তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
পন্ডিত রাজেন্দ্রলাল একদা লিখেছিলেন, “অধুনাতম বঙ্গীয় কবিবৃন্দের মধ্যে শ্রীযুক্ত রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সর্বশ্রেষ্ট বলিয়া প্রসিদ্ধ অছেন।” রঙ্গলাল এর জন্ম ১৮২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর মামার বাড়ি কালনার কাছে বাকুলিয়া গ্রামে। তিনি মামা বাড়িতেই প্রতিপালিত হন। তাঁর কলকাতার খিদিরপুরেও বাড়ি ছিল। গ্রামের স্কুলে পড়াশুনার পর রামকমল ভাগ্নে রঙ্গলাল কে চুঁচুড়ায় মহসীন কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন।
১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হিসাবে তাঁর সরকারি কর্মজীবনের শুরু। তারপর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নানা স্থানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৮৮২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এই হলো তাঁর পেশাগত জীবন। এই সময়ের মধ্যেই করে গেছেন তাঁর সাহিত্য ও কাব্য সাধনা।
বাঙলা সাহিত্যে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় এর কথা আলোচনা করতে গেলে গুপ্ত কবি অর্থাৎ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর কথা স্বাভাবিক ভাবেই এসে পরে। কারণ রঙ্গলাল ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র এর ভাব শিষ্য এবং তাঁর সম্পাদিত ‘ সংবাদ প্রভাকর ‘ পত্রিকাতেই রঙ্গলাল এর লেখালেখির সূত্রপাত। তথাপি কিন্তু রঙ্গলাল তেমন ভাবে ঈশ্বরচন্দ্র এর প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন না।রঙ্গলাল পাশ্চাত্য কাব্যের আদর্শে বাঙলা কাব্য লক্ষ্মীকে নতুনভাবে শ্রীমন্ডিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে জাতীয়তাবাদী ওজস্বী কবিতা পরবর্তী সময়ে হেমচন্দ্র এবং নবীনচন্দ্রকে সমস্ত দেশে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল তার সূত্রপাত কিন্তু আসলে রঙ্গলাল এর হাত ধরেই। তিনি বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য থেকে আসল রস গ্রহণ করে দেশের মাটিতে দেশীয় রূপেই তাকে প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর দেশপ্রেমের কবিতার অনবদ্য কয়েকটি লাইন:
“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দ্বাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়?
দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গসুখ তায় হে
স্বর্গসুখ তায়।”
‘সংবাদ প্রভাকর ‘ পত্রিকার জন্য লিখতে গিয়ে তিনি নিজেও পত্রিকা সম্পাদনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা ‘ সংবাদ রস সাগর ‘। তারপর তিনি সম্পাদনা করেন ‘ এডুকেশন গেজেট ‘ ও ‘ সাপ্তাহিক বার্তাবহ ‘। অর্থাৎ পত্রিকা সম্পাদনেও
তিনি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছিলেন।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ ” ঋতু সংহার” প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে। ১৮৫২ তে প্রকাশিত হয় ‘ বাঙলা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ ‘ , এরপর হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি অবলম্বনে ‘ ডেক ও মুশিকের যুদ্ধ ‘ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৮ সালে। ঐ বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল রাজস্থানের ইতিহাস অবলম্বনে রচিত বিখ্যাত ‘ পদ্মিনী’ উপাখ্যান। ১৮৬০ সালে তিনি শরীর সম্পর্কিত একটি মূল্যবান গ্রন্থ ‘ শরীর সাধণী বিদ্যার গুণকীর্তন ‘ প্রণয়ন করেছিলেন। এরপর ১৮৬২ সালে রাজস্থানের সতী দের নিয়ে গবেষণাধর্মী বই ‘কর্মদেবী ‘ রচনা করেন। এই সব বই গুলি গুরুত্বের দিক দিয়ে অতীব মূল্যবান। তিনি কবি বলে শুধু কাব্য চর্চার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি দেশের এবং সর্বোপরি তার মানুষদের নিয়ে তিনি ভাবতেন। কোনো গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে সাহিত্যিক আঙ্গিকে চমৎকার ভাবে সেই বিষয়কে সকলের সন্মুখে তুলে ধরেছিলেন। তারা বুঝতে পারলেন, জানতে পারলেন, উপলব্ধি করতে পারলেন।
রঙ্গলাল এ সবের পাশাপাশি হাত দিয়েছিলেন অনুবাদ কর্মে। রেভারেন্ড লঙ সাহেবের ‘সিলেক্টেড প্রভার্বস ‘ এর অনুবাদ করলেন ‘প্রবাদ মালা ‘(১৮৬৯) নাম দিয়ে। কালিদাসের ‘ কুমার সম্ভব ‘ (১৮৭২) এর তিনি স্বার্থক অনুবাদ করে ছিলেন। উৎকল বীর গাঁথা নিয়ে রঙ্গলাল এর ‘ কাঞ্চি কাবেরী ‘ (১৮৭৯) ছিল আর একটি মূল্যবান গ্রন্থ।
ইংরেজী রচনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত ছিলো, ‘ দ্য নেটিভ অ্যারিস্টকেসি অফ বেঙ্গল ‘, ‘অ্যান ইন্ডিয়ান জ্যাক শেফার্ড ‘ , ‘কপার প্লেট গ্রান্ট ফ্রম কপিলেশভরা ইন উড়িষ্যা ‘। এত বড় একজন প্রতিভা মাত্র ষাট বছর বয়সে ১৮৮৭ সালে ইহ লোক ত্যাগ করেন।
তাঁর প্রয়াণের প্রায় ৩৬ বছর পর নৈহাটিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভাপতি অমৃতলাল বসু তাঁর অভিভাষনে রঙ্গলাল সম্পর্কে প্রশস্তি করে বলেছিলেন,” ঈশ্বরগুপ্তের মিউটিনি প্রভৃতি পদ্যে উদ্দীপনা থাকিলেও যিনি নব্য বঙ্গের হৃদয় ক্ষেত্রে উদ্দীপনার রসে সিঞ্চিত করিয়া দেশহিতৈষনার বীজ বপন করেন তাহার নাম রঙ্গলাল।… জাহাজ মেরামত করার ডকের জন্য খিদিরপুর প্রসিদ্ধ। কিন্তু এখানে একসময় বড় বড় কয়খানি জাহাজ প্রস্তুত হইয়াছিল । তাহাদের প্রধান তিন খানির নাম রঙ্গলাল, মধুসূদন এবং হেমচন্দ্র।’