সৌমিতা রায় চৌধুরী

লেখক পরিচিতি 

(প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বড়িশা গার্লস হাইস্কুল (দ্বাদশ)-এ পড়াশোনা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে ভর্তি। সসম্মানে সেখান থেকে স্নাতক হয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রাপ্ত হয়ে সাংবাদিকতা পাঠক্রমে প্রবেশ। সসম্মানে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা প্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা। আকাশবাণী কলকাতায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা। লেখিকা সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের ৩৫ তম বংশধর।)

কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পৌষ পার্বণ হলো এমনই একটি পার্বণ। নবান্ন ঘরে আসার আনন্দে ঢেঁকি কুটে নতুন চাল তৈরি হয়। শীতের ভোরে শিউলিরা যে খেঁজুর রস পেড়ে আনে তা দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়, পাটালি। এইসব উপকরণ দিয়ে গ্রাম বাংলার মানুষ পিঠে, পুলি, পায়েস তৈরি করেন। শীতের আমেজে এই ধরনের খাবার সহযোগে নানান আচার অনুষ্ঠান ও উৎসবে নাচগানে মেতে ওঠে গ্রামবাংলা। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গান —

            পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে

            আয় রে চলে আয় আয় আয়। 

            ডালা যে তার ভরেছে আজ রাঙা ফসলে

            মরি হায় হায় হায়। 

বিজ্ঞান অনুযায়ী সূর্যের গতি দুই প্রকার। উত্তরায়ন এবং দক্ষিণায়ন। মাঘ থেকে আষাঢ় মাস উত্তরায়ন এবং শ্রাবণ থেকে পৌষ দক্ষিণায়ন। মকর সংক্রান্তির দিন সূর্য তার কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। পৌরাণিক মতে দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধে অশুভ শক্তির বিনাশ হয় এই পৌষ সংক্রান্তির দিনে। 

ভারতবর্ষের সমস্ত অঞ্চলেই পৌষ পার্বণ পালিত হয়। অঞ্চল ভেদে এদের নাম ভিন্ন। যেমন, নেপালে এই অনুষ্ঠানের নাম মাঘী। পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে ‘লহরী’ নামে পালিত হয় পৌষ পার্বণ। বিহার, ঝাড়খন্ডে এর নাম ‘খিচরি’। তামিলনাড়ুতে ‘পোঙ্গল’। ১৪ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এই উৎসব পালন করা হয়। অসমে এই উৎসবের নাম ‘ভোগালী বিহু’, গুজরাটে ‘উত্তরায়ন’, মহারাষ্ট্রে ‘তিলগুল’, কর্নাটকে ‘ইল্লুবিল্লা’। ভারতবর্ষের বাইরেও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন অংশে পাকা ফসল ঘরে তোলার উৎসব পালিত হয়। থাইল্যান্ডে এই উৎসবের নাম ‘সংক্রান’। লাওসে ‘পি-মা-লাও’ এবং মায়ানমারে ‘থিংইয়ান’। 

প্রত্যেক অঞ্চলেই নিজস্ব রীতি অনুযায়ী ফসলের উৎসবকে নাচ, গান এবং পুজোর মাধ্যমে উদযাপিত করা হয়। বাংলার ঘরে ঘরে আমন ধানের শীষ দিয়ে বিনুনি তৈরি করে মুলোর ফুল, সর্ষে ফুল ও আম পাতা দিয়ে ‘আউনি-বাউনি’ তৈরি করে ধানের গোলা ও ঢেঁকিতে শুভ লক্ষণ হিসেবে দেওয়া হয় এবং এর চারধারে বসে মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি ও গান বাজনায় মেতে ওঠে গ্রামবাসী। বহু মানুষ মকর স্নান করতে গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে ভিড় জমান। বর্ধমানে এই বিশেষ দিনটিতে ঘুড়ি ওড়ানোর রীতি আছে।  

সাঁওতাল, লোধা, মুণ্ডা রাঢ়বঙ্গের (পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রাম) এই সম্প্রদায় গুলি টুসু গানে মেতে ওঠে। টুসু গানে গভীর ভাব ব্যক্ত হয়। টানা তিন মাস কঠোর পরিশ্রমের পরে ফসল ঘরে তোলার আনন্দ এবং ব্যক্তি জীবনের দৈনন্দিন কষ্টের কথা প্রকাশ পায় টুসু গানে। যেমন —

            পৌষ আসছে সাধের টুসু

            পূজব তোমায় ফুল দিয়ে

            তোমার ক্ষেতের ধান তুলেছি

            সে ধান যাবেক কে লিয়ে। 

পঞ্চকোট রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এক ধরনের লোকগানে ভাদু ঘরানার সৃষ্টি হয়। ভাদু গানে সাধারণত গৃহ নারীদের জীবন কাহিনি বর্ণিত এবং পাঁচালীর সুরে গানগুলি গাওয়া হয়। এছাড়া চার লাইনের ছড়া জাতীয় ভাদু গান গাওয়া হয়। কৃষ্ণ রাধার প্রেম কাহিনিও কিছু কিছু ভাদু গানের বিষয়বস্তু। যেমন —

            ভাদু আমার গরবিনী

            ওগো আমার ভাদুমনি

            মাথায় দিব সোনার মুকুট

            শাড়ি দিব জামদানি….. 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় পৌষ সংক্রান্তির দিন নানা উপাচারের মাধ্যমে এই ফসল ওঠার মাসকে আগলে রাখার উৎসব পালন করা হয়। একে পৌষ আগলানো বলে। পিঠে পুলি বানানোর সঙ্গে সঙ্গে গৃহবধূ গান ধরে —

 এসো পৌষ যেও না জন্ম জন্ম ছেড়ো না

 আঁদাড়ে পাঁদাড়ে পৌষ, বড়ো ঘরের কোণে বসো

 পৌষ এল গুড়ি গুড়ি, পৌষের মাথায় সোনার ঝু্ঁটি। 

মুসলিম সমাজেও পৌষে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। কবি সুফিয়া কামাল ‘পল্লী মায়ের কোলে’ কবিতায় শীতকালীন গৃহস্থ উৎসবের বর্ণনা করেছেন এইভাবে —

           পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি 

           খুশিতে বিষম খেয়ে

           আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে 

            মায়ের বকুনি পেয়ে। 

কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং মহাভারতের যুগেও শীতের আমেজে ফসল ঘরে ওঠার আনন্দে উৎসবের পরিবেশের পরিচয় পাওয়া যায় এইসমস্ত উক্তির মাধ্যমে —

            “নতুন ধান্য হবে নবান্ন” 

        মহাভারতের দময়ন্তীর বিবাহ ভোজের বর্ণনায় —

            “সুমিষ্ট পিষ্টক এবং দই” 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগরদ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে গঙ্গাসাগর মেলা বহু প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। মকর ডুব এবং গানের আখড়া এই মেলার বৈশিষ্ট্য। এছাড়া বীরভূম জেলার দুটি বিখ্যাত মেলা যেমন শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা, যা মূলত বাউল গানের আসর। এই লোকসংগীত উৎসব দেখতে দেশ-বিদেশ থেকেও পর্যটকরা এখানে আসেন। এছাড়া বীরভূম জেলারই কেন্দুলি গ্রামে জয়দেবের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এটি পুরোপুরি একটি বাউল গানের উৎসব। 

শীতের দিনে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষ জুড়ে এবং এশিয়া মহাদেশের কিছু কিছু অংশে শীতকালীন উৎসবের পরিবেশ লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক কালে সংগীত শিল্পী মান্না দে-র একটি গানের মাধ্যমে এই উৎসব মুখর পরিবেশের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। 

           পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন

           ফিরে আর আসবে কি কখনো? 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *