শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(যা কিছু দেখি, তাই কি বাস্তব, নাকি যা কিছু অন্তরালে থাকে সেই আপাত অদেখা জীবনেই লুকিয়ে আছে বাস্তবের সারাৎসার। আমরা যদি কোন জাদুবলে সেই অদেখা জীবনকে জীবন্ত করে তুলতে পারি, গোটা সমাজজীবন আর তার চারপাশের চেনা জগৎটাই হয়ত একদিন পাল্টে যাবে, কিংবা অবাক হয়ে ভাবতে থাকবে, যাকে বাসভূমি বলে জেনে এসেছি এতকাল, আদপেই তা নয়, আসলে চোখে পট্টি পরানো সম্পূর্ণটাই এক ধাঁধার জগৎ। লেখক এই উপন্যাসে তার খোলস ছাড়িয়ে আসল জগৎ ও ঘুমন্ত মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন অন্য মোড়কে, যা আসলে স্বপ্নভঙ্গ নয়, কোন এক সুন্দর সকালে দেখে ফেলা আলো ঝলমলে জগতের বাহিরে ভিন্ন এক ভূমি, লড়াকু মানুষের জীবন, পশুদের চিৎকার, পাখিদের কলরব, পরম্পরায় মাখা  নোনা ঘামের কলেবর। উপন্যাসে বিচরণ করুন আর সেই কুশীলবদের নতুন করে আবিষ্কার করুন, চিনে নিন অচেনা, অপরাজিত, অপরিচিত নতুন এক বাস্তবতা, লেখকের সৃষ্ট জগতের  অপরনাম ‘অমরাবতী’ )

ষষ্ঠ অধ্যায়

লোকটার পশ্চাৎগামীতা দেখে বিলু ভাবে জীবন কখনও কখনও এইভাবেই হিসেব কষে বুঝে নিতে চায় আসলে তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন।  শুধুমুধু দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন, তিনি দৌড়তেও পারেন। সহজ কথা তো নয়। এমন ব্যত্যয় পৃথিবীতে ঘটে, ঘটে চলেছে, বাদ কী করে পড়ে মানুষটি। ধরে নেওয়া যাক মানুষটার নাম ল্যাংড়া। ল্যাংড়া না হয়ে অন্য নামও হতে পারত, তাই বলে তিনি কিন্তু নুলো নন, বরঞ্চ বেশি করে বকবক করতেই ওনার পছন্দ। বিলু লক্ষ্য করেনি এমনটা কেমন করে হতে পারে। পারে না তো! ধুত্তরি কা, তবে কী মানুষটার ভীমরতি হয়েছে লোক দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে। হোমো ভাবনার কোনো কারন নেই। হোমো শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ কেন যে মনে পড়ছে না, এমনটা হয়েই থাকে। নিজের বিস্মৃতির অপরাধ বোধটা এমন করে চেপে বসে, বুঝতেই পারেনা ও ল্যাংড়ারা  ধীর স্থির না অস্থির। এরকম কেন হয় বিলু ভাবতে ভাবতেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়, যদি একবার ধরে ফেলতে পারে তাহলে কী দশা হবে? ভয় পেয়েছে বিলু, ভয়টা অমূলক নয়, অবান্তরও নয়। একবার নয়, দুবার নয়, ঘন ঘন পাক খায়। হায় হায় রে, কত তো মানুষ, আবার অমানুষ, সিঁড়ি বেয়ে কেউ উপরে উঠছে, কেউ নামছে, তরতর করে নামছে। নিশ্চয়ই সেই ধাঁধারও উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে, কতটা সিঁড়ি টপকাল, আদৌ গুনে ফেলেছে, কি গুনে ফেলেনি, নাকি আন্দাজে ইস্টনাম করে জানার চেষ্টা করছে, সঠিক সংখ্যাটা কি। ল্যাংড়ার কাছে লোকগুলো এতটা নরম সরম নয়, না হলে এতটা জোরে কেমন করে ধমক মারছে বলুন তো! বিলুর এমন ইচ্ছেটা হয়নি ওকে জড়িয়ে ধরে। ল্যাংড়াকে ও বসিয়ে দেয়, না ও নিজেই বসে পড়ে নিজের মনে করে, কেউ কেউ আবার দখলদারীও ভাবলে অসম্ভব কিছু মনে হবে না, জায়গাটা বড্ড ছোট, আধাখ্যাঁচরা হয়ে আছে। কী কাণ্ড! কী কাণ্ড! ওরা কথা বলতে চাইছে না, তবুও ও কথা বলবে। কথা বলতে চাইলে তো হলো না, কথার ওজন চাই তো। বিলুর মত পাগলামি, ল্যাংড়ার গায়ে বিচুটি পাতার দাগ লাগে নি, ফুলেও ওঠেনি, তবু ও ভেবেই চলেছে ওর গা থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে, বা গন্ধ ছড়াতে পারে। ল্যাংড়া আলটপকাই চেনাজানাহীন লোকটার গাল টেনে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার গালে এত বসন্তের দাগ কেন? কবে থেকে হয়েছে বলে তো? দিনটাই বা কেমন ছিল? মুহূর্তটা কোন দাগা দিয়েছিল কিনা। বিলুর ইচ্ছে হল একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা যাক না, মুখটা চেনা চেনা মনে হয় কিনা। কোথায় যেতে পারে ল্যাংড়া, এমনিতেই মনে এসে গেল কিনা। সবকিছু কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। ডাক দিয়ে দেখা যাক। গলার স্বরে এমন একটা চিনচিনে ভাব ছিল ল্যাংড়ার কাছাকাছি পৌঁছনোর আগেই স্বরটায় এমন ভাঙচুর হলো, ল্যাংড়া ভাবল, বাতাসের দপদপানিতে এমন এক জায়গায় ধাক্বা খেয়েছে দু’একটা অক্ষর অদল বদল হয়ে গিয়ে ল্যাং-এর সংগে জুড়েছে ‘টা’, ‘ড়’-এর আগে জুড়েছে ‘জ’, জড় শব্দটা ওর সঙ্গে খাপ খায় কিনা। কিন্তু ‘উলঙ্গ’ শব্দটা জড় তার সঙ্গে ‘ভরত’ শব্দটা জুড়লে একটা অর্থবোধক শব্দ হয় বটে,কিন্তু পথচলতি মানুষের কাছে অস্বস্তির কারন তো ঘটে। বিলু আরও একটু এগোবে কিনা ভাবছে,   ল্যাংড়া কি মনে করে লম্বা টেবিলটার এক কোনে বসে পা দোলাতে শুরু করে। আঙুলগুলো মটমট করে উঠলে যে লোকটা খরিদ্দারকে কাপড়ের আঁচল চেনাচ্ছিল, বলতে ছাড়ল না তারস্বরে ‘দেবো নাকি এক ঘুসি।’ পাই পাই করে দে ছুট। বিলুর সাধ্য কি তাকে ছোঁয়। যে রাস্তাটাকে বিলুর আঁকাবাঁকা মনে হচ্ছিল, সোজা হয়ে গেল কেমন করে। এমনটাই বোধ হয়। বিলুর মগজটা টলমল করে উঠল। কত আবর্জনার স্তূপকে সরিয়ে ভেবেছিল মানুষের চলার পথটাকে সহজ করে দেবে, ভক ভক করে বেরুচ্ছে কতই  না দুর্গন্ধ,  নাকে মুখে সেঁধোচ্ছে। ল্যাংড়া যে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে কে তার খোঁজ রাখে। সে কি ঠিকই করে ফেলেছে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে রাতের আঁধারকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করবে। একটু এগিয়েই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার ছুরি কাঁচি কাটারি’র দাম কত?’ লোকটা পলকে পলকে তাকাল। কোঁচকানো ভুরু অদ্ভুত ভঙ্গিতে উপর নিচ নাচানাচি করে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার মতলবটা কী! কোথাও কোন ফাঁদ পেতেছ?’  ‘এত কামকাজ থাকতে ফাঁদ পাততে যাব কেন?’ ‘সিঁদ কাটার দিন ফুরিয়েছে কিনা। মনে কি কোন নতুন প্রশ্ন জাগতে নেই? ভয়ে ভয়ে চোখমুখে দাগ লেগেছে। কালসিটে পড়ে গেছে গায়ে পিঠে।’ ‘বকবে না একদম বলে দিচ্ছি। ছলচাতুরি করে কথা বের করবার রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছ কিনা। এই রাস্তা এত সহজ নয়। মরা বাঁচার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসতে পারে।’ ‘ আরে বাবু, পালাও দেখি, মাথা চেটো না। মেঘ দেখ না। কেমন উরু উরু করে মনের সুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটুখানি রাস্তা তো বের করে দাও। ঝর ঝর ঝর করে নামলে তার দাম কে দেবে, তুমি? 

উটকো ঝঞ্জাট! কেমন ডানা নাড়তে নাড়তে  কাছেই চলে আসে। ধার নেই, যেমনটা তুমি চাইছ। এত সহজে ডালগুলো খ্যাঁচ করে কাটা যাবে না। গাছগুলো ফালাফালা হবে না।’ ‘ তুমি কচু জান। এত বছর ধরে বসে বসে আমি এমনি এমনিতে লোম ছিঁড়ছি।’

 গাছে গাছে কত জাতের কত পাখি ডেকে চলে গেছে নিজের ঘরে। কে রাখে আর কেমন করেই রাখে, কোন দলিলে লেখা রয়েছে সেই হিসাব কিতাব ? ‘তুমি এসেছ কাটারি আর ছুরির ধার আছে কিনা পরীক্ষা করবে বলে!’ ‘ ধারই যদি না দেখব, পথটাকে পরখ করব কেমন করে, ছক কষে তো আর জীবন চলে না, যাচাই করে দেখব না!’ কাকটার তক্ষুনি বোধ হয় ডাক দেবার সময় হল। ডাকটা কর্কষ না মিষ্টি এই সিন্ধান্ত দেবার মালিক ল্যাংটা কিনা সেই কথাটা মনে মনে কেউ ভেবে রাখেনি। বিলু তো নয়ই, সে শুধু দেখেছিল কাকটার গলাটার ওঠানামাটা কত দ্রুত চলে। ওর শক্ত চঞ্চু দুটি ওঠানামা করছিল, তাই নিয়ে ও শহরের কল্লোলটাকে আন্দাজ করে। এতকালের অভ্যাসটা নিয়ে ওতো মুখ গুঁজে থাকতে পারে না, কাঁদতে তো পারেনি এমন নয়। গোপন কান্নায় গুমড়ে গুমড়ে মরেছে,  ল্যাংটাকে খুঁজে মরেছে কিনা নিজের মতো, হয়তো খুঁজেছে। ল্যাংটা এসেছিল নিজের মতো সেজেগুজে, চিনলে কি কেউ চিনল না এই দায় তো ওর নিজের নয়। কত নজরেই তো জব্বর নিজের জায়গাকে আগলে রেখেছে। ল্যাংটা কাটারিটা চেয়েছিল বটে, উদ্দেশ্যটা তেমন করে ব্যাখ্যা করেনি, না অন্য পদক্ষেপগুলো নিয়ে উত্তর জানতে চাইলে কোন মানুষটা এসে ধরা দেবে, জব্বরের তাতে কী এল আর গেল। কত মানুষই তো দলে দলে আসে আর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ‘না বাপ এমন করে কাঁদতে নেই।’ চোখের জল মুছতে মুছতে চলে যায়। ল্যাংটাকে কতকটা চেনে, আর কতকটা চেনে না। দশ হাত দূরে যে ভাজাভুজির কড়াইটা ছিল, ছ্যাঁতছুঁত আওয়াজটা যে ঢঙে উঠে আসা দরকার ছিল, সেইভাবে হয়নি। হায় হায়রে কস্মিনকালেও যদি ওই যে ওপার থেকে সুরটা ভাসতে ভাসতে আসছে, মিশিয়ে দিতে তো পারতো এপারের রঙ ঢঙের সঙ্গে, কত তো রঙ্গ হতো, নেচেকুঁদে এমন সব গল্পজুড়ে দিত তার কোন মাথামুণ্ডু নেই। ল্যাংটা তো চলে গেল, জব্বর আবার নিজের মতো করে সব ‘গুইচ্ছে গাইচ্ছে’ নিল, ডান দিকেরটা বাঁয়ে নিল। ‘ আরে লোকটা পাগল নাকি, বকবক তো করতেই লাগলো, চেহারাটা বেঁটে, লম্বাচওড়া কথা, জো বাইডেন সাহেবের সঙ্গে উলঙ্গদের আকথা কুকথাগুলো যত তাড়াতাড়ি দরবার করে বোঝাচ্ছে নাকি ছাপোষারা নিপাত যাক, এটাই চাইছে, ঠিকাদারি নিয়েছে নাকি। ছি ছি মানাচ্ছেনা গো, যে চুলোয় ছিলি, সে চুলোয় যা।

আহাঃ কী সুখ! কী সুখ! সুখের আবার রামরাজত্ব! ল্যাংটার যে কী হলো। বাঁধা নেই, কোন বিপত্তি কোথায়! সে আবার কী রঙ্গ দেখল, ধেই ধেই করে নাচল। কত তো পাখি আগুন ছড়াল। ‘ যা যাবি তো যা যেমন করে যেতে চাস যা।’ যেই সুখের কোন বিনাশ নেই, আত্মসুখ সেই এক পরম প্রাপ্তি। কথার পরে কথা সাজালে সে কেমন কথা হয়,  জব্বরও জানে, কেমন করে জানে, ল্যাংটা যেমন করে জানে। বিলু সে পথের মালিক নয়। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। ল্যাংটাকে পথ দেখাবে এমন দিশা পেলে তো যাবে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার। এত ধুলো গায়ে মাখলে সে কি আর এত সহজে ছাড়ানো যায়। জয় পরাজয় তো দূরের কথা। ভাবের ঘরে চুরি করলে আর তো কোন কথা নেই। রাজা রানী পায়ের উপর পা তুলে ছড়ি ঘোরাবে, ল্যাংটা সে কথা আর জানবে কেমন করে! এত জোরে দৌড়ল রাজার হাতি শুঁড় তুলে সেলাম করল, ভেবেছিল লোহার তোরণটা আপনা আপনি খুলে যাবে। সে মারের চোটে পিঠে রক্ত ঝরল। ‘কত করে বারণ করলুম ও পথ মাড়িও না, শুনল সে কথা।’ ল্যাংটা নিজের মতো করে পা ফেলল, যা হবার তাই হল, কত লোক গাঁইগুঁই করল। ‘ তাই বলে স্বপ্ন দেখব না। খালি ওরাই পথের সন্ধান পাবে? দোষ আমাদের ছিল যদি, ছুঁড়ে ফেল না চার বিঘত দূরে। জোঁক এসে রক্ত চুষবে।’ বিলু বলল, ‘এমন মাঠে ধান চাষ করতে যেয়োনি গো। জঙ্গলের রাজত্বে এমনটি করতে নেই।’ রুলের বাড়ি পড়ল, ‘ও মা গো’! তাই বলে কথার সুখে মন ভরাব নি।’ জব্বর তো সাবধান করেছিল। ‘গোখরোর সঙ্গে গায়ে পড়ে ঝগড়া করো নি গো। যে পথ তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছ, সে পথ তুমি পাবে কোথায় কালে কালে, কালের আঁধারে সেঁধিয়ে গেছে।’ ল্যাংটা এসেছিল যে কোন পথে, কবে থেকে, বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভুবনে, উল্টাপাল্টা মা পড়েছিল, আওড়েছিল, যদি কিছু একটা ম্যাজিক ঘটে চলে। ভাগ্যিস ঘটে নি, কেউ ভাগ ও বসায় নি। ভেবেছিল অনেক কথা। দিল্লী বুঝি অনেক দূরের পথ। শুনল রাজামশাই হাতে তালি, মুখে বুলি তুলে এক নিমিষে সেই যে গিয়ে একবার বসল, আর নামল না। অ আ ক খ – ই জানে না, সে নাকি রাস্তা চেনাবে। বিলুর কথা শুনল না। কাঁকটা যেই না বেঁকে বসল, পথের নিশানা গেল পাল্টে। সেই তো কাকভোরে মুখে করে যেই না আনল লেফাফাখানা, পড়বি তো পড়, রাজার বেটা গামছা গলায় উলঙ্গ হলে যেমনটি লাগে। সৈন্যসামন্ত সকল তেড়ে এল, হুমকির পর হুমকি, বলে বেড়ায় যে যার পথ চিনে নে। কে আর কার কথা শোনে, ল্যাংটা সেই যে দুনিয়া চিনল, আর কি থামতে চায়। চেনার কে, ওই জব্বর মিঞা! এত কথার আমদানি করল, রপ্তানির বেলায় শূন্য, পেট খালি নিয়ে কি রাজার বাড়ির পাথর গোনা যায়, তবু সাত রাজার ধন এক রাজার মানিক, নিড়ানি দিয়ে কি আর ওসব কাজ চলে। জব্বর মিঞা কেন যে নিড়ানী খানা হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল ‘পথ দেখ’। কী অবাক কাণ্ড! হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া। রাজার চেলা চোঙা ফুকে বলে বেড়ায় ‘ ওরে ও মূর্খের বেটা, পথ মাপতে এয়েছিস, তোর ঘাড় মটকে না দিয়েছি তো! আমি রাজার পা চাটা কুত্তা নয়।’

জব্বর কখন আসে, কখন যায়, ফিরে ফিরে আসে। ফিরে আসাটা ও পছন্দের তালিকায় রেখেছে কিনা, সে নিজেও জানে কিনা সন্দেহ। মনের কান্না শরীরের কান্নাকে ছাড়িয়ে ভিন্ন জায়গা নিতে পারে কিনা এই জিজ্ঞাসা অবান্তর। শুধু ওর ডালার দিকে তাকিয়ে – রামদা, কাটারি, ছোরা, চাকু, ভোজালি, বল্লম, সড়কি,কোঁচ,বঁটি, কুরানি,কাস্তে, কর্নিক কতকিছুই যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, চোখের দেখাই যে শেষ কথা নয়, কখন যে যন্ত্রপাতির সঙ্গে আত্মীয়তা পাতিয়েছে, ভেঙেচুরে গেলেই যন্ত্রণাটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মানুষগুলো হেঁটে চলে যায় বটে, চেয়ে চেয়ে থাকে, চোখ পাকিয়ে তাকায় না এমনটাও তো নয়। ঘৃণা ছড়ানোটাও কম জ্বালাতনের নয়। জবরদখল শব্দটা মনে মনে পোষণ করে বিড়বিড় করে পাশকাটিয়ে যায়, জব্বরের জানার কথা নয়, হুশ হুশ শব্দ করে নিজের উপস্থিতিটা বুঝিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। হারিয়ে যাবে না, গেলেও তো যেতে পারে। অস্তিত্বকে অসাধারণ করার কোন চেষ্টাই তো থাকে না। থলেটাকে মুড়িয়ে যে মাঝে মাঝেই খোলা মুখে হাত গলিয়ে দেয়, দাঁতের গোড়ায় দিয়ে তৃপ্তির রস জিভ দিয়ে টেনে নিয়ে গালের ডানে বাঁয়ে নিয়ে সামনে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। মুলামুলি করে দু’পক্ষের সমঝোতায় এলে ঘন নিঃশ্বাস টেনে বলে, ‘ না পোষালে চলবে কেন, ভরদুপুরে চড়া রোদে ঘাম ঝরাচ্ছি এমনি এমনি। এই শহর জীবন দিয়েছে, রুটিও দেবে, প্রাণটা যখন টেনে টেনে নেবে, শ্বাসটা যখন আসবে আর যাবে, তোমাদের মুখগুলোই ভাসবে গো ভাসবে। এন্তেকালের সময় এমনটা হয়, হয়তো, না হলে চলবে কেন? অনিশ্চিত আর অস্বস্তির পৃথিবীতে এমনটা হয়েই থাকে। বাপকেলে ওই যে দোকানটা ছিল ওই চার মাথার দোকানের ডান পাশে কে যে এসে গুঁড়িয়ে দিল, ছিঁটকে গেল ঘটিবাটি, বোয়াম, টিনের কৌটো, ভাঙা কাঠগুলো টুকরো টাকরা হলো, বালতিটা উপুড় হয়ে পড়ে রইল। নোটিশ দিয়েছে তো কর্পোরেশন, কিছু কি করার ছিল, ভিটের মাটি চটকে গেল। হাজার চোখের জমায়েত হলো, যার গেল তার গেল। ওরা তরতর করে পরমুহূর্তেই ছুট্টে চলে গেল, রক্তের নদী বইছে গলগল করে। জব্বরের ছেলেটাই তো সাদিক। দৌড়চ্ছিল এপার ওপার, রাস্তার ডানে বাঁয়ে, চেনাশোনা ছিল না এটা কেমন করে হয়, রোজ আসে, রোজ যায়, হাপুস হুপুশ করে কাঁদে। হাত পা ছড়িয়ে মাথা চাপড়ালে কি আর ছেলে ফিরে আসবে, বুড়ি লোকটা বলেই তো ছিল। এক দল গেল, আর এক দল গেল। কাঁচের আয়নাটা ভেঙে দু’টুকরো হলে ভেবে দেখল, কবর থেকে বেহেস্তের পথটা কতটা লম্বা। ইলেকট্রিক লাইনের থাম্বাটা ধড়াস করে ভাঙা ইটের টুকরোয় পড়ে গড়াগড়ি খেল। চলে তো গেল, এক এক করে লাশ হয়ে গেলে কাফনের সাদা ঢাকনায় লেগে ছিল অসাড় শরীরটা। কত চোখের পানি রাস্তায় রাস্তায় মিশে গেল কেউ জানতেই পারল না। জব্বর রামদাটা ওর ঘাড়ের কাছে কি মনে করে আবার নামিয়ে নিল। দুর্দিনে এমনটাই হয়, কেউ ভিড় পাতলা হলে ফিরেও তাকায় না।

বিলুর এই জিজ্ঞাসা বৃথা যায়নি। কোন ভনিতা না করেই জিজ্ঞেস করল জব্বরকে, ‘চোখের জলের দাম নেই ভেবেছ? যারা ফেলার আয়োজন করছে, তাদের বলতে তো ইচ্ছে হয়, একটুও কি মেপে দেখতে চাও না, কোনটা দামী, চোখের জল না অন্যকিছু?’ ল্যাংড়াকে কেন যে বিলু খুঁজে বেড়াচ্ছে? ল্যাংড়াই বা পালিয়ে মরতে চাইছে কেন? ‘মরতে হয় সকালের সামনে এসে মর, নাকি সব চুরমার করে দিয়ে নতুন করে গড়েপিঠে নিতে চাও।’ সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে কিনা, নাকি মরা মানুষরাই জ্যান্ত মানুষের ভান করে পড়ে আছে। দয়া করে যদি কেউ মর্গে নিয়ে শুইয়ে দিতে পারে। ইচ্ছেটা এমন নাকি, ডুবে যদি যাক সব যাক না, নোয়ার নৌকাটা ভেসে তো বেড়াবে এপাশ ওপাশ যাত্রী তুলে নেবে বলে। ‘সর, সর, তাড়াতাড়ি সরে যাও, পথ খুঁজে নিতে দাও। পথটা আমার বড় জানা দরকার।’ এত তো অলিগলি, কোন গলিতে গেলে কোন জিনিসপত্রের আড়ালে ল্যাংড়া লুকিয়ে আছে কে জানে! পাহাড়প্রমাণ কত তো জিনিস এক একটা মানুষের মাথা গোঁজার জন্য প্রয়োজন হয় কে জানে। অম্লমধুর সম্পর্কে জীবন চলে। উত্থান পতনে আকাশপাতালের শব্দ শোনা যায়। আশংকার ধোঁয়া গলগলিয়ে ওঠে। বিলু কেন যে খুঁজে বেড়ায় ল্যাংটাকে। ‘বহুত হারামি  নয়তো ল্যাংটা।’ প্রথমে ওই লোকগুলোর গল্পগুলো গড়গড়িয়ে বাড়ে। সময়ের বাড়াকমা নিয়ে আজকাল  ওদের গল্পগুলো ওঠানামা করে। কাজের বহর ছেড়ে বাহিরের দোষগুণ ঢুকে পড়ে ফাঁকে ফাঁকে। কোনটা আগে যাবে, কোনটা পেছনে কিছুই বোঝা যায় না।  তবু ওরা বলেই চলে। তর্কের জালে বিতর্কের আড়েবহরে আবারও গল্প খোঁজে। ওদের গল্পগাছায় গল্পের গরু গাছে ওঠে বটে, নিচে নামতে খুব একটা সময় নেয় না, ল্যাংটা কোন আড়ালে গিয়ে পরখ করছে, বোঝার কোনো উপায় থাকে না। শব্দগুলো বিলুর চেনা নয়, নামছে আর উঠছে, পাঁচ নম্বর প্যাকের দু’নম্বর ছানা, ছয় নম্বর প্যাকের জয়পুরিয়া, ধড়াম করে নামছে আর লুপছে। কেমন যেন নামগুলো – কেত্তন, ভোঁদাই, বিটলে, কানমলা, কচি। বিলু হুড়মুড় করে ঢুকল, নামের অর্থ খোঁজার নামাবলী গায়ে জড়াবে, বুঝবেইবা কেমন করে। ‘ও কেত্তন, বৌদিকে ট্রেলারের কাছে নিয়ে যা দিখিনি। যান বৌদি, কোন চিন্তার কারন নেই। ঠিক যেমনটি চাইছেন,তেমনটি বানিয়ে দেবে।’ ‘মানুষকে যদি মনের মতো করে বানিয়ে দিতে পারত।’ ‘তাও পারবে, গিয়েই একবার দেখুন না। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।’ বিলুর মাথাটা ঘুরেই গেল। মানুষ কত জাদু না জানে। তবে ওর চেয়ে কম না বেশি, নজরটা অন্যদিকে ঘুরে গেল। শোনা তো যাচ্ছে, ‘দিদি, একবারটি শুনুন, কেনা দামেই না হয় দেবেন। গরীবদের দিকে তাকিয়ে দেখবেন না। বালবাচ্চা আমাদের ঘরেও আছে। আপনাদের বাচ্চা আদরের ধন, আমাদের বাচ্চা বানের জলে ভেসে এসেছে? দু’টাকা কমই দেবেন।’ ‘দশ টাকা কম দামে দিলে দু’পিস নিতে পারি।’ ‘পোষাবে না দিদি। দেখুন সস্তায় পান কিনা।’ গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন মহিলা। ‘এনারা নাকি ভদ্দরলোক! হবে হয়তো।’ ‘কী বললেন?’ লোকটার মুখ দিয়ে আর কথা সরল না। এক দলা কফ উল্টো দিকে মুখ করে পথের ডান দিকে ছুঁড়ে মারলেন। ভোঁদাই পোলা মাইয়াদের জন্য মিলিয়ে মিশিয়ে সাত আটটা বাক্স মই বেয়ে নিচে নামিয়ে এনে বলল, ‘এগুলা থেকে বাইচ্ছা নিন।’ 

ভোঁদাই বিলুর দিকে ফাঁকতালে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেই থাকল। ‘ ভাবতেছি কোথায় যেন দেইখেছি আপনারে। এদিকে কী কামে? কাকে খুঁজতে আছেন বুঝি। আপনারে দেখেছি তো রাস্তাঘাটে কী যেন খুঁজতেই থাকেন। লোকে তো আপনারে বিলুপাগলা কয়।’ বিলুর চোখের ভাষায় কোন শব্দ নেই। হঠাৎই বেরিয়ে এল দাঁতের ফাঁকে,’প্রাইভেট গলি’ শব্দ দুটি ফুরুৎ করে, ‘বিলু পাগলা জানল কেমন করে?’

চোখ দুটো বেশ করে ঘুরিয়ে নিল। ‘ জানলা কেমন কইরে?’ ‘যেমন করে তুমি জানলে।’ ‘ঘরের উপর ঘর, তার উপর ঘর।’ ‘সাধে তোমারে লোকে বেআক্বেলে জাদুকর কয়!’ ‘ একটা খবর দিতে পার গো? ল্যাংটার দেখা কোথায় পাই, বল দেখি।’ ‘এই কথা! কত ল্যাংটা লোক চাও। এই যে দুকানঘরগুলো দেখতে আছ, পুরা দিনে কত ল্যাংটা লোক ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ায়। ভাবতেছ আমি মস্কারা করতে আছি।’ ‘তোমাদের কাঁড়ে লুকিয়ে রাখা নি তো! এই যে কত লোক মুখ বাড়িয়ে আমাকে দেখছিল, ওদের মধ্যে কেউ নেই তো?’ ‘ বিশ্বাস হচ্ছে না, তাহলে চল আমার লগে।’ ‘কোথায়?’ ‘চল না, ওই ল্যাংটা লোকটারে যদি আমি না দেখাইতে পারি, তবে আমি এক বাপের বেটা না।’ ভোঁদা ম্যানাজারের দিকে চেয়ে বলে, দাদা, আমি দুমিনিটের লাইগে একটু আইতে আছি।’

এমন একটা কাণ্ড যে বিলুর কল্পনার বৃত্তে এসে জায়গা দখল করতে পারে, ভাববার অবকাশও ছিল না। তবু ভোঁদাই যে ঘটিয়ে দিয়েছে তা যতটা না চিন্তার ততটাই অচেনার।  লোকটি উলঙ্গ ছিল, মুখ দিয়ে ফেনা বেরচ্ছিল, কিছু কথাও ছুঁড়ে দিচ্ছিল পথচারীদের উপলক্ষে। পাত্তা দিল কি দিল না, সে অবহেলা সরিয়ে রেখে চলনে বলনে এমন ইঙ্গিত করছিল, উড়ে এসে জুড়ে বসা নিয়ে নানা প্রশ্ন। এই জায়গাটা ওদেরই চেনার কথা ছিল। কেউ কি বলতে পারে, কংক্রিটের রাস্তা আর শক্তপোক্ত মজবুত বাড়ি বানানোর দু’বাহুতে তাকতটা কাদের ছিল। ওরা কিন্তু হাসতে হাসতে চলে গেল।  আপাত অন্ধকারে পড়ে পড়ে পায়খানা আর মুতের গন্ধ তার পাকস্থলীর আয়তন বাড়িয়েছে। ভোঁদাই ওর সকাল সন্ধ্যে আর গড়িয়ে পড়া সময়টাকে বিলুকে ফিরিয়ে দিয়ে যাচাই করতে চাইছিল ল্যাংটার অস্তিত্বটা নড়বড়ে কিনা না ওর পথের দিশা ভিন্ন। কথাটা আমল দেওয়ার মতো, ঈশানকোণে মেঘ জমেছে কিনা, তাই বলে নৈঋর্তকোণে আলোর ঝিকিমিকি জমাট বাঁধবে না, কেউ কি জানে! ওরা পুলের বাঁ পাশে জঙ্গলের আগুন থেকে শরীরটাকে বাঁচিয়ে এনে উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল, বিটলে আর কানমলা সেই বনের দরজা খুলে একটুখানি জায়গা চেয়ে বসেছিল বলেই না এত টান, এত শোনা কথায় বলে দেওয়া এক লফতে। চেয়েচিন্তে, আস্তাকুঁড়ে হাত গলিয়ে জাঙ্গিয়া পরে লজ্জা থেকে রেহাই মেলেনি। তারামা হোটেলের বাসি ভাত আর কাঁটাকুটায়, পচা তারকারি মুখে পুরেছিল। কে জানবে, কখন কি ঘটবে, বিলুর ঘ্রাণশক্তিটা দিনে দিনে বেড়েছে, মনের কথা শোনাবে না, তা বলে কি হয়! ওরা গা বাঁচিয়ে রাখবে কোথায়! এত সোজা নয় বাপ, দিন দুনিয়ার পাশাখেলা যখন খুশি, তেমন খুশি পালটে পাল্টে যাবে। কত আর খেলবি বাপু, সময়েরও মাপজোক আছে, মনেরও রকমফের আছে। গতির খেলার রঙ দেখেছ, হাঁটা তোমার যত জোরেই হোক, হোঁচট তুমি খাবেই আজ কিংবা কাল, এত জ্ঞানবুদ্ধি বেপথু হলে ল্যাংটারা রাস্তায় নামবেই। মন্ত্র তুমি যতই জপ, পুরোহিত তুমি যতই ডাক, নিদান তুমি যতই দাও, হাতে হাত না ধরলে লিফটে তোমার আগুন ধরবেই। বিলু নিজে থেকেই একটু উলটে পালটে দিল নিজেকে নয়, খোলা শরীরের লোকটাকে। একটুও লজ্জা হয়নি কারও। নিজেকে ঢেকে রাখার আনন্দে কত লাফালাফি, আলাদা প্রমাণ করার কত উন্মাদ উত্তেজনা। কেউ কি ওকে কখনও লাথি মেরে ড্রেনে উল্টে ফেলে দিয়েছিল, ‘যা, যমের দূয়ারে যা, খাবি খেতে খেতে মনের যত গোনাগুণতি আছে সব থলেয় পুরে নে।’ ও একবার জানতে চেয়েছিল কীসের থলে? এত চটজলদি কেন? এখনও অঢেল সময়। আমি তো জানি না, সময় কাকে বলে! সময় তো আমাকে কেউ চেনায় নি। বলতে পারেন বিপদ হবে বলেই ওরা মুখ ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরেছিল। ওই রাস্তাটি নাকি কেউ বানিয়ে দিয়েছে নিজেদের জন্য। কী গর্ব! বুক ফুলিয়ে হাঁটে তাই তো। কী মনের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। আমার রাস্তাটা বড্ড কাঁচা থকথকে, পা ডেবে যায়। ওই মনকাঁটা আছে না। শরীরটাকে জাগিয়ে দু’কথা বলব, সেই বোধটুকু নেই বলে কত ব্যঙ্গই না করেছে, ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমির গল্প আমি জানি না, এটা পুরোপুরি মিথ্যে। মিথ্যে বলেই কত তো সত্যের অপলাপ, শ্মশানের শরীরে কত তফাৎ। ওরা যায় আর আসে। ‘ কে তোরা? ভাগ বসাচ্ছিস। কুত্তার বাচ্চা কারা? ভিক্ষে দিল তো খাবি। ভাগ বাটোয়ারা করে ওয়াগনে করে যাচ্ছে না ঝিকুর ঝিকুর। কতদূর আর যাবি, ইঁদুরকলের ফাঁদ পেতেছে।’ বিলুর কানের পাশ দিয়ে বুনে শুয়োর আর হরিণগুলোর কথাগুলো দাপটে আর মিঁউ মিঁউ করে চলে গেল । ‘কুত্তা’ শব্দটা কানে বাজল বুঝি, নেড়ি কুত্তা,খেঁকি যেই সেই কুত্তা নয়, ওদের লোমে,হাঁটুতে দুর্গন্ধ। আর ওই এলসেশিয়ান, জার্মান শেফার্ড, গ্ৰেহাউন্ড, লাব্রাডর, যেমন মিষ্টি নাম, সুগন্ধ, পটি তো রাস্তার কোণে কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। অধিকার, একমাত্র ওদেরই, প্রতিবাদ করেছেন কি মরেছেন। যত দোষ, নন্দ ঘোষ, জেগে জেগে থাকে মানুষের জন্য কত দায়। অজাত কুজাতদের কত দায় ওরা থাকে তুলোর বিছানায়। মানুষ শূয়োরগুলো দিব্যি পড়ে থাকে। ভিখিরিদের আবার জাত বলতে ওই তো একটাই ‘নিচু জংলী। কত কথা ঘেউ  ঘেউ করে বলার স্বাধীনতা আছে না! ওদের দয়ায় বেঁচেবর্তে আছে। প্রমাণ তো করতে হবে, কোথায় আমরা, কোথায় তোরা। বিলু আবারও শরীরটা নেড়েচেড়ে দেখতে চায়, ল্যাংটা কিনা। ভোঁদাই ওর পুরণো বুদ্ধিতে পুরণো কথা মুখ ফসকে বলেই ফেলে, ল্যাংটার নেই বাটপারের ভয়। কী সোন্দর কথা! এই কোথায় আনলি রে ভোঁদাই? গাঁ গাঁ করে চলে যাচ্ছে উড়াল পুলের উপরে কত কত গাড়ি। কী গতি! বারে বা! কী মজার কথা, মজার দৃশ্য!

ভোঁদাই-এর কথার সূত্র ধরে বিলু লোকটাকে উলঙ্গ বলেই সম্বোধন করে। ‘ও ভাই উলঙ্গ, শুনছ আমার কথা।’ বিলুর হাতের ছোঁয়ায় উবুড় হওয়া শরীরটাকে খানিকটা হলেও ঘুরিয়ে নেয় উলঙ্গ। ধুলোর চামড়ায় মোড়ানো চামটি লাগা শরীরটা থেকে কিলবিল করে ওঠে নাম না জানা পোকারা। ওরা কোথা থেকে এলো কীভাবে এল, কেইবা দিল এমন সন্ধান। উলঙ্গ এত সহজে মরতে না চাইলেও এরা বোধ হয় ঠিকই করে ফেলেছে ওরা উলঙ্গ’র চামড়াটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। ভোঁদাই কথায় কথায় বলেছিল, ‘তখন পুল ছিল না, ফুটপাতের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে ছিল হাঁটাচলার রাস্তা। উলঙ্গ দু’পাশ দিয়ে মনের সুখে হেঁটে চলে যেত। জুতোর দোকান, থালা-বাসনের দোকান, কাপড়-চোপড়ের দোকান, ফলমূলের দোকান, মোবাইলের দোকান, পুরনো বইয়ের দোকান, ফ্রেমে বাঁধানো ছবির দোকানে কিছু পয়সাকড়ির বিনিময়ে ফায়ফরমাস খাটত, চলে যেত জীবনটা এইভাবেই দৌড়ঝাঁপ করে। তিনকুলে এমন কেউ ছিল না, ভালোবেসে বলবে যে ‘পাত পেড়ে দুটো ভাত খা।’ এর তার টিফিন কৌটোয় ভাগ বসিয়ে জীবন চলে যেত। উলঙ্গের কদর ছিল সবার ঈর্ষা করার মতো। সকলে বলত, ‘উলু, তোর মরণকালে দেখার মতো আর কেউ থাকবে না, আমরা তো হরিনাম জপতে জপতে ততদিনে উপরে গিয়ে দেবতাদের গা-হাত পা টিপতে হবে। বুঝলি না, আমাদের একুশ ওকুল দুকুলই লাথিঝাঁটা খেয়ে থাকতে হবে।’ সেই মানুষগুলো ঘরে বসে গেছে, ওদের ছেলেরা দুচ্ছারই করত দিনেকালে। পুলটা হয়ে গেলেও উলঙ্গ ওরফে উলু দু’এক পাক খেত এমথা ওমাথা, লম্বালম্বি সোজাসুজি কম বড় তো নয়। পোকাগুলো সব কিলবিল করে উঠছে।   ওরা বাসা বেঁধেছিল কখন কীভাবে কেউ জানে না। ওর নিজের উপলব্ধি ওকে শিখিয়ে দিয়েছে গোপনে মায়ের গর্ভের কথা। উলঙ্গকে ওরা নাড়ী কাটার সময় থেকেই কুট কুট করে খেতে শুরু করেছে। কেমন করে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে রপ্তও করেছে। শুধু কি তাই! কৌশলকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যত পদ্ধতি ছিল পরীক্ষা করে করে রপ্তও করেছে। উলঙ্গরা বুঝতেই পারে নি । মধ্যরাত থেকে শুনে নিয়েছে মৃত্যঘন্টা। ভোর না হতেই মৃত্যুভাবকে প্রয়োগও করেছে। কী বলবে, কেমন করে বলবে আর কি বলতে চায় সেই শব্দগুলো জানা ছিল না বলে ছন্দ আর সুরকে বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বলেছে ,’এই তো আমি।’ উলঙ্গ ওর নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে জন্ম মৃত্যর ব্যবধানে নিজেকে দাঁড় করিয়ে শুনেছিল মৃত্যুর ঘন্টাধ্বনি। সেই কথা আর সুরগুলো ছিল অভিনব। ওই জনতার বৃত্ত থেকে উঠে এসেছিল সেই কথারূপ। বলতে চাইছিল এক, হয়ে গেল অন্যকথা। উলঙ্গ কি তবে নিজেকে চিনতেই পারছে না! ও ভুল করে আপন মনে গজিয়ে ওঠা গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল ওই গাছের পাতাগুলো সবুজই-বা হয় কেন, ধীরে আরও ধীরে হলদে হয়ে নিজেকে আবার পাল্টে ফেলছে কেন? একসময় স্বরগুলো থেমে যেতে চায়, সুরগুলো হারতে হারতে জিতে যায়। উলঙ্গ আর নিজেকে নিজের মতো করে দেখতে চায় না। ওর চোখের জ্যোতি উজ্জ্বল হয়ে উঠলে ভাবে ‘এই তো আমি? আমি কি পৃথিবীর অধীস্বর! তবে এরা কারা! ওরা ফিসফিসিয়ে সনহনিয়ে কথা বলে উঠেছে কেন? হনহনিয়ে চলে যেতে চাইছে কেন অনেকদূর। ওরা কতকিছুই তো মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে! তাতে ছিল বুঝি আমারও শরীর। উলঙ্গ ওর আত্মপরিচয়কে এইভাবেই খুঁজতে চায়। আর ও একবার দৌড়ে চলে গিয়ে হাত দুটো উপরের দিকে তুলে গোটা শরীরটাকে নিয়ে পাক খেয়ে জেনে নিতে চায় আবারও,’ওরা কারা! ওরা জাল বুনছে কেন? গোটা জাল ছড়িয়ে ওদের বন্দী করবে বলে!’ প্রশ্ন করে ফেলে উত্তরটা আশার আগেই কেমন হারিয়ে গেল? ওরা উলঙ্গের দিকে তাকাচ্ছে কেন? যেমন করে তাকালে ওর নিজেকে আপন আপন মনে হতো। ওর অন্য বন্ধুগুলোকেও তো ওরা সমান তিরস্কার করল। ওরা কি তবে ভুলে গেছে আরও অসংখ্য পা এইভাবেই দৌড়চ্ছে। এতক্ষণ বিলু ওর ভাবনাগুলো নিজের মতো করে নিজেই টেনে নিয়ে আসল। বিলু দেখে নিতে চাইল, জগৎটা কেমন দাঁড়িয়ে পরে, একসময় নিজের মতো করে থেমে যায়। বড় আজব কান্ড তো! উলঙ্গকে ঘিরে থাকা গুয়েপোকাগুলো ওকে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। বিলুর সেই চোখের আলোতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওরা কেমন করে ভাবছে! উলঙ্গের প্রৌড় বন্ধুগুলো নুব্জ্য হয়ে যাচ্ছে। উলঙ্গদের বামন করে দিয়ে ওরা সুখের পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে শীতসন্ধ্যায় মুড়িয়ে ফেলছে রাজকীয় কম্বলে। সুখই সুখ! আরামই আরাম! একবারও প্রশ্ন করছে না, ‘উলঙ্গ তোরা থরথর করে কাঁপছিস কন? বিলু ওর বাবার কাছ থেকে শেখা শব্দটাই বলতে চাইল ‘স্ক্রাউন্ডেল’ কোত্থেকে শিখলে কী জানি! নাকি ওদের শেখানো শব্দটাই ওদের ফিরিয়ে দিল। বিলুর মনের মধ্যে অন্য আরও ঘৃণ্য শব্দের জন্ম হচ্ছে বটে। ওরা দাবিয়ে রাখার জন্য যে শব্দগুলো আবিষ্কার করেছিল বিলুর মনের মধ্যেই সেই শব্দগুলোর নতুন করে জন্ম হচ্ছে। কী যেন নাম দেওয়া যায়? উলঙ্গ তখন বলতে পারত, ও বোধ হয় বলতে শেখেনি। জবাবটা নিজের মনের মতো করেই দিতে পারত। ‘এই উলঙ্গ দিতে পারবি তুই, খুঁজে পাবি সেই আগুনখোর শব্দ?’ ছি ছি উলঙ্গকে ও তুই করে বলছে কেন? ল্যাংটাকে খুঁজে না পেয়েই ওর মনের বিকার! ল্যাংটাকে খুঁজে বের করতেই হবে যেই করে হোক। ‘ ও উলঙ্গদা, তুমি বোধ হয় বলতে শেখনি?’ বিলু প্রথম ওকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করল।  উলঙ্গ কী শুনতে পেল! এতটা সহজ নয় উত্তরটা। ও কতদিন ধরে শুনতে পারছে না এই প্রশ্নের জবাবই কে দেবে? সামাল দেওয়াও তাহলে কঠিন হয়ে যাবে না তো! উলঙ্গের পেট আর মন মিলিয়ে ও বুঝতেই পারছিল না এ কেমন পৃথিবী! কি জানি বড্ড চুলকাচ্ছে হয়তো। বিলু ওর গা-টা চুলকাতে যায়। গুয়েপোকাগুলো ওর নখ ছুঁয়ে আঙুল বেয়ে গোড়ালি বরাবর কনুইতে চলে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।  ‘আহাঃ করছটা কি।’ কথাটা ভোঁদাই বলে ফেলেও দাঁতে কাটল। বুঝতে তো ও পারেনি বিলু আসলে কী করতে চাইছিল। শহর জুড়ে সব পয়সাওয়ালাদের ছেড়ে ওই গুয়েপোকারা কেমন করে এই শহরের বাকিদের শরীরে গা বেয়ে বেয়ে চলে আর কেনই বা চলে আর কারাইবা ওদের ছেড়ে দেয়, দেখার বড় সখ বিলুর। বিলুর রঙঢঙ কেন এমন হল এমন প্রশ্ন ওকে তাড়া করে বেড়ায় নি, কেমন করে বলে! চঞ্চল ওর পেছনে ঘুরঘুর করলেও অপরের মাস্তানি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে দিত। আর ওই ডানা ঝাপটানো কালো কালো পাখিদের কথা বলতে গেলে আর শেষ হবে না। এত দেখে, তবু দেখার সাধ মেটে না, যখন তখন যেখানে সেখানে ঢুকে পড়ে, ঝাড়ুদার না মাইন্দার কে জানে। একবার ভাবতে বসলে দ্বিতীয়বার চেহারা আর হাঁকডাক করে এমন ধারা করে ঝাঁটা নিয়ে তাড়া খেলে দুজন দুজনায় কী কথা হয ও়রাই জানে ‘মানুষগুলা মোদের বুঝতে পারলনি গো। এশহর ছেড়ে অন্য শহরে যাব নাকি হে, জেবনটা গোটাটাই নাকি মিছে। মিছে কথা বলব নি, এই উলু দাদাদের দুঃখটায় আগুন জ্বলে যায়। মাইনষে মোদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাল নি, অথচ মিলমিশ করে থাকতি চাইলেও তাড়াতি চায়। ওই সব পেয়েছির দেশের নোকেরা ওদের সাথে যেমন পারা করে। কত করে বলি ওই বড়বাবুদের, ‘এই শহরটা মোদের সক্কলার, মোদের ছাড়া তোমরা বাঁচবেক নাই, এই কথাখান বুঝে নাও, মনের ভেতরে গেঁথে নাও।’ ওরা হো হো করে হাসে। বলে, ‘পালা পালা।’ ‘বলি গুয়েপোকার গন্ধ যেদিন শুঁকতি হবে, বুঝি যাবে ওইদিন কত ধানে কত চাল। এটা ভালো করে বুঝি নাও, দ্যাশটার মালিক বল, আর মালকিন বল, মোদের বাদ দিবা কোন সাহসে।’ ভোঁদাই বলে, ‘এই শহরটা আমাগো রক্তে গড়া, তোমরা রাজা সাইজলে কেমন কইরা, দেখবা না মজাখান। মৌজ করতে চাও, যত খুশি কর, বাপের নাম খগেন হইলে টেরটি পাবা।’ উলঙ্গের পিঠ যত চুলকায়, গুয়েপোকাগুলো বিলুর গা ছেড়ে নেমে পিচ রাস্তায় নেমে খেলা করতে শুরু করে।

   সপ্তম অধ্যায়

কালভার্টটায় ফাটল ধরলে পিলে চমকে যায় কাকটার। কাকে বাঁচাবে আর কাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখবে এই নিয়ে চিন্তার কি অন্ত আছে! যে শূন্যস্থান এসে সামনে হাজির হয়েছে, ঐ যে দেখতে পারছেন ছয় সাত বছরের শিশু, পোঁদ ঘষটে ঘষটে চোখের জল ফেলতে ফেলতে একটা ল্য্যবঞ্চুচের বায়না করে মৃত্যু ফাঁদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেছিল, ভাগ্যিস ওই রেলযাত্রীটা কোলে তুলে নিয়েছিল, চুমু খেতে চেয়েছিল ধুলোমাখা মুখে, না হলে বিপদ ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারত। জানেন বোধ হয় সকলে, কত বছরের পুরনো। মনে পড়ে তো সেই দিনটার কথা, দৌড়ে ছুটে এসে প্ল্যাটফর্মের কোলঘেঁষে ট্রেনটার কামরার গেইটটা ধরে পাদানিতে পা-টা ছোঁয়াবে বলে হাঁপাচ্ছে হুপহাপ করে, কাকটা বোধ হয় দেখে ফেলে স্বরটাকে একটু আধটু পাল্টে নিয়েছিল। ওরাও অর্থাৎ ওই ছোট্ট ছোট্ট মুখগুলো চেয়ে চেয়ে দেখেছিল ওই ডালের উপর ঠ্যাংগুলো চিপকে থাকা ওদের ওই অজানা অচেনা না বোঝা বন্ধুটিকে, পরম বন্ধু, একা হয়ে থাকা মানুষ, না না-মানুষটিকে। মানুষ কাকে বলে, কেমন করে মানুষ হতে হয়, ওদের তো জানার কথা নয়। ওদের মায়েরা এখন কোথায় যে যায়, ওরা তো জানে না, ওরা তো চোখে ঘুম মেখে  বসে আছে, ওরা তো জানতে পারে না, একটু পরেই তো গু মেখে ঢুকে যাবে সুড়ঙ্গে। ওই আর কি ওদের জন্মস্থান, জন্মভূমিতে, আঁধার যেখানে লেপ্টে থাকে সারাক্ষণ, কখন চুপি চুপি এসে মহাযোজন দূর থেকে চলে আসা আঁকাবাঁকা আলোর বিন্দুগুলো এসে জমাট বাঁধবে, ওরা এক এক করে নিজেদের মুখগুলো চিনে ফেলবে, হি হি করে হেসে ফেললে হাসিগুলো এক হয়ে গেলে ওরা অবাক চোখে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবে, ওরা কারা! আর ওরাই বা কারা! আর ওই অনেক দূরের মুখগুলোই বা কারা! সেদিন বাসি গায়ে মায়ের বাজুতে জাপটে প্যান্ডেলের বাইরে এসে অপেক্ষা করেছিল ঘন্টা পার করে ওদের মায়েরা। কোথায় যে ওরা দাঁড়ায়? কেন যে ওরা দাঁড়ায়? পাঁচিলের কাছে ভুটভুট করে জলের ফোয়ারা ছিটকে যাচ্ছিল রাস্তাটা, রাস্তার কফ আর থুথুর দলা জলের সঙ্গে মিশে গিয়ে অনয়াসে চলে আসছিল খাবারের ডাব্বার কাছাকাছি,খেটেখুটে আসা এক পেট খিদে নিয়ে গোগ্ৰাসে গিলতে গিলতে বলেছিল ‘ নে খা, নে নে।’ ‘দেবে তো! তবে দাও।’ 

বিলু দেখেও দেখতে চায় না। ঘুরেফিরে নিজের ঘরেই ফিরতে চায়। কাকে নিজের আলয় বললে ওর মনের তৃপ্তি হবে, এই প্রশ্ন নিজের মনে জেগে উঠলেও থেমে যেতে চায়। এই আশ্চর্য প্রশ্নটির উত্তরের আশায় ও কোন গর্ভগৃহে যাবে। সুড়ঙ্গগুলো কোন জাদুকর নিজের মনের মতো গড়ে তুলেছে সেই তো আর এক সময়। দেখেছিল হয়ত এমন কেউ, ভাঙা গালে আর বিষন্ন চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ সময়ের এক কোনে, দু’চোখে ছানি নিয়ে নাতি-নাতকুরদের দেখছে চোখেরই পর্দায়। ওরা হুশ করে যায়, হুশ করে আসে। সেদিনই তো হল, ভাঁজ হয়ে চলা পেটের এক কোনে নাতনিকে কোলে নিয়ে কেঁপে উঠেছিল ওর শরীর। গল্পটা শুনেছিল বলেই না, আদিম এক প্রবৃত্তি নিয়ে খেলে বেড়িয়েছিল এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, ঐটুকুনি শরীর থেকে ঝরেছিল রক্তের দলা, মাথাটা ঘুরেই গিয়েছিল দিনু ঢুলির। জলও গড়িয়েছিল একটু একটু করে। নাতনী ওর সঙ্গীসাথী নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চোখের নিমেষে যখন প্ল্যাটফর্মের কালভার্টগুলো পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারল না মালগাড়িটা ঝিকুর ঝিকুর শব্দ তুলে চাকার ঘর্ষণে এইদিকেই তাক করে আছে। দু’চারটে ধেড়ে ইঁদুর আর ভোঁদর ফাঁকতালে গুলু গুলু চোখে বগির নিচ দিয়ে কেমন স্বচ্ছন্দে পার হয়ে গেল। দিনু’র নাতনি কালিমনির দুই নাতির হাত ধরে অনায়াসে ঠিক সময়েই পাশাপাশি সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল। ওদের চেয়ে আর একটু বড় কালা আর ধলা নিজেদের মধ্যে বাবুদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে পাওয়া আট আনি নিয়ে হুজ্জতি করতেই বলে গেল ওদের পাড়াটায় বিদঘুটে সব জীবজন্তুর উৎপাত শুরু হয়েছে। বিলুর আবার পাগলামির ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। বসন্তের বিস্কুটের বয়ামে হাত ঢুকিয়ে লেরি বিস্কুটটা তুলে যেই না হাত ঢোকাতে যাবে তাকিয়ে দেখল নেড়ি কুত্তাটা জিভ লকলক করে চেয়ে আছে। আয় তু তু করে ডাকতেই দেখল লখাই পকপক করে দেখছে। এই লখাইকে দেখেছিল কাল রাতেই বিশুদের পাড়ার মোড়ে দোকানের জায়গা দখল করা নিয়ে রক্তারক্তি, মাথা ফেটে চৌচির। ওকে যে কোন দল হুজ্জতি করবে বলে মাঝরাতে হাঁকাহাঁকি ডাকডাকি করে তুলে নিয়ে গেছিল, সেই নিয়ে পাড়া কাঁপিয়ে দোচালা থেকে হাত পা ছুঁড়ে সেই যে কান্না, সেই কি আর থামে, না থামতে চায়। লখাইয়ের হাতটা ধারালো ছুরির পোঁচে সেই যে চিরে গেল, দাগটা গভীর ক্ষত হয়ে হয়েছে দগদগে ঘা। বিলুর টানটা বেড়েই যায়, আধ টুকরো কুকুরটার মুখে পুরে বাকি আধ টুকরো লখাইয়ের গায়ের কাছে গিয়ে বলে, ‘নে খা।’ বিলু গায়ে গতরে কত তো খেটেছিল, রেলের এই বাড়িটা তরতর করে যখন বেড়ে উঠছিল, তাই তো এত টান, রোজই তো পালা করে পাহারা দেওয়া,চুরিচামারি হয় কিনা, অতন্দ্র প্রহরীর মতো পড়েই তো ছিল। দুষ্টুমি করতে করতেই সেই উদোম গায়ের ছেলেগুলোর সঙ্গে চেনাশোনা। কোথায় যে গেল, গেল হয়ত মাটির নিচে চাপা পড়ে, বিলুর দৃষ্টির আড়ালেই ঘটেছিল। কত কিছুই তো ঘটে যায় অজান্তে। মানুষরাও বন্য জন্তুর মতো চলে যায় গোপন গভীরে, কেউ দেখে, কেউ দেখে না, কারো পায়ের তলায় জমি সরে গিয়ে লাফিয়ে ওঠে, বিলু তো তাই মনে করে। 

চঞ্চলকে তাই তো নিজের ঘর সংসার চেনাতে চেয়েছিল বিলু। ঘর সংসার বলতে চঞ্চল বুঝেছিল ঘর, আসবাবপত্র, জঞ্জাল, এমন এক ধাতুতে গড়া জীবন, যাকে দেখাও যায়, অনুভব করা যায়, তার স্পর্শে মন চনমন করে ওঠে, হৃদয়ের আন্দোলনে বিস্ফোরণ ঘটে, এই শহরের আদুল গায়ের মানুষদের সেইভাবেই চিনেছিল ও। কী আর বলবে, বলতে বলতে বলেই ফেলেছিল, ‘ কে ভাববে আমাদের কথা, কোনদিন চিনতে গিয়ে চলে যাবে, কোন এক পরদেশে, দেখে ফেলে বলবে,’ এই তো আমাদের দেশ, চিনতে পারিনি বুঝি, কেন পারি নি, কোন পথে হাঁটি নি, হাঁটা উচিত ছিল, তাই তো এত দুরবস্থা! পরিত্রান মেলেনি তো। ‘ আচ্ছা মিলবে কেমন করে, তাই তো এত সাদা চোখে এত সাদা আলো, কেমন অদ্ভুত না। চঞ্চল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। নদী ওর কাছে উন্মত্ত মনে হয়, পাড়ের গাছগুলো কথা বলে তো, মনের মতো কথা বলে, যারা ওদের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে ‘বড় নিশ্চিন্তে আছি, লম্বা করে শ্বাস নিচ্ছি, যত গোলমাল বাড়ে হাত বাড়ালেই, যত দুঃখ হয়, যন্ত্রণাটা চাগাড় দিলেই।’ গরমে সিদ্ধ হয়ে যাই, একটুখানি সরে গেলেই দূর দূর করে তাড়া মারে কিনা। ওরা ভাবে কাঙালগুলোর জন্য আঁধার নামলেই পোড়ো বাড়ির ভাঙা ভাঙা ইটের টুকরোগুলোতে গুঁতো খাওয়া। তাড়া খাওয়া গরুগুলো ছুট লাগায়, পই পই করে ছোটে, সেই ছোটা কেউ যদি দেখেছে, কানে তো দুঃখের শব্দগুলো তো বাজছে, সমান তালে তো বাজছে না, কোনটা মনে হচ্ছে দূরে, কোনটা কাছে। সুখের রঙগুলো চিনবে না তাই বলে। ‘আচ্ছা বলেন দেখি তারও তো কত রকমফের, এই যায়, এই আসে, পোড়া পোড়া, মরা মরা, পচা পচা, কাদা, কাদা, ফেনা ফেনা, সুখের রঙের কথা তো বলে শেষ করা যায় না, দূরের রঙ কত কমলা, কাছের রঙ কত হলুদ, চেনা অচেনার দেয়াল ভাঙলে ওদের কোন টান টান ভাব নেই, শুধু আধপেটা নাড়িভুঁড়িতে কত তো ক্ষত চিহ্ন। তাই বলে চঞ্চল দৌড়বে না, দৌড়বে। পায় না বলেই তো খাবলে খাবলে খেতে চায় এখানে সেখানে।’ 

অটল তো বিন্দুর মধ্যে বৃত্ত খোঁজে, তাই তো শুয়ে শুয়ে কান পেতে শোনে। ওদের যখন লাথ মেরে কত উঁচু তলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পান থেকে চুন খসলেই, ওদের চোখে কী তখন জল থাকে! ওরা জানে আজ না হয় কাল ওদের কেউ ঠেলে ফেলে দেবেই। রাখবে তো না, রাখবে কেন! রাখলেই তো বিপদ। অটল ভাবে ‘বিপদ! বিপদ আবার কি কোন শব্দ!’ তাই তো ওদের বারণ ও শূনতে চেয়েও কানে আঙুল দেয়। ওরা আবার ঘন ঘন মৃত্যুর শব্দ শোনে, ওই লোকগুলো ওদের তাড়িয়ে শহর ছাড়া করবে। অটল ওই ষড়যন্ত্রের কারণ খুঁজতে চেয়েও কোন কূলকিনারা পায় না। ওদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করে বলে, ‘এখনও সময়ের খেলাধুলা অনেক রে বাকি। ঘাবড়ানোর কোন কারণ তো ঘটেনি। আনন্দের নানা বাজনা ঘন্টা কাঁসর ঢাক ঢোল বাজবে, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবে অনেক দূর। এমন হাসি হাসবে, তাই বলে পেটে খিল ধরবে না, তাই কখনও হয়!’  ওরা তবু অটলের হাতে হাত রেখে বিশ্বাসের জায়গাটা মজবুত রাখতে চায়। ‘যাব যখন যাব, নিজেদের উত্তরসূরিদের জন্য কথার বাঁধটাও তৈরি করে যাব। কি জানি কখন বানের জলে যদি ভেসে যায়? ফন্দি তো আঁটছে ষোল আনা। কত তো অস্রশস্র, কত তো ছল চাতুরী, না হলে কি আর এমনটা হয়! এমন পিছুই বা হঠবে কে?’ না হলে চঞ্চলের চেনা লোকগুলো কেমন করে এত অচেনা হয়ে যায় অটলের কাছে। অটল ওর এত কাছে থেকেও বুঝতে পারে না চঞ্চল কেন মানুষগুলোর ছোঁয়া পেতে চায় ? কেন দূরকে ও নিকট করতে পারে না এত ভাবনার বহরে ? কল্পনার নীরব যাত্রা কি পায়ে জায়গা পেতে পারে না? ধরে‌ ফেলতে হবে, ধরার জায়গাটাও করে দিতে হবে। ‘তোমরা এত ভাব কেন?’ ,’ কী বল হে,  দুনিয়াটা তো ভাবনার জগৎ থেকে আসে। খসে খসে পড়বে তো। না পড়লে কী বাঁচার উপায় আছে? নতুন ডালপালা গজাবে কেমন করে?’ ওরা বলে, আর দিনে দিনে কুঁজো হয়ে চলে। ‘কী অদ্ভুত জীবন না? একে শুধু সাজালে তো হবে না, মনের মতো করে সাজাতে হবে। সে সাজানোটা কেমন?’ ‘বেদনার বলছেন, না করুণার।  এগিয়ে যাবেন, না থেমে থাকাও অভ্যাস করবেন। একটু থেমে আবার চলবেন?’  ‘ মনে বড় কষ্ট বুঝলেন।’ ‘এই কষ্টের শুরু কবে থেকে?’ ‘চেপে বসে আছে, শক্তপোক্ত হয়ে। দিনটা কি মনে আছে! কে কবে এসে পুঁতে দিয়ে গেছে চারাগাছটি, গজায়নি যে ঠিকঠাক। লোকে বলে, ‘দূর হট।’ ‘বলি, এ কী তোর বাপের রাস্তা? হাঁটব তো হাঁটব, বুক চিতিয়ে হাঁটব। আপনাদের কারও কিছু বলার আছে?’ ‘কথা তো বলতে চাই, তা-ও বলতে চাই, মনের মতো। কাঁচুমাচু হয়ে শুয়েছিলাম রাতটুকু, একটুও জায়গা ছিল না।’ ‘ছুটছ কেন গো? কেউ কি তাড়া মারছে?’ বুনে শেয়ালরা জড় হয়েছে যে। কত তো অঙ্ক! এমন অঙ্ক কখনও শুনি নি গো। ‘শুভঙ্করি আর্যা’র কথা শোন নি,?’ ‘কে কার কথা শোনে? মাথাটা ঘোরাচ্ছে বুঝি। ঔষধটা সময়ে সময়ে খেয়ো কিন্তু।’ ‘ মানুষকে এমন করে ভালবাসতে তোমার একটুখানি কষ্ট হয় না? কত তো গল্প তোমার পেটে পেটে। একটু গালে আবার চুমু খেতে দেবে?’ ‘অটলদা এ-আবার শোনালে গো কেমন কথা?’

 ‘লোকটা এমন করে চলে যাচ্ছে কেন? ওর কি মরণ হয়েছে? চালচলন ভাল নয় গো, ভালোবাসা ভিক্ষে চেয়েছে, কেউ দেয়নি যে। খালি বলে, নিজে খাব, নিজে পরব। জোটে না গো, শয়ে শয়ে লোক পায়ে হাঁটতে চায়।’ ‘হাসব বুঝি একটু, কেউ কারো দিকে তাকায়‌ না। ফিরেও চায় না। কালকে ওরা আমার বউদিকে পিটিয়েছিল। বলতে পার, তুমি জান কি আমার কাছে কী ধন আছে? সব নাকি লুটপাট করে নেবে। আমাদের ঘরছাড়াতেই ওদের আনন্দ। এক টুকরো মাটিও দেয়নি যে।’ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘কেন দেব?’ কাকে প্রশ্ন করা যায় বলো তো? বক্তৃতার বহরখানা দেখ, স্বর্গের দূত যেন। আজরাইল গো, উদ্ধার করে তবে নাকি যাবে। অটল তো চঞ্চলকে দু’চামচ ভাত দিয়ে বলেছিল, ‘তোর আর একটু লাগবে, আর একটু চাই নাকি!’ ধোঁয়াটা একটু আগেই গলগল করে উঠেছিল। পোষ মানানো কী যায়! এঘর থেকে ওঘরে যায়, কত গল্পস্বল্প করে আবার তো ফিরে আসে। ফিরে ফিরে আসে। অচেতন, ঘুম, আধা ঘুম, ঘোরে থাকে, আধা ঘোরে থাকে। আচ্ছা বল দেখি,’তাপটা না উঠলে চালটা ফুটবে কেমন করে? আধা সেদ্ধ ভাত কি খাওয়া যায়?’ ওরা বলে, ‘খাওয়া যায়। খেতে অভ্যাস কর, খেতে খেতে সব শিখে যাবি। 

অটলের কি হয়েছে ও নাকি কোন কিছু চিনতে পারছে না, সব কিছু ঘোর অন্ধকার লাগে। দেখতো চঞ্চল যে দিকে তাকায়, কোথাও নাকি একটুও কালো নেই। ও বিশ্বাস করে আর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে সকল কিছু ভাঙচুর হয়ে সব নাকি নতুন হয়ে যাচ্ছে। কি জানি কেন ওর মনে নয় আর তাতেই নাকি ওর সকল কিছুকেই আদর করতে ইচ্ছে করে। আরে ও তাই বলে যেখানে যায়, জড়িয়ে মড়িয়ে যায়, এই এক পাগল ছেলে। কথাটা কি জান, পাগলের অভিনয়টা করতেই শেখেনি, ও নাকি আবার জ্যান্ত মানুষ চায়, যাকে পায়, তাকে ছোঁয়। কান্ডখানা দেখনি। এমন মানুষ পাবে কেমন করে! না, না, বুঝলে না, সব কেমন অগোছালো। আমার মাথাটা দেখেছ কেমন বড় বড়, লোকে বলে তাই নাকি আমার এত বুদ্ধি। ও আমাকে বিলুর গল্প বলে। বিলুকে ও যেমন করে দেখেছে, তেমন করে আর কেউ দেখে নি। ও আবার নাকি সবকিছু সব ঘেঁটে ঘেঁটে দেখে। ‘আচ্ছা, আপনারাই বলুন, আমি এমন করে দেখতে শিখিনি তো! এই তো  এক আজব কাণ্ড কারখানা। ওরা নাকি প্রবল তান্ডব থেকে রেহাই পেতে অগ্ৰিম বায়না ধরেছিল যদি জীবনের উষ্ণতাকে বাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে পারে কয়েক ধাপ, অভিশপ্ত সময় থেকে রেহাই পেয়ে ইচ্ছেগুলোকে ওলট পালট করে দিতে পারে। যারা ছুটে আসছিল সীমানার ওপারে গিয়ে দেখে নেবে, আর কতটা উঁচুতে উঠলে চিনে নিতে পারবে পূর্বসূরিরা কোথায় কেমন করে বসেছিল, কী ছিল তাদের অভিপ্রায়? ওদের মাথার খুলিটা ধরে ওরাই নাড়িয়ে দেখল, কতটা বোঝা  পিঠে চাপিয়ে দিলে মাথাটাকে রেহাই দিতে পারবে! অটল এই গোপন ইচ্ছেটা জানিয়ে দিচ্ছিল পথেঘাটে, মোড়ের মাথায়, গোলপোস্টের কিনারে, বার্তাবাহকদের গন্তব্যস্থলে। 

‘মুক্তি!’ শব্দটা জোরে এসে ধাক্কা মারল কেন, মুহূর্তটাকে বোধে আনতেই সময় ক্ষয় করে ফেলল অনেকটা। চঞ্চলকে এই বলে কথার লড়াই চালালে কতটা ওর ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে পারল এই নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলে যেই উত্তরটার জন্ম হল, ‘ পাওয়ার কথা কি ছিল, তবুও তো পেলি, আর দু-ঘন্টা বেগার খেটে দে। গরু ছাগলরা ঘুরে মরছে, তোরা কোন জমিদারের বেটা?’ ওরা কাঁদল, খুব কাঁদল, পথ খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল, নিজের ভাষাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ দেরি হোক তাও সই।’ চোখ বড় বড় করে বলল, ‘ভাবখানা ভুলেছি বেশ করেছি, মায়াদয়ার কোমল স্থানগুলোতে পট্টি পরিয়েছি, এর চেয়ে বেশি রোগদের  নেমন্তন্ন তো করি নি। অটল হাঁক লাগাল, ‘ধীরে চল বাপু, গোলামি থেকে এত সহজে মুক্তি পাবে, এই কথাটা তোমাদের কে বলেছে? ষণ্ডাগুণ্ডাদের যা উৎপাত, থলে কেড়ে নেবে, পকেট কেটে ফাঁক করে দেবে, তাতেও কি রক্ষা মিলবে, তোমার ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে চোখ টাটাবে। বলবে এত নাচানাচি করিস না বাপ, বাজারঘাট করে দিস, থালাবাসন মেজে মুছে দিস, ফায় ফরমাস না খাটলে চলবে কেন? এই যে দু’চার পয়সা তারা দয়া-দাক্ষিণ্য করে হাতে গুঁজে দিলেন তোরা ধন্য ধন্য করিস, ওই টাকার মালিক কে জানিস?’ দু’আঙুলের টুসকি মেরে বলে, ‘ওটা আমাদের!’ ‘তোমরা আমাদের নয়, কাদের তাহলে ? এই দেশে থাক কেন? কে তোমাদের থাকতে বলেছে?’ ‘এত জ্ঞানগম্মী তোমার অটলদা। এত বুদ্ধি তুমি কি ধার করেছ, না সবটাই নিজের?’ এই কথাটা তো ভেবে দেখেনি কখনও। কার মাথায় কখন যে কি এসে যায়। আহা, এমন কথার যদি কোনদিন সামনে এসে বলাবলি করত, ‘ আয়, আয় ওই তো সব সুখের দিন আসছে, গোটা দেশটাই অহল্যার মতো উদ্ধার পেয়ে যাবে একদিন।’ ওরা সক্বলে অটলের কথা শুনে হো হো করে হাসলো, না কাঁদল, কিছুই বোঝা গেল না।

ডান হাতে লাঠিটা বন বন করে ঘোরাতে গিয়ে শুনে ফেলল, ‘ কারা যেন কান্না করছে।’ যারা মাঝে মাঝেই ওর পিছু নেয়, রহস্য করে বলতে শুরু করে, ‘পৃথিবীটাই কাঁদছে বোধ হয়।’ নিষ্ঠুরতার থেকেই জন্ম নেয় আর এক কান্নার। বিলুর কিন্তু তা মনে হল না। এমন কান্নার স্রোতে ও জীবনে কোনদিন ভেসে যায়নি। শোনা যাচ্ছে, অথচ শোনা যাচ্ছে না, নিজের মতো করে একটা আকারের আয়োজন করছে। বিরুপ রুপে ওরা যে ধরা দিতে চায়, সেটা গৌরবের না অনাসক্ত, তাদের চোখের জল ওদেরও অজানা, তাদের জন্য তারাই বা কতটুকু জানে। বিলুর মায়ায় যারা পথের ইশারায় মাতে তাদেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিলুর পায়চারিটা আজ অন্যরকম, বেসামাল, বেঘোরে। চিন্তায় কোন দৈন্যতা এসে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিনা কে জানে। কালভার্টের ভাঙাচোরা টুকরোগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে গলগল করে। ওদের পাতা ঘর সংসার গুলোতে আঁধারের কোনে কোনে টুকরো টুকরো আলোগুলো উঁকিঝুঁকি দেয়। পিলপিল করে বেরিয়ে আসে কিশোর কিশোরীদের দল। ওরা ডাংগুলি খেলতে খেলতে দলে দলে ভাগ হয়ে গেলে শক্তির উচ্ছাসে ফেটে পড়তে দেখে ভাবতে কষ্ট হয় ওদের আধপেটা খাইয়ে একা করে দিয়ে চলে গেছে এঘর থেকে ওঘরের মানুষজন। বিলুর চিন্তার ধরণেও এক আশ্চর্য পরিবর্তন এসেছে। কেন এল, কীসের জন্য এই ভাব পরিবর্তন, এই প্রশ্নে অনেকে নিরুত্তর। মানুষ যায়, মানুষ আসে,  হুড়মুড় করে মানুষের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। ওরাও ছুঁচো আর ইঁদুর হয়ে ঘর-গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ কাউকে সোনা মনা ধনা নানা নামে ডাকাডাকি করে, তারপরে পচা পেটের গন্ধে চারপাশের রাতের বাতাস আরও বিষাক্ত হয়ে এলে ওই কোন অঞ্চল থেকে তিন চারটে লাইন বরাবর শুধুই রেল ইঞ্জিন, মালগাড়ি, মানুষের গাড়িগুলো নিজের থামা-চলার কাজ সেরে গড়াতে আরম্ভ করে। ওরা ঘর-গর্ত থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে যেতে আরম্ভ করলে বিলুর দলের মনে হতে থাকে জীবনটা শুরু হয়ে গেছে। ওর ছড়ির জাদুখেলা কীভাবে শুরু হয়ে যাবে কেউ জানে না, শহরটাও জানে না। পেঁ পোঁ, ভটর ভটর, ঘ্যাঁচ ঘুঁচ, ঝিকঝাক, মচর মচর, টুং টাং ওরা সব নানা বৃত্তে যে খেলা শুরু করে, ঘর-গর্তের মানুষ-জন্তুরাও জড়িয়ে পড়ে। ওরা লাথ খায়, এমন জোরে খায় চিৎপটাং হয়ে লোহার চাকতির মতো ঘুরতে শুরু করে। খাড়া হয়ে মাথা উঁচু করে যারা জীবনের স্টিয়ারিং ঘোরাতে আরম্ভ করে, ওদের পংক্তিটা চাওয়া না-চাওয়ার হিসাব কষে না। ‘যা, যা, প্যাঁক প্যাঁক করিস না, কোন কিছু হবার নয়, বুঝলি না, পথ দেখ, আরও বার চারেক ঘুরে ফিরে আয়, খিস্তি-খেউর হজম করতে শিখ, এলাইনমেন্ট, সাইলেঞ্চার মেরামত করা এত খেলো কাজ নয়, এলাম আর জয় করলাম, এলেমদার লোক দরকার।’ মাথা নিচু করে ঘন্টুরাম যন্তরটা উঁচু করে হোসপাইপটা চালিয়ে দিলে যত দাগদুগ নিমেষে ভ্যানিস। ‘তোর মূরোদ ঐটুকুই, বুঝলি না, সকলে ব্যাটন নিয়ে ছুটতে পারে না কিনা, এই দুনিয়াটা একটা রিলে রেস, একটুখানি এধার ওধার হলো তো খেল খতম। ঐ সাদা আ্যপ্রন পরা বড় বাবুকে দেখেছিস, কেমন রেলা মেরে চলে, আসলে একটা ঘেঁচু, অষ্টরম্ভা, কাঁপাকাঁপি শুরু করে।  রেস্তর জোর আছে তো, এমন লোক যেই না দেখল, পায়ে পড়ে যায় আর কি।’ ঘর-গর্তের এক দঙ্গল দলে দলে ভাগ হয়ে বাস স্ট্যান্ডের লাইনে, বিরানি’র হাঁড়ির ডান দিক বাঁদিক, খান পঞ্চাশেক ফুটপাতের দোকানের সামনে সেই কী হুজ্জতি। ঘুরে ঘুরে সব দেখে, আর গামছা পেতে গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে কত কিছু ও যে জুড়ে দেয়, মুখস্ত বলে যায়, এর তার কথা, রসকস মিশিয়ে লাখো লাখো লোকের গল্প শোনায়। আসলে এমন গল্প শোনায়, এই লোক ওই জীবন চেনে না তো, ওই লোক এর কথা শোনে না। ওই যে বলল না রসিয়ে রসিয়ে এমন লোকের গল্প, খাওয়ার জোটে না, কেমন করে ট্যাক্সি চড়ে ঘোরে। বিলুর ছড়িটার খেমতা আছে, ঘোরালে গল্পগুলো কেমন ফরফর করে বেরিয়ে আসে।’ ‘এই খেঁচুনির বেটা এখানেও গ্যাঁজা দিচ্ছে।’ বিলু আসলে কি জানাতে চায়, কেমন করে জানালে এই শহরের মানুষগুলোকে বুঝে নিতে পারবে। ওরা বিদ্রুপের মশলা মাখিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ কথা ওরা ওর দিকে ছুঁড়ে দেয়। কেউ কাউকে ধরতেই জানে না। একটু আগেই ও বসন্তকে দেখেছিল, কেমন করে বলার কথা শোনাচ্ছে আর শিখিয়ে দিচ্ছে, ‘জ্যান্ত থাকাটা একটা বিদ্যা, ও জানে, জানাতে চায়, পছন্দ নিজের নিজের।’ মা কালীর মায়াময়ী মূর্তিটার ছবি ও জোগাড় করে নিয়েছিল। পিলারের গায়ে টাঙিয়ে দিয়েছিল ছোট্ট একটা বাক্স। বাক্সতে রয়েছে একটা গর্ত। পদ্ধতিটা শিখেছিল নিশ্চুপ হয়ে। ওই গরীব-গুরবো লোকগুলোকে ফল খাওয়াবে বলেই না বুদ্ধিটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। ও চিৎকার করে বলেই তো বেড়ায়, ‘ও বেটি আমার এখানে, ভেতরে যাবার দরকার কী!’ শুনিয়েই তো দিল পথিক, ‘ দামী কথা বলেছ হে। লাখ কথার এক কথা, দ্যাশের মাইনষে বুঝল নি।’ 

বিলু কি ওই উত্তর খুঁজবে বলে ওই থরে থরে চাতালের নিচে বইয়ের বাগানে ফুল ফোটাতে যাবে, পাতার পর পাতা ওলটাবে। ‘ওই লোকটার ঝোলাতেই বা কি?’ ‘ওমা তাও জানো না, একটু দাঁড়িয়ে যাও না বাপ, দেখবে ও কেমন জাদু জানে। তোমার জীবনের গল্প তো রয়েছে। ‘তা তো আছে।’ ‘কত ভাবেই না ভেবেছে। বয়স কত?’ ‘কী!’ ‘বলছি বয়স কত?’ ‘এই ধরে নাও পঞ্চান্ন’র কোঠায়।’ ‘কর কি?’ ‘ জাহাজ এসে নোঙ্গর করলে গোডাউনে মাল বয়ে বয়ে নিয়ে যাই। মজদুর বলতি পার।’ ‘ তোমাদের কথা কেউ কি বলে?’ ‘কে আর বলে বাপ। কন্ট্রাক্টর বাবুর দিনরাত গাল খেয়ে মরি।’ ‘ সরকার বাহাদুর তোমাদের কথা বলে’ ‘সরকার! তাঁর কত কাজ। তিনি আমাদের কথা শুনতে যাবে কোন দুঃখে, বলেন দেখি। ছাপোষা লোকের কথা কেউ কি কোনকালে ভেবেছে। বাপ-ঠাকুরদার মুখে কত গল্প শোনা। আমার ঠাকুরদার বাপের বাপ ক্ষেতমজুর ছিল গো। কত মারটাই না খেয়েছে।  এই কি যেই সেই মার,চাবুকের মার। আমাদের গ্যারামে কত্ত বড় মন্দির বাইনেছে জমিদারবাবু সেই কত্ত বছর আগে। বংশধররা আসে, বছরে বারোয়ারি পূজার সময়, খিচুরী খাওয়ায়। আর আমরা হলেম গিয়ে মজদুর। ইউনিয়ন বাবুরা আমাদের তাই তো বলে। আচ্ছা বলেন দেখি আমাদের অন্য নাম হতি পারে না?’ ‘পারে, পারে, অবশ্যই পারে। ওই যে লোকটারে দেখতে আছ, ও তো তোমাদের গল্পই বলে। দেখনা, তোমার জীবনের কত গল্প জমা হয়ে আছে। গড়গড় করে বলে তো ফেললে। আমাদের আরও অনেক গল্প আছে। আমরা জানতেও পারি না, বুঝতেও পারিনা। ওই লোকটা বুঝতে পেরে আমাদের না জানা গল্পগুলোই বলে। ‘ তুমি কি কাম কর? ‘শিল্পী বলে লোকে। আমি কিন্তু নিজেকে শিল্পের চাকর বাকর বলি।’ ‘ সে আবার কেমন কাম?’ ‘ লোকে তেমন পাত্তাটাত্তা দেয় না। চৌমাথা তেমাথার মোড়ে মোড়ে ঠাকুর দেবতার ছবি এঁকে বেড়াই। ‘ছবির ইসকুলে গেছিলে বুঝি?’ ‘আমাকেও বাপ শিখাইছে। বলেছিল, ‘জায়গা জমিন তো নাই, তোকে এই বিদ্যাটাই দিয়ে গেলাম।’ বাপই হলেন গিয়ে আমার গুরু। এই লোকটা একদিন আমার জীবনের গল্পটাই আমাকে অন্য রকম করে শোনাল। ঊরি ব্বাস! শুনি তো আমি  আকাশ থেকে পড়লাম। আমার নাড়ী নক্ষত্র সব জানে। শুধু আমার! আরও তো আমাদের মতো কত লোকের কথা জানে। কেমন করে শুনল কী জানি! এই বড় আজব বিদ্যা, রপ্ত করেছে বটে, এলেম আছে।’  ‘তাইলে তো শুনতি হয়। একটু বসি না হয়, কি বল?’ ‘সময় তো আজ আর নেই গো। সূয্যি যখন অন্য দেশে যায়, তখন ওই লোকটাও ছুটি নেয়।’ ‘ তাহলে আর ওর মুখে নিজের গল্পগুলো শুনতি পাব না?’ ‘ ভাগ্যি থাকলে শুনতি পাবা একদিন।’ ‘ আচ্ছা, আমার আর কী কী গল্প থাকতি পারে বলে তোমার মনে হয়!’  ‘আচ্ছা, সে যদি আমি নিজে জানতে পারতুম তাহলে এত কথা বিলুকে নিয়ে বলতে যাব কেন! সক্বলের জন্য সকল কাজ নয়। সক্বলের মগজ আর মনটা এক নয়। ‘ ও এই সবগুলো জানতে গেলে বুঝি মগজ আর মনের দরকার পড়ে। এতই তখন বিদ্যাবুদ্ধি, তবে আর এসব করে বেড়ায় কেন গো?’ ‘এইসব ওর কাজ বলে।’ ‘যা, এইসব আবার কাজ হল, লোকের কথা লোককে শোনানো।’ ‘কাজ নয়! ,তাহলে তুমিই বা শুনতে চাইছ কেন?’ ‘হ্যাঁ, তাই তো আমিই বা শুনতি চাইছি কেন! এ তো ভারি অবাক কাণ্ড। মনের যে এত ইচ্ছে হয়, আগে তো জানতুম না।’

রোজদিন তো সূর্য একই সময়ে অস্ত যায় না। কালো কালো মেঘ এসে পৃথিবীটাকে আর পৃথিবীর মানুষগুলোকে ঢেকে দেয়। সেই দিনটায় কোনো মানুষ অন্য মানুষকে চিনতে পারে না। সূর্য চন্দ্র পৃথিবীটা একই সরলরেখায় চলে এলে আঁধারের সঙ্গে ‘মহিমা’ শব্দটা এসে জুড়ে যায় কখনও। অবস্থাটা মহাকাশ বিজ্ঞানের চর্চার বিষয়, একথা সত্যি তো বটেই, তাবৎ প্রাণীকুল এমন এক বিষ্ময়কর অবস্থার আড়াল আবডালে গিয়ে নিজেকে ধন্য ধন্য করবে না মহাজাগতিক কর্মকান্ডকে প্রত্যক্ষ করে, এই কথাটা মিথ্যা হবেই বা কেমন করে? বিলুর  বয়স কিইবা ছিল, কেমন ছিল তার মনের গতি, কল্পনার চূড়ায় উঠে সেই মানুষগুলোর চিন্তাশক্তি আজ শতচ্ছিন্ন হয়ে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বা থাকা উচিত ছিল এই জবাবই বা কে দেবে? বিলু ছড়িটা আবারও ঘোরাতে আরম্ভ করে, জেনে নিতে চায় নিজের কাছ থেকে ‘মানুষ কি সেই অদ্ভুত আঁধারের পরশ পেয়ে নিজের ঘুমন্ত মানুষটাকে টেনে আনতে পেরেছে নাকি ওই ক্ষণিকের অন্ধকার পৃথিবীর সাক্ষী হয়েছে কয়েক গুণ। পাওনাগণ্ডার হিসেব যারা করবেন বা যারা হিসেব চাইবেন, তার মূল্যায়ন হতে পারে এইভাবে – আসলে প্রকৃতি কী কী চায় আর কী কী ফিরিয়ে দিতে পারে। বিলু এই গোটা মানবজাতির একজন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির মানুষ হয়ে কি এমন চাইতে পারে, যার জন্ম হয়েছে সাত বাই পাঁচ ফুট পাট কাঠির বেড়ার মাটির মেঝেতে বাঁশের ছিলায় নাড়ী কেটে, কাঁচা মাটির উপর খড়ের বিছানায় ওঁয়া ওঁয়া শব্দে সেই আলোর ছোঁয়ায় গড়াগড়ি খেয়েছে, এই অন্ধকার পৃথিবীর মুহূর্তের সত্যিই কি কোন মূল্য আছে ? হয়তোবা আছে, হয়তোবা নেই, কিন্তু মুহূর্তের চাক্ষুস করেছে এটা তো মিথ্যা নয়। হ্যাঁ, এই প্রতিক্ষণ নিয়েই বিলু জীবনটাকে দেখতে চায়। যে মানুষটিকে ভিড়ের মধ্যে এইমাত্র ও দেখেছিল, মানুষটা কোথায় যে হারিয়ে গেল, ভিড়টাও একে একে শূন্য হয়ে গেল, তারা কারা ছিল, লোকটিই বা কে? মুহূর্তের দামটা যে একেবারেই উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ওই মুহুর্তে গড়নের ভূমিকাটা অস্বীকার করবে কার সাধ্য। ভিড়ের মাঝখানের ওই লোকটির কোন একটি কল্পনা ভাবনার স্রোতে মিশে গিয়ে জুড়ে দিয়েছে কোন এক শূন্যতাকে যা কিনা দুঃসাধ্যই ছিল পূর্ণ করার। বিলু তাই তো বলে মুহূর্তকে অবহেলা নয়, চঞ্চল অটলকেও নয়, ওই নিকষ অন্ধকারে ডালে বসে থাকা বিস্মিত কাকটাকেও নয়, স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল কিনা ডেকে ডেকে, ‘প্রকৃতির এই বিষ্ময়কে যতক্ষণ যত খুশি দেখে নাও।’

বিলুর এই আকাঙ্খাকে চিনে নেওয়া নিজের ভূমির আপন বৃত্তে বিচরণ ছাড়া আর কি। নতুন ভাবে মেলে ধরবে বলেই তো চেনা ছকটাকে ভেঙে ফেলতে চায় বিলু। প্রাণের উৎসকে একই সূত্রে গেঁথে দিয়ে জানাতে চায়, ‘তোমরা তোমাদের উৎস আর পরিণতির সম্পর্কটাকে জুড়ে দাও অন্য ঢঙে, ঘর বেঘর হওয়ার কারণটা হাতের মুঠোয় এসে যাবে দিনেকালে। বিনু শোনাতে শুরু করে নতুন গল্প। বরুণ হাত জোর করে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে। হাতটা নামিয়ে দিয়েই বলেছিল, ‘হাতে হাত মেলাও না বাপু, তুমি তো কোন হিংস্র জন্তুর সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি করছ না। কোন লুকোচুরিও নয় জোচ্চুরি নয়, নিজের মাটির উপর নিজেই দাঁড়িয়ে কথা বলছ। বিলুর শব্দের মায়া বরুণকে মাতিয়ে দিয়ে বলে, ‘চাকরিটা খোয়াব নাকি, দারোয়ান বই তো নই’। বিলু ওর হাতের ছড়িটা  ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখি তো কেমন থামাতে পার? পারোনি তো! এবার তোমার দেখার মতো ঘুরিয়ে দিচ্ছি। দেখলে তো কেমন সুন্দর ধরে ফেললে। দোকানটা মালিকের কিন্তু খরিদ্দারের মুখোমুখি হচ্ছ তুমি। ওদের খুশি অখুশি তোমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে। চেয়ার কথা বলে না, মানুষ কথা বলে।’ বরুণের ভাবনাকে বিলুর চিন্তা ওলট পালট করে দেয়। বরুণ বোঝার চেষ্টা করে কোথায় বিলুর কথার জাদু। লোকের মুখে গল্প শুনেই না ও ভিড়ে এসে গা ঘষেছিল। এই কথাগুলো অন্যের মুখে শুনলে আজগুবি মনে হতো, বিস্বাদ লাগত। বিলু ছড়িটাকে বনবন করে ঘুরিয়ে দেয়। বিদায়ক্ষণ বুঝতে পেরে ভিড় পাতলা হতে শুরু করে। ‘কোথায় ওর পথের জমায়েত হবে?’ ‘লোকটা এইভাবে কথা বেঁচে খায়!’ ‘কোথায় বেচতে দেখলে! এটি ওর সত্য কথা বলার পুরস্কার। অন্য জমায়েতে কেমন করে ফিরিয়ে দেবে, দেখবে চল।’ বদ লোকটা বলল, ‘ গোটা শহর জুড়ে এমন তান্ডব চলে!’ ‘তোমার একটুও লজ্জা করল না, ‘তান্ডব’ শব্দটা এমন বিচ্ছিরিভাবে উচ্চারণ করলে।’ ‘কোন নতুন কথা বলার ঢঙ রপ্ত করতে পারলে না? কেন আস সময় খরচা করে?’ ‘ বন্ধু বলল, ‘চল, বিলুর বকবকানি শুনবি, কত লোকই তো শোনে। লোকটা উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে, তবু লোকে বুঁদ হয়ে শোনে যেন এমন কথা আগে কেউ বলে নি।’ ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমাকে কেউ ল্যাংটাকে খুঁজে দেবে?’

‘সে আবার কে বিলুদা?’ ‘ ওকে আমার খুব দরকার, খুঁজে তো পাচ্ছি না, কি করি বলতো?’ ‘দেখতে কেমন? কোন ছবিটবি আছে?’ বিলুকে নিরুত্তর দেখে লোকটা আর কথা বাড়ায় না। 

এক পথচারী গলার আওয়াজেই চিনে ফেলে বলল, ‘বিলুদা না?’ ওই মোড়ে চঞ্চল, অটলরাও এসেছে শুনবে বলে, বিলু আজ নতুন কী এমন কথা বলে। শহরের ছাপোষা লোকগুলো ওর কথা শোনার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে, কি এমন কথা যা ও নতুন ভাবে শুনবে। লোকে ওই প্যাঁচপ্যাঁচে পুরণো কথা আর শুনতে চায় না। বেঁটে কালো লোকটার মধ্যে এত কথার জন্ম হয় কি করে? নির্ঘাত মা সরস্বতী ওর জিভে এসে ভর করেছে। ‘আজব এক পৃথিবী আর পৃথিবীর মালিক, হাভাতের মগজে সব কথা গুঁজে দিয়েছে। এসব ওর কোন কাজে লাগবে!’ ‘ তা বেটা, তুই পেলে তো সব ঝেড়ে খাবি। শুনতে হয় শোন, না হয় কেটে পড়।’ যা বলতে চাস তাড়াতাড়ি বল না বাপ, আলো যাবে চলে তখন হবে সমূহ সর্বনাশ! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের নিয়মকেও হার মানায় বিলুর এই স্বঘোষিত নিয়ম। এমন বক্তা আর তার নিয়ম ইহকালে দেখি নি।’ উপদেশ ও নির্দেশ কোনটাই বিলুর বিবেচনায় জায়গা পেতনা। যন্ত্রণায় ও বেদনায় নিজের মুক্তিকে নিজেই আঁকড়ে ধরতেই বোধ হয়। পথ খুঁজতে গিয়ে পেয়ে যেত লম্বা সময়ের মাটি চাপা পড়া মরা নদীর গন্ধ। নিরূপায় নিরুদ্দেশ যাত্রায় তরণীর সহযাত্রী সাজিয়ে পাড়ি জমাতে চাইত বিলু যাদের তারা আর কেউ নয়, যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে চলা নিজের ভূমির নির্বাসিত মানুষজন। ল্যাংটাকে কখন যে ও দেখে ফেলেছিল, আর কী এমন দেখে ফেলেছিল, আর কেনইবা দূরে গিয়েও কাছে আসতে চাইছিল আর সেই তাড়নাতেই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে ছায়াময় কায়া ল্যাংটাকে।

ল্যাংটা দৌড়চ্ছে, প্রাণপনে দৌড়চ্ছে। যদি ওকে কেউ চিনে ফেলে। ও কী এদের রক্তের মূল্য ফিরিয়ে দিতে পারবে না কোনদিন? আক্রমণের ভয়! বন্দী হয়ে যাওয়ার ভয়! নাকি বিলুই ওর ছায়া হয়ে উঠছিল এমন এক আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিল ওর মন। খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছিল উৎক্ষেপণের সংবাদ ছড়ায় যেমন কোনে কোনে। আশা নিরাশার, সাফল্য অসাফল্য মাথায় চেপে বসে বিলুর । কত লোকই তো রুটি রোজগারের আশায় দলে দলে নতুন রাস্তায় পা রাখছে। ঢাক ঢোল পেটাচ্ছে, পৈতে পরে নকল পুরোহিত সেজে মন্ত্র আওড়াচ্ছে। কার কাছে যে ধরা পড়ে যাচ্ছে, ঘোমটা দিয়ে মুখ লুকোচ্ছে। চেনা তো ল্যাংটাকে সহজ কথা নয়! শব্দগুলো পাল্টে ফেলেছে, গলার স্বর পাল্টে গেছে, কথার বিষয় পাল্টেছে। কোন পথ দিয়ে গেলে ওকে ধরে ফেলতে পারবে? ওকে তো ধরে ফেলতে হবে। অন্তত ছায়াটা ঘন হয়ে এলে ওর অবয়বটা জাপটে ধরে ফেলা সহজ হয়ে যাবে। দু’জনেই যে দুজনকেই চায়, তবে কেন এত লুকোচুরি! এর উত্তর খুঁজে বের করতেই হবে। ছোট ছোট গলিপথে ও খুঁজবে বলে পথের মানচিত্র এঁকে নিয়েছিল। সংশয় তো ছেড়ে কথা বলে না। ছায়াটা দীর্ঘ হলে ল্যাংটা নিজেকেই চিনতে পারে না, অন্যকে ধরা দেবে কী! রূপের এই বাহ্যিক পরিবর্তন অন্তরের পরিবর্তনের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে নামে। বিলু ভাবে  এই রূপান্তর মহাজাগতিক অদল বদলের চেয়ে কম কীসে! তাই বলে কি ফাঁকি দেবে, এমনটা কী চলতে দেওয়া যায়, না দেওয়া উচিৎ! এই কথার উত্তর জনপদের কোলাহল থেকে জন্ম নেওয়ার কথা নয়, মানসিক বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নিলেও নিতে পারে। বিলু জানে ল্যাংটা বারবার এই জনসমুদ্রে ফিরে আসতে চাইছে, এর উত্তর না দিলেই যে চলছিল না। কিন্তু হতদরিদ্র, কাঙালি, অনাথ, পাতকুড়ানিদের যে জায়গাটা জরুরি এই কথা অস্বীকার করবে কে? ফেরিওয়ালা, হকার, মাংসের, কাপড়ের, ওষুধের, দশকর্মভাণ্ডার, লোহার, ইমারতি, মুদির, মনিহারি শুঁড়িখানায় করেকম্মে যারা দিনরাত ঘাম ঝরাচ্ছে তাদের জমে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর যে বিলুকে দিতে হবে, পালিয়ে তো পার পাবে না, যাক না মন্দির মসজিদ গীর্জায়। ইহকালে, না হয় ধরাই গেল পরকাল, নিত্য নতুন জীবন হচ্ছে, কত কথার বুদবুদ হচ্ছে, উত্তর তো চাই নাকি, উত্তরের যে কত রকমের ফাঁকফোকর। ওরাই খালি মানুষ, এরা কি কেউ নয়! বটেই তো, জন্মেছে যখন ধরাধামে, মানুষ নয় একথা কী কেউ বলতে পারে, না বলা উচিত! ‘ ও বিলুদা, তুমি কোথায় গেলে গো?’ ‘সত্যি দেখনি বুঝি। পথটা যে ওখানে গিয়ে ঠেকেছে, তবে গেল কোথায়! লোকটার মাথায় যে কখন কী ভূত চাপে, কে জানে।’ ‘তোরা এত ভাবিস না তো, যখন আমাদের কথা মনে পড়বে, তখন এসে যাবে। টান, মনের টান বলে তো একটা বস্তু আছে না নাকি। আমাদের বাদ দিয়ে যে চলবে সেটা আবার হয় নাকি!’  ‘আমাদেরকে গনায় না ধরলে দেশটা হবে কি করে, দেশটাকে মানাবেই বা কী করে! আমরা আছি বলেই না দেশটা চলছে, নাকি!’ 

বিলুর চোখের সামনেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। ল্যাংটার ছায়াটা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে যাচ্ছে। বিলু অনেক কসরত করলেও, অনুনয় বিনয় করলেও মাটি ছোঁয়ার নামটি করছে না। এত বিষোদগার কেন? বিলু এ কী দেখছে! আকাশের এত ভাবান্তর! মাটিকে আগলাবার ব্যাকুলতা কেন? এইভাবেই কি কোনদিন পরিবর্তন আসবে? ভালো লাগা মন্দ লাগার ইচ্ছেটা নিজের খুশিমতো পাল্টাতে থাকবে! ল্যাংটা ছোট হয়ে যাচ্ছে আবার। জমি, গাছগাছালি, ফুলফলাদি, মানুষ এইসবের জন্য ল্যাংটার আচ্ছন্নতা চাঙ্গা হয়ে উঠছে। অন্য কোথাও যাচ্ছে না তো। মানুষ হয়ে মানুষকে যারা জায়গা দেয়নি, ল্যাংটা যাচ্ছে তো ঝুপড়ির মানুষগুলোর কাছে। হাঁড়িতে ফুটছে কন্ট্রোলের চাল। পোকা বেছে বেছে ফেলে দিয়েছিল। ওই তো কোলের ছেলেটি ভুল করে কুড়িয়ে নিয়ে ঢুকিয়েছে ঠোঁটের কোনায়। খুঁটিতে ঝুলছে বাসি শাড়ি আধাআধি ভাঁজ করা। যাবে নাকি সেই টাইম কলের লম্বা লাইনে, ঝগড়াঝাঁটি সুখ দুঃখের গল্প আওড়াচ্ছে ওরা কেমন। কী কটু কথা, মিলমিশ নেই একথা কে বলে! কত কথা শেষ হয়ে যায় না। অনেক কথা হয় নিঃশেষ। ল্যাংটা আসলে নিজের অবিশ্বাসকে কখনও কখনও বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে গিয়ে দেখে আসলে অবিশ্বাসই বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষের চেহারাটা ওর কাছে ধরা পড়ছে না, উল্টো করে ওর নিজের দেখাটাই হয়ে উঠছে মানুষের চেহারা যা কোন কালেই সত্য নয়। ছুটে বেড়াচ্ছে ও পাগলের মতো। পাগল অসুস্থ মানুষ কিনা জানা নেই। পাগলরাই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। জানাতে চেয়েছে, কারো দেখা ও দেখানোটাই সিন্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে না। বিলু ল্যাংটার এই ছোট হয়ে যাওয়াটাকে তাই আন্দাজ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ও চাইছে ল্যাংটা নিচে নেমে আসুক, আরও ছোট হয়ে যাক, সাজিয়ে দিক নিজের মতো। ঝাঁপ দিক গনগনে আগুন থেকে জলে, পৃথিবীটাকে ঠাণ্ডা করে দিক। জীবনের উত্তাপ থেকে মৃত্যুকে সহজ করে নিক। মৃত্যু যদি সহজ হয়ে যাবে, জীবন এত কঠিন কেন? এই প্রশ্ন সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই করে বসবে ল্যাংটাকে কোন একদিন। কে টিকে থাকবে আর কারাইবা টিকে থাকবে, এরও উত্তর চাইবে ব‌ই কী! ল্যাংটার নতুন মতাদর্শকে আগলে ধরা ‘শুভ লক্ষণ’। কত দ্রুত স্থান পরিবর্তন করছে, এ-ও কিন্তু লক্ষণীয়। বাড়িগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, ওরা রোগাক্রান্ত হয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে। ওরা হাত-পা নেড়েচেড়ে কামনা করছে ‘ জীবন ফিরিয়ে দাও।’ ল্যাংটা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

এতক্ষণ বিলু যা দেখছিল, না ভাবনার প্রশ্রয় দিচ্ছিল বিলু ছাড়া আর কেইবা বলতে চায়, জানতে চায়। জানার কথাটা এতটা গুরুত্ব যখন পেলই, শতাংশের হিসেব কষে নব্বই ভাগ লোককেই ধরে ফেলা যাক। ইতিমধ্যেই ওরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। না, কোন প্রশ্ন নয়, এক নজর দেখে মনের সাধ মেটানো। হারানো প্রাপ্তির নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনের পরের পর্বে যে প্রশমিত উত্তেজনার প্রবাহ থাকে, তার বাকি অংশটা, অচঞ্চল, ধীর ও শান্তির নির্জনতা। ওরা এমনভাবে দেখবে বলেই নিজের নিজের জায়গাটুকু ছেড়ে অন্য এক পথের এমন মোড়ে এসে হাজির হলো, বিলু বলেই চলে, ‘বাতাসের শনশন শব্দ কানে আসবে ভেসে যখন, জানবে এটা তোমাদের কন্ঠস্বর, কথার জালে আটকা পড়ে গেলে জানবে এটা তোমাদের বোকা বানানোর আয়োজন. ঝনঝন শব্দ যদি কানে বাজে, জানবে তোমাদের ফাঁদে ফেলবে বলে জাল পেতেছে।’ ওরা কতদিন অভুক্ত শরীরটাকে টেনেটুনে এনে অপেক্ষা করেছে, আজ ওরা এমন বৃত্ত রচনা করেছে ওদের নিজেদের মুখগুলো হয়েছে জ্বলন্ত অঙ্গার যেন, ধিকি ধিকি করে জ্বলছে, ওরা নিজেরাও জানে না কবে নিভবে। কী  আসুরিক শক্তিতে ওরা বলীয়ান হয়েছে, কেউ চাইল কি চাইল না কী আসে যায়! ফিরে যাওয়ার পথ যে আর খোলা নেই। পরের পিড়ির মুখগুলো যে কোনও মূল্যে জ্যান্ত রাখতে চাইবেই চাইবে। কাকটা কা কা করে উঠল এমন মিষ্টি স্বরে, চঞ্চল আর অটলের দেখানো পথটাকে রয়ে গেছে কত রকমের দাগ, ওরা শুনতেও পেল না বিলুর নতুন শেখানো কথা আর কোনো উন্মুক্ত পথ কিনা। গুয়ের গন্ধ যেন বেরুচ্ছে শুধু ওদের গা থেকে, সাহেব সুবোধের গা থেকে ফুরফুরে সুগন্ধি। ভেসে আসছে ওদের পোষা ঘোড়ার খুরের শব্দ খটখট করে, যারা ওদের প্রিয়জনদেরও মাড়িয়ে চলে গেছে,  ওদেরও মাড়িয়ে যাওয়ার ফন্দি এঁটেছে, তিল তিল করে মাড়িয়ে যাবে ছানাপোনাদের। জমায়েতের শেষ প্রান্ত থেকে শুধু শেষ শব্দটি শুনতে পেল, বিলুরই তো  গলা, অমরাবতীর ছাপোষারা শোন ‘বৈতরণীর পাঁক, শুধুই ছলনা, কেবলই বঞ্চনা, কেবলই ভণ্ডামি।’ আরও কত কথা তো বলে ‘ছি ছি ঘরের পাশে ঘর বাঁধল, আর নিজেদেরই ঘর বাঁধার জায়গা পেল না।’

সমাপ্ত 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *