পার্থ সাহা

লেখক পরিচিতি

(পার্থ সাহা, জন্ম ৫ জুলাই ১৯৮৭ সাল, তৎকালীন জলপাইগুড়ি জেলায় (বর্তমানে আলিপুরদুয়ার জেলা)। অরণ্য-নদনদী লালিত আলিপুরদুয়ার শহরে বেড়ে ওঠা। আলিপুরদুয়ার মহাবিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দিব্যেন্দু পালিতের ছোটগল্প নিয়ে পিএইচ.ডি. ডিগ্রী লাভ। “দিব্যেন্দু পালিতের ছোটগল্প : জীবনবীক্ষণ ও শিল্পাঙ্গিক’ গ্রন্থটি তার পরিমার্জিত সংস্করণ এবং প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এছাড়াও বিবিধ বিষয়ে নানা প্রবন্ধ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন গ্রন্থে ও পত্র-পত্রিকায়।

পেশায় শিক্ষক, নেশায় ‘আলিপুরদুয়ার মানবিক মুখ নামক সামাজিক সংগঠনের বিশ্বস্ত সৈনিক। বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় ও নৈরাশ্যের যুগে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস রাখেন মানবিকতায়, স্বপ্ন দেখেন সমাজের গাঢ় অন্ধকার ছাপিয়ে ভোরের আলো ফোটার)

বিষয় পরিচিতি

(গোটা ভারতের ছোটো সংস্করণ ডুয়ার্সের বুকে ভারতের চার ভাষাগোষ্ঠীর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তালিকাভুক্ত ৪১ আদিবাসীর মধ‍্যে ৩৮ আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের নৃ-তত্ত্ব, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বাস করছে। যার মধ‍্যে আদিম-আদিবাসী টোটোও রয়েছে। ডুয়ার্স যেন এক মহামানবের মিলনক্ষেত্র। ভারতের এই আদি স্বয়ংসম্পূর্ণ জনজাতিরা কেমন ছিলেন? কেমন আছেন? কলোনিয়াল ভাবনা কিভাবে মূলস্রোতকে পরিণত করেছে দয়া-দাক্ষিণ‍্য-করুণার পাত্রে? কারণ প্রান্তিক মানুষ কথা বলতে পারে না বা আমরা তথাকথিত সভ‍্য সমাজ হয়তো কথা বলতে দেই না ! লেখাগুলো ধারাবাহিকভাবে তাদের কথা নিয়েই আবর্তিত হবে….)

অসুর জনজাতি

ইতিহাসের পাতা বেয়ে মিথ ও সত‍্যের দ্বন্দ্ব, আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব…

  আলিপুরদুয়ার শহরের অনতিদূরে মাঝেরডাবড়ি চা-বাগান, কালকূট বনবস্তিতে কয়েক ঘর অসুর আদিবাসীর বাস। পড়ন্ত বিকেলে এই অঞ্চলের অসুর সম্প্রদায়ের এক শিল্পী টিটুস্মার সঙ্গে গল্প করতে করতে আপন খেয়ালে গল্প জুড়ে দেয় তার মা সিবরিয়া অসুর।  ৯০ বছরের বৃদ্ধার স্মৃতির খেয়া বেয়ে এলোমেলো কথাগুলোর মধ‍্যে খুঁজে পাই তাদের মাইগ্রেটেট হওয়ার কারণ ও ঐতিহ্যে।  আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, ভারতের বিভিন্ন জায়গা জুড়ে ‘অসুর’ নামক এক আদিম জাতি আছে, যাঁরা নিজেদেরকে মহিষাসুরের বংশধর বলে দাবী করেন। অসুর শব্দটি ঋকবেদ, উপনিষদ সহ আরও  বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থেও পাওয়া যায়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই অশুভ শক্তির প্রতীক, শেষপর্যন্ত ধর্ম প্রতিষ্ঠায় প্রবল পরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও এদের পরাজয় দেখানো হয়েছে। পুরাণের বাইরে  এসে দেখা যায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এরা আসে উত্তরবঙ্গে। আসলে ‘অসুর’ সম্প্রদায় বিহারের একটি জনজাতি। সেইসময়ের ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল গুল্‌মা ও লোহারডাঙ্গা(বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) জেলায় এদের বসবাস। সেখানে তারা লোহা গলানোর কাজ করতো। মূলত অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত। অষ্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত । এদের  ভাষা অসুরি, কিন্তু লিপি নেই।  বর্তমান প্রজন্ম হিন্দি, সাদ্‌রি ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ্য। ১৯৯১ সালের জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে ‘অসুর’ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৪৮৬৪ জন। আগেই বলেছি যে মূলত উত্তরবঙ্গের তিনটি জেলাতেই এদের বসবাস। তারমধ্যে জলপাইগুড়ি জেলাতেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যা ৩১০৮ জন। কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় সংখ্যাটা অনেক কম তুলনামূলক। জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা ব্লকের কেরণ চা-বাগান এলাকায় সংখ্যাটা বেশি।

     টিটুষ্মা ও সিবরিয়ার মতো অসুরেরা এই অঞ্চলের চা-বাগানে কাজের সূত্রে এসেছে। লোহার গলানো ছেড়ে আজ তরা আজ শ্রমিক, এছাড়াও জীবন-জীবিকার সন্ধানে প্রাণ হাতে করে প্রবেশ করে গভীর অরণ‍্যে। অসুরি ভাষার পরিবর্তে কথা বলেন সাদরি বা হিন্দিতে। আধুনিক সভ‍্যতার ছোঁয়ায় বদলেছে পোশাক, খাদ‍্যাভাস, জীবনচর্যা। গল্প করতে করতে সিবরিয়া বলে ওঠেন তারা এখনও দূর্গাপূজা দেখন না, তারা দূর্গাকে দেবী বলে মানেন না। আগ্রহ বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে গভীরে যাওয়ার কৌতুহল। গল্পের সূত্র ও অসুর সম্প্রদায়ের ইতিহাস অনুসন্ধান করে  মিথের সন্ধান পাই। অসুর জনজাতির ঐতিহ্য অনুসারে…

মিথ-১

 পূর্বপুরুষ মহিষাসুর ছিলেন পরাক্রমশালী রাজা। বাইরে থেকে অন্য যেসব জাতি অসুরদের আক্রমণ করেছে, তারা কেউই মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে ওঠেনি। অসুরদের রাজাকে হারানোর জন্য চক্রান্ত করে এক সুন্দরী রমণীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেয়। বিয়ের নবম রাতে সেই রমণী মহিষাসুরকে হত্যা করে। তারপর থেকে ওই রমণীকে ঘিরে দুর্গা পূজা শুরু হয়। 

মিথ-২

 পাশাপাশি কথিত আছে, বিদেশিরা যখন মহিষাসুরের সঙ্গে পেরে উঠছিল না, তখন তারা দুর্গাকে তাঁর সামনে এগিয়ে দেয়। যেহেতু, যুদ্ধের নিয়মানুযায়ী শিশু, মহিলা, বৃদ্ধদের আক্রমণ করা যায় না, তাই মহিষাসুর দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধই করেননি। বিনা যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। 

 মিথ ও সমাজবাস্তবতাকে এক সূত্রে মেশালে উঠে আসে কিছু প্রশ্ন। যে প্রশ্নে লুকিয়ে আছে একটি জাতির  ইতিহাস। এই জনগোষ্ঠী মনে করেন, দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধ আসলে দেবতাদের ষড়যন্ত্র। দুর্গাপূজোর সময় এঁদের ঘরে আলো জ্বলে না। পূজোর ক’দিন তাঁরা গৃহবন্দী থাকেন, কোনমতেই দুর্গার মুখ দেখতে চান না। দুর্গার মুখ দেখা তাঁদের কাছে পাপ। নবমীর দিন তাঁরা মহিষাসুর বন্দনার জন্য ‘হুদুড় দুর্গা’-র পূজো করেন। এই দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী নন, ইনি প্রজাপালক স্বয়ং মহিষাসুর। আকাশ-বাতাস যখন শারদীয়ার আনন্দে মত্ত, তখন পালিত হয় ‘দাসাই’ – যা একপ্রকারের নাচ। এই নাচের মধ্য দিয়ে তাঁরা মহিষাসুরকে স্মরণ করেন। এই নাচ যুদ্ধনৃত্য (বর্তমানে এই নাচ অনেক সুসজ্জিত) হলেও যার অন্তর্নিহিত অর্থ শোকের, দুঃখের। এছাড়া কালীপূজোর সময় পালিত হয় আরেক উৎসব ‘সোহরাই’। এই উৎসবে আদিবাসী যুবকেরা নাকে, বুকে, নাভিতে করঞ্চার র তেল লাগায় ও শসা খায়। এর প্রতীকী অর্থ হল, মহিষাসুর যখন মারা যান, তখন তাঁর নাক, বুক, নাভি দিয়ে রক্ত পড়ছিল আর শসা খাওয়ার অর্থ, তাঁরা তাঁদের পরমপ্রিয় মহিষাসুরের হত্যাকারীর কলিজা ভক্ষণ করছে। এভাবেই হয়তো মিথের আড়ালে লুকিয়ে আছে আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বের ইতিবৃত্ত। এভাবেই মিথের অনুসন্ধান ও নৃ-তাত্ত্বিক , সামাজিক বিশ্লেষণ থেকে উঠে আসে আমাদের ভারতের এমন এক ঐতিহ্য, যা আপাত সভ‍্য সমাজ মান‍্যতা হয়তো দেয় না! সিবরিয়ারা তাদের কথা বলার ভাষা , ক্ষেত্র না পেয়ে অতীত ঐতিহ্য নিয়ে হায়িয়ে যায় কালের গহ্বরে। এভাবেই মূল স্রোত , মূল স্রোতের বাইরে বেরিয়ে পড়ে থাকে প্রান্তিক হয়ে…ভারতের বুকে এও যেন এক রক্তচিহ্ন।

টোটো জনজাতি

ছবিতে ধনীরাম টোটো, ঁসত‍্যজিৎ টোটো, দেবি টোটো, প্রথম টোটো উপন‍্যাস, টোটো ভাষার পত্রিকা…সাথে আমি ও লোকসংস্কৃতি গবেষক প্রমোদ নাথ

গোটা ভারতের ৭৪ টি , পশ্চিমবঙ্গের ৩ টি আদিম আদিবাসীর মধ‍্যে অন‍্যতম টোটো জনজাতি। গবেষকদের অনুমান অনুসারে টোটোরা বৃহত্তর ইন্দো-মঙ্গলীয় জনগোষ্ঠীর একটি বিচ্ছিন্ন শাখা।  বর্তমান সংখ‍্যা প্রায় ১৬৩২(২০২১ সালের জনগণনা)।এদের অবস্থান কেবলমাত্র হাউরি নদী ও তাদিং, ইসপা, পুদুওইয়া পাহাড়ের কোলে ৬ টি গ্রামে। গ্রাম পঞ্চায়েত টোটোপাড়া বল্লালগুড়ি, ব্লক মাদারীহাট, জেলা আলিপুরদুয়ার। ১৩ টা পাহাড়ি নদীর ওপর দিয়ে পৌঁছতে হয় টোটো পাড়া গ্রামে। বছরে ছয় মাস নদীতে জল থাকায় যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ থাকে। তখন ভেলা, হাতি একমাত্র অবলম্বন। 

গ্রামগুলি এখনো শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থ-যোগাযোগ ব‍্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে ডুবে থাকা ভূখন্ড। টোটো জনজাতির প্রথম মহিলা দেবী টোটো , যিনি এই জাতিকে প্রথম পথ দেখালেন শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশের। ১৯৬৮ সালে ভর্তি হলেন অবৈতনিক স্কুলে। ক্লাস টু পর্যন্ত পড়েলেও যে পথটা তিনি দেখিয়েছেন, সেই ইতিহাসের  পথ বেয়ে এসেছে আলো, সংস্কৃতির বদল। সেই পথের চলমানতায় আজ অনেক টোটো নারী শিক্ষার আলোয় আলোকিত। 

ধনীরাম টোটো,এক জীবন্ত ইতিহাস। নিজের জাতি-সংস্কৃতিকে না ভুলে বাইরের জগৎ থেকে নিয়ে এসেছেন আলো। বিশ্বের দরবারে মেলে ধরেছেন টোটো সংস্কৃতিকে। ব্রত গ্রহণ করেছেন টোটো জাতির সার্বিক উন্নয়নের। চাইছেন টোটোরা শিক্ষিত হোক। তার কর্মতৎপরতা চোখে পড়ার মতোই, সঙ্গে সরলতা ও বিনয়। সারাদিন ওনার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে হলো অভিজ্ঞতার সঞ্চয়। অনর্গল তুলে ধরলেন খন্ড খন্ড চিত্র, পরিচয় করালেন টোটোপাড়ার সাথে। যার মধ‍্য দিয়ে একটা কল্পনার জাল বুনে ফেলা যায় সহজেই। টোটো ও বাংলা ভাষায় কবিতা , প্রবন্ধ,  নিয়ে চর্চা করেন তিনি। তার লেখা উপন‍্যাস ‘ধানুয়া টোটোর কথামালা’ আত্মজৈবনিক তবে এটিই টোটোদের লেখা প্রথম উপন‍্যাস। টোটো ভাষার আকর টোটো লিপি তৈরির চেষ্টা যেনো ভগিরথের গঙ্গা আনার মতোই অনেকটা।

 সত‍্যজিৎ টোটো, মাত্র ৪১ বছর বয়সে সাধারণ জ্বরে ইহলোকের মায়া ত‍্যাগ করলেও স্বল্প জীবনপর্বে টোটো সংস্কৃতির জগতে নিয়ে এসেছেন অনেকটা আলো । জীবনের অভিজ্ঞতা জন্ম দিয়েছে নাটকের, যে নাটক জংলী হয়ে উঠেছে কলোনিয়াল ভাবনার বিরুদ্ধে শাণিত তরবারি । নাটকের প্রতিবাদের ভাষা ধ্বনিত হয় কোলকাতার বিনয় মজুমদার মঞ্চেও।  নাটকের বিষয় ও ভাব থেকে প্রশ্ন উঠে আসে সমাজের মূল স্রোতে থেকে, পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমরা কতটা সভ‍্য ? হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে দিয়ে অপমানের যন্ত্রণা থকেই শিল্পের সৃষ্টা সত‍্যজিৎ। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি, বাংলা লিপিতে টোটো ভাষায় প্রথম লিটিল ম‍্যাগাজিন প্রকাশ করে চমকে দেন, পত্রিকার নাম টোটবিকো লোইকো দেরেং, অর্থাৎ টোটোদের গ্রামের খবর। একে একে ৬ টি সংখ‍্যা বের হয়। সাহিত‍্যরস নিয়ে আলোচনা সাহিত‍্যতাত্ত্বিকদের বিষয় হলেও টোটো সংস্কৃতিকে জানতে এই পত্রিকার ঐতিহাসিক মূল‍্য অমূল‍্য…

সময় কথা বলে, মানুষ কথা বলে। মূল স্রোত বিচ্ছিন্ন মানুষ হয় প্রতিবাদ করে নয় আলোর সন্ধান করে। দেবী টোটো, ধনীরাম টোটো, সত‍্যজিৎ টোটোর মতো মানুষেরা নিজের আলোকিত করে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া সমাজকে-

“সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;” (জীবনানন্দ দাশ)

1 thought on “ডুয়ার্স : নৃ-তত্ত্বের জাদুঘর!

  1. এমন এক জনজাতি গোষ্ঠীর জীবন প্রণালী মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হলে সমাজের ক্রমমুক্তি হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *