তাপস সরকার
লেখক পরিচিতি
(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। )
মূলাংশ
(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )
অধ্যায়: তিন
আগের দিন প্রান্তরের শেষে নদীর ধার ধরে যে রাস্তা সেখান দিয়ে একটা কনভয় যাচ্ছিল। বিকেল আসার মুখোমুখি সময়ে। বেশ কয়েকটি গাড়ির এক শোভাযাত্রা। যেতে যেতে তারা এখানে থেমেছিল কিছু সময়ের জন্য। ছিল তাতে খান তিন-চারেক এস ইউ ভি ধরনের শক্তপোক্ত গাড়ি ছাড়াও অন্তত দুটি এগারো-বারো আসনের যাত্রীবাহী ছোট বাস। সবাই ভ্রমণার্থী। একেক গাড়িতে একেক দল, নানা দেশের এবং এদেশেরও। ওখানেই গেরহার্টের সঙ্গে তার আলাপ। মধ্যবয়সী, কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ, বেশ লম্বা আর সমর্থ দৈহিক কাঠামো। নিয়মিত ঘোরাঘুরিতে তামাটে গাত্রবর্ণ, টিকোলো নাক। জার্মান ওই ভদ্রলোক পেশায় অধ্যাপক ও দার্শনিক। মুখেচোখে অতীত যুগের আর্যসুলভ গর্ব এবং কথাবার্তাতেও রয়েছে সেই রেশ। তারা পাহাড়ি ঢাল দিয়ে সযত্নে আচ্ছাদিত এক এলায়িত প্রাঙ্গণে ম্যাট বিছিয়ে বসেছিল নানান দলে। একটানা চলতে থাকার মধ্যে একটু থেমে বিশ্রাম নেওয়া ও একইসঙ্গে কিছু খাবার খাওয়ার জন্য। আর খানিকটা সময়ের মধ্যে যান্ত্রিক বাহনের কথা ভুলে মানুষের প্রথম অভ্যেস হেঁটেচলে পরিবেশকে উপভোগ করার বাসনায়। সে ছিল কাছাকাছি, তবে অন্য পার্বত্য ঢালের আড়ালে। ঘুরতে গিয়ে গেরহার্ট তাকে আবিষ্কার করে নিজেই ভাব জমাবার চেষ্টা করল তার সঙ্গে। সে বলল, ‘তোমরা ভারতীয়রা এবং আমরা একই গোত্রের। আমাদের উৎস এক। তোমাদের আর আমাদের গায়ে একই পূর্বপুরুষের রক্ত। তাই তোমাদের সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্যের এতটাই মিল।’
গেরহার্টের কথায় প্রকাশ পেয়েছিল প্রচ্ছন্ন গর্ব। শৈবাঙ্কনের মধ্যে এমন বিশেষ একাত্মবোধ নেই, সে মনে করে সমগ্র মানবজাতিরই পূর্বপুরুষ এক, সবাই একই উৎস থেকে উৎসারিত। কিন্তু নিজের মতামত সে গোপন রাখতে শিখে গেছে এ যাবৎকালের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে। তাই সে নীরব থেকে গেল।
দিনের প্রকাশ এখন শান্তমনা স্থিতধী পুরোহিতের মত, যেন সে পূজাপর্বের শেষলগ্নে নিবেদিতপ্রাণ কোন ইষ্টদেবতার উদ্দেশ্যে, যেন বলছে, ‘আমার কি কথা বলা উচিত হবে ? নাকি আমি দেখে যাব কেবল আমার এতক্ষণের নিবেদন কী ফল দেয় ?’ পার্বত্যচূড়ার খাড়াই ঢালগুলির পায়ের তলায় স্তূপাকৃতি প্রসারিত নানান আকৃতির পাথর ও বোল্ডারের সমাবেশে কোন চঞ্চলতা নেই, তারাও অপেক্ষমান কোন এক প্রত্যাশায়, আপন আপন অবস্থানে মগ্ন আর দৃশ্যত নীরব। তবুও তাদের অন্তরের কথা কান পেতে বোঝা যায়, শোনা যায় তাদের মৃদুকন্ঠের পারস্পরিক আলাপ, ‘আমরা কিন্তু ঘুমিয়ে নেই। আমাদের গায়ে যে সৌরবর্ণের ছটা আপতিত তাতে কি স্পষ্ট নয় আমরা কী মুগ্ধতা রচনা করতে পেরেছি ?’
আকাশের ভাষা এমনই নীল যাতে কোন কবিতা লেখা হয়ে চলেছে অবলীলায় আর শুভ্রবসনা মেঘের ঝাঁক এখানে-ওখানে উপস্থিত থেকে ছন্দ আর অলংকারের পসরা সাজিয়ে এনে অনুচ্চারিত ভাষায় জানাচ্ছে, ‘তুমি যখন কবিতা লিখছ আকাশ, আমরা তোমার জন্য শব্দচয়ন করে এনে দিচ্ছি। তুমি সাজাও তোমার কবিতা যেভাবে পাহাড়ি প্রেক্ষাপটের গাম্ভীর্য অবিস্মরণীয় মাত্রায় নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে।’ তারপর সেখানে হওয়ার এসে যোগ করে তাদের কণ্ঠস্বর, ‘আমরা আছি প্রচারের দায়িত্বে।’
তার পরিবেশকে এভাবে রোজ দেখে শৈবাঙ্কন। কী কথা শোনায় চারপাশের প্রকৃতি সে দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে বুঝতে শিখে গেছে তাদের মর্মার্থ। অথবা অন্যকথায়, তার প্রাকৃতিক পরিবেশের সদস্যরা তাকে এতদিন দেখতে দেখতে বুঝে গেছে কিভাবে নিজেদের দেখালে সে জানতে পারবে তাদের অন্তরের কথা। এভাবেই দিন কাটে তার এমন নির্জনতায় স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে। তার নিজেকে একা মনে হয় না।
তবে আজ গেরহার্টের আগমন হঠাৎই তার দৈনন্দিনতায় এক বিক্ষেপ। মানুষের সঙ্গ কি আজকাল তার জন্য অস্বস্তিকর ? হতে পারে না, কারণ উপত্যকার নানা প্রান্তের গ্রামগুলিতে সে যাতায়াত করে আর সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে মেলামেশায় সে অভ্যস্ত। সমস্ত গ্রীষ্মকাল জুড়ে এখানে ভেড়া আর ছাগলের দল চড়াতে আসে পাহাড়শ্রেণির ওপ্রান্তের দূরদূরান্ত বাসস্থান থেকে আধা-যাযাবর প্রান্তরান্বেষী গাদ্দি সম্প্রদায়ের মেষপালকরা। তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা রয়েছে তার। এখানে এই উপত্যকায় দেবতাত্মার সন্ধানে বাসিন্দা হওয়ার পর বড়োই উপকার হয়েছে। মানুষের পাশাপাশি সে প্রাকৃতিক সদস্যদের ভাষাও শিখে গেছে, কথা বুঝতে পারে তাদের, তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথাও বলতে পারে। ‘তোমাদের প্রাচীন দর্শন জগৎবাসীকে অনন্ত জীবনের কথা শুনিয়েছে। মোক্ষলাভের উদ্দেশ্যে তোমাদের মুনিঋষিরা অনন্ত জীবন অর্জনের পথ কিভাবে পাওয়া যেতে পারে তার সন্ধান দেখিয়ে গেছে। এখানেই তোমাদের বিশেষত্ব। তোমাদের পুরাণ শাস্ত্র তাই অদ্বিতীয়। তোমরা ধর্মকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মত চর্চা করনি। ধর্ম তোমাদের কাছে মোক্ষলাভের উপায়, যা দেয় অনন্ত জীবনের সন্ধান।’
পাশেই অন্য একটি অপেক্ষাকৃত নিচু পাথরে বসে কথাগুলি বলছিল গেরহার্ট। দু’হাত দুই হাঁটুর ওপর রেখে আঙুলগুলির পারস্পরিক আলতো বন্ধন তৈরি করে আর চোখ ফেলে অনির্দিষ্ট সম্মুখে। পাহাড়ি দেয়ালের ছায়ার ভাষায় সূর্য জানিয়ে দিচ্ছিল যে ওখান থেকে তাকে দেখা যাবে না। ‘যদি তুমি আরও শীতলতাকে পছন্দ কর তো এখানে এসো,’ উন্নত ঢালের আচ্ছাদন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে থাকা ছায়া ওকথা বোঝাচ্ছিল দীর্ঘায়িত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায়। পরিবেশ নিঃশব্দ হতে পারেনি যেহেতু কোথাও কোন আড়ালে একটানা চলমান থাকার কৌশল ব্যবহার করে হাওয়ার সম্মিলিত শনশনানি কলরবে কণ্ঠ মুখর রাখছিল বিরামহীন ভঙ্গিমায় শোনাতে শোনাতে, ‘আমরাও আছি, আমরাও আছি।’
উন্মত্ত হাওয়ার এই প্রবাহ এখানে এই ত্রিধাবিভক্ত পর্বতগাত্রের কল্যাণে বিরচিত খাঁজের ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলে প্রবেশ না করতে পেরে কেবল তাদের মৃদুকন্ঠের দামাল উপস্থিতি ঘোষণা করছিল। সেই শৈত্যপ্রবাহের অস্ফুট রেশ এখানেও বর্তমান যদিও সৌরকিরণের দুর্বলতা প্রকাশিত ছিল ক্ষীণ তপ্ত ভাষ্যে, ‘আরও সতেজ থাকার উপায় কী আমার ?’ কারণ এখানে এই বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে আবহাওয়ার চরিত্রে উষ্ণতা অনুপস্থিত গ্রীষ্মের এমন প্রখর সময়ে। এটাই স্বভাব এই অঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন ঘোষণায়, ‘আরও বেশি উষ্ণতা আমার চরিত্রে নেই। কী করব, এখানে আমাকে এমনই মেজাজে দেখতে পাবে। থেকেই দেখ, ভালো লাগবে অবশ্যই।’ শৈবাঙ্কন শ্রোতা হয়ে থাকতে পছন্দ করে সবসময়, আর এখনও। কী শুনে তার কী মতামত সহজে সে ব্যক্ত না করতে অভ্যস্ত। তার আয়ত কালো চোখও কথা বলে না, ওষ্ঠাধরে অনুচ্চারিত ভাষা ভরাট মুখমণ্ডলে কোন ভাব প্রকাশ করতে জানে না। প্রশস্ত কপালে থাকে না ভাঁজ, এলোমেলো অযত্নলালিত দীর্ঘ কালো চুল কাঁধে নেমে থাকে নীরবে, চঞ্চল থাকে স্পষ্ট প্রকাশিত আলম্ব দুটি কানের দু’পাশে। তার স্থির সমর্থসবল ঋজু দেহে থাকে না কোন চঞ্চলতার প্রকাশ, প্রশস্ত দুই কাঁধ থেকে নেমে আসা কোলের ওপর রাখা দু’হাত সে কথা বলুক আর না বলুক চলাচল করে না। এতকিছু বলার পরও তাকে নীরব দেখে গেরহার্ট প্রশ্ন করেছিল তার মুখে দৃষ্টি ফেলে,
‘তুমি কোন্ ধর্মে বিশ্বাসী ? বৌদ্ধ ? এই অঞ্চলে জানি বজ্রযান মতাবলম্বী বৌদ্ধরা থাকে। বৌদ্ধধর্ম মূলত হিন্দুধর্ম থেকেই বিচ্যুতি ঘটিয়েছে এবং এখানেও আছে অনন্ত জীবনের বিশ্বাস, যেহেতু তারা জন্মান্তরবাদকে মেনে নিয়েছে। তারাও বলে, একই মানুষ এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে বিচরণ করতেই থাকে বিভিন্ন পরিচয়ে আর এভাবেই কোন মানুষের মৌলিক সত্ত্বা অবিকৃত থেকে যায় অনন্তকাল যা অন্য কথায় অমরত্বেরই এক বিশেষ রূপ। তুমি কোন্ ধর্মমতে আছো ? বৌদ্ধ বলে মনে তো হয় না তোমার চেহারা আর পোশাক দেখে। মুন্ডিতমস্তক নও, অঙ্গ আচ্ছাদিত নয় তাদের নির্দিষ্ট পোশাকে। হিন্দু মনে হচ্ছে, কিন্তু সন্ন্যাসী বলেও মনে হয় না। অথচ থাকছ এখানে। স্থানীয় অধিবাসী যে নও তাও তোমার চেহারায় স্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে সমতলের মানুষ।পরিব্রাজক ?’ এবার কিছু বলতেই হয়, না বলা অশোভন। মৃদুকণ্ঠে সে জানাল,
‘ঠিকই ধরেছ, আমি সন্ন্যাসী নই। না বৌদ্ধ, না হিন্দু সন্ন্যাসী। আমি সমতলেরই বাসিন্দা ছিলাম। পরিব্রাজকও ঠিক নই। আমাকে অভিযাত্রী কি বলা যায় ? নিজেও জানি না আমি ঠিক কী। তবে এখানে আছি এই অঞ্চলকে ভালো লেগেছে বলে। মনে হয়েছে এখানে হয়তো এককালে দেবতারা বসবাস করত। এখানকার আকাশে-বাতাসে-পরিবেশে এখনো তাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আমি অনুভব করি। মনে হয় এখনো তাদের স্পর্শ থাকছে এই এলাকার অঙ্গসজ্জায়, সুউচ্চ পাহাড়ের ঢালে, বিছিয়ে থাকা পাথরের মেলায়, গিরিখাতে, স্পিতি নদীর জলধারায় আর তার ওপাশের গুচ্ছ গুচ্ছ টিলা ও শৃঙ্গের বর্ণবৈচিত্রে। এখানে শৈত্যপ্রবাহে, সূর্যকিরণের নানা চরিত্রে, অবারিত প্রান্তরের ঢেউখেলানো ছন্দে, হাওয়ার চলাফেরায়, পাহাড়ি ঢালের গাম্ভীর্যে আর রাতে অন্ধকার ঘনঘটায় তারকারাজির নিঃস্পন্দ কোলাহলে বা পূর্ণিমাতিথির চন্দ্রকলার জ্যোৎস্নাবিকশিত ভাষ্যে আমি সেইসব দেবতাদের অশ্রুত কণ্ঠের আলাপ শুনতে পাই। আমি আধুনিক প্রযুক্তির প্রশ্রয়লালিত ক্রমশ ভাষা ভুলতে যাওয়া মানুষের ভিড়ে থেকে থেকে জীবনের স্বাদ আর আহ্লাদ হারিয়ে চলে এসেছি এখানে। ফার ফ্রম দা ম্যাডিং বাট স্পিচলেস ক্রাউড এখানে খুঁজতে এসেছি নীরব প্রকৃতির বাসিন্দারা সবাই আমার সঙ্গে সবাক হতে পারে কিনা তার সন্ধানে।’
সে যতটা সময় নিচ্ছিল তার সমস্ত কথাগুলি বলার জন্য ততক্ষণ গেরহার্ট নির্বাক শ্রোতা হয়ে রইল। তার চোখ থাকল সোজাসুজি পাহাড়ি ঢালের আড়াল থেকে বেরিয়ে রয়েছে যতটুকু আকাশের নীল সমাচার তার দিকে, যদিও সেই নীলে তার নীল চোখ ঠিক পড়েছে এমন মনে হচ্ছিল না। শৈবাঙ্কন থামলে পর তার দিকে ফিরে তাকিয়ে গেরহার্ট দরদভরা গলায় জানাল,
‘তোমার এই মনোভাব আমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, প্রায় হুবহু। কী জান, কোন মানুষই পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ নয়। জীবনের কোথাও না কোথাও প্রত্যেকেই তার দোসর খুঁজে পায়। আধুনিক পৃথিবীর চালচলন আমারও পছন্দ নয় বলেই বছরের অধিকাংশ সময় আমি ঘুরে বেড়াই। হিমালয় আমাকে অভিভূত করে, এই পর্বতমালার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে তার মতই সুউন্নত সুগম্ভীর দার্শনিক তত্ত্ব, অবশ্যই বৈদিক হিন্দু সভ্যতার, যেখানে লুকিয়ে রয়েছে জীবনের রহস্য। তারই টানে আমি এখানে বারবার আসি, বিগত দশবছরে অন্তত ছ’বার তো হবেই। যতবার এসেছি ততবারই মনে হয়েছে জীবনকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি, চোখে পড়েছে কিছু না কিছু অভিনবত্ব। এই পর্বতশ্রেণির খাঁজে খাঁজে, শৃঙ্গরাজিতে, আনাচে-কানাচে জড়িয়ে আছে বৌদ্ধ আর হিন্দু দর্শনের অমৃতভাণ্ডার, যেখানে পাওয়া যায় অমরত্বের সন্ধান। এই অমরত্বের খোঁজেই এখানে গুহায় বসতি স্থাপন করে ধ্যানমগ্ন থেকেছেন সহস্রাধিক বছর ধরে তপস্বী ঋষি ও সন্ন্যাসীরা।আমাকে এই ব্যাপারটা বিস্মিত করে। আমি এখনও বুঝতে পারি নি ওই দার্শনিক তপস্বীরা কেন অমরত্বের সন্ধানে মগ্ন থেকে জীবনের মোহ ভুলে যেতেন। জীবনের মোহই যদি তাঁদের না থাকল তো অমরত্বের খোঁজ কেন ? ব্যাপারটা কী, কিসের এমন ব্যাকুল সন্ধান ?’
জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল গেরহার্ট। সে কিছু উত্তর আশা করছিল। একটু তাই চুপ করল। শৈবাঙ্কন কিছু বলল না, সে বুঝতে পারল না কী বলা উচিত। নির্বাক ভাষা তার চোখেমুখে, স্থির অচঞ্চল বসে থাকা। তাকে নিরুত্তর দেখে গেরহার্ট প্রশ্ন তুলল,
‘তোমার কখনও অনন্ত জীবনের রহস্যটা কী জানার ইচ্ছে হয়নি ? অবশ্য তোমার এই নির্জন প্রদেশে আসা যদিও অন্য কারণে, তবুও জিজ্ঞেস করছি যেহেতু তুমি বললে দেবতাত্মার অন্বেষণ তোমার একটা বড় উদ্দেশ্য। দেবতারা তো হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী অমৃতের অধিকারী হওয়ার সুবাদে অমরত্বপ্রাপ্ত। তুমি কোনদিন এই অমরত্বের বিষয়ে কৌতূহল বোধ করোনি ?’
খুবই নরম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে, কোনভাবে উত্তর দেওয়ার মত। সত্যিই তার এই ব্যাপারে কোনদিন কৌতূহল হয়নি। অমরত্ব শব্দটা জানে সে, এই পর্যন্ত। কিন্তু এই জানা অন্য অনেক কিছু জানার মত যেসব বিষয় মনে কোন দোলা দেয় না। তাকে এই একই ব্যাপারটা বলেছিল সন্ন্যাসী জীবাক্ষ। এইতো কয়েকদিন আগে। কী আশ্চর্য, কথাটা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তার কাছে উত্তর জানতে আসবে সে বলে গিয়েছিল। কিছু তো বলতেই হবে। ভাগ্যিস আজ গেরহার্টের সঙ্গে দেখা হল, তাই তার মনে পড়ল বিষয়টা। কিন্তু কী বলবে সে ওই ভিক্ষু সন্ন্যাসীকে ? তার কি অনন্ত জীবনলাভের অভিযানে যাওয়ার কোন ইচ্ছে আছে ? বর্তমান জীবনের ব্যাপ্তিকে দীর্ঘায়িত করে যাওয়ার এমন বিশেষ এক প্রক্রিয়া যার আবিষ্কার দেবে অনন্ত জীবন। সেই বিশেষ উপায় প্রাচীন মুনিঋষিদের করায়ত্ত ছিল বলে শোনা যায়। তা কি গল্পকথা নাকি বাস্তব ? কিন্তু তাতেও কি অমরত্ব পাওয়া গিয়েছিল ? যদি যেত তো সেদিনের সেই মানুষগুলি আজ গেল কোথায় ? তাদের তো এখনও বেঁচে থাকার কথা ছিল ? তারা তাহলে অমরত্বের কথা কেন বলেছিল বা কী অর্থে অমরত্বের সন্ধান করছিল ? অনন্ত জীবন বলতে জীবাক্ষই বা কী বোঝাতে চেষ্টা করেছে ? কোথায় কিভাবে চলবে তার অন্বেষণ ? আরও বড় প্রশ্ন, কী উদ্দেশ্যে এমন অনুসন্ধান।
লোকজনের গলার আওয়াজ শোনা গেল ধারেকাছে। অনেকে মিলে এগিয়ে আসছে বোঝা যাচ্ছিল। গেরহার্ট উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘সঙ্গীরা আমাকে খুঁজছে। আমি এবার যাব। তাবো হয়ে কাজা, আর সেখান থেকে চন্দ্রতাল লেক। পথে আরও কিছু গন্তব্য আছে, যেমন ধনকর ভিলেজ ও ধনকর লেক ট্রেকিং, হিক্কিম আর কিবের ভিলেজ, কি মনাস্ট্রি, তারও আগে পিন ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক, মাড ভিলেজ এইসব। হয়তো তোমার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। আরও খানিকটা সময় থাকতে পারলে ভালো হত। একই মানসিকতার লোক জীবনে ক’জন পাওয়া যায় ? আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাই। কিভাবে সম্ভব, বল ?’
গেরহার্ট দাঁড়িয়ে কথাগুলি বলতে বলতে তার দিকে সাগ্রহে তাকাল। সে কী বলবে নিজেও জানে না, মুখে সে কথা না বলে মাথা নেড়ে জানাল সেটাই। এই নীরব প্রদেশ তাকে নির্বাক থেকে কথা বলতে শিখিয়েছে। প্রকৃতিও সবাক হয় অন্তরের ভাষায়, মৌখিক ভাষার কোন ভূমিকা নেই এখানে। দেবতারাও নিরুত্তর থাকে, সাড়া দেয় না ডাকাডাকিতে। উপলব্ধি করা যায় তাদের উপস্থিতি আর কার্যকলাপ এমনটাই বিশ্বাস করে সবাই। তাই তাদের অন্তর্যামী বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় মুনিঋষিরাও এভাবেই বাক্য বিনিময় করতে শিখেছিলেন, মুখে কথা বলতেন না তাঁরা কেউ, কথা বলতেন অন্তর দিয়ে। ধ্যানমগ্ন হয়ে জেনে যেতেন মানুষ, জীবজন্তু বা অন্যসব বস্তুসমূহের মনের কথা। প্রচলিত বিশ্বাস অন্তত এটাই জানায়।
সঙ্গীরা সবাই খুঁজতে খুঁজতে এসে গেল। তিন-চারজন মহিলা-পুরুষ। শৈবাঙ্কনকে দেখিয়ে গেরহার্ট অল্প কথায় জানাল তার বিবরণ। তারা সবাই কৌতূহলী হয়ে আরেকটু নিকটে এসে ঘিরে দাঁড়াল। একজন তার দামি ক্যামেরা হাতে নিয়ে অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
‘ছবি তুলতে পারি তোমার ?’
সে আপত্তি করল না। আবারও মৃদু মাথা নেড়ে উত্তর দিল সে, সম্মতিজ্ঞাপক। তবে উঠল না তার আসন থেকে। পাহাড়ি ঢালের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি কোণ থেকে ছবি তোলা হল বেশ কয়েকটি। অন্য আর সবাইও এগিয়ে এল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মোবাইল ফোনে তাকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলে গেল একের পর এক। এবং গেরহার্ট নিজেও। আবার সে তার সঙ্গীকে দিয়ে তার ক্যামেরাতে দ্বৈত ছবিও তোলাল বেশ কয়েকটি। সবাই মিলে যৌথ ছবিও তোলা হল।
‘কিন্তু তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব কিভাবে তার তো কোন নিস্পত্তি হল না ? তোমার মোবাইল নম্বর দাও।’
গেরহার্টের আকুল জিজ্ঞাসার উত্তরে সে মাথা নাড়ল খুবই মন্থর ভঙ্গিতে। নেতিবাচক সেই আন্দোলন দেখে বিস্মিত-হতাশ প্রশ্ন তুলল গেরহার্ট তার দিকে তাকিয়ে,
‘তোমার মোবাইল ফোন নেই ?’
সে নেতিবাচক মাথা নেড়ে উত্তর দিল। গেরহার্ট জিজ্ঞেস করল,
‘নেই ? কেন ? মোবাইল ফোন নেই তোমার ? যোগাযোগ রাখো তাহলে কিভাবে ?’
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সে, অস্পষ্টভাবে। এবার তাকে কথা বলতেই হবে বলে সে বলল,
‘আমি বোধহয় আমার কথা তোমাকে বোঝাতে পারিনি। বললাম না তোমাকে, বাইরের পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে একা থাকব বলেই আমি এখানে চলে এসেছি। তুমি কেন ভাবলে আমার কাছে মোবাইল ফোন থাকবে ?’
কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিতভাবে নিস্পলক দাঁড়িয়ে তাকে দেখল গেরহার্ট। তারপর দুঃখিত ভঙ্গিতে বলল,
‘ক্ষমা করবে। আসলে সভ্য মানুষের স্বভাবদোষ ভুলতে পারিনি।’
পকেট থেকে ছোট্ট নোটবই বার করে কলম দিয়ে লিখল তার পাতায় কিছু। সেই পাতাটা ছিঁড়ে তাকে দিয়ে বলল বিনীত মিনতির ভঙ্গিতে,
‘এখানে আমার ঠিকানা আর মোবাইল নম্বর রইল। প্লিজ রাখো, আর একবার অন্তত আমাকে ফোন করো কোনদিন।’
শৈবাঙ্কন আপত্তি করল না। হাত বাড়িয়ে কাগজের টুকরোটা নিল।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)