অমিত ত্রিবেদী
লেখক পরিচিতি
(পর্যটনমূলক ধারাবাহিকটির লেখক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সভাতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে। তারই পটভূমিকায় লেখা এই ভ্রমণ বৃত্যান্ত।)
তৃতীয় পর্ব
রাজকুমার হ্যামলেটের দেশে সারাদিন মেঘলায়…
স্টকহোম থেকে রাতের ট্রেনে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হ্যাসলহোম, সেখান থেকে একটি বাসে লুন্ড; আবার সেখান থেকে অন্য একটি ট্রেনে মালমো হয়ে বাল্টিক সাগর পার করে পৌঁছালাম ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। রাতের ট্রেনে ওঠার সময় চেকার ভদ্রমহিলার সাথে কিঞ্চিত্ বাদানুবাদ হয়েছিল। একই কুপেতে আমাদের সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তিটি ছিলো একটি বিদেশী ছেলে, সে চাইলে কুপেতে আমার অর্ধাঙ্গিনীর উপস্থিতির ব্যাপারে নাকি বিধিসম্মত প্রতিবাদ জানাতেই পারতো, সেক্ষেত্রে আমাদের ঠাঁই কোথায় হতো তা বজ্রপ্রহরণ থরই জানেন। নিশ্ছিদ্র প্রযুক্তির দেশে টিকিট বানানোর সময় এই অদ্ভুত সমস্যার উল্লেখ দেখিনি কেন, সেটা ভেবে একটু বিরক্ত আর বিস্মিতই হয়েছিলাম। ধন্যবাদ মহাবলী থরকে, মধ্যরাত্রে মাথায় বাজ পড়েনি।
কোপেনহেগেনে যখন পৌঁছলাম, তখন সকাল। কিন্তু আবহাওয়া দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। সুইডেন যতটা উষ্ণ অভ্যর্থণা এগিয়ে দিয়েছিল, রাজকুমার হ্যামলেটের দেশ ঠিক ততটাই শীতল আর মেঘধূসর ম্লান হাসিতে স্বাগত জানালো যেন। স্টকহোমের মতো এখানেও সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে শহর ঘোরার জন্য একাধিক সংস্থার একাধিক রুটের রকমারি যানবাহনের ব্যবস্থা ছিলো। বাসের ব্যবস্থাটির একটা বদ-তরজমা করলাম “উঠে-পড়ুন-নেমে-পড়ুন পরিষেবা”। সুইডেনের মুদ্রা সুইডিশ ক্রোনা (বা ক্রাউন, যার সংক্ষেপ SEK) আর এদেশের মুদ্রা Danish krone (DKK) র মূল্য অভিন্ন। আমরা শুরু করলাম High Bridge Square (স্থানীয় ভাষায় Højbro Plads) থেকে। এখানের মূল দ্রষ্টব্য চৌমাথার মধ্যিখানে বিশপ অ্যাবসালনের অশ্বারোহী মূর্তিটি। হাতে উদ্যত কুঠার নিয়ে উদ্ধতভঙ্গিতে তাঁর সাধের ক্রিশ্চিয়ানবর্গ দুর্গপ্রাসাদের দিকে তাকিয়ে আছেন কোপেনহেগেনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্মানিত যোদ্ধা-বিশপ। ঝিরঝির বৃষ্টিতে রাস্তার দুপাশে নিওক্লাসিকাল স্থাপত্যের প্রাসাদোপম বাড়িগুলো ভিজছে। অদূরে একটি গলির শেষ প্রান্তে সন্ত নিকোলাসের গীর্জার চূড়া দেখা যাচ্ছে।
Højbro Plads |
পরের দ্রষ্টব্যস্থান হলো কোপেনহেগেনের ‘নতুন বন্দর’ বা নাইহ্যাভন। সপ্তদশ শতাব্দীতে সুইডিশ যুদ্ধবন্দীদের বানানো এই জলযানপোতটি খুব নয়নাভিরাম। জলের মধ্যে দুপাশের শতাব্দীপ্রাচীন রঙবেরঙের টাউনহাউস, রেস্তোরাঁ আর পানশালা ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ। অজস্র জলযান নোঙর করে থমকে আছে চিত্রার্পিতের মতো।
Nyhavn |
এরপর এসে নামলাম ড্যানিশ রাজপ্রাসাদ Amalienborg Palace-এ। একটি অষ্টভুজাকার কোর্টইয়ার্ডকে ঘিরে চারটি একইরকমের স্থাপত্যের রাজপ্রাসাদ, যার প্রতিটার অভ্যন্তর ‘রকোকো’ নামের একটি অপ্রতিসাম্যধর্মী ফরাসী স্থাপত্যশৈলীতে সাজানো। অষ্টভুজের কেন্দ্রে সুউচ্চ অশ্বারূঢ় মূর্তিতে অ্যামেলিয়েনবর্গের প্রতিষ্ঠাতা রাজা পঞ্চম ফ্রেডেরিক স্বয়ং! মূর্তিটার একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা নেহাৎ মন্দ না। Frederick V (1723-1766) ডেনমার্ক-নরওয়ের রাজা ছিলেন কুড়ি বছর (1746 – 1766)। তিনি যদিও মদ্যপ ছিলেন ও বিলাসবহুল জীবন পছন্দ করতেন, কিন্তু তার উদার মানসিকতার জন্য তাঁর রাজত্বে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয়েছিল। তাঁর আমলেই সাতবছরের যুদ্ধ (1756–63) চলেছিল। যুযুধান সুইডেন-রাশিয়ার প্রতিবেশী হয়েও তিনি দেশকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখেন। এরকম অনেক কীর্তির জন্য দেশবাসীর কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর মৃত্যুর পাঁচবছর পর তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে এই অশ্বারোহী মূর্তি (রোমান সম্রাটের বেশে) উদ্ঘাটিত করা হয়। পরে একটি মজার তথ্য জানলাম, Danish India র অংশ হিসেবে আমাদের শ্রীরামপুরের নামও ওনার নামে Frederiksnagore রাখা হয়েছিল (1755 থেকে 1845 পর্যন্ত এই নাম ছিল)।
Frederick V (1723-1766) |
ফ্রেডেরিক্–স্ চার্চ |
Amalienborg Palace |
বৃষ্টিস্নাত প্রাসাদচত্ত্বরে ও রাস্তার উল্টোদিকের ঝর্ণাশোভিত উদ্যানে কয়েকশতাব্দীর ইতিহাসযাপন করে বেড়ালাম অনেকক্ষণ। রাণী সোফি অ্যামেলি যে প্রাসাদ ও উদ্যান নির্মান করিয়েছিলেন, সেটিই পরবর্তী রাজাদের আমলে পরিবর্ধিত ও পুনর্নির্মিত হতে হতে আজকের এই মনোমুগ্ধকর বিশাল রূপ পেয়েছে। কিন্তু প্রথমে রাজপরিবার এখানে থাকতেন না। ১৭৯৪এ ক্রিশ্চিয়ানবর্গ রাজপ্রাসাদ এক বিশাল অগ্নিকান্ডে ধূলিসাত্ হয়ে গেলে তদানীন্তন রাজা সপরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ইতিহাসে এরকম প্রলয়ঙ্কর অগ্নিকান্ড অনেকবার হয়েছে। অ্যামেলিয়নবর্গের প্রাসাদগুলি তদানীন্তন মালিকদের কাছ থেকে রাজার কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার পর রাজপরিবার এখানে উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে এই প্রাসাদচারটি ড্যানিশ রাজপরিবারের স্থায়ী বাসস্থান হয়ে ওঠে। চারটি প্রাসাদের নামকরণও হয় যথাক্রমে রাজা সপ্তম ও অষ্টম ক্রিশ্চিয়ান, রাজা অষ্টম ফ্রেডেরিক ও রাজা নবম ক্রিশ্চিয়ানের নামে। প্রাসাদচত্ত্বরের পশ্চিমদিকে, যেখানে Frederiksstaden নামের এই জেলাটির নাভি অঞ্চল, সেখানে রয়েছে আগাগোড়া রকোকো স্থাপত্যশৈলীর অপরূপ ফ্রেডেরিক্-স্ চার্চ। যে দেশের সাতাত্তর শতাংশ নাগরিক লুথারীয় খ্রীষ্টধর্মের, এই শতাব্দীপ্রাচীন রাজকীয় লুথারীয় মর্মর গীর্জাটি সেই দেশের ধর্মপ্রাণতার, বলাই বাহুল্য, পীঠস্থানস্বরূপ। গীর্জার ভিতরে ঢুকে অপূর্ব স্থাপত্যে ও উপকরণে সুসজ্জিত প্রার্থনাগৃহ দেখে মন ভালো হয়ে গেলো।
এবার গন্তব্য জেফিঅন ঝর্ণা। বিশাল ঝর্ণার কেন্দ্রটিতে নর্স দেবী জেফিঅন তাঁর চার সন্তানকে চারটি প্রকান্ড ষাঁড়ে পরিবর্তিত করে তাদের দিয়ে তীব্র গতিতে হলাকর্ষণ চলে চলেছেন। ড্যানিশরা এটাকে উইশিং ওয়েল হিসেবে ব্যবহার করে।
জেফিঅন ঝর্ণা
কোপেনহেগেন সেন্ট্রাল স্টেশনে আমাদের বেছে নেওয়া ট্যুরিস্ট রুটটার নাম ‘দ্য লিটল মারমেড ট্যুর’ যে দ্রষ্টব্যটির নামে রাখা, অতঃপর সেটির দেখা পাওয়া গেলো। স্বনামধন্য ড্যানিশ লেখক হান্স অ্যান্ডারসনের ট্র্যাজিক রূপকথার নায়িকা ভাগ্যবিড়ম্বিতা মত্স্যকন্যা এরিয়েলের ব্রোঞ্জ প্রতিকৃতি কোপেনহেগেনের অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। বাস যেখানে নামিয়ে দিলো, সেখান থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে জলের ধারে গিয়ে দেখলাম, অদ্ভুত বিমূর্তভঙ্গিতে সাজিয়ে রাখা প্রস্তরখন্ডের উপর যেন ওফেলিয়ার প্রতীক্ষার আদলে বসে আছে সে। যে প্রেমিকের জন্য অসহন কন্টকবেদনাভরা নৃত্যে সে আবহমানকাল কাঁদিয়ে আসছে তামাম রূপকথার পাঠকপাঠিকাদের, তার জন্য প্রতীক্ষায় বসে আছে সে আজও! এই মূর্তির ইতিহাস রূপকথাটির চেয়ে ঢের বেশি রোমহর্ষক! ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে কোপেনহেগেনের রয়্যাল থিয়েটারে অ্যান্ডারসনের রূপকথার ব্যালে উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কার্লসবার্গ বিয়ারের উত্তরাধিকারী কার্ল জেকবসেন। তাঁর অনুরোধে সুন্দরী ব্যালেরিনা এলেনা প্রাইস রাজী হন রূপকথার মত্স্যকন্যার আদলে একটি অনুপম ভাস্কর্যনির্মানের মডেল হতে। তবে নগ্নতার ব্যাপারে তাঁর অস্বস্তি থাকায় শুধু মূর্তির মুখ বানানো হলো এলেনার মুখাবয়বের অনুকৃতি করে। অবশিষ্ট অংশের জন্য নগ্না হয়েছিলেন মূর্তির ভাস্কর এডভার্ড এরিকসেনের স্ত্রী এলিন।
উদবোধনের পর ১৯৬০ সাল থেকে অজস্র বার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে মূর্তিটি। কখনও রাজনৈতিক বাদানুবাদের দোহাই দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে অপাপবিদ্ধ তার মাথা, তার ডানহাত! কখনও ধর্মীয় কারণে তার নগ্নতায় আপত্তি জানিয়ে মূর্তিটি ঢেকে দেওয়া হয়েছে কালো আচ্ছাদনের অন্ধকার ব্রীড়ায়, কখনো তার হাতে একটি কৃত্রিম পুরুষাঙ্গ গুঁজে দিয়ে সবুজ রঙে লিখে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক নারীদিবসের তারিখ। প্রতিবার ধ্বংসের হাত থেকে পুনর্নির্মানের হাত ধরে ফিরে এসেছে মত্সকন্যা, যাবতীয় মৌলবাদের আর সংকীর্ণতার মুখের উপর তুমুল অট্টহাসির মতো!
দ্য লিটল মারমেড
‘দ্য লিটল মারমেড’ ট্যুরের রাস্তায় আমার সবচেয়ে চোখধাঁধানো লাগলো রোজেনবর্গ দূর্গ। রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের অনেক স্থাপত্যকীর্তির অন্যতম হলো ডাচ রেনেসাঁর স্থাপত্যশৈলীতে ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে বানানো এই দুর্গটি। পরবর্তীতে ক্রমাগত পরিবর্ধনের পথ ধরে যেটি আজকের রূপটি পেয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানবর্গ দুর্গের অগ্নিকান্ডের পর কিছুদিন রাজপরিবারের বসবাসের জন্যও দুর্গটি ব্যবহৃত হয়েছিল। দুর্গের বহিরঙ্গ দেখে তো মোহিত হতেই হলো, ভিতরে গিয়ে তো মোটামুটি চক্ষু ছানাবড়া হবার উপক্রম! রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের আমল থেকে শুরু করে এখন অব্দি দীর্ঘ সময়ের রাজকীয় আড়ম্বরের আর ঐশ্বর্যের ঝলমলে রত্নখচিত তোষাখানা সাজানো রয়েছে প্রদর্শনী করে। যুদ্ধাস্ত্রের প্রদর্শনী, মণিমাণিক্যখচিত রাজমুকুট, রাজআভরণ, আসবাব, রকমারি দর্পন, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মর্মর ভাস্কর্যে ছয়লাপ অজস্র “Schatzkammer”, আবগারি সরঞ্জাম, আরও কত কী! চারতলায় রয়েছে Knight’s Hall, ১৬২৪এ বলরুম হিসেবে বানানো হলেও এটা মূলত অভ্যর্থনাকক্ষ হিসেবে বা কখনও রাজ্যাভিষেকের মতো বড় সমারোহের কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতিটি সিলিং অতিসূক্ষ্ম ভাস্কর্যমন্ডিত, দেওয়ালে রয়েছে বারোটি ট্যাপেস্ট্রি, স্ক্যানীয় যুদ্ধে রাজার বীরগাথা আঁকা… যেগুলি শিল্পীরা রাজার সাথে সমরাঙ্গনে সশরীরে উপস্থিত থেকে ‘লাইভ’ এঁকেছিলেন! বিশাল ঘরের একপ্রান্তে রয়েছে রাজা ও রাণীর অভিষেকের সিংহাসন, চারটি প্রকান্ড রৌপ্য-সিংহ প্রবল পরাক্রমে নিশিদিন অতন্দ্র প্রহরায় যেগুলিকে নিষ্কন্টক রেখে চলেছে…
রোজেনবর্গ দুর্গ
রোসেনবর্গ দুর্গের রাজতোষাখানা
রাজা পঞ্চম ক্রিশ্চিয়ানের রাজমুকুট
Knight’s Hall
Christianshavn হলো কোপেনহেগেনের একটা প্রতিবেশী এলাকা। সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজা চতুর্থ ক্রিশিয়ান কোপেনহেগেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য অনেক পদক্ষেপের সঙ্গে এই বিশেষ অঞ্চলটিরও পত্তন করেন। মূলশহরের থেকে আলাদা স্বাধীন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি উচ্চশ্রেণীর বাণিজ্যঅঞ্চলও গড়ে তোলা হয়। সঙ্গে তৈরী হয় একটি গীর্জাও, যার নাম ‘চার্চ অফ আওয়ার সেভিয়ার’। ওলন্দাজ ‘ব্যারক’স্থাপত্যের নিদর্শন এই গীর্জার বিশেষতা হলো এর বহির্ভাগ বেষ্টন করে একদম চূড়ায় উঠে যাওয়া সর্পিল সিঁড়ি। চূড়ায় উঠলে ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিকোণে অপূর্ব হয়ে ধরা দেয় কোপেনহেগেন শহর। অনেক উত্থাণপতনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই মূল প্রতিরক্ষাপরিকল্পনাটি প্রায় অবিকৃত রয়ে গেছে এই অঞ্চলে। আর রয়েছে ফ্রিটাউন ক্রিশ্চিয়ানিয়া। ৮৪ একর জায়গা জুড়ে ডেনমার্ক থেকে আইনগতভাবে বিচ্ছিন্ন একটি স্বাধীন এলাকা। ১৯৭১এ পত্তন হওয়া থেকে শুরু করে অসংখ্য বিতর্কিত ঘটনা ঘটে চলেছে এখানে। মূলত মাদকব্যবসাকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি, বিক্ষোভ হয়েছে বারবার। আমাদের বলে দেওয়া হলো, গাড়ি, ক্যামেরা, ‘কড়া’ মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র এই সব স্থানীয় আইনমতে একদম নিষিদ্ধ। ক্যামেরা ছাড়া কিছু নিষিদ্ধ জিনিস ছিলোনা, বলাই বাহুল্য। সেগুলিকেও চালান করে দিলাম ব্যাগের গহনতম কন্দরে। প্রবেশদ্বারের মুখে স্প্যানিশগীটারে তুফান তুলেছেন একজন তরুন। ভিতরে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘোরাঘুরি করলাম। অজস্র সাজসরঞ্জাম, দোকানপত্রে গমগম করছে। একটি এলাকা পুরো গঞ্জিকাসেবনে মত্ত অগুনতি যুবকযুবতী, বয়স্য, গঞ্জিকা ও একইরকমের মাদকের উন্মুক্ত বেচাকেনার দোকান আর অনর্গল ধোঁয়ায় ভর্তি আর ম ম করছে। বোঝা গেল গঞ্জিকাকে অন্তত কড়া মাদকের তালিকায় ধরেনি এদের আইন। জানতে পারলাম, দুটি মাদক মাফিয়ার দল Bullshit আর Hell’s Angels পারস্পরিক রেশারেশি করে মাঝে মাঝেই এই শহরের শান্তি বিঘ্নিত করে, কিছুদিন সব বন্ধ করে রাখার পর আবার সব খুলে দেওয়া হয়। এখানে পুরুষ সমকামীদের একটি শিল্পীগোষ্ঠীও রয়েছে, যার নাম ‘দ্য গে হাউস’। স্থানীয় বীয়ারপান করে আর চারপাশে ‘মনের খুশিতে বানানো’ দেওয়ালচিত্র, দেওয়ালকবিতা, ভাস্কর্য দেখতে দেখতে, আর রকমারি বাজনা শুনতে শুনতে অনেকটা সময় কেটে গেলো । যখন বেরিয়ে আসছি, গেটের মুখে এর তরুণটি তখনও নিজের মনে বাজিয়ে চলেছে তার গীটার।
ফ্রিটাউন ক্রিশ্চিয়ানিয়া
ক্রিশ্চিয়ানিয়ার স্বাধীন শহর থেকে ফিরে এলাম আবার High Bridge Square এ, ততক্ষণে সে জায়গা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে রাস্তার ধারে দুরন্ত অপেরাগায়কদের গানে গানে, বাদকসঙ্গীদের যন্ত্রানুষঙ্গে মুখর হয়ে উঠেছে সমস্ত চৌরাহা! উষ্ণ গ্রীষ্মউদযাপন শুরু হয়েছে নিশীথসূর্যের স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়! সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার সেন্ট্রাল স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ কিছুদূর এসে চোখে পড়লো বিখ্যাত টিভলী উদ্যানের গগনচুম্বী রাইডগুলির মাথা। টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম উদ্যানে। শতসহস্র শিশুর কলকাকলিতে মুখর টিভলী উদ্যান সকালের বিষন্ন আবহাওয়ার মেজাজে যেন জ্বেলে দিয়েছে উত্সবের সাতরঙা আলো! ঘুরে বেড়ালাম চারপাশে অজস্র রাইড আর এক্সহিবিটের মধ্যে। একদিকে জ্যাজবাদকের দল, অন্যদিকে অপেরাগায়কের দল! কোথাও রকমারি যন্ত্রের তুমুল রোশনচৌকি! মন্ত্রমুগ্ধকর বাজনা শুনতে শুনতে আত্মহারা হয়ে বসেছিলাম বেশ কিছুক্ষণ! সম্বিৎ ফিরে পেতে ঘড়ির দিকে চোখ গেলো! ফেরার সময় হয়ে এসেছে।
Tivoli Garden
High Bridge Square
যাওয়া হলোনা রাজকুমার হ্যামলেটের ‘এলসিনোর’ দুর্গে, যার অন্য নাম ক্রনবর্গ দুর্গ। কোপেনহেগেন থেকে বেশ খানিকটা দূরে Helsingør শহরে রয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতিহাস বিজড়িত এই রেনেসাঁ স্থাপত্যটি। হয়তো সেটার টানেই আর একবার আসতে হবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়…
সমাপ্ত