেছিল, নার্ভের ওষুধটা কনটিনিউ করতে। সে আর কত দিন, মাস খানেক চলেছিল, তারপর যে কে সেই। 

সকালে উঠে মাসকুরা বিবির কাজ আগের দিনের রাতের এঁটো থালা-বাসন মাজা। নতুন বউ আসবে বলে ফারুক উঠোনে আমগাছের পাশে টিপকল বসিয়েছিল খরচ করে। নতুন বউ এসেগেলেও আর কলের গোড়াটা শানবাঁধানো হয়ে ওঠেনি। চটের বস্তা দিয়ে ঘিরে দিয়েছিল তখন, নতুন বউ গা ধোবে। কিন্তু শীত বর্ষা আর রোদ – এর তেজ সহ্য করে কত দিন পাটের বস্তা টিকে থাকবে! মাসকুরার কথা যদি হত, সে ব্যাপারটা আলাদা। 

সকালে কলতলায় বসে নুড়োটাকে ছাইয়ের মধ্যে ডুবিয়ে, একটু সবানের গুড়োর জলে ভিজিয়ে ঘষে ঘষে স্টিলের কড়াটা চকচকে করছিল। একটু চেপে চেপে ঘষতে হবে। একটু তালে তালে ঘষতে হবে। তাহলে একটা মিউজিকের মতো তাল উঠবে। কড়াই ঘষে যে শব্দ তৈরি হয়, আর মাসকুরা যা যা ভাবে, দুটো যেন তালে তাল মিলে যায়। সে কানের কাছে সেছে ফিস ফিস করে বলে, কী করছিস লা টুনটুনি?

মাসকুরার কড়াইয়ের সাথে শব্দ করে বলেছিল, দেখতে পারছ না, কড়াই মাজছি। এখনো হাঁড়ি থালা গ্লাস পিতলের ঘটি মাজা বাকি।

সে বলেছিল, থাক না বাকি। চল একটু আমরা সুখ দুঃখের গল্প করি। 

মাসকুরা বলেছিল, বাপ বে দিয়ে দিয়েছে, স্বামী রাতে রাতে কাজ করে ঘরে ফেরে। শাশুড়ি ছেলে আগলে বসে থাকে, আমি গোটা গুষ্টির কাজ করি। আমি আর কী সুখ দুঃখের কথা বলি!

সে বলেছিল, বাহ রে, তাই বলে তুই রোজ সকালে সকালে হাড়ি মাজতে বসবি?

মাসকুরা বলেছিল, তা না করে কী বিবি সেজে কলেজে যাব?

সে বলেছিল, যাবি। আলবাত যাবি। বের সময় তেমনটাই কথা হয়েছিল।

মাসকুরা বলেছিল, তাহলে হল। বে যে তিন বছর পেরিয়ে গেছে। তিন বছরের আগের কথা কী আর কথা থাকে!

সে বলেছিল, দূর হতভাগি তুই বলবি নে তোর কথা কাউকে, তাহলে মর হতভাগী!

মাসকুরা খরখর শব্দে হাড়ির তলা মাজছিল। হেতনে থেকে ছপিলা হাঁক দেয়, দ্যাখ আবার ফারুকের পাগোল বউটা খেপেছে। বিড়বিড় করে ভুল বকছে। বাপকে বল গিয়ে আমরা রোজ রোজ মাথার বড়ি কিনতে পারব না। যেন কিনে পাঠায়। শুধু খাচ্ছে আর গা-গতরে বাড়ছে। ওদিকে আমার ছেলেটা খেটে শুকিয়ে কাঠ হচ্ছে। 

ছপিলার নাতি কেঁদে ওঠলে হাঁক দেয়, রাখ তোমার কলতলার কাজ। ‎এট্টুকুনি ছেলেটা সেই সকাল থেকে না-খেয়ে আছে, একটু মাই খাওয়াতে যে কী হয় বুঝি না বাপু! 

মাসকুরা ওঠে কলতলায় থালা বাসন রেখে হাত ধোয়। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে যায়। সে তখনও মাসকুরার কানের কাছে বলেছিল, যাসনে যাসনে। কাঁদুক, যার নাতি সে বুঝবে।  মাসকুরা কানের কাছে মাছি তাড়াবার মতো করে হাত নাড়িয়ে এগিয়ে যায়। 

অন্যদিন হলে মাসকুরা বিবি স্বামী শাশুড়ি খেলে, তারপর সে খেতে বসত। মাসকুরার আর কী খাওয়া লাগে। সবাই খেয়ে দেয়ে যা পড়ে থাকে, সেটা ও খায়। কোনো দিন হাঁড়ির তলার জলা ভাত, কোনো দিন নুন দিয়ে যেটুকু তরকারি পড়ে থাকে, সেই টুকুনি। কোনো দিন মাছ হলে, ল্যাজা আর তাও যদি দিতে দিতে শেষ হয়ে গেলে স্বামীর ফেলে দেওয়া মাছের কাঁটা চুষে মাছের স্বাদটা মনে রাখত আরকি। সমস্যা হল যেদিন ভালো তরকারি রান্না হত। ফারুক বলত, আর একটু দে। স্বামী খেতে চেয়েছে, আহা সারাদিন শরীরে যে খাটুনি যায়, খাক না পেট ভরে। পেট ভরলে তবেই মন ভরবে। ছপিলাও ছেলের সাথে খেতে বসে কম যায় কিসে, বউ আছে কিছু? আর একটু দে না। একবার দিল ডালের বাটি। আরেকবার দিল ডাটা চচ্চড়ি, আরেক বার দিল তেলাপুয়ার ঝাল। তাও বলে, বউ আর একটু আছে নাকি, দে। মাসকুরা আর কী করবে! 

সে কানের কাছে এসে বলত, মর, মর না আবাগীর বুড়ি। 

মাসকুরা ফারুককে আর একবাটি ডাল এগিয়ে দিয়ে বলত, এমন কেন বলিস। স্বামী শাশুড়ি না আমার। 

শাশুড়ি বলত, আবার বিড় বিড় করতে লেগেছিস। ফারুকের দিকে চেয়ে, ও ফারুক এ তোর কেমন বউ! 

ফারুক ভাতের থালা ফেলে, ডালের বাটি উল্টে পুরোনো বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলত, রইল ঝোলা চলল ভোলা। আজ রাতে আমি ফিরিব না। থাক তুই আর তোর বউ। 

সেদিনও ফারুক ফেরেনি। মাস খানেক হয়ে গেল ওষুধও খাওয়া হয়নি। সারাদিন মাথা ঝিঁঝিঁ করত। সে এসে বারে বারে তাড়া দিত। প্রশ্ন করত মাসকুরা বিবির সারা দিনের কাজগুলোকে। ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে সেদিন মাসকুরা বিবি সেদিন এমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল যে ছেলের কান্নাতেও উঠতে পারেনি। শাশুড়ি ঘরের দরজা খুলে গালি গালাজ দিয়ে কাজ হয়নি যখন, তখন গায়ে জল ঢেলে দিইয়েছিল। তবেই মাসকুরার ঘুম ভেঙেছিল। মাসকুরা ঘুম থেকে উঠে শুধু শাশুড়ির মুক নাড়া দেখতে পাচ্ছিল। কানে ঝিঁঝিঁ শব্দ। আঙুল দিয়ে বার কয়েক কান ঝাকুনি দিলেও কোনো কাজ হচ্ছিল না। শাশুড়ি বকেই যাচ্ছিল। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মাসকুরার ছেলেকে নিজের সাথে নিয়ে গিয়েছিল। মাসকুরা দেখতে পাচ্ছে ছেলের চোখে জল, তবুও ছেলের কান্না শুনতে পাচ্ছে না। থ মেরে বসে আছে। টিউবের আলোটা কেমন তরঙ্গ কেটে আঁধারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে আঁধারকে ফালা ফালা করে কেটে আলো বিজয়ী হচ্ছে। সে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও, হাতে চিমটি কেটে ব্যাথা পেলেও কোনো শব্দ সে শুনতে পারছে না। এক মুহূর্তের জন্য সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থেকেছিল। এই তো শুনতে পারছে ওর বুকের হৃদপিণ্ডের ধড়াস ধড়াস শব্দ। এই তো শুনতে পাচ্ছে ছেলের চিৎকার করে কান্নার শব্দ। এই তো শুনতে পাছে শাশুড়ির চিৎকার, কোথা থেকে এ পাগোল বউ তু জোটালি ফারুক। ছেলে কান্নাকাটি করে মারা যাচ্ছে আর ও পাগলীর হুঁশ নেই। 

না, আর দম চেপে রাখা যাচ্ছিল না বলে মাসকুরা বিবি দম ছেড়ে দেয়। না, আর কোনো শব্দ তো সে শুনতে পাচ্ছে না। আবার দম আটকে রাখে। এই তো শুনতে পারছে, শাশুড়ির বলছে, আবাগীর বেটি মরে না, মরলে আমার হাড় জুড়োয়। 

মাসকুরা আবার দম ছেড়ে দেয়। এবার সে এসে মাসকুরার কানের কাছে বলেছিল, এতদিন আমি বলতাম, আজ তোর শাশুড়িও বলছে- মর। মরবি না তুই!

মাসকুরা কানের কাছে মাছি তাড়াবার মতো করে হাত নাড়ায়। সে মরতে যাবে কেন? মরবে না। দম আটকে রাখলে যদি সবার কথা শুনতে পায়, তাহলে কিছু একটা উপায় সে বের করবেই করবে! হাত দিয়ে নিঃশ্বাস আর কতক্ষণ আটকে রাখবে। শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে রাখলেও হাত টনটন করছিল।  

উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখতে পাচ্ছিল শুধু, কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিল না। শাড়িটা যে ফ্যানের উপরে গলাবে, হাত পাচ্ছিল না। বরং বেরিয়ে পড়ে কলতলার দিকে। উঠোনে বাল্বের আলোও আছে বেশ। কলতলায় দাঁড়িয়ে আমগাছের ডালে অনায়াসে শাড়িটা পেঁচিয়ে গেছিল। গলার মধ্যে জড়িয়ে নিঃশ্বাস যত চেপে যাচ্ছিল, ঠিক ততই স্পষ্ট শাশুড়ির গলা আর ছেলের কান্না শুনতে পারছিল। শাশুড়ি কাঁদছিল আর বলছিল, কোথাকার কোন পাগলী এসে জুটেছে, মরছেও না। 

না, মাসকুরা মরবে না, নিঃশ্বাসটা আটকে রাখছিল শুধু, যাতে ও সবার কথা শুনতে পারে।    

4 thoughts on “সমাপ্তি

  1. আধুনিকতার মোড়কে মফস্বলের গল্প নাকি ফেমিনিজমের দুনিয়ায় একটি মেয়েমানুষের ‘পাগলামি’-র গল্প – কী বলব সঠিক ভাষা পাচ্ছিনা। তবে পাঠক হিসেবে ছোটগল্পের খিদে মিটল বেশ।কাহিনী, বর্ণনা – সবটুকু এক নিশ্বাসে পড়ে আর একটাই কথা বলার, ‘আপনার ছাত্রী হিসেবে আমি বড্ড proud feel করছি…’

  2. ঘটনাটা কোন বাস্তব অভিজ্ঞতার কি-না জানিনা তবে বাস্তবে এরকম অনেক ঘটনা ঘটে থাকে। খুব সুন্দর সহজ সরল গ্রামীণ জীবনের একটা ছবি পাওয়া গেল এই গল্পে। মাশকুরা বিবির চরিত্রটা খুবই দুঃখের ও কষ্টের। এরকম মাসকুরারা সমাজে অবহেলার শিকার হয়েই দিনের পর দিন কাটায় এবং একসময় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে নেয়। গল্পটি শিরোনামের সাথে যথাযথ হয়েছে।সর্বোপরি গল্পটি ভালো হয়েছে। শুভেচ্ছা রইল লেখকের প্রতি।

  3. কী নিখুঁত ডিটেলস! সে এবং মাছি তাড়ানো অন্য মাত্রা দিয়েছে।
    পড়ার পর ভোম মেরে ভাবছি আমিও।
    অভিনন্দন ❤

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *