সুদেষ্ণা মৈত্র
বিশুটা ঠিক পাগল নয়।ওর ঘাড়ের কাছে নাক নিয়ে গেলে এখনো বোঝা যায় ওটা আতর।আসলে বিশু আতরকে নয়।আতরই বিশুকে মাখে।মেখে মেখে ছালচামড়া হয়ে ঝুলে থাকতে চায়।ঠোঁটের ফাঁকের ফেনায় বা ভ্রূএর কাছে একরোখা বিনবিনে ঘামে-আতর থেকে যেতে চায়-প্রয়োজন হয়ে-ভবিষ্যতের কথা ভেবে।বিশু একটি চরিত্রের নাম,এই ধরুন আমিই হয়ত বিশু কিম্বা আপনি।সকালের চায়ের দোকানে দশটি হাতের মধ্যে এগারো নম্বর হাত বাড়িয়ে ‘বিশু’।রিক্সার ধাক্কায় সাইকেল উল্টে যে জটলা তিন নম্বর মাথাটি বিশুর।রাস্তায় বের হলেই দুটো চোখ ভিড় খুঁজে বেড়ায়।যে কোনো জট যে কোনো মিছিল।শয়ে শয়ে লাল চেয়ার বা সবুজ-বিশুর সামান্য পাছা ঠেকানোর জায়গা চাই।বিশু নিয়ম করে শ্মশানেও যায়।কান্না হয়ে সঙ্গ দেবে বলে।বিশু অনুষ্ঠান খুঁজে বেড়ায়,হাসির আদল ধার দেবে বলে।এই শহরটা এতো ছোটো,এতো কৃপণ যেন সবাই সবার মুখ চেনে,জিভ চেনে,চিনে নেয় নখের আঁচড়ও।বিশু একটু আলাদা হতে চেয়েছিল মাত্র।বিশু স্বপ্ন দেখে একদিন ঠিক সে লোকাল ট্রেন হয়ে যাবে।
লোকাল ট্রেন হওয়া অতো সহজ কথা নয়, দু’বার কেশে পাড়ার নগেন ডাক্তার জানিয়েছে বিষয়টি- ‘ কতোবার পোশাক পাল্টাতে হয় জানো?’
রোজ ভোরে ‘নমিতা’ হতে হবে, যে তার অপুষ্ট ১৬ বছরের বিবাহিত মেয়েকে সদ্য হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সামনের সিটে বসা টুম্পাদি’কে শোনায় মেয়েটি কীভাবে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছিলো, আর তারপরেই বলে চলবে টাকাপয়সার দিক থেকে কাজের বাড়ির বৌদি কী সতর্ক! সামান্য দশ টাকা সরিয়ে রাখলেও কথা শোনায়।
ঠিক সকাল ১১টা নাগাদ বিশুকে হয়ে উঠতে হবে সদ্য গোঁফ গজানো মফস্বলে অমিতের মতো। দুরন্ত কলারের গায়ে নতুন এসেন্স লাগিয়ে কলেজ ছুটছে সে। পাল্লা দিতে পড়িমরি জুতো পালিশ করেছে। ব্যাগের নিচের দিকের রঙচটা অংশে উঠতি হিরোর স্টিকার বসিয়ে সামলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে নিজেকে।
দুপুরে সেই যুগ বিস্মৃত যেকোনো ব্যথার অব্যর্থ ওষুধ-দাদা। মুখস্থ সমস্ত শব্দের একটাও না ভুলে তুমুল দক্ষতায় মলম বিক্রির কৌশল হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়! নগেন ডাক্তার আর এগোয় না। দ্যাখে, বিশু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিড়বিড় স্বরে বলে চলেছে -‘ একদম ঘরের মাঝ বরাবর, দুটো পা যেন বুকে ঠেকছে, দুটো পা যেন…’ ডাক্তারও এগিয়ে যায় তাঁর জং ধরা ওষুধের বাক্সের দিকে।
স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে বিশুর জ্ঞান খুব কাঁচা। কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগরের পাশ দিয়ে সেদিন সারাটাক্ষন ঘোরাফেরা করেছে। ভেঙে পড়া মুখটি এখনো তৈরি হওয়ার সময় হয়নি। বিশু প্রথমে ভেবেছিলো ওখানেই নিজের মুখটা খ্যলে রাখবে। সাহস হয়নি।
সেদিন রাত্রে বিশু শুতে যাওয়ার আগে আকাশের দিকটা ভালো করে দেখে নেয়। শরীর থেকে গোটাকতক পিঁপড়ে আর মাছি সরিয়ে কিশোরবেলায় বাবা’র হাত ধরে তোলা ছবিটি খানিকক্ষণ ছুঁয়ে থেকে একটি চিঠি লেখে। সেই চিঠি কেউ পড়েনি। তবে, লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে বামদিকের রাস্তায় যে নামহীন, মুখহীন অর্ধসমাপ্ত মূর্তিটি পেরিয়ে যায় অনেকেই, তারা জানে , মাঝেমধ্যে সৌধের গা থেকে কেমন একটা আতর-আতর গন্ধ পাওয়া যায়।
উফফ…দুর্দান্ত…এই কলমের জাদু চিনি আমি…মুগ্ধ হই।
গল্পটা আকারে ছোট হলেও প্রকারে অনেক বড়।
দুরন্ত। সুদেষ্ণা মৈত্র-র কবিতা পড়েছি কিন্তু গদ্য আগে পড়িনি ভেবে আফসোস হচ্ছে। আরো লেখা চাই। অনেক শুভেচ্ছা।
Nice