তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি

(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব  চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

 অধ্যায় : চার

জীবন অনন্ত কে বলেছে ? কোথায় শিখল মানুষ এভাবে স্বপ্ন দেখতে যাতে সে এমন মোক্ষলাভ করতে পারে ? অনন্তকাল ধরে মানুষের এই যে অনন্তকে অর্জনের লক্ষ্য স্থির করে চলা তাকে তো আজ পর্যন্ত বর্জন করতে পারেনি মানুষ। কেন ? এখানে এই প্রাণের চিহ্নবর্জিত শৈলমালার কৌলিন্যে নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কারের বাসনায় হাজির হওয়ার সময় কিন্তু শৈবাঙ্কনের অন্তরে কিছুমাত্র এমন লক্ষ্য ছিল না। সে নিজেকে এই পরিবেশে সমর্পণ করার সময়েই অগণিত শীলাখন্ডবিধৌত প্রান্তর থেকে উঠে যাওয়া পার্বত্য চূড়ারাজি নীরব ভাষায় তাকে নিজেদের বর্ণ-বৈচিত্রের খেলায় জানিয়েছিল, ‘আমরা নিঃসঙ্গ, নির্বাক।’ আর সেদিন থেকে প্রতিমুহূর্তে তারা তাকে একথাই বারবার জানিয়ে যাচ্ছে। তার পর থেকে সেও তার নির্বাক অন্তরের ভাষায় নিবেদন করে এসেছে, ‘আমিও তোমাদেরই মত একজন।’ কতদিন থাকা হল তার এই অপরূপের আঙ্গিক বিন্যাসে ? খুব একটা কম দিন নয়। তার সমতলের বিক্ষিপ্ত মানসিকতাকে শান্ত করে প্রাণে শান্তি দেখা সহজ ছিল না। সেই অসহজে প্রাণের প্রলেপ আর আদর ক্রমাগত বিলিয়ে তাকে এমন নিরুপদ্রূত করাটা এক বা কয়েকদিনে সম্ভব হত না। তার জন্য যে কদিনের ব্যাপ্তি দরকার ছিল সেই দিনগুলি কেটে গেছে। আর সে এখন তাই স্নিগ্দ্ধ, সমাহিত। রোজই সকালে ঘুম ভাঙার পর রাতের আশ্রয় ছেড়ে খোলা প্রাঙ্গণে বেরিয়ে সে নতুন নতুন অঙ্গবিন্যাসে নতুন নতুন বর্ণনা আর ভাষা খুঁজে পায়। আজও সে তেমনই একটি জীবন্ত আর কলরব মুখরিত দিনের সূচনা দেখতে পাচ্ছে। সে সেখানে পেতে চলেছে এমন এক অধরা আনন্দের সন্ধান যা মূক ও বধির যেকোন অঞ্চলের যেকোন বস্তুকে জীবন্ত করে। তার চোখের সামনে স্পিতি নদীর ধারাপ্রবাহের অজস্র অলিন্দে দাঁড়িয়ে থাকা টিলাগুলির গায়ে সূর্যালোকিত সেই আনন্দ ফুটে উঠছে নানা প্রজাতীয় হাসির প্রকাশে, তাদের মুখাবয়বে আর অঙ্গে অঙ্গে গুচ্ছ গুচ্ছ বর্ণসমারোহ, তাদের অনবরত রঙ-রূপ পাল্টে যাওয়া প্রতিটি ক্ষণে অগণিত দৃষ্টিকোণ ভিত্তিক, তারা এভাবে সারাদিন সূর্যের চলাচলের সাপেক্ষে তার কিরণছটার পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের সাজসজ্জা কেবলই বদলাতে থাকে বহুরূপী কোন স্বর্গীয় বিকাশের সামিল হয়ে যেখানে কোনদিন দেবতাত্মারা সৌন্দর্যমুগ্দ্ধ তাদের চলাচলে ব্যস্ত থাকত। দিনের শুরু থেকেই স্পিতি নদীর বয়ে চলা তুলি হাতে উপস্থিত হয়ে গতিপথের গোলকধাঁধায় ও বুকে দাঁড়িয়ে থাকা সার সার পাহাড় চূড়াগুলির গায়ে রঙ মাখাতে মগ্ন হয়েছিল। সূর্য ওঠার অপেক্ষায় ছিল সে এতক্ষণ, সূর্য দেখা দেওয়ার পরে পরেই তার আলোর জোয়ারে রঙের পাত্র ভরাট করে তাতে অদৃশ্য তুলি ডুবিয়ে টিলাগুলির গায়ে নানাবর্ণের চিত্রকলা আঁকায় মেতে উঠেছে আপন খেয়ালে মনের সুখে। সে পরিষ্কার শুনতে পায় সেইসব টিলা আর গতিপথে শুয়ে থাকা শিলারাশিসমূহের কথা বলাবলি জলধারার কলশব্দে,

‘সূর্যকে দেখতে পেলে কি ? আমি তাকে অনুভব করছি উত্তাপে।’

‘আমিও।’

‘কী ঠাণ্ডা হয়েছিল গা সারারাত ধরে ! এখন বেশ আরাম লাগছে।’

‘আমারও। আর আরাম লাগছে বলেই সূর্যের ছোঁয়ায় গায়ে আমার এমন রঙের বাহার। দেখেছ কি ?’

‘তোমাকে কী দেখব ? আমি দেখাচ্ছি আমাকে। দেখ।’

‘আরে, আমার দিকে একটু তাকাও। আমি বুঝতে পেরেছি সূর্যের আলো সাতরঙা। দেখ, আমার গায়ে সেই প্রমাণ।’ ‘আচ্ছা ভাই স্পিতি, তোমার চলায় এতো টান কেন ? আমরা গড়িয়ে যাচ্ছি।’

‘আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যৎ দুটোই তুমি নড়বড়ে করে চলেছ।’

‘আমাদের কি তুমি একটু তিষ্ঠোতে দেবে না কোথাও ? কেবল গড়িয়ে দেবে ?’

‘তোমরা যে কেন গড়াও ! কই, ওরা তো গড়ায় না ? এত আঘাত করছি, ওরা তবু যেমন ছিল যেখানে তেমনই থেকে যাচ্ছে। কোন তো অভিযোগ নেই ওদের।’

‘আরে, ওদের তো ভিত্তি জমির তলায়। শক্ত গাঁথা। আমাদের ভিত বলে কিছু নেই।’

‘অবশ্য ভিত থাকলেও হয় না, আকারও বড় হতে হবে। আসলে তোমাদের ভিত গোড়া থেকেই দুর্বল ছিল বলে ছিটকে গেছ। ছিলে একসময় আমাদেরই অঙ্গের শোভা হয়ে। এখনও দেখনা, তোমাদের মত অনেকেই এমন থেকে গেছে। তারা সূর্যালোকের সঙ্গে কথাও বলছে। সে কথা থাকছে আমাদেরই গায়ে।’

‘তবে তারাও কিছু না কিছু খসে পড়ছে রোজই প্রায় নদীর জলে।’

‘খসে পড়ায় আমাদের কী দোষ ? স্পিতির জল এত ধাক্কা দিচ্ছে কেন ? ছিটকে যাচ্ছি অনবরত।’

‘ধাক্কা না দিয়ে এগোব কী করে ? তাহলে তো আমাকে থেমে যেতে হয়। আমি চলব না ? গান গাইব না ? ছবি আঁকব না জলোচ্ছ্বাসের ? সবাই তো চায় আমাকে সচল-সবাক দেখতে।’

‘তুমি কী গো স্পিতি ? তোমাকে কি থামতে বলছি আমরা ? বলছি, একটু আস্তে চল। আমাদের অত টান দিও না।’ ‘টান হারালে আমার চলা যে আনন্দ হারাবে ! তার বেলা ?’

‘ওদের হাহাকার শুনতে যেও না স্পিতি।ওরা সব চপল বালক-বালিকাবৃন্দ।আমাদের গায়ে লেগে থাকতে পারল না। পড়ে গেল নিজেদের বালখিল্য আবেগের ভারে, আর এখন দোষ দিচ্ছে তোমাকে।’

‘ওরা অস্থিরমতি। ছটফটানি ওদের শিরায় শিরায়। আমাদের গায়ের শোভা বিনষ্ট করে খসে পড়েছে স্বাধীন চলাফেরার বাসনায়। আর এখন ঠোকাঠুকির ভাষায় আর্তনাদ করে মরছে।’

‘ভালো রে ভালো, আমাদেরই সব দোষ ! তোমরা খসিয়ে দিলে গা থেকে গায়ে সূর্যকিরণ সবটা মেখে চিত্র-বিচিত্র হতে। ঠিক হয়েছে, ন্যাড়া পাহাড়ের চুড়ো সব !’

‘ঝগড়া করে মরছ নিজেরা। আমি কেমন চলতে চলতে গান শোনাচ্ছি শুনতেও চাইছ না চুপটি করে।’

‘শুনতে চাইছি বলেই তো গড়াতে চাইছি না। গড়িয়ে দিচ্ছে তো তোমার ওই পাগল ধারা। চুপ থাকার উপায় কোথায়?’

‘কী মুশকিল ! তোমাদের চুপ রাখতে গেলে যে আমাকে থেমে যেতে হয়। আমি থেমে গেলে গান গাইবে কে ? কে ছবি আঁকবে উচ্ছ্বসিত জলোদ্ভাসের ?’

‘ওদের কথা শুনতে কী দায় তোমার ? চল যেমন চলছ তোমার খেয়ালে। তোমার চলার গানে ওদের গড়ানো আর ঠোকাঠুকি বাদ্যঝংকার। শুনতে তো ভালোই লাগছে।’                                                                                          

শিলাখণ্ড, টিলাসমূহ আর স্পিতি নদীর জলধারার কথোপকথন এভাবে চলতেই থাকে। তাদের বাক্যজাল মুখরিত করে তোলে পরিবেশ সূর্যালোকের সম্ভাষণে। সে দাঁড়িয়ে দেখে আর শোনে, মুগ্দ্ধ হতে থাকে বিস্ময়ে। কথা তার হারিয়েই থাকে। মৌখিক উচ্চারণে আসে না তারা, মনের অন্দরে ভাবনার ভঙ্গিতে বিকশিত হয়ে চলে। নিজের সেইসব অনুচ্চারিত বাণী নিজেরই কর্ণকুহরে শ্রবণগোচর হওয়া উপলব্ধিতে আসে, যেমন সে শোনে পাহাড়প্রদেশ বর্ণনাময় করে সাজিয়ে রাখা জড়জগতের প্রাণস্পন্দনহীন বাসিন্দাদের ভাষা। সে এখন তাদেরই দলভুক্ত, তাদের মতই সেও আর মুখে কিছু বলে না। সে বুঝেছে, মানুষের ভাষা এখানে অচল। এখানে সবাই কথা বলে দেবতাদের ভাষায়, আর সে ভাষা নিঃশব্দে বাজে। তবুও তা সবাই বোঝে, কারণ দেবতারা অন্তর্যামী এবং তারা এখানকার বাসিন্দাদেরও অন্তর দিয়ে কথা বলতে শিখিয়েছে। সেও এতদিনে সেভাবেই কথা বলতে ও বুঝতে শিখে গেছে। নাহলে সে বোঝে কী করে এই সকালে স্পিতি নদীর জল, শৈল চূড়াসমূহ, শীলাখন্ডগুলি কিভাবে কী বাক্যবিনিময় করে চলেছে ? আর সে নিজেও নিশ্চুপ কথা শোনায় নিজেকে, ভাবনার ভাষায়। সে ভাবে, ‘এই যে নিষ্প্রাণ সমারোহের ভালোবাসা, আমার প্রাণ যে এই ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে আটকে থাকতে চাইছে এটাই তো বড় পুরস্কার ও পাথেয়। একে আশ্রয় করে আমি জীবন চালিয়ে যেতে পারি যতদিন চলতে চায় সে। জীবন আর এখন আমার অবহ নয়। এই বেঁচে থাকা আমার কাছে মূল্যবান হয়ে উঠছে। দিনগুলি সব হতে পেরেছে অলংকৃত আর অর্থবহ। কী আশ্চর্য, আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে বেড়ে যাচ্ছে ! আমি ভাবছি, জীবনকাল আরও দীর্ঘায়িত হলে মন্দ কী ! এটাই কি জীবনের মোহ ? অনন্তকাল এভাবে থেকে যাওয়ার এই আগ্রহই কি অমরত্ব লাভের ইচ্ছে ? অনন্ত জীবনের সন্ধান ? জীবাক্ষ কি এর কথাই বলেছিল আমাকে ? এভাবে জীবনের স্বাদ উপভোগ করার অফুরন্ত সুযোগ করায়ত্তে আনার যা একমাত্র পন্থা ?                                                                                                 

তবুও মানুষের ভাষা ভুলে যাওয়ার উপায় থাকে না তার, জীবনযাপনের নানা প্রয়োজনে ও পরিস্থিতিতে বা পরিবেশে তাকে ওই ভাষায় কথা চালাতেই হয়। তার বর্তমান বাসভুমিতে যখন সে থাকে জনমানবহীন তখন সে কথা বলে দেবতাদের নির্বাক ভাষায় স্পিতির জলধারা, সারিবদ্ধ টিলাসমূহ, পাহাড়ি ঢাল, প্রান্তর, সুউন্নত শৈলচূড়া, ঝোড়ো বায়ুপ্রবাহ, দিনের আলো, সূর্য, রাতের আকাশের তারা বা চাঁদ, খণ্ডবিখণ্ড শিলারাশি বা বোল্ডার, শৈত্যঝাপটা, গভীর বা গম্ভীর খাদ, শৈলশিরা ইত্যাদি নিষ্প্রাণ বাসিন্দাদের সঙ্গে। সে এভাবে দ্বৈত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এতে তার ক্লান্তি নেই, বিষাদও নেই। বরং এভাবেই সে বেঁচে থাকায় খুঁজে পেয়েছে জীবনের আনন্দ।                                           

লোকালয়ে তো তাকে যেতেই হয়, নিছক পরিভ্রমণের উদ্দেশ্য ছাড়াও জীবনধারণের নানা উপকরণ সংগ্রহের তাগিদে। বেঁচে থাকার এই দায়বদ্ধ দিকটাকে সে কেন, পৃথিবীর কোন জীবই অগ্রাহ্য করতে পারে না। মানুষের সমাজের বাধ্যবাধকতা আরও বিরক্তিকর, আহার সংস্থানের মাঝখানে অনিবার্য হয়ে আছে অর্থসংশ্লিষ্ট লেনদেন। পশুপাখিদের সমাজে এই ঝামেলা নেই, কী রহস্যে কে জানে, তবে যেভাবেই হোক বেঁচে থাকার উপযুক্ত রসদ জুটে যায়। সংজ্ঞায়িত জড়জগতের সদস্যদের তারও দরকার নেই। তারা উপস্থিত থাকে স্বভূমিতে কোন বাহ্যিক প্রয়োজনের কথা মাথায় না রেখে। যদি তাদের মত বাঁচা যেত তো জীবন বুঝি এমন ক্লেদাক্ত হয়ে উঠত না।                                                        

সে আক্ষেপ অবশ্য তাকে ভুলে যেতে হয়েছিল, ভুলে যাওয়ার জন্য একটু বাস্তবতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। নাহলে এমন নির্জন বাসভুমিতে দিনের পর দিন এই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন সম্ভব হত না। উন্মত্ত জনসমাজ বর্জন করে এখানে স্বেচ্ছানির্বাসিত হওয়ার আগে নিকটবর্তী এক শহরে ব্যাঙ্কের একাউন্ট খুলে বেশ কিছু অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। দূরে যে জনসমাজ ছিল তার প্রাক্তন বাসস্থান সেখানেও ছিল অর্থসঞ্চয়। মোবাইল ফোন বিসর্জন দেওয়ার একটা মুশকিল ছিল ব্যাঙ্কজাতীয় আর্থিক সংস্থাগুলির সঙ্গে লেনদেন। তবে মজার কথা হল এই যে এখানে বাসভূমি বানিয়ে থাকার পর থেকে এতদিনে তার কোন আর্থিক লেনদেনের জন্য কোন ব্যাঙ্কে যেতে হয়নি। যতটুকু টাকাপয়সা সে সঙ্গে করে এনেছিল তাও শেষ হতেই চাইছে না, যতটুকু খরচ হয়েছে সে না চাইলে সেটুকুও হত না। তার দিনযাপনের খাদ্যোপকরণ কিভাবে যেন সংগ্রহ হয়ে যায় সে না চাইলেও। কাছেদূরের গ্রামের মানুষ বা অন্য কোন মাধ্যমের দাক্ষিণ্যে তার নিম্নতম চাহিদাটুকু ঠিক মিটে যায়। এটাই কি প্রকৃতির অজানা রহস্য যা অন্য পশুপাখিদেরও বেঁচে থাকার রসদ জুটিয়ে দেয় ?                                                                                                                                                   

যেমন জার্মান পর্যটক গেরহার্ট ও তার সঙ্গীরা তাকে খুঁজে পেয়েছিল। তারা যাওয়ার সময় জোর করেই প্রায় তার জন্য রেখে গেল প্রচুর শুকনো খাবার, ফল-মিষ্টি-নোনতা জাতীয়। পরিমাণে এতটাই যে অনায়াসে মাসখানেকও চলে যেতে পারে, যেহেতু সে স্বল্পাহারী থাকার অভ্যেস ও শিক্ষা গ্রহণ করেছে। এভাবে অন্য পর্যটকরাও তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে কিছু দিতে আগ্রহী হয়, সে চায় না, তবুও। দেখে মনে হয় যেন তাকে কিছু দেওয়ার সুযোগ পেলে তারা ধন্য হয়ে যাবে। কেন কে জানে এমন মানসিকতা হয় তাদের ! বোধহয় সেই অজানা প্রাকৃতিক রহস্য। সে বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। তাতে সে দেখে, তার জীবন বিপন্ন হয় না। এতো গেল গ্রীষ্মকালের কয়েক মাসের কথা, তখন উপত্যকার পাহাড়চূড়ো অনাবৃত থাকে, বরফ ঢাকে না তাদের। তাপমাত্রা বারো-তের ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা অসহনীয় নয়। কিন্তু শীতকালে কী হয় ? অথবা গরমকাল বাদ দিয়ে অন্য সময় ? শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নিচে নেমে যায়। পাহাড়চূড়াগুলি সবই বরফাবৃত, নদীর জলও জমাট বেঁধে যায় এক সময়। মানুষের পক্ষে তখন আর এই উন্মুক্ত প্রকৃতির বুকে বসবাস সম্ভব হয় না কোনমতেই। প্রান্তরপিপাসু গাদ্দি উপজাতির আধা-যাযাবর যেসব মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ভেড়া ও ছাগলের পাল নিয়ে আসে এখানে চরাবার জন্য তারা উপত্যকায় বরফপাতের সূচনাতেই সদলবলে নিজেদের বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য যাত্রা করে। তখন প্রকৃত অর্থেই উপত্যকা কেবল জনমানবশূন্য নয়, সম্পূর্ণভাবে প্রাণের চিহ্নবর্জিত হয়ে যায়। সে কী করে ওই সময় ? সেও তখন বাধ্য হয়ে এখানকার কোন না কোন গ্রামে বা জনপদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর সে অবাক হয়ে দেখে যে ওই জনপদনিবাসীরা তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে গ্রহণ করে স্বভূমিতে ফিরে আসা প্রবাসী কোন স্বজন হিসেবে। অন্য সময়েও সে যখন এসব লোকালয়ে আসে কোন কারণে তখনও সে এমনই  ব্যবহার পায় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের কাছে। তারা সবাই বৌদ্ধ, কিন্তু সে কী তা সে নিজেও জানে না। তবুও কোন সমস্যা হয় না কোন পক্ষে। তাকে সবসময় যেকোন জনপদের সমস্ত মানুষরা বরণ করে নেয় সমাদরে নিজেদের মধ্যে। তারা বোঝে যে সে তাদের মত বৌদ্ধধর্মমতাবলম্বী নয়, এমনকি সে কোন সন্ন্যাসী বা জাদুকরও নয়, তবুও তারা তাকে আপনজনের মত বুকে টেনে নেয়। সবাই তাকে কেন যে মনে করে কোন অসাধারণ মানুষ, কোন দেবদূত বা জ্ঞানীগুণী তা সে নিজেও বোঝে না। শুধু দেখে, তাকে পেলে সবাই নিজেদের ধন্য মনে করে। এও কি সেই অজানা প্রাকৃতিক রহস্য ? সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায় মানুষের এমন আদর, এমন ভালোবাসা দেখে। অবাক হয়ে ভাবে, মানুষ এভাবে মানুষকে এত ভালোবাসতে পারে। সভ্য সমাজে থাকার সময় কেন তাহলে তার নিজেকে নিঃসঙ্গ একা মনে হত, কেন সে জানত না সেখানে মানুষের মধ্যে এত ভালোবাসা লুকিয়ে আছে ? আর এই নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে এসে সে দেখছে, তার চারপাশে অজস্র মানুষের ভিড়, সবাই তার আত্মীয়। এখানে আসার আগে সে ধারণাই করতে পারত না যে পৃথিবীটা সত্যিই সভ্য মানুষের ভালোবাসায় মোড়া, মানুষরা সত্যিই এতটা ভালো হতে পারে, পৃথিবীতে সত্যিই এত এত ভালো মানুষ থাকে।            

আর ওই গাদ্দি উপজাতির মেষপালকরা। তাদের বাসস্থান কাংড়া জেলার বড়া ভাঙালে বা চাম্বা জেলার ভারমোরে, এই শেষে উল্লেখিত এলাকার জনপ্রিয় নাম গাদেরণ যা অন্য কথায় বোঝায় গাদ্দিদের বাসভূমি। কথিত আছে যে তাদের স্রষ্টা স্বয়ং দেবাদিদেব শিব। মহাদেব তাঁর দেবকীয় সিংহাসনে বা গদিতে বসে তাদের জন্ম দিয়েছেন বলে তারা গাদ্দি নামে পরিচিত। সে উপকথা সত্যিমিথ্যে কে জানে, কিন্তু স্বভাবে-চরিত্রে সত্যিই তারা সদাশিবের মত অতুলনীয়। কৃষিকাজ তাদের অন্যতম  প্রধান জীবিকা হলেও বনে-জঙ্গলে বা প্রান্তরের তৃণভূমিতে ভেড়া-ছাগল চরানো তারা মনে করে তাদের পবিত্র কাজ। স্বয়ং শিব তাদের সৃষ্টি করে এ কাজের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন বলেই তাদের বিশ্বাস। যদিও সভ্যতার অগ্রগতির চাকার চলনে ও পরিস্থিতির চাপে তাদের এই জীবিকা আজ বিপন্ন তবুও অনেকেই নিয়োজিত ওই আদিম দায়িত্বপালনে।                                                                                                                                       

সে যেখানে বাসস্থান বানিয়েছে তার কাছাকাছি প্রান্তরে গ্রীষ্মকালে আসে যে গাদ্দি মানুষগুলি তাদের মধ্যে আছে পবন, বৈজনাথ, ভৈরব এবং আরও কয়েকজন। পুরুষানুক্রমে একেকটি পথ নির্দিষ্ট একেক দলের জন্য, বছরের পর বছর সেই পথেই আসে একই তৃণভূমিতে নির্দিষ্ট দলটি। এই নিয়ে কখনো নিজেদের মধ্যে কোন ঝামেলা বা মতান্তর হয় না তাদের। আসলে গাদ্দিরা হিংসে-বিদ্বেষ কাকে বলে জানেই না। সরকারি তথ্য অনুযায়ী একথা প্রতিষ্ঠিত যে শান্তিপ্রিয় গাদ্দি উপজাতিদের বাসস্থান হওয়ার কারণেই গোটা হিমাচল প্রদেশে অপরাধের হার ভারতে সর্বনিম্ন।                                   

এই তথ্য কতটা খাঁটি তা তার চেয়ে কোনও সমতলের মানুষ বেশি জানে না। সারা গ্রীষ্মকাল সময়টা তার কাটে পবন, কৈলাস, বৈজনাথ, গিরিধারীদের সান্নিধ্যে। তারা চরিত্রে কষ্টসহিষ্ণু হলেও তেমন অর্থবান নয়। জীবন চালানোর দায়ে ভেড়া চরাতে আসে দূর-দূরান্ত থেকে দিনের পর দিন বিপদসঙ্কুল পথ ধরে প্রাণ হাতে নিয়ে। তবুও তাদের প্রাণোচ্ছ্বলতার কোন অভাব হয় না। উপত্যকার প্রান্তরে ভেড়া আর ছাগলের দল নিয়ে এসে আগে তারা তার সঙ্গে দেখা করে, যতদিন থাকে নিয়মিত খোঁজ-খবর নেয় তার। তাকে তারা সযত্নে নিজেদের খাবার রোজদিনই এসে খাইয়ে যায়। দুধ, রুটি, বার্লি ইত্যাদি। সে নিষেধ করলেও শোনে না। ব্যাপারটা নিজেদের এক পবিত্র কাজ বলে ভাবে তারা। সে যদি তাদের দান গ্রহণ করতে শেষপর্যন্ত অসম্মত হয় তো তারা মনোকষ্টে ভোগে এবং সেই আন্তরিকতার ছাপ তাদের মুখে স্পষ্ট প্রকাশও পায়। সে তাই তাদের ফেরায় না, তাদের সম্মান জানাতে তাদের দান সানন্দে গ্রহণ করে। তারা তাতে কৃতার্থ হয়ে যায়, তার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটায় আত্মীয়ের মত।                                               

এই নির্জন নীরব উপত্যকার বাসিন্দা হয়ে এতদিনে সে বুঝতে পেরেছে পৃথিবীটা কত বড়, কত উদার। অনুভব করতে পেরেছে, মানুষের পৃথিবী আসলে কী  এবং মানুষের জন্য মানুষের কতটা মমত্ববোধ। সে জেনেছে, পৃথিবী মানুষকে কতটা ভালোবাসে।                                                                                                                                                  

আর সে উপলব্ধি করতে পেরেছে, ‘জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি,’ এই বিশ্বাসের মর্মার্থ। সে নিশ্চিত, বিশ্বপ্রকৃতি বা দেবতা, যে জগৎকে সৃষ্টি করেছে তাকে রক্ষা করার দায়িত্বও সে নিজের আয়ত্ত্বেই রেখেছে।  

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

                                                              

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *