মহাদেব মণ্ডল

লেখক পরিচিতি 

জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের চূড়াভান্ডার গ্রামে ১৯৯২ সালের ৪ মে মহাদেব মণ্ডল জন্মেছেন। বাবা মঙ্গল মণ্ডল, মা ভাগ্য মণ্ডল। গরুমারা অভয়ারণ্য এবং লাটাগুড়ি জঙ্গলের খুব কাছের গ্রামেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন। তাই প্রকৃতির প্রতি এক গভীর টান তাঁর ছোটবেলা থেকেই। তাঁর চর্চা এবং বিশেষ পছন্দের বিষয় মূলত কথাসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতি। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।  পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ থেকেই তিনি কিন্নর রায়ের উপন্যাসে পরিবেশ ভাবনা নিয়ে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে রচনা করেন ‘কিন্নর রায়ের কথাসাহিত্যে পরিবেশ প্রসঙ্গ’ নামক নিজস্ব গ্রন্থ। এর আগে যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘বাংলা ছোটগল্প : বিষয় ও নির্মাণ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘প্রাজক্তা’ সহ নানা পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত।

 তিনি বর্তমানে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে  গবেষণারত।

বিষয় পরিচিতি 

( পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বর্তমানে রীতিমত নানা আন্দোলন যেমন হচ্ছে তেমনি পরিবেশ রক্ষার জন্য সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণাও করে চলেছেন। এ বিষয়ে পরিবেশবিদরা বর্তমানে ভীষণভাবেই চিন্তিত। এই মর্মেই নানারকম প্রবন্ধ নিবন্ধন প্রকাশিত হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। পিছিয়ে নেই সাহিত্যও। তাইতো বর্তমানে পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য রচিত হচ্ছে। কবি সাহিত্যিকরা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করছেন পরিবেশ সম্পর্কে তাদের ভাবনা-চিন্তা। পাঠককে সচেতন করতে সমসাময়িক পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যাকে সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন তাই তাঁরা। এই ধরনের সাহিত্য পরিবেশ সচেতন সাহিত্য, পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা পরিবেশবাদী সাহিত্য নামে পরিচিত। এই ধরনের সাহিত্যের সাহিত্যমূলক ছাড়াও একটি পরিবেশগত বা পরিবেশবাদী মূল্য আছে। সাহিত্য সমালোচনায়, সাহিত্য পাঠের তাই নতুন এক প্রস্থান তৈরি হয়েছে পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা বা ইকোক্রিটিসিজম। এই আলোচনায় মূলত বাংলা সাহিত্যের পরিবেশবাদী গল্প নিয়ে আলোচনা করা হবে, দেখার চেষ্টা করা হবে গল্পগুলি কীভাবে ইকো টেক্সট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের লেখকরা কীভাবে তাঁদের গল্পের মধ্যে পরিবেশ ভাবনা সম্পৃক্ত করে পরিবেশবাদী সাহিত্য রচনা করে চলেছেন এবং পাঠককে পরিবেশ ভাবনায় মগ্ন করে পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য সচেতন করে চলেছেন সেই দিক নির্দেশ করার চেষ্টা করা হবে মূলত এই আলোচনায়। )

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে পরিবেশচেতনা

সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে ঘনিয়ে আসে প্রকৃতি ও পরিবেশের সংকট।ফলস্বরূপ পানীয় জল, শ্বাস-প্রশ্বাসের বায়ু এবং প্রাণ- ধারনের খাদ্যবস্তু হয়ে যেতে লাগলো দূষিত। সভ্যতা এগিয়ে যেতে লাগলো ক্রমশ এক খয়ের দিকে। তাইতো মানুষের বসবাসযোগ্য সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে পরিবেশবাদীরা অনেক আগেই যে মতামত পোষণ করেছিল রাষ্ট্রনেতারাও তাতে কান দিতে বাধ্য হলেন। তাই ১৯৭২ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আহব্বানে সুইডেনের স্টোকোমে প্রকৃতি- পরিবেশ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলি আলোচনার জন্য প্রথম সম্মেলন আহুত হল। এই সম্মেলন উন্নত দেশগুলিকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারল না। যন্ত্রশিল্পের সম্প্রসারণ অব্যাহত রইল। পৃথিবী এগিয়ে যেতে লাগলো নিশ্চিত ধ্বংসেরই অভিমুখেই। তাইতো ১৯৮৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি টোকিও ঘোষণায় প্রতিটি রাষ্ট্রকে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হল। ১৯৯২-এ আবার অনুষ্ঠিত হল সুবৃহৎ সম্মেলন ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন যেটি বসুন্ধরা সম্মেলন নামেও পরিচিত। এই আলোচনায় যোগ দিলেন ১৬০ টি দেশের সরকারি প্রতিনিধিরা। গৃহীত হলো অনেক সংকল্প। কিন্তু পুঁজিবাদী ও বৃত্তশালী দেশগুলি এই সংকল্পগুলি কিছুই মেনে চলল না ফলে এই সম্মেলন থেকেও খুব একটা ফল পাওয়া গেল না। আরো পাঁচ বছর পরে ১৯৯৭-এ কিয়োটো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। খুব সামান্য চেতনা বৃদ্ধি হয়তো হয়েছে ততদিনে কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিশেষ কিছু পরিবর্তন ঘটেনি।

এই সব পরিবেশবাদী আন্দোলন এবং সম্মেলন শুরু হওয়ার অনেক আগেই চিন্তাশীল মানুষেরা সংবেদনশীল বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন মানুষ ও প্রকৃতি- পরিবেশের সম্পর্ক নিয়ে। মানুষের প্রসারিত লব্ধ করতলের আঘাত কীভাবে প্রকৃতি পরিবেশকে করে তুলেছে প্রতিদিন বিপন্নতর তার খতিয়ান নিয়ে বই লিখেছেন। তাঁরা নিজেদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বার্তা দিয়ে গেছেন প্রকৃতিকে রক্ষা করার। এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিশিষ্ট নাম স্যার প্যাট্রিক (১৮৫৪-১৯৩২)।তিনি ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ‘এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি’ স্থাপন করেন এবং ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে সম্পাদনা করতে শুরু করেন ‘এভারগ্রিন বা চিরসবুজ’ নামে একটি পত্রিকা। তিনি ইউরোপের ‘বস্তি-শহর’ গুলির বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন এক আন্দোলন। আমরা তাঁর পরেই এই পরিবেশবাদী রূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম করতে পারি। যে রবীন্দ্রনাথ মানুষ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সামঞ্জস্য গড়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর লেখায় ও কাজে। 

  রবীন্দ্র সাহিত্যে সর্বত্র পরিবেশ বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনার ক্ষেত্রে দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার একটি হল বিদেশ ভ্রমণ ও অন্যটি হল বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সান্নিধ্য। জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে সান্নিধ্যই রবীন্দ্রনাথকে পরিবেশ আরও বেশি করে আকৃষ্ট করেছিল। কবিগুরুর শিলাইদহে বসবাসকালে জগদীশ চন্দ্র বোস বহুবার সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁর গবেষণা ভাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গবেষণা ভাবনার সাযুজ্যের জন্যই তাদের মধ্যে সম্পর্কের বাঁধন দৃঢ় হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তিতে আমরা জানতে পারি – “প্রাণ পদার্থ থাকে জড়ের গুপ্ত কুঠুরিতে গা ঢাকা দিয়ে। এই বার্তাকে জগদীশ বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে পাকা করে গেঁথে দেবেন, এই প্রত্যাশা তখন আমার মনের মধ্যে উন্মাদনা জাগিয়ে দিয়েছিল -কেননা ছেলেবেলা থেকেই আমি এই ঋষি বাক্যের সঙ্গে পরিচিত- ‘যদিদং কিঞ্চ জগৎ প্রাণ এজতি নিসৃতং’ এই যা কিছু জগৎ, যা কিছু চলছে, তার প্রাণ থেকে নিঃসৃত হয়ে প্রাণেই কম্পমান। সেই কম্পনের কথা আজও বিজ্ঞানে বলছে। কিন্তু সেই স্পন্দন যে প্রাণস্পন্দনের সঙ্গে এক, একথা বিজ্ঞান এর প্রমাণ- ভান্ডারের মধ্যে জমা হয়নি। সেদিন মনে হয়েছিল আর বুঝি দেরি নাই।” বিশ্বজগতের এই ঐক্যতও্ব রবীন্দ্রনাথের কবি সৃষ্টির  নিকটে ধরা দিয়েছিল।

   আমরা দেখি সৃষ্টিশীল শিল্পী রবীন্দ্রনাথও ছিলেন ত্রিকালদর্শী। তাই তিনি নদীর বাঁধ নিয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগেই বাঁধকেন্দ্রিক সমস্যা নিয়ে সৃষ্টি করেছেন ‘মুক্তধরা’র মত নাটক। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতির প্রতি আকর্ষণ সব থেকে বেশি লক্ষ করা যায় ছিন্নপত্রাবলীতে।শিলাইদহে থাকাকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে অনেক একাত্বে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন খুব কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রাবলীতে পরিবেশ ভাবনার এক সুন্দর চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। পৃথিবীর সঙ্গে নিজের আত্মীয়তা প্রকাশ করে বলেছেন –“এই পৃথিবীটি আমার অনেকদিন কার অনেক জন্ম কার ভালোবাসার লোকের মতো আমার কাছে চিরকাল নতুন; আমাদের দুজন কার মধ্যে একটা খুব গভীর এবং সুদূরব্যাপী চেনাশোনা আছে।” পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে একাত্ম করে দেখেছেন কবিগুরু-“আমার সঙ্গে এই বিশ্বের ক্ষুদ্রতম পরমাণুর বাস্তবিক কোন জাতিভেদ নেই, সেই জন্যই এই জগতে আমরা একত্রে স্থান পেয়েছি -নইলে আমাদের উভয়ের জন্য ভিন্ন জগত হয়ে উঠত।” ‘ছিন্নপত্র’ গুলিতে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনার মূল চিত্রগুলি স্থাপিত হলেও তার ছোটগল্পগুলিকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনার সম্পূর্ণ চিত্র আমরা পাইনা। তাই তাঁর লেখা ছোটগল্পগুলির পাট নেওয়া বিশেষ জরুরী। এই আলোচনায় গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত ‘পোস্টমাস্টার’(১২৯৮) ‘ছুটি’(১২৯৯) ‘সুভা’(১২৯৯) ‘অতিথি’(১৩০২)‘বলাই’ (১৩৩৫)এই গল্পগুলি নির্বাচন করা হয়েছে।

    ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি ভরা বর্ষাকালে লেখা। বর্ষাকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই গল্পটি রবীন্দ্রনাথ স্বজন বিচ্ছেদের রূপগল্প হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বর্ষা প্রকৃতি পোস্টমাস্টারের হৃদয়কে ব্যাকুল করে তুলেছে আপনজনের স্নেহের পরশ পাওয়ার আশায়। রতন যেন সেই মানবতার পূর্ণরূপ। আর বর্ষা যেন তার আলম্বন বিভাব। এই গল্পে বর্ষা বিচ্ছেদের সুর বহন করে এনেছে। আমরা দেখি গল্প শেষে পোস্টমাস্টার রতনকে ফেলে রেখে কলকাতা চলে যাচ্ছেন –“যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন- একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুন মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল।….. কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদী কুলের শ্মশান দেখা দিয়েছে- এবং নদী প্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ কত মৃত্যু আছে ফিরিয়া ফল কী।পৃথিবীতে কে কাহার।” প্রকৃতির বিচিত্ররূপ। আর বিচিত্র রূপিনী বলেই চিরন্তনী। সে কখনো বা সুখের কখনো দুঃখের বার্তাবহ। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে প্রকৃতি দুঃখের বার্তা বহন করে নিয়ে এসেছে। বর্ষাকালে প্রবল বর্ষায় পোস্টমাস্টারের মন ব্যাকুল হয়েছে তার প্রিয়জনদের জন্য। রতনের হাতের  স্পর্শে তার মনে পড়ে শাঁখা পরা কমল হাতের স্পর্শ। আর রতন হল এই গল্পের প্রকৃতির মূর্তপ্রতীক। তার ভালবাসা অকৃত্তিম ও গভীর। তাইতো আমরা দেখি পোস্টমাস্টার চলে যাওয়ার পরও রতন সেই পোস্ট অফিস ছেড়ে চলে যেতে পারে না- “সে সেই পোস্ট অফিসের  গৃহের চারদিকে কেবল অশ্রুজলে ভাসিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। বোধকরি তাহার মনে ক্ষীণ আশা জাগিয়েছিল দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে- সেই বন্ধনে পরিয়া কিছুতেই দূরে যাইতে পারিতে ছিল না।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গল্পে প্রকৃতির মূল বৈশিষ্ট্য সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আসা এবং যাওয়া প্রকৃতির ধর্ম। কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, কোন বন্ধনই তাকে ধরে রাখতে পারে না। তাইতো- “যেতে নাহি দেব’ বলার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে কিন্তু ‘তবু যেতে দিতে হয়।”

    ‘ছুটি’ গল্পের গ্রাম্যবালক ফটিক। প্রকৃতি ছাড়া তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায় না। প্রকৃতির বুকে তার গতি দুরন্ত দুর্বার। কিন্তু এই প্রকৃতির কোল থেকে যখন কলকাতায় চলে যায় তখন হারিয়ে যায় তার অস্তিত্ব। তাই্ মামার বাড়িতে গিয়ে চার দেওয়ালের মাঝে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল হাঁফ ছাড়ার জায়গা পাচ্ছিল না সে। কলকাতায় মামার বাড়িতে বসে ফটিক তাই গ্রাম্য জীবনের স্মৃতি চারণা করেছে- “প্রকাণ্ড একটা ধাউস ঘুড়ি লইয়া বোঁ বোঁ  শব্দে উড়াইয়া বেড়াইবার সেই মাঠ, তাইরে নাইরে নাইরে না করিয়া উচ্চ:স্বরে স্বরচিত রাগিনী আলাপ করিয়া অকর্মণ্যভাবে ঘুরে বেড়ায়বার সেই নদীতীর, দিনের মধ্যে যখন -তখন ঝাঁপ দিয়ে পরিয়া সাঁতার কাটিবার সেই সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, সেইসব দল-বল উপদ্রব স্বাধীনতা।” এই প্রকৃতির কোল থেকে দূরে ফটিক তার জীবনকে বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। পারেনি শহরের কৃত্তিম জীবনকে নিজের জীবনের সঙ্গী করে নিতে। তাইতো সে ফিরে যেতে চেয়েছে গ্রামে। কিন্তু তার মামা স্কুল ছুটির আগে যেতে বারণ করেছে। তাই গল্প শেষে আমরা দেখি ফটিক জীবনের কাছে ছুটি নিয়ে চির বিদায় নিচ্ছে –“এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

    ‘সুভা’ গল্পের সুভাষিনী ওরফে সুভা একটি বোবা মেয়ে। সে কথা বলতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতি যেন তার ভাষার অভাব পূরণ করে দেয়, যেন তার হয়ে কথা বলে। প্রকৃতির সঙ্গে সুভার যেন সখ্যের সম্পর্ক। দুপুরে যখন মাঝি জেলেরা খেতে যেত, গৃহস্থরা ঘুমোত, খেয়া নৌকা বন্ধ থাকত, পাখিরা ডাকতো তখন– “বোবা প্রকৃতি এবং একটি বোবা মেয়ে মুখোমুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত।” প্রকৃতির বুকে বোবা সুভা যে প্রকৃতির কন্যা হয়ে উঠেছে। তাই এই প্রকৃতির কোল থেকে সুভাকে যখন তার বাবা বিয়ে দেওয়ার জন্য কলকাতায় নিয়ে যেতে চায় সুভা তখন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে প্রকৃতির এই কোল ছেড়ে যেতে। তাইতো কলকাতা যাওয়ার আগের রাতে- “সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চিরপরিচিত নদীতটে পুস্পশয্যায় লুটাইয়া পড়িল- যেন ধরণীকে, এই প্রকাণ্ড মূগ মানবমাতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে, তুমি আমাকে যাইতে দিয়ো না, মা। আমার মত দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো।”১০ সুভার এই বিদায় মুহূর্তের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় অভিজ্ঞান শকুন্তলম এর শকুন্তলার পতি গৃহে যাওয়ার মুহূর্তটির। শকুন্তলা যেমন প্রকৃতি ছেড়ে প্রতি গৃহে যেতে চায়নি তেমনি সুভাও তার প্রকৃতি মাতাকে আঁকড়ে ধরে গ্রামে থাকতে চেয়েছে। 

    ‘অতিথি’ গল্পের নায়ক তারাপদ। প্রকৃতি মুগ্ধ চঞ্চল কিশোর চরিত্র। পারিবারিক স্নেহ বন্ধন তাকে বাঁধতে পারে না। সে বারবার ঘর ছাড়ে প্রকৃতিকে ভালোবেসে। যখন সে দেখতো নদী দিয়ে বিদেশি নৌকা গুন টেনে চলছে, গ্রামের অশ্বথ গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছে দূরাগত সন্ন্যাসী কিংবা বেদেরা নদীতীরের পতিত মাঠে ছোট ছোট চাটাই বেঁধে বাখারি ছুলে চাঙ্গারি নির্মাণ করছে, তখনই অজ্ঞাত বহিঃপ্রকৃতির স্নেহহীন স্বাধীনতার জন্য তার মন চঞ্চল হয়ে উঠত। লেখক বলেছেন- “গাছের ঘন-পল্লবের উপর যখন  শ্রাবনের বৃষ্টিধারা পড়িত, আকাশে মেঘ ডাকিত, অরণ্যের ভিতর মাতৃহীন দৈত্য শিশুর  ন্যায় বাতাস ক্রন্দন করিতে থাকিত তখন তাহার চিত্ত যে উৎশৃংখল হইয়া উঠিত।  নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে বহু দূর আকাশ হইতে চিলের ডাক, বর্ষার সন্ধ্যায় ভেকের কলরব, গভীর রাতে শৃগালের চিৎকার  ধনী সকলই তাহাকে উতলা করিত।”১১

     শৈশবে পিতৃহীন ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ ছিল পরিবারের সকলের কাছে খুবই আদরের। প্রতিবেশী থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষকও তাকে খুবই ভালোবাসতো কিন্তু তারাপদ গৃহত্যাগী বন্ধনমুক্ত যাযাবর জীবনই তার কাম্য। পরিবারের স্নেহের বন্ধন ত্যাগ করে বারবার গৃহ ছাড়ার ফলে এক সময় তার আশা ত্যাগ করেছে আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে গ্রামের লোকেরাও। এই তারাপদ আবার ঘর ছেড়ে বাইরে সংসারে বাধা পড়েছে প্রায় দুই বছর- কাঁঠালিয়ার জমিদার মতিলাল বাবুর সংসারে। তারাপদর সুন্দর দেহ, সহজ সরল আপন কড়া মনোভাবের ফলে মতিলাল বাবুর সংসারে সে একজন সদস্য হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় কাঁঠালিয়া গ্রামের সমস্ত মানুষ জনের সঙ্গে স্থাপিত হয় তার হৃদ্যতার সম্পর্ক। তারাপদর ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করে মতিলালবাবু। তার সঙ্গে যুক্ত হয় মতিলালের মেয়ে চারুশশী। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক ভালোবাসার সম্পর্ক। তাই জমিদারবাবু শেষ পর্যন্ত তার কন্যা চারুশশীর সঙ্গে বিবাহ ঠিক করেছেন তারাপদর। কিন্তু- “তারাপদকে বাঁধবে কে? তাহার জন্ম নক্ষত্র তাহাকে গৃহহীন করিয়া দিয়াছে।”১২ তাইতো সেই সময় কড়ুলকাটায় নাগবাবুদের এলাকায় বিখ্যাত রথের মেলার কথা শুনে ঘাটে গিয়ে তারাপদ দেখল কোন নৌকা নাগরদোলা, কোন নৌকায় যাত্রার দল, কোন নৌকা পণ্যদ্রব্য লইয়া প্রবল নবীন স্রোতের মুখে দ্রুতবেগে মেলা অভিমুখে চলছে। এই দৃশ্য দেখে মুহূর্তে তারাপদর স্নেহ প্রনয়ের বন্ধন ছিন্ন হল-  “সম্মুখে আজ যেন সমস্ত জগতের রথযাত্রা- চাকা ঘুরিতেছে ধ্বজা উড়িতেছে, পৃথিবী কাঁপিতেছে,  মেঘ  উড়িয়াছে, বাতাস ছুটিয়াছে, নদী বহিয়াছে, নৌকা চলিয়াছে, গান উঠিয়াছে, দেখিতে দেখিতে গুরু গুরু শব্দে মেঘ  ডাকিয়া উঠিল,বিদ্যুৎ আকাশকে কাটিয়া কাটিয়া ঝলসিয়া উঠিল, সুদূর অন্ধকার হইতে একটা মুষলধারাবর্ষী বৃষ্টির গন্ধ আসিতে লাগিল। কেবল নদীর এক তীরে পাশ্বে কাঁঠালিয়া গ্রাম আপন কুঠিরদ্বার বন্ধ করিয়া দীপ নিবাইয়া দিয়া নিঃশব্দে ঘুমাতে লাগিল।”১৩ এই গল্পে আমরা তারাপদর সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’র অপুর চৈরবেতি চরিত্রের মিল খুঁজে পাই। প্রকৃতির মাঝে তারাপদ নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে। কোনো  গৃহ মধ্যে নিজেকে বাঁধতে দেয়নি। লেখক এখানে দেখাতে চেয়েছেন- “ইকোলজি শব্দের মধ্যে ব্যবহৃত গ্রিকশব্দ oikos এর অর্থ হল বসতি।এই বসতির অর্থ সামাজিক মানুষের তৈরি বাসগৃহ নয়। এখানে পৃথিবীটাই একটা বাসগৃহ। যেখানে মানুষ ছাড়াও বাস করে বিভিন্ন সপ্রাণসত্তা। ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ ঘরছাড়া তার জন্ম নক্ষত্র তাকে গৃহহীন করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রতিস্থাপন করেছেন আরও বৃহত্তর বাসগৃহে, পরিবেশ চেতনার ধারণায় তা হল পৃথিবী নামক গ্রহ।”১৪

    ‘বলাই’ গল্পটি এক মা হারা কিশোরের প্রকৃতি প্রীতি তথা বৃক্ষ প্রীতির গল্প। যার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখা। প্রকৃতিকে তার নিজের দৃষ্টিতে দেখেছে ভিন্নভাবে ভিন্নরূপে। শান্ত স্বভাবের বলাই গাছপালার মধ্যে খুঁজে পেয়েছে জীবনের মূল সুরকে। আম গাছে বোল দেখলে ওর মন আনন্দে ভরে উঠে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘন সবুজ ঘাসের আস্তরণ দেখে খুশিতে আত্মহারা হয় বলাই এর মন। কেউ গাছের ফুল তুললে গাছের ডাল ভাঙলে ওর খুব কষ্ট হয় আর বাগানের নাম না জানা গাছগুলির প্রতি বলাইয়ের দৃষ্টি ও স্নেহের শেষ নেই। তাই যেদিন ঘাসিয়ারা ঘাস কাটতে আসে সেদিন বলাইয়ের সবচেয়ে বিপদের দিন। কারণ –“ঘাসের ভিতরে ভিতরে ও প্রত্যহ দেখে দেখে বেড়িয়েছে- এতটুকু- টুকু লতা বেগুনি হলদে নাম হারা ফুল অতি ছোট ছোট,…..তারা বাগানের সৌখিন গাছ নয়, তাদের নালিশ শোনবার কেউ নেই।“১৫ লেখকের ভাবনায় বলাইয়ের বয়স সেই কোটি বছর আগেকার দিনে- যেদিন পশু পাখি ছিল না, জীবনের কলরব ছিল না, পৃথিবীর ভাবি অরণ্য আপনার জন্মের প্রথম ক্রন্দন তুলেছিল এই বিশ্ব প্রাণের বাণী শুনেছে বলাই।  তাই তার রক্তে বৃক্ষের প্রতি প্রগাঢ় টান। যে কোনো মূল্যে  বৃক্ষকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে সে। বাগানের রাস্তার ধারে বেড়ে উঠেছে একটি শিমূল চারা। অপ্রয়োজনীয় বলে তার কাকা সেটাকে কেটে ফেলতে চায়। কিন্তু বলাই কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে না তাই দু-চারবার গাছটি কাটার চেষ্টা হলেও বলাই এর আকুতিতে সেটা বেঁচে যায়। তারপর বলাই এর বাবা বলাইকে সিমলা নিয়ে যায়। সেই সময় তার কাকা সেই গাছটি সত্যিই কেটে ফেলে। বিদেশে যাওয়ার আগে বলাই তার কাকিমাকে চিঠি লিখে শিমূল গাছটির ফটোগ্রাফ চেয়েছে। কিন্তু তা আর বলাই পায়নি। কারণ তার ‘প্রাণের দোসর’ তারাই ‘প্রতিরূপ’ শিমূল গাছটির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এই শিমূল গাছ কাটার ফলে বলাইয়ের কাকিমা দুদিন অন্নগ্রহণ করেননি। কারণ- “ঐ গাছই যে ছিল তাঁর বলাইয়ের প্রতিরূপ, তারই প্রাণের দোসর।”১৬

    আলোচিত পাঁচটি গল্পের মূল চরিত্রগুলি মূলত কিশোর বয়সী। আমরা জানি শিশুরা স্বভাবজাত ভাবেই পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হতে ভালোবাসে। সভ্যতার আদি লগ্নে মানুষ যেমন প্রকৃতি সংলগ্ন ছিল। সভ্যতার অগ্রগতি মানুষকে পরিবেশ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পোস্টমাস্টার প্রকৃতির থেকে দূরে কলকাতা শহরে চলে গেছে উন্নত সভ্যতার টানে। তাই রতনের ভালোবাসা তার কাছে মর্যাদা পায়নি। রতন রয়ে গেছে প্রকৃতির মাঝে চিরন্তন আশা বুকে নিয়ে। আবার ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক বেড়ে উঠেছিল প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনে কিন্তু পরিবারের সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে যেতে হয়েছে প্রকৃতির কোল থেকে কলকাতায় ইট কাঠ পাথরে ঘেরা কংক্রিটের শহরে। সেখানে প্রকৃতিকে ছাড়া, তার মাকে ছাড়া অস্থির হয়ে উঠেছে সে।তাই জীবন থেকে ছুটি পাওয়ার আগে ও ফিরে আসতে চেয়েছে তার গ্রামে, সবুজে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে। ‘সুভা’ গল্পেও সুভা চায়নি তার প্রকৃতি মাতাকে ছেড়ে কলকাতা যেতে। ফটিক ও সুভা দুজনেরই জীবনে এসেছে বিপর্যয় যে বিপর্যয়ের উৎসে কাজ করেছে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্নতা। অন্যদিকে তারাপদ আটকা পড়েছে মনুষ্য সৃষ্ট গৃহ পরিবেশের অভ্যন্তরে। লেখক চরিত্রটিকে তার থেকে মুক্ত করে প্রতিস্থাপন করলেন প্রকৃত সৃষ্ট বৃহত্তর বাসগৃহে। আর ‘বলাই’ গল্পটিতে এসে আমরা পেলাম চরিত্রের অন্দরমহলেই প্রাকৃতিক পরিবেশের সমাবেশ। বলাই আদ্যান্ত বৃক্ষ প্রেমিক। এখানে লেখক বলাই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বৃক্ষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা জাগানোর চেষ্টা করেছেন। আজকের এই বিশ্ব-উষ্ণায়নের দিনে একটি বৃক্ষ কত গুরুত্বপূর্ণ তা রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই অনুভব করতে পেরেছিলেন। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিদ্যায়তনের জন্য উৎসব অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলেন। সে-সব উৎসব আয়োজিত হল দেব-দেবী ধর্মাচরণ নিয়ে নয়, প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। বর্ষামঙ্গল, পৌষ-মেলা বসন্তোৎসব। তিনি শুরু করলেন হলকর্ষণ উৎসব, বৃক্ষরোপণ উৎসব। এই সবই ১৯৩০ এর মধ্যে। তখন কোথায় ১৯৭২-এর কনফারেন্স, কোথায় ১৯৯২-এর বসুন্ধরা শীর্ষ সম্মেলন। বৃক্ষরোপন উৎসবকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ যেসব গান কবিতা লিখেছেন তা আজও হতে পারে বিশ্বের প্রকৃতি পরিবেশ চেতনার বিকাশের বাণী। তিনি তারও অনেক আগে লিখে গেছেন সভ্যতার প্রতি কবিতা-

“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,

লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর

হে নব সভ্যতা। হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,

দাও সেই তপোবন পুণ‍্যছায়রাশি,”১৭

     পুরাণের রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে প্রাচীন- মধ্য ও আধুনিক সাহিত্যে প্রকৃতি একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। তাইতো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলির মধ্যেও প্রকৃতি তার নিজস্ব জায়গাটি স্বতন্ত্র করে নিয়েছে। প্রকৃতির কোলে বাস করে লেখক রবীন্দ্রনাথ যে প্রকৃতিকে তাঁর সৃষ্টি জগতে শ্রেষ্ঠ আসন দেবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই প্রকৃতির নানা রূপ এবং তার পরিবর্তনের চিত্র সমস্ত ছোটগল্পগুলিতে তিনি তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতির বর্তমান করুণ অবস্থাকেও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বুঝতে পেরেছিলেন বনভূমি হ্রাসের ফলাফল কী হতে পারে। দূরদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন আগামী দিনে পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে মনুষ্য সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ। আর এই দূষণ মুক্তির চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্পের পরিবেশ ভাবনায়।

 তথ্যসূত্র:

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,জগদীশচন্দ্র,চিঠিপত্র,ষষ্ঠ খন্ড,ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩,বিশ্বভারতী,পৃ-১২৫

২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,ছিন্নপত্র,বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পত্র সংখ্যা ৭৪,পৃ-১৪৩

৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,ছিন্নপত্র,বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পত্র সংখ্যা ২২৭, পৃ-২৭৯

৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, প্রথম খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ ১৩১৩, ‘পোস্টমাস্টার’,পৃ-২৩

৫. তদেব

৬. আশিষ রায়, ‘এবং প্রান্তিক’ An international research referred journal vol-4th September 2014,পৃ-১৭৪

৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, প্রথম খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ ১৩১৩, ‘ছুটি’,পৃ-১৩৯

৮. তদেব,পৃ-১৪১

৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, প্রথম খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ ১৩১৩, ‘সুভা’,পৃ-১৪৩

১০. তদেব,পৃ-১৪৬

১১.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গল্পগুচ্ছ, দ্বিতীয় খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ ১৩১৩, ‘অতিথি’,পৃ-২৮১-২৮২

১২. কবিতা নন্দী চক্রবর্তী, ‘বাংলা সাহিত্যে পরিবেশচেতনা’, রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ জীবনানন্দ, প্রথম প্রকাশ- কলকাতা বইমেলা জানুয়ারি ২০১৭,পৃ-১৩৭-১৩৮

১৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘গল্পগুচ্ছ’, দ্বিতীয় খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ-১৩১৩ ‘অতিথি’, পৃ-২৯০

১৪. কবিতা নন্দী চক্রবর্তী, ‘বাংলা সাহিত্যে পরিবেশচেতনা’, রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ জীবনানন্দ, প্রথম প্রকাশ- কলকাতা বইমেলা জানুয়ারি ২০১৭, পৃ-১৩৮

১৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘গল্পগুচ্ছ’,তৃতীয় খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ-১৩১৩ ‘বলাই’,পৃ-৬৫১

১৬. তদেব,পৃ-৬৫৩

১৭. রবীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ‘চৈতালি’, সভ্যতার প্রতি, প্রকাশ জুলাই ১৯৮০, পৃ-৬৬০

বিভূতিভূষণের ছোটগল্পে প্রকৃতিচেতনা

বিভূতিভূষণের শিল্পজগৎ প্রকৃতির বিচিত্র রূপ-রস-অনুভূতির আনন্দে বিহ্বল। প্রকৃতির সাহচর্যে তাঁর শিল্পী সত্তা লালিত হয়েছিল। ব্যক্তি জীবনেও বিভূতিভূষণ শুরু থেকেই প্রকৃতির সংস্পর্শে এসেছেন। গ্রাম বাংলার নানা জায়গায়, যশোহর জেলার বারাকপুর গ্রামে, হুগলির কাছে শাগঞ্জ কেওটায় ও মুরাতিপুরে মামার বাড়িতে তাঁর শৈশব কৈশোরের অনেকগুলো দিন কেটেছে। নির্জন আকাশ, উধাও মাঠ আর নিঃসঙ্গ নদী তীরের গোপন সাহচর্যে পৃথিবীর সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় ঘটেছিল। জীবনের প্রারম্ভেই প্রকৃতির সাথে তাঁর যে বিস্ময়কর সাক্ষাৎ ঘটেছিল তার পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন রচনায়। প্রকৃতির সংস্পর্শে এলে তাঁর মন থেকে জাগতিক জীবনের দুঃখ গ্লানি সব তুচ্ছ হয়ে যেত। প্রকৃতির সুবিশাল রূপের স্পর্শ শৈশব থেকেই তাঁর মনে গভীরভাবে মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল। তাইতো বিভূতিভূষণের সাহিত্যে প্রকৃতির অনন্য সাধারণ রূপের বর্ণনা একটা স্বতন্ত্র আসন লাভ করেছে। প্রকৃতির থেকে মানুষকে তিনি কখনো বিযুক্ত বলে ভাবেননি। ফলে কল-কারখানা ও যন্ত্র জীবনের জটিল সমস্যা প্রকৃতিপ্রেমী বিভূতিভূষণকে ব্যথিত করেছে, সেই চিত্রই আমরা দেখতে পাই ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’, ও ‘অপরাজিতা’ প্রভৃতি উপন্যাসে। বনভূমি হ্রাস পাওয়া নিয়ে লেখক কতটা ভাবিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় পাতায়। তবে শুধু উপন্যাসের মধ্যেই লেখক বিভূতিভূষণের প্রকৃতি ভাবনা সীমাবদ্ধ নয়, দিনলিপি, ভ্রমণ কাহিনি এবং ছোটগল্পেও কথাসাহিত্যিকের প্রকৃতি প্রীতি ও প্রকৃতিচেতনা অন্যতম এক বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর প্রকৃতি প্রীতিমূলক গল্পগুলি হল ‘শাবলতলার মাঠ’, ‘মৌরিফুল’, ‘মেঘমল্লার’, ‘পুঁইমাচা’, ‘কুশল পাহাড়ী’ প্রভৃতি।

   ‘শাবলতলার মাঠ’ গল্পে লেখক যন্ত্র সভ্যতার আগ্রাসী প্রভাবের ফলে প্রকৃতির বিনাশের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান সময়ে বিপন্ন পরিবেশ বিপন্ন পৃথিবী। পৃথিবীর এই বিপন্নতার কাহিনি নিয়েই লেখক এই ‘শাবলতলার মাঠ’ গল্পটি রচনা করেছেন। যে সময়ে এই গল্পটি লেখা সে সময় পৃথিবী এতটা বিপন্ন ছিল না তবুও প্রকৃতিপ্রেমী লেখক প্রকৃতির বিপন্নতা এতদিন আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাইতো আজ থেকে এত বছর আগেই যন্ত্র সভ্যতার আগ্রাসনে পৃথিবীর কী করুণ পরিনিতি হতে পারে সেই চিত্র অঙ্কন করেছেন ‘শাবলতলার মাঠ’ গল্পটিতে। গল্পের শুরুতেই দেখি লেখকের ছোটবেলায় কাটানো শাবলতলার মাঠ জুড়ে মস্ত বড় কী এক কারখানা বসছে। শুধু তাই নয় মাঠের উপরে বসেছে বড় রেললাইন। এই কারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে হারিয়ে গেছে লেখকের প্রিয় শাবলতলার মাঠের পুরনো প্রকৃতি ও পরিবেশ। কারখানা স্থাপনের সাথে সাথে গাছপালা, পশুপাখি সবকিছু হারিয়েছে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব। উন্নয়ন আর পরিবেশের দ্বন্দ্বে বিপন্ন মানবত্মার কাহিনি এই ‘শাবলতলার মাঠ’ গল্পটিতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। পৃথিবীতে যন্ত্র যত বৃদ্ধি পাচ্ছে যন্ত্রণাও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যন্ত্রের দানবীয় গর্জন, গগনচুম্বি চিমনি থেকে গল গল করে বেরিয়ে আসা দৈত্যকার কালো ধোঁয়া কেবল মানুষ নয় সর্ব শ্রেণির প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করছে। গল্পে আমরা দেখতে পাই গ্রাম মাঠ দখল করে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার কাহিন—

‘কলকারখানা বসছে বোধ হয়।

কতদূর নিয়ে?

তা বাবু অনেক দূর নিয়ে উই বাজিতপুর, মনসাতলা, ছাওয়াল-মারি, বেদে-পোতা হাঁসখালির চড়া পর্যন্ত।

গ্রামগুলো সব কোথায়?

সব উঠিয়ে দিয়েছে।’

ঠিক একই চিত্র আমরা দেখি অমর মিত্রের ‘কৃষ্ণগহ্বর’ উপন্যাসে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য গ্রামের পর গ্রাম উঠিয়ে দিয়ে জমি গ্রাস করে নিচ্ছে কোম্পানির প্রয়োজনে। প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনিষ্ট করে তৈরি হচ্ছে পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি—“উত্তর কাঁঠাল বেড়ের সবটা নেবে, মণ্ডল পাড়া, কুমোর পাড়া, জেলে পাড়া, ধান জমি।” এভাবেই কারখানার প্রয়োজনে চলছে জমি অধিগ্রহণ। অমর মিত্র ১৯৯৮ সালে কারখানার বৃদ্ধির ফলে জমি অধিগ্রহণের চিত্র এঁকেছেন তাঁর ‘কৃষ্ণগব্বর’ উপন্যাসে। আর বিভূতিবাবু তার বহু আগেই ‘শাবলতলার মাঠ’ গল্পে কারখানার বৃদ্ধির ফলে প্রকৃতি ধ্বংসের চিত্র অঙ্কন করে গেছেন। সুকান্তি দত্ত তাঁর ‘যুধান কথা’ উপন্যাসেও অনুরূপ সমস্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। বর্তমান পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেমন প্রয়োজন হয়ে পড়ছে বসতবাড়ির তেমনি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটাতে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে কলকারখানা। এসব কলকারখানা নির্মাণ করতে যেমন ফাঁকা জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে তেমনি দূষণ করছে প্রকৃতি ও পরিবেশকে। ‘যুধান কথা’ উপন্যাসে লেখক বলেছেন—“কর্কশ পাথুরে প্রান্তর উধাও। উধাও সেই বিকৃত জলাশয়।” এভাবেই মাঠ, ঘাট, প্রান্তর, জলাশয় সমস্ত কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে কলকারখানা নির্মাণের প্রয়োজনে। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। ধ্বংস হচ্ছে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স। তাইতো বর্তমানে পশুপাখি তাদের বাসস্থানের পরিবেশ হারিয়েছে। যে ‘শাবলতলার মাঠ’ ঝোপ ঝাড়ে পূর্ণ ছিল তা আজ ইট-কাট-পাথরে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। তাইতো লেখক আক্ষেপ করে বলেছেন— ‘আমার সেই ছেলেবেলাকার শাবলতলার মাঠ কোথায় গেল? সত্যিই তা নেই। তার বদলে কতগুলো তাঁবুর সারি ইটখোলা, পাথুরে কয়লার স্তুপ, চুনের ঢিপি, লোকজনের হৈ চৈ লরির ভিড়।’ গাছপালা হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে পশু-পাখিও। তাই গল্প শেষে লেখক দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন—‘দুঃখ হলো দেখে-সে শাবলতলার মাঠ একেবারে ধংস হয়ে গিয়েছে। মুছে গিয়েছে সে সৌন্দর্য সে নির্জনতা।’ গল্পে শিল্প কারখানা তৈরির এবং তার ভয়াল পরিণীতির চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে। শিল্প সভ্যতার উন্নয়ন প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে এই গল্পে সেই দৃশ্য সচেতন পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে।

    ‘মৌরীফুল’ গল্পটির প্রকৃতিও বিভূতিভূষণের চির পরিচিত জগতের এক টুকরো চিত্র। গল্পটি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩৩০ বঙ্গাব্দের অগ্রায়ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গল্পের মূল উপজীব্য হল প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিসত্তা প্রকৃতির বিপুল প্রান সত্তার মধ্যে এসে আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়ে। ভালো লাগার এক চিরস্থায়ী দাগ তার হৃদয়ে আঁকা হয়ে যায়। ডেপুটিবাবুর স্ত্রীর এমনই হয়েছিল গ্রামের বধু সুশীলাকে দেখে। উভয়ের বন্ধুত্বের স্মারক হয়ে রইল মৌরীফুল। রামতনু, মোক্ষদা কিশোরীরা সুশিলার বিপরীত পক্ষ। প্রকৃতি বিনষ্ট হচ্ছে জাগতিক প্রয়োজনে। আর এই জাগতিক কামনা বাসনার যুপকাষ্ঠে সুশীলা বলি হয়ে গেল। সুশীলাও পারলোনা প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে।

    বিভূতিবাবুর ‘মেঘমল্লার’ গল্পে প্রকৃতি একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। বিভূতিভূষণের অন্তর প্রকৃতি অনেকটা শান্ত ও সমাহিত তাঁর লেখার প্রকৃতিও আমাদের চোখে শান্ত ও স্থির। সেই প্রকৃতি একটু যেন নির্জন। ‘মেঘমল্লার’ গল্পে বর্ণিত বৌদ্ধ বিহারের আশেপাশের প্রকৃতিও নির্জন। কিশোর অপুর মত এই গল্পে প্রদ্যুম্নও প্রকৃতিকে ভালোবাসে এবং সে নিজে সুর সাধক। যিনি শিল্পী মানুষ তিনি তো প্রকৃতিপ্রেমিক হবেই। এই গল্পে আমরা দেখি আসন্ন বর্ষার প্রকৃতি খুব সুন্দর ভাবে চিত্রিত। জৈষ্ঠ্য মাসের সংক্রান্তি তিথিতে মন্দিরে উৎসব তাই ঐ অঞ্চলের মেয়ে পুরুষ সবাই ভিড় করেছে সেখানে। প্রদ্যুম্নও সেখানে গেছে ভালো বিন বাজিয়ের সন্ধানে। মন্দির থেকে নেমে আসার সময় ভেসে ওঠে আসন্ন বর্ষার এক টুকরো ছবি—‘প্রদ্যুম্ন দেখলে দূরে নদীর ধারে মন্দিরটার চূড়া দেখা যাচ্ছে। চূড়ার মাথার উপরকার ছায়াছন্দ আকাশ বেয়ে ঝাপসা ঝাপসা পাখীর দল ডানা মেলে বাসায় ফিরছিল। আরও দূরে একখানা সাদা মেঘের প্রান্ত পশ্চিমদিকের পড়ন্ত রোদে সিঁদুরের মত রাঙা হয়ে আসছিল, চারিধারে তার শীতোজ্জ্বল মেঘের কাঁচুলি হালকা করে টানা।’

     গল্পশেষে দেখি  প্রদ্যুম্নর প্রিয়া সুনন্দা প্রদ্যুম্নকে পাওয়ার জন্য ‘কুমারশ্রেণীর বিহারে’ প্রবজ্রা গ্রহণ করে। প্রদ্যুম্ন যখন দেবীর সন্ধানে যায় তখন সে বলেছিল ফিরে আসবে। তাই সুনন্দা প্রতিদিনই অপেক্ষায় থাকে। সে তো জানে না তার প্রিয়তম পাষানবৎ হয়ে উরুবিল্ব গ্রামে রয়েছে। সে আর কোনদিনও ফিরবে না।

    এই সময় সুনন্দা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত, যা গল্পের কাহিনি অনুযায়ী সত্য বলেই প্রতিভাত হয় আমাদের সামনে। এই অংশেও প্রকৃতি চিত্রই প্রধান হয়ে ওঠে-‘এক এক রাতে সে বড় অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। কোথাকার যেন কোন এক পাহাড়ের ঘন বেতের জঙ্গল আর বাঁশের বনের মধ্যে লুকানো এক অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি। নিঝুমরাতে সে পাহাড়ের বেতগাছ হাওয়ায় দুলছে, বাঁশবনে শিরশির শব্দ হচ্ছে, দীর্ঘ দীর্ঘ বেতডাটার ছায়ায় পাষাণমূর্তিটার মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। সে অন্ধকার অর্ধরাত্রে জনহীন পাহাড়টার বাঁশগুলোর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে কেবল বাজছে মেঘমল্লার…।’ এই প্রকৃতিচিত্রণের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় প্রদ্যুম্ন আর জীবিত নেই। বেতের আর বাঁশের জঙ্গলের মাঝে ‘অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি’ যে পদ্যুম্নই সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃতির এই বর্ণনায় আমাদের হৃদয়ও রসার্ত হয়ে ওঠে। যে মেঘমল্লার ধ্বনিত হয় প্রদ্যুম্নর বাঁশিতে এবং তা তুফান তুলত সুনন্দার হৃদয়েও সেই রাগই ধ্বনিত হয়ে ফিরছে প্রদ্যুম্নর পাষাণমূর্তির কাছে। এই গল্পের ঘটনা সংস্থান ও চরিত্রের টানাপোড়েনও আন্দোলিত হয় বিভূতিভূষণের অসাধারণ প্রকৃতি বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে।

    ‘পুঁইমাচা’ গল্পের প্রথম প্রকাশ ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৩১ সালের মাঘ সংখ্যায়। প্রকৃতিপ্রেমী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রায় দ্বিশতাধিক গল্পের মধ্যে অন্যতম প্রকৃতি নিবিড় গল্প হল ‘পুঁইমাচা’। মূলত ক্ষেন্তির জীবন বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে গল্পে, আর সেই সূত্রেই গল্পে প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মানবের নাড়ীর টানের চিত্র। প্রকৃতির কোলে বড় হয়ে ওঠা ক্ষেন্তির প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতার করুণ পরিণতির চিত্র গল্পের শেষে প্রকাশিত‌। ‘পুঁইমাচা’ গল্পটি ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের আগে লেখা। এই গল্প ও উপন্যাসে আছে বাংলার গ্রামজীবন, সহজ-সরল শান্ত প্রকৃতি আর তীব্র দারিদ্র-লাঞ্চিত পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বাঁধা মানব-মানবীর জীবনের উজ্জ্বল প্রেক্ষিত।

    ‘পুঁইমাচা’ গল্পে আমরা দেখি গ্রাম বাংলার প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এক দুরন্ত বালিকাকে তার নাম ক্ষেন্তি। সে যেমন পুঁইশাক মানুষের পুকুরপাড় থেকে তুলে এনেছে তেমনি তার বাবার সঙ্গে বরোজপোতার বনে গিয়ে মানুষের মেটে আলু চুরি করে এনেছে। শুধু তাই নয় নিজের প্রিয় শাক পুঁইয়ের চারা পুতেছে নিজের হাতেই। লেখকের বর্ণনায়— ‘…পাঁচিলের ধারে যে ছোট খোলা জমিতে কতগুলো পাথরকুচি ও কন্টিকারীর জঙ্গল হইয়াছিল, ক্ষেন্তি ছোট বোনটিকে লইয়া সেখানে মহা উৎসাহে তরকারির আওলাত করিবার আয়োজন করিতেছে এবং ভবিষ্যসম্ভাবী নানাবিধ কাল্পনিক ফলমূলের অগ্রদূত স্বরূপ বর্তমানে কেবল একটিমাত্র শির্ণকায় পুঁইশাকের চারা কাপড়ের ফালির গন্থিবদ্ধ হইয়া ফাঁসি হইয়া যাওয়া আসামীর মতন ঊর্ধ্বমুখে একখণ্ড শুষ্ক কঞ্চির গায়ে ঝুলিয়া রহিয়াছে।’ ক্ষেন্তির মা বলেছে এই খরার সময় পুঁইচারা বাঁচবে না তবুও ক্ষেন্তি প্রতিদিন জল ঢেলে এই পুঁইশাকের চারাকে বাঁচিয়ে তুলেছে। এভাবেই প্রকৃতির কোলে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ক্ষেন্তি দুরন্ত জীবন অতিবাহিত করেছে। কিন্তু মেয়েদের জীবন বৈশিষ্ট্যকে মেনে চিরকাল ক্ষেন্তি প্রকৃতির কোলে তার পিতার গৃহে কাটাতে পারেনি। কোনো এক বৈশাখ মাসে তার বিয়ে হয়েছে শহরের ধনী পাত্রের সঙ্গে —‘কিন্তু পাত্রটি সংগতিপন্ন, শহর অঞ্চলে বাড়ী, সিলেট, চু্ন, ইটের ব্যবসায় দু’পয়সা নাকি করিয়াছে, এরকম পাত্র হঠাৎ মেলাও বড় দুর্ঘটনা কিনা!’ গ্রাম থেকে উচ্ছিষ্ট হয়ে ইট কাঠ পাথরে ঘেরা বড় লোকের বাড়িতে ক্ষেন্তি অসহায় হয়ে পরে। শুধু তাই নয় প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা দুরন্ত বালিকা বড়লোক শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতেও পারেনা। তাই একটি তরতাজা প্রাণ হারিয়ে যায় অকালে। এই একই দৃশ্য আমরা দেখেছি রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পে সুভা কথা বলতে পারেনা, কিন্তু প্রকৃতি তার ভাষার অভাব পূরণ করে দিয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে সুভারও ছিল  ক্ষেন্তির মতোই সখ্যর সম্পর্ক সুভাও প্রকৃতিমাতাকে ছেড়ে কলকাতায় যেতে চাইনি। কিন্তু তার পিতা তাকে কলকাতায় নিয়ে বিবাহ দেয় এবং প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা প্রকৃতির কন্যা সুভা প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। তাইতো কলকাতা যাওয়ার আগের রাত্রে সুভা প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে বলে—“সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চির পরিচিত নদীতটে পুষ্পশয্যায় লুটাইয়া পড়িল -যেন ধরনীকে, এই প্রকাণ্ড মৃগ মানব মাতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে, তুমি আমাকে যাইতে দিও না মা। আমার মত দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো।” ক্ষেন্তিও চেয়েছিল প্রকৃতির কোলে এইভাবে বেঁচে থাকতে কিন্তু পারেনি। একইভাবে পারেনি রবীন্দ্রনাথের ফটিক, প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে ফটিক যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তখন সে তার মাকে বলে—“এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।” ফটিক গ্রামে প্রকৃতির মাঝে বড় হয়েছে তাইতো প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি, পারেনি শহরে মামীর কাছে প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে। সুভা ও ফটিকের মত ক্ষেন্তিও প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকতে পারেনি।

    ‘কুশল পাহাড়ী’ গল্পে লেখক বিভূতিভূষণ প্রকৃতির অপরূপ চিত্র যেমন এঁকেছেন তেমনি প্রকৃতির মাঝে মানুষ কতটা সুস্থ স্বাভাবিক ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে সেই চিত্রও অঙ্কন করেছেন। এই গল্প আরণ্যক উপন্যাসের ক্ষুদ্র রূপ বলা যায়। বন্য জীবজন্তু ও জলপ্রপাত এবং বনভূমির অপরূপ দৃশ্যে ভরপুর অরণ্যময় সুন্দরগড় স্টেট্। সেই স্থানে ঘুরতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাই লেখক এখানে ব্যক্ত করেছেন। গল্পে লেখক বলেছেন—‘সুন্দরগড় অরণ্য প্রকৃতির লীলানিকেতন।’ প্রকৃতির এই লীলানিকেতনের এক টুকরো চিত্র লেখক এই গল্পে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতির এই রূপ ও সৌন্দর্য যাতে হারিয়ে না যায় লেখক সেই কামনা করেছেন—‘বর্ষার দিনে পথের এই সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সেদিন ভাবছিলুম, আজ এ বন যেন শেষ না হয়। শেষ হলেই তো মায়া ফুরিয়ে যাবে। আবার পড়বে লোকালয়, তখুনি শুরু হবে ব্ল্যাকমার্কেট খবরের কাগজ, হপ্তায়-একদিন-ভাত-খেও না উপদেশ, উদ্বাস্তু-সমস্যা। এই রকম মায়াজগতের মধ্যে দিয়ে যতদিন চলে চলুক গাড়ি।’ নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার নানা ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত হয়ে লেখক প্রকৃতির মাঝে দিন কাটাতে চেয়েছেন। প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যে বিলীন হতে চেয়েছেন।

     পাহাড়ি জল অনেক উপকারী হয়, লেখক সে কথাও গল্পে বলেছেন—‘এ দেশের জলের গুন আছে বটে। আগ্নিমান্দ্যে ভুগছিলাম গত এক বছর, ক্ষুধাবোধ একেবারে ছিল না। বেশ পেট ভরে চিড়ে দই ও ফল খেয়ে ঝর্নার নির্মল জল পান করে আবার গাড়ী ছেড়ে দিলাম।’ বিশুদ্ধ পানীয় জল মানুষকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে যে জলের বর্তমানে বড়ই অভাব। পাহাড়ের বিশুদ্ধ জল লেখকের পেটের সমস্যা দূর করে খিদে সঞ্চার করেছিল। ঠিক এই একই দৃশ্য আমরা অমর মিত্রের ‘হাঁসপাহাড়ি’ উপন্যাসেও দেখতে পাই। এই উপন্যাসের শুরুতেই দেখি অফিসের কেরানি রবিলোচন অসুস্থ কিছুতেই রোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ডাক্তার কবিরাজ একের পর এক বদল করেও যখন কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না তখন তার অফিসের এক বন্ধু বলে— “তুমি হাঁসপাহাড়ি চলে যাও রবিলোচন, ওখানকার জল মানেই আয়ু।” পাহাড়ের এই জল কত বিশুদ্ধ তার প্রমাণ এই গল্পেও পাওয়া যায়। তাইতো লেখক উন্নত সভ্যতা আমাদের শরীর ও মন নিস্তেজ করে দিচ্ছে বলে আক্ষেপ করেছেন আর থেকে যেতে চেয়েছেন সুপ্রাচীন প্রকৃতির কোলে—‘সব যেন এখানে সুপ্রাচীন-প্রাচীন সাধু, প্রাচীন শালবৃক্ষ, প্রাচীন শিলাসন, প্রাচীন অরণ্য-ভূমি। মনে হলো এ পরিবেশ ছেড়ে আর কোথাও যাচ্ছি নে, থেকে যাই এখানেই।’ লেখক আধুনিক শহরের সভ্যতার বৈষয়িক হিসাব, ভোটের আগের হাঙ্গামায় ফিরে না এসে থেকে যেতে চেয়েছেন প্রকৃতির কোলে। লেখক নিজেকে এই বৈষয়িক জীবনে নিজেকে বাঁধতে চাননি তাই গল্প শেষে বলেছেন—‘মানুষ মুক্ত। সে-ই নিজেকে নিজে বেঁধেচে। সে-ই অনুভব করুক সে মুক্ত। সে মানুষ, সে মুক্ত।’ মুক্ত পৃথিবী মুক্ত প্রকৃতিই মানবের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান লেখক সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন ‘কুশল পাহাড়ী’ গল্পের মধ্য দিয়ে।

    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আদ্যন্ত একজন প্রকৃতিপ্রেমিক। তাঁর প্রত্যেকটি রচনায় প্রকৃতি তার সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে উপস্থিত থাকে। শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয় সেই সঙ্গে থাকে প্রকৃতি হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রনা। ‘আরণ্যক’-এ সত্যচরনের কাছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যেমন ধরা দিয়েছে তেমনি অরণ্য প্রকৃতিকে ধ্বংস করার জন্য বারবার সত্যচরণ ধিক্কার দিতে থাকে নিজেই নিজেকে। শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের কথক এই কাজ ছেড়ে চলেও আসে। একইভাবে আমরা দেখি যন্ত্রসভ্যতার আগ্রাসন শাবলতলার মাঠকে গ্রাস করেছে দেখে লেখকের হৃদয় যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেছে। কলকারখানার বৃদ্ধি কীভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করছে সেই চিত্রই গল্পে লেখক দেখিয়েছেন কতকাল আগেই। ‘মৌরীফুল’ গল্পে প্রকৃতির অপরূপ চিত্র চিত্রিত হয়েছে। ‘মেঘমল্লার’ গল্পে প্রকৃতি ও প্রদ্যুম্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ‘বলাই’ গল্পে একটি গাছ যেমন বলাইয়ের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছিল এখানেও প্রকৃতি প্রদ্যুম্নের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে। ‘পুঁইমাচা’ গল্পে পুঁইলতার বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্র ক্ষেন্তির বেড়ে ওঠাকে আশ্চর্যভাবে মিলিয়েছেন বিভূতিভূষণ। আর ‘কুশল পাহাড়ী’ গল্পে প্রকৃতির অপরূপ চিত্র যেমন প্রকাশিত, তেমনি প্রকৃতির বিশুদ্ধ জল মানবের কত উপকারি তা যেমন বর্ণিত, এই জলের অভাব মানুষের কত ক্ষতি করছে তাও বর্ণিত হয়েছে। তারসঙ্গে যন্ত্রসভ্যতা মানব জাতিকে কীভাবে বিকল করে তুলছে সে কথাও লেখক পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন‌। তাইতো গল্পগুলির মধ্যে বিভূতিবাবু শুধু প্রকৃতির চিত্র আঁকেননি, এঁকেছেন প্রকৃতি বিনষ্ট হওয়ার চিত্র। কারন তিনি জানতেন প্রকৃতি হারা হয়ে মানব একদিন বিপন্ন পরিবেশের সম্মুখীন হবে। তাই তিনি মানবজাতিকে প্রকৃতি রক্ষা করার শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁর  গল্পগুলির মধ্য দিয়ে।

 তথ্যসূত্র:

১.মিত্র, অমর: ‘কৃষ্ণগহ্বর’, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮,পৃ-৯

২.দত্ত, সুকান্তি: ‘যুধান কথা’, শিল্পভাষা একাদেমি, কলকাতা-২৭, প্রথম প্রকাশ- ডিসেম্বর,২০০১, পৃ-১২

৩. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ: গল্পগুচ্ছ, প্রথম খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ ১৩১৩, ‘সুভা’,পৃ-১৪৬

৪. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ: গল্পগুচ্ছ, প্রথম খন্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বিশ্বভারতী সংস্করণ ১৩১৩, ‘ছুটি’,পৃ-১৪১

৫.মিত্র, অমর: ‘হাঁসপাহাড়ি’, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯২, প্রথম করুণা মুদ্রণ বইমেলা ২০০৬, পৃ-৮

সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে পরিবেশ চেতনা

   একজন সার্থক শিল্পী তাঁর সাহিত্যে মনোরঞ্জনের পরিবর্তে মননধর্মিতার চর্চায় বেশি মনোযোগী হন। কথাশিল্পী সাধন চট্টোপাধ্যায় (১৯৪৪) এই মননধর্মিতার কথা বলেই বাংলা কথাসাহিত্যে দায়বদ্ধ শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সাহিত্যিক নয়, বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই বিজ্ঞানচর্চা এবং বিজ্ঞান চেতনা তাঁর গল্প উপন্যাসেও বিস্তর প্রভাব ফেলেছে। একইসঙ্গে তাঁর লেখায় রয়েছে পরিমিতি বোধ এবং এক বিশ্লেষণী জিজ্ঞাসা। তাঁর টেক্সটে ধরা থাকে সময় এবং আগামী সময়ের ভাষ্য। এপ্রসঙ্গে উপন্যাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে তপোধীর বাবু বলেছেন–“সার্থক উপন্যাস তাকেই বলব যেখানে বয়নের সংকটময় সন্ধি মুহূর্ত ও আবর্তন বিন্দু ব্যক্ত হয় সময়ের বিভিন্ন চিহ্নায়কের মধ্য দিয়ে।” ঠিক একইভাবে ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। আমরা দেখি কথাকার সাধনবাবু তাঁর ছোটগল্পগুলির মধ্যদিয়ে একইভাবে সময়ের কথা বয়ন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন, সামাজিক চাহিদা, বিশ্ব রাজনীতি প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন করে দেয়। সেই প্রকৃতি পরিবেশের বিনষ্ট হওয়ার চিত্র সময় ও সমাজ সচেতন কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায়ের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাঁর গল্পের সংখ্যা যেমন বহুল তাই তাঁর বিষয়বৈচিত্র্য নানা রূপে রসে ভরা। এই বহুল বিষয়বৈচিত্র্যের মধ্যেই তাঁর গল্পের অন্যতম একটি বিষয় হয়ে উঠেছে প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতনতা। তাঁর পরিবেশ সচেতনামূলক গল্পগুলি হল- ‘একটি চুম্বনের জন্ম’ (পরিচয়, ১৯৮৭), ‘মহাপ্রাণের ঋণ’ (নির্মাণ, শারদীয়, ১৯৯৫), ‘ভুঁই জোনাকি’ (প্রমা, শারদীয়, ১৯৯৫)প্রভৃতি। গল্পগুলি আলোচনা করে দেখব লেখকের সচেতনতার গুণে কীভাবে গল্পগুলি পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা ইকো-টেক্সট হয়ে উঠেছে।

    ভূমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ সাধারণত নিরপেক্ষ হলেও মূলত ইদানিংকালে উষ্ণতা বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করা হয় এবং এটি মানুষের কার্যকর্মের প্রভাবে ঘটছে। গত এক দশকে প্রায় প্রতিবছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আগের রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। এই ক্রমবদ্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়ন বর্তমানে বিশ্ববাসীর কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধন চট্টোপাধ্যায় এই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে আজ থেকে ৩৬ বছর আগে লিখেছেন ‘একটি চুম্বনের জন্ম’(১৯৮৭) গল্পটি। প্রচন্ড গরমে পুড়ছে চারপাশ। এই গল্পে ক্ষিতিমোহন স্কুল টিচার এবং একজন অসফল লেখক। তিনি গরমে পিস রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাবেন কালকের কাগজের হেডলাইন হবে-‘কোনদিন এদেশে বৃষ্টি হবে না? এই কর্কটক্রান্তীয় মহাদেশে শুধু ঘাস জ্বলবে, মাটিতে কাঁকর ফুটে উঠবে, তামার বর্ণ আকাশের নিচে কালো মানুষরা ঝিমিয়ে বোধির ক্রীতদাস হয়ে থাকবে?’ তীব্র গরমে ক্লান্ত ক্ষিতিমোহন, সে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হয়েছে–‘সমস্ত দেহ নিংড়ে নাকের ডগা, থুতনি এবং কানের পাশ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা লবণাক্ত সাদা রক্ত পড়তে থাকে সে যেন পীড়নের উল্লাসে চারদিকে কাঁচা কয়লার কুণ্ডলী জ্বালিয়েছে।’ দিন দিন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে কল-কারখানা এই কল-কারখানা বৃদ্ধির ফলে তা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। আধুনিক জীবন যাপনে বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা তা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে, শুধু তাই নয় মানবজাতি যত ভোগবাদী হয়ে উঠছে ততই প্রকৃতির উপর অত্যাচার করছে। শহর বাড়ছে, গ্রাম কমছে, হ্রাস পাচ্ছে গাছপালা ফলস্বরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। এই যে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে কিন্নর রায় তাঁর ‘প্রকৃতি পাঠ’ উপন্যাসে বলেছেন-“যেন আইখম্যানের গ্যাস চেম্বারে সবাই একসঙ্গে বসবাস করছে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর প্রতীক্ষায়।”

     গল্পে আমরা দেখতে পাই গাছপালার হ্রাসের ফলে তাপও প্রবাহ বৃদ্ধির চিত্র। বর্তমানে প্রকৃতির ঠান্ডা হওয়া নেই মানুষ এ.সি আর ফ্যানের মতো যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল। যন্ত্রের হাওয়ায় ক্লান্তি মুক্তি হয় না। তাই লেখক আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছেন–‘ফ্যানটা ঘুরছে। বিয়ে বাড়ির বাসি ফুলের মতো, যন্ত্রের বাতাসে কোন আকর্ষণ নেই।’ যন্ত্র সভ্যতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বনভূমি হ্রাস প্রকৃতি পরিবেশকে ধ্বংস করছে ফলে ঋতুচক্র বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই চিত্র গল্পকার গল্পে তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব ভাষায়–‘বাধ্য হলে, দু একটা কথা বলে মানুষ। যার বিষয় হল অসহ্য তাপ।

— বৃষ্টি হবে না।

 —একটানা দু’মাস ধরে।

— মরে যাবে মানুষ।’

 পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন এতই বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তাপে মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। শুধু মানুষ নয় জগতের সমস্ত প্রাণীকুল আজ ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি। তাইতো হিট স্টকে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক দশকে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্র আমরা কিন্নর রায়ের ‘ব্রহ্মকমল’ উপন্যাসেও দেখতে পাই–“অসহ্য গরম জুন মাসের আকাশে মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। পুড়ে যায় গা-হাত। পা-মুখ। প্রায় সত্তর ছোঁয়া রাঘবেন্দ্র সান্যাল কিছুতেই গরম সহ্য করতে পারেন না।” এভাবেই বিশ্ব উষ্ণায়ন পৃথিবীর যে ঋতুচক্র তা বিঘ্নিত করছে এবং জীবকুলের ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বিনষ্ট করছে।

   গল্পে দেখি প্রবল গরমের মধ্যেও ক্ষিতিমোহন চল্লিশ মিনিট সাইকেল চালিয়ে লাইব্রেরী যান। লাইব্রেরীর মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকেন তাই বাইরে যে কখন বৃষ্টি শুরু হয়ে ঠান্ডা বাতাস বইছে তা তিনি বুঝতে পারেন না। তাই নিজের অজান্তেই এই বৃষ্টিতে ভিজেছেন তিনি–‘ফোঁটা ফোঁটা জলের স্পর্শে শীতল বায়ু প্রবাহে ক্ষিতিমোহন নিজেকে বিস্মিত হল। কে যেন তাকে চুম্বন করছে। ব্যক্তি পরিচয় হারিয়ে, অপ্রত্যাশিত চুম্বনে সে গলতে শুরু করল। কী ঘন আনন্দের শিহরণ! মানুষ হাঁটছে বৃষ্টি মাথায়। কিন্তু জীবনের এই গোপন চুম্বন কোথায় ছিল? কে দিয়ে গেল? কিসের বিনিময়ে?’ তপ্ত পৃথিবীর বুকে নেমে আসা হঠাৎ বৃষ্টির ছোঁয়া ক্ষিতিমোহনের কাছে নারীর চুম্বনের তৃপ্তি বলে মনে হয়।

    গল্পের শেষ লাইনে লেখক বলেছেন–‘রাস্তায় লুটিয়ে আছে দুর্বল ঝরা পাতা, ভাঙ্গা ডাল-পালা, কিছু বৃক্ষ, চালা, লোনাধরা ইট-কাঠ, পুরনো পাখির বাসা-কিছু অপরিহার্য ক্ষয়-ক্ষতি।’ বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে এবং বিভিন্ন সময় নানা স্থানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঝড়ঝঞ্ঝার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতিতে এই ঝড়ঝঞ্ঝার ফলে প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। কারণ ঝড়ের প্রভাবে যেমন অনেক গাছপালা ভেঙে পড়ে তেমনি মারা যায় নানা পশু পাখি যা ইকোলজিকাল ব্যালেন্স নষ্ট করে। লেখক গল্প জুড়ে বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণ যেমন বর্ণনা করেছেন সেই সঙ্গে এই বিশ্ব উষ্ণায়ন কীভাবে ক্ষতি করছে সেই চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন। আজকের এই বিশ্ব উষ্ণায়নের ভয়ংকর পরিণতির অনেক বছর আগেই এই আখ্যানের মধ্যে দিয়ে লেখক পাঠককে সচেতন করতে চেয়েছেন।

    ১৯৭৪ সালে ৫-ই জুন প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। এটি পরিবেশ রক্ষার  সচেতনতা এবং নতুন পদক্ষেপকে উৎসাহিত করতে রাষ্ট্রসংঘ পালন করে থাকে‌। ১৯৭৪ সালে এই বিশেষ দিনটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছে সামুদ্রিক দূষণ, মানব জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বন্যপ্রাণের মতো পরিবেশগত বিষয়ের সচেতনতা বৃদ্ধির একটি স্বার্থে। আর ২০২১ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম ছিল ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা’। এই থিমের মধ্যদিয়েই বোঝা যায় যে আমাদের বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয়ে গেছে। এই বাস্তুতান্ত্রিক সংকটের কথাই সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘মহাপ্রাণের ঋণ’(১৯৯৫) গল্পে আজ থেকে বহু বছর আগে বলেছেন। দূষণ যত বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থলজ এবং জলজ প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। জীব বৈচিত্রের আতুড়ঘর তাই ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। গল্পের শুরুতেই দেখি একটা বৃষ্টি ভেজা কেজি দেড়েকের ব্যাঙ পিচের রাস্তায় লাফিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে জানে না এই পৃথিবী তার বাস যোগ্যতা হারিয়েছে। দূষণ এবং যন্ত্র সভ্যতার আগ্রাসনে সে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন। প্রসব যন্ত্রণায় ব্যাকুল ব্যাঙটি প্রসব করার মতন সামান্য আশ্রয়টুকু পাচ্ছে না-‘ন্যাতানো মাংসল পা দুটোর আশ্রয়ে ব্যাঙটা হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলেছে একটি গর্ভ পেট, থকথকে ডিমরাশির একটি পিণ্ড। এক্ষুনি ঠেলে বেরিয়ে পড়বে সব। ঘাড়হীনমাথায় একজোড়া চোখ কেমন বোকাবোকা। ব্যথায় কেমন ঘোরঘোর। ব্যাঙটা আড়াল পেলেই বিয়োবে।’ তাইতো ব্যাঙটা একটু আড়াল খুঁজছিল। যেখানে সে প্রসব কাজটি সারতে পারে কিন্তু রাস্তায় গাড়ির ভিড়, ব্যাঙটা চেষ্টা করেও রাস্তা পেরোতে পারে না। শিবু এগিয়ে গিয়ে ব্যাঙটার পাছায় জুতোর ডগাটি দিয়ে আলতো একটা টুসকি দেয়। আর তাতেই উড়ে গিয়ে থপাস করে পড়ে কাঁদার ফুটপাথে। চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। শিবুর মনে হয় ব্যাঙটা মরে গেছে-‘শিবু নিজেকে বোঝাতে পারে না, এক-পেট-ডিমরাশি-প্রাণের কোটি কোটি অনু, যা একটু পরেই ফুটে বেরুত মাটির পৃথিবীতে, ফুলকা ও ব্যাঙ্গাচি পর্বের পর চুলবুলিয়ে ঘাসের আড়ালে মহাপ্রাণচক্রের কুশীলবের ভূমিকা পালন করত–অযথা শেষ করে দিয়ে কোথাও দায়ি রয়ে গেল নাতো?’ জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য বংশবিস্তার করা। সেই বংশবিস্তার করার জন্য যে সুস্থ স্বাভাবিক জায়গার প্রয়োজন সেই জায়গার আজ বড়ই অভাব, তাই মানবেতর প্রাণীকুলের বেঁচে থাকা আজ দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তাইতো এই সমস্ত প্রাণী দিন দিন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স। তাইতো বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার’ থিম করে ঘটা করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

    গল্পে লেখক ব্যাঙ্গের ছলে এক অতিপ্রাচীন সংস্কারের উল্লেখ করেছেন–‘…উল্টে রাখুন। নইলে সাত দিনেও আকাশ ধরবে না।’ এই কথার মধ্যদিয়ে লেখক ঋতু বৈচিত্রের বৈষম্যের কথাই তুলে ধরেছেন। প্রাণীকুল তার স্বাভাবিক বাসস্থানের অভাবে ক্রমশ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ বনভূমি যেমন হ্রাস পেয়েছে তেমনি জল, স্থল সবই আজ দূষিত। তাই বনভূমি হ্রাস এবং প্রাণের বিনাশ সার্বিকভাবে ইকোলজিকাল ব্যালেন্স নষ্ট করে দিয়েছে। ফলস্বরূপ দেখা দিয়েছে অনাবৃষ্টি এবং অতিবৃষ্টি। নষ্ট হয়ে গেছে ঋতুবৈচিত্র্য।

   রাতে শিবু স্বপ্ন দেখে ব্যাঙের দৃষ্টিতে মানুষের মতো স্বস্তির হাসি। চোখের কোন থেকে এক ফোটা রক্ত গড়াচ্ছে। আর সে ক্রমে পরিণত হচ্ছে ব্যাঙে। সে স্বপ্নে দেখে–‘মস্ত থলথলে একটা গর্ভ, পেছনের দুই ঠ্যাংয়ে আড়াল দিয়ে রাস্তার পাশে হাঁসফাঁস করছে। রাস্তাটুকু পেরুবে। এত ব্যস্ততা কখনো দেখেনি রাস্তায়। ধোঁয়াধুলো, চাকা, হর্ন, কার্বন-মনোক্সাইড এবং নিষ্ঠুর উদাসীনতায় টায়ারগুলো ছুটছে স্যাটস্যাট। এত দ্রুত ছুটছে সব, ছিটোনো পেট্রলের ফোঁটাগুলো পর্যন্ত, শিবু ব্যাঙটিকে গাঢ় প্রলেপ দিচ্ছে। দম নিতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় থলথলে গর্ভটিসহ শরীর ফাটিয়ে অপেক্ষা করছে। কিছুতেই এক টুকরো অবসর বা মুহূর্তের সুযোগ তাকে দেওয়া হচ্ছে না রাস্তাটা পেরিয়ে নির্জন একাকিত্বে মহাপ্রাণের কাছে আপন ঋণটুকু শোধ করতে পারে যাতে।’ বনভূমি হ্রাস পেয়েছে, কলকারখানার বৃদ্ধির ফলে বায়ু দূষণ যেমন বেড়েছে, তেমনি কলকারখানার দূষিত জল জলজ প্রাণীর বাসস্থানকেও ধ্বংস করেছে।ফলে কীট, পতঙ্গ এবং মানবেতর প্রাণীকুল তাদের জীবন ধারণের পরিবেশ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে পৃথিবীর কাছে প্রাণীর প্রধান যে ঋণ বংশগতি রক্ষা করা সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য যে জায়গার দরকার সেই জায়গাটুকু আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন ভাঙ্গে শিবুর কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না–‘পৃথিবী নামক অতি পরিচিত গ্রহটির আকাশ ফুটো হয়ে রুদ্র-আলোককণা হর্ন, হেডলাইট এবং টায়ারের গতির লক্ষগুণ বেগে ছুটে আসছে এবং সেই পথের দুধারে কয়েক বিলিয়ন ব্যাঙ অপেক্ষা করছে কীভাবে পারাপার করবে লাফিয়ে লাফিয়ে।’ ওজন স্তর ভেদ করে ছুটে আসা ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি এবং প্রতিদিন যানবাহন থেকে উগরে দেওয়া কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড জনিত তীব্র দূষণে একাকার হয়ে গেছে প্রাণীর বাসরত পৃথিবী। এর প্রভাব পড়েছে বাস্তুতন্ত্রে, শিবুর মতো মানুষদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। মানুষ তো একা বাঁচতে পারেনা, সে প্রত্যক্ষভাবে পরিবেশের একটি অংশ এবং বাস্তুতন্ত্রের এক অঙ্গ। তাই বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে শরিক হয়েই মানুষও বেঁচে থাকে। পরিবেশের পরিবর্তন এবং বাস্তুতন্ত্রের ভাঙ্গন মানুষের বেঁচে থাকাকেও কঠিন করে তুলেছে। বিপন্ন পরিবেশ মানুষের অন্তর্জগতেও ঘা দিয়ে যাচ্ছে। তাইতো জীবন ছন্দ আজ বিপন্ন‌।

    বিশ্ব উষ্ণায়নে শেষ হয়ে যাচ্ছে কত প্রাণী। নষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য। বর্তমান অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে অতীতকে ফেরানো সম্ভব নয় ঠিকই কিন্তু আমরা গাছ লাগাতে পারি, জল দূষণ রোধ করতে পারি, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর সমস্ত রকম দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণী ও উদ্ভিদ কূলের বাসযোগ্য করে তুলতে পারি আমাদের স্বর্গভূমি পৃথিবীকে। তাইতো আজ থেকে বহু বছর আগে লেখা সাধনবাবুর এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা এতোটুকুও কমেনি বরং আগের থেকে অনেক অনেক গুণ বেড়েছে। এভাবেই পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলি পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।

     ‘ভুঁই জোনাকি’(১৯৯৫) গল্পে সাধনবাবু গাছপালা হ্রাসের ফলে পরিবেশ দূষণের চিত্র তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যানবাহনের বৃদ্ধির ফলস্বরূপ শব্দ ও বায়ু আজ দূষিত। তাইতো স্বর্গের অমৃত পান করা জোনাকি আজ নিশ্চিহ্ন। শব্দ আর বায়ুদূষণের বাড়াবাড়ির জন্যই মধুও শহরে না গিয়ে গ্রামেই পড়ে রয়েছেন শুধুমাত্র সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে বসবাস করার তাগিদে। তাছাড়া গল্পে বর্ণিত হয়েছে কীভাবে পতিত জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে এবং শহরগুলি কীভাবে গ্রামগুলিকে গ্রাস করে ফেলছে তার চিত্র। দিন দিন সমস্ত জায়গায় ঘর-বাড়ি অট্টালিকায় ভরে যাচ্ছে। জমির দাম যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি ফাঁকা জমির পরিমাণ প্রতিনিয়তই কমছে। লেখক বলেছেন–‘দু’বছর আগে সোজা তাকালে দেখতে পাওয়া যেত যখন, ঘরখানাকে মনে হতো জলকাছারি। এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যত আশ্রয় গড়ে উঠছে, ততই বিষন্ন বোধ হয়। ৮০০ টাকা কাটা কিনেছিল এখন সাড়ে পাঁচ হাজার। তাও জমি কই? এভাবেই ফাঁকা জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে সমস্ত জায়গা বড় বড় অট্টালিকা এবং শপিংমলে গ্রাস করছে। লেখক কিন্নর রায় তাঁর ‘প্রকৃতি পাঠ’ উপন্যাসে গ্রামগুলিকে কীভাবে গ্রাস করে করে শহরের বিস্তার ঘটছে সেই বর্ণনা দিয়েছেন–“কলকাতা উত্তরে আর দক্ষিণে কতটা ছড়িয়েছে তার হিসেব ঠিক ঠিক বলে দেয়া বেশ মুশকিলের ব্যাপার। দক্ষিণে হরিনভি, শিবরামপুর, হরিদেবপুর, বোড়াল, ব্রহ্মপুর, জোকা, সোনারপুর, সুভাষগ্রাম, সবই বলতে গেলে কলকাতার কাছেই। আর উত্তরে দমদম, বাগুইহাটি, সল্টলেক, লেক টাউন পূবে ইস্টার্ন বাইপাস। কলকাতা এভাবেই মফ:স্বলকে গ্রাস করতে করতে হাত পা ছড়াচ্ছে।”শহর, গ্রাম এবং গ্রাম্য প্রকৃতিকে গ্রাস করার ফলে কীটপতঙ্গ এবং পশু পাখি কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এবং ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ সেই চিত্রই বর্ণিত হয়েছে এই ‘ভুঁই জোনাকি’ গল্পে।

    সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে পাঠকের জন্য নানা অভিমুখ থাকে। একমুখী বিষয় ভাবনা তাঁর গল্পের আঙ্গিক নয়। একই গল্প পাঠ করে পাঠক নানা দৃষ্টি কোন থেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেন। তবে এই প্রবন্ধে আলোচিত তাঁর গল্প তিনটি মূলত প্রকৃতি ও পরিবেশ চেতনা নির্ভর গল্প বলা যেতেই পারে। এই গল্প তিনটি পড়তে পড়তে আমরা যদি মুলের বিষয়ের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখব গল্পের আদ্যোপান্ত জুড়ে রয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণের কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা। লেখক বহুদিন আগে গল্পগুলি রচনা করলেও বর্তমান সময়ে গল্পগুলি আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এখানেই পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা ইকো-টেক্সটগুলির অন্য ধরনের বিশিষ্টতা রয়েছে।

তথ্যসূত্র:

১.ভট্টাচার্য, তপোধীর: উপন্যাসের সময়, এবং মুশায়েরা, জানুয়ারি-১৯৯৯, কলকাতা-৭৩, পৃ-২৮

২.রায়, কিন্নর: প্রকৃতি পাঠ, দে’জ, দ্বিতীয় সংস্করণ: নভেম্বর ২০০২, কলকাতা-৭৩, পৃ-৫৭

৩.রায়, কিন্নর: ব্রহ্মকমল, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি-২০০৯,কলকাতা-৭৩, পৃ-৯

৪.রায়, কিন্নর: প্রকৃতি পাঠ, দে’জ, দ্বিতীয় সংস্করণ: নভেম্বর ২০০২, কলকাতা-৭৩, পৃ-৩৪

অমর মিত্রের ছোটগল্পে পরিবেশচেতনা

বিশ শতকের সাতের দশকের অন্যতম কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র(জন্ম ১৯৫১)। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন তিনি। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল অন্য আর পাঁচজন লেখকের থেকেও অনেক বেশি প্রখর। লেখাপড়ার পর্ব শেষ করে গল্পকার ভূমি দপ্তরের আধিকারিক রুপে প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩-এর নভেম্বরে চাকরি পেয়ে কলকাতা ছেড়ে তাঁকে মেদিনীপুরে যেতে হয়। ১৯৭৪-র এপ্রিলে ট্রেনিং শেষে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হন ডেবরা থানার করন্ডা নামের একটি গ্রামে। বাস থেকে নেমে কংসাবতী নদী পার হয়ে ঘন্টা দেড়েক হেঁটে লোকালয়ের প্রায় বাইরে তাঁকে ক্যাম্প অফিসে পৌঁছতে হত। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং চাষিবাসি মানুষদের সংস্পর্শে থেকে অমর মিত্রের লেখক সত্তায় প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন উপলব্ধির জন্ম হয়েছে, যার সুনিশ্চিত প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর গল্প বিশ্বে। লেখকের আত্মজীবন কথায় গ্রামের প্রকৃতির চিত্র উঠে এসেছে নিজস্ব বর্ণনাতেই–“শহর থেকে দূরে গিয়ে কখনো কংসাবতী, কখনো সুবর্ণরেখা, কখনো ডুলুং, তারপর হলদি নদী, বঙ্গোপসাগরের তীরে বদলি হয়ে হয়ে আমার এক সময় মনে হলো আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমার মতো করে এই পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছে কে? আমি বরং লিখেই যাই। আমি বরং ক্ষুদ্র ক্ষমতাটুকু ব্যবহার করি চাষিবাসী বিপন্ন মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি। আমি টের পেলাম কলকাতায় এসে আর বেশিদিন থাকতে পারি না। সুবর্ণরেখা নদী তীরের বংশীধরপুর গ্রাম টানছে।” গ্রামকে দেখেছেন তিনি অনেক কাছ থেকে, উপলব্ধি করেছেন গ্রামের শান্ত প্রকৃতি ও পরিবেশকে নিজের শিল্পী সত্তা দিয়ে। তাই শহরে এসে তিনি থাকতে পারেনি। এই অনুভব দিয়েই তিনি বুঝতে পেরেছেন গ্রামের পরিবেশ ধ্বংসের করুণ চিত্র। তাঁর সচেতন দৃষ্টিতে শুধু গ্রামের দূষণ এবং পরিবেশ বিনষ্টের চিত্রই ধরা পড়েনি, ধরা পড়েছে গ্রামগুলি কীভাবে আস্তে আস্তে শহরে পরিণত হয়ে যাচ্ছে সেই চিত্রও। আর এই নতুন শহর পুরোনো পৃথিবীর কথা মনে রাখেনি। মানুষও এই নতুন শহরে স্মৃতিহীন। এখানে পাখি ডাকে না। এখানে গাছেরা নেই। পথে পথে প্লাস্টিক, পলিমার বৃক্ষ। পরিবেশের এই অবক্ষয় কথাশিল্পী অমর মিত্রকে ভাবান্বিত করেছে‌। এই ভাবনার ফলস্বরূপ গল্পকারের কলমে সৃষ্টি হয়েছে ‘জল ও বায়ু’, ‘কালো জল’, ‘নদী-ভূমি’, ‘কালো নদী’, ‘কলসপুর যাইনি’, ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ প্রভৃতি পরিবেশ সচেতন গল্পগুলি। এই গল্পগুলির মধ্যে লেখক পুরোনো গ্রামীণ পরিবেশ, প্রকৃতি ও পরিবেশ হারিয়ে কীভাবে শহর হয়ে উঠছে সেই চিত্রই মূলত তুলে ধরেছেন। তার ফলে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স। সেই বর্ণনা গল্পগুলিকে করে তুলেছে ইকো-টেক্সট।

     পরিবেশ দূষণের সঙ্গে সঙ্গে বায়ুতে বৃদ্ধি পাচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলির পরিমাণ। বায়ুতে যতই কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেন প্রভূতি গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে চলছে। তার ফলে দেখা যাচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন। জলবায়ুর পরিবর্তনের সূচনা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। আর এই জলবায়ু পরিবর্তন লেখক অমর মিত্রকে ভাবিয়ে তুলেছে সর্বদা। এই ভাবনার প্রতিচ্ছবি ‘জল ও বায়ু’(১৯৯০)গল্পটি। ফুড ইন্সপেক্টর তলাপাত্রবাবুর বড় পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে পছন্দপুর সেখানকার আদি বাসিন্দা না হয়েও। কিন্তু ভবঘুরে ছাড়া কেউ এই গ্রামে এসে থাকেনি আজ পর্যন্ত। কিন্তু তলাপাত্রবাবুর কাছে পঁয়ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে সব থেকে প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে এই পছন্দপুর। কিন্তু এই গ্রামে কিছুই নেই, তাই এই গ্রামে চাকরি করতে এসে কেউ থাকেনি সবাই বদলি নিয়ে চলে গেছে শহরে। লেখক বলেছেন–‘কেন যে থাকবে তাও বুঝি না। সত্যিই তো, পরিষ্কার বাতাস ছাড়া পছন্দপুরে আর কী আছে?’ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যা, তা হল এই পরিষ্কার বাতাস। পছন্দপুরে বিলাসবহুলতার জন্য কোন কিছু না থাকলেও বেঁচে থাকার জন্য এই পরিষ্কার বাতাস রয়েছে তবুও কোন চাকরিজীবী বা এই গ্রামে কাজের সুত্রে আসা কেউ থেকে যেতে চায়নি, থাকেনি। এই পছন্দপুরের জল, বাতাস তলাপাত্রবাবুর পুরোনো যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছে। তিনি যখন এখানে এসেছিল তখন তার চুল পাকা ছিল, শরীরের চামড়া ঝুলে ছিল। কিন্তু পছন্দপুরে জল ও বায়ুতে পাকা চুল যেমন কাঁচা হয়েছে তেমনি শরীরের চামড়া পেয়েছে যৌবনের উজ্জ্বলতা। তলাপাত্রবাবুর কথাতেই তা আমরা জানতে পারি–‘সেই সময় আমার কত চুল পাকা ছিল, গায়ের চামড়া কত ঝুলে ঝুলেই না ছিল, এক বছরে কত বদলে গেছে বলুন দেখি হেড মাস্টার মশায়।… কী তেল মাথায় দেন? তেল তো দিই না। তবে কি করে হল? পছন্দপুরের জল-হাওয়া, এমন ভালো হাওয়া আমি কোথাও দেখিনি, এমন জলও নয়, ভিতরের কলকব্জার যে সব ময়লা জমেছিল সব ধুয়ে মুছে সাফ।…শুধু হাওয়া কেন, রোদ্দুরও, শরীর সব সময় গরম থাকে, খুব উপকারী।’ কিন্তু এই সুন্দর জলবায়ুতেও থাবা বসিয়েছে সভ্যতার উন্নতি। যে জল-বায়ু বুড়ো মানুষকে যৌবনে নিয়ে গেছে সেই জলবায়ু দূষিত হয়ে গেছে সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে রেলের আবিষ্কার প্রকৃতি ধ্বংসের প্রথম সোপান। লেখক সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছে থেকে। তাই এই পছন্দপুরের মতো জায়গা যখন দূষিত হয়ে যাচ্ছে তখন লেখক হৃদয় ব্যথিত হয়েছে–‘ট্রেন আসা-যাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই।…এসে থেমেই থাকল এখানে সারারাত। শুধু ফোঁস ফোঁস শব্দ আর ধোঁয়া। সারারাত ইঞ্জিনের নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দে ঘুম চটকে যায় হেড স্যারের।’ এভাবে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ পছন্দপুরের জলবায়ুকে বিষাক্ত করে তুলেছে। তা নিয়ে লেখক অমর মিত্র চিন্তিত। সেই চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায় আলোচ্য গল্পের আখ্যানে।

    গাছপালা দ্রুত গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীতে জল শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত গতিতে। যার ফলে ঋতু পরিবর্তন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। এই সমস্ত কিছু নিয়ে অমর মিত্র রচনা করেছেন ‘কালো জল’(১৯৯৮) গল্পটি। গল্প জুড়ে জল সংকটের চিত্র এবং আবহাওয়া পরিবর্তন, তার ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি প্রভৃতি প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। লেখক জানিয়েছেন–‘আসলে জলের টানটা ক্রমশ বাড়ছে। সবে তো গরম এল। এ বছর বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে শীত অনেকদিন ছিল। গত সপ্তাহেও ঠান্ডা ছিল।’ এই যে অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত। ঋতু পরিবর্তন সঠিক সময় হচ্ছে না, কখনোবা কিছু ঋতু অনুভব করা যাচ্ছে না। ফলে আবহাওয়ার দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এছাড়াও গল্পে জল সংকটের চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে। উষ্ণায়নের প্রভাবে নদীগুলি সব শুকিয়ে গেছে। বৃষ্টিপাত অনিয়ন্ত্রিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান জলের আজ বড়ই সংকট, তা লেখক অমর মিত্র আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এই জলসংকট বর্তমানে আরো অনেক অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কায় মানবজাতি প্রহর গুনছে।

     আধুনিক জাপানের অন্যতম এক সমস্যা নদীর অস্তিত্ব সংকট। মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে ততই ছোট-বড় নদী উন্নয়নের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারি মহলেও নদী নিয়ে খুব বেশি সচেতনতা দেখা যায় না। নদী হারিয়ে যাওয়ার করুণ চিত্রই উঠে এসেছে অমর মিত্রের ‘নদী-ভূমি’ গল্পে। এই গল্পে বর্ণিত হয়েছে নদীর মরে যাওয়ার কথা, মজে যাওয়ার কথা, হারিয়ে যাওয়ার কথা। চব্বিশ পরগনা জেলার নদী ভরাটি গ্রামে জলের সংকট। এই সমস্যা সমাধানে আসতে হয়েছে জেলাশাসককে। শ্রাবনের শেষ থেকে ভাদ্র মাস জুড়ে জল সংকটে ভুগছে এই গ্রাম। তাই গ্রাম জুড়ে ক্ষোভ। ধান চাষ নষ্ট হয়ে গেছে। ফসলের ক্ষেত শুকিয়ে গেছে। বিডিও, পুলিশ চেষ্টা করেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি তাই সমস্যার সমাধানের জন্য আসতে হয়েছে জেলাশাসককে। তিনি রাজস্থানের মানুষ, মরু অঞ্চলের লোক। সেখানে জলের বড়ই অভাব। সেখানকার মানুষ একটু গঙ্গাজল ৪০-৫০ টাকা দিয়ে কিনে নেয়, আর এখানকার মানুষ পবিত্র গঙ্গাজল চাইছে চাষের জন্য, শুনে বিস্মিত হন তিনি। একসময় এই গ্রামের নীচ দিয়ে বয়ে যেত পিয়ালি নদী। এখন শুকিয়ে গেছে। চর হয়ে গেছে। এখন নদীর উপর দিয়ে গ্রাম-ঘর-বাড়ি-জমিজামা-ধানখেত-পুকুর। এই নদীর মরে যাওয়ার চিত্র বর্ণিত হয়েছে সাহিত্যিক কিন্নর রায়ের ‘ব্রহ্মকমল’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক বলেছেন–“লক্ষ্য করেছি সরস্বতী মরে যাচ্ছে।”এভাবেই মরে গেছে অনেক নদী। একসময় অনেক নদী ছিল, কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সব হারিয়ে গেছে, মুছে গেছে তাদের চিহ্ন। ক্যানেল আছে, কিন্তু সেখানেও জল নেই। তাই জেলাশাসক বলেন ফসল চাষের পদ্ধতি এবং ফসলের প্যার্টান চেঞ্জ করতে হবে। বাঙালির খাবারও পরিবর্তন করতে হবে। মাছ ভাতের দিন শেষ হয়েছে বাঙালির জীবনে–‘ইয়ে হায় বাঙ্গালি, ওদিন চলা গিয়া, হামার এক দেশ, এক হি ভাষা, এক ফুট হ্যাবিট তো হোনা চাহিয়ে, গেহু মকাই বজরা, কালটিভেট করো, পানি লাগবে না।’ জেলাশাসক ধান বাদ দিয়ে যেসব ফসল চাষ করতে জল কম লাগে সেইসব ফসল চাষ করতে বলেছেন এবং সেইসব ফসল খাবার হিসেবে গ্রহণ করতেও বাঙ্গালীকে অভ্যাস করে নিতে বলেছেন। প্রতিটি নদীতে জল কমে যাচ্ছে, নদী হারিয়ে ফেলছে তার পুরোনো যৌবন। নদীর বুকে দেখা দিচ্ছে বড় বড় চড়া। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা। নদীর জল শুকিয়ে যাওয়ার ফলে জলজ বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হচ্ছে। এই করুণ চিত্রই লেখক অমর মিত্র ‘নদী-ভূমি’ গল্পে তুলে ধরেছেন। গল্পটি হয়ে উঠেছে নদীর হারিয়ে যাওয়ার এক অন্যন্য আখ্যান।

      নগর সভ্যতা যেমন মানুষকে অনেক কিছু দিয়েছে তেমনি কেড়ে নিয়েছে আরো অনেক বেশি কিছু। পরিভোগের নানা উপকরণ মানুষের জীবনে এখনো ড়ানো, কিন্তু নগর সভ্যতার জঠরে বস্তুভাবের বেড়াজালে মানুষ হারিয়েছে নিঃসর্গ বেষ্টিত জীবনের শান্ত সৌন্দর্য। বর্তমানে মানবজাতি প্রকৃতি সম্পর্কে বড়ই উদাসীন এবং প্রকৃতিকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করাটাই লোকে সভ্যতার মাপকাঠি বলে মনে করে। প্রযুক্তির অত্যাধিক উন্নয়নে আর বিশ্বায়নের হু হু করা বাতাসে মানুষের জীবনের গতি বেড়েছে, অনেক সুযোগ-সুবিধা হাতের মুঠোয় এসেছে এটা যেমন সত্য, তেমনি মানুষের উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ এবং সমস্যাও বেড়েছে শরীরে মনে এবং সামাজিক পরিবেশে। অত্যাধিক উন্নয়ন এবং তার প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর তারই প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র রচনা করেছেন ‘কালো নদী’(২০০৭) গল্পটি।

     গল্পের শুরুতেই লেখক জমি অধিগ্রহণ করে দিন দিন কীভাবে মল, টাউনশিপ গড়ে উঠেছে সেই চিত্র অঙ্কন করেছেন। ভরত কুইলা জমি হারা এক সাধারণ মানুষ তার জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে উঠেছে নতুন টাউনশিপ। ভরতকে তাই বলতে শুনি–‘টাউনের ভিতরে যদি ঢুকা যেত, আমি দেখে আসতাম জায়গাটা। কি দেখবা বাবা, আমরা কি আর ভাগের জমিন ফিরে পাব?’ নতুন টাউনশিপে সাধারণ মানুষ ঢোকার সুযোগটুকু পায় না, অথচ তাদের জমি, প্রকৃতি, পরিবেশ ধ্বংস করেই নির্মাণ হয় এইসব বহুতল শহর। এইসব নতুন নগর সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করার কারিগর রূপেই নির্মিত হচ্ছে। অত্যাধুনিক জীবন যাপনের আশায় আমরা আমাদের স্মৃতি ভরা পুরনো গ্রাম্য জীবনের কথা ভুলে নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে মেতে উঠেছি। তাই গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে নিচ্ছে নগর সভ্যতা। এই জমি অধিগ্রহণ করে শহর নির্মাণের প্রসঙ্গ লেখকের ‘সবুজ রঙের শহর’ উপন্যাসেও দেখতে পাই। উপন্যাসে মনোময় আগের গ্রাম হারিয়ে ভারতকুইলার মতই স্মৃতিচারণা করেছে–“আমার আগের শহর, আগের গ্রাম, বাবা-মা ভাই-বোন, আমার দেখা গ্রাম, যে গ্রাম নগরে ঢুকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেই গ্রামের কথা।” মনোময়ের গ্রাম টাউনে ঢুকে গেছে সেই গ্রামের স্মৃতিচারণা করছে। একইভাবে ভরত কুইলা আফসোস করছে তার গ্রাম হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। লেখক গল্পে বলেছেন–‘পুকুরিয়া গাঁয়ের নাম বলতে তারা বলল, ওই গা আর ভূ-ভারতে নেই, টাউনে ঢুকে গেছে।’

     আমাদের মানব সভ্যতার উন্নয়নের প্রভাব গিয়ে পড়ছে নদীগুলির উপর। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে নদীগুলি হারিয়ে ফেলছে তার পুরোনো গৌরব। লেখক তাই গল্পে উন্নত পিচ রাস্তাকে কালো নদী বলে উপমিত করেছেন। কারণ নদীর মতই এই পিস রাস্তা গ্রাম থেকে টাউনশিপকে আলাদা করে দিয়েছে। এ রাস্তা পার হয়ে টাউনশিপে যাওয়া বড়ই কষ্টসাধ্য। শুধু তাই নয়, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার আশায় মানবজাতি বনভূমি কেটে, পাহাড় ভেঙ্গে, নদী-জলাশয় বুজিয়ে প্রকৃতির সর্বনাশ করে গড়ে তুলছে এই পিস রাস্তা। তাই আজ কালো নদীতে সভ্যতা পরিপূর্ণ, আর প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষে পরিপূর্ণ। সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে মানুষ নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন উন্নয়নকে সফল করার আশায়। আর এই উন্নয়নের প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশকে ব্যবহার করেছে। মাটি, জল, খনিজ সম্পদ, জলবায়ু, গাছপালা, জীবজন্তু, ফলমূল, নদী-নালা সবকিছু মানুষ নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে। প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই উন্নয়ন করতে গিয়ে মানুষ নষ্ট করে দিয়েছে মানবের বাসরত এই পৃথিবীর ভারসাম্য। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ থেকে বহুদিন আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছিলেন–

“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,

লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাস্ট ও প্রস্তর

হে নব সভ্যতা, হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,

দাও সেই তপোবন পুণ্যছায়ারাশি।”

বর্তমানে পুণ্যচ্ছায়ারাশির বড়ই অভাব। তাই কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র ‘কালো নদী’ গল্পেও এই পুণ্যছায়ারাশি ফিরিয়ে আনার জন্য মানবজাতির কাছে আহব্বান জানিয়েছেন।

       উন্নয়নের নামে বহুজাতিক কোম্পানি গ্রাস করে নিচ্ছে গ্রাম্য প্রকৃতি, বনভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ। তার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানবসম্পদ এবং মানেবতর প্রাণী। গল্পকার অমর মিত্রের ‘কলসপুর যাইনি’(২০১০)গল্পে উঠে এসেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলি কীভাবে প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে মানবের ক্ষতি সাধন করছে সেই চিত্র। প্রকৃতিকে ঘিরে মানুষের যে আনন্দ ও স্বপ্ন তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি ধ্বংসের সাথে সাথেই সে দৃশ্যই আমরা গল্পে লক্ষ করব। গল্পের কথক বিধান কখনো কলসপুর যায়নি কিন্তু কলসপুরকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। সে না গিয়েও কলসপুর তার কাছে আত্মজার মত কিংবা সহধর্মিনীর মতই পরিচিত। বিধান কলসপুরের চন্দনা নদীর রূপ যেমন জানে, তেমনি জানে বসন্তকালে কলসপুরের রূপের ছটা। তাই সে বারবার কলসপুরে যেতে চেয়েছে। কাজে নয়, ঘুরতে, দেখতে। যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে  কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত কলসপুর যাওয়া ভেস্তে গেছে তার। কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে থেকে কলসপুরের খোঁজ নিয়েছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনেছে কলসপুরের রূপের বর্ণনা। তার আকাঙ্ক্ষা আরো তীব্রতর হয়েছে। স্বপ্ন দেখেছে, স্বপ্ন বুনেছে কলসপুরকে ঘিরে। সেই স্বপ্নের কলসপুর একদিন তছনছ হয়ে গেল তার যাওয়ার আগেই, দেখার আগেই।

     কলসপুরের বনভূমি কেটে নির্মাণ হয়েছে শপিংমল। যার ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য হ্রাস হয়েছে। গল্পকার বলেছেন–‘কলসপুরে আগে শপিংমল ছিল না, এখন হয়েছে, টুরিস্টরা কেনাকাটা করছে খুব, শপিং করার জন্যই কতজন যাচ্ছে কলসপুর, শপিং করে ফিরে আসছে।’ যেখানে মানুষ একসময় যেত প্রকৃতির রূপ দেখতে, এখন মানুষ সেখানে যাচ্ছে শপিং করতে। অতিরিক্ত টুরিস্টদের আগমন, তাদের খাদ্য, থাকার জায়গার প্রয়োজন বনভূমি এবং বন্য-প্রাণী এবং বন্য-প্রকৃতি হ্রাসের এক অন্যতম কারণ। লাটাগুড়িতে আজ থেকে দশ বছর আগে যে বনভূমি ছিল আজ তা অনেকটাই গ্রাস করে নিয়েছে টুরিস্টদের খাদ্য ও বাসস্থানের যোগান দেবার প্রয়োজন। প্রতিনিয়ত প্রতিটি বনভূমি ও পাহাড়ে পর্যটকদের থাকার জন্য তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন বিলাসবহুল হোটেল ও রিসোর্ট। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোপ পড়ছে বনভূমির উপর। তাইতো নষ্ট হচ্ছে বনভূমি ও পাহাড়ের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য। কলসপুরের অন্যতম আকর্ষণ কুবাই পাখির এখন আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, যে চন্দনা নদীর খরস্রোত ছিল সে হারিয়েছে তার গতি। শুধু তার গতি হারিয়েছে তাই নয়, চন্দনার জল আজ মাছের বসবাসের অযোগ্য। মানুষ স্নানও করতে পারে না–‘জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে, আ্যাসিড কারখানার বিষে।’ কারখানা থেকে নির্গত দূষিত জল সমস্ত জলাশয়গুলির জল দূষিত করে চলছে। কারখানার দূষিত জল সরাসরি জলাশয়ে না ফেলার জন্য সরকার নিয়ম করেছে। কিন্তু সেই নিয়মকে তোয়াক্কা না করেই বেশিরভাগ কোম্পানি তাদের দূষিত জল জলাশয়ে ফেলছে। ফলে জল হয়ে উঠছে মাছের বসবাসের এবং অন্যান্য প্রাণীর ব্যবহারের অযোগ্য। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ক্যারাক্কাস’ গল্পের কথা। সেই গল্পে দেখতে পাই কারখানার দূষিত জল শুধু মানুষের বা প্রাণীর সাময়িক ক্ষতি করে না। কীভাবে জিনগত পরিবর্তন করে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি করে তার করুণ চিত্র। গল্পে নতুন প্রজাতির মাছ দেখা যাচ্ছে–“আঠালো জিনিসটা গোল পাকিয়ে বঁড়শিতে গাঁথলেন স্যার। ফেললেন। একটু পরেই নড়ে উঠল ফাতনা। ছিপে  লাগালেন টান।… সুতোর তলায় ফড়ফড় মাছ নড়ছে। স্যার লাফিয়ে উঠলেন। মাছটা ঝুলছে চোখের সামনে। ভীষণ আনন্দ আমার। ঝুঁকে দেখতে থাকি মাছটাকে‌। হাত খানিক লম্বা। ড্যাবা-ড্যাবা চোখ। সারা গায়ে আঁশ নেই একটুও। খরখরে গা‌। গিরগিটির মতন।” শুধু নতুন প্রজাতির মাছ নয় গল্পকথকের যখন সন্তান জন্ম নিয়েছে তখন দেখা যায় মানব সন্তানেরও এক নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে।

  এভাবেই আস্তে আস্তে কলসপুরের পূর্ণকলস ধীরে ধীরে খালি হতে থাকে। গৌরি বলেছে কিছু একটা অভাব হয়ে যাচ্ছে কলসপুরে ছয় মাস, এক বছর, দেড় বছর আগে যে কলসপুর ছিল সেই কলসপুর এখন আর নেই। থাকবে কী করে–‘পাহাড় ভাঙছে ডিনামাইটে, স্টোন ক্রাশার বসে গিয়েছে, ধুলো উড়ছে সব সময়, ফুল ঝরে যাচ্ছে অকালে।’ জঙ্গলে পাতা ঝরছে আর সেই পাতায় আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে আ্যাসিড কোম্পানির লোক। জঙ্গল পুড়ে গিয়েছে ভিতরে ভিতরে। মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে নদীর সঙ্গে সঙ্গে। পাহাড় ভাঙছে। তার সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে যুবতী মেয়েরা। ফুল, ধুলোয় রং হারিয়ে ঝরে পড়ছে। বিভিন্ন কোম্পানি ধীরে ধীরে কলসপুরকে গ্রাস করে নিচ্ছে–‘আ্যাসিড কোম্পানি জায়গা দখল করতে এবার পোড়া গাছ কাটবে; তারপর না-পোড়া গাছ কাটবে, জঙ্গল ফাঁকা করবে, করাত কল বসেছে কলসপুরে, টিম্বার মার্চেন্টও হাজির।’ এসব কথা শুনতে শুনতে বিধান চূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল ডিনামাইটে ফাটা পাহাড়ের মতোই। এভাবেই গল্পকার বনভূমি ধ্বংসের এবং প্রকৃতি দূষণের চিত্র এঁকেছেন ‘কলসপুর যাইনি’ গল্পের আখ্যানে। যা পাঠ করে সচেতন পাঠক পরিবেশের বিনাশ কীভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়।

     নদী জলাভূমি, বনভূমির মতো পাহাড়ও তার পুরনো গৌরব হারিয়ে ক্রমশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যেতে বসেছে মানুষের আগ্রাসনে। আমাদের দেশের বহু পাহাড় গত কয়েক দশকে হারিয়ে ফেলেছে তাদের পুরনো গৌরব। অনেক স্থানে শুধু পাহাড়গুলি পুরনো গৌরব হারিয়েছে তাই নয়, হারিয়ে গেছে পুরো পাহাড়টাই। ব্যক্তিগতভাবে আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গের বন-জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকায়। পাহাড়ও বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়, নিজে চোখেই প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে পাহাড় ফাটিয়ে ট্র্যাকের পর ট্রাক ডলোমাইট বোঝাই হয়ে চলে যায় সেই দৃশ্য। বড়দের বলতে শুনেছি এগুলো ডলোমাইট বোঝাই ট্রাক। কিন্তু এই পাহাড় ফাটানোর বিরুদ্ধে কোনো দিন প্রতিবাদ হতে তেমন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ডলোমাইট আকরিকের লোভে কত পাহাড় এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং হয়ে চলেছে প্রতিদিন মানবজাতির আগ্রাসনে তার হিসাব কেউ রাখে কী? আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে রাস্তা করছে মানুষ। বর্তমানে পর্যটনের ভিড় ক্ষতি করছে পাহাড়ি পরিবেশকে। টুরিস্টদের প্রয়োজনে নির্মাণ করা হচ্ছে বড় বড় হোটেল, শপিংমল, রিসোর্ট, রেস্তোরা যা পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। তাইতো পাহাড়ের উচ্চতা কমছে প্রতিনিয়ত। শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝর্না। সবুজ পাহাড় দ্রুত গতিতে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপট নিয়েই অমর মিত্র লিখলেন ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ (২০১১) গল্পটি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু আগেই অনুভব করেছিলেন অরণ্যের প্রয়োজনীয়তা, গাছপালার প্রয়োজনীয়তা, সবুজের প্রয়োজনীয়তা। ‘আরণ্যক’-এর সত্যচরণ জানতেন অরণ্য রক্ষা করা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু চেষ্টা করেছিল এই অরণ্য ধ্বংসের কাজ যতটা সম্ভব পিছিয়ে দিতে। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে সত্যচরণ আক্ষেপ করেছে তার হাত দিয়ে অরণ্য ধ্বংস হয়েছে বলে। উপন্যাসের শুরুতেই তাই তাকে বলতে শুনি–“এই স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি আমার হাতেই বিনষ্ট হইয়াছিল, বনের দেবতারা সেজন্য আমায় কখনও ক্ষমা করিবেন না জানি। নিজের অপরাধের কথা নিজের মুখে বললে ভার শুনিয়েছি লঘু হইয়া যায়। তাই এই কাহিনীর অবতারণা।” সত্যচরণের জবানিতে বিভূতিভূষণ আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অরণ্য ধ্বংসের কারণে। কিন্তু সেই সময় তার নিশ্চিত ধারণা ছিল পার্বত্য অরণ্যগুলি শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। শেষবারের মতো ধনঝরির পাহাড় থেকে নামতে নামতে সত্যচরণ তাই ভেবেছিল–“লবটুলিয়া গিয়াছে, নাঢ়া ও ফুলকিয়া বইহার গিয়াছে কিন্তু মহালিখারূপের পাহাড় রহিল- ভানুমতীদের ধনঝরি পাহাড়ের বনভূমি রহিল। এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে না– শুধুই চাষের ক্ষেত পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেইসব অনাগত দিনের মানুষেরদের জন্য এ বন অক্ষুন্ন থাকুক।”কিন্তু বিভূতিবাবুর এই ভাবনা আজ সম্পূর্ণ মিথ্যা হয়ে গেছে। এই পার্বত্য অঞ্চল আজ ধ্বংস হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। তাইতো বিভূতিভূষণের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কাহিনি নিয়েই নতুন করে আখ্যান নির্মাণ করেছেন বর্তমানের কথা সাহিত্যিক অমর মিত্র। যে বনভূমি পাহাড় অনাগত দিনের মানুষের জন্য সুরক্ষিত থাকবে বলে কথাসাহিত্যিক স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সব পাহাড়ে অনাগত মানুষরা খুঁজে পেল ম্যাঙ্গানিজ, লৌহ আকরিক, ডলোমাইট; যা উন্নত মানব সভ্যতার অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস। আর এইসব সংগ্রহ করতে গিয়ে পাহাড়ের পরিবেশ শুধু ধ্বংস করল তা নয়, পুরো পাহাড়টাই নিশ্চিহ্ন করে দিল মানবজাতি। রাজবিহারী সিংয়ের নাতি ধনেশ সিং রাসবিহারীর থেকেও বেশি বেইমান। তাই তিনি ধনঝরি পাহাড় বিদেশি কোম্পানির কাছে ঠিকা দিয়ে দিয়েছে। সেখানকার মানুষদের উৎখাত করে সেই পাহাড় ফাটিয়ে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য। তাইতো দোবরু পান্নার নাতনি রাজকন্যা ভানুমতির মেয়ে রূপবতীকে ধনজুরি থেকে সরে যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে ধনেশ সিং–‘…মাটির তল থেকে কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন সব ধাতু উঠবে, পাহাড় ভেঙে স্টোন-চিপ যাবে শহরে, সব পাহাড় আমার নিজের।… ধনেশ সিং মাটিতে লাথি মেরে মেরে বলল, সব পাহাড় আমার, বিলিতি কোম্পানি বরাত দিয়েছে ভেঙে ফেলতে।… পরশু থেকে ডিনামাইট চার্জ করা হবে ধনঝরি পাহাড়ে, তখন এখানে থাকতে পারবি না।… ওই ধনঝরি থেকে মহালিখারূপ পর্যন্ত যত ছোট বড় পাহাড়, সব সে ফাটাবে। ভেঙে শেষ করবে।’ এভাবেই বসবাসরত, বিশেষ করে আদিবাসী সমাজকে উৎখাত করে সেই সব স্থানে নির্মাণ করা হচ্ছে রিসোর্ট, শপিংমল এবং কোথাও পাহাড় ফাটিয়ে সম্পদ উত্তোলন করা হচ্ছে। যার ফলে হারিয়ে গেছে পাহাড়, শুকিয়ে গেছে পাহাড়ের ঝর্না। বিভূতিবাবু যে পাহাড় ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মানুষের কাছে রেখে যেতে চেয়েছিলেন তা মানুষ ধ্বংস করছে নির্বিচারে। যে বনভূমি পাহাড় মানুষকে সুস্থ সবল স্বাভাবিক জীবন দেয় সেই বনভূমি কিছু মানুষ অর্থের নেশায়, উন্নত সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ধ্বংস করে ফেলেছে। পাহাড়ি জল বাতাস মানুষের বাঁচার জন্য উপযুক্ত। মানুষকে আয়ু দেয় এই পাহাড়ের জল ও বায়ু, তার প্রমাণ আমরা পাই অমর মিত্রের অপর এক উপন্যাস ‘হাঁসপাহাড়ি’-র আখ্যানে। উপন্যাসে দেখি রবিলোচনবাবু অসুস্থ তাই অফিসের এক বন্ধু তাকে বলছে–“তুমি হাঁসপাহাড়ি চলে যাও রবিলোচন, ওখানকার জল মানেই আয়ু,”যে হাঁসপাহাড়ি এসে রবিলোচন সুস্থ হয়েছিল সেই হাঁসপাহাড়িকে রবিলোচনের ছেলে সুনন্দ ধংস করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় হাঁসপাহাড়ির বন-জঙ্গল, নিশ্চিহ্ন করে দেয় পাহাড়টিকেই। তাই সুনন্দ যখন বিভিন্ন আকরিকের আশায় পাহাড় এবং পাহাড়ের উপর গাছ ধ্বংস করে দেয় তখন তার বাবা চুপিচুপি দেখতে গেলে সুনন্দ শাসন করে তার বাবাকে। তাই তো রবিলোচনবাবুকে বলতে শুনি–“দেখতে গিয়েছিলাম গাছটা পড়ল কেন, দেখলাম ডিনামাইট দিয়ে তুই তার শিকড় ছিঁড়ে দিয়েছিলি, ওখানে ব্লাস্টিং করতে কে বলেছিল, শুভেন্দু মন্ডল ত অন্য সাইটে করত। আমার মনে হয়েছিল, তাই।…নিচের এদিকে করলে লাভ বেশি, আর, ওই বটগাছ ত কী হয়েছে, গেছে গেছে। পাহাড় ত আমার।” পাহাড়কে মানুষ নিজের সম্পত্তি বলে ধরে নিয়েছে, তাই নিজের ইচ্ছামতো ধ্বংস করছে। যে পাহাড় রবিলোচনের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে সেই পাহাড়ে আজ জল পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবর্তন হয়ে গেছে জলবায়ু। আলোচ্য গল্পেও একইভাবে ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে বিভূতিবাবুর সেই স্বপ্নের নাঢ়া বইহার, ফুলকিয়া বইহার ধ্বংসের চিত্রই চিত্রায়িত।

    অন্যান্য পাহাড়ি মানুষদের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় দোবরু পান্নার উত্তরসূরীও। ভানুমতির মেয়ে-নাতনি। আজকের সময়ে টাঁড়বারো, রাজা দোবরু পান্না কেউই আর বাঁচাতে পারে না বিভূতিবাবুর সেই দেশকে। বন্য মহিষের দেবতাকে ভয় পায় না আজকের রাজপুত। শিং চামড়ার লোভে পশু শিকার করে চলে। তাই গল্পে লেখক বলেছেন–‘কেন না বুনো মহিষ আর নেই। তাদের মেরে চামড়া আর শিং পাচার করে দিয়েছে রাসবিহারী সিং-এর নাতি।’ এই ভাবেই অর্থের লোভে মত্ত হয়ে লোভী মানবজাতি বন্যপ্রাণীদের ধ্বংস করে চামড়া ও শিং পাচার করে চলছে। ফলে বনে আজ আর বন্য প্রাণীর দেখা মেলে না‌‌। যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে বনভূমির ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স।

    গল্পের শেষে দেখা যায় ধনেশ সিং একরকম ব্যর্থই হয়েছে। কোন ধাতুই বেরোয় না মাটির নিচ থেকে। সয়েল স্টেট, সার্ভে রিপোর্ট, কর্পোরেটের কোন হিসাবই মিলাতে পারে না ধনেশ সিং। যেখানে মাটির তলা থেকে পাহাড় ফাটিয়ে বের করার স্বপ্ন ছিল কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আইরন, ইউরেনিয়াম, সেখানে বেরিয়ে আসে–‘বেরিয়ে আসতে থাকে শুধু ক্যালসিয়াম পতিত হওয়া, চুন হয়ে যাওয়া প্রাণীর হাড়গুঁড়ো। বোন ডাস্ট। শুধু তো মানুষ নয়, যুগল প্রসাদ, রাজু পাঁড়ে, মুকুট নাথ পন্ডিত, ধাতুরিয়া, কুন্তা, মঞ্জিরা নয়, ওই বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমির যত প্রাণী, কীট-পতঙ্গ, পাখ-পাখালি সব নিধন করে ধনেশ সিং আর টহলদার বাহিনী মাটির তলায় চালান করে দিয়েছিল। শবদেহ মাটির তলায় গিয়ে ঢেকে দিয়েছে যত আকরিক। চুনাপাথর ব্যতীত আর কিছু নেই টের পেয়ে ধনেশ সিং ক্ষিপ্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে।’ পাহাড় ফাটিয়ে কোন মূল্যবান আকরিক ধাতু হয়তো অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায় না। কিন্তু পাহাড় অরণ্য তো আর থাকে না, হারিয়ে যায় মানবের লোলুপ দৃষ্টিতে। পাহাড় জঙ্গল না থাকায় হারিয়ে গেছে জঙ্গলের পশু পাখিরাও, সভ্যতার লেলিহান গ্রাসে। তাইতো আজ হারিয়ে গেছে বিভূতিবাবুর রেখে যাওয়া সাধের ধনঝরি সহ সমস্ত ছোট বড় পাহাড় এবং বনভূমি। ধ্বংস হয়ে গেছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বা বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য।

    কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র তাঁর  ‘জল ও বায়ু’, ‘কালো জল’, ‘নদী-ভূমি’, ‘কালো নদী’, ‘কলসপুর যাইনি’ এবং ‘বিভূতিবাবুর দেশ’ গল্পগুলিতে  সভ্যতার তথাকথিত উন্নয়ন কীভাবে পরিবেশকে দূষণে ভরিয়ে তুলছে এবং এই দূষণ মানবজাতির বাসরত পৃথিবীকে কীভাবে বাসের অযোগ্য করে তুলছে, সেই চিত্রই পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর সব মিলেমিশে গল্পগুলিতে তৈরি হয়েছে এক নতুন সংরূপ। তাঁর এই অভিনব সংরূপ পাঠকের মনে ভালো লাগার পাশাপাশি পরিবেশ সম্পর্কে গভীর বার্তা প্রদান করে যাচ্ছে। যা পাঠককে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন ও সতর্কীকরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।‘Eco-criticism’ আনন্দদানের পাশাপাশি সাহিত্যের কাছে ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’ সম্পর্কে দায়িত্ববোধ প্রত্যাশা করে। অমর মিত্রের আলোচ্য গল্পগুলি নিঃসন্দেহে তার নান্দনিক মাত্রা বোঝায় রেখেও বক্তব্য পরিবেশনার কৌশলে পাঠককে পরিবেশ সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের অভিমুখে পৌঁছে দিতে পেরেছে। তাই গল্পগুলি হয়ে উঠেছে সার্থক ইকো-টেক্সট।

তথ্যসূত্র:

১.মিত্র, অমর: শ্রেষ্ঠ গল্প, অলীক এই জীবন, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯,প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০০৩, পৃ-XVI

২.রায়, কিন্নর: ব্রহ্মকমল, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি-২০০৯,কলকাতা-৭৩, ভূমিকা অংশ।

৩.মিত্র, অমর: সবুজ রঙের শহর, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ-জানুয়ারি ২০০৯, পৃ-১২

৪.ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ: রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রথম খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ‘চৈতালি’, সভ্যতার প্রতি, প্রকাশ জুলাই ১৯৮০, পৃ-৬৬০

৫.চক্রবর্তী, স্বপ্নময়: শ্রেষ্ঠ গল্প, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা পুস্তক মেলা ২০০৩, পৃ-১২৭

৬.বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ: আরণ্যক, প্রস্তাবনা, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা-১২, প্রথম প্রকাশ: জৈষ্ঠ্য ১৩৭১,পৃ-৪

৭.বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ: আরণ্যক, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা-১২, প্রথম প্রকাশ: জৈষ্ঠ্য ১৩৭১,পৃ-১৬৩-১৬৪

৮.মিত্র, অমর: ‘হাঁসপাহাড়ি’, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯২, প্রথম করুণা মুদ্রণ বইমেলা ২০০৬, পৃ-৮

৯.মিত্র, অমর: ‘হাঁসপাহাড়ি’, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা জানুয়ারি ১৯৯২, প্রথম করুণা মুদ্রণ বইমেলা ২০০৬, পৃ-৬০

আকর গ্রন্থ:

১.মিত্র, অমর: শ্রেষ্ঠ গল্প, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-০৯, প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০০৩

২.মিত্র, অমর: সেরা ৫০টি গল্প, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা-৭৩,প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১২

৩.মিত্র, অমর: নদী-ভূমি, অর্কিড, অক্টোবর ১৯৯৫, গ্রন্থে প্রকাশ-আশালতা গল্প সংগ্রহ, গুরুচন্ডা৯,২০১৬

স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ছোটগল্পে পরিবেশচেতনা

 স্বপ্নময় চক্রবর্তী বিশ শতকের সাতের দশকের কথাশিল্পী। তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্যে সমকালীন তাপ-ছাপ সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়েছে। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর প্রথম কর্মজীবন শুরু বিহারে দেশলাইয়ের সেলসম্যান হিসেবে। কিন্তু কাজে গরহাজিরার দরুন অর্থাৎ বিহার শরিফে ঠিকমত কাজ না করে নালন্দা দেখতে চলে যাওয়ায় তাঁর চাকরি চলে যায়। পরে তিনি পেইন্ট ভার্নিশ টেকনোলজি পড়তে আরম্ভ করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক টানাপোড়নে গল্পকার বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি রাজস্ব দপ্তরের কানুনগোর চাকরি গ্রহণ করেন। কানুনগোর চাকরিতে থাকাকালীন তিনি গ্রামকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাই গ্রাম্য মানুষের জীবন, ভূমি, ভূমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সামন্ত ও ভূমিদাস, উঁচুজাত-নিচুজাত বিষয়গুলিকে তিনি দরদ দিয়ে অনুভব করতে পেরেছেন। ভূমি রাজস্ব দপ্তরের চাকরি ছেড়ে তিনি আবহাওয়া দপ্তরের চাকরি গ্রহণ করেন। বেশ কিছুদিন আবহাওয়া দপ্তরে চাকরি করার পর তিনি আকাশবাণীর ডিরেক্টর পদ গ্রহণ করেন। বিচিত্র কর্মজীবন লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীকে সুযোগ করে দিয়েছে জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের। এই অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবেই তিনি বহুমাত্রিক কাহিনি, ঘটনা ও বিষয়কে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাঁর লেখায়। তাই তাঁর সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছে সমাজ জীবনের নানা বাস্তব দিক। তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান বিষয় যা তাঁর গল্পের  কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান পেয়েছে তা হল পরিবেশ দূষণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায়। তিনি তাঁর গল্পগুলিকে নির্মাণ করেছেন ইকো-টেক্সট হিসাবে। সাহিত্য সমালোচনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা সাহিত্যতত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে, তাই পরিবর্তন হয়েছে সাহিত্য সমালোচনার বিভিন্ন তত্ত্বের। বলা যায় অ্যারিষ্টটল ও আচার্য ভরত থেকে সাহিত্য বিচারের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তা আজও বহমান। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নানা তত্ত্বের উদয় যেমন ঘটেছে তেমনি বিলোপও ঘটেছে হয়তো অনেক। এই ধারার নবতম সংযোজন ‘ইকো-টেক্সট’, পরিবেশবাদী সাহিত্য’ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যতত্ত্ব ‘ইকো-ক্রিটিসিজম’ বা ‘পরিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্ব’ নামে পরিচিত। ইকোক্রিটিসিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন উইলিয়াম রাকার্ত তাঁর— Literature and Ecology An Experiment in Ecocriticism প্রবন্ধে   ১৯৭৮ সালে। ইকোক্রিটিসিজম এর  সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গল্টফেন্টি বলছেন–“Ecocriticism is the study of the relationship between literature and the physical environment।”  কিন্তু এই ইকোক্রিটিসিজম সাহিত্য সমালোচনা তৈরির অনেক আগেই পরিবেশের বিপন্নতার কথা নিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করে গেছেন ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯) উপন্যাস। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি জগতে পরিবেশ ভাবনার নানা দৃষ্টান্ত রেখেছেন ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’ নাটকে ‘বলাই’ গল্পে এবং সবচেয়ে বেশি তাঁর পরিবেশ ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে। পরিবেশ সম্পর্কিত নানা পদক্ষেপ বিভিন্ন দেশে নানা ভাবে গ্রহণ করা হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিবেশ-বিষয়ক প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের জুন (৫-১৬) মাসে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। এরপর ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোতে পরিবেশ সংক্রান্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন জুন ১৪, ১৯৯২ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনটি বসুন্ধরা সম্মেলন নামেও পরিচিত। এই বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে যখন সর্বস্তরে ভাবনা শুরু হয়েছে ঠিক সেই সময় কথা সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী পরিবেশ ভাবনা নিয়ে যুগান্তকারী কিছু গল্প লিখলেন। এই গল্পগুলিতে পরিবেশ দূষণ এবং তার ভয়াবহতার চিত্র লেখক তাঁর সুনিপুণ লেখনীগুনে সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। যার ফলে এই গল্পগুলো ইকো-টেক্সটের মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছে।

       স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘শনি’ (অনুষ্টুপ, ১৯৮৭) গল্পটি চেরনোবিলের পারমাণবিক চুল্লির দুর্ঘটনার কিছুদিন পরেই প্রকাশিত হয়। বিগত শতাব্দীর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা হল এই চেরনোবিল গ্যাস দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার ফলে আজও চেরনোবিল ভুতুড়ে নগরী হয়ে আছে। এই পারমানবিক দুর্ঘটনায় পরিবেশের ভয়ঙ্কর ক্ষতি সাধিত হয়। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমায় যা ক্ষতি হয়েছিল তার থেকেও… পাঁচ গুণ বেশি ক্ষতি হয় এই দুর্ঘটনায়। তেজস্ক্রিয় ভস্ম ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এই দুর্ঘটনার ফলে উদ্ভূত পারমাণবিকভাবে সক্রিয় মেঘ ইউক্রেন রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের  উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে গ্রেট ব্রিটেনে এমনকি পূর্ব আমেরিকার উপর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘শনি’ গল্পে সেই কথাই ব্যক্ত হয়েছে তাজু মিয়া ও তার স্ত্রীর সন্তান হওয়ার ঘটনার মধ্যেদিয়ে। গল্পে বলা হয়েছে হাঙ্গেরি, চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ডের পশুচারণভূমিতেও ছড়িয়ে পড়ে এই তেজস্ক্রিয় ছাই। পশু দুধে দেখা দেয় তেজস্ক্রিয়তা। গল্পের প্রধান চরিত্র তাজুউদ্দিন, তার গর্ভবতী স্ত্রীকে সস্তার দুধ খাওয়ায়। তাই ভাজুউদ্দিন যখন জানতে পারে বাংলাদেশ সরকার গুঁড়োদুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাই হাজি সাহেবের সতর্কতা শুনে আর্তনাদ করে উঠেছে তাজুউদ্দিন, ‘এই দুধ খেলে গর্ভবতীর কী হয়?’ তার উত্তরে হাজি সাহেব বলেছেন— ‘সন্তান বিকলাঙ্গ হয়’। একথা শুনে জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে তাজুউদ্দিন, কারণ অনেক কষ্টের পর তাজুউদ্দিনের স্ত্রী গর্ভবর্তী হয়েছে। মুসলমানের পীর শুধু নয় তিনি সন্তান লাভের আশায় হিন্দু দেবতা শনি ঠাকুরের পুজাও করেছেন। প্রতি শনিবারে তাজুউদ্দিন চাঁদপাড়া বাজারে পাঠিয়ে দেয় শনি পূজার জন্য পাঁচ সিকে করে টাকা। এত কিছুর পর তিনি পিতা হতে চলেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাজারের সস্তা গুঁড়ো দুধ খাইয়ে তার যদি বিকলাঙ্গ সন্তান জন্মায় সেই ভয়ে এবং কষ্টে সে অস্থির হয়ে ওঠে। ছুটে যায় বিপ্রদাসবাবুর চেম্বারে। বিপ্রদাসবাবু তাকে বলেন-‘আমার মেয়ের তো বাচ্চা হবে, সে তো আমার কাছেই আছে। সেও তো কম গুঁড়ো দুধ খাইনি, কিসসু হবে না, গুজবে কান দিতি নাই।’ কিন্তু কিছুদিন পর বিপ্রদাসবাবুর মেয়ে সন্তান প্রসব করে মৃত এবং বিকলাঙ্গ। তাজুউদ্দিনের চিন্তা আরো বৃদ্ধি পায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে আসেন। তিনি ভাবেন— ‘বিশ্বচরাচরে এক্ষনি সর্বাত্মক হরতাল হয়ে যাওয়া উচিত।’ যদিও একটি খবরের কাগজে খবর বের হয়েছিল বাংলাদেশ গুঁড়ো দুধ পোল্যান্ড থেকে আমদানি করে। বেশ কিছুদিন আগে রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেই দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক ছাই-এর কিছু অংশ পোল্যান্ডের চারনক্ষেত্রের উপর পরে। সেই অঞ্চলের গরুর দুধে তেজস্ক্রিয়তার চিহ্ন পাওয়া যায়। সেই দুধ থেকে তৈরি হয় গুড়ো দুধ যা পোল্যান্ড বাংলাদেশে রপ্তানি করে দেয়। কিন্তু ভারত পোল্যান্ড থেকে দুধ আমদানি করে না, তাই ভারতে গুঁড়ো দুধ খেয়ে ক্ষতি হওয়ার কোন ভয় নেই। তবুও যখন বিপ্রদাসবাবুর মেয়ে মৃত সন্তান জন্ম দেয় তখন চাঁদপাড়া হাইস্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক ভরসা দেয় তাজুউদ্দিনকে, বলে হাজার কারণে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে। তিনি জানান–‘চেরনোবিল কি একটা? এরকম কত আছে ভারতবর্ষেও।’ লেখক এখানে আমাদের দেশের পারমাণবিক দূষণ, কলকারখানার দূষণ, যানবাহনের দূষণ সমস্ত কিছুর প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন। এছাড়াও লেখক বিজ্ঞানের উন্নতির জন্যই যে পরিবেশ আজ এক ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন ‘শনি’ গল্পটিতে। গদাধরের কথায়-‘ছাইনছ মারাচ্ছে না সব ছাইনছ। সারদেচ্ছো মোটা মোটা মুলো খাচ্চো, রেডিও শোনচো, ঘরে ঘরে রেডিও। টিভিও কতগুলো এসিছে গ্রামে, বাতাসে ইলেকটিরিক ঘুরিয়েছে না।’ একথা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে আমাদের সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে যানবাহন, কলকারখানা যেমন বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দূষণ। তাই লেখক এই দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে পাঠককে সচেতন করেছেন। ‘শনি’ গল্পের শেষে আমরা দেখি লেখক হতাশার মধ্যেও প্রবল সংশয় বুকে নিয়েও আশার আলো দেখাতে চেয়েছেন। তাজুউদ্দিনকে ভয়ের শনি তাড়া করে। চেরনোবিল কতদূরে তাজুউদ্দিন জানে না। আতঙ্কের ‘ইবলিশ’ ওকে তাড়া করে বাতাস। বাতাসে রেডিও বিষ। মেঘের ওপারে আল্লাতালা? কেমন জানি না। পরম আকুতি ভরে আত্মজাকে বিশ্বাস দিতে দিতে ডাকে—”সমস্ত চেন্নোবিল, সমস্ত শনি, সাতঙা-দেওদের কেরদানিকে নাথি মারতি মারতি, নাথি মারতি আয়রে আমার আহ্লাদ। তুই কেমন জানি না।’ লেখক এই গল্পে পরিবেশের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও সন্তান জন্মাবার আশাই প্রকাশ করেছেন। সমস্ত দূষণকে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে এক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের বসবাসযোগ্য পরিবেশের স্বপ্ন দেখেছেন। ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনা (১৯৮৪) চেরনোবিল গ্যাস দুর্ঘটনার (১৯৮৬) কিছুদিন পরেই লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর ‘ক্যারাক্কাস’ (শারদীয় বর্তমান: ১৯৯২) গল্পটি লেখেন। যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের পৃথিবীতে বৃদ্ধি ঘটছে কল-কারখানার আর কলকারখানার বৃদ্ধির ফলে দূষণের মাত্রাও বেড়েছে সবদিক থেকে। বায়ু দূষণ, জল দূষণ এর পাশাপাশি কারখানাগুলোতে গ্যাস দুর্ঘটনার চিত্রও এখন দেখা যায় অহরহই। সেই বিষয় নিয়ে লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর ‘ক্যারাক্কাস’ গল্পটির কাহিনি নির্মাণ করেছেন। এই গল্পের কাহিনির মূল উপজীব্য বিষয় হল কল কারখানার বর্জ্য পদার্থ ও রাসায়নিক পদার্থ জলকে কীভাবে বিষাক্ত করে তুলছে সেই চিত্র। গল্পে দেখি—“নালায় কালো জল ছরছর বইছে। আহা। জল তো নয়, অ্যাসিড।। শুধু কি অ্যাসিড? অ্যালডিহাইড-কিটোন- আর্সেনিক-সোডা।’  এই জল থেকে বের হয় নানা রঙের ধোঁয়া। ঝাঁঝালো তার গন্ধ, কাশি আসে। কারখানার এই দূষণ শেষ করে দিতে পারে এক-একটি প্রজাতিকে। এই গল্পে একটি পুকুরে কারখানার বিষাক্ত জল জমা হয়। বিষাক্ত সেই জল শোষণ করে নেয় পাতার সবুজত্ব। পুকুরের আশেপাশের গাছগুলি মারা যায়। সেই বিষপুকুরে একদিন কারখানার এক কর্মচারী মাছ দেখতে পায়। সেই মাছ দেখার খবরটি কারখানার মালিককে দেয়। তিনি ছিপ দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করেন। ছিপে চিংড়ি মাছ গেঁথে দিলে মাছটি কালো হয়ে কুকড়ে যায়। অবশেষে মাছ ধরতে সক্ষম হলে দেখা যায়-‘এ এক নতুন প্রজাতির মাছ হাতখানিক লম্বা। ড্যাবা ভ্যাবা চোখ। সারা গায়ে আঁশ নেই একটুও। খরখরে গা। গিরগিটির মতন।’ এই নতুন মাছ আবিষ্কার করে লাফিয়ে উঠেন কারখানার স্যার। তিনিই এই নতুন স্পেসিস আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিতে চান। তাই কর্মীটিকে ধাক্কা দিয়ে বিষপুকুরের জলে ফেলে দেন। এই পুকুরের জলের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল এই জলে পড়ে কর্মীটির শরীরের জামা কাপড় পুড়ে যায়। গায়ের চামড়া গিরগিটির চামড়ার মত খরখরে হয়ে যায়। তাকে দেখে কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে নিজের স্ত্রী পর্যন্ত ভয় পায়। ঐ পুকুরের মাছের চামড়া দিয়ে অ্যাসিড প্রুফ, রেডিও অ্যাকটিভিটি প্রুফ গ্লাভস তৈরি হয়। ফলে চামড়ার জন্য ক্যারাক্কাসের চাহিদা বাড়তে থাকে। হঠাৎ একটি দুর্ঘটনায় কারখানায় সমস্ত শ্রমিক আহত হলেও নায়েকের কিছু হয়না। রহস্যটা আমাদের কাছে স্পষ্ট। কারখানায় নোটিশ জারি হয় সবাইকে বিষ পুকুরে ডুব দিয়ে আসতে হবে। মালিকের অভিপ্রায় দুর্ঘটনা প্রুফশ্রমিক শ্রেণি তৈরি করা। এদিকে নায়েকের স্ত্রী একদিন সেই পুকুরে স্নান করে পুনরায় স্বামীর দোসরে পরিণত হয়। তাদের সন্তান হয়-‘বউ কাতরাচ্ছে। আমি বাপ হচ্ছি।… একটু পরেই কান্না শুনলাম। শিশুর কান্না। আমার বুকের মধ্যে কারখানা ছুটির ভো বাজলো। বললাম, ছেলে না মেয়ে? ধাই বললে, জেবনে এই পরথম ভুতের জন্ম করালুম। পেত্নীর গর্ভতে ভূতের জন্ম। ছেলেটার চামড়া ঝোলা ঝোলা। সারা চামড়ায় গুড়িগুড়ি কাঁটা। মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছে ড্যাবা ভ্যাবা চোখ।’ দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসে এই অদ্ভুত শিশু দেখতে। একদিন আসে কারখানার মালিক ছেলেটিকে দেখতে –‘স্যার মন দিয়ে দেখছেন। স্যার চামড়া টিপে টিপে দেখছেন, শিশুর চামড়া। স্যার স্যাম্পল দেখছেন, স্যাম্পল। স্যার হাসলেন। বললেন বা। তারপর স্থির হলেন। চোখ স্থির, দেহ স্থির। মন্ত্র পড়ার মতন বলতে থাকলেন— ইউরেকা… ইউরেকা নতুন প্রজাতি। নিউ স্পেসিস। ক্যারাক্কাস নিউ ক্যারাক্কাস।’

২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে জলপাইগুড়ির করলা নদীতে প্রথম মাছের অকস্মাৎ মৃত্যু শুরু হয়, নদীর জলে বিষক্রিয়ার ফলে প্রচুর মাছ মারা গিয়েছিল। ২০১৫ সালে আবার করলা নদীতে মাছের মৃত্যু হয় অতিরিক্ত কীটনাশক বা রাসায়নিক বিষক্রিয়ার ফলে। ২০১৯ সালে করলা নদীতে বিষক্রিয়ার ফলে শুধু চিংড়ি মাছের মৃত্যু হয়। প্রাকৃতিক অবস্থায় ব্যবহারযোগ্য জল যেভাবে দূষিত হচ্ছে তাতে বিশ্বজুড়ে পানীয় জলের সংকট তীব্র। এই দূষিত জল পান করার ভয়ংকর পরিণতি কী হতে পারে তার নিদর্শন ফুটে উঠেছে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘জল তিমির’ উপন্যাসে। মানুষ বাধ্য হয়ে দুষিত জল পান করছে। আর এই দূষিত জলের প্রধান উৎস কলকারখানার বর্জ্য। তার সঙ্গে রয়েছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত নানা রাসায়নিক সার। ফলস্বরূপ জল দূষণে বিচিত্র শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত জল উত্তোলনের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে জলে আর্সেনিক সমস্যা। সেই চিত্র ফুটে উঠেছে, ‘জলতিমির’ উপন্যাসে। গবেষণায় জানা গেছে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ভূস্তর যা আর্সেনিক পুষ্ট এবং কাদা পলি দ্বারা গঠিত ভূতল থেকে ৭০ এবং ২০০ ফুট গভীরের মধ্যে অবস্থান করছে। এই স্তরটি সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ছিল। কিন্তু আগে তো আর্সেনিক সমস্যা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে মানুষের খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই কৃষিক্ষেত্রে ফসল বৃদ্ধির জন্য প্রতিনিয়ত সেচের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ বিপুল পরিমাণ জলের ব্যবহার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাচ্ছে, ফলে গরমকালে আর্সেনিক সমস্যা বেশি দেখা যায়। এই আর্সেনিক সমস্যা নিয়েই লেখা স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ফুল ছোঁয়ানো (শারদীয় বর্তমান ২০০১) গল্পটি। গল্পের প্রধান চরিত্র হীরক ট্রেনে তার সিরিয়ালের স্কিপ লেখা খাতা ভুল করে ফেলে রেখে চলে যায়। সেই খাতা আসগর আলি যত্ন করে নিয়ে যায় নিজের বাড়িতে এবং নিজের টাকা খরচ করে আসগর বাবু টেলিফোন করে হীরককে সেই খাতা নিয়ে আসতে বলে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে হীরক পৌঁছে যায় গাইঘাটার বাঁশপোতা গ্রামে। সেখানে হীরক দেখে আসগর আলির নখের রং কালো, হাতের চামড়া গিরগিটির গায়ের মতো খরখরে। চামড়া মোটা ফাটাফাটা, আঙুলগুলো মোটা ফাটা, শুকনো রক্ত, ভ্রুতে চুল প্রায় নেই। হীরক প্রথমে ভেবেছিল আসগর আলি কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার ভুল ভাঙে। যখন হীরককে জল খেতে বলে হীরক যেন আঁতকে ওঠে, তখন আসগর আলি জানায়-‘আছেনিকের ভয়? এক গ্লাস খালি কিছু হবেনে। আমরা তো রোজ খাই।’ শুধু আসগর আলি নয়,এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ আর্সেনিক আক্রান্ত। সেই আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে একটি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে গিয়েই হীরকের খাতাগুলি পেয়েছেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানের খবর প্রকাশিত কাগজটা আসগর হীরককে দেখতে দেয়। তাতে জানা যায়-পশ্চিমবাংলার ৮টি জেলায় ৩২ লক্ষ মানুষ বিপদমাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিকযুক্ত জল খেতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের গ্রামবাংলায় চারপাশে জলের অভাব নেই ঠিকই কিন্তু পানীয়জলের বড়ই অভাব। আজকের দিনে দাঁড়িয়েও গভীর নলকূপ গ্রামগুলিতে নেই বললেই চলে। সরকারের তরফ থেকে যে রানিং ওয়াটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে তা আজ পর্যন্ত অধিকাংশ গ্রামগুলিতে পৌঁছায়নি। আর যেসব গ্রামে জলের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জল পৌঁছায় না। এই ঘটনার করুন চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘জলতিমির’ উপন্যাসটিতে। লেখক জানিয়েছেন সরকার যদিও ৪০ পাইপের কল অর্থাৎ ৮০০ ফুট গভীর কল নির্মাণের টাকা দেয় কিন্তু সেই কল নির্মাণ করা হয়নি। রাজনৈতিক টানাপোড়নে তা অনেক কম গভীর যুক্ত কল নির্মাণ হয়। তাই এই গল্পে দেখি আসগর আলি নিজেই আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে কবিতা রচনা করেন-

‘পৃথিবীর বক্ষ হতে অমৃত তুলিল

আর পৃথিবীর ভিতরেতে বিষ জন্মে গেল

সে বিষ কে সরাবে, কে ঘুচাবে ভাই

কালীয় সৰ্প আছে শ্ৰীকৃষ্ণ তো নাই।’

সাধনবাবু ‘জলতিমির’ উপন্যাসে যেমন মিথের ব্যবহার করেছেন তেমনি লেখক স্বপ্নময়  চক্রবর্তীও এখানে কালীয়র প্রসঙ্গ এনে মিথের ব্যবহার করেছেন। লেখক এখানে বলতে চেয়েছেন কালীয় যেমন কালীদহের জল বিষ দিয়ে বিষাক্ত করে তুলেছিল। কিন্তু সেই সময় শ্রীকৃষ্ণ ছিল তাই শ্রীকৃষ্ণ কালীয়কে হত্যা করে কালীদহের জল মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছিল। কিন্তু বর্তমানে শ্রীকৃষ্ণ নেই। কী করে এই আর্সেনিক দূষণ থেকে মুক্তি সম্ভব সেই বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। লেখক শ্রীকৃষ্ণের কালীয়র ফনা ভেঙে মটকে দেওয়া প্রসঙ্গে সাধনবাবু ‘জলতিমির’ উপন্যাসে জানিয়েছেন-“এগুলো যেন কালিয়র ভগ্ন ফনা নয়, জলের ব্যাকটেরিয়া, আর্সেনিক সিসা বা লোহার গ্রেডিয়েন্টের এক-একটি শক্ত অস্তিত্ব। চুন, ফিটকিরি, ক্লোরিন, থেকে শুরু করে এক একটি পরিশোধক ছড়ানো হচ্ছে, জল হয়ে উঠছে টলটলে।” তাইতো গল্পে দেখি গ্রাম বাংলার মানুষদের বিশুদ্ধ পানীয় জলের আর্তি।

      এভাবেই জল দূষণ থেকে মুক্তির কথা ভেবে লেখক ভাবান্বিত হয়েছেন। পৃথিবীর বিরামহীনতার কারণে আরও দূষণের চিন্তায় লেখক গভীর সংকটের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন-‘বসুন্ধরার তো বিশ্রাম নেই; কতবার ফসল দিতি হয়। আউশ, আমন, বোরো। হাইবিরিড ধান পানি টানে বেশি আর ওই পানিতে আর্সেনিক। ধানের ভিতরেও কি আর্সেনিক মেশে না।’ আজ খাবারে ভিটামিনের অভাব, খাবার থেকে নানা রোগের সৃষ্টি, তার মূল কারণ এই দুষিত জল ও রাসায়নিক সারের প্রচুর পরিমাণে কৃষিকাজে ব্যবহার। লেখক সেদিকটি আমাদের সামনে দেখিয়েছেন আসগর আলির কথার মধ্য দিয়ে। ‘ফুলছোঁয়ানো’ গল্পের শেষে আমরা দেখতে পাই কীটনাশক ব্যবহারের ফলে অবলুপ্তি ঘটেছে প্রজাপতি, ফড়িং সহ নানা কীটপতঙ্গের। তাই ফুলের পরাগ মিলন বর্তমানে প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে না। এদিকে আর্সেনিকের প্রকোপে জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ রিকেট আক্রান্ত শিশু। তারপর হীরক জানতে পারে এই আক্রান্ত শিশুরা তাদের কচি কচি আঙুলে ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরাগ মিলন ঘটায়। ফসল ফলে- পটল, করলা, ঝিঙ্গে। কচি কচি আঙ্গুল কোনোদিন আর পুষ্ট হবে না। আরো বড় সামাজিক সংকট হল এই গ্রামে কেউ নতুন করে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে না। পরিবেশ কীভাবে আমাদের সামগ্রিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তা কী ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে লেখক ‘ফুল ছোঁয়ানো’ গল্পটিতে তাই দেখাতে চেয়েছেন।

       বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে প্রতি লিটার জলে ০.০১ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে তাকে আর্সেনিক দূষিত জল বলে ধরা হয়। আর্সেনিক পৃথিবীর ভূত্বকের গঠনগত উপাদানগুলির মধ্যে অন্যতম একটি উপাদান। প্রকৃতিতে আর্সেনিক মুক্ত মৌল হিসেবে পাওয়া যায় না। আর্সেনিক এক প্রকার ধাতব পদার্থ। এটি জলে দ্রবীভূত অবস্থায় থেকে জলের ধাতব দূষণ ঘটায়। সাধারণত প্রতি কেজি পাললিক শিলায় ৫-১০ গ্রাম আর্সেনিক থাকে। এছাড়া যেসব শিলায় লোহার পরিমাণ বেশি সেই সব শিলায় আর্সেনিকের পরিমাণও বেশি। এই শিলা মধ্যস্থ আর্সেনিক ভূগর্ভস্থ অ্যাকুইফারের সাথে যুক্ত হয়ে ভৌমজলকে দূষিত করে। আর এই ভৌমজল আমাদের পৃথিবীর এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ এই ভৌমজলকে আমরা পানীয় জলের একমাত্র স্বচ্ছ উৎস হিসেবে ব্যবহার করে থাকি।জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও তার সাথে সাথে আধুনিক প্রাম্পীয় সিস্টেমের আবিষ্কারের ফলে মানুষ অতি সহজেই অবিবেচনা প্রসূত প্রচুর পরিমাণে ভৌমজল উত্তোলন করে ফেলছে। ফলে ভূগর্ভস্থ জলে অক্সিজেন মিশে গিয়ে আর্সেনিকের সংস্পর্শে এসে জলে আর্সেনিক দূষণ ঘটাচ্ছে। সেই দূষিত জল পানীয় হিসেবে সেচের কাজে ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমেও মানুষের শরীরে আর্সেনিক প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। তাইতো কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা নির্ভর গল্প রচনা করতে গিয়ে আর্সেনিক সমস্যা নিয়ে রচনা করলেন ‘আর্সেনিক ভূমি’ নামে অমূল্য এক গল্প। লেখক নিজে গল্পটি লিখে আরো ভালো হতে পারতো বলে আক্ষেপ প্রকাশ করলেও গল্পটি স্প্যানিস ও জার্মানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়াও আর্সেনিক বিষয়ক এক ইন্টারন্যাশনাল ওয়েবসাইটে গল্পটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

    গল্পের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই ইছামতি নদীর দুরবস্থার চিত্র। বর্তমান সময়ে নদী সমস্যা ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। অতীতে যেসব নদীগুলিকে নির্ভর করে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেই নদীগুলি আজ হারিয়ে গেছে। অনেক নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে আবার অনেক নদী পুরোপুরি মরে গেছে। চিহ্নমাত্র নেই। আর যেসব নদী এখনো আছে সেগুলি দূষণে পরিপূর্ণ, সেইসব নদীর জলে মাছ বসবাস করতে পারে না, মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। গল্পকার বলেছেন–‘ইছামতি ওর ইচ্ছামতো সরে গেছে দূরে, পুরনো খাতে জল রয়ে গেছে কিছু, নোনা জল, খাওয়া যায় না, কিন্তু পাখি আসে।’ এভাবেই নদী তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে এবং পুরোনো খাতের জল আস্তে আস্তে শুকিয়ে গিয়ে নদীর বুকে গড়ে উঠেছে বাড়ি-ঘর, বাজার। তবে গল্পের ভরকেন্দ্রে জল-জলদূষণ এবং তজ্জনিত সতর্কতা গুরুত্ব পেয়েছে। গল্পকথক আমেরিকা প্রবাসী রামপ্রসাদের কলকাতার সল্টলেক নিবাসী স্ত্রী যখন আমেরিকা থেকে নিজের শহরে আসে তখন সেখান থেকে কয়েক লিটার জল নিয়ে আসে। কলকাতার মিনারেল ওয়াটারের প্রতি ভরসা করতে পারে না পৃথা, তাই ভয় পায় সে। রামপ্রসাদের উচ্চারণে উঠে আসে–‘ইস কী যে হলো আমাদের জলভীতি।’

       রামপ্রসাদের বাবা তাকে দেশের জন্য কিছু করতে বলেছেন। দেশ বলতে এখানে রামপ্রসাদের জন্মস্থান বা বাকালির কথা বলা হয়েছে। তাই বাবার মৃত্যুর পর রামু তার দেশের বাড়িতে যান। যাবার পথে রাস্তায় বাদুড়িয়ার মোড়ে তার চোখে পড়ে–‘একটা নীল বোর্ডে লাল হরফে লেখা দেখলাম সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া নলকূপের জলে বিপদসীমার বেশি আর্সেনিক আছে। ওই জল পান করিবেন না।’ এদিকের জলে আর্সেনিক আছে বুঝতে পেরে সঙ্গে নিয়ে আসা মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা আঁকড়ে ধরে রামপ্রসাদ। এই সাইনবোর্ড দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার বিশ্ব পরিবেশে আর্সেনিক সমস্যার চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ইন্টারনেটে রামু দেখেছে শুধু ভারত নয়, ব্রাজিল, মেক্সিকো, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও আর্সেনিক সমস্যা এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। আর এই সুযোগে বেশ কিছু দেশ আর্সেনিক মুক্ত জল বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। আমেরিকান কোম্পানিগুলি এই কাজ করে যাচ্ছে। আর্সেনিক ফ্রি জল বিক্রি করে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। তাই কোম্পানিগুলি মুখিয়ে থাকে কোথায় আর্সেনিক দেখা দিল তার অপেক্ষায়। তিনি নিজেও এরকম একটা কোম্পানির কনসালট্যান্ট ছিলেন কিছুদিন। রামপ্রসাদ তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে নিজের স্কুলে যায় যেখানে তিনি ছোটবেলায় পড়েছে। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় কলের মুখে বস্তা বাঁধা। তা দেখে সে বুঝতে পারে আর্সেনিকের জন্যই টিউবয়েলে বস্তা জড়ানো। হেডমাস্টারের সাথে কথা বলে জানতে পারে ছাত্ররা এই জলে পান করে, কারণ বাড়িতেও একই সমস্যা। তাই এই জল খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। জলে আর্সেনিক দূষণের জন্য বর্তমানে অত্যাধিক হারে জল সেচকেই দায়ী করেছেন কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ফসল উৎপাদনের প্রয়োজন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত জল, যার ফলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচ থেকে জল তুলে নেওয়া হচ্ছে। যার ফলে ভূগর্ভে ফাঁকা স্থানে অক্সিজেন প্রবেশ করে সেই অক্সিজেন আর্সেনিকের সঙ্গে বিষক্রিয়া করে জলে আর্সেনিক দূষণ ঘটাচ্ছে। গল্পকার তাই বলেছেন–‘এমনিতে মাটির তলায় আর্সেনিকের যে পিরাইটস থাকে, সেটা জলের সঙ্গে থাকতে পারে না। অক্সিজেন মিশলে আস্তে আস্তে জলে মিশতে পারে। মাটির ভিতর থেকে জল তুলে নেওয়া হচ্ছে বলে মাটি একটু করে ফোঁপড়া হচ্ছে, ফলে অক্সিজেন ঢুকছে।’ এই অক্সিজেন আর্সেনিকের সঙ্গে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে জলকে করে তুলছে বিষাক্ত। এই অতিরিক্ত জলসেচের করুন চিত্র লেখক  তাঁর অপর গল্প ‘ফুল ছোঁয়ানো’-তেও উল্লেখ করেছেন। আসগর আলি বলে–‘মাটির তলার পানি বের করি, মা বসুন্ধরার তো বিশ্রাম নাই, কতবার ফসল দিতি হয়। আউশ, আমন, বোরো…। হাইব্রিড ধান পানি টানে বেশি, আর ওই পানিতে আর্সেনিক।’ 

      গল্পে দেখি পঞ্চায়েত নির্বাচিত মেম্বার নিজেও আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। তার ভুরুর চুল পড়ে গেছে, নখের রং কালচে হয়ে গেছে। গ্রামগুলো আজও নোংরা রাজনীতিতে আক্রান্ত। সরকারি প্রতিনিধিদের কাছে ভোটের মূল্য ছাড়া আর কোন মূল্যই নেই গ্রাম বাংলার মানুষদের। গল্পকার তাই বলেছেন–‘জানেন আমাদের বে-থা হয় না। কে আমাদের গাঁয়ে মেয়ে দেবে মরার জন্য? আমাদের কিচ্ছু নেই? ঘর সংসার, জেবন, খালি ভোট আছে। একটা করে ভোট আছে।’ গ্রামের মানুষের শুধু ভোটই থাকে,আর কিছুই থাকে না। তাইতো আটত্রিশ বছরের ছেলে আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মরে গেলেও সরকারের কোন যায় আসে না। তাতে কোন প্রভাব পড়ে না সরকারি আমলাদের জীবনে। ভোটের আগে বারবার বিশুদ্ধ জলের প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোট শেষে অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটে না। যে গ্রামে রামপ্রসাদ বড় হয়ে উঠেছে সেই গ্রামের সবাই চোরে পরিণত হয়েছে। এমনকি তার নিজের কাকা ভাইরাও। কারণ তাদের জীবনে কিছুই নেই, বিয়ে পর্যন্ত হয় না। তাই মরতেই যখন হবে তখন আর জীবনের ভয় নেই। গ্রামের মানুষের আর্সেনিকে কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার দেখি রামপ্রসাদের ভাই খাদুর বাচ্চা হয়েছে বিকলাঙ্গ, আর্সেনিকের প্রভাবে জিনের পরিবর্তন ঘটেছে, প্রমাণ দেখা যায় তার প্লাস্টিকের বাচ্চা জন্মানোর মধ্যেদিয়ে। আর্সেনিক আক্রান্ত বাচ্চারা কখনো বড় হয় না, একই অবস্থায় থাকে। গল্পে তা লেখক বর্ণনা করেছেন–‘আমার বাচ্চা তো বড় হবে না কখনও …বউটা আরও কিছুদিন বাচ্চা নিয়ে থাকতে পারবে।’ এভাবেই আর্সেনিক গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে নিচ্ছে। মানুষকে যেমন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি নব্য শিশু জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ হয়েই।

          শুধু ভূগর্ভস্থ জল নয়, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবাও এখন আর্সেনিকে জর্জরিত। নলকূপের জলে আর্সেনিক পাওয়া যায় যেসব জায়গায়, সেখানে নদীর বহমান জলই ভরসা ছিল মানুষের। কিন্তু নদীর জলেও এখন আর্সেনিকের সন্ধান মিলছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমীক্ষা উদ্ধৃত করে মন্ত্রকের রিপোর্ট জানাচ্ছে- দেশের অন্তত ১২০ টি নদীর জলে আর্সেনিকের মতো বিষাক্ত ধাতু রয়েছে যা সত্যি আশঙ্কার। স্বাধীনতার এতদিন পরেও দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। প্রতিবছর বিশ্বে ৫০ লক্ষের বেশি মানুষ জল সংক্রান্ত অসুখে মারা যায়। জলের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে, বিশুদ্ধ জলের পরিমাণ ঠিক তেমনি দ্রুতগতিতে কমছে। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরেজেলডিন আশঙ্কা করেছেন-পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ হবে জলের জন্য। আমরা চাইবো তাঁর এই আশঙ্কা যাতে সত্যি না হয়। তাই সকল স্তরের মানুষকে জল দূষণ রোধ করতে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনি জল অপচয় রোধ করতে হবে। জল দূষণ রোধ করা সম্ভব হলে জল বাহিত রোগগুলি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অনিয়ন্ত্রিত ভূগর্ভস্থ জল ফসলের কাজে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। তাহলে আর্সেনিকের মতো বিষক্রিয়া থেকে মানব সমাজ মুক্তি লাভ করতে পারবে এই আশা করা যায়।

      পরিবেশ দূষণের মারাত্মক চেহারা উঠে আসছে বিভিন্ন সমীক্ষায়। ভূপালের গ্যাস দুর্ঘটনার প্রভাব আজও মানুষ ভোগ করছে। চেরনোবিলে আজও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। করলা নদীতে রাসায়নিক বিষক্রিয়ার প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মাছ। সাঁতরাগাছি ঝিলে দূষণের জন্য শীতে পাখিরা আসে না। এই বিচিত্র ভাবনার বহুমাত্রিক রূপপ্রকাশিত হয়েছে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর গল্পের আকাশে। তাঁর লেখা এই পরিবেশ ভাবনা সমৃদ্ধ গল্পগুলি পাঠকদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতে খণ্ডকাল এবং অখণ্ডকাল ধরে সাহায্য করবে বলেই আমার বিশ্বাস ।

তথ্যসূত্র:

১. Cheryl Glotfelty and From Harold (eds.), The Ecocriticism Reader: Landmarks in Literary Ecology, University of Georgia, 1996, P. XVI ২.স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শ্রেষ্ঠগল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ-কলকাতা পুস্তকমেলা-২০০৩, পুনঃমুদ্রণ জুন- ২০১৭, কলকাতা- ৭৩,পৃ-৭৯

২. সাধন চট্টোপাধ্যায়, জল তিমির ও মাটির অ্যান্টেনা, গাঙচিল, প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর- ২০১৬,

কলকাতা, পৃ.৪০

কিন্নর রায়ের ছোটগল্পে পরিবেশচেতনা

সাহিত্য সমালোচনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশের পথে নানা সাহিত্যতত্ত্বের আবির্ভাব হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনা চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে, তাই পরিবর্তন হয়েছে সাহিত্য সমালোচনার বিভিন্ন তত্ত্বের। বলা যায়, অ্যারিস্টটল ও আচার্য ভরত থেকে সাহিত্য বিচারের যে ধারা সূচিত হয়েছিল তা আজও বহমান। এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় নানা তত্ত্বের উদয় যেমন ঘটেছে তেমনি বিলোপও ঘটেছে হয়তো অনেক। এই ধারার নবতম সংযোজন ‘ইকো-টেক্সট’, ‘পরিবেশবাদী সাহিত্য’ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যতত্ত্ব ‘ইকো-ক্রিটিসিজম’ বা ‘পরিবেশবাদী সাহিত্যতত্ত্ব’ নামে পরিচিত। ইকোক্রিটিসিজম শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন উইলিয়াম রাকার্ত তাঁর –‘Literature and Ecology : An Experiment in Ecocriticis’  প্রবন্ধে ১৯৭৮ সালে। ইকোক্রিটিসিজম এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গল্টফেন্টি বলছেন—”Ecocriticism is the study of the relationship between literature and the physical environment. “ কিন্তু এই ইকোক্রিটিসিজম সাহিত্য সমালোচনা তৈরির অনেক আগেই পরিবেশের বিপন্নতার কথা নিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করে গেছেন ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯) উপন্যাস। তারও আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি জগতে পরিবেশ ভাবনার নানা দৃষ্টান্ত রেখেছেন ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’ নাটক, ‘বলাই’ গল্প এবং সবচেয়ে বেশি তাঁর পরিবেশ ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে ছিন্নপত্রাবলীতে।

      পরিবেশ সম্পর্কিত নানা পদক্ষেপ বিভিন্ন দেশে নানা ভাবে গ্রহণ করা হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিবেশ-বিষয়ক প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের জুন (৫-১৬) মাসে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। এরপর ব্রাজিলের রিও-ডি জেনেইরোতে পরিবেশ সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৪ জুন, ১৯৯২ সালে। এই সম্মেলনটি বসুন্ধরা সম্মেলন নামেও পরিচিত। এই বিশ্ব পরিবেশ নিয়ে যখন সর্বস্তরে ভাবনা শুরু হয়েছে ঠিক সেই সময় কথা সাহিত্যিক কিন্নর রায় পরিবেশ ভাবনা নিয়ে এক যুগান্তকারী উপন্যাস লিখলেন সেটি হল ‘প্রকৃতি পাঠ’ (১৯৯০)। তারপর তাঁর ছোটোগল্পগুলির মধ্যেও এই প্রকৃতির নানা সংকট ও তা থেকে উত্তরণের প্রয়াস নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন গল্পকার কিন্নর রায়।

       ১৯৫৩ সালে ৬ নভেম্বর কিন্নর রায় জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সাংবাদিক। তাই তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশ দেখার সুযোগ পেয়েছেন খুব কাছ থেকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি প্রকৃতির টানে তিনি গ্রাম থেকে শুরু করে নদী, মাঠ-ঘাট ঘুরে বেড়ান আজও। লেখক কিন্নর রায় তাঁর প্রকৃতি চেতনার কথা বলতে গিয়ে ‘আমার প্রকৃতিপাঠ’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন—“এই ব্রত প্রকৃতিকে ভালোবাসা, প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করার স্ত্রী আচার। জল, বৃক্ষ, পাখি, ফুল, মাছ, সাপ, কুমির, বাঘ, কচ্ছপ-সবাইকে বাঁচিয়ে রেখে সুন্দর সবুজ প্রকৃতি সন্ধানী হওয়ার ডাক এইসব ব্ৰততে।” ছোটোবেলা থেকে মা-কাকিমা-মাসিমাদের যে ব্রত পালন করতে তিনি দেখেছেন তাতে তিনি প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য তাদের আকুল আবেদন লক্ষ করেছেন। সেই ব্রতকথা থেকেই লেখকের প্রকৃতির প্রতি জন্মেছে গভীর টান। যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সৃষ্ট কথাসাহিত্যের প্রতিটি শাখায়। তাছাড়া তিনি সাংবাদিকতার কাজ করায় সব দিকে তাঁর স্বতন্ত্র দৃষ্টি ছিল। সেই স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই তিনি লক্ষ করেছিলেন বর্তমানে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভয়ংকর চিত্র। মানুষ যতই উন্নত হচ্ছে ততই প্রকৃতির প্রতি বিরূপ হয়ে যাচ্ছে যার ফলে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যের হেরফের ঘটছে। কিন্নর রায়ের গল্প ও উপন্যাসের সংখ্যা অনেক তার মধ্যে তাঁর পরিবেশকেন্দ্রিক গল্পগুলি আমার আলোচনার বিষয়। তাঁর লেখা ‘অনন্তের পাখি’, ‘একা গাছ’, ‘মহাজাগতিক’, ‘আজান গাছ’, ‘অচিন তলা’ গল্পগুলিতে প্রকৃতির চিত্র, প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার চিত্র এবং পশু-পাখিদের সমস্যার কথা তিনি তাঁর সুনিপুণ লেখনীর মধ্যেদিয়ে পাঠকের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।

  সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান মানুষকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে। যা জীবন যাপনকে করেছে সহজতর। কিন্তু বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদ মানুষের বিবেচনার অভাবে পরিণত হয়েছে অভিশাপে। প্লাস্টিক বর্জ্য তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আজ পরিবেশ সংকটের অন্যতম মূল উপাদান হল এই প্লাস্টিক। লেখক কিন্নর রায় এই প্লাস্টিক দূষণ এবং পলিব্যাগ সংক্রান্ত মারাত্মক সংকটের কথাই তুলে ধরেছেন তাঁর ‘অনন্তের পাখি’(১৯৯৬) গল্পটিতে। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় প্লাস্টিকের ব্যবহার আজ অপরিহার্য। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে বিকল্প সামগ্রী হিসেবে পলিমারের ব্যবহার হচ্ছে। ক্যারিব্যাগ থেকে ঔষধের বোতল, খাদ্য পরিবেশনের পাত্র থেকে ফুলের টপ সমস্ত কিছুতেই ব্যবহৃত হচ্ছে শুধুই প্লাস্টিক। বাজার থেকে আমরা সমস্ত কিছু পলিব্যাগে ভরে নিয়ে আসি। প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে ততটা আপত্তি নেই, কিন্তু ব্যবহারের পর যেভাবে এগুলিকে যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে লেখক কিন্নর রায় সেই বিষয়ে গভীর আপত্তি জানিয়েছেন। তাঁর এই ‘অনন্তের পাখি’ গল্পে গল্পকথক অনন্তের দোকানের নাম ‘সর্বমঙ্গলা স্টোর্স’ স্টেশনারি কাম জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার্স। ইচ্ছে না থাকলেও প্লাস্টিক বিক্রি হয় তার দোকানে। কোম্পানির নানা অফার তাকে আরো বেশি করে বাধ্য করে প্লাস্টিক বিক্রি করতে। হারপিকের সঙ্গে প্লাস্টিকের মগ ফ্রি। চায়ের সঙ্গে জার। খদ্দেররা পলিব্যাগে ছাড়া জিনিস নিতে চায় না। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি ব্যথিত করে গল্পকথক অনন্তকেও।

       অনন্তের বাড়িতে পেঁচুরাম নামে একটি বিড়াল আছে। টিয়া আছে একটি, তার নাম বুটি। বাড়ির পিছনের মস্ত বড় পুকুরটা আস্তে আস্তে মরে গেছে। তাই এই বিড়াল ও টিয়াকে খেতে দিলে জল ছাড়া ঘর হারানো বক আসে ভাত খেতে। অনন্তের স্বপ্নেও সেই বক সাদা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে কথা বলে। দোলামোচড়া, পলিব্যাগ উড়ে আসে তার মশারির কাছে।  সেই পলিব্যাগও কথা বলে–‘এখন কোথায় যাই বলতে পারেন? ছাইমাখা পলিপ্যাগ কে নেবে!… এমনি কাগজের ঠোঙ্গা পচে। শালপাতা পচে। মাটিতে মিশে যায়। আমরা তো সহজে পচি না। আমরা এবার কোথায় যাব অনন্তবাবু?’ তখন অনন্তর মনে পড়ে সন্ধ্যা বেলা তার দোকানে আসা রোগা ফর্সা মেয়েটা পলিব্যাগে ঝাটা দিতে বলেছিল। তাই তার ভাবনা হয়—‘এত পলিব্যাগ যাইব কোথায়?’

সে ঘুমের মধ্যে দ্যাখে—‘বিশাল একটা জল আর জলের বুকে শালুক, পদ্মের বদলে লাল নীল সবুজ সাদা অনেক অনেক পলিপ্যাক। মরা মাছ কিংবা কচ্ছপের পিঠ হয়ে তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে বুঝি। কেউ বা চুপসে মিশে আছে জলের সঙ্গে। সেই সব রঙ চটে যাওয়া পলিব্যাগের গায়ে ভিতু চাঁদের আলো। দু-এক ফোঁটা দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির কান্না।’ গোটা জলাভূমি ঢেকে আছে নানান রঙের পলিব্যাগে। তাদের বাড়িতে ভাত খেতে আসা বাসা হারানো বকটি গম্ভীর মুখে বসে জলের পাড়ে।

গল্পের বর্ণনায়—‘আমি প্রতি রজনীতে ক্রৌঞ্চদ্বীপে উড়িয়া যাই ও প্রভাত সূর্য উদিত হইবার পূর্বেই ফিরিয়া আসি। কারণ আমার প্রতি শাপ আছে, শহরে-নগরে, মনুষ্যের কাছাকাছি থাকিবার ফলে যে ক্লেদচিহ্ন জমিয়াছে আমার সর্ব শরীর ঘিরিয়া, তাহা ক্রৌঞ্চদ্বীপের রমণীয় ঊষাকাল দেখিবার উপযুক্ত নহে। ক্রৌঞ্চদ্বীপের প্রথম আলো দেখিলেই আমি পূর্বোক্ত শাপে ভস্মীভূত হইব। কিন্তু হে মৃত ও অর্ধমৃত পলিব্যাগ সকল—তোমাদের এই ক্লেদ তো আমি ক্রৌঞ্চদ্বীপে বহন করিয়া লইয়া যাইতে পারিব না। হায়! তোমাদিগের কী হইবে–বলতে বলতে বক বড় করে শ্বাস ফেলল।’

ঘুমের মধ্যে অনন্ত শোনে—‘শুধু পেট ফোলা বা চুপসে যাওয়া বাতিল পলিব্যাগেরাই নয়, গোটা জল, যার ওপর জমেছে রঙিন সাদা পলিব্যাগের সারি—বাঁচাও বাঁচাও বলে কেঁদে উঠছে। অনন্ত অনেক চেষ্টা করেও আশেপাশে বকটিকে আর খুঁজে পেল না। জল শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল।’ অনেকদিন আগে লেখা হলেও এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না এর একাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়, তাই ক্রমশ তা বর্জ্য হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়ের বুকে। আর তা থেকেই ছড়াচ্ছে দূষণ। পলিমার সামগ্রী পুড়িয়ে ফেললে আরো বিপদ হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে দূষণের মাত্রা। প্রতিবছর ভারতে ৫৬ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়। এর মধ্যে রাজধানী দিল্লি প্রতিদিন ৯,৬০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন করে। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কঠোর কোনো আইন ভারতে নেই। এই প্লাস্টিক নগরী থেকে বাঁচার উপায়ও যেন আমাদের হাতে নেই। লেখক এই গল্পের মধ্যেদিয়ে পাঠককে প্লাস্টিক ব্যবহার বিষয়ে সচেতন করতে চেয়েছেন এবং সমাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন প্লাস্টিক মুক্ত সমাজ হিসেবে।

       গাছ মানুষের সব থেকে পরম উপকারী বন্ধু। কিন্তু এই গাছদের মধ্যেও রয়েছে মানব তথা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভয়ংকর শত্রু। চিকিৎসক ও পরিবেশবিদদের মতে প্রকৃতি ও মানবের ক্ষতিকারক গাছের মধ্যে অন্যতম হল পার্থেনিয়াম গাছ। বিশেষ করে যখন ফুল ফোটে তখন পার্থেনিয়াম গাছ মানুষ ও গবাদি পশুর জন্য হয়ে ওঠে মারাত্মক ক্ষতিকর। এমনকি কৃষি জমিতে যদি পার্থেনিয়াম গাছ বেড়ে ওঠে তবে সেই জমিতে ফসলের গুণগত মান ও পরিমান কমতে থাকে। পার্থেনিয়াম রেনু বাতাসে মিশে ধান, ছোলা, সর্ষে, গম, টমেটো, লঙ্কা ও বেগুন গাছে ব্যাপক ক্ষতি করে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন পার্থেনিয়াম মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকারক এই ফুলের রেনু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে পৌঁছাতে পারে যা থেকে জন্ম নিতে পারে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ, এলার্জি হাঁপানির মতো রোগ। গল্পকার কিন্নর রায় এই পার্থেনিয়ামের ফলে মানব ও প্রকৃতির কত ভয়ংকর ক্ষতি হতে পারে সেই চিত্র তুলে ধরেছেন ‘একা গাছ’(১৯৯৬) গল্পের আখ্যানে। গল্পে শান্তিপ্রিয় ও তার ছেলে সন্দীপের কথোপকথনে উঠে এসেছে পার্থেনিয়ামের ক্ষতিকর সব কুফলের কথা। সন্দীপের ভাবনায় উঠে এসেছে সেই সব ক্ষতিকর প্রভাবের চিত্র— ‘আমায় শুঁয়োয় কিন্তু হাত চুলকাতে পারে। চুলকোয়ও। আমার ডাঁটার কষ থেকে বিশ্রী ঘা পর্যন্ত হতে পারে চামড়ায়। এমনকি স্কিন ক্যান্সারও। আমার গা ছোঁয়া বাতাস উড়ে যাওয়া ফুলের বীজ থেকে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট। বলতে বলতে পার্থেনিয়াম গাছটি আবারও নেতিয়ে পড়ল।’ গাছের এই ভয়ঙ্কর ক্ষতির কথা জানার পরেও কিছু মানুষ সচেতন হতে পারছে না‌ তাইতো বিকাশবাবু বলছেন—‘কত দেখেছি পার্থেনিয়াম সল্টলেকে। কি হয়েছে তাতে! ওতে কিছুই হয় না।’ এই যে সচেতনতার অভাব যার মাশুল গুনতে হচ্ছে মানব সমাজকেই। কারণ আমাদের সমাজ নোংরা রাজনীতিতে আক্রান্ত ভোট আসছে, সরকার পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু আমাদের সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য কোন কাজ হচ্ছে না বললেই চলে। নেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ভাবনা, নেই পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা। তাই সন্দীপ আক্ষেপ করে বলছে—‘আমাদের এখানে ভালো রাস্তা নেই। ড্রেনের মুখ খোলা। পুকুর বুজিয়ে বাড়ি হচ্ছে। খেলার মাঠ সব ভর্তি হয়ে যাচ্ছে ঘর-বাড়িতে। ছড়িয়ে পড়ছে পার্থেনিয়াম।’ এভাবেই দূষনে ভরে যাচ্ছে সর্বত্র। দূষণমুক্ত করে কলকাতার বাতাসকে স্বচ্ছ স্বাভাবিক এবং মানুষের উপকারী এবং উপযোগী করে তোলার স্বপ্ন দেখেছে সন্দীপ—‘আমরা কি পারব সব পার্থেনিয়াম উপড়ে কদমতলার বাতাসকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে।’ আমরা চেষ্টা করলে যে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে দূষণমুক্ত সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি লেখক কিন্নর রায় সেই বার্তাই আমাদের দিয়েছেন ‘একা গাছ’ গল্পটির আখ্যানে।

         কিন্নর রায়ের ‘মহাজাগতিক’ (১৪০৫) গল্পটি তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের ব্যতিক্রমী সংযোজন। তিনি পরিবেশ ব্যাখ্যায় সমসাময়িক ইতিহাসকে বিষয় করে নিয়েছেন। দেখিয়েছেন উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশের বিরোধ। কাহিনি উপস্থাপনে দুটি প্রধান চরিত্র দেখা যায় শালিক পাখি, যিনি পূর্বজন্মে পাটলিপুত্রের ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠ সাগর দত্ত, তিনি বিপুল অর্থ সাহায্য করেছিলেন রাষ্ট্রসম্রাটকে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের গবেষণায়। দ্বিতীয় চরিত্র— মেঘ, যিনি পূর্ব জন্মে ছিলেন কবি বসুবন্ধু। তিনি সবসময় মনে করতেন ‘যুদ্ধ আসলে পাপ’; গল্পের পরিণতিতে দেখা যায় বিপন্ন পৃথিবীর জন্য রাষ্ট্রপ্রতিনিধি সগর দত্তের দুই অনুতপ্ত হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ। গল্পের প্রধান বিষয় যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। পারমাণবিক বিস্ফোরণের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্তি দান। বৃহত্তর অর্থে শুধু পারমাণবিক অস্ত্রই নয়, যে কোনো পরমাণু কর্মসূচী বিরোধী জনমত গঠন করা। এসেছে পরিবেশবাদী জৈনধর্মের বিভিন্ন ধরনের কর্মপ্রণালীর কথা। গল্পের সূচনা—‘ঠহরিয়ে। ঠহর যাও… ছায়া নেই কোথাও, বাতাসে আগুন। ছ্যাঁকা দেওয়াার বাতাস গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছিল।’ এর পরই ১৯৭৪ সালের পরমাণু বিস্ফোরণের প্রসঙ্গ। ১৯৭৪ সালের ১৮ তম রাজস্থানের

      প্রত্যন্ত মরুপ্রান্তর পোখরানে ভারতের প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। যা “স্মাইলিং বুদ্ধ” নামে পরিচিত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরাগান্ধী। তিনি নীতিগত দিক থেকে পরমাণু বোমার বিরোধী হলেও শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর সমর্থন করেন। চব্বিশ বছর পর আবার এগারোই মে’ অর্থাৎ পোখরান ২। ১৯৯৮ সালে ১১ই মে তারিখে রাজস্থানের পোখরানে সফলভাবে পরমাণু বোমার পরীক্ষা করে ভারত। লক্ষ্য পাকিস্তান। পাকিস্তানকে সতর্ক করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন— এখনো পর্যন্ত আমাদের পরমাণুনীতি প্রথম ব্যবহার নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী ভবিষ্যৎ নীতিও বদলাতে পারে। গোটা দেশ সেদিন এই শক্তির প্রশংশায় জয় জয় করে উঠেছিল। প্রসঙ্গ অবতারণা করে গল্পকার বলেন—‘আকাশে কালো মেঘ ফিস ফিস করে বলে যাচ্ছিল, তিপ্পান্ন বছর আগে তাঁদের স্মরণে হিরোশিমায় বন্ধ করে দেওয়া হয় ঘড়ির কাঁটা। তারপর প্রার্থনা।’ অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের উপর লিটল বয় নামে নিউক্লিয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের উপর ফ্যাটম্যান নামে আরেকটি বোমা ফেলে। যার পরিণতি মানব সমাজ আজও ভোলেনি। কিন্নর রায়ের ভাষায়—‘কালোমেঘ ফিস ফিস করে বলেছিল, আমি হিরোশিমার মেঘ।-তিপ্পান্ন বছর ধরে আকাশে ঘুরছি। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখের জল বুকে বাঁধা। এবার সঙ্গে নিলাম চাঘাই আর পোখরানের মেঘদেরও। উড়ে বেড়াব, ভেসে বেড়াব। বিষ ছড়িয়ে দেব পৃথিবীতে। সভ্যতার বিষ।’

       এবার চাঘাই আর পোখরানের মেঘদের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা যাক। দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পালাবদল ঘটলেও উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখনো অপরিবর্তনীয়। কাশ্মীর হয়ে উঠেছে এক অমীমাংসীত অধ্যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির হাতে পড়ে কাশ্মীর ভেঙেছে, গড়েছে কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলতে থাকে। ১৯৪৯ সালের ২৯ জুলাই রাষ্ট্রসংঘের প্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা যুদ্ধবিরতির রেখা নির্ধারণ করেন। ফলে কাশ্মীর উপত্যকার একটা বড় অংশ ভারত ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হলেও পুঞ্চ, বালুচিস্তান, গিলগিট পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। এরপর পাকিস্তানের সঙ্গে নানা সন্ধি-চুক্তি ঘোষণা হলেও সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। সেই চুক্তিগুলি হল- ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর রাজা হরিসিং ও ভারত সরকারের চুক্তি, ১৯৪৯ সালের ২৯ জুলাই যুদ্ধবিরতির সীমারেখার চুক্তি, ১৯৫২ সালের নেহেরু ও শেখ আব্দুল্লার যৌথ ঘোষণা, ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও আয়ুব খানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি, ১৯৭২ সালে ইন্দিরাগান্ধি ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সিমলা চুক্তি, ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ আবদুল্লাহ Accord, ১৯৯৯ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ী ও নওয়াজ শরীফের লাহোর চুক্তি। আর এই পটভূমিতে দুই দেশ মিলে এগারোটি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায় পোখরান ও চাঘাই-এ। কিন্নর রায় গল্পের পরিণতিতে দেখিয়েছেন অস্ত্রশক্তির অভিশাপ কোনো গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। ফলে চাঘাই আর পোখরানের মেঘ নিজেদের ভিতর কোলাকুলি করছিল। তাদের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইছিল হিরোশিমার মেঘটিও। অর্থাৎ যে দেশই পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার করুক না কেন তার অভিশাপ পৃথিবীর সকল দেশকেই পোহাতে হবে। গল্পকার শেষে দেখিয়েছেন রাষ্ট্রশক্তির প্রতিভূ শালিক, শান্তি ও সমন্বয়ের প্রতীক মেঘের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। আর বলে–‘আমি এখন সাধনায় বসবো। অনশনে থাকব। যতক্ষণ না তেজস্ক্রিয় বালির বুকে আমার খয়েরি পালক, হলুদ ঠোঁট, হলুদ ঠ্যাঙ, শাদা হাড় সব আলাদা আলাদা করে ফুল হয়ে খসে পড়বে, একটি একটি করে ফুল, যেমন ঝরে যায় গাছ থেকে, ততক্ষণ।’ গোটা বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ দূষণ, নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল ১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোম শহরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিচালিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ১৯৯২ সালে জুন মাসে ব্রাজিলের রিওডি জেনোরোতে বসুন্ধরা শীর্ষ সম্মেলন। এর পরও একাধিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। রাষ্ট্রপ্রতিনিধিরা সেই সম্মেলনে তাদের গভীর চিন্তার ফসল পাঁচ পাতার প্রেস্ক্রিপশন পেশ করেন। কিন্তু তাদের পরিবেশবাদী ভাবনাচিন্তায় যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। তারা মনে করেন পরিবেশবাদী ভাবনায় যুদ্ধের প্রসঙ্গ অবান্তর। এ প্রসঙ্গে ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ ‘যুদ্ধের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে পরিবেশ চর্চা সম্ভব?’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন— “পরিবেশ আন্দোলনে যুদ্ধের কথা বলা যাবে না। যদি বলা না যায় তবে সে আন্দোলন বা উপলব্ধি আর যাইহোক, পরিবেশ নিয়ে হতে পারে না। আজকে পরিবেশ বিজ্ঞান, পরিবেশ শিক্ষার, পরিবেশ বিতর্কে সবার মাঝে যুদ্ধের আলোচনা শুরু করতে হবে। যুদ্ধের ভয়াবহতা গভীরভাবে বুঝতে হবে। পরিবেশের উপর তার বিধ্বংসী প্রভাব অন্তঃকরণ দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। নতুবা পরিবেশ আন্দোলন, পরিবেশ বিজ্ঞান, পরিবেশ চর্চা, এ সবেই মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে যাবে।”

      কথাসাহিত্যিক কিন্নর রায় এই মূল সমস্যাকে লক্ষ্য করে তাঁর পরিবেশ ভাবনায় ‘মহাজাগতিক’ গল্পটি রচনা করেন। আমাদের দেশের সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে একাধিকবার খণ্ডযুদ্ধ হয় ও হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলির যুদ্ধ, যুদ্ধের সম্ভাবনা ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব সম্পর্কে এ গল্প সচেতনতার বার্তা দেয়। সে দিক থেকে ‘মহাজাগতিক’ গল্পটি পরিবেশবাদী ভাবনার নবতম সংযোজন। আর গল্পের মূল বিষয় হয়ে উঠে— যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।

        কিন্নর রায়ের একটি অন্য ধারার গল্প ‘আজান গাছ’(১৯৯৯) লৌকিক এবং অলৌকিকতায় বিভ্রম এবং স্বপ্নের ঘোরে গল্পটি আবর্তিত হয়েছে। গল্পে দেখি গাছ, শালিক, দোয়েল, নদী, ঘোড়া সব কথা বলে। আর এইসব কথার মধ্যেদিয়েই উঠে আসে পরিবেশের কথা, পরিবেশের নানা সমস্যার কথা। গল্পে দেখি পুরোনো আজান-গাছ নামে পরিচিত গাছটি আর নেই। নবু শেখ গাছটি আর দেখতে পায় না। ভাবে গাছটি উড়ে গেছে—‘কিন্তু দেখতে পায় না গাছকে। আজান গাছ কত দিন যে মুছে গেছে।’ এভাবেই বহু গাছ হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দু’বছর আগে যেখানে গাছ ছিল আজ সেখানে বহুতল বাড়ি বা শপিংমল, টাউনশিপ গড়ে উঠেছে। তারই পরিণতিতে আজকের এই পৃথিবী তাপপ্রবাহের পরিমাণ এত বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গাছ হারিয়ে যাওয়ায় মাটির যে বাঁধন তা বিঘ্নিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে নদীর পাড় ভাঙ্গনের দৃশ্য। মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে লেখা এই গল্পে বিশেষভাবে এসেছে নদী ভাঙ্গনের কথা। পদ্মা প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসছে। তাই লেখক বলেছেন—‘পদ্মা এগিয়ে আসছে। একটু একটু করে মাটি ঢুকে যাচ্ছে নদীর বুকে। রোজ রোজ এগোয় নদী। মাটিতে দাঁত বসায়।’ আর এই নদীর পাড়ের প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ এলাকায় আজান-গাছ নামে পরিচিত গাছকেও খেয়ে ফেলেছে। এই নদীর জলে ধুয়ে গেছে আজান গাছের গল্প কাহিনি। গাছ কমেছে বন্যা বেড়েছে। আর বন্যার জলে ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। মানুষ প্রকৃতিকে যেমন আঘাত করেছে প্রকৃতিও তেমনি তার প্রতিঘাত ফিরিয়ে দিচ্ছে। বহরমপুর, জিয়াগঞ্জ ভাসিয়ে দিয়ে পদ্মা মিশে যাচ্ছে গঙ্গায় এই আশঙ্কায় লেখক আতঙ্কিত হয়েছে গল্পের আখ্যানে।

গল্পে লেখক দেখিয়েছেন বাঁধ রক্ষার মধ্যেদিয়ে পরিবেশ রক্ষা করার চিত্র। গল্পে বুড়ো মকবুল হোসেন সত্তর পেরিয়ে গিয়েও গায়ের তাগোদ আর মনের জোর দিয়ে বাঁধকে রক্ষা করেছেন। ভাদ্র মাসের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টির ভেতর সে সবাইকে চিৎকার করে ডেকেছে—‘বাঁধ বাঁচাও। বাঁধ বাঁচাও।’ কারণ তিনি জানতেন এই বাঁধের উপরেই তাদের জীবন নির্ভর করছে। বাঁধ বাঁচাতে না পারলে তাদের জীবনও সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়াবে। তাই তাদের বলতে শুনি—‘আমরা তো ইঁদুর। জল বাড়লেই ভাসবো। ইঁদুর ভাসলেই বা কি! থাকলেই বা কি?’ কারণ নোংরা  রাজনীতিতে এখন গ্রাম বা শহর আক্রান্ত। যে বাঁধ নির্মাণের জন্য টাকা আসে সেই টাকা চলে যায় নেতাদের পকেটে। প্রকৃতি ও পরিবেশও নোংরা রাজনীতির শিকার। তাই শহর জুড়ে জলাভূমি বুঝিয়ে তৈরি হচ্ছে বহুতল বাড়ি, শপিংমল ও টাউনশিপ।

     গল্পের আখ্যানে পরিবেশের আরো একটি গভীর সংকটের চিত্র চিত্রায়িত হয়েছে। অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাবার যোগান করতে গিয়ে ফসলে কীটনাশকের ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই কীটনাশক পোকা-মাকড় মেরে দিচ্ছে। দোয়েল মাটিতে খাবার খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু পোকা নয় ব্যাঙ, সাপ সব নিকেশ হয়ে যাচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহারের ভয়ংকর চিত্র আমরা কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘ফুল ছোঁয়ানো’ গল্পেও দেখতে পাই। গল্পে গল্পকারকে বলতে শুনি—“ফুলি ফুলি আঙুল ছোঁয়াতি হয়। এখানে ড্যাঙ্গা জমিতে এখন পটল চাষ চলিতেছে। পটলের ফুল এল। এখন তো আর অত প্রজাপতি টজাপতি নেই পোকা মারার বিষে সব শেষ।” এই কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পোকামাকড় সাপ ব্যাঙ হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সার্বিকভাবে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বিনষ্ট হওয়ার চিত্র লেখক ‘আজান গাছ’ গল্পেও তুলে এনে পাঠককে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন।

    একটি প্রাচীন বৃক্ষকে নিয়ে লেখক কিন্নর রায়  স্মৃতিচারণা করেছেন ‘অচিন তলা’(১৯৯৯) গল্পটিতে। গল্পের শুরুতেই লেখক বলেছেন—‘বহরমপুর থেকে তা হবে পঞ্চাশ কিলোমিটার। সেখানে ডোমকলের বাটিকামারি মৌজা। সেই মৌজার ২০৯ নম্বর দাগের ৯৯ শতক জমিতে ডাল পাতা ছড়িয়ে রোদ্দুর বাতাস ক্লোরোফিল নিজের গভীরে শুষে নিতে নিতে অচিন বৃক্ষ দাঁড়িয়ে। সেই যে আদি মা-গাছটি, তাকে বোধহয় এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’ এখন আর আমাদের চারপাশে চোখ রাখলেন অনেক পুরনো আদি গাছের দেখা মেলে না। অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমফান, ফনীর মতো সাইক্লোন যেমন পুরনো গাছগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তেমনি আবার মানবজাতির তীব্র লোভ লালসা এবং প্রকৃতির উপর আগ্রাসনে হারিয়ে গেছে এইসব আদিবৃক্ষগুলি। সেই যে প্রাচীন গাছ তার নাম অচিন গাছ। সেই গাছের নিচে অচিন তলা। সারাদিন সেখানে তাস খেলার শব্দে মুখর। এই গাছকে ঘিরে কত শত কিস্যা। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে আলাদা আলাদা গল্প প্রচারিত এই গাছটিকে ঘিরে। এই গাছ এখন মানবের আগ্রাসনের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। কাঁটা পড়বে। তার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে কত শত কিস্যা। এই অচিন বৃক্ষকে বাঁচানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক যুগল কুন্ডু। ‘অচিন বৃক্ষ বাঁচাও কমিটি’ নামে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির কথা কাগজে ছাপা হয়েছে। যুগল রাতে স্বপ্ন দেখে- কালো কালো অনেকগুলো লোক দা-কুড়ুল হাতে হই-হই, রই রই করে ছুটে আসছে। অচিন তলায় হামলা করবে তারা। কারা হামলা করবে অচিনতলায়। কারা কেটে নেবে গাছ। ভাবতে ভাবতে যুগল বাইরে যায়। তার ভাবনা গুলিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আবার স্বপ্নের লেজটা খুঁজে পায়— ‘চুল খোলা একটি মেয়ে, তার পরনের শাড়িটা শাদা, পিঠের ওপর চুল ফেলে দুহাতে জড়িয়ে রেখেছে অচিন গাছেদের কোন একজনকে। মেয়েটির দুহাতের বেরের মধ্যে সেই গাছ। দা-কুড়ুল নিয়ে হই হই করে ছুটে আসা লোকেরা এবার ধীরে ধীরে পিছোচ্ছে পিছোচ্ছে…।’ লেখক এই যে গাছ কাঁটা রুখে দেওয়ার কাহিনি বর্ণনা করেছেন তার মধ্যেদিয়ে পাঠকদের বোঝাতে চেয়েছেন মানবজাতিই পারে এই গাছ কাঁটা রুখে দিতে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় চিপকো আন্দোলনের কথা। স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে—“রাজস্থানের বন শহীদদের কথা। চুনাপাথর গলানোর জ্বালানির জন্য রাজ কাঠুরেরা এসেছিল খেজুরির জঙ্গলে। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ১১ই সেপ্টেম্বর সেদিন বিশনোই  গ্রামের মানুষরা নিজের সন্তানসম বৃক্ষদের জড়িয়ে ধরেছিল কাঠুরিয়াদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। ৩৬৩ জন মানুষ সেদিন প্রাণ দিয়েছিল। আজ থেকে ৩০০ বছর আগে। কিন্তু আজও আমরা নির্বিচারে বন ধ্বংস করছি। উল্লেখ্য ২০১০ থেকে ওই দিনটি জাতীয় বন-শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।” এই গল্পের আখ্যান পাঠ করতে করতে মনে পড়ে যায় ভগীরথ মিশ্রের ‘মধুবনের বন্ধুরা’ উপন্যাসের সাধারণ মানুষদের বন রক্ষা করার সেই উজ্জ্বল চিত্র। উপন্যাসে কাঠ কারবারী লোকেরা রাতের অন্ধকারে কাঠ কাঁটতে এসে দেখতে পায় গ্রামের মানুষ গোটা বনভূমি ঘিরে ধরেছে তাদের হাতে বর্ষা, লাঠি বল্লম। এভাবেই সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করে বনভূমি রক্ষা করার স্বপ্ন দেখেছেন লেখক কিন্নর রায় তাঁর ‘অচিন তলা’ গল্পটির আখ্যানে।

     আমরা দেখি কিন্নর রায় তাঁর বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস গুলির মধ্যে ভয়ানক পরিবেশ দূষণের চিত্র যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তা থেকে উত্তরণের পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন তাঁর লেখায়। লেখক ‘অনন্তের পাখি’, ‘একা গাছ’, ‘মহাজাগতিক’, ‘আজান গাছ’, ‘অচিন তলা’ গল্পগুলিতে প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার চিত্র যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি মানুষকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়ে সচেতনও করেছেন। তেমনি এই গল্পগুলিতে কীভাবে আমরা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পশুপাখি ও বনভূমি বাঁচিয়ে রাখতে পারি সেই দিকটির প্রতিও আমাদের সচেতন করেছেন লেখক। তাই বর্তমানের এই বিশ্বউয়ায়নের দিনে লেখকের পরিবেশ ভাবনাকেন্দ্রিক গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যের আকাশে এক নতুন পথের দিশা দেখাবে বলেই আমার মনে হয়। সেই সঙ্গে এই গল্প পাঠ করে সাধারণ পাঠক পরিবেশের দূষণ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হবে তেমনি তা থেকে উত্তরণের প্রতি যত্নশীল হবে বলেও আমার বিশ্বাস। ‘Ecocriticism’ সাহিত্যচর্চা পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতার দাবি করে, কিন্নর রায়ের গল্পগুলি সেই দাবি পূরণ করতে সম্পূর্ণভাবে সমর্থ হয়েছে।

তথ্যসূত্র:

১. Glotfelty, Cheryll and fromm Harold (eds), ‘The Eco-criticism Reader: Land- marks in Literary Ecology’, University of Georgia, 1996, P.XVII

২. দোলা, দেবনাথ সম্পাদিত : ‘সাহিত্য বিচারে পরিবেশকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, মিত্রম্, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি, ২০১৩, কলকাতা, পৃ. ৭০

৩.http://samay. Indiatimes.com

৪. চক্রবর্তী, স্বপ্নময়: শ্রেষ্ঠ গল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা পুস্তক মেলা ২০০৩, পুনমুদ্রন: জুন ২০১৭, কলকাতা-৭৩, পৃ-২৫৬

৫. রায়, রাহুল: অমৃতা দেবীর স্মরণে, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৮ আগস্ট ২০১০

আকর গ্রন্থ:

১.রায়, কিন্নর: সেরা ৫০ টি গল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১১, কলকাতা-৭৩২.রায়, কিন্নর: শ্রেষ্ঠ গল্প, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: কলকাতা পুস্তক মেলা জানুয়ারি ২০০৩, কলকাতা-৭৩

পরিবেশকেন্দ্রিক ভাবনায় মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের ছোটগল্প ‘জাদুনগরী’

বর্তমান পৃথিবীর সবথেকে বড় সমস্যা পরিবেশ দূষণ এবং রাষ্ট্রনায়কদের সবথেকে বড় চিন্তার বিষয় এই দূষণ কীভাবে হ্রাস করা যায়। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি ঘেরা উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ও পরিবেশও যখন দূষণের কড়াল গ্রাসে আক্রান্ত তখন উত্তরবঙ্গের বুকে বসে একজন মননশীল লেখক যে পরিবেশ নিয়ে ভাবিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। তাইতো সাহিত্যিক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য প্রকৃতি ও পরিবেশের দূষণ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায় ১৯৭০ সালে ২রা  আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তারপর স্কুল জীবন অতিবাহিত করে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পেশায় একজন সরকারি চাকরিজীবী হলেও লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর বরাবর। ২০০৬ সালে উত্তরবঙ্গ সাংবাদে প্রথম গল্প ‘উজান’ প্রকাশিত হয়। এরপর ‘দেশ’, ‘সানন্দা’, ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায় একে একে গল্প প্রকাশিত হতে থাকে। বর্তমানে তিনি উত্তরবঙ্গের একজন বিশিষ্ট লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পেরেছেন। জলপাইগুড়ি শহরে বসবাস করার দরুন ডুয়ার্সের অমলিন প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁর গল্পে বারবার হাতছানি দেয়। তাঁর গল্পের রন্ধে রন্ধে রয়েছে উত্তরের জলবায়ু প্রাকৃতিক পরিবেশ ও চা বাগান অধ্যুষিত মানুষের জীবন জীবিকার নিখুঁত জলছবি। এ বিষয়ে লেখক তাঁর ‘পঞ্চাশে 50’ গল্প গ্রন্থের মুখবন্ধে নিজেই জানিয়েছেন–“আমার গল্পে অবধারিত ভাবে ছায়া ফেলে তরাই ডুয়ার্সের অমলিন প্রকৃতি। আমার কাহিনির আরশিতে ধরা পড়ে পাহাড়ি জনপদের জলছবি।” উত্তরবঙ্গের পাহাড়, পর্বত এবং জঙ্গল সমস্ত কিছুর উপরেই আজ পড়েছে বিশ্বায়নের প্রভাব। তাইতো লাটাগুড়ির অর্ধেক জঙ্গল আজ অত্যাধুনিক রিসোর্টে পরিণত হয়েছে‌। পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে সেখানে মানবজাতি দূষণে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। আর উত্তরের চা বাগানগুলি আজ পিকনিকের সব থেকে জনপ্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে। যার ফলস্বরূপ মানবজাতি দূষণমুক্ত সুন্দর স্বাভাবিক পরিবেশে প্রকৃতির রূপ আস্বাদন করতে গিয়ে প্রকৃতির বুকে আঁচড় বসিয়ে দিয়ে ফিরে আসছে। প্রকৃতির কোলে ঘুরতে গিয়ে মানুষ তার ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্যাকেট, অপ্রয়োজনীয় জলের বোতল এবং নানা আবর্জনা ছুড়ে ফেলছে অনায়াসেই প্রকৃতির নির্মল বুকে। যার ফলে প্রকৃতি হারাচ্ছে তার রুপ লাবণ্য। উত্তরের প্রতিটি প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়ে সেই সব দৃশ্য লেখক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং প্রতিনিয়ত ব্যথিত হয়েছেন। তারই প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে লেখক ‘জাদুনগরী’ গল্পটি রচনা করেছেন। গল্পের মূলভাবনা প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে শুধু গ্রহণ করে যাওয়া নয় তাকেও কিছু ফিরিয়ে দেওয়া প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। সেই বর্ণনা দিতে দিতেই লেখক গল্পের কাহিনিতে পাঠককে করে তুলেছেন প্রকৃতিপ্রেমী এবং গল্পটি হয়ে উঠেছে ইকো-টেক্সট।

       ডক্টর মুখার্জি মেঘমুলুক চা বাগানে কর্মরত। এই যে চা বাগানের নাম মেঘমুলুক তার মধ্যদিয়েই লেখকের পরিবেশ সচেতনতার পরিচয় ফুটে ওঠে। উত্তরবঙ্গ বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ, প্রকৃতিতে দূষণমুক্ত বায়ু, যার ফলে এখানে বৃষ্টিপাতের অভাব নেই। মেঘ তৈরি হতে অসুবিধা হয় না, সেই দিকের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই মেঘমুলুক নামের মধ্যদিয়ে। বড় গাছ পাখিদের বাসস্থান, যা উত্তরবঙ্গে এখনো পর্যন্ত খুব বেশি অভাব নেই। তাই  মেঘমুলুক চা বাগানে পাখিদের প্রচণ্ড কলরব শোনা যায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই– ‘…আলোর চাইতে অন্ধকারের ভাগ বেশি হচ্ছে ক্রমশ। কানে আসছে বিচিত্র সব পাখির ডাক। ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে ঘরে ফিরছে এক ঝাঁক টিয়া। তাদের কলরব যেন আকাশ ছাপিয়ে যাচ্ছে।’ ২০২০ সালে লেখা এই গল্পে লেখক পাখিদের কলরবের বর্ণনা করেছেন উত্তরের নির্মল প্রকৃতির মাঝে আর লেখক কিন্নর রায় ১৯৯০ সালে ‘প্রকৃতি পাঠ’ উপন্যাসে কলকাতায় বড় গাছের অভাবে পাখিদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন–“পাখি থাকবে কোথায়? বসবে যে, এমন উঁচু গাছ নেই। তাই মানুষ যত এগোচ্ছে, প্রকৃতি-সবুজ-পাখি তত পেছচ্ছে।”মানুষের উন্নয়নের সাথে সাথেই ফাঁকা জায়গায় তৈরি হচ্ছে বড় বড় অট্টালিকা, গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে রাস্তা, শপিংমল। ফলস্বরূপ পাখিরা হারাচ্ছে তাদের বাসস্থান। তাই ক্রমশ পৃথিবী থেকে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে বাস্তুতন্ত্রে, বিঘ্নিত হচ্ছে ইকোলজিকাল ব্যালেন্স। লেখক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য নদী, সবুজ, অরণ্যে ভরা প্রকৃতিতে বড় হয়ে উঠেছেন এবং প্রকৃতির কোলে বসেই সাহিত্য রচনা করে চলছেন অবিরত। তাই তিনি উত্তরের দূষণমুক্ত আকাশের সঙ্গে কলকাতার দূষিত বায়ুতে পরিপূর্ণ পরিবেশের আকাশের যে পার্থক্য তা অনুধাবন করতে পেরেছেন–‘এখানকার আকাশের সঙ্গে কলকাতার আকাশের কোন তুলনা হয় না। এদিকের আকাশ যেন একটু বেশিই নীল।’ দূষণ মুক্ত আকাশ স্বচ্ছ, তাই উওরে পরিস্কার নীল আকাশ দেখা যায়। অপরদিকে দিল্লী বা কলকাতায় দূষণ এতটাই বেশি বায়ুতে সর্বদা কুয়াশা নয় ধোঁয়াশায় পরিপূর্ণ থাকে, যার ফলে কলকাতায় স্বচ্ছ নীল আকাশের দেখা মেলে না, লেখক সেকথাই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন।

          মানবজাতি প্রকৃতি থেকে শুধু গ্রহণ করেই চলেছে প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেনি কোনদিন। তাইতো ডক্টর মুখার্জি মেঘমুলুক চা বাগানে কাজ করতে এসে প্রকৃতির কাছে যেমন অনেক কিছু পেয়েছে তেমনি কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করে এক অন্য ধরনের বাগান। মুখার্জিবাবুর বন্ধু উদ্ভিদবিজ্ঞানী রাধাকৃষ্ণণ তাকে একশো গাছের চারা পাঠায়। সেই চারা রোদ্দুররা তাদের কম্পাউন্ডে লাগায়। এই বাগান তৈরির মধ্যদিয়ে মুখার্জিবাবু প্রকৃতিকে তার পাওনা কিছুটা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন–‘…ডুয়ার্স আমাদের দিয়েছে অনেকখানি। আমরা এতদিন নিয়েছিই শুধু। এবার সময় এসেছে ঋণ শোধের। এবার আমাদের ডুয়ার্সকে কিছু ফেরত দেবার পালা।’ কিন্তু এই বাগানে যেসব গাছ লাগানো হয় সেই সব গাছ রোদ্দুর এবং তার মার একটাও পরিচিত গাছ ছিল না। তার বাবা বলেন এটাই তো সাসপেন্স একদিন এই বাগান হয়ে উঠবে জাদুনগরী।

        সেই জাদুনগরীর সাসপেন্স প্রকাশিত হয় পঁচিশ বছর পর। তখন রোদ্দুরের বাবা-মা দুজনই চলে গেছে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে, সেও এখন বিদেশে থাকে আর তার বন্ধু মুকুট বাবার পেশায় যুক্ত হয়েছে চা বাগানের ম্যানেজার হিসেবে। অনেক বাগান ঘুরে মুকুট এখন মেঘমুলুক চা বাগানের ম্যানেজার। এমন সময় ফেসবুকে মুকুট আর রোদ্দুরের আবার পরিচয় হয়। কথাসুত্রে মুকুট মুখার্জি বাবুর লাগানো গাছ যে আজ কত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা রোদ্দুরকে জানায়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য তার বাবার হাতে নির্মিত বাগান জাদুনগরী দেখার জন্য বন্ধুর আহ্বানে রোদ্দুর মেঘমুলুক চা বাগানে আবার ফিরে আসে। এসে জানতে পারে মুকুটের স্ত্রী উদ্ভিদবিদ্যা নিয়ে পড়ার দরুন এই স্থানীয় সকলের অজানা গাছের নামগুলো উদ্ধার করতে পেরেছে। পরবর্তীকালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের সহযোগিতায় এই বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ ও চিহ্নিত করনের সুবিধা হয়। জাদুনগরীতে গুরমার, জিঙ্গাবাইলোবা, টাক্কর, কৃষ্ণবট প্রভূতি গাছ রয়েছে। এই গাছগুলি সাধারণ গাছ নয়। এই গাছগুলি শুধু অক্সিজেন দেয় তাই নয়, এগুলোর রয়েছে আরো অসাধারণ সব গুণ। এপ্রসঙ্গে সাহিত্যিক কিন্নর রায়ের ‘প্রকৃতি পাঠ’ উপন্যাসের একটি কথা স্মরণ করা প্রয়োজন–“একটি গাছ মানুষকে পঞ্চাশ বছরে যত অক্সিজেন দিয়ে যায়, এখনকার হিসেবে তার দাম পনের হাজার সাতশো টাকা। গাছ তো আরও কত কি দেয় মানুষকে-ছায়া, সবুজ, বৃষ্টি, কাব্য। এমনকি জীবনদায়ী ওষুধও।” মানুষের কড়াল গ্রাসে এইসব উপকারী গাছগুলি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন। কিন্তু গল্পের চরিত্র মুখার্জিবাবু একজন ডক্টর তাই তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন এই গাছগুলির গুরুত্ব, তাই নিজের হাতে নির্মাণ করলেন জাদুনগরীর মত অমূল্য এক বাগান।

           ডঃ মুখার্জি চরিত্রটি লেখক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য তাঁর নিজস্ব ভাবনা থেকে নির্মাণ করেছেন। মৃগাঙ্কবাবু ছোটবেলা থেকে উত্তরবঙ্গে বসবাস করেছেন তাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন এই উত্তরের বনভূমি হ্রাসের করুণ চিত্র। তিনি দেখেছেন প্রতিনিয়ত বনভূমি হ্রাস করে কীভাবে রিসোর্ট, রাস্তা এবং বাসস্থান গড়ে উঠছে। এই দৃশ্য তাঁকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি অনুভব করেছেন প্রকৃতি থেকে শুধু নিলেই হবে না ফিরিয়ে দিতে হবে জাদুনগরীর মত আরও অনেক অনেক মূল্যবান বাগান। যা প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা করবে তেমনি মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং জীবনদায়ী ওষুধের চাহিদা মেটাবে। লেখক তাই গল্পে মুখার্জি চরিত্রের পরিবেশ ভাবনা এবং পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা সকল পাঠকদের মধ্যে সঞ্চারিত করে পাঠকদের পরিবেশ ভাবনা সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন গল্প কাহিনিতে। পরিবেশবিদ্যাচর্চা সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা আশা করে, যা সমগ্র গল্প জুড়ে স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। তাই গল্পটি একটি সার্থক ইকো-টেক্সট হয়ে উঠেছে।

তথ্যসূত্র: 

১.ভট্টাচার্য, মৃগাঙ্ক : মুখবন্ধ, ‘পঞ্চাশে ৫০’, এখন ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি, অক্টোবর ২০২০, পৃ-৬

২.রায়, কিন্নর: প্রকৃতি পাঠ, দে’জ, দ্বিতীয় সংস্করণ: নভেম্বর ২০০২, কলকাতা-৭৩, পৃ-৯৬

৩.রায়, কিন্নর: প্রকৃতি পাঠ, দে’জ, দ্বিতীয় সংস্করণ: নভেম্বর ২০০২, কলকাতা-৭৩, পৃ-৫৩

আকর গ্রন্থ:

১.ভট্টাচার্য, মৃগাঙ্ক :‘পঞ্চাশে ৫০’, এখন ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি, অক্টোবর ২০২০, 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *