তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

ভরতচন্দ্র শিরোমণি (১৮০৪-১৮৭৮)

ভারতবিদ্যা চর্চায় যে সব কৃতি বাঙালী অবদান রেখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে উনিশ শতকের একদম শুরুতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্মৃতিশ্রাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিত ভরতচন্দ্র ভট্টাচার্য তৎকালীন ২৪-পরগনা জেলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম লাঙলবেরিয়ায়, ১৮০৪ সালে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছিলেন গ্রাম্য পাঠশালা ও চতুস্পাঠি তে। এরপর সদ্য স্থাপিত সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন ১৮২৪ সালে। ওই কলেজ থেকেই ১৮২৯ সালে তিনি কৃতি ছাত্র হিসাবে ‘শিরোমণি’ উপাধি প্রাপ্ত হন। তখন থেকেই তিনি ভরতচন্দ্র শিরোমনি নামে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। কলেজীয় শিক্ষা সমাপন করে তাঁর প্রথম প্রথাগত নিয়োগ ছিল হিন্দু ল পরীক্ষা কমিটির ‘পণ্ডিত’ এর পদে (১৮৩০-৩৭)। এরপর পরবর্তী দুই বছর তিনি বিহারের সারণ জেলায় জজ পণ্ডিতের পদে আসীন ছিলেন। এর পর শুরু হয় তাঁর মনন চর্চার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, কারণ ১৮৪০ সালে বিহার থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ১৮৪০ সালে এবং সেখানে তিনি দীর্ঘ একত্রিশ বছর স্বারসত্ত সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন।

   অতএব অন্যভাবে বলা যায় যে ওই সময় পর্বেই তিনি বিশেষভাবে ভারতবিদ্যা চর্চায় অবগাহন করেছিলেন। স্মৃতিশাস্ত্রের প্রায় সমগ্র পরিসরে তাঁর মননের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়েছিল। প্রবেশ করেছিলেন ধ্রুপদী জ্ঞানচর্চার গহনে। উপকৃত হয়েছিল তাঁর ছাত্র সম্প্রদায়। সমৃদ্ধ হয়েছিল পরবর্তী প্রজন্ম। মনে রাখতে হবে তার সময়ে তিনিই একমাত্র স্মৃতিশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে বঙ্গ দেশে গণ্য হতেন। স্মৃতি শাস্ত্র গ্রন্থগুলির চর্চা বৃদ্ধির উদ্দশ্যে তিনি বেশ কিছু স্মৃতি শাস্ত্র কে সাবলীল ও সহজবোধ্য করে রচনা করেছিলেন। প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের আর্থানুকুল্যে ‘জিমুতবাহনের দায়ভাগ’ গ্রন্থটি টিকা সহ দুখন্ডে প্রকাশ করেছিলেন।

   এরপর তিনি এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞে হাত দিয়েছিলেন প্রসন্ন ঠাকুরেরই আর্থিক আনুকূল্যে। তা ছিল ‘দত্তক শিরোমনি’ নামে স্মৃতি শাস্ত্রের বিশ্বকোষ তুল্য গ্রন্থটির সম্পাদনা করা। এই গ্রন্থটির বিশেষত্ব ছিল এই যে ভারতে দত্তক সংক্রান্ত আটটি গ্রন্থ প্রচলিত ছিল। যেমন, ১. দত্তক চন্দ্রিকা,২. দত্তক মীমাংসা, ৩. দত্তক নির্ণয়, ৪. দত্তক তিলক, ৫. দত্তক দর্পণ, ৬. দত্তক কৌমুদি, ৭. দত্তক ধীধিতি, ৮. দত্তক সিদ্ধান্ত মঞ্জুরি। এগুলির প্রত্যেকটির সার সংকলন করে সেগুলিকে বিষয়ানুগ বিন্যাস করে পর্ব প্রতি অধ্যায় শেষে স্মার্ত পণ্ডিতদের বক্তব্য আলোচনা করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজের মতামত বিশ্লেষণ করেছেন। দত্তক সংক্রান্ত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর এই বিশাল গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। এক কথায় এই মহা গ্রন্থটি বিশ্বকোষই বটে। বর্তমান কালের উত্তরাধিকার আইন সংক্রান্ত যুক্তি তর্কের ক্ষেত্রে আইনঞ্জ দের কাছে এটি বেদ তুল্য। এই গ্রন্থ প্রণয়নে তিনি তাঁর সমস্ত মেধা, ধৈর্য, শ্রম ব্যয় করেছিলেন, তার তুলনা হয়না। অথচ আমরা অনেকেই এই মহাগ্রন্থটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই। যেমনভাবে আমরা অভহিত নয় ভরত শিরোমণি সম্পর্কে। মজার ব্যপার হল অবহিত নয় বলেই ভরতচন্দ্রের বেশ কিছু বই আমাদের দেশে আর পাওয়া যায়না; বইগুলির একটি করে খন্ড ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। যেমন, বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে লিখিত একটি গ্রন্থ, ‘যোগ সংস্কার  ব্যবস্থা’ অগম সংহিতা। 

   পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের ব্যাপারেও তাঁর পরোক্ষ অবদান অনস্বীকার্য। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা বিবাহ প্রচলনের ব্যাপারে তাঁর অকুন্ঠ সমর্থন ছিল। তিনি নিজে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হওয়ায় বিদ্যাসাগর তথা বিধবা বিবাহের পক্ষে সওয়াল করা সহজ ছিল। তিনিও শাস্ত্র গ্রন্থগুলির সাহায্য নিয়ে যুক্তি তুলে ধরে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। সুতরাং একাজে বিদ্যাসাগরের মহৎ কীর্তির পাশে ভরতচন্দ্রের কিঞ্চিৎ অবদানকে অস্বীকার করা চলে না। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যের জীবনধারা ও পরিবেশের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে একজন স্মৃতিশাস্ত্রবিদ বাঙালী পণ্ডিত ভরতচন্দ্র শিরোমণি যে ভাবে বিধবা বিবাহের পক্ষে আন্দোলনের সমর্থনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, উদারতা, নৈতিকতা ও সাহসের দিক থেকে বিচার করলে, তার তুলনা বিরল। আবার দেখা যায় রাজা কলিকৃষ্ণ দেবের সভাপতিত্বে ‘সনাতন ধর্মরক্ষিনী’ সভা নামে একটি প্রস্থিষ্ঠান স্থাপিত হলে, সেই সভার আচার্যের দায়িত্ব ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ভরত শিরোমণি। এই সভার পক্ষ হতে ‘সনাতন ধর্মোপদেশিনী’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হত, যার সম্পাদনা করতেন তিনি। এখানেও তাঁর লেখনীতে সুধা বর্ষিত হোত। সেখানেও তিনি আমাদের দেশের বহু প্রাচীন গ্রন্থের উপর আলোকপাত করতেন এবং সেগুলিকে অবলম্বন করে অনেক মৌলিক লেখা তিনি লিখেছিলেন, যার বেশির ভাগই বর্তমানে অধরা, সামান্য কিছু বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত আছে। এই লেখনিগুলি তাঁর এবং তাঁর পূর্বের সময়কে বুঝতে এক অসামান্য উপাদান হিসেবে সহায়তা করে।

   জীবনের প্রান্ত সীমানায় তিনি যখন উপস্থিত, তখন তাঁর উপর কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি পরিচালনার দায়িত্ব ভার এসে পড়ে। সোসাইটির সভাপতি থাকাকালীন কর্তৃপক্ষ তাঁর উপর একটি গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিল। তা হল, এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বিবলিওথেকা ইন্ডিয়া গ্রন্থমালায় দাক্ষিণাত্যের পণ্ডিত হেমাদ্রী বিরচিত ‘চতুর্বর্গ চিন্তামনি’ গ্রন্থটিকে প্রকাশ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাঁচ খন্ডে বিভক্ত সেই গ্রন্থ পুরোপুরি শেষ করার পূর্বেই তার প্রয়াণ ঘটে ১৮৭৮ সালে। আমরা হারালাম উনিশ শতকের প্রথমার্ধের একজন শ্রেষ্ট বাঙালী পণ্ডিতকে। তবে দীর্ঘ জীবন ব্যাপী নিরলস ভারতবিদ্যা চর্চা সাধনার দ্বারা তিনি বঙ্গজাগরণে একজন অখ্যাত, অপরিচিত বিরল প্রতিভার সাধক হিসাবে অবদান রেখে গেছেন।

শিবচন্দ্র দেব

উনিশ শতকের সূচনালগ্নে বঙ্গীয় জাগরণের এক প্রাজ্ঞ, শিক্ষিত, বিনয়ী এবং শিষ্টপ্রকৃতির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন শিবচন্দ্র দেব। দুর্ভাগ্যবশত উনিশ শতকের আলোচনায় শিবচন্দ্রের নাম একরকম অপাংক্তেয় রয়ে গেছে। তার জন্ম ২০ জুলাই, ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে, হুগলি জেলার কোন্নগরে। অর্থাৎ তার আবির্ভাবের দ্বীশতবর্ষ অতিক্রান্ত। অতএব এই অবসরে উনিশ শতকের ভারতবিদ্যা চর্চায় শিবচন্দ্রের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে।   শিবচন্দ্র ছিলেন পিতা-মাতার কনিষ্ঠ সন্তান। গ্রামের পাঠশালাতেই তার  শিক্ষারম্ভ। তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ১৪ বছর বয়সেই তাঁর বাবা তাকে  কলকাতায় নিয়ে গিয়ে হিন্দু কলেজে ভর্তি করেছিলেন। এখানেই রচিত হয় তাঁর প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ভবিষ্যত জীবনের  প্রথম অধ্যায়। এখানেই একদিকে যেমন তিনি গণিত শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তির প্রমাণ দেন, তেমনি ডিরোজিওর শিক্ষাদীক্ষা ও চিন্তাধারায় তিনি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। হিন্দু কলেজে তিনি সাড়ে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এইসময় তিনি কেশব চন্দ্র সেনের পিতৃব্য হরিমোহন সেনের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ত্ব সূত্রে আবদ্ধ হন। এরপর দুই বন্ধু মিলে আরব্য উপন্যাস বাংলাতে অনুবাদ করেন। তিনি প্রাথমিক পর্বে সরকারী চাকুরীতে বেশ কিছু কাল অতিবাহিত করেন।১৮৬৩ সালে তিনি স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’  গ্রন্থে লিখেছেন, ” অপরাপর লোকের পক্ষে বিষয়কর্ম হইতে অবসৃত হওয়ার অর্থ সম্পূর্নরূপে বিশ্রামসুখ ভোগ করা। কিন্তু শিবচন্দ্র দেব মহাশয়ের পক্ষে তদ্বীপরিত ঘটিল। পেনশন লইয়া কোন্নগরে বাস করিয়াই তিনি স্বীয় বাসগ্রামের সর্ববিধ উন্নতিসাধনে মনোনিবেশ করিলেন।”   কর্মজীবনেও তিনি সমাজ উন্নয়ন এবং স্বদেশ হিতৈষনার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই মেদিনীপুরে একটি ব্রাহ্ম সমাজ স্থাপিত হয়েছিল।১৮৫২ সালে নিজ গ্রামের লোকজনদের একত্রিত করে ‘কোন্নগর হিতৈষনী সভা ‘ স্থাপন করেন। এর দুই বছর পরে তিনি সেখানে একটি ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর পাশাপাশি তিনি একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলের পুন:প্রবর্তন করেন।সেই সঙ্গে তিনি একটি সর্বসাধরনের জন্য একটি পুস্তকালয় প্রতিষ্ঠা করেন।     হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময় থেকেই শিবচন্দ্র স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য আন্তরিক ভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে স্ত্রীজাতির উন্নতি ব্যতিরেকে সমাজের সার্বিক বিকাশ কখনোই সম্ভব নয়। এই ভাবনা থেকেই তিনি নিজের বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৬০ সালে এক বালিকা বিদ্যালয়। এই বালিকা বিদ্যালয়টিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি শিবচন্দ্র তাঁর সমাজ কল্যাণকর কাজের স্বাক্ষর রেখেছেন কন্নোগরে হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা, রেল স্টেশন স্থাপন এবং ডাকঘর নির্মাণের মধ্যে দিয়ে।   জনহিতকর কর্মে নিয়োজিত থেকেও তিনি নিয়মিতভাবে সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছেন। শিবচন্দ্র তাঁর সাহিত্যকর্ম কে নিয়োজিত রেখেছিলেন সমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণসাধনায়। তাঁর সাহিত্যকীর্তি  খুব বেশি না হলেও স্ব -দেশ, স্ব-কাল ও সমকালীন সমাজের কল্যাণব্রতে তাঁর কলম ছিল নিরলস। এর মধ্যে শিশু পালন  এবং অধ্যাত্মবিজ্ঞান  বই দুটি খুব সমাদর লাভ করেছিলো। প্রথম বইটি শিশু বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়কে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন। শিশুরাই কিভাবে জাতির ভবিষ্যত কারিগর হয়ে উঠতে পারে সে সাধনার কথা তিনি ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয় বইটি অবশ্য কিঞ্চিত উচ্চমার্গিও। কি ভাবে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে মন – প্রাণ – আত্মার সামগ্রিক উন্নয়ন এবং উত্তরণ সম্ভব হয় সে বিষয়ের আলোচনা সেখানে অভিব্যক্ত হয়েছে। বই দুটির গুরুত্ব শুধু সেই সময়ের নিরিখেই নয়, আজও তার প্রাসঙ্গিকতা সমানভাবে বিদ্যমান। এর পাশাপাশি তিনি ব্রাহ্মদের প্রচারিত পত্রিকাগুলোতেও কলম ধরেছিলেন, যদিও তা খুব বেশি ছিল না। অর্থাৎ নবজাগরণের সেই ঊষালগ্নে শিবচন্দ্র কলকাতা থেকে দূরে মফস্বলে সামাজিক কাজকর্ম এবং লেখনী ধারণের মধ্যে দিয়ে বঙ্গদ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিলেন এবং এই কর্মদ্যোগের  দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল ভারতবিদ্যাচর্চা।   পরিশেষে বলা যায় যে শিবচন্দ্রের সর্বপ্রধান গৌরব হলো তাঁর নীতিনিষ্ঠা এবং সমগ্র জীবন অবিচল চিত্তে কর্তব্য সম্পাদনের মধ্যে দিয়ে মনুষ্য ধর্ম পালন। ভারতবিদ্যার মূল ভাব তো এটিই। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এমন অসাধারণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও শিবচন্দ্র ইতিহাসে তেমনভাবে জায়গা করে নিতে পারেননি। তার একটা কারণ হতে পারে, নিজের সংগতির জোরে তিনি কলকাতার বাসিন্দা হয়ে সেখানকার বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারতেন, অনেক সময় নেতৃত্বও দিতে পারতেন। যদি তিনি তা করতেন তাহলে আপনা থেকেই তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় উঠে আসত। তা না করে তিনি নিজেকে প্রচারের আলোয় রেখে দিয়ে  স্বগ্রামের উন্নতিতে নিজের সমগ্র জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। আর তা করার মধ্যে দিয়ে তিনি মানবসেবা ও মনুষ্যধর্ম পালনের এক অসামান্য নজির রেখে গিয়েছেন। তাই মানুষের ইতিহাসে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন। 

গণিতজ্ঞ রাধানাথ শিকদার

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গদেশে গণিতশাস্ত্রকে অবলম্বন করে জটিল সমস্যার সমাধান করে ভারতবিদ্যাচর্চায় অন্য এক রকম অবদান রেখেছিলেন বিশিষ্ট পন্ডিত রাধানাথ শিকদার। তিনিই ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। গণিত শাস্ত্রের পাশাপাশি সাহিত্যের অঙ্গণে তাঁর অবাধ বিচরণ ভারতের বিজ্ঞান দর্শনে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছে, প্রকারান্তরে সমৃদ্ধ করেছে ভারত বিদ্যা চর্চা কে। যদিও তাঁর প্রধান কীর্তি মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা নিরূপণ করা। কিন্তু এর পাশাপাশি তাঁর আরও কীর্তি রয়েছে, যার অনেকটাই আমাদের অজানা।
   রাধানাথ শিকদার আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৮১৩ সালের ৫ অক্টবর, কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। পিতা তিতুরাম শিকদার ছিলেন সে যুগের যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ এবং আধুনিক শিক্ষা – দীক্ষা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই গুন তাঁর পুত্রের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ১৮২৪ সালে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। তিনি সেখানে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও কে। এখানে অধ্যায়নের সময় তিনি তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি মোট সাত বছর হিন্দু কলেজে ছিলেন। কলেজ জীবনে তাঁর সহপাঠী ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণা রঞ্জন মিত্রমজুমদার, হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়দের। অর্থাৎ এক অনির্বচনীয় বুধমন্ডলের সাহচার্যে তাঁর ছাত্রজীবন বিকশিত হয়েছিল।
   ছাত্রজীবনে সাহিত্য এবং গণিত দুটি বিষয়ে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ইংরেজী ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষাটা তিনি ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। কলেজে তাঁর গণিতের শিক্ষক জন টাইটলার তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক ক্লাসিকগুলির সংস্কৃত অনুবাদ কর্মে। যদিও রাধানাথ শুরু করেও তা শেষ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত গণিতই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর উৎকর্ষতা প্রকাশের প্রধান জায়গা। তিনি বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্য ও দর্শনকে মিলিয়ে এক অসামান্য মাত্রা দান করেছিলেন।আর সেটাই তাঁর ভারতবিদ্যাচর্চায় প্রতিফলিত হয়েছে।গণিত বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা এবং লেখালিখি ভারতের বিজ্ঞান ভাবনাকেই সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষায় নতুন ভোর এনেছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জ্যমিতির এমন একটি সম্পাদ্য সমাধান করে ফেলেছিলেন যা     ‘গ্লিনিংস ইন সায়েন্স’ পত্রিকায় ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ছিল সম্পূর্ণ ভাবে রাধানাথের নিজস্ব আবিষ্কার। ওই বছরই রাধানাথ কলেজের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ করে শোনান। তার শিরোনাম ছিল ‘, The cultivation of sciences is not more favourable to individual happiness, not more useful and honourable to nation, than that of political literature’ এবং তা Asiatic Journal and Monthly Miscellane’  জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
   তবে রাধানাথকে সবাই মনে রেখেছে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা পরিমাপের জন্য। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সে বিষয়কে তুলে ধরা যেতে পারে। ১৮০০ সালে ব্রিটিশদের অনুকরণে এদেশে স্থাপিত হয়েছিল জমি জরিপ বিভাগ। আর এর প্রকৃত কাজকর্ম শুরু হয়েছিল ১৮০২ সালে। এরপর ১৮২৭ সালে ওই সংস্থার সার্ভেয়ার জেনারেল পদে নিযুক্ত হয়ে জর্জ এভারেস্ট ভারতের ২৭টি স্থানে জরিপের কাজ সম্পন্ন করার জন্য ট্রিগণমিতি জানা কিছু দক্ষ তরুণের সন্ধান করছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের শিক্ষক ড. টাইটেলর সাহেব তাঁর প্রিয় ছাত্র রাধানাথের নাম সুপারিশ করেন। ১৯ বছরের রাধানাথ কলেজের পাঠে ছেদ টেনে সার্ভেয়ার জেনারেলের পদে যোগ দিলেন। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দেরাদুনে ‘computor’ পদ দিয়ে, যে পদে তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়। তিনি তাঁর সহজাত গাণিতিক প্রতিভার সাহায্যে কাজের উপযোগী ফরমুলা তৈরী করে জরিপ সংক্রান্ত যে কোন কাজের সঠিক সমাধান করতেন। এভারেস্টের মতো উন্নাসিক সার্ভেয়ার জেনারেল ১৮৩৮ সালে রাধানাথ সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ” … there are few in India wheather European or non native that can at all compete with him. Even in Europe these mathematical attainments would rank very high.” ১৮৫১ সালে রাধানাথের পদোন্নতি ঘটে ‘computor general’ হিসাবে।
   ইতিমধ্যে এভারেস্টের উত্তরসুরি এন্ড্রু ওয়াঘ সার্ভেয়ার জেনারেল হয়েছেন। ওয়াঘ সাহেব রাধানাথকে এমন এক গাণিতিক সূত্র বের করতে বললেন , যার দ্বারা ১০০ মাইল দূর থেকেও হিমালয়ের চূড়াগুলোর পরিমাপ পাওয়া সম্ভব হয়। নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ১৫০ মাইল দূরত্ব থেকে স্বপ্রবর্তিত এক্সরে সিস্টেম নামে এক বিশেষ পদ্ধতিতে হিমালয়ের ১৫ নং চূড়ার উচ্চতা নিরূপণ করলেন ২৯,০০২ ফুট। সময়টা ছিল এর ১৮৫৫। এরপর আরো কাছ থেকে সেই চূড়ার উচ্চতা মাপলেন ২৯.০২৯ ফুট।এটাই ছিল সঠিক পরিমাপ। পরে রাধানাথের দ্বারা উচ্চতা নিরূপিত শৃঙ্গটির নাম রাখা হয় এভারেস্ট শৃঙ্গ (এই শৃঙ্গটির একটি স্থানীয় তিব্বতী নাম ছিল ‘ চোমো লুংমা’)। কিন্ত উপেক্ষিত রয়ে গেলেন বাংলার আধুনিক গাণিতিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা পরিমাপকারী রাধানাথ শিকদার।
   আমরা আগেই জেনেছি, রাধানাথ কেবল গণিতেই সুপণ্ডিত ছিলেন না, তাঁর মধ্যে   বিরাজমান ছিল সাহিত্যিক সত্তা, যা বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রর হাত ধরে সুপ্রতিস্থিত হয়েছিল। যুগ্মভাবে একটি পত্রিকা শুরু করেন তাঁরা, নাম ছিল ‘মাসিক পত্রিকা’।  এই পত্রিকার গদ্য ছিলো সুললিত, তা মৌখিক বাংলা ঘেঁষা। সাধারণ পাঠকরা তো বটেই, মহিলারাও এই পত্রিকাটির যথেষ্ঠ সমাদর করতো। এখানে রাধানাথ ও অন্যান্যরা ঐতিহাসিক উপাখ্যানের মাধ্যমে নারী শিক্ষার পক্ষে এবং হিন্দু সমাজে যে কুসংস্কার ও রক্ষণশীল মনোভাবের বিপক্ষে কলম ধরেছিলেন। এগুলি উনিশ শতকের সমাজ সচেতনতার পক্ষে খুব কার্যকরী ছিল।এই পত্রিকার মাধ্যমে রাধানাথ গ্রীক ও সাহিত্যের চর্চা করতেন। এই পত্রিকার জন্যই তিনি প্লুটার্ক জেনোফোণের রচনা অনুসরণ করেই তিনি প্রবন্ধ ও গল্প রচনা করতে থাকেন। সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর রচনা ভারত বিদ্যা  চর্চাকে   সমৃদ্ধ  করেছিলো।
   ১৮৭০ সালে মাত্র ৫৭ বছরে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর প্রয়াণে ১৮৭০ সালের ২৩ মে ‘Hindu Patriot’ লিখেছিল  “…he was the first Bengali Youth to have learut the mathematics invented by Newton and Laplace and accomplished great things in science and obstronomy”। প্রচার বিমুখ, স্পষ্ট বক্তা, ঋজু মেরুদণ্ডের অধিকারী,  বিজ্ঞান ও সাহিত্য সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ রাধানাথ উপেক্ষিতই রয়ে গেছেন। উপেক্ষার শিকার শুধু ইংরেজ শাসকদের কাছেই ছিলেন না, বাঙালিদের কাছেও তিনি বিস্মৃতির অতলে চলে গেছেন। 

প্যারীচাঁদ মিত্র

উনিশ শতকের যে সব ব্যক্তিত্ব তাদের জীবন ব্যাপী সাধনা দেশ ও দশের মঙ্গলার্থে নিয়োজিত করেছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। আর প্যারিচাঁদের নাম বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ; ‘আলালী সাহিত্য’ পড়েন নি এমন বাঙালি বোধ হয় খুব কমই আছেন। বঙ্কিম প্যারীচাঁদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “যে ভাষা সকল বাঙালির বোধগম্য এবং সকল বাঙালি কর্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যবহার করিলেন এবং তিনিই প্রথম ইংরাজি ও সংস্কৃতের ভান্ডারে পূর্বগামী লেখকদিগের উচ্ছিস্থাবশেষের অনুসন্ধান না করিয়া স্বভাবের অনন্ত ভান্ডার হইতে আপনার রচনার উপদান সংগ্রহ করিলেন। এক ‘ আলালের ঘরের দুলাল ‘ নামক গ্রন্থে এই উভয় উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল। ‘ আলালের ঘরের দুলাল ‘ বাংলা ভাষায় চিরস্থায়ী ও চিরস্মরণীয় হইবে।” বঙ্কিমের উক্তি সত্যি প্রতিপন্ন হয়েছে।
  এই সূত্র ধরেই বলা যায় যে তিনিই প্রথম  দেখালেন সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে। তার জন্য সব সময় ইংরাজি বা সংস্কৃতের কাছে শরণাপন্ন হতে হয় না।  তিনিই প্রথম দেখালেন, যদি সাহিত্যের মাধ্যমেই বঙ্গদেশ চর্চা করতে হয় তবে বাংলাদেশের মানুষের কথা নিয়েই উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করতে হবে। সেই সাহিত্য কীর্তি স্বদেশবাসীকে নাড়া দিতে পারবে।সেই সাহিত্য কীর্তির মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের সবভাবগত বৈশিষ্ট প্রতিফলিত হয়। ভালো – মন্দ দিক গুলি সহজেই ধরা পড়ে। সঠিক পথ নির্দেশের উপায় নির্ণীত হয়। দেশ ও জাতির ভবিষ্যত গঠনে সহায়ক হয়।
   প্যারিচাঁদের পৈতৃক নিবাস হুগলী জেলার হারিপাল গ্রামে। পিতা – মাতার চতুর্থ সন্তান প্যারীচাঁদের জন্ম  অবশ্য কলকাতায় ১৮২৪সালের ২১ জুলাই। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী। বাল্য বয়সেই তিনি গুরুমহাশয়ের কাছে বাংলা এবং মুন্সীর কাছে ফারসি ভাষা রপ্ত করে ছিলেন। এর কিছুকাল পরে তিনি ইংরেজী ভাষাতেও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। হিন্দু কলেজে পড়ার সময় তিনি ডিরোজিওর শিষ্য ছিলেন। নিসন্ধেয়ে তার উপড় ডিরোজিওর প্রভাব পড়েছিল। ছাত্রাবস্থায় তিনি পুরস্কার ও বৃত্তি পেয়েছিলেন। একথা বলাই যেতে পারে যে  ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি বাংলা লেখালিখির মধ্যে দিয়ে ভারতবিদ্যা চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন।
    তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৮৩৬ সালে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরীর সাব লাইব্রেরিয়ান হিসাবে। দশ বছর পরেই তিনি লাইব্রেরিয়ান ও সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। লাইব্রেরির পুস্তকরাজির মধ্যে নিমজ্জিত থেকে তিনি তাঁর সমাজ ভাবনার রসদ সংগ্রহ করেছিলেন। ওই লাইব্রেরী থেকেঅবসর নিলেও তিনি কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অবৈতনিক সম্পাদক ও কিউ রেটরের দায়িত্বভার সামলেছিলেন। তিনি একাধিক পত্রপত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আর এই পত্রপত্রিকা গুলির মধ্যে প্রকাশিত তাঁর লেখনীর মধ্যে ভারতবিদ্যার অন্বেষণ ঘটেছিল। সেই সময় ইয়ং বেঙ্গলের অন্যতম সদস্য রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিকদের সঙ্গে ‘ ঞ্জানান্বেষণ’  ও ‘ স্পেক্টেটর ‘ পত্রিকার পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আরেক সুহৃদ রাধানাথ শিকদারকে সঙ্গে নিয়ে ‘ মাসিক পত্রিকা ‘ নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। এই পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘ আলালের ঘরের দুলাল ‘। এছাড়াও তিনি ‘ ইংলিশম্যান ‘ , ‘ ক্যালকাটা রিভিউ ‘, ‘ হিন্দু প্যাট্রিয়ট,’ ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া ‘ পত্রিকা গুলোতে নিয়মিত লিখতেন।
   আমরা সকলেই জানি প্যারীচাঁদ ‘ টেকচাঁদ ঠাকুর ‘ ছদ্মনামে সমাজের নানান বৈপরীত্য, বিসদৃশ, অসংলগ্ন বিষয় গুলিকে “আলালী” ভাষায় একাধিক রচনার মধ্যে তুলে ধরেছেন। তিনি উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের এক অনবদ্য চিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর সাহিত্য দর্পনে। সেই  দর্পনে প্রতিফলিত ” আপনার মুখ আপনি দেখ” বাঙালিকে সঠিক পথে পরিচালিত হবার দিশা দেখিয়েছিলেন।  চেয়েছিলেন জাতির জাগরণ, উত্তরণ, দৃষ্টির উন্মিলন। বাঙালি তরুণ সমাজ সমস্ত কৈবল্য, দুর্বলতা, গড্ডালিকাপ্রবাহ থেকে মুক্ত হয়ে জাতির মেরুদন্ড হয়ে বিরাজ করুক, এই ছিল তাঁর অভিপ্রায়। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে সেই আশাবাদ অভিব্যক্ত হয়েছে। এই ভাবেই তাঁর মানসলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল স্বপ্নের ভারত। তাঁর বিশ্বাস, উপলব্ধি, কল্পনার এবং বাস্তবতার দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয়েছিল ‘ মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায় ‘(১৮৫৯), ‘ রামারঞ্জিকা ‘(১৮৬০), ‘ গিতাঙ্কুর ‘(১৮৬১), ‘ ঈশ্বরের অস্তিত্ব ‘(১৮৬৫), ‘ আত্মার অবিনাশস্ত ‘(১৮৬৫), ‘ যৎকিঞ্চিৎ ‘(১৮৭১),’ অভেদী ‘(১৮৭১) উপন্যাসের মধ্যে। এ ছাড়াও তিনি রচনা করেছিলেন ‘ডেভিড হেয়ারের জীবন চরিত ‘(১৮৭৮), এবং নারী কল্যানমুখী উপন্যাস ‘ ‘আধ্যাত্মিকা ‘(১৮৮৬)।
  এর পাশাপাশি তিনি কিছু ইংরেজী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমালোচনায় তাঁর রচিত ‘The Zamindar and Ryots’ প্রবন্ধটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গরীব চাষীর রক্ষাকবচ হিসাবে তিনি পঞ্চায়েত ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছিলেন। কৃষি বিষয়ক আধুনিক জ্ঞান কৃষকদের মধ্যে প্রচারের জন্য এগ্রিকালচারাল সোসাইটির সদস্যপদে থাকাকালে একটি অনুবাদ কমিটি স্থাপন করেন। এই কমিটি কৃষি বিষয়ক রচনাগুলি প্রকাশ করেছিল। পুলিশী অত্যাচারের বিরূদ্ধেও তিনি সরব হয়েছিলেন।
  পাদ্রী জেমস্ লঙ তাঁকে ” ডিকেন্স অফ বেঙ্গল” বলে অভিহিত করেছিলেন। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্ধ্যপাধ্যায় তাঁকে দেশীয় ও ইউরোপীয় সমাজের মধ্যে যোগসূত্র রূপে বর্ননা করেছেন। সেই সময়কার বিখ্যাত পত্রিকা ‘ হিন্দু প্যাট্রিয়ট ‘ এ প্যারীচাঁদ সম্পর্কে প্রশস্তি করে লিখেছিল, “In him the country loses a literary veteran, a devoted worker, a distinguished author, a clever wit, an earnest patriot and an enthusiastic spiritual enquirer.” প্যারীচাঁদ সম্পর্কে এর থেকে যথার্থ মূল্যায়ন আর হতে পারে না। 

ভূদেব মুখোপাধ্যায়

এই ধারাবাহিক কলামে উনিশ শতকে বাঙালী ভারততত্ত্ববিদদের স্বপ্নের একটি রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এবার আলোচনা করা হবে এই স্বপ্নের আনুষঙ্গিক বাঙালীর ভারতবিদ্যাচর্চা। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন সে যুগের স্বপ্নদর্শীদের পথ প্রদর্শক। তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৮২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। পিতা বিশ্বনাথ তর্কভুষণ ছিলেন সেকালের এক খাতিমান পন্ডিত। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। আর তেরো বছরে ভর্তি হয়েছিলেন হিন্দু কলেজে সপ্তম শ্রেণীতে।। আর এইখানেই তার সাথে পরিচয় ঘটেছিল মধুসূদন দত্তের সাথে এবং সে পরিচয় পরবর্তী কালেও বজায় ছিল। 
   হিন্দু কলেজে একবার এক প্রতিযোগিতা হয়েছিল যে ইংরাজি ভাষায় স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লিখতে পারবে এমন দুই জন কে স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক দিয়ে  পুরষ্কৃত করা হবে। প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলেন মধু কবি এবং দ্বিতীয় পুরষ্কার লাভ করেছিলেন ভূদেব। কর্ম জীবনের প্রথম দিকে তিনি কলকাতা মাদ্রাসাতে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এরপর টানা ৩৫ বছর তিনি সরকারি শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজের কর্ম দক্ষতায় উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছিলেন। 
   এ ইউরোপীয় সাহিত্যে গদ্যকে বলা হয় যুক্তির ভাষা, যা বঙ্গ সাহিত্যে প্রায় বিরল। যে সামান্য সংখ্যক সেই কর্মসাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন ভূদেব তাদের মধ্যে অন্যতম। ভূদেব মুখোপাধ্যায় এর ভারতবিদ্যাচর্চায় অন্যতম অবদান ১৮৭৫  সালে প্রকাশিত ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’, যেখানে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মহারাষ্ট্রশক্তির বিজয়ী হলে ভারতবর্ষের পরবর্তী ইতিহাস কি রকম হতে পারত তারই এক কাল্পনিক চিত্রকল্প। এই গ্রন্থে তিনি মহারাষ্ট্রশক্তির নেতৃত্বে ভারতরাষ্ট্রের ঐক্য ও পুনরুত্থানের চিত্র এঁকেছেন। ভূদেব কল্পনা করেছেন যে শিবাজীর বংশধরের নেতৃত্বে পেশোয়ার পরিচালনায় ভারতবর্ষ সংঘবদ্ধ হয়ে এক ও অখণ্ড সাম্রাজ্যে পরিণত হতো। মারাঠাদের রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ভূদেবের ধারণা অবাস্তব সন্ধেহ নেই, কিন্তু, কিন্তু তাঁদের কার্যাবলীর বিবরণ ভূদেব যেভাবে দিয়েছেন সেভাবে না ঘটলেও ভূদেবর আঁকা ছবি নিঃসন্দেহে আদর্শনিষ্ঠ ও ভাববাদী – এক উচ্চতর হিন্দু সভ্যতার ভাবনা।
   ভূদেবের ভারতদর্শী কল্পনার ভারত শুধু হিন্দু ভারত নয়, মুসলমান সমাজকেও এই ঐক্যবোধের মধ্যে গ্রথিত করে দিয়েছেন। হিন্দু আচারের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা তাঁকে গোঁড়া ও ধর্মান্ধ করে তোলেনি, তাঁকে উদার ও পরমতসহিষ্ণু করেছে। প্রদেশে প্রদেশে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, প্রদেশ নির্বিশেষে হিন্দুর মধ্যে, এবং সর্বোপরি হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে যাতে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়, ভারতীয় প্রজাপুঞ্জের মধ্যে ভারতীয় ঐক্য বৃদ্ধি ও সংহতিবোধ যাতে সকলের মনে জাগ্রত হয় – সেই লক্ষ্যে তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। ভূদেব কল্পিত নতুন সাম্রাজ্যে ” একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন, ‘ যে রাম সেই রহিম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়’ …।”
   ভূদেব ছিলেন প্রাচীন ব্রাহ্মণ, তাঁর স্বপ্নের পিছনে ইতিহাসের চেয়ে বেশি কাজ করেছিল পুরাণ ও পৌরণিক উপকথা। অন্যদিকে ‘ পুষ্পাঞ্জলি ‘ (১৮৭৬) গ্রন্থের পরিচয় দিতে গিয়ে গ্যেটের দুটি ছত্রের ইংরেজী অনুবাদ মুদ্রিত হয়েছে – “Ordinary history is traditional, higher history mythical, and highest mystical.” এই উদ্ধৃতি দিয়ে ভূদেব বলতে চান যে, তিনি traditional history লিখতে আগ্রহী নন। তিনি ইতিহাসের mythical রূপকে অবলম্বন করে mystical রূপ আঁকতে বসেছেন। এই গ্রন্থে তিনি ভারতের তীর্থ ভ্রমণ উপলক্ষ্যে ভারতবোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। সেই সঙ্গে ভারতের হিন্দু সাধনার ইতিহাসও বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের আন্তর বাহ্যমূর্তি একদেহে প্রকট করে তোলা হয়েছে। সম্ভবত তিনিই বাংলা সাহিত্যে ভারতভূমিকে দেবী রূপে কল্পনা করেছেন। আবার বঙ্কিম প্রণীত ‘আনন্দমঠ ‘ এও দেবীমূর্তি ভারতবর্ষ। দুই গ্রন্থেই দেবীমূর্তির ব্যাখ্যাস্থলে মাতৃভূমির ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
   পরিশেষে বলা যায়, ভূদেব ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে ঘটনাদির বিচার করে সত্যিকারের ইতিহাস লেখেননি, তিনি লিখেছিলেন ঐতিহাসিক নীতিগত রূপক কাহিনী। এ কথা সত্য, যে ভূদেব কথিত নূতন হিন্দু সভ্যতার সবগুলি উপাদানই তিনি গ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন ভারতের সভ্যতা থেকে। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল গৌরোজ্জ্বল অতীত ভারতীয় সভ্যতার মর্মবাণী বর্তমান ও ভবিষ্যতের দৃষ্টি পথে তুলে ধরা। 

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়

পন্ডিত রাজেন্দ্রলাল  একদা লিখেছিলেন, “অধুনাতম বঙ্গীয় কবিবৃন্দের মধ্যে শ্রীযুক্ত রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় সর্বশ্রেষ্ট বলিয়া প্রসিদ্ধ অছেন।”  রঙ্গলাল এর জন্ম ১৮২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর মামার বাড়ি কালনার কাছে বাকুলিয়া গ্রামে। তিনি মামা বাড়িতেই প্রতিপালিত হন। তাঁর কলকাতার খিদিরপুরেও বাড়ি ছিল। গ্রামের স্কুলে পড়াশুনার পর  রামকমল ভাগ্নে রঙ্গলাল কে চুঁচুড়ায় মহসীন কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন।

১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে  বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক হিসাবে তাঁর সরকারি কর্মজীবনের শুরু। তারপর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নানা স্থানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৮৮২ সালে  তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এই হলো তাঁর পেশাগত জীবন। এই সময়ের মধ্যেই করে গেছেন তাঁর সাহিত্য ও কাব্য সাধনা।
বাঙলা সাহিত্যে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় এর  কথা আলোচনা করতে গেলে গুপ্ত কবি অর্থাৎ  ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এর কথা স্বাভাবিক ভাবেই এসে পরে। কারণ রঙ্গলাল ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র এর ভাব শিষ্য এবং তাঁর সম্পাদিত ‘ সংবাদ প্রভাকর ‘ পত্রিকাতেই রঙ্গলাল এর লেখালেখির সূত্রপাত। তথাপি কিন্তু রঙ্গলাল তেমন ভাবে ঈশ্বরচন্দ্র এর প্রভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন না।রঙ্গলাল পাশ্চাত্য কাব্যের আদর্শে বাঙলা কাব্য লক্ষ্মীকে নতুনভাবে শ্রীমন্ডিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে জাতীয়তাবাদী ওজস্বী কবিতা পরবর্তী সময়ে হেমচন্দ্র এবং নবীনচন্দ্রকে সমস্ত দেশে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল তার সূত্রপাত কিন্তু আসলে রঙ্গলাল এর হাত ধরেই। তিনি বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য থেকে আসল রস গ্রহণ করে দেশের মাটিতে দেশীয় রূপেই তাকে প্রস্ফুটিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর দেশপ্রেমের কবিতার অনবদ্য কয়েকটি লাইন:
“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
         কে বাঁচিতে চায়?
দ্বাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
          কে পরিবে পায়?
দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গসুখ তায় হে
              স্বর্গসুখ তায়।”
‘সংবাদ প্রভাকর ‘ পত্রিকার জন্য লিখতে গিয়ে তিনি নিজেও পত্রিকা সম্পাদনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা ‘ সংবাদ রস সাগর ‘। তারপর তিনি সম্পাদনা করেন ‘ এডুকেশন গেজেট ‘ ও ‘ সাপ্তাহিক বার্তাবহ ‘। অর্থাৎ পত্রিকা সম্পাদনেও
তিনি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছিলেন।
   তাঁর প্রথম গ্রন্থ ” ঋতু  সংহার” প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালে। ১৮৫২ তে প্রকাশিত হয় ‘ বাঙলা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ ‘ ,  এরপর হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি অবলম্বনে ‘ ডেক ও মুশিকের যুদ্ধ ‘ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৮ সালে। ঐ বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল রাজস্থানের ইতিহাস অবলম্বনে রচিত বিখ্যাত ‘ পদ্মিনী’ উপাখ্যান। ১৮৬০ সালে তিনি শরীর সম্পর্কিত একটি মূল্যবান গ্রন্থ ‘ শরীর সাধণী বিদ্যার গুণকীর্তন ‘ প্রণয়ন করেছিলেন। এরপর ১৮৬২ সালে রাজস্থানের সতী দের নিয়ে গবেষণাধর্মী বই ‘কর্মদেবী ‘ রচনা করেন। এই সব বই গুলি গুরুত্বের দিক দিয়ে অতীব মূল্যবান। তিনি কবি বলে শুধু কাব্য চর্চার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি দেশের এবং সর্বোপরি তার মানুষদের নিয়ে তিনি ভাবতেন। কোনো গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে সাহিত্যিক আঙ্গিকে চমৎকার ভাবে সেই বিষয়কে সকলের সন্মুখে তুলে ধরেছিলেন। তারা বুঝতে পারলেন, জানতে পারলেন, উপলব্ধি করতে পারলেন।

রঙ্গলাল এ সবের পাশাপাশি হাত দিয়েছিলেন অনুবাদ কর্মে। রেভারেন্ড লঙ সাহেবের ‘সিলেক্টেড প্রভার্বস ‘ এর অনুবাদ করলেন ‘প্রবাদ মালা ‘(১৮৬৯)  নাম দিয়ে। কালিদাসের  ‘ কুমার সম্ভব ‘ (১৮৭২) এর তিনি স্বার্থক অনুবাদ করে ছিলেন। উৎকল বীর গাঁথা নিয়ে রঙ্গলাল এর ‘ কাঞ্চি কাবেরী ‘ (১৮৭৯) ছিল আর একটি মূল্যবান গ্রন্থ।

ইংরেজী রচনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত ছিলো, ‘ দ্য নেটিভ অ্যারিস্টকেসি অফ বেঙ্গল ‘, ‘অ্যান ইন্ডিয়ান জ্যাক শেফার্ড ‘ , ‘কপার প্লেট গ্রান্ট ফ্রম কপিলেশভরা ইন উড়িষ্যা ‘। এত বড় একজন প্রতিভা মাত্র ষাট বছর বয়সে ১৮৮৭ সালে ইহ লোক ত্যাগ করেন।

তাঁর প্রয়াণের প্রায় ৩৬ বছর পর নৈহাটিতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভাপতি অমৃতলাল বসু তাঁর অভিভাষনে রঙ্গলাল সম্পর্কে প্রশস্তি করে বলেছিলেন,” ঈশ্বরগুপ্তের মিউটিনি প্রভৃতি পদ্যে উদ্দীপনা থাকিলেও যিনি নব্য বঙ্গের হৃদয় ক্ষেত্রে উদ্দীপনার রসে সিঞ্চিত করিয়া দেশহিতৈষনার বীজ বপন করেন তাহার নাম রঙ্গলাল।… জাহাজ মেরামত করার ডকের জন্য খিদিরপুর প্রসিদ্ধ। কিন্তু এখানে একসময় বড় বড় কয়খানি জাহাজ প্রস্তুত হইয়াছিল । তাহাদের প্রধান তিন খানির নাম রঙ্গলাল, মধুসূদন এবং হেমচন্দ্র।’ 

রামনাথ সিদ্ধান্ত পঞ্চানন

দেশ ভাগ হবার অনেক আগের কথা। অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার কোটাঁলিপারা অঞ্চলের এক অখ্যাত গ্রামের নাম ছিল পশ্চিমপাড়। সেই গ্রামেই ১৮২৯ সালে রামনাথ এর জন্ম। তার বাবা ছিলেন রামকুমার ভট্টাচার্য। তাদের এক পূর্বপুরুষ কৃষ্ণনাথ  সার্বভৌম এবং তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী দেবী যুগ্মভাবে “আনন্দলতিকা” নামে একটি  অসাধারন কাব্য গ্রণ্থ  রচনা করেছিলেন। এর  থেকেই বোঝা যায় এই পরিবারের সংস্কৃতির চর্চার ধারা।

ছোট বেলায়  রামনাথ কিছুটা স্থুলো  বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। নিজের ভালো মন্দ, লেখাপড়া করা, না করা এ জাতীয় কোনও বোধ বুদ্ধি তার ছিলনা। চিন্তিত বাবা রামকুমার ছেলের ভবিষ্যত ভেবে কোনও কূল কিনারা পান না। শোনা যায় তারপর হঠাৎ ই তিনি কাশী চলে গেলেন। সেখানে তিনি বাবা বিশ্বনাথের শ্রী চরণে পুত্রের সুবুদ্ধি কামনা করে একলক্ষ বেলপাতা সহযোগে পূজা দিলেন।   তারপরেই নাকি দেবতার অনুগ্রহে রামনাথ এর বুদ্ধি এবং প্রতিভার ক্রমবিকাশ শুরু হয়। প্রথমে নিজেদের গ্রামের টোলেই তিনি ব্যাকরণ, সাহিত্য এবং নবন্যায়ের  কিছু অংশ অধ্যয়ন শুরু করেন। কিন্তু তাতে তাঁর মন এবং ঙ্গানের আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হলনা। একদিন তিনি একা নিঃসম্বল অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন তখনকার বাংলার ন্যায় শাস্ত্র  অধ্যয়ন এর মূল কেন্দ্র নবদীপ ধামে। সেখানে এসে তিনি প্রসিদ্ধ ন্যায়শাস্ত্র  বিশারদ  শ্রীরাম শিরোমণি মহাশয়ের কাছে নবন্যায় শাস্ত্র  অধ্যয়নের ইচ্ছা এবং  আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ছাত্রের আগ্রহে নৈয়াইক শ্রীরাম শিরোমনি রাজি না হয়ে পারলেন না।
পড়াতে গিয়ে রামনাথ এর প্রতিভা  দেখে অধ্যাপক শ্রীরাম শিরোমনি মুগ্ধ হয়ে যান। ক্রমে নবদ্বীপের পণ্ডিত মহলে রামনাথ এর  প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়ে।  এমনকি তখনকার পণ্ডিত সমাজের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ট হরমোহণ  তর্কচুরামনির মতো বিদগ্ধ পন্ডিত নিজে উপযাচক হয়ে রামমনাথের অধ্যয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ছাত্র থাকাকালীন সময়েই তাঁর প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের খ্যতি বাংলার সীমানা অতিক্রম করে ভারতের অন্যত্র প্রসারিত হয়েছিল।
   একটানা দশ বছর অধ্যয়নের পর তিনি অতীব গৌরব সূচক ‘ সিদ্ধান্ত পঞ্চানন ‘ উপাধিতে ভূষিত হন। এরপর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর নিজের জন্মভূমি ফরিদপুর জেলার পশ্চিমপাড় গ্রামে। সেখানে তিনি অধ্যাপনায় প্রবৃত্ত হলেন। নিজের খরচ চলে না, সেই অবস্থাতেই দশ – বার জন ছাত্রের লেখা পড়ার দ্বায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী সংসারের সমস্যার কথা বলে বলে ক্লান্ত কিন্তু কোনো দিকে তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি সমস্ত  সাংসারিক চিন্তা ঈশ্বরের শ্রীচরণে নিবেদন করে নিশ্চিন্তে অধ্যাপনায় এবং অধ্যয়নে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন। তাঁর ছাত্র তথা শিষ্যরা মাঝে মাঝে গুরু গৃহে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করে তাঁর পরিবারের সমস্যা কিছুটা লাঘব করতেন। আসলে তাঁর শিশুর মতো সারল্য, পর্বতের মতো বিশাল পাণ্ডিত্য, সাগরের মতো গাম্ভীর্য দেখে যে কেউ একাধারে মুগ্ধ ও বিস্মিত না হয়ে পারতেন না। ন্যায়রত্ন কেশরী জয়নারায়ন তর্করত্ন, নীলকান্ত তর্কবাগীশ, মাধব চন্দ্র তর্কসিদ্ধান্ত , শশী কুমার শিবরত্ন প্রমুখ সব পণ্ডিতেরা ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ।

একবার নবদ্বীপের বিখ্যাত পাকা টোলের প্রধান অধ্যাপক এর পদ শূন্য হলে তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল পদ টি গ্রহণের। সে সময়ের সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ একথা শুনে তাঁকে নিয়ে শিক্ষা অধিকর্তা ক্রাফট সাহেবের কাছে গেলেন। সব কিছু শুনে মি ক্রাফট খুবই উৎসাহী হলেন। পন্ডিত প্রবর রামনাথ সিদ্ধান্ত পঞ্চাননকে নবদ্বীপের বিখ্যাত পাকা টোলের প্রধান অধ্যাপক নিয়োগ করতে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবার পর পন্ডিতপ্রবোর রামনাথ যখন শুনলেন ওই পদে যোগদান করলে তাঁকে বেতন নিতেই হবে, তিনি তৎক্ষণাৎ সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করে গৃহে ফিরে এলেন। কারণ বিদ্যা তিনি কোনও মতেই বিক্রি করবেন না। ১৮৯৭ সালের ১লা জানুয়ারি সরকার এই নির্লোভ পন্ডিত প্রবর্ কে ‘ মহামহোপাধ্যায় ” উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিল।

তাঁর নিজের জন্মস্থান কোটালি প|ড়া  আর্য শিক্ষা সমিতির তিনি ছিলেন সভাপতি। নির্লোভ এই পন্ডিত কোনও গ্রন্থ রচনা করে যাননি। ঈশ্বর আরাধনা, শাস্ত্র আলোচনা এবং প্রকৃত ছাত্র তৈরি করার মাধ্যমেই তিনি সারা জীবন ভারত – বিদ্যা চর্চার মহৎ কর্ম করে গেছেন।
১৯০৫ সালের মাঘী সপ্তমী তিথিতে বাংলার এই অসাধারণ নৈয়|য়িক পন্ডিত মহামহোপাধ্যায়
রামনাথ  সিদ্ধান্ত পঞ্চানন পরলোক গমন করেন। 

মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন 

উনিশ শতকের আরেক ভারতবিদ্যা বিশারদ মহেশচন্দ্র এমনই এক বংশে আবির্ভূত হয়েছিলেন যাদের পাণ্ডিত্যের দ্যুতিতে তাঁরা নিজেদের কৌলিক পদবী ভট্টাচার্যের পরিবর্তে প্রাপ্ত উপাধীতেই  সমাজে পরিচিত লাভ করেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৩৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হাওড়া জেলার আমতা গ্রামে। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে কলকাতায় চলে আসেন এবং সংস্কৃত শিক্ষা শুরু করেন। এরপর সংস্কৃত কলেজের খাতিমান অধ্যাপক জয়নারায়ন তর্কপঞ্চননের চতুস্পাঠীতে ভর্তি হয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে ন্যায়, দর্শন, অলঙ্কার অর্থাৎ সংস্কৃতের নানান দিকে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। মহেশচন্দ্রের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে অধ্যাপক জয়নারায়ন তাঁকে ‘ ন্যায়রত্ন ‘ উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর তিনি কিছুদিনের জন্য বারাণসীতে যান আরো কিছু শিক্ষা অর্জনের জন্য। সেখানে থেকে কলকাতায়  ফিরে এসে তিনি রাজা কমল কৃষ্ণদেবের সহায়তায় একটি চতুস্পাঠী খোলেন।
   অনেকেই হয়তো জানেন না বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত এডোয়ার্ড কাওয়েল। তিনি আবার সংস্কৃত ভাষা চর্চা করেছিলেন মহেশচন্দ্রের কাছে। এজন্য মহেশ চন্দ্র কোনো পারিশ্রমিক নেননি। অবশ্য এর বিনিময়ে তিনি সাহেবের কাছ থেকে ইংরেজী শিখেছিলেন। কাওয়েল সাহেব ‘ কুসুমাঞ্জলি ‘, ‘ সর্বদর্শন সংগ্রহ ‘  ‘ শান্ডিল্যভক্তিসূত্র ‘ সংস্কৃতের বিখ্যাত গ্রন্থগুলি সাহেব মহেশচন্দ্রের সাহায্যে অনুবাদ করেন।
   ১৮৬১ সালে মহেশচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের অলঙ্কার শাস্ত্রের অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন। কর্ম জীবনের বাকি সময় টুকু তিনি এখানেই অতিবাহিত করে ১৮৯৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি সংস্কৃত কলেজের বিভিন্ন বিভাগের উন্নতি সাধনে নানান পরিকল্পনা রচনা এবং সেগুলির বাস্তবায়ন করিয়েছিলেন। পুরাতত্ত্ব, লিপিবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যার মতন বিষয় গুলির শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করে ভারতবিদ্য চর্চাকেই সমৃদ্ধ করেছিলেন। বাংলার বাইরে সংস্কৃত শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখাকে ছড়িয়ে দেবার কাজে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি পঞ্জিকা সংস্কারের মতো একটি দুরুহ কাজে হাত দিয়েছিলেন। তিনি স্ত্রী শিক্ষা প্রসারেও কাজ করেছিলেন। নিজ গ্রামে ন্যায়রত্ন ইনস্টিটিউশন নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
   ১৯০৬ সালে বঙ্গদেশের এই পন্ডিত, সমাজসেবী, সংস্কারক ইহলোক ত্যাগ করেন। পরিতাপের বিষয় এই যে,  মৃত্যুর একশো কুড়ি বছরের মধ্যেই বাংলার এই কৃতি সন্তানকে বাঙালী ভুলে গেছে। 

চন্দ্রকান্ত তর্ক লঙ্কার

প্রাচ্যবিদ্যায় পারদর্শী বেশিরভাগ পণ্ডিতদের মতোই মহামোহপাধ্যায় চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারও কৌলীক পদবীর পরিবর্তে প্রাপ্ত উপাধিতে সমাজে পরিচিত হতেন। অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার সেরপুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে আবির্ভুত হন। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত রাধাকান্ত বিদ্যাবাগিশ। বাল্য বয়সে পিতৃবিয়োগ হলে তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র নবদ্বীপে চলে আসেন। সেখানে তিনি বিখ্যাত পন্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের কাছে স্মৃতি, শ্রীনন্দন তর্ক বাগিশের কাছে ন্যায়,  কালীনাথ শাস্ত্রীর কাছে বেদান্তের পাঠ শেষ করে চন্দ্রকান্ত ‘ তর্কালঙ্কার’ উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন। 
   এরপর তিনি নিজ গায়ে ফিরে গিয়ে একটি চতুস্পাঠী স্থাপন করে সেখানে অধ্যপনা শুরু করেন। এখান থেকেই তাঁর খ্যাতি সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৭৯ সালে সংস্কৃত কলেজের এক্সটার্নাল স্টুডেন্টদের পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরই ফাঁকে তিনি একটি দুরূহ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ‘গোভিল গুহ্য সূত্রের’ অনুসন্ধান করে তার একটি ভাষ্য রচনা করেছিলেন। ১৮৮০ সালে তাঁরই সম্পাদনায় ‘বিবলিওথিকা ইন্ডিকা’ গ্রন্থমালায় প্রকাশিত হয়। এর পাঁচ বছর পরে জার্মানি থেকে ড:ডোরপ্যাটের সম্পাদনায় এর জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮৮৬ সালে বিখ্যাত পন্ডিত ম্যাক্স মুলার সম্পাদিত ‘সেক্রেড বুকস অফ দা ইস্ট ‘ গ্রন্থমালায় স্থান লাভ করেছিল। এইভাবে তাঁর খ্যাতি দেশের সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বে খাতি লাভ করেছিল।
   ইতিমধ্যেই তিনি সংস্কৃত কলেজের আধ্যপনার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। তখন থেকেই তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। এই পর্বে তিনি বঙ্গ দেশের প্রাচ্য বিদ্যা চর্চার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এশিয়াটিক সোসাইটির সংস্পর্শে আসেন। সেখানকার বিবলিওথিকা ইন্ডিকা গ্রন্থমালা তে তাঁর সম্পাদনায় পর পর প্রকাশিত হতে থাকে তিন খন্ডে ‘পরাশর স্মৃতি’ , দুই খন্ডে ‘কুশুমাঞ্জলি প্রকরনম’ খন্ডদেবের ‘ভট্ট দীপিকা’ , ‘গোভিল পরিশিষ্ট’ এবং ‘সূত্র গৃহ্য’ সংগ্রহ প্রভিতি।
   ভারত বিদ্যাচর্চার প্রতিটি পরিসরকে তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন। আমাদের যে সকল ধ্রুপদী রচনা তার বেশ কিছুকে তিনি সম্পাদনা করে সহজবোধ্য ভাবে সাধারণের সমক্ষে আনেন। তিনি আলোকপাত করেছিলেন প্রায় অজ্ঞাত সাহিত্য সম্ভারের। প্রাচ্য বিদ্যাচর্চায় তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ভারত সরকার ১৮৮৭ সালে তাঁকে
‘মহামোহপাধ্যায়’ উপাধি প্রদান করে সম্মানীত করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যপনার পদ থেকে অবসর নেন। উনিশ শতকের একদম শেষার্ধে তিনি আরো কিছু গ্রন্থ প্রণয়ন করে ভারত বিদ্যাচর্চা কে আরো প্রসারিত করেছিলেন। গ্রন্থগুলি ছিলো, ‘প্রবোধ প্রকাশ’, ‘সতী পরিণয়’, এবং ‘অলঙ্কার সুত্রম’।
   ১৮৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চন্দ্রকান্ত মহাশয় কে পঞ্চাশ হাজার টাকা দক্ষিণায়  পাঁচ বছরের জন্য সদ্য প্রবর্তিত ‘ শ্রী গোপাল বসু ফেলোশিপ লেকচার’ প্রদানের জন্য  আমন্ত্রন জানান। তিনি ১৯০২ সাল পর্যন্ত সেখানে মোট ৪২ টি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন হিন্দু দর্শনের জটিল বিষয় গুলির বিচার ও মীমাংসার উপর। এ কাজে তিনি দর্শন শাস্ত্রের জটিল – কঠিন পরিভাষা গুলিকে সহজ বাংলায় প্রকাশ করার জন্য যে মেধা ও অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। এই বক্তৃতাগুলি পরে গ্রন্থাকারে ‘লেকচারস অন হিন্দু ফিলোসফি – হিন্দু দর্শন ও বেদান্ত ‘ নামে পাঁচ খন্ডে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বাংলা ভাষায় হিন্দু দর্শনের যে মণি মাণিক্যের যে ভান্ডার উন্মোচিত করেছিলেন তা এককথায় তুলনাহীন। ভারত বিদ্যাচর্চার নানান দিক নিয়ে যেমন, অলঙ্কার, স্মৃতি, ব্যাকরণ, ন্যায়, দর্শন, নাটক বিষয়ে ৪০ টি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছিলেন। এছাড়া সমসাময়িক পত্র পত্রিকায় কিছু লিখেছিলেন, যে গুলি পরে:শিক্ষা’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।
   অতয়েব, চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার যে অসম্ভব মেধা ও ধী-শক্তির পরিচয় দিয়ে একের পর এক গ্রন্থ প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে ভারত বিদ্যাচর্চার যে নব দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন তাতে আমাদের মনে যুগপৎ শ্রদ্ধা ও বিস্ময় জাগে। এই বিরল প্রতিভার অধিকারী মানুষটি ১৯১০ সালে কাশিধামে প্রয়াত হন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁকে বাঙালী প্রয়াণের একশ বছরের মধ্যেই বিস্মৃত হয়েছে 

রামদাস সেন

উচ্চ শিক্ষার তথাকথিত শিখর স্পর্শ না করেও স্বীয় শিক্ষা, অধ্যাবসায় ও আপন জ্ঞানদীপ্তির বিচ্ছুরণে ভারতবিদ্যা অন্বেষণে ব্যাপৃত হয়ে যশস্বী হয়েছিলেন। তিনি জন্মেছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে ১৮৪৫ সালে। পিতা লালমোহন সেনের ছিল বিস্তৃত জমিদারী। তবে অতি শৈশবে পিতৃ বিয়োগ হলে মা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের কাছে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। ছোটো বেলা থেকেই তিনি অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। সেকালের বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার দুই দিকপাল পন্ডিত যথাক্রমে, রামগতি ন্যায়রত্ন ও কালিবর বেদান্ত বাগিশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ গ্রহণ করেন। কিছুদিন স্থানীয় কে. এন. কলেজেও পড়াশোনা করেছিলেন।

   রামদাসের সাহিত্য সাধনার অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ ঘটে কবিতা চর্চার মাধ্যমে। তাঁর কবিতা গুলি প্রকাশিত হতো সেই সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’ এ। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তাঁর প্রথম কবিতার বই  ‘সঙ্গীত লহরী ‘  প্রকাশিত হয়। অল্প বয়সে স্ত্রী বিয়োগ ব্যথায় কাতর রামদাস লেখেন ‘বিলাপ তরঙ্গ ‘ কাব্যগ্রন্থ, তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ বছর।

   এরপর তিনি ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, দর্শন, শাস্ত্রগ্রন্থ, বিশেষত হিন্দুশাস্ত্র ও বৌদ্ধ শাস্ত্র তে গভীর ভাবে আকৃষ্ট হন। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৯ সালে বহরমপুরে ডেপুটি ম্যাজি্স্ট্রেট হয়ে এলে তাকে কেন্দ্র করে এক বুধমণ্ডলী গড়ে ওঠে, যার মধ্যমনি ছিলেন রামদাস সেন। প্রাচীন ভারতের সভ্যতা ও ইতিহাস – সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর লেখাগুলি ‘বঙ্গ দর্শন ‘ পত্রিকাতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ১৮৭০ সালে বহরমপুরে লিটারারি সোসাইটির উদ্যোগ অনুষ্ঠিত এক বিশেষ সভায় তিনি ‘On Modern Buddhist Researches’ নামে একটি নিবন্ধ পাঠ করেছিলেন। সেই বক্তৃতায় ভারততত্ত্ব বিষয়ে তাঁর গভীরতা প্রকাশ পেয়েছিল। পরে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে তা দেশী – বিদেশী পন্ডিতদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল। ইতিমধ্যে তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার আগ্রহ নিয়ে পালি ভাষা চর্চা করেন। যার ফলে বৌদ্ধগ্রন্থ গুলি তিনি মূলে পড়ে ফেলতে পেরেছিলেন।

   ভারতবিদ্যাচর্চার অমোঘ আকর্ষণে তিনি ইউরোপে সফরে বেরিয়ে পড়েন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালিতে নানা সারস্বত প্রতিষ্ঠান ঘুরে তথ্য আহরণ করেন। সেখানে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর রচনাগুলি সম্পর্কে সেখানকার পন্ডিতবর্গের দ্বারা অবহিত হওয়ার মধ্যে। ইতালির ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত ওরিয়েন্টাল অ্যাকাডেমি তাঁর সামগ্রিক বিদ্যাবত্তার স্বীকৃতি স্বরূপ সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। ১৮৭৪ সালে লন্ডন শহরে  অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ওরিয়ান্টলিস্টিস নামক সম্মেলনে আর্য বিভাগে সভাপতির ভাষণে বিখ্যাত পন্ডিত ম্যাক্সমুলার সাহেব ভারতবিদ্যা আলোচনায় রামদাস সেনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছিলেন। মাত্র তিরিশ  বছরের মধ্যে এত বড় এক পণ্ডিতের কাছ থেকে অগাধ স্বীকৃতি চারটে খানি ব্যাপার ছিলো না।
   রামদাসের ভাবনার মূল সুরটি নিহিত ছিল এই যে ভারতের গৌরব বর্তমানে কিছুটা ম্লান হলেও ব্যাস, বাল্মীকির মতো মহাকবিদের কীর্তিকাহিনী এখনও বিরাজমান। ভারতবর্ষের মানুষের জ্ঞানের ক্ষেত্রটি মহীয়ান। তিনি লন্ডনের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সন্মানীয় সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি বিশ্বের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বল্পায়ু জীবনের একদম শেষ পর্যায়ে তিনি প্রাচীন সংস্কৃত ও পালি শাস্ত্র থেকে আহরিত নানা তথ্যকে অবলম্বন করে মহামানব বুদ্ধকে নিয়ে একটি বৃহৎ গ্রন্থ ‘ বুদ্ধদেব ‘ রচনা করেন। কিন্তু ১৮৮৭ সালে তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটলে, কয়েক বছর পর তাঁর পুত্র মনিমোহন সেন গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সাংস্কৃতিক গবেষণা কার্যের সুবিধার জন্য তিনি নিজ অর্থ ব্যয় করে একটি মূল্যবান লাইব্রেরী তৈরী করেছিলেন। সেখানে বিদেশের নামী দামী বই সংগৃহীত হয়েছিল। বাংলা বই তো বটেই, ভারত চর্চা সম্বন্ধীয় বহু পত্র পত্রিকা তিনি এই লাইব্রেরীর জন্য সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর পৌত্র অনুত্তম সেন এই অমূল্য গ্রন্থরাজি ন্যাশনাল লাইব্রেরীকে দান করেন। ভারতবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে রামদাসের পাণ্ডিত্য , ত্যাগ আজকের দিন দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত।

সত্যব্রত সামশ্রমি (১৮৪৬ – ১৯১১)

এই সংখ্যায় যে ভারততত্ত্ববিদের আলোচনা করা হবে তাঁর জন্ম অবশ্য বঙ্গদেশে নয়, তবে কর্ম এই বাংলায়। বাংলার অন্যতম বেদ বিশেষজ্ঞ পন্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমি জন্মেছিলেন বিহারের পাটনা শহরে ১৮৪৬ সালের ২৮ মে। পিতার নাম রামদাস চট্টোপাধ্যায়।  চট্টোপাধ্যায় এর পুত্র কিভাবে সামশ্রমি হলেন সে বিষয়ে পরে আসছি। যদিও তাদের আদি নিবাস ছিল বর্ধমানের কালনাতে। সত্যব্রত কর্মজীবনে আইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং কর্মকালের শেষে তিনি বিচারপতিও হয়ে ছিলেন। চাকুরী জীবনে তিনি বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন; তবে একটি ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রাচীনপন্থী। তা হলো তিনি পুত্রদের বিলাসিতা বা সাহেবিয়ানা একদম পছন্দ করতেন না। বরং চাইতেন পুত্ররা প্রাচীন কালের আদর্শ অনুসরণ করে গুরুগৃহে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে।

    আর বাল্য বয়স থেকেই সামশ্রমির মনে ঈশ্বর ভক্তির ভাব ছিল। আট বছর বয়সে তাঁর উপনয়নের পর গুরু গৌড় গোস্বামীর অধীনে সরস্বতী মঠে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শিক্ষা গ্রহণের জন্য। সেখানে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে পাণিনির ‘অষ্ঠাধ্যয়ী ‘ এবং পতঞ্জলি র ‘ মহাভাষ্য ‘ রপ্ত করে ফেলেন। দীর্ঘ বারো বছর গুরু আশ্রমে অতিবাহিত করে তিনি বেদ এবং ব্যাকরণে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। আর কুড়ি বছর বয়স থেকেই তিনি পন্ডিত ব্যক্তিদের সাথে বেদ আলোচনায় অংশ নিতেন এবং কোনো জটিল প্রশ্ন থাকলে তার সমাধানও করে দিতেন। এই ভাবে তিনি অতি অল্প বয়সেই একজন বেদ বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। সেই সময় সত্যব্রত বুন্দির রাজার আমন্ত্রণে তাঁর রাজ্যসভায় বেদ আলোচনায় যোগদান করেন। সেই রাজ্সভায় এই তরুণের বেদ সম্পর্কে পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে ‘ সামশ্রমি ‘ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকেই তিনি তাঁর পৈতৃক উপাধির পরিবর্তে এই প্রাপ্ত সম্মান নামের সাথে ব্যাবহৃত হতে থাকে
   ১৮৬৭ সালে তিনি বারাণসী থেকে ‘প্রত্নকেন্দ্র নন্দিনী ‘ নামে সংস্কৃত ভাষায় একটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করেন। আট বছর এই পত্রিকাটি সগৌরবে চলেছিল। এই পত্রিকা – টির মাধ্যমে তিনি ভারতের প্রাচীন সাধনা ও গৌরব সম্পর্কে লিখতে থাকেন। ভারতবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে এই পত্রিকার অবদান অপরিসীম।

   ১৮৬৮ সালে তিনি নবদ্বীপের খ্যাতিমান স্মার্তপন্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের নাতনীকে বিবাহ করেছিলেন। এ নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। একবার নাকি পন্ডিত ব্রজনাথকে নবদ্বীপে গিয়ে এই তরুণ বেদবিশেষজ্ঞ সত্যব্রত তর্ক যুদ্ধে পরাজিত করেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ব্রজনাথ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সত্যব্রতের বাবা কে এর বিহিত করতে বলেন। রামদাস পড়েন ফ্যাসাদে; তিনি ব্রজনাথকে বলেন সেইই বলুক কি করলে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হবে। চতুর বিদ্যারত্ন রামদাসকে বলেন তাঁর একমাত্র নাতনীকে বিবাহ করলে তিনি সত্যব্রতকে মার্জনা করবেন। আর তখন থেকেই নাদিয়ার সারস্বত সমাজে তিনি জায়গা করে নেন।

প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ রজেন্দ্র লাল মিত্রের উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ‘বিব্লথেকা ইন্ডিকা ‘ গ্রন্থমালায় সামবেদ সংকলনের পরিকল্পনা করেন, তখন এই দায়িত্ব তিনি সাগ্রহে সত্যব্রতকে দেন। তিনিও মনের মত কাজ পেয়ে পূর্ন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এদিকে ১৮৭৫ সালে তাঁর পিতৃ বিয়োগ হলে তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় বসবাস শুরু করে তিনি নিজের টাকায় একটি মুদ্রাযন্ত্র কিনে ফেলেন। এই মুদ্রাযন্ত্রের দৌলতে তিনি সামবেদ সংকলনের সাথে সাথে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ন বই প্রকাশ করেন; যা তাঁর ভারতবিদ্যা চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছিলো। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বেদ শাস্ত্রের অধ্যাপক ও পরীক্ষক ছিলেন। ভারতবর্ষের বৈদিক যুগ সম্পর্কে তিনি অনেক অজানা তথ্য পরিবেশনের জন্য ‘ ঊষা ‘ নামক একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিন যুক্তি সহযোগে বেদের নানা বিষয় ও ঘটনাকে তুলে ধরতেন, যা আজকের দিনেও ভীষণ প্রাসঙ্গিক।

    সামশ্রমি মহাশয় সমস্ত বেদের সংকলন ও ভাষ্য প্রদান করেছিলেন, সেগুলি ব্যতিরেকে ভারতবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রটি মূল্যহীন হয়ে পড়বে। শৈশব থেকে বাংলার বাইরে মানুষ হলেও বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম প্রেম। তাঁর উদ্যোগে সম্পাদিত ও প্রকাশিত বাংলা গ্রন্থগুলি হলো: ‘ ত্রয়ী ভাষা ‘ ‘ ‘ ত্রয়ী চতুস্থয় ‘ শতপথ ব্রাহ্মন ‘ ‘সামবেদ সংহিতা ‘ , ‘ উপনিষদ ‘ এবং ‘ দেবতাতত্ত্ব ‘ ।

   ১৯১১সালে ১জুন বঙ্গদেশের এই খ্যাতিমান বৈদিক পন্ডিত কলকাতা শহরেই নি:শব্দে  ইহলোক ত্যাগ করেন। অথচ, আমরা কজনেই বা তার নাম জানি!

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৭- ১৯১৯)

অধুনা প্রায় বিস্মৃত ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিক। উনিশ শতকের পাশ্চাত্য রোমান্স প্রভাবিত যে সাহিত্য তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে ছিল তাঁর অবস্থান। প্রাচ্য সাহিত্য ঐতিহ্যের যে মৌখিক রীতি বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্ভবত ত্রৈলোক্যনাথ ছিলেন তাঁর শেষ উজ্জ্বল নক্ষত্র।
   ১৮৪৭ সালে বর্তমান উত্তর ২৪- পরগণার শ্যামনগরের কাছে এক গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর  জন্ম। শৈশবেই তিনি পিতা – মাতাকে হারিয়েছিলেন। পৈতৃক যে সম্পত্তি ছিল তাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে। আর ম্যালেরিয়া ছিল সেই সময় নিত্য সঙ্গী। রোগ, দারিদ্র্য আর হতাশায় তখন ত্রৈলোক্যনাথ প্রায় মরিয়া। প্রথাগত শিক্ষা তাঁর কপালে জোটেনি। সেই দিক দিয়ে দেখলে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। ১৮৬৫ সালে তিনি নিজের গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশ্যে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বোহেমিয়ান লেখকদের ভবঘুরে জীবনের সঙ্গে তাঁর মিল আছে। তবে সে মিল বাইরের, অন্তরের নয়। ইউরোপের বোহেমিয়ান লেখকদের লেখায় ছিল দারিদ্র্যের আস্ফালন এবং লালসার অসংযম এর আধিক্য। কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথ ছিলেন সেসব থেকে মুক্ত। তাঁর লেখায় ছিল না দারিদ্র্য বিলাস, বরং ছিল দারিদ্র্য বিমোচনের উপায়।
   দিনের পর দিন যে প্রবল কষাঘাতে জর্জরিত হয়েছিলেন, তা বোধ হয় কোন বাঙালী লেখকের জীবনে ঘটেনি। বেশিরভাগ দিন কেটেছিল অনাহারে বা অর্ধাহারে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নিজের প্রতি আস্থা হারাননি। এই অনমনীয় মনোভাব তাঁকে সাহিত্য সেবার মধ্যে দিয়ে ভারতবিদ্যা অন্বেষণে ব্যাপৃত করেছিল। আপামর ভারতবাসীর দুঃখ যন্ত্রণার কথা তাঁর লেখনীতে অভিব্যক্ত। সেই বেদনা নিরসনের চেষ্টাও তাঁর লেখনীতে প্রতিফলিত হয়েছিল। নিজে ব্রাহ্মণ সন্তান হলেও ত্রৈলোক্যনাথের লেখায় ব্যাঙ্গের চাবুক বারবার আছড়ে পড়েছে প্রকৃত শাস্ত্র জ্ঞান শূন্য আচারপালনকারী হৃদয়হীন ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের উপর। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ কঙ্কাবতী ‘ এবং শেষ গ্রন্থ তাঁর প্রয়াণের পর ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ‘ ডমরু চরিত ‘ এই ধরনের নিদর্শনে ভরপুর।
   ১৮৭৬ সালে এক সরকারি প্রদর্শনীর দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে কালাপানি পেরোতে হয়। এই যে বিলেত যাত্রা তা নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য ছিল না, এটা ছিল ভারতীয় শিল্পীদের সৃজনশীল কাজের সঙ্গে বিদেশের মানুষদের অবহিত করা। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে ফিরে তাঁকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়ে ছিল। সংস্কার আন্দোলনের সৈনিক ত্রৈলোক্যনাথের লেখালেখিতে যা সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, শাস্ত্র ধর্মের নামে মনুষত্বের লাঞ্ছনার বিরূদ্ধে সোচ্চার হওয়া। বিশেষ করে নারী জাতির লাঞ্ছনা তাঁকে বেদনাকাতর করে তুলেছিল। এ বিষয়ে তাঁর পূর্বসূরি বিদ্যাসাগরের আর্তনাদ ত্রৈলোক্যনাথের বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলন ঘটেছে। অর্থাৎ সমাজ সংস্কারের যে ধারা প্রবাহিত হয়েছিল তিনি ছিলেন সেই ধারার অনুসারী। দেশবাসীর মঙ্গল সাধনার মধ্যেই তাঁর ভারতবোধ, ভারতভাবনা, ভারতচিন্তা আমরা খুঁজে পেতে পারি। তিনি ভারতীয় শিল্পবিদ্যাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। একদিকে শিল্প সমালোচনা, অন্যদিকে সাহিত্য সাধনা এবং সমাজ ভাবনা এই ত্রিবেণী সঙ্গমের মধ্যেই তাঁর ভারতবিদ্যাচর্চার ধারা বহমান ছিল। ১৯১৯ সালে তিনি প্রয়াত হন।এই বিস্মৃতপ্রায় ভারততত্ত্ববিদকে বর্তমান প্রজন্ম প্রায় ভুলে গেছে। 

শরচ্চন্দ্র দাশ (১৮৪৯ – ১৯১৭)

একাধারে তিনি ছিলেন তিব্বত বিশেষজ্ঞ, বৌদ্ধধর্ম অনুরাগী, পালি ও সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত। তিনি হলেন শরচ্চন্দ্র দাশ। তবে তাঁর প্রথম জীবনের দিকে তাকালে তাঁর পরের জীবনের কার্যক্রমকে মেলানো যায়না। জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার চট্টগ্রাম শহরে। পিতা ছিলেন দীন দয়াল দাশ। শরচ্চন্দ্র এন্ত্রাস ও লোয়ার আর্টস পাশ করে করে প্রেসিডেন্সী কলেজে পূর্ত বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন।ওই বিভাগে শেষ পরীক্ষার সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারদের পরামর্শে তাকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়। সেই সময়ে ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুল নামে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তৈরী হলে, সেখানে ইংরেজি ভাষা শেখানোর জন্য একজন মাস্টারের প্রয়োজন হয়। সে সময় প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ আলফ্রেড ক্রফট তাঁর ছাত্র শরচ্চন্দ্রকে সেই দায়িত্ব অর্পণ করেন। শরচ্চন্দ্র সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি ছাত্রদের ইংরেজী শেখাতে থাকেন, অন্যদিকে দার্জিলিংয়ের তিব্বতি পরিবারগুলির কাছ থেকে তিব্বতি ভাষা রপ্ত করেন।
   সেই শুরু, পরে তা আরো গভীর ভাবে তিনি আত্মস্থ করেন। ক্রমে তাঁর মনে হলো, অতীত ভারতে অতীশ দীপঙ্করের মতো মনীষীরা কত কষ্ট করে তিব্বত গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন। তাঁর সেই তিব্বতী স্কুলের এক শিক্ষক শরচ্চন্দ্রএর তিব্বতী অনুরাগে খুশি হয়ে তাকে তিব্বতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। মনে রাখতে হবে সে সময়ে
তিব্বতে যাওয়া চারটে খানি কথা ছিল না। যাইহোক অনুমতি পত্র যোগাড় করে ১৮৭৯ সালে শরচ্চন্দ্র তাঁর স্কুলের সহকর্মী লামা উগায়েনকে সঙ্গে নিয়ে পদব্রজে তিব্বত পাড়ি দিলেন। দীর্ঘদিন বাদে তিব্বতের তাসিলুঁনপো মঠে উপস্থিতি হলেন। ছয়মাস সেখানে ছাত্র হিসাবে থেকে অনেক দুর্লভ বৌদ্ধ গ্রন্থ পাঠ করেছিলেন এবং মূল্যবান পুঁথি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করে দেশে ফিরেছিলেন। তাঁর এই তিব্বত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘Narrative of a Journey to Tashilumpo in Tibbet in 1979’ নামে এক অনবদ্য গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছিলেন। এই ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন স্বযং আলফ্রেড ক্রফট। এই বইতে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত শৃঙ্গের উত্তর ও উত্তর – পূর্ব দিকের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক।
   এরপর ভারত সরকার তাঁর তিব্বত সংক্রান্ত জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে দ্বিতীয় বার তিব্বত জওয়ার অনুমতি প্রদান করেছিলো। তিনি ১৮৮২ সালে আবার তিব্বত যাত্রা করেন। এবার তিনি অনেকটা সময় লাসা তে অতিবাহিত করেন। সেখানে তিনি চোদ্দ মাস থেকে তিব্বতি ও বৌদ্ধ বিষয়ক জ্ঞান আহরণ ও তথ্য সংগ্রহ করে দেশে ফিরে আসেন। এর ফলশ্রুতি  হলো তিব্বতের অজানা ভৌগলিক তথ্য নিয়ে ১৯০২ সালে রচনা করেন ‘Journy to Lasha and Central Tibbet ‘ নামক আর একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে দিয়ে তাঁর প্রচ্যবিদ্যাচর্চা বিকষিত হতে থাকে। সেই বহু যুগ আগেই ভারত সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর সেই গড়ে ওঠার কাজে শরচ্চন্দ্র দাশের মতো ভারততত্ত্ববিদদের অবদান অনস্বীকার্য।
   তিনি শুধু তিব্বতেই নয় বৌদ্ধশাস্ত্র বিশারদ হিসাবে চিনেও গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ” কাচেন লামা” হিসাবে সমাদৃত হয়েছিলেন। এর অর্থ কাশ্মীর থেকে আসা বৌদ্ধপন্ডিত। ১৮৮৭ সালে
শরচ্চন্দ্র গিয়েছিলেন থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার সম্পর্কে জানতে। তাঁর পাণ্ডিত্য ও অধ্যবসায়ে মুগ্ধ হয়ে থাই রাজা তাঁকে সেখানকার সর্বোচ্চ উপাধি ‘ তুষিতমত ‘ পদক দিয়ে সম্মানিত  করেন। তাঁর আর একটি অন্যতম কীর্তি ভারত থেকে হারিয়ে যাওয়া মহাকবি ব্যাসদাস খেমেন্দ্রের লেখা ‘ বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা ‘ নামক অমূল্য সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বত থেকে ভারতে ফিরিয়ে আনেন। পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অনুরোধে চার খন্ডে এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। সমকালীন অনেক ইংরেজী ও বাংলা সাময়িক পত্রে তিনি ভারতবিদ্যাচর্চা বিষয়ক বহু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র ও গ্রন্থ প্রচারের জন্য কলকাতাতে Buddhist Text and Research Society নামে সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
   বৌদ্ধপন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাশ সম্পর্কে আলোচনায় একটি কথা খুবই জরুরী তা হলো লুপ্ত বৌদ্ধ গ্রন্থ উদ্ধার ও প্রচারের কাজে তিনি প্রায় সারা জীবন অতিবাহিত করে ফেললেও , তিনি নিজে কিন্তু বৌদ্ধ ছিলেন না। আজীবন বৌদ্ধ সংস্কৃতি কেন্দ্রিক ভারতবিদ্যা চর্চায় রত থেকে তিনিই প্রথম তিব্বতের সুমহান সৌন্দর্য ও সুমহান সংস্কৃতির কথা বিশ্ব মানবের কাছে উন্মোচিত করেছিলেন। ১৯১৭ সালের  জানুয়ারি  মাসে বিশ্বখ্যাত এই বাঙালি বৌদ্ধপন্ডিত ইহলোক ত্যাগ করেন। 

রমেশ চন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯)

ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এর উজ্জ্বল নক্ষত্র, ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় দের মধ্যে প্রথম বিভাগীয় কমিশনারের মতো উচ্চপদে দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তি, ব্রিটিশ ভারতের উচ্চশির জাতীয়তাবাদী অর্থনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক, ভিনসেন্ট স্মিথের সহপাঠী এবং ভারতবিদ্যাচর্চার অগ্রণী পুরুষ রমেশ চন্দ্র দত্ত, যিনি Dr. R.C.Dutt নামেই সারস্বত্ত সমাজে অধিক  পরিচিত। আবার কর্মজীবনে ব্রিটিশ শাসনে বাঙালী প্রজাদের দুর্দশা দেখে তিনিই ছদ্মনামে ১৮৭৪ সালে লেখেন The Peasantry of Bengal. আবার স্বদেশ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ এই রমেশচন্দ্র অবসরের নির্দিষ্ট সময়ের নয় বছরের আগেই সরকারী চাকরী থেকে অব্যাহতি নেন। কারণ সরকারি আমলা হিসাবে ইচ্ছামতো সাহিত্য চর্চা ও দেশের কাজ করা যাবে না।

   এমনিই এক বিরাট চরিত্রের মানুষ রমেশচন্দ্র জন্মেছিলেন পুরনো কলকাতার রামবাগানের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে ১৮৪৮ সালের ১৩ আগস্ট। পিতা ঈশান চন্দ্র ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। রমেশচন্দ্রের প্রথম পাঠ হেয়ার স্কুলে। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি পিতা – মাতা উভয়কেই হারান। যাইহোক এন্ট্রান্স পাশ করার পর ১৮৬৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ. এ. পাশ করেন। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ই তিনি বাড়ির রক্ষনশীলতাকে অগ্রাহ্য করে দুই বন্ধুর সাথে বিলেতে আই. সি. এস. পড়ার জন্য পাড়ি দিয়েছিলেন। ১৮৭১ সালে তিনি আই.সি.এস. শেষ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়ে ছিলেন। একই বছরে তিনি ইনার টেম্পল থেকে বার এট ল হয়ে দেশে ফিরে এসে কিছু দিন নানা জায়গায় জেলা শাষকের দ্বায়িত্ব পালন করে বর্ধমান বিভাগের কমিশনার নিযুক্ত হন। কর্মজীবনে তিনি কিছুদিন উড়িষ্যা তে কমিশনার হিসাবে ছিলেন।
   একথা মনে রাখতে হবে সরকারি চাকরি তাঁকে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা, তাঁদের দুঃক্ষ – কষ্ট প্রভৃতি বুঝতে সাহায্য করেছিলো। অবসরের পর তিন বছরের জন্য তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়ে ভারতবিদ্যাচর্চার সঙ্গে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও সেখানকার জনসাধারনের মধ্যে ভারতবাসীরা যাতে নায্য অধিকার পান সে বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।

   ১৯০০ সালে দেশে ফিরে এসে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রতিকারের আন্দোলন শুরু করেন। সরকারী আমলা হিসাবে তাঁর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে দুটি তথ্য সমৃদ্ধ বই রচনা করেছিলেন, যার প্রচার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। একটি ছিলো Economic History of India: 1757-1837 এবং India in Victorian Age : 1837-1900. এছাড়াও পিতৃবন্ধু সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশে বাংলা ভাষায় লিখেছিলেন: ‘ বঙ্গবিজেতা ‘, ‘ মাধবীকঙ্কন ‘, ‘ মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত ‘, ‘ রাজপুত জীবন সন্ধ্যা ‘ মতো অসাধারণ ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি। বিখ্যাত জার্মান ভারতবিদ্যাচর্চাবিদ মনিষী ম্যাকসমুলার দীর্ঘ চব্বিশ বছরের পরিশ্রমে সায়ন ভাষ্য সহ সমগ্র ঋকবেদ ছয় খন্ডে সম্পদনা করে প্রকাশ করেছিলেন। তারপর সেই মহাগ্রন্থ প্রথম ভারতীয় হিসাবে রমেশ চন্দ্র দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলা ভাষায়  ‘ঋকবেদ সংহিতা ‘  নামে অনুবাদ করেছিলাম। এমনকি মহাভারতের সম্পুর্ন উপাখ্যান ইংরেজীতে রচনা করেছিলেন। যার ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং ম্যাক্সমুলার সাহেব। হিন্দুশাস্ত্রের মূল কথাগুলি সহজ করে জনসাধারনের মধ্যে প্রচারের জন্য তিনি ‘ হিন্দুশাস্ত্র ‘ নামে এক গ্রন্থমালা প্রবর্তন করে ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন।
   রমেশ চন্দ্র শেষ জীবনে বোরোদার মহারাজের আমন্ত্রণে সেখানকার রাজস্বমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হয়ে প্রশাসনকে জনউন্নয়নমুখী করে তুলতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন। একই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের নানা কল্যাণকর কাজে তিনি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এবারে এই বিশিষ্ঠ ভারততত্ববিদের  গ্রহণযোগ্যতার একটি দৃষ্টান্ত তুলে  ধরা যেতে পারে,যে ব্যাপারটা আমরা অনেকেই জানি না।  আমরা ইতিপূর্বেই তাঁর ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের উপর লিখিত বিখ্যাত বইয়ের সঙ্গে  পরিচিত হয়েছি। যেখানে তিনি ব্রিটিশ সরকারের নীতিগুলো কে তীব্র সমালোচনায় জর্জরিত করেছেন। ভারতে ব্রিটিশ সরকারের অ – ব্রিটিশ সুলভ শাষনের যে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন তা বড়লাট লর্ড ন্যাথানিয়েল কার্জনের গোচরে আসে। তিনি রমেশচন্দ্র দত্তের লেখা গুলিকে ভালো করে পাঠ করেছিলেন। কার্জন সাহেব কিন্তু এই নেটিভ ইন্ডিয়ান এর প্রতি কোনো রকম বিষেদাগার প্রকাশ করেননি, বা তাঁকে কোনো রূপ শাস্তি দেননি ব্রিটিশ শাসনের তীব্র সমালোচনা করা সত্বেও। কার্জন একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলেন রমেশ চন্দ্র কে, যেখানে তিনি রমেশ চন্দ্রের বক্তব্যগুলিকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে খন্ডন করেছিলেন। পাঠক ভাবুন,  আজকের দিনে এমন ঘটনা কল্পনাও করা হয় না। এই রকম ঘটলে সেই ব্যক্তির সোজা হাজতবাস, নয়তো মন্তব্য প্রত্যাহারের জন্য হুমকি প্রদর্শন অনিবার্য। কিন্তু কার্জনের মতো একজন ঘোর সাম্রাজ্যবাদী শাসক গুণী মানুষের বক্তব্যের কদর করেছিলেন। সাহেবদের সবই যে খারাপ এমনটা যারা ভাবেন তারা ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকবহাল নন।এই বিশিষ্ট ভারতবিদ্যাবিশারদ আর. সি. দত্ত ১৯০৯ সালে ইহ জগত ছেড়ে চলে যান। প্রয়াণের পর তাঁর মানসকন্যাতুল্য ভগিনি নিবেদিতা তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে Modern Rivew পত্রিকাতে এক দীর্ঘ  প্রবন্ধ লিখেছিলেন। রবীন্দ্র নাথ যথার্থই লিখেছিলেন: ” তাহার চরিত্রে প্রাণের বেগের সঙ্গে অপ্রমত্ততার যে সম্মিলন ছিল তাহা এখনকার কাছে দুর্লভ। তাহার সেই প্রচুর প্রাণশক্তি তাহাকে দেশহিতকর বিচিত্র কর্মে প্রবৃত্ত করিয়াছে, অথচ সে শক্তি কোথাও অপনার মর্যাদা লঙ্ঘন করে নাই। কি সাহিত্যে, কি রাজকার্যে, কি দেশহিতে, সর্বত্রই তাহার উদ্যমপূর্ণ বেগে ধাবিত হইয়া গেছে ……।” 

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১)

ভারতবিদ্যা চর্চার বহু উল্লেখ্য কাজের মধ্যে একটি গুরুত্বপুর্ন অবদান হল বাংলা ভাষার প্রাচীন পুঁথি চর্যাপদ আবিষ্কার, যে মহৎ কাজটি করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। আদি নিবাস ছিল অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার কুমিল্লা গ্রামে। পারিবারিক পদবী ছিল ভট্টাচার্য্য। পাণ্ডিত্যের জন্য তিনি ‘ শাস্ত্রী’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। হরপ্রসাদ এর জন্ম অবশ্য উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি তে ১৮৫৩ সালে। এই নৈহাটিতেই জন্মেছিলেন আরেক বিখ্যাত ভারতবিদ বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।হরপ্রসাদএর পিতা ছিলেন পন্ডিত রমকমল ন্যায়রত্ন । অর্থাৎ পারিবারিক সূত্রে পাণ্ডিত্যের ঐতিহ্যের ধারা বহমান ছিলো তাদের। তাঁর বরদাদাও ছিলেন ন্যায়শাস্ত্রে পারদর্শী। অল্প বয়সে পিতৃ বিয়োগ হলে তিনি এই দাদার কাছেই মানুষ হয়েছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি শুধু বাংলার নন সমগ্র ভারতের মুখ উজ্জল করেছিলেন।

   হরপ্রসাদ শিক্ষার প্রাথমিক পর্বে হরপ্রসাদ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের টোলে অধ্যয়ন করে ছিলেন। তিনি অল্প বয়সেই ইংরেজি ভাষা রপ্ত করেছিলেন। ১৮৬৬ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় হরপ্রসাদকে কলকাতায় নিয়ে এসে সংস্কৃত কলেজে ক্লাস সেভেনে ভর্তি করে দেন। এই সময় তিনি থাকতেন বিদ্যাসাগরের বাড়ির ছাত্রাবাসে। কিন্তু সেই ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে গেলে লোকের বাড়ি ছাত্র পরিয়ে অনেক কষ্টে নিজের থাকা খাওয়ায় ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকে বৃত্তি সহ এন্ট্রান্স এবং প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. পাশ করেছিলেন। এরপর ১৮৭৭ সালে  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ওই একই বছরে তিনি ‘ শাস্ত্রী ‘ উপাধি প্রাপ্ত হন।
  তিনি তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন হেয়ার স্কুলের শিক্ষক তা দিয়ে। এরপর তিনি কিছুদিন লক্ষ্ণওনের ক্যানিং কলেজে কিছু দিন অধ্যপনা করে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে সংস্কৃতের অধ্যপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি সরকারের একাধিক শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এবং সেই দায়িত্ব তিনি সফলতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গেও তিনি গভীর ভাবে যুক্ত ছিলেন। এর আগে তিনি পড়াশোনা শেষ করে এশিয়াটিক সোসাইটির কর্ণধার রাজেন্দ্র লাল মিত্রের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরই সাহচার্যে তিনি প্রাচ্যবিদ্যা অন্বেষণে বের হয়েছিলেন। রাজেন্দ্রলালএর প্রয়াণের পর তিনি পুঁথি দেখাশোনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। ওই সূত্র ধরে তাকে দেশের নানা জায়গায় যেতে হয়েছিলো। এইরকমই একদিন সন্ধান করে নেপালের রাজ দরবারে উপস্থিত হন। রাজার গোয়াল ঘর থেকে উদ্ধার করেন লুপ্তপ্রায় সংস্কৃত টিকা সহ ‘ চর্যাচর্যর্বিনিশ্চয় ‘। এটিই বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ।
   ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে , সেখান থেকে হরপ্রসাদশাস্ত্রীর ডাক আসে। তিনি সেখানে একই সঙ্গে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বলে রাখা ভাল যে ইতিপূর্বেই ১৮৯৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববি দ্যালয়ের থেকে ‘মহামহোপাধ্যায় ‘ উপাধি লাভ করেছিলেন। তিনি সমসাময়িক বঙ্গদর্শন, কল্পনা, নারায়ণ, প্রবাসী, ভারতী, ভারতবর্ষ, সাহিত্য প্রভৃতি পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। ঐ পত্রিকা গুলোতে তিনি ভারতবিদ্যাচর্চার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করতেন। যে গুলি সমৃদ্ধ করেছিল ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে। দুরুহ জ্ঞানের বিষয় কে সাহিত্যের সিগ্ন্ধ রসে জড়িত করে প্রকাশিত করে প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক। তাঁর লেখালিখির বিস্তৃত বিবরণ এ সল্প পরিসরে অসম্ভব। শুধু একটা কথা – সাহিত্যের ও সংস্কৃতির সমস্থ বিভাগই তিনি তাঁর উজ্বল মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। এই বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ ১৯৩১ সালে দেহত্যাগ করেন। 

স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২)

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা, বাংলার সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে এক উজ্জ্বল তারকা স্বর্ণকুমারী দেবী আজ প্রায় বিস্মৃত এক নাম। কিন্তু  ভারতবিদ্যাচর্চা তে তাঁর অবদান আলোচনা করলে বোঝা যাবে যে আজও তিনি কত প্রাসঙ্গিক। স্বর্ণকুমারীর জন্ম বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে ১৮৫৫ সালে। স্বর্ণকুমারীর দাদা জ্যোতিরিন্দ্র নাথ তাঁর জীবনস্মৃতি তে বলেছেন, ” আমি সন্ধ্যাকালে সকলকে একত্র করিয়া ইংরেজী হইতে ভালো ভালো গল্প তর্জমা করিয়া শুনাইতাম – তাঁহারা সেগুলি বেশ উপভোগ করিতেন। ইহার অল্প দিন পর দেখা গেল আমার কনিষ্ঠা ভগিনী শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবী কতগুলি ছোটো ছোট গল্প রচনা করিয়াছেন। তিনি আমায় সেই গল্পগুলি শুনাইতেন। আমি তাহাকে খুব উৎসাহ দিতাম। …”
   স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ বিলেত গেলে তিনি ঠাকুর বাড়ীর পিত্রালয়েই থাকতেন। সেই সময় জ্যোতিদাদা পিয়ানোতে সুর তুলতেন, আর সেই সুরে গান গাইতেন স্বর্ণকুমারীর দেবী। ১৮৭৭ সালে ঠাকুর বাড়ীর ছত্রছায়ায় যে ‘ ভারতী ‘ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার সম্পাদনা সহায়তা করেছিলেন স্বর্ণকুমারীর। পড়ে ভারতীর পূর্ন দ্বায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়ে। এরপর ১৮৮৪ থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি সফল্যের সঙ্গে সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ভারতীর পৃষ্ঠায় স্বর্ণকুমারীর বহু গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। বাঙালী মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই উপন্যাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার পথিকৃৎ ছিলেন।  তাঁর রচিত গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো, ‘ দ্বীপ নির্বাণ ‘, ‘ ছিন্ন মুকুল ‘, ‘ মালতি ‘,’ স্নেহলতা ‘,’ ফুলের মালা’,’ বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধের মধ্যে ছিলো,  ‘ পৃথিবী ‘,’ ঐতিহাসিক রচনার মধ্যে ছিলো, ‘ হুগলির ইমামবাড়া ‘,’ বিদ্রোহ ‘, রাজনৈতিক উপন্যাস ‘ মিবার রাজ ‘।
   ইংরেজি সভ্যতা ও সাহিত্যের সাথে আমাদের যোগাযোগের পর বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যে নব জাগরণের সুচনা হয়েছিল তাতে দেশের মহিলা সমাজের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন স্বর্ণকুমারী। তাঁর সাহিত্য চর্চার মধ্যে দিয়েই ব্যক্ত হয়েছিল ভারতবিদ্যার অনুষঙ্গ। সেই সূত্রেই ধরা পড়ে যে স্বদেশ প্রেমই ছিল তাঁর সাহিত্য সাধনার উৎস। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি জড়িত ছিলেন নানা সামাজিক কর্মকান্ডে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ সখী সমিতি ‘ ; এর দুটিই উদ্দেশ্য ছিলো: এক, বিধবা ও অনাথ বঙ্গললনাদের সাহায্য করা এবং দুই, তাঁদের শিক্ষার প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা। শিল্পক্ষেত্রে নানান কাজ কর্মের মধ্যে তাঁদেরকে নিয়োজিত করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। একথা বলা হয়তো অত্যুক্তি হবে না যে বঙ্গজাগরণের মূল স্রোতে বঙ্গরমনীদেরকে আনার ব্যাপারে তাঁর অবদান নি:সন্ধেহে অনস্বীকার্য।
   তাঁর দীর্ঘ কর্মবহুল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৩২ সালে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির সব দিক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একথা বলা যেতেই পারে যে সে কালের নারী সমাজের সাহিত্য ও সংস্কৃতির কীর্তি বিষয়ে তিনি শুধুমাত্র অগ্রণীই ছিলেন না, ছিলেন শ্রেষ্ঠও। আসলে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার প্রখর দীপ্তির কাছে তাঁরই জেষ্ঠা ভগিনীর কীর্তি কিঞ্চিৎ ম্লান হয়ে পড়েছিল, তা অস্বীকার করা যায়না। 

প্রমথনাথ বসু (১৮৫৫ – ১৯৩৪)

সত্যেন বসুর বিজ্ঞান সাধনাকে যাঁরা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন বিজ্ঞানী প্রমথনাথ বসু। বিজ্ঞান সাধনার মধ্যে দিয়েই তিনি স্বদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে যে অবদান রেখেছিলেন তার মধ্যে অভিব্যক্ত তাঁর ভারতবোধ, স্বদেশ ভাবনা। জন্মেছিলেন বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণা জেলার গোবরডাঙ্গায় ১৮৫৫ সালের ১২ মে। স্থানীয় হাই স্কুলে তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনার সূচনা। মেধাবী প্রমথনাথকে মাত্র নয় বছর বয়সে ঠাকুরদা নবকৃষ্ণ বসু কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন।
   ১৮৭০ সালেই তিনি এন্ট্রান্স এ বসার যোগ্য হয়েছিলেন কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। ইত্যবসরে তিনি লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ আকাশ কুসুম ‘। এটা ছিল সত্যিই অভাবিত। এর পর এন্ট্রান্স পরীক্ষার সময় শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর মেধার স্বাক্ষর তিনি একদম প্রথম থেকেই রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে তিনি মনস্থ করেছিলেন বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনার জন্য বিলেতে যাবেন। এরই ফলশ্রুতি, তিনি সেই সময়ের কঠিন বৃত্তি পরীক্ষা গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ লাভ করেছিলেন। এর আগে মাত্র দুই জন এই বৃত্তি পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এস. সি. ডিগ্রী লাভ করেন।
   লন্ডনে থাকাকালীন তিনি রয়াল স্কুল অফ মাইনস এ ভর্তি হয়েছিলেন। এই বিষয়ে পাঠ নেওয়ার সময় তিনি ভারতের আর্য সভ্যতা নিয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখে ইতালী সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই সময় থেকেই তাঁর মনে ভারতচর্চার আগ্রহ জাগে। একদিকে বিজ্ঞান সাধনা অন্যদিকে স্বদেশবিদ্যাচর্চা পাশাপাশি চলতে থাকে। বিলেতে ভারতবর্ষের উন্নতির জন্য গঠিত ইন্ডিয়া সোসাইটির সম্পাদক মনোনীত হয়েছিলেন মাত্র ২৪ বছর বয়সে। সেখানে তিনি ব্রিটিশ শাসনের কু দিক গুলি সম্পর্কে তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্য তুলে ধরতেন। এই জন্য ব্রিটিশরা তাকে ভূতত্ত্ব বিভাগে চাকরি দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
   ভূতাত্বিক প্রমথনাথ ১৮৮০ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে যোগদান করেছিলেন। এই চাকরি করার ইত্যবসরে লিখে ফেললেন তিন খন্ডে বিখ্যাত গ্রন্থ A History of Hindu Civilization Under British Rule. এই গ্রন্থ ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক আকর হিসাবে বিবেচিত। এই গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ভারতবিদ্যাচর্চায় তাঁর অসাধারণ দক্ষতা।
   এর পাশাপাশি দেশব্রতি হিসাবেও তিনি ছিলেন এক অসাধারন মানুষ। এশিয়াটিক সোসাইটির শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সোসাইটির ১০০ বছরের মূল্যায়ন করে যে স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার বিজ্ঞানখন্ডটি রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এই বিজ্ঞান সাধক। বিজ্ঞান লেখনীর মধ্যে দিয়েও তিনি স্বদেশ ব্রতের দীক্ষা দিয়েছিলেন। দেশের কারিগরী শিক্ষা প্রসারেও তিনি ছিলেন অগ্রনী পুরুষ। বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার কাজেও তাঁর অবদান সর্বজন বিদিত।
   সফল কর্মজীবনের নানা জায়গায় তাঁর স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেও সাধারণ বাঙালির কাছে তিনি আজ প্রায় বিস্মৃত। এই মহান ব্যাক্তিত্ব ১৯৩৪ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর সম্পর্কে বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু যা বলেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক: ” জগদীশচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্র দেশ বিখ্যাত বিজ্ঞানী। এদের আগে আর একজন বাঙালি বিলেত থেকে কৃতবিদ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন। তিনি ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসু। প্রমথনাথের জীবনধারা কালে কালে তাঁকে বাঙলা দেশের পূর্বাচার্যদের সমআসনে উঠিয়েছিল। ” 

ভারতবিদ্যা সাধক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যার্ণব (১৮৬১-১৯১৮)

শ্রীশচন্দ্রের কৌলিক পদবী বসু হলেও নামের শেষে প্রাপ্ত উপাধি বিদ্যার্ণব দিয়েই তিনি অধিক পরিচিত। খুলনা জেলার বাসিন্দা পিতা শ্যামাচারণ বসু কর্মসূত্রে অবিভক্ত ভারতের লাহোর শহরে, সেখানেই শ্রীশচন্দ্রের জন্ম ১৮৬১ সালে। অল্প বয়সে পিতৃহারা হয়ে মায়ের অধীনেই তাঁর লেখাপড়া শুরু। মেধাবী শ্রীশচন্দ্র ১৮৭৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তৃতীয় হন। ১৮৮১ সালে স্নাতক হন। এরপর লাহোরের একটি সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। ইতিমধ্যে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মিরাট শহরে আইন ব্যবসায় নিযুক্ত হন।
   আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সময় হিন্দু আইন সম্পর্কে জানার জন্য সংস্কৃত শিখে নেন এবং মনু, পাণিনি প্রমুখের আইন বিষয়ক বই গুলি অধ্যয়ন করেন। সেই সঙ্গে জার্মান ভাষাও ভালো করে তিনি জানতেন। ১৮৮১ সালে অস্ত্যাধ্যায়ী ব্যাকরণ ইংরিজিতে অনুবাদ করেন। ফলে একজন প্রাচ্যবিদ্যা পণ্ডিত হিসাবে তাঁর খ্যাতি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। চলতে থাকে একদিকে আইন ব্যবসা অন্য দিকে ভারতবিদ্যাচর্চা।
   এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। গাজীপুরে থাকার সময়ে বিচারের জন্য একটি মামলা এসেছিল যার রায় দেবার জন্য তাঁকে বিভিন্ন মুসলমান প্রধান দেশ গুলোর নানা ধর্ম শাস্ত্র পাঠ করতে হয়েছিল। আরবী ভাষা জানা থাকায় তিনি ওই সব গ্রন্থ মুলে পাঠ করে ছিলেন। মামলাটির মূল বিষয় ছিল সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলিম দের সঙ্গে ওয়াহাবীরা একসাথে নামাজ পড়ার অধিকার আছে কিনা। যেহেতু তিনি ইতিমধ্যেই সব মুসলিম ধর্ম শাস্ত্র গুলি পাঠ করেছিলেন তাই তিনি তার ভিত্তিতে রায় দিলেন সমস্ত ধরণের মুসলিম দেরই নামাজ পড়ার অধিকার আছে। সেদিনের রায় ভারতের আইনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
   তিনি পাণিনি কার্যালয় থেকে হিন্দু শাস্ত্রের দুর্লভ সব অপ্রকাশিত গ্রন্থ Sacred Books of the Hindus নামে একটি সিরিজের মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সিরিজের বেশিরভাগ রচনায় ছিল তাঁর। দারাশিকোর lekha’ ইবন শাজাহান ‘ তিনি মূল ফারসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। বিরামহীন জ্ঞানচর্চায় অতিবাহিত করে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ১৯১৮ সালে তিনি মারা যান। 

প্রথম বাঙ্গালী মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়

যে বছর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন সেই বছরেই ১৮৬১ তে ৮ ই মে জন্মেছিলেন আরেকজন বিখ্যাত বাঙ্গালী মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। তবে বাঙ্গালী মননে তিনি এখন বিস্মৃত প্রায়। কাদম্বিনী জন্মেছিলেন বিহারের ভাগলপুরে এক শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্ম পরিবারে। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পরিবার বহরমপুরে চলে আসে। ১৮৭৪ সালে তিনি কলকাতায় পড়তে গিয়ে তিনি ভর্তি হন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে যা বেথুন স্কুল নামে পরিচিত হয়। এই বেথুন স্কুলেই তাঁর সাথে পড়তেন স্বর্ণ কুমারী দেবী, অবলা দাস প্রমুখ।

বেথুন স্কুলে তিনি সাহিত্যর বিষয় গুলি ছাড়া বিজ্ঞানেও ভালো নম্বর পেয়েছিলেন। সরকার তাঁকে বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিল এই শর্তে যে সে এফ. এ. পড়বে। কাদম্বিনীতো এক কথায় রাজি। তাঁর জন্যই সেদিন বেথুন স্কুলে এফ. এ. ক্লাস খোলা হয়েছিল। এই কৃতিত্ব তাঁকে ভাওয়াল রাজের কাছ থেকে স্বর্ণ পদক এনে দিয়েছিল। এরপর ১৮৮৩ সালে তিনি বেথুন কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করলেন। তিনিই প্রথম মহিলাদের মধ্যে স্নাতক উত্তীর্ণ। আর তাঁর সঙ্গে ছিলেন চন্দ্রমুখী বসুও।
   কাদম্বিনী যখন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের ছাত্রী তখন তাঁর সাথে আলাপ হয় সমাজ সংস্কারক ও নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় এর। পরবর্তীতে তাঁরা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঢাকা থেকে  অবলাবান্ধব  পত্রিকা প্রকাশ করলে কাদম্বিনী সেখানে নিয়মিত লিখতেন। নারী সমাজের মুক্তির জন্য তাঁর তীব্র নিবন্ধ গুলির জন্য তিনি বিখ্যাত মানুষদের কাছেও আদর্শ হয়ে ওঠেন। দ্বারকানাথ তাঁর স্ত্রীর কে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য উৎসাহিত করেন। কিন্তু প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনীর মেডিক্যাল পড়ার রাস্তা সহজ ছিল না। বহু বাঁধা- বিপত্তি পার হতে হয়েছিল। কলেজের ডাক্তাররাই নানা অজুহাতে তাঁকে মেডিক্যাল পড়তে না পারে সেই যুক্তিই সাজান। কিন্তু সেই সময় বাংলার ছোটোলাট রিচার্ড টমসন মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের আপত্তি উপেক্ষা করে মেডিক্যাল কলেজের মেয়েদের ডাক্তারী পড়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। যাইহোক, ছেলেদের সঙ্গে পূর্ন আত্ম মর্যাদা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে ১৮৮৮ সালে তিনি কলেজের শেষ পরীক্ষায় বসলেন। কিন্ত সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেলেও মেডিসিনের প্রাকটিক্যালে তিনি প্রয়োজনের থেকে এক নম্বর কম পেলেন। শোনা যায় একাজ করে ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের এক বাঙালি ডাক্তার রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র যিনি কাদম্বিনীর ডাক্তারী পড়াতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেলেন। শেষপর্যন্ত তাঁকে M.B. উপাধী না দিয়ে G.B.M.C.উপাধী প্রদান করা হয়। যাই হোক সেই যুগে তীব্র বাঁধার পাহাড় ঠেলে কাদম্বিনী প্রথম বাঙ্গালী মহিলা ডাক্তার হতে পেরেছিলেন।
   ডাক্তার হয়ে তিনি প্রথমে লেডি ডাফরিন হাসপাতালে যোগদান করেন। কিন্তু M.B. ডিগ্রী না অর্জন করার বেদনা তাঁকে দমাতে পারেনি। তিনি সদ্যজাত শিশু সন্তানের দায়িত্ব তাঁর স্বামীর কাছে দিয়ে ১৮৯২ সালে তিনি লন্ডনে গেলেন। এডিনবরা গ্লাসগো এবং ডাবলিন থেকে চিকিৎসা বিদ্যায় বেশ কিছু উপাধি পাবার পর ১৮৯৩ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি আবার লেডি ডাফরিনেই যোগ দিলেন। ডাক্তারী করার ফাঁকে ফাঁকে তিনি সমাজ, মেয়েদের সমস্যা , অন্যান্য সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখালিখি করে গেছেন। সেগুলি বিভিন্ন পত্র পত্রিকা তে প্রকাশিত হতো।
   তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলেও বিত্তহীন মানুষদের জন্য প্রতিদিন একঘন্টা তাঁর বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকে তাঁদের পরীক্ষা করে প্রয়োজনে বিনামূল্যে ওষুধপত্রও দিয়ে যেতেন। কর্ম এবং সামাজিক উভয় জীবনেই তিনি হয়েছিলেন নানা বৈষম্যের শিকার। কিন্তু অসম্ভব ব্যাক্তিত্ব মর্যাদা জ্ঞানের অধিকারি কাদম্বিনী সব সময়েই মাথা উঁচু করে নিজের আদর্শ অনুযায়ী অভীষ্ট লক্ষের দিকে এগিয়ে গেছেন।
      তাঁর সম্পর্কে কামাখ্যপ্রসাদ গুহ লিখেছিলেন,”  অসম্মানজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি সারাটা জীবন। কিন্তু মেধা, প্রত্যয় এবং স্তৈর্য নিয়ে এই বিরুদ্ধ স্রোতকে বারে বারে পরাজিত করেছেন। তাঁর জীবনের শেষের দিনটিও উজ্জ্বল (৩ অক্টোবর ১৯২৩)। একটি কঠিন অপারেশন শেষ করেছেন সফল। তার পরেই চিরশান্তি”। 

প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ মনমোহন চক্রবর্তী

প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব ছিলেন মনমোহন চক্রবর্তী, জন্মেছিলেন তৎকালীন চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতে ১৮৬৩ সালে। পিতা দ্বারিক চন্দ্র ছিলেন শিক্ষা বিভাগের একজন আধিকারিক। পিতার চাকরীর সূত্রে তিনি উড়িষ্যার কটকের বিখ্যাত রভেনসন কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স উত্তীর্ণ হন এবং পরে ওই কলেজ থেকেই স্নাতক হন। এরপর তিনি কলকাতায় ফিরে  আসেন। তিনি প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  কটকেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত থাকেন বেশ কিছুদিন। জীবনের প্রাথমিক পর্যায় উড়িষ্যায় থাকার জন্য তাঁর মনে ওখানকার প্রাচীন ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি একটা অনুরাগ জন্মেছিল। আর সেটাই তাঁর ভবিষ্যত প্রাচ্যবিদ্যা তথা ভারত বিদ্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলো। তিনি উড়িষ্যার প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে চর্চা করেছিলেন।
    এই বিষয়ে তাঁর পূর্বসুরী ছিলেন, এন্ড্রু স্টার্লিং, উইলিয়াম  হান্টার, রাজেন্দ্র লাল মিত্র ও রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পূর্বসূরীরা অনেকেই ‘মাদলাপঞ্জির ‘ উপর নির্ভর করে ওড়িষা চর্চা করেছেন, তাঁর ওড়িষা বিষয়ক চর্চা ছিল একটু ভিন্ন পথে । মাদলাপঞ্জি হলো,পুরির জগন্নাথ দেব মন্দিরের পূজারীদের দ্বারা পুরুষানুক্রমে লিখিত ও রক্ষিত বিবরণ। এটি উড়িষ্যার প্রাচীন ইতিহাসের অন্যতম উপকরণ। তিনি মাদলাপঞ্জি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর না করে তামর শাসন, শিলালেখ, প্রাচীন পুঁথি এই সব প্রামাণ্য ঐতিহাসিক উপকরণের উপর নির্ভর করেছিলেন। যার ফলে তাঁর ইতিহাস অন্বেষণ ছিল যুক্তিসঙ্গত। ফলত, উড়িষ্যার সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চার ইতিহাস রচনায় তিনি ছিলেন অগ্রদূত। এখানেই তিনি নিজের প্রতিভার পরিচয় বহন করেছেন। 
    ১৮৯২ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তিনি উড়িষ্যা বিষয়ে সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল ও প্রাচীন সাহিত্য সম্পর্কে অজস্র নিবন্ধ রচনা করেছেন। কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে উড়িয়া ভাষাতে এম, এ. পাঠক্রম শুরু হলে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তাঁর যত প্রবন্ধ বেরিয়েছিল সেগুলিকে সংকলন করে বিশ্ববিদ্যালয় ‘Notes on the Language and Literature of Orissa” নামে অবশ্য পাঠ্য বইয়ের তালিকায় রাখা হয়েছিল।  এছাড়াও তিনি ‘History of Mithila during Pre Moghul Period’ নামে উৎকৃষ্ঠ মনের একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ‘Sanskrit Literature in Bengal during Sen Rule’ আর একটি ভারত চর্চা  বিষয়ক মূল্যবান প্রবন্ধ। তিনি নব্য ন্যায়ের ইতিহাস চর্চার সঙ্গে মনমোহন বাংলা ও স্মৃতি শাস্ত্রের চর্চা সম্বন্ধে গবেষণা করে ১৯১৫ সালে লিখেছিলেন ‘History of Navya Naya in Bengal and Mithila’. শুধু এদেশে নয়, বিলেতের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তিনি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সাংস্কৃতির উপর একাধিক নিবন্ধ লিখেছেন।
   ১৯১৪ সালে বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি সরকার কতৃক ‘ রায়বাহাদুর ‘ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।  এই বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ ১৯১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন। 

মহামহোপাধ্যায় প্রমথনাথ তর্কভূষণ (১৮৬৫-১৯৪৪)

উনিশ শতকের শেষার্ধে কিঞ্চিৎ অপরিচিত এক বাঙালি ভারতবিদ্যাচর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রমথনাথ তর্কভূষণ। প্রমথনাথের জন্ম উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ার এক বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৬৫ সালে। তাঁর পিতা তারাচরণ তর্করত্ন ছিলেন কাশি মহারাজের প্রধান পণ্ডিত। প্রমথনাথের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ভাটপাড়ার চাতুষ্পটিতে। সেখান থেকে কাব্যের পরীক্ষায় সফল হবার পর তিনি ধর্মশাস্ত্র, সাংখ্য দর্শন, ন্যায়শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। জানার প্রবল আগ্রহে  তিনি ১৮ বছর বয়সে কাশী গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি সাক্ষাৎ করলেন তখনকার দিনের বিখ্যাত পণ্ডিত স্বামী বিশুদ্ধানন্দর সঙ্গে। তিনি স্বামীজির কাছে নিজের মনের কথা খুলে বললেন, যে এক দিকে জ্ঞানতৃষ্ণা অন্যদিকে পারিবারিক দ্বায়িত্ব সামলানো। তিনি প্রমথনাথকে সেখানকার সংস্কৃত পাঠশালার শিক্ষক নিযুক্ত করলেন।এইভাবে তিনি অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করে স্বামী  বিশুদ্ধানন্দর সঙ্গে গভীর শাস্ত্র আলোচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ক্রমে  ক্রমে তিনি ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন এবং একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত হিসাবে সমগ্র ভারত জুড়ে তাঁর কর্মকাণ্ডের খ্যাতি বিস্তৃত ছিল।কাশীর পণ্ডিত সমাজ প্রমথনাথকে ‘ তর্কভূষণ ‘ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
    এই সময় তিনি সংস্কৃতে কয়েকটি খন্ডে কাব্যও রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে ‘ রাস রসো দয়ম ‘ এবং শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ চরিতম ‘ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কাশী থাকাকালীন প্রমথনাথ তাঁর গুরু স্বামী বিশুদ্ধানন্দর সঙ্গে কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়েছিলেন সেখানকার মহারাজের আমন্ত্রণে। এই ভ্রমণ নিয়ে তিনি ‘ জন্মভুমি ‘ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে বাংলাতে কয়েকটি সংখ্যায় লিখেছিলেন। এখানে তিনি ভূস্বর্গের অপূর্ব বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন।
   কাশী থেকে কলকাতায় ফিরে এসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল বিপ্লবী ‘ ডন সোসাইটির ‘।  এমনকি যোগাযোগ ঘটেছিল স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গেও। তাঁরই প্রেরণায় তিনি বেলুড় মঠের মুখপত্র  ‘ উদ্ধোধন ‘ এ গীতার বঙ্গানুবাদ ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির অনুরোধে তিনি জিমুত বাহনের লেখা ‘ কাল বিবেক ‘ এবং হিমাদ্রী রচিত ‘ চতুর্বর্গ চিন্তামনি ‘ গ্রন্থের সম্পাদনা করেছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি বেশকিছু সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।
    তিনি দীর্ঘদিন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯১১ সালে ভারত সরকার তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রমথনাথকে  ‘ মহামহোপাধ্যয় ‘ উপাধী তে ভূষিত করে। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর অনুরোধে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন কিন্তু এইজন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। তাঁর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো হিন্দু ধর্মের সংস্কার সম্পর্কিত বেশ কিছু নিবন্ধ। যেগুলি ‘ সনাতন হিন্দু ‘ নামে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছে। । এই মহান ব্যাক্তিত্ব ১৯৪৪ সালে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। ভারতবিদ্যচর্চায় তাঁর অনবদ্য অবদান আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে উচিত। 

মহামহোপাধ্যায় সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ (১৮৬৯-১৯২০)

ভারতগৌরব সতীশচন্দ্র বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খানকুলা গ্রামে ১৮৬৯ সালে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম পীতাম্বর বিদ্যাবাগীশ। তাঁদের কৌলিক পদবী ছিল আচার্য। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। আর্থিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। গ্রামের প্রাথমিক পাঠ শেষ করে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস নবদ্বীপে চলে আসেন। সেখানকার হিন্দু স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ  হন। সেই সময় নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজের দ্বারা আয়োজিত এক বিশেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি বিদ্যাভূষণ উপাধি অর্জন করেছিলেন।

   ১৮৯৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করার পর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারী কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। একই সঙ্গে তাঁর নিজস্ব পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি সেই সময় নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছ থেকে কাব্য ও ন্যায় শাস্ত্রের উপর পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। এই অধ্যাপনায় থাকাকালীন সময়ে বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটির অনুরোধে সরকারী কর্তৃপক্ষ তাঁকে দার্জিলিং পাঠিয়েছিল। এই প্রবাস জীবন তাঁর কাছে আশীর্বাদের মতো হয়েছিল। ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত দার্জিলিং এ অবস্থানকালে তিনি সেখানকার তিব্বত পরিব্রাজক ও বৌদ্ধ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত শরৎচন্দ্র দাসের সঙ্গে যৌথভাবে ইংরেজি – তিব্বতী অভিধান সংকলন করেছিলেন। দার্জিলিং থাকাকালীন অবস্থায় তিনি সেখানে অবস্থানরত এক তিব্বতী লামা পন্ডিতের কাছ থেকে তিব্বতী ভাষাটা ভালোভাবে রপ্ত করে নেন, যা তাঁর পরবর্তী সারস্বত সাধনায় ভীষণভাবে কাজে লেগেছিল।

দার্জিলিং থেকে ফিরে আসার পর তার কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা হয় কলকাতার সংস্কৃত কলেজ।  সেই সময় কলকাতায় শ্রীলঙ্কা ও ব্রহ্মদেশের কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন, যাদের কাছ থেকে তিনি পালি ভাষাটাও রপ্ত করে নেন। ঠিক এই সময়েই স্যার আশুতোষ এর উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি তে এম. এ.  চালু হলে সতীশচন্দ্র এম.এ., পালিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এখানে একটা জিনিষ মনে রাখা দরকার যে সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিতে কোনো উপযুক্ত পরীক্ষক না থাকায় উত্তরপত্রগুলি সব লন্ডনে বিখ্যাত পালি বিশেষজ্ঞ স্যার রিজ ডেভিস এর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি সতীশচন্দ্রর উত্তরপত্র পড়ে তাঁর পালি ভাষার পান্ডিত্যে অভিভূত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে এক চমৎকার পত্র লেখেন সতীশচন্দ্রের প্রশংসা করে। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বদলি হয়ে আসেন। ইতিমধ্যে তাঁর বৌদ্ধ, পালি এবং সংস্কৃতে মূল্যবান ভারতবিদ্যা বিষয়ক রচনা দেশ – বিদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।
  

তাঁর সম্পাদনায় বিখ্যাত Indology: Past, Present and Future ‘  সারা ভারত জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ছিল, A History of Indian Logic , যেখানে তিনি অতীব যত্ন সহকারে যুক্তি তর্কের জটিল বিষয়ের সহজ সরল ভাষ্য প্রদান করেছিলেন। ভারতে, বিশেষত বৌদ্ধ ও পালি সাহিত্য ও দর্শনের উপর তিনি ব্যুৎপত্তির পরিচয় রেখেছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন।
   সতীশচন্দ্র ভারতবিদ্যা চর্চার ধারাটিকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মূল চর্চার কেন্দ্রে ছিল কাব্য, দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অটুট ছিলো। সেখানে বাংলা এবং ইংরেজীতে বহু মূল্যবান প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। সতীশচন্দ্র ১৯২০ সালে মাত্র একান্ন বছর বয়সে ইহজগত ত্যাগ করেন। 

ইতিহাসাচার্য স্যার যদুনাথ সরকার (১৮৭০ – ১৯৫৮)

( প্রাককথন: ভারতবিদ্যাচর্চা কলামে আজ যার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হবে তিনি পুরোনো দিনের একজন শুধু  ভারতখ্যাত নয়, বিশ্বেও তাঁর কীর্তি সমাদৃত। বর্তমানের  স্কুল কলেজে ইতিহাস পড়ুয়া ছাত্র -ছাত্রীরা এই আদর্শনিষ্ঠ ও পন্ডিত  ঐতিহাসিকের  সারস্বতসাধনা সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। অথচ তাঁর সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে যদি অবহিত হয়  তাহলে আমাদের পড়তে পড়তে  বিষ্ময় জাগাবে। একজন ইতিহাসের সাধরণ ছাত্র ও মাষ্টারমশাই হিসাবে তাঁর সম্পর্কে একটি দীর্ঘ আলোচনা করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। তাই কিছু কিছু করে কয়েকটি পর্বে  স্যার যদুনাথ সর্ম্পকে লিখব।)

প্রথম পর্ব 

বাংলাদেশের রাজশায়ী জেলার করচামারিয়ার জমিদারবাড়িতে যদুনাথের জন্ম হয় ১৮৭০ সালের ১০ ডিসেম্বরে। পিতা রাজকুমার সরকার গ্রামের বাড়িতে একটি ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন প্রধানত ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের বই সংগ্রহ করে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজকুমারকে রাজশাহীর ব্রাহ্মসভার ট্রাস্টি নিযুক্ত করেছিলেন। সেই সূত্রে পুত্র যদুনাথের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তবে সেই সম্পর্ক পরবর্তীতে শিথীল হয়ে গিয়েছিল নানা কারণে।
   যদুনাথ গ্রামের স্কুলে প্রথম পাঠ নেন।সাতবছর বয়সে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এক বছরের আগেই তিনি কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। কোলকাতায় থাকাকালীন রাজকুমার যদুনাথকে নিয়ে দেবেন ঠাকুরের কাছে যান। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ১৮৮৭ সালে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন এবং স্কলারশিপ পান। ১৮৮৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় হিন্দু হোস্টেলে তাঁর সহ আবাসিক ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার সুরেশ চক্রবর্তী। তাঁর প্রেরনায় যদুনাথ ফুটবলে আকৃষ্ট হন। তিনি বাল্যবয়সে রুগ্ন ছিলেন, ফুটবল খেলার দৌলতে তাঁর স্বাস্থ্য সুদৃঢ় হয়। যাইহোক তিনি ইংরেজি ও ইতিহাস নিয়ে বি. এ. পরীক্ষা দেন ১৮৯১ সালে ইতিহাসে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় হন। ১৮৯২ সালে ইংরেজি এম. এ. পরীক্ষার সঙ্গে দেখা যায় যে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনটি পেপারে তিনি গড়ে নব্বয় শতাংশের বেশি নম্বর পান।ব্রিটিশ সরকার তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ডের জাওয়ার বৃত্তির প্রস্থাব পেলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।এর পর তিনি পাঁচ বছর পড়াশোনা করেন এবং পি.আর.এস. স্কলারশিপ পান। বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করে তিনি একটি থিসিস লেখেন ‘India of Auranzeb ‘ (১৯০১) নামে।
    ইতিমধ্যে এম. এ. পাশ করে তিনি ১৮৯৩ সালে রিপন কলেজে (এখনকার সুরেন্দ্র নাথ কলেজ) ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এরপর তিনি রিপন কলেজ ছেড়ে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন এ ১৮৯৬ সালে যোগ দেন। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে বৃত্তির থিসিসের পরবর্তী অংশের কাজ করতে থাকেন। কি অসাধারণ ধীশক্তি যদুনাথের , যে অধ্যাপনা করছেন ইংরেজি সাহিত্যের আর গবেষণা করছেন ইতিহাসের। ১৮৯৮ সালে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে মনোনীত হয়ে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন। কিন্তু পরের বছর তিনি বদলি হয়ে পাটনা কলেজে চলে যান। তারপর বছর খানেক বাদে তিনি আবার প্রেসিডেন্সীতে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে ১৯০১ সালে তার প্রথম বই ‘India of Aurenzeb’ প্রকাশিত হলে ঐতিহাসিক মহলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পাটনা কলেজে পড়ানোর পর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। কিন্তু দুবছর যেতে না যেতে সেখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মর্মাহত হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। এরপর তিনি আবার ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের মধ্যে দিয়ে কটকের বিখ্যাত র‍্যাভেনশন কলেজের একই সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। মজার ব্যাপার হলো হলো একই সঙ্গে তিনি বাংলাও পড়াতেন। বর্তমান সময়ে যা ভাবায় যায় না। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন আবার ইতিহাসেও অসাধারণ ব্যুৎপত্তি প্রদর্শন করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি  দুইটি বিষয়ে ক্রমাগত নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ইতিমধ্যে জোরকদমে তাঁর ইতিহাস গবেষণার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে পাটনাতে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯২৬ সালে পাটনা কলেজ থেকে তিনি প্রত্যক্ষ শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর পুরোপুরি পেশাদার ঐতিহাসিক হিসাবে তিনি ইতিহাস গবেষণা কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রকাশিত হতে থেকে একের পর এক বিখ্যাত ইতিহাস গবেষণা গ্রন্থ। এগুলির মধ্যে তাঁর ভারতবিদ্যাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।           

দ্বিতীয় পর্ব 

আমরা আগের পর্বে স্যার যদুনাথের কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা দেখব তাঁর ব্যক্তিজীবনের বিশেষত জীবন সায়াহ্নের অবস্থা। পাঠকের কাছে এটা ধান ভাঙতে শিবের গীত মনে হতে পারে। কিন্তু কিছু মানুষের ব্যক্তিজীবন অবগত না হলে এটা অবহিত হওয়া যায়না যে একটা মানুষ কি অসহনীয় শোক – বেদনাজর্জর অবস্থার মধ্যেও সারস্বত সাধনার সর্বোচ্চ শিখরে বিরাজ করেছিলেন। এ দিক দিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেকটা মিল পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের। যদুনাথ ছিলেন রবীন্দ্র নাথের সমসাময়িক এবং প্রথম জীবনে দুজনের মধ্যে ছিল অতীব সখ্যতা। এটা হয়তো অনেকেই জানেন না যে রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনার সর্বপ্রথম ইংরেজী অনুবাদ করে ছিলেন যদুনাথ।

    যদুনাথ ছিলেন অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ, প্রচন্ড পরিশ্রমী, ভীষন নিয়মানুবর্তি এবং সময়ানুবর্তি। তাঁর দীর্ঘ ৮৮ বছরের জীবনে বহু শোক – তাপ পেয়েছেন। এর মধ্যেও আপন কর্তব্যে তিনি ছিলেন অবিচল। যদুনাথের বাবার মৃত্যু হয়েছিল যদুনাথের ছোটোবেলায়। তাঁরা ছিলেন দুই ভাই। তাঁর বড় দাদা অনেক আগেই মারা যান। যদুনাথ লিখেছেন, তাঁর মা মৃত্যুর আগে নানান শোক পেয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শেষের দিকে একাধিক নিকট জনের মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করেছিল। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি। যদুনাথের জামাই হঠাৎ মারা যান সাতটি মেয়ে রেখে, যাদের প্রতিপালন করেছিলেন যদুনাথ। ১৯৪১ এর দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উনার আরেক জামাই সুশীল কুমার ঘোষ সিঙ্গাপুরের কাছে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তিনি  সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ১৯৪৩ সালে জানা যায় যে জামাই জাপানিদের হাতে জাভাতে বন্দী আছেন। কিন্তু সিঙ্গাপুরের ইংরেজ শাসন সুশীল বাবুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন ১৯৪৫ সালের ১৪ নভেম্বর। যদুনাথ সিঙ্গাপুরের নিকটে পমপম দ্বীপের আসেপাশে খোঁজ নেবার ব্যাবস্থা করেন কিন্তু যুদ্ধের পর ঐসব জায়গা এমন দুর্গম হয়ে যায় যে খোঁজ নেওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। তাঁর জামাই তিনটি নাবালক পুত্র রেখে যান।
    এখানেই পারিবারিক বিপর্যয়ের শেষ নয়, স্বাধীনতার আগের বছর ১৬ আগষ্ট ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। পার্কসার্কাস অঞ্চলে ব্যাপক লুঠপাঠ শুরু হয়। যদুনাথের নাতির হোস্টেল দাঙ্গাবাজদের দ্বারা আক্রান্ত হলে সে কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচে। এই দাঙ্গায় যদুনাথের বড় ছেলে বলি হন। এর কিছু দিনের মধ্যে ছোট ছেলেও ঐ দাঙ্গায় মারা যান। ওর বিশেষ প্রিয় ছোট মেয়ে রমা ইংল্যান্ডে গবেষণারত অবস্থায় অকস্মাৎ মারা যান। যদুনাথের স্ত্রী শেষ জীবনে আমৃত্যু শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। একের পর এক বিপর্যয়, কয়েক বছর বাদে ১৯৫৪ সালে তাঁর ভাইপো ড. জগদীশ চন্দ্র সিংহ ( প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক ছিলেন) মোটর দুর্ঘটনায় মারা যান। উনি যে খুব মর্মাহত হয়েছিলেন সেটা তাঁর বন্ধুবর ঐতিহাসিক রঘুবীর সিংকে লেখা পত্র থেকে জানা যায়। মৃত্যু মিছিলের এখানেই শেষ নয়; ১৯৫৭ সালে যদুনাথ তাঁর নাতি অমিত সরকারকে হারান। অমিত পুনেতে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যান। ১৯৫৭ সালের ২০ এপ্রিল একটি চিঠিতে যদুনাথ দুঃক্ষ করে লিখেছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় বংশধরেরা আগেই গিয়েছে; এখন তৃতীয় প্রজন্মরা যাচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন মৃত্যু শোক তাঁকে বিহ্বল করলেও কর্তব্যচ্যুত করতে পারেনি। এতো শোক যন্ত্রনার মধ্যেও তিনি মধ্যকালীনভারত ইতিহাসের একের পর এক গবেষণাধর্মী মনিমুক্ত আমাদের উপহার দিয়েছেন, যা ভারতবিদ্যাচর্চাতে অমূল্য সংযোজন ঘটিয়েছেন। সমৃদ্ধ হয়েছে অগণিত ঐতিহাসিক, গবেষক, ছাত্র এমনকি ইতিহাসের বাইরে সাধারণ পাঠক। পরবর্তী কিস্তিতে সেই বৃত্তান্তের অবতারণা করা হবে। 

শেষ পর্ব 

এই পর্বে স্যার যদুনাথের প্রধান গ্রন্থগুলির পরিচয় দেওয়া যেতে পারে। ১৯০১ সালে প্রকাশিত India of Aurangzib নামক গ্রন্থে তিনি মুখ্যত মুঘল শাসনাধীনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বিবরণ, রাজস্ব সংক্রান্ত তথ্যাবলী, পথঘাট ইত্যাদি সর্ম্পকে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। এই ব্যাপারে তাঁর প্রধান সহায়ক উপাদান ছিল, ফার্সি রচনা। যদুনাথ খুব ভালো ফার্সি ও উর্দু জানতেন। যার ফলে তিনি মূলে গিয়ে কোনো বিষয়ের সত্য আহরণে সক্ষম হয়েছিলেন।কারণ মধ্যযুগের ইতিহাস নির্মাণে উর্দু বা ফার্সি জানা একান্ত প্রয়োজন ছিল। আকবর ও ঔরঙ্গজেবের তুলনামূলক আলোচনাও এ গ্রন্থের অন্যতম উপজীব্য। মোঘল যুগ সর্ম্পকে গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর পরবর্তী সুবিখ্যাত গ্রন্থ History of Aurangzib এ। পাঁচ খন্ডে এই গ্রন্থ সমাপ্ত হয়েছে। মুঘল ইতিহাসের উপর এ এক আকরগ্রন্থ। প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে ঔরঙ্গজেবের জন্ম অর্থাৎ ১৬১৮ থেকে তাঁর রাজ্যভিষেকের কাল ১৬৫৯ সাল পর্যন্ত ভারত ইতিহাসের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। ঔরঙ্গজেবের পুরো রাজত্বকালের আলোচনা পরবর্তী তিন খন্ডের বিষয়বস্তু। মুঘল ইতিহাসের এই মহাগ্রন্থ রচনার সময় তিনি মোঘল যুগের রাজভাষা, ফার্সিতে রচিত সমসাময়িক সরকারি ও বেসরকারি ইতিবৃত্ত, ফরমান, চিঠিপত্র, দলিল – দস্তাবেজ ইত্যাদি  উপকরণ ব্যবহার করেছিলেন।এজন্য ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু পরিশ্রমে এই সমূহ আকর উপাদান সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
   মোঘল আমলের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে যদুনাথের দৃষ্টি মারাঠা জাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলো। মোঘল – মারাঠা দ্বন্দ্বের মধ্যেই মারাঠা রাষ্ট্রের বিকাশ ও শিবাজীর উত্থান। বিপুল মারাঠা উপাদান সংগ্রহ করে রচনা করলেন Shivaji and His Times।  এ জন্য তাঁকে সমসাময়িক ফার্সি ইতিবৃত্ত, মারাঠি বখর, শকাবলী ও কাগজপত্র, ডিঙ্গল (প্রাচীন রাজস্থানী কাগজ পত্র), সংস্কৃত ও হিন্দি কাব্যাদি, ইংরেজী এবং পর্তুগিজ ভাষায় রক্ষিত উপকরণের চর্চা করতে হয়েছিল। এও এক প্রামাণ্য গ্রন্থ।
   তাঁর আরেকটি অতীব মূল্যবান গবেষণা নাদির শাহের ভারত ত্যাগের কাল থেকে ১৮০৩ সাল পর্যন্ত মোঘল শাসনের অবলুপ্তির ইতিহাস Fall of the Mughal Empire শীর্ষক চার খন্ডে বিরাট গ্রন্থ রচনা। মোঘল ইতিহাসের এও আরেক মহাগ্রন্থ। এই গ্রন্থটিকে অনেক ঐতিহাসিক বিখ্যাত ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গীবনের Decline and Fall of the Roman Empire এর সমগোত্রীয় বলে মনে করেন। মোঘল ও মারাঠা ইতিহাস চর্চায় স্যার যদুনাথকে বাদ দিয়ে কখনোই কোনো লেখা বা পাঠ করা সম্ভব নয়।
   মোঘল যুগের শেষ দুশো বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস ব্যতীত তিনি আরো বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। রচনা করেছেন অজস্র প্রবন্ধ। সবই যে ইতিহাস ভিত্তিক তা নয়। সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন বিষয়ক বহু রচনা লিখেছেন। তিনি ‘চৈতন্যচরিতামৃত ‘ এর ইংরেজি ভাবানুবাদ chaitanya’s Life and Teachings    প্রণয়ন করেন। চৈতন্য চর্চায় এই গ্রন্থটির মূল্য অসীম। এছাড়াও আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক হামিদউদ্দিন খাঁ লিখিত ফার্সি গ্রন্থ ‘ আহখম – ই – আলমগিরি ‘ – র ইংরাজী অনুবাদ Anecdotes of Aurangzib রচনা করেছিলেন। অর্থাৎ একজন মানুষ কতো বিচিত্র দিকে তাঁর প্রতিভাকে উদ্ভাসিত করেছিলেন। তাঁর এই কর্মদ্যম এর মধ্যে অভিব্যক্ত হয়েছিল ভারতবিদ্যাচর্চার নানা দিগন্ত। বাংলাতেও তিনি কলম ধরেছিলেন, সেখানেও বিষয় বৈচিত্র ছিল বিচিত্র। দীর্ঘ জীবনের অধিকারী এই মানুষটি আজীবন কাজ করেছিলেন ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *