অমিত বসাক
লেখক পরিচিতি
(লেখক ২২ বছর ধরে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন অন্য কলেজে। সমবায় ব্যাঙ্ক ও অকৃষি সমবায় সমিতির ওপর গবেষণাধর্মী তার দুটি বই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা নতুন আঙ্গিকের একটি বই আমি মলে ঘুচিবে জজ্ঞাল। ভ্রমণ ও সমবায় বিষয়ক কিছু লেখা আজকাল ও গণশক্তি পত্রিকাতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্বার এ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণে পাহাড়প্রেমী লেখক বারবারই ছুটে গেছেন হিমালয়ে:কেদারনাথ,তুঙ্গনা্থ,রূপকুন্ড,বৈজনাথ,যজ্ঞেশ্বর,হর কি দুন, পিন্ডারী, কাফনি, মুন্সিয়ারি, প্যাংগং, সান্দাকফু এবং এরকম আরো অনেক জায়গায়।)
(ভোর সাড়ে চারটে –পাঁচটা নাগাদ বাইরে এসে আনন্দে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। এখনো দিনের আলো ফোটেনি। এ কোথায় এসে পড়লাম-এই কি স্বর্গ। জ্যোৎস্না রয়েছে এখনও-সেই আলোতে দেখতে পেলাম দুধ সাদা সব তুষারশৃঙ্গ প্র্রায় অর্ধাচন্দ্রাকারে আমাদের ঘিরে রয়েছে। সবই যেন প্রায় হাতছোঁয়া দূরত্বে। আস্তে আস্তে চারদিক আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগলো-তুষার হিমালয়ের অঙ্গনে ঢুকে পড়েছে সোনার রথ।………………। এই সব মনকাড়া স্বপ্নের অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে শুরু হল এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় লেখকের ধারাবাহিক ভ্ৰমণ কাহিনী “হিমালয়ের ডাইরীর” অংশ হিসেবে “পিন্ডারী ও কাফনীর পথে ”।)
তৃতীয় পর্ব
১৮ তারিখ,ট্রেকিং এর তৃতীয় দিন। আজ আমরা যাব দ্বোয়েলি। খাতি থেকে এর দূরত্ব ১১ কিমি। এই খাতি থেকেই একটি পথ চলে গেছে জাতোলী হয়ে সুন্দরডুঙ্গা-ভার্নোটি-মাইকতোলি বেসক্যাম্প-দেবীকুন্ডের দিকে। আমরা চলেছি ডানদিকের পথে। পিন্ডার নদীর পার ধরেই এই পথ চলে গেছে। নিচে পিন্ডার নদী দুরন্ত গতিতে বয়ে চলেছে। কিছুটা যাবার পর আর কোন পথ নেই-বিশাল ধস-বিশাল বিশাল গাছ সব নদীর উপর যেন শুয়ে পড়েছে। অতিকষ্টে ধীরে ধীরে নেমে আসলাম প্রায় নদীর গর্ভে,বোল্ডারের উপর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দুইদিকে পাহাড় আর পাহাড়-গভীর বন,আর মাঝখানে আমরা। এইভাবে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিট পার হয়ে গেল। সামনে দেখলাম একটা কাঠের সাঁকো। কাঠের নড়বড়ে পুল পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। বিশাল বিশাল সব আকাশছোঁয়া মহীরুহ-দেওদার-পাইন-চীর আর আখরোট গাছের চাদোয়া। বাঁদরের কিচির মিচির,বনমুরগীর দল,আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখীর কলকাকলী আমাদের সঙ্গী। সামনেই খাদের ওপাশে ডানদিকের পাহাড়ের কোল বেয়ে প্রায় ২০০-২৫০ ফুট উপর থেকে এক বিশাল জলপ্রপাত সোজা পিন্ডারের বুকে আছড়ে পড়ছে,আর তাতে রামধনূর সাতরঙ্গের খেলা চলছে। কিছুটা যাবার পর সামনেই পিন্ডার ও কাফনীর সঙ্গমের ব্রীজ পেলাম। এই ব্রীজ পার হলেই দ্বোয়েলী। ব্রীজের উপর থেকে ওপারের দ্বোয়েলীকে অসাধারন লগছিল। এর উচ্চতা প্রায় ৯০০০ ফুট। এখানে KMVM এবং PWD এর বাংলো আছে। আমরা PWD এর বাংলোয় রাতের আশ্রয় নিলাম। ওখানকার চৌকিদারই খাবার ব্যবস্থা করলেন। এখানেই KMVM বাংলোয় অনুপদা,পীযুষদাদের সঙ্গে আলাপ হল। শুনলাম ওরা চারজন কাল কাফনী যাবে। যদিও পথেই শুনেছিলাম কাফনীর পথে ধস নেমেছে। খুব দু্গম পথ। তবে PWD রাস্তা করছে। আমরা আমাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করলাম। ঠিক করলামও তাহলে আগে কাফনী যাবার চেষ্টা করবো,তারপর পিন্ডারী।
পরেরদিন ১৯ তারিখ,ভোর পাঁচটাতেই গাাইড আনন্দের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোর সাড়ে পাঁচটায় হাাঁটা শুরু করলাম। ওদিকে অনুপদারাও বেড়িয়ে পড়েছে। আজ আমাদের সম্মিলিত টিমের সদস্য সংখ্যা সাত জন। অনুপদারা তিন জন (একজন অসুস্থতার জন্য থেকে গেছেন),আমরা দুজন আর দুজন গাইড। এখানে প্রসঙ্গত বলি এই অনুপদার সঙ্গে পরের বছর আমি হরকিদুন ট্রেকং এ গেছিলাম। আসলে পাহাড়ে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধুত্ব এই ভাবেই হয়। সদা হাস্যময় বিনয়ি অনুপদার সাথে আমার সখ্যতা আজও অটুট। যাহোক আমাদের এবারের ট্রেকিং এ ফিরে আসি। আজ আমাদের ট্রেকিং করতে হবে ২৪ কিমি-১২ কিমি যাওয়া এবং ১২ কিমি আসা। এখনও পুরো আলো ফোটে নি। আবছা আলোয় পাাহাড়ের ঢাল বরাবর সরু পথরেখা ধরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। প্রায় দেড় কিমি যাাওয়ার পর দেখি কোন রাস্তারই অস্তিত্ব নেই। সামনে কোন পথই নেই। বিশাল ধস। পুরো পথ কয়েকশো ফুট নীচে নদীর মধ্যে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে আছে। বাঁদিকে পাাহাড়ের গায়ে সরু সরু বাঁশ গাছ। গাইডের সাহায্যে অতি সাবধানে ঐসব হেলানো বাঁশ গাছ ধরে ধরে ঝুরো মাটিতে পা ফেলে ফেলে এগোতে লাগলাম। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি। চোখ মন সব কিছুই ঐ পায়ের পাতায় আবদ্ধ। আমরা যেন ভূমিকম্প বিদ্ধস্ত কোন জায়গায় চলে এসেছি। কোন কোন জায়গায় কাফনী নদীর দিক পরিবর্তন হয়ে গেছে ধসের ফলে। সরু এক চিলতে ঝুরো মাটির পথ-পাহাড়ের খাঁজে কোনক্রমে শুধু পা রাখার জায়গামাত্র। এভাবে খুব সাবধানে পাহাড়ের দেওয়াল ধরে পা টিপে টিপে ১০০/১৫০ মিটার যাবার পর এক জায়গায় এসে দেখি সামনে শুধুই বোল্ডার-Bolder Zone ।কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর আবার একটি ধস আমাদের পার হতে হল;ভাবলে এখনও বুক কেঁপে ওঠে। একদম সরু পথরেখা-পাথুরে মাটির উপর গাইড আনন্দের পিছন পিছন এক একজন এগোচ্ছি,আর ঝুর ঝুর করে মাটি ঝরে পড়ছে। আরো কিছু মাটি ঝরে পড়লেই সোজা গিয়ে পড়বো কয়েকশো ফুট নিচে কাফনীর খরস্রোতা জলে। অন্ধকারের পরই যেমন উঁকি মারে সোনালী আলোর পরশ,ঠিক এরকমই বিপদসঙ্কুল ঐ ধসের সাম্রাজ্য পেরিয়ে প্রবেশ করলাম বিরাট বিরাট হলদেটে ঘাসের জঙ্গলে। দুধ সাদা নন্দাকোট একদম চোখের সামনে-প্রায় হাতছোঁয়া দূরত্বে। এদিকে ডানদিকে কাফনী নদী আর বাঁদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের দেওয়াল;মাথাগুলো ছুঁচলো হয়ে আছে। দূরে উপত্যকায় একদল হরিণের মতো জন্তু দৌঁড়ে ক্রমশঃ পাহাড়ের খাঁজে হারিয়ে গেল। আমরা অবশেষে কাফনী হিমবাহের প্রায় কাছে চলে আসলাম;ঘড়িতে তখন সময় ১২-১৫ মিনিট। পিছনে নন্দাকোট। হিমবাহের মুখটা দিয়ে তির তির করে বেরিয়ে আসছে জলের ধারা-কাফনী নদী। হিমবাহের উপরটা ছাই ছাই রঙ্গের;মোরাম বিছানো।ওদিকে ইতিমধ্যে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। কোথা থেকে একদল মেঘ এসে ক্রমশঃ নন্দাকোটকে ঢেকে দিতে লাগলো। ওদিকে গাইড ও তাড়া দিতে লাগলো আর অগ্রসর না হবার জন্য। তাই একদম জিরো পয়েন্টে যেতে পারলাম না। ওখানেই আমরা কিছুক্ষণ থাকলাম। এরপর আবার সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর পথ ধরে অতি সাবধানে ফিরে আসলাম দ্বোয়েলীতে। ঘড়িতে তখন বিকাল ৫-৩০ মিনিট। সারাদিন খুবই ধকল গেছে;তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)