শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(যা কিছু দেখি, তাই কি বাস্তব, নাকি যা কিছু অন্তরালে থাকে সেই আপাত অদেখা জীবনেই লুকিয়ে আছে বাস্তবের সারাৎসার। আমরা যদি কোন জাদুবলে সেই অদেখা জীবনকে জীবন্ত করে তুলতে পারি, গোটা সমাজজীবন আর তার চারপাশের চেনা জগৎটাই হয়ত একদিন পাল্টে যাবে, কিংবা অবাক হয়ে ভাবতে থাকবে, যাকে বাসভূমি বলে জেনে এসেছি এতকাল, আদপেই তা নয়, আসলে চোখে পট্টি পরানো সম্পূর্ণটাই এক ধাঁধার জগৎ। লেখক এই উপন্যাসে তার খোলস ছাড়িয়ে আসল জগৎ ও ঘুমন্ত মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন অন্য মোড়কে, যা আসলে স্বপ্নভঙ্গ নয়, কোন এক সুন্দর সকালে দেখে ফেলা আলো ঝলমলে জগতের বাহিরে ভিন্ন এক ভূমি, লড়াকু মানুষের জীবন, পশুদের চিৎকার, পাখিদের কলরব, পরম্পরায় মাখা নোনা ঘামের কলেবর। উপন্যাসে বিচরণ করুন আর সেই কুশীলবদের নতুন করে আবিষ্কার করুন, চিনে নিন অচেনা, অপরাজিত, অপরিচিত নতুন এক বাস্তবতা, লেখকের সৃষ্ট জগতের অপরনাম ‘অমরাবতী’ । )
চতুর্থ অধ্যায়
নাম সংকীর্তন সেরে জঙ্গল সাধুখাঁ যখন ইহকালের পাপবোধ থেকে মুক্ত হতে চাইছিল ঠিক তক্ষুনি ওর ডাক পড়ল। ‘এত চটজলদি মুক্তি চাইলে হবে বাপু, জীবন যে অনেক কিছু এখনও চেয়ে বসে আছে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তো কী হয়েছে, সে কি এত সহজে ছাড় দেবে?’ জঙ্গলের তখনও বিশেষ কোন ভাবনার পাহাড় এসে জমা হয় নি। একটা সমতার খেলাই খেলছিল এতদিন যা খেলছিল এঁটেল মাটির মতো, এখন খানিকটা কাদা মাটি, পিছল খেয়ে চলে যায়। জীবনের মর্মাথ কী খোঁজার সুযোগ থাকে! যে গাছটা লম্বা হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে সবুজ পাতার ফাঁক ফোকরে হলুদ পাতার আত্মীয়তায় জড়াতে চাইছিল, বলছিল যার ফুরিয়ে যাবার সময় হয়েছে তাকে ধরে রেখে কী লাভ! বিবর্ণ পাতাগুলো দুই তিন ভোল্ট খেতে খেতে এসে পড়ল জঙ্গল যেখানে ডালা নিয়ে বসেছিল, ঠিক নাক বরাবর। এমনিতে দূর্ভোগের অন্ত নেই, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। টিয়া চন্দনারা বিনা বাধায় ছ র্ র্ র্ করে ছেড়ে দিল মাথার তালুতে, কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই, পেট ছাড়াড় কথা উঠেছিল বলেই যখন তখন মাথার তালুর ওপরে আগাপাশতলা না ভেবেই এমন কাণ্ড বাঁধিয়েছে। ‘হারমজাদা রাধাচূড়া আমার সঙ্গে বেইমানি, জন্মাতে দেখেছি লজ্জা করে না। ট্রামলাইনটার পাশ থেকে যেতি তো ধাপার মাঠে, ভাগ্যিস চোখটা পড়েছিল, না হলে কী দশা হত, বংশ নিব্বংশ হতো, কত বড় বেইমান। ‘ মানুষের উপর দায় না চাপিয়ে, যত দোষের ভাগ ওর! হরি হে দীনবন্ধু কাছের মানুষ দূরে যাবে, দূরের মানুষ মজা লুটবে, এই তো জগৎ সংসারের নিয়ম। কাঁকটা কা কা করে উঠলে জঙ্গল চমকেই ওঠে। শ্রবণশক্তি কমে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন আক্বেল গুড়ুম হয়, লাথি ঝাঁটা খেয়ে আর শোধবোধ থাকে না। সেই তো সাতসকালে সাইকেল চালিয়ে দশ মাইল দূর থেকে টানা ছয় ঘন্টা খরিদ্দারের সঙ্গে বকর বকর। ওই তো পুঁজি। বিকেলে ট্রেনে চেপে পাইকারি বাজারে লাইন লাগান। কে আর অত পাত্তা টাত্তা দেয়। বাপ-ঠাকুরদাকে কেউ গণায় ধরেনি, দূর দূর করে তাড়িয়েছে, শেষমেষ বাজার কমিটির হাতে পায়ে ধরে একরকম মাটি আঁকড়ে বসেছিল। ঝাঁকা মাথায় নিয়ে দু-চারটে কাগজি গন্ধরাজ লেবু, বেগুন ঢেড়স দূর দূর গাঁ থেকে কিনে ভোর রাত থেকে পায়ে হেঁটে তবে না বাজার ধরা। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে আধপেটা খেয়ে সেই যে বুকের ব্যামো বাঁধালো, এক ধাক্কাতেই সব শেষ। জঙ্গল এখন বুঝতে পারে না কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক, সব হিসেব গোলমাল হয়ে যায়। বাবার স্মৃতি আঁকড়েই বাকি পথটুকু চলে ফেরে বেড়ান। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করলেও জঙ্গল মুখ চেয়ে বসে থাকে কখন সুফল এসে টিফিন ক্যারিয়ারে ওর সবজি ভাতটা নিয়ে হাজির হবে। আরো দু-চারটে ভাতের হোটেল যে চারপাশে গজিয়ে ওঠেনি এমন নয়, তবুও পুরনো আমলের ঠাকুর সুফলের সঙ্গে ওর আত্মার সম্পর্ক, এই কথা ও ভুলবে কেমন করে, দেরি একটু না হয় হল, সুফল তো বারবার করে যে ওর বাবার কথাই মনে করিয়ে দেয়, তার দামই বা কম কী! তবু দিন দিন এই যে জায়গাটা পাল্টে যাচ্ছে, মেনে নিতে একপ্রকার যন্ত্রণাই হচ্ছে। কেউ কেউ প্রশ্নও তো করে ‘কীরে জঙ্গল এত ঝিমুচ্ছিস কেন? বাজারের গতিক ভালো নয় বুঝি।’ কাঁকটা এবার ফাটিয়ে চিৎকার করল ‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ উত্তরটা জঙ্গলের হয়ে ওই ছাদে বসা কাঁকটা দিল কিনা, আংশিক সত্যটাই কি প্রকাশ হল? সফলের দুশ্চিন্তায় দিন যায় আর বাজারের অন্দরে বেড়ে ওঠা বাজারটার দিকে চেয়ে থাকে। মাঙ্গা হয়েছে বলে কত কথাই না শুনতে হয়। সইতে হয়, আবার কথার ঝাঁজ থাকলে জবাব দিতে পিছপা হয় না – ‘বাবু, যত দোষ জঙ্গল সাধুখাঁর, আসল দোষী যে কলার তোলে ঘোরে, সে খেয়াল আর কার আছে? অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়।’
তলার পর তলা ওঠে। বড় মজবুত এই বহুতল বাড়ি। পুরুষের পর পুরুষ পার হয়ে গেল, জঙ্গলরা যেই তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেল। চঞ্চলের কাছে মনে হল সব ভোজবাজি। আলো আঁধারের ভোল বদলালে কখনও সখনও এরকমটা হয়ে থাকে। এই আছে এই নেই, বড় আজগুবি এই দেশ, গুঁড়িয়ে দিতে
কে আর কতটা ভাবে। বাড়িটার গায়ে কালচে ছোট ছোট দাগ পড়েছিল, মজবুত ছিল এইকথা বলা যাবে না, লোকজনের আনাগোনাও ছিল, কত গল্পের ছিল ছড়াছড়ি। জন্ম মৃত্যুর হিসেবের কথা সে তো কেবল মূর্খের কাজ, তাই না! জমা খরচের হিসাব সকল লেনাদেনা সকলে চোখ পাকিয়ে দেখেছে। আর কেউ চোখের জল ফেলুক না ফেলুক জঙ্গল দরদর করে কেঁদেছিল। বলেছিল ‘কেন যাব, যাব কেন?’ গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। কী জানি ওই ভাঙনের সময়টা মিষ্টি না তেতো। চালওয়ালা বোকা বলল, ‘ বাবুলোকদের জন্য রোজ পাঁচ কেজি করে চালের অর্ডার ছিল বাঁধা।’ যে দু-একটা পুরণো দোকান নিজেদের সগর্বে অস্তিত্ব ঘোষণা করছে পরাজিত বীর সৈনিকের মতো, চঞ্চল ঘুরেফিরে সেই দরজাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল, সময়টা বোধহয় এইভাবেই একদিন নতুন হয়ে ওঠে। নতুনের গর্জনে সব ওলট পালট হয়ে যায়, পুরাতন এসে শেষবারের মতো নিস্ফল মায়াবী বন্ধনে জড়াবার চেষ্টা করে। দেড়শ বছর আগের পোড়া ইট বালি সিমেন্ট আর লোহার বিমগুলোর লরির পর লরি এসে শেষকৃত্য সম্পন্ন করে। চঞ্চলের কানে যেন মরাকান্নার এক জরাগ্ৰস্ত বাজনা এসে গুনগুন করে। চঞ্চল অস্থিরময় হয়। ‘কেউ আপনারা নিজের কথাগুলো বললেন না।’ ‘ বলেছে না! মিউ মিউ করে বলেছে।’ চঞ্চল অবাক হয়ে জঙ্গলের দিকে তাকালো। ‘ তুমি দেখেছিলে লোহার রড, বিশালকায় স্ল্যাবগুলো একে একে কীভাবে জায়গা দখল করে নিচ্ছিল?’ জঙ্গল নিশ্চুপ হয়ে যায়। চঞ্চলের উচ্চারিত শব্দগুলো ওকে ধাক্বা মারে কিন্তু বেশিদূর পৌঁছতে পারে না। গুড়গুড় শব্দ করে। ক্রেইনের ওঠানামার শব্দগুলোর তুলনায় বড়ই ম্রিয়মান। কাঁকটা শাগরেদ জুটিয়ে সমস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়। চঞ্চলকে দেখে জঙ্গল কথাগুলো আওড়াতে থাকে। কীসের কথা? বলার কথা তো বটেই। মানুষগুলো কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসবে এক এক করে। কোটি কোটি টাকার বান্ডিল এনে হাজির করবে। ওরা এমনি করেই নিদ্রা যায়। সুখই সুখ, সুখের গগণে উড়ে উড়ে বেড়ায়। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে থাকে জঙ্গলের। কত পুরুষের অনিশ্চিত জীবন। ওই তো গাঙের বুকে কালো জলে ভরা মানুষের লাশ ভাসে। টলটলে জলে কোন পুরুষ পশরা নিয়ে নাও ভাসাত। বানের জলে কাঠের টুকরো হাফিজ, কুকুর বেজি ইঁদুরের লাশ নিয়ে জলে ভাসলো। জঙ্গল ইঁদুরের জায়গা নিল। কোন রকমে থামের গোড়ায় প্লাস্টিকে মুড়িয়ে পরিচয় দিল – ওই দেখছ আমার বাপকেলে জায়গা, কেমন লাগছে। চলেই তো আসছে। জোটেনি তো এক চিলতে, একটা হিল্লে তো হতো। ত্রিশটা বছর গেল। ওই লোকগুলো টাকার জোরে এমন আস্তানা গড়ল, চার পুরুষ ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলল, আমফান, যশ সব ধোপে টিকল না,এমন ইমারত বানাল, জঙ্গলের টিনের চাল উড়ে উড়ে গেল, দেয়াল খসে পড়ল। জঙ্গল নিজের গান নিজে লিখল, সুরের টানে এতকাল নিজেই মাতাল, এমন করে ঠোঁট নাড়াল, যারা রাস্তার ধারে নাড়া বেঁধেছিল, বুঝতেই পারল না, কোথায় শুরু কোথায় শেষ। চঞ্চল শুনে বলল, ‘ভায়া হিম্মৎ রাখ। কেউ ওদিকে ফিরেও তাকাবে না, এমন দিন আসছে।’ কাঁকটাও তালে তাল মেলাল – ওই দেখ জীবন হাসছে আর বলছে তোমাদের দশ পুরুষের জাবদা খাতা খুলেই যাবে একদিন। জঙ্গল কোন কথার মানেই বুঝল না। সাইকেল চালিয়ে ক্রিং ক্রিং শব্দ করে গলিপথ ধরল। ‘ পড়ালেখার বাবুটা পাগল।’
বিলুর উৎকণ্ঠা নিজের অঙ্গনে ঘোরাফেরা করে নিজেই যখন খোঁজার আকুতিকে চতুর্গুণ করল, পদ্মপলাশই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, বলেই ফেলল জোর গলায়, ‘তুমি আমায় চিনলে কেমন করে গো?’ ‘দেখলাম যে হুবুহু অধিকারী বাড়ির পোষ মানানো হরিণের মতো, যতই খাঁচায় পুরুক, পালিয়ে ও যাবেই, সে তুমি যতই আটকে রাখার ফন্দি কর। তুমি বলবে কেমন করে পালাল? সে কী আর আমি জানি। জানতে পারলে আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার হয়ে যেত। তবে এটা জানি কেমন করে সশরীরে স্বর্গে যাওয়া যায়।’ ‘তোমার গল্প শুনেছি বটে, কিন্তু এত গোপন কথা জান, সে তো জানতুম না।’ ‘এত তো খুঁজে মরি, এই পথের খোঁজে বের হব, এ জানব না। এই দেখ, এই রহস্য জানবে বলেই তো ওরা আমার পিছু নিয়েছে।’ পদ্মপলাশ বিলুর চিন্তার এই বন্ধনকে নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। মিল খুঁজে বেড়ায় নানা রঙে। পদ্মপলাশ জানতেই পারল না ওকে জানবে বুঝবে বলেই এই কানা গলিতে অনুসরণ করে চলেছে বিলু। হোঁচট খায়নি বলতে চাইছেন, কত যে রক্ত ঝরেছে। ঝরছে ঝরুক, তাই বলে পথচলা তো থামাতে পারেনা। বিলু জানে ওর জীবনের গল্পগুলোতে আগুন আছে। সেই আগুন জীবনকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে যে কোন মুহুর্তে। তাই তো ওর এত জ্বালা। ও কি বিশেষ কোনো হুঁশিয়ারি দিতে চায়! বলতে চায় এই বেপরোয়া জীবনে রাশ টানতে না পারলে ধ্বংস অনিবার্য। পদ্মপলাশ কি দেখেও দেখেনি এই অনুসরণকারীকে। বিলুর মতলবে কোন দূরভিসন্ধি জেনে পাল্টে দিয়েছিল ওর চেনা পথ। বলতে কি শোনেনি, শুনেছে কত কথা, মানুষের চলার পথে এখন কত চোরাগলি, ওরা ঘুমিয়েছিল, না জেগে ঘুমিয়েছিল বিলু কেমন করে জানবে। পদ্মপলাশকে ডেকে বলতে পারে, ‘যেয়ো না গো, ও পথে কাঁটা আছে।’ শুনবে কি শুনবে না ওর সিন্ধান্ত। গাঁক গাঁক করে চলে যায়। ওর ভেতরে জ্বালা, বাহিরে জ্বালা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্ক্রুডাইভার, ফিল্টার, টিডিএস মাপার যন্ত্র, মেমব্রেন,পাম্প মোটর নিয়ে বড় রাস্তা থেকে গলি, তস্য গলির ভেতর ঢুকে পড়ে বড়লোক, মেজলোক,সেজলোকদের দরজায়। ওর অবস্থানটা যে কোথায়, জানে না তো, ছোটলোক কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর ওদের সম্বোধনের মধ্যেই, নিন্দেমন্দের মধ্যেই গুমড়ে মরছে। বিলু তো সবজান্তা, কিছুটা বেশিই জানে। এই বিশেষ বিদ্যাটা জানে বলেই না এত ওর দুশ্চিন্তা, টেনে হিঁচড়ে নিতে চায়। ‘ও ছেলেটা জবাবটা তো দিতেই পারিস, মুখ বুজে কত আর সইবি বাপ, মানুষ কি নয়, না রোবট।’ চোখের সামনে চোখে মুখে রক্ত তুলে মরে গেল, জ্বলন্ত পিচের গোলা এসে পড়ল পাঁজরে। বয়স আর কত সতের আঠারো হবে, ঠিকাদার মালিক, পাড়ার লোকজনই সম্বল কিনা, বাপের চিকিৎসা তো করাল, টিকে ছিল বছর তিনেক, যেই কে সেই। নেমে তো পড়ল রাস্তায়। বিলু তো এইসব দেখতে পায়, মিথ্যে তো নয়, ‘লোকে যা ভাবছে ভাবুক না, ভাবাভাবি দিয়ে তো দোষগুন বিচার হয় না, লাথি ঝাঁটা খাচ্ছিস, এই কথা চাউর হতে কত বাকি, এই কথা কি আর বুঝি না।’ ‘দেব না আবার, বাবুরা উল্টোসিধে বললে ছাড়ি কি আমি। ঝেড়ে দি,বেশি দাঁত ফুটিয়ো না, গরীবের ছেলে বলে কথা জোগাবে না মুখে, এ কেমন করে বুঝলে।’ পদ্মপলাশের চোয়ালটা শক্ত হচ্ছে কিনা। শক্ত হয়ে চলেছে আবার নরমও হচ্ছে, চোখের চাহনিতে কত ভাষা ঘুরে ঘুরে মরল, আবার জেগে উঠল। জেগে
গিয়ে থেমেও তো যায়। রীক্সা স্ট্যান্ডের ছেলেগুলো বিলুকে কত তোষামোদি না করে। করবে নাই বা কেন, উত্তর দক্ষিণের খোকাখুকু, ছেলেবুড়ো, নানা নানী, দাদা দাদী কেউ কি আর বাদ যায়, নাড়িভুঁড়ি টেনে সকল কথার আদ্য শ্রাদ্ধ করে ছাড়ে। মুখের উপর দাবি পেশ করেই ছাড়ে না, সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কী জানি কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হবে কিনা, কে আর বলবে? পূর্ব পশ্চিমে গুণকীর্তন তো কম হচ্ছে না। বিলুর আবার থোরাই কেয়ার। ভাবের ঘোরে দিন কাটে, মন মানে না। মানুষের মন চেনার কত আন্দাজ কত গালগল্প সবই তো জানার জন্য ছিপ ফেলে বসে থাকা, কখন বরশিতে মাছ গেঁথে তুলবে, সেই ধান্দায় না থাকে। ভুলু তখন তড়িঘড়ি করে রীক্সার প্যাডেল ঘোরায়, সে কি আর ঘোরে, কে যেন ঘুরিয়ে দেয়। আরে পড়বি তো পড়, ধড়াস করে পথভোলার ঘাড়ে, পথ চেনে না, ঘাট চেনে না, গন্তব্যে যাওয়ার টান।
কত আর বয়েস। এই বয়সে জোশ থাকবে না সেও কি হয়, তাতে যত বিপত্তি। নিশ্চুপ নিঝুম নিরালায় বসে ওরা দিন গোনে। শেষের কি আবার অন্ত হয়! ভুলু আঙ্গুল পাকিয়ে পাকিয়ে স্পঞ্জ কারখানার কোল ঘেঁষে চলে যাওয়া সরু রাস্তার পাশে ভাঙাচোরা টিনের ঘরটার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলতে চায়। ডানা ঝাপটে চন্দনা পাখিগুলো দলবেঁধে কিচিরমিচির করে, খুঁটে খুঁটে পিচের আস্তরন ছাড়িয়ে এগিয়েই অল্পস্বল্প মাটির ঢেলাগুলো আছাড়ি পিছাড়ি খুঁজে বেড়ায়, যদি কিছু মিলে যায় খুদকুঁড়ো। ভুলু গেঞ্জিটা উপরে তুলে পেটের ভাঁজে ভাঁজে হাত বুলায়। বাপ খেদানো, মায়ের দুচ্ছার করা জীবনটা ওকে এর চেয়ে ভাববার বেশি সুযোগই দেয় না। না হলে ঘর ছেড়েছে এক গেলাস জল খেয়ে, সারাদিনটা কেউ জিজ্ঞেসও করেনি বগার ছেলের পেটে দানাপানি পড়ল কি পড়ল না। রীক্সাটা নিয়ে এক পাক মেরে তাসের আড্ডায় এসে জমে গেল, জমবে না আবার! বগা জুয়ার আড্ডায় গিয়েই তো দিনরাতে সর্বসান্ত। পা দুটো টলমল করবেই তো গলা সমান মদ গিললে। ওর বউ কেতু গালাগাল দিয়ে ঝাঁটা পিটা করবে না সে আবার হয় নাকি। লুঙ্গি উঁচিয়ে ল্যাংটা হয়ে পড়ি কি মড়ি করে পালাবার আগে কেতুকে লাথি কিল চড় ঘুষি মেরে নাস্তানাবুদ তো করবেই। কেতু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলে মাটিতে ধড়ফড়ালে ভুলু এসে বলবে, ‘ কিচ্ছু ভাবিসনি মা তুই, ওই শালার বাপের মাজা না ভাঙতে পেরেছি তো, আমিও বগার বেটা নয়।’ মাজা ভাঙলে কেতুরই কপাল পুড়বে, সে কথাটা ওর চেয়ে ভালো আর কে বোঝে। মায়ে পোয়ে দরজার হাতল ছাড়াবার লড়াই চলে যতক্ষণ ওদের কথা কাটাকাটিই না থামে। ‘তবে মর বগার বউ, মারের ঘায়ে বেন্দাবন দেখ, এই বগার বেটা ভুলুকে ডাকবিনি।’ পেটটা ভুলুর আজ বড্ড কামড়াচ্ছে, শ্বাসের কষ্ট, বুকের ব্যথাটা থেকে থেকে চাগাড় দেয়। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে, ‘ওই বাংলা খাওয়া তোকে ছাড়তে হবে ভুলু, বাপ কত ভালোবেসে এই অভ্যাসটি তোকে দান করেছে, ধন্য তুই বাপের বেটা, কে আর তোকে বাঁচাবে বল।’ বিলু হাত দুটো আশীর্বাদী ভঙ্গিতে ‘তথাস্তু’ বলে বলেই চলে, ‘ খেয়ে যা বাপ, কিচ্ছু ভাবিস নি।’ ‘প্যাডেল ঘোরাতে গেলেই বুকে হাপরের শব্দ শোনে।’ ভুলু ঘোরাতেই থাকে, চেইন পড়ে গেলে আবার তুলে দেয়। ব্যথাটা বাড়তেই থাকে। যাত্রীরা যদি ভুল করে এমন প্রশ্ন করেই ফেলে ‘ধরে চালা ভাই।’ ও নিজের অক্ষমতাকে ঢাকার জন্য বলে ওঠে, ‘এ তো কিছুই নয়, সবে তো শুরু আরো তো খেলা বাকি। ভলুকে দেখেছেন, ভুলুর বাপ বগাকে তো দেখেননি, এক ছিলিমেই রাজা।’ বিলু চমকায় না, ও জানে না এমন কথা আছে নাকি। ‘রাজার বেটা বড়লাট হওয়ার সখ হয়েছে, তাই তো এত গপ্প দিচ্ছিস। জমিদারিটা দেখাবি একবার। বড্ড শখ জেগেছে রে বাপ।’ পেটে যে দু’কাপ চা আর জল ছাড়া কাল থেকে পেটে একটা দানা পড়েনি, সেই লজ্জাটুকু তো এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারে নি। এই ব্যামোতে শুয়ে বসে থাকতেই তো বলেছে ডাক্তারবাবু, তের-চৌদ্দ বছরের ছেলেকে কি মানায় গোটা সংসারটার জোয়াল কাঁধে তুলে নেবে।
‘এই তো বাবু রিক্সা পট্টি। এই কথা কি সকলের মুখে সাজে! ওই বগার ছেলে ভুলু, একটা পাজির পা ঝাড়া,নচ্ছার, যেই না বড়াই করার সুযোগ পেল, জমা যা ছিল উগড়ে দিল।’ বিলু ভাবল স্বপ্ন তো ও দেখায়, খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে কোথায় আছে স্বপ্নের খনি। কী বলে যে লাল ফুল সাদা করে দেবে, ওটা তো ভেলকিবাজদের কাজ। কোন কথার জাদুতে যে ওদের বুঁদ করে রাখবে। এরা তো মেঘের কোলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। নিজের ঘরে কত যে ঘর বানায়। সংসারের বাঁধাধরা নিয়মগুলো অনায়াসে নিজের মতো করে পাল্টে দেয় হিসেবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। জগা যখন গজিয়ে ওঠা শিবমন্দিরের লম্বা টেবিলটায় পা ছড়িয়ে বসেছিল, বুঝতে অসুবিধা হয় না বোধ হয় একটু পরেই আরও দু’তিনজকে নিয়েই দলবেঁধে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দূরেই যে কর্পোরেশনের ভ্যাটটা পাতা রয়েছে ওরা সেইদিগেই ছুটবে, রিসাইকেল হওয়ার মেশিন বসেছে ঘটা করে, কাছে কিনারেই সুলভ শৌচালয়। দুটো কাজই একসঙ্গে সারবে কিনা। সাউণ্ড বক্সটা গাঁক গাঁক করে ডেকে উঠল হঠাৎই। ‘মিউজিক প্লিজ’। শব্দগুলো মুখস্তই আওড়াল। জগার বউ মালতি একটু আগেই কেতুকে দু’চারটে সান্ত্বনা বাক্য শুনিয়ে বিলুর দলটাকে দেখবে বলে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়েছিল। সাধে তো আর চুপ মারেনি। ‘মাগী তোর খালি রসের নাগর দেখলেই চুকচুক করা।’ ‘বলছে বলুক এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়!’ ছেলে ছোকরা ছুকরি কেউ যে আর বাকি নেই। জগা বলেই তো গেল ‘অকম্মার ঢেঁকি’। জগা, নন্তু, রতনরা কোমর দোলানিতে চোস্ত। সাহেববাবুরা তো চাইছে ওরা আরো নাচুক, কেত্তনের সঙ্গে পপ মিশিয়ে গজকচ্ছপ না হলে ভুলিয়ে দেবে কী করে। মালতির খিলখিলিয়ে সে কী হাসি। বিলুর গাঁজাখুরি গল্প তো নতুন এক জগৎ। ওই যে বেঁটে লোকটা লম্বাই তো ছিল, ও ঢেঙা ছিল বলেই না সখ জেগেছিল নাটা হলে কেমন লাগে। কত লোকই তো স্বপ্ন দেখে লাফাতেই থাকে। ওই দেখাতেই কত আনন্দ। ‘লোকটা বলে কীরে! এমনটা কখনও হয়!’ ওরা চোখ বুজে স্বপ্নের নদীতে নাও ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে বহুদূর চলে যায়, আর যে কিছুতেই ফিরে আসতে পারে না। ‘ ‘আজ আর ঝাড়ু দেব না। স্বপন দেখব। এই তোরা সত্যি সত্যি স্বপন দেখেছিস। ওই দেখলি ওরা দাঁত কেলাচ্ছে।’ ‘কথার তোমার কী অমন ছিরি, দাঁত ক্যালাব না! বিশ্বাস না কর তো যাও যমের দূয়ারে।’ কোথায় যেন ওদের ধাক্বা লাগে। ‘ নিকুজি করেছে তোদের ‘মিউজিক প্লিজ’। ওরা চোখ বোজে। বউদের একপাশে সরিয়ে দেয়। ‘সে কী!’ কত তো রাস্তা। রাস্তার পর রাস্তা। এক এক করে খুলে যাচ্ছে। থামাথামির লেশমাত্র নেই। ওরা ঠিক করে অনেকটা পথ পার হয়ে যাবে। বিলু বুঝতে পারে সবকিছু ঠিকপথেই এগোচ্ছে। অস্থিরতা ঘোরাফেরা করে। কত মানুষের চেল্লামেল্লি বড় বেশি অখুশি করে দেয়। ওরা যাবে তো যাবে, কোন পথে যাবে? স্বপ্নের সঙ্গে ঝাড়ুকে মেলাতে ইতস্তত করে না। ঝাড়ুদার হয়ে খোলা রাস্তাটাকে সম্বল করে নেয়। এমনটা তো হওয়া যায়। রাস্তার ধারে ভ্যাটটা কোথায় গেল উধাও হয়ে। বুড়ি বউ ছেলেমেয়েরা যারা জড় হওয়া জঞ্জালে বাঁচার রসদ খুঁজে বেড়ায় ওরা হাউ হাউ করে। ওরাও কি এমনি করে বিলুর স্বপ্নটায় এতক্ষণে ধাতস্থ হয়ে গেছে। জগা নন্তু রত্না যারা কোলাকুলিতে জড়াজড়ি করা ভুলতে বসেছিল, মুখেই কথার তুফান ছুটিয়ে জেতা হারার অঙ্ক কষত, রাস্তাগুলো খোলা বন্ধের খেলায় শব্দগুলো পাল্টাতে থাকে। তাহলে স্বপ্নেরও এক আগুন আছে, এত উঁচুতেই তার অবস্থান হাইড্রলিক ল্যাডার লাগিয়ে জল ছিটানোর তীব্রতায় সেই স্বপ্নের আগুন নেভাতে গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। এত দূরে চলে যায় স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন নিরূপণ করা যায় না। বিলুর স্বপ্নের তরঙ্গ তাই তো আগুন হয়ে যায়। জগা ছুটে বেড়াচ্ছে, চেনা রাস্তাটা অচেনা হয়ে যাচ্ছে। অন্তু যে পথের ঠিকানায় বিচরণ করে, সে পথে ছিল তো কত কাঁকর, আজ এত মসৃন লাগছে কেন? এর রাস্তা ওর রাস্তার ঘাড়ে চেপে বসছে। একেই কী বলে স্বপ্নের মিথ্যা, না মিথ্যার স্বপ্ন। বিলু কি তাহলে স্বপ্নের ছাদনাতলায় এই বন্ধনটাকে শক্তপোক্ত করতে চায়। ভ্যাটটা আবার নিজের জায়গা দখল করে নেয়। যে মুখগুলো দুর্গন্ধের আস্তাকুঁড়ে গুনগুন করত, ফিরে এসেছে এক এক করে। স্বপ্নের ঘোরে কি ওরা পথ হারিয়েছিল? তাই কেমন করে হয়! বিলুর গড়া পৃথিবীটায় জন্ম নেওয়া মানুষগুলো তো মিত্ররা হতে পারে না! তাহলে কী কোন বড় ঝড় আসতে চলেছে! ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কী বামন হয়ে যাবে, তেতাল্লিশ তাকে ঝামটা মেরে ফেলে দেবে। ভ্যাটের বৃত্তকে ঘিরে এক অসামান্য পৃথিবীর জন্ম হবে, আরও ভয়ঙ্কর, আরও নিরবিচ্ছন্ন। বিলু কাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?
বিলু হঠাৎই এক আধা উলঙ্গ শিশুর দলকে দেখে ফেলেছিল। ওরা কি উলঙ্গ হয়েছে, নাকি কেউ উলঙ্গ বানিয়ে দিয়েছে কোন পোটোপাড়ার কুমোর এসে ওদের সাজপোশাকে মুড়িয়ে দেবে বলে। ওরা কুড়িয়ে পাওয়া টেনিস বলটা নিয়ে লোফালুফি খেলেই ইচ্ছেমত পা-টাকে বাড়িয়ে দেয়। কোন পথচারীর পায়ে লেগেছে কি লাগে নি ফোঁস করে ওঠে – ‘ বেজন্মা উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেগুলোর আর থাকার জায়গা পায় নি। এই শহরে এসে আস্তানা গেড়েছে।’ কথার ঝালটা গায়ে মাখে নি। রাস্তার পর রাস্তা লাফিয়ে লাফিয়ে চলেই তো ওরা উত্তর থেকে দক্ষিণে এসেছে। আপন পর ওরা বোঝে না, বিলুর ওই ছু মন্তর ছু ভাবখানা দেখে বলটা নাচাতে নাচাতেই দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘ ওটা বল কোথায় দেখলি, সোনার ঢেলা।’ কথাটা প্রথমে কানে গেলেও ওরা খেলার ছলে এমনই মত্ত ছিল শব্দের মায়ায় ওদের ছুঁয়ে ফেলতে পারে নি। হঠাৎই সোনা শব্দটা ওদের হতচকিত করে দেয়। বিলু কথাটা বার বার উচ্চারণ করলে এবার আরও মনোযোগী হয়ে পড়ে। বলটাকে ওরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, সন্দেহের বশে আবারও এর ওর হাত ঘুরে ওদের দলের দাদা গোছের ছেলেটার হাতে এসে পড়ে। ওরা জানে না সোনা কাকে বলে, সোনাকে কীভাবে আগলে রাখতে হয়, ওটা আসলে কোন কাজে লাগে? নাদান ছেলেরা আগের মতোই লাফাতে শুরু করে। বুকে পিঠে ধুলোবালি মিশে চামটি ধরলেও ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওদের পাশ কাটিয়ে স্কুল ভ্যানটা চার পাঁচটা ওদেরই সমবয়সী বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলেও বাধা পায়, সামনেই দুটো অটো, দুটো মিনি বাস, তারও সামনে দুটো পাবলিক বাস আর একটা ভলভো বাস ক্রসিং-এ পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। স্কুল বাচ্চারা ভ্যানগাড়ি থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে গলা বাড়িয়ে দেখতে গেলে ড্রাইভার এসে চড় কসায়। ‘কতবার বারণ করেছি ওদিকে তাকাবে না। গলাটা ক্যাঁচ করে কেটে গেলে তোদের মা-বাবা আমাকে আস্ত তো রাখবেই না, জেলের ঘানি টানাবে।’ ছেলেগুলো ওদের কাণ্ড দেখে অবাকই হয়ে গেল। ওদের ভয় মাখানো চেহারা আর কথাবার্তার মাথামুন্ডু না বুঝতে পেরে অবাকই হলো। সিগন্যাল পার করে চলে গেলে ওরা আবারও বল নিয়ে লোফালুফি খেলতে গিয়ে বিলুর কঠিন শব্দটা বেমালুম ভুলে যায়। বিলুর দলটিকে ওরা আরও অনেকটা পথ অনুসরণ করল। একজন শুধু না বুঝেই জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কী বলছিলে!’ ফুটপাতের মেয়েটার গলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই ঐটা’। ওরা এবার মেয়েটার পেছন পেছন ছুটল। ‘এই তোরা কী চাস?’ ‘ওটা।’ মেয়েটা ভয় পেয়ে চোর চোর করে চেঁচাতে ওরাও ছুট লাগাল। চোর শব্দটার সঙ্গে ওরা বিশেষভাবে পরিচিত কিনা। ওদের সুযোগ বুঝে বাবুলোকরা এই নামে ডাকতে পছন্দ করে। কত কিছু ভেবে দু’এক ঘা দিতেও ছাড়ে না। ‘দুটো পয়সা দেবে বাপ’ এই বলে কেউ কেউ ক্ষিদের জ্বালায় ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় , সেটাও তো সত্যি। তাই বদনামটা ওদের বয়েই বেড়াতে হয় – জাত-কাকের ছাঁ, বাসায় করে রা। কিছু অতি উৎসাহী লোক ওদের চোর চোর করে তাড়িয়ে মারল। হোঁচট তো খেল, চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেল, রামধোলাই খেল, অপরাধের বহর না জেনেই। বিলুর হেঁয়ালির যে এভাবে খেসারত দিতে হবে কে জানত। মার খেয়ে দু’একটা কটু কথা উচ্চারণ করল বটে, ধুলো ঝেড়ে উঠেও দাঁড়াল, রাস্তার ছেলেকে এত সহজে কাবু করা যায়! ঝড় তুফান হজম করে, ধুলোর পাহাড়ে ভরা কাঁথা মুড়িয়ে রাতের অন্ধকারে কাঠের পাটাতনে শুয়ে যারা প্রহর গোনে তাদের ঘিরে সব দিনের আলোরা এইভাবেই চোখ বুজে থাকে। চোখের আলো নিভিয়ে দিয়ে খেলাটা চালিয়েই যায়, হতে পারে টেনিস বলটা সজ্ঞানেই আগুনের গোলা হয়ে যায় কিংবা বিলুর কল্পিত সোনার বল, কিইবা যায় আসে তাতে। ল্যাংটা ছেলে চোর হল, চোর হল ল্যাংটা, সোনা চেনা কি এতই সোজা!
বিলু এখন একলা হতে চায়। যারা এতক্ষণ ওর পিছু নিয়েছিল, নিজের অজান্তেই ‘হুশ’ কথাটা বাতাসে উড়িয়ে দিল। নিজের দেখাটা কাছেপিঠে পেলে ও যে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় কেমন করে বোঝাবে। যা নেই বলে অনেকে উল্লাসে মেতে উঠেছে, কেবলই আমার, কেবলই আমার বলে অধিকার ফলাতে চাইছে, তা যে আদপেই মিথ্যার ফুলঝুরি ছাড়া কিছুই নয়। সময় তো নেবে, যত সময় গুনবে, স্পষ্ট হয়ে ধরা দিতে ওরা এগোতে থাকবে। অনেক দূরের পথ, সামনে থকথকে কাদা, কোথাও কোমর অবধি জল। শ্বাপদের উৎপাত কম হবে, কেমন করে ভাবা যায়, সব কাজ যে চুপি চুপি সেরে ফেলে। এমনও দিন যায় ও মুখ দেখা ছাড়া ওরা জলগ্ৰহণ করে না। দিনদুপুরে পুকুরে ডুব দেবার সখ, নিদেনপক্ষে ডোবার বদ্ধ জল, দিঘির কথা না হয় নাই ভাবল। শান বাঁধানো সিঁড়ি হলে শ্যাওলায় পা পিছলে যাওয়ার ভয়, না হয় চার ঘাটের জল খেয়ে আইঢাই আইঢাই। বিলুর আবার কত দিকেই না নজর। বাঁচলে ভালো, মরে গেলে তো ল্যাঠা চুকে গেল, উদ্ভট জীবনের গোঙানি তো কত রকমেই না জানান দেয়। চাকাটা ঘুরছে, বড় জোরে ঘুরছে, রোজই তো ঘুরতে থাকে, পা দুটো সমানতালে না চাপলে চাকাটাইবা ঘুরবে কেমন করে। সারাদিনই চলে এমনি করে। কে দেবে একটুকু বিশ্রাম। শুধু কি এই চাকা, আর কত চাকা যে ঘুরছে সকাল সন্ধ্যা ইরফানের জানার তো কথা নয়, শুনতে পায় প্রচার গাড়ি থেকে ধামাকা সেলের ঘোষণা, বলেই চলে চালু রেকর্ডার থেকে, থামাথামি তো নেই। চার চারটি ব্যাগ জমা পড়েছে। চেইন তো কেটেই গেছে, রানারও খারাপ, চেইনের দাঁতগুলো অয়েল দিয়ে দুদিকে ভাবল সেলাই মেরে দেওয়া, লক পাল্টানো, চাকা পাল্টানো, হাতল মেরামত করা, রিফু করা, আরও কত রকমের কাজ। সামান্য এদিক ওদিক হলে কাস্টমারদের গায়ে জ্বালা ধরানো দাঁত খিঁচুনি। সামনের পার্কে রাইডে চড়াবে ছাওয়ালদের, ভাবাই সার, বরঞ্চ দুটো পয়সা বাড়তি রোজগার হলে দু’বেলা দু’মুঠো জুটবে। আজ কাজ আছে, কাল যে কাজ জুটবে, তার কি কোন গ্যারান্টি আছে? বিলুর সাঙ্গোপাঙ্গরা অর্থাৎ যারা সারাক্ষণই বিলুর কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে এপাশ ওপাশ ঘুরে বেড়ায় তারা গলির মোড়ে থেকে ডান দিকে ঘুরে যায়। ইরফানের কানে ওদের গল্পগাছার সংবাদ যে পৌঁছয়নি এমনটা নয়। বিলুর এই আসা যাওয়ার পথনির্দেশে যে কাঁকের ডানা মেলানোর এক জাদুকরি সম্পর্ক রয়েছে সেই গল্পও এমন ছড়িয়েছে শহর জুড়ে, বলাবলি শুরু হয়েছে ওদের জন্ম জন্মান্তরের গল্প নিয়ে। কেন কে বা কারা এর উৎস তা জানার আগ্রহ লোকে হারিয়েছে, কেবলমাত্র ওদের উপস্থিতি দিয়ে ঘটনার সত্যাসত্য বিচার করে, সমস্যা সমাধানের বাছবিচার হয়। বিলু যে এই মুহূর্তে ইরফানের মনোযোগ দাবি করছে, ইরফান হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিলু যে ওর ঘূর্ণিত চাকাকে দেখবে বলে ঘুরে দাঁড়াবে এটাও তো স্বপ্নাতীত, চোখ ফেরায় না যে। কথাটা যে এমন করে জুড়ে দেবে, সেটাও কি জানত। বলার ভঙ্গিটা একরকম ঘাড় ঘুরিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে, বলার কথাটা সাবলীল। ‘চাকা উল্টো দিকে ঘুরে যাবে।’ ইরফান কান পেতে শুনবে কি? দমকা হাওয়াটা এল, মর্মর করে পাশের আড়াইশ বছরের পুরনো বাড়িটার ছাদটা খসে পড়ল, আওয়াজের তীব্রতায় শুষে নিল সব কোলাহল। খণ্ডহারে স্মৃতি গেল, বিস্মৃতি এল। বিলুর অদেখা জগৎ ওলটপালট হল। ঝাঁপ বন্ধ করবে কি, এখনো যে অনেক কাজই বাকি রয়ে গেল, কি জানি কখন শেষ হবে, সময়ের কী মাপজোক আছে!
বিলুর আরও একবার অন্তর্দর্শন হল। গাছে গাছে মিতালি হলো। ফলে ফলে হল চুমোচুমি। চেনার ঐশ্বর্যে আরও কত অচেনার দীনতা। টুকরো টুকরো সিমেন্ট বালি তুলে গা ঘষে নেয়। কত তো আঁকিবুঁকি দেয়ালে দেয়ালে ভিজে যাচ্ছে, ওরা থাকে আপনমনে। কার ছোঁয়া মেখে নিজের অস্তিত্বে আজও থাকে ভাসমান। মানুষের আনাগোনা বেড়ে যায়, হাঁটুজলে বেগবান এই স্রোত। গর্ভে নাচে কত পুতলা পুতলি। বিলুর তো ইচ্ছে করে কোন এক জাদুদণ্ড হাতে পাক, ছাল ওঠা, আঁচড় কাটা দেয়ালগুলো উঠে আসুক মনের পাতায়। ওই তো এক চিলেকোঠা ঝুলে আছে কোন এক কড়িবরগায় ভর করে। ছায়াময় আলুথালু এক কিশোরীর আয়ত চোখ দুটো। স্বপ্নের রঙিন পাখায় এ কোন মোহিনী মায়ায় ঘিরে আছে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। কল্পনার জ্বাল বুনতে বুনতেই সিঁড়ি ভাঙছে। অহিংস ঘ্রাণে হিংসার উলুক ঝুলক। বিলু থলে ঝুলিয়ে চেয়ে আছে গল্পের ছানাগুলো ডানা মেলে কখন এসে গলা জড়িয়ে ধরবে। মেয়েটির কলমটা তো বুলিয়েই চলেছে কাগজের পাতায় পাতায়। সময়রা মরে গিয়ে জন্ম নিয়েছে নিজের মতো করে। দোষের কি আছে? নিয়মের আঙিনায় দিনগুলো এমনি করে ফুরিয়ে যায়। আর এক জগৎ দেখবে বলে ছটফট করে। বিলুর কল্পনাগুলো উড়ে এসে জুড়ে বসে। ওরা বলে, ‘বাপু হে, পালাও পালাও।’ কোন এক পড়ন্ত বিকেলে ওরা কথা বলে উঠবে। মচমচ করা ভাঙা ইটের টুকরোগুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হলে বেঁকে যাবে ওর শরীর। ঝুলিটাও ভর্তি হয়ে পড়তে পড়তেই বলবে, ‘বিলু আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, আমরা আবার আমাদের উৎসে ফিরে যাচ্ছি। বিলুর গল্পগাছার হাত পা নড়েচড়ে ওঠে। অভিনন্দনের আকাঙ্ক্ষায় ওরা কুলোয় করে ধান দূর্বা সিঁদুর মিষ্টি নিয়ে দূয়ারে হাজির হয় মিষ্টি মুখখানি দেখবে বলে। ঘোমটা টেনে দেখে, ‘আহা, ভারি সুন্দর মুখখানা।’ বিলু ভাবে এ না হলে গল্পের মুখখানি! আরো কিছু কি চাই? কত গয়নাগাটি সাজগোজ করার উপকরণ ছড়িয়ে তো রয়েছে, সাজিয়ে গুছিয়ে নিলেই তো হয়। রূপবতী না হলে পাড়া পড়শী বলবে কী! ওরা যা বলছে বলুক, ঘরদোর ওতো পয় পরিষ্কার করা জানা চাই। না হলে অতিথিরা ঘরবাড়ি দেখে বলেই তো বসবে ‘দেখতে মন্দ নয় বটে, কাজে তো অষ্টরম্ভা।’ ছি ছি তখন মুখ দেখাবে কেমন করে? সেই উত্তরই তো খুঁজে বেড়ায়। এটা ঠিকই সুন্দরের সংজ্ঞাটা দেশকালে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। যেই ভাবা, সেই কাজ। ওর ঘরে যেই ধন আছে তাতেই তো মাতব্বরি করতে হবে, না হলে চলবে কেন! বিলু ভাঙাচোরা যাই পেল, তাই কুড়োতে শুরু করল, কত বছরের ধন, পড়ে পড়ে কি মারটাই না খাচ্ছিল। রং চং তো সব ধ্বসে গেছে। কোথাকার জিনিস কোথায় গড়ায়। বিলু একটু হড়বড়ই করে ফেলে। যতটুকু পারল তো নিল, বাকিটা শাগরেদদের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘ হারাস না কিন্তু, আজ না হয় কাজে লাগবে।’ তাতেও কী শেষরক্ষা হল! মনের মতো গড়ে নিতে আরো তো চাই। এই ঘর থেকে ওঘরে গিয়ে শুনতে পেল কত কথার ফিসফিসানি, শোনাতে চেয়ে হায় হুতাশ করছে, বিলুকে দেখে আনন্দে আত্মহারা। সময়ও কখনও কেঁদে ফেলে। নিজেকে চিনে নিতে চায় আলোর বিন্দুগুলোকে চুরি করে, আঁধারের মোড়কে বন্দী হয়ে। অন্যের উপর নিজের দায়ভার চাপিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। বিলু ইটের টুকরোগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। ফেলে আসা ইচ্ছেগুলোকে কোলে তুলে নেয়, আদর করে, চোখের জলের হিসেব কষে। অস্তিত্বের বিপন্নতাকে নিয়ে সময়ের আত্মায় ঘর করছিল যারা তাঁদের মুখগুলোকে চিনতে চায়। ইচ্ছে হলে ইরফান,বগা,ভুলু, পদ্মপলাশ ও জঙ্গলদেরও জুড়ে দেয়। এই লম্বা হয়ে যাওয়ার ইতিহাস কী কোনদিন ধরা দেবে? পন্থাটা খুঁজতে ওকে হবেই, না হয় ওরা জানবে কেমন করে চাকাটা আসলে কোনদিকে ঘুরছে। বাতাসের কাঁপুনিটা আবারও শুরু হয়, আরও দ্বিগুন জোরে। যা যা বাকি ছিল, খসে পড়তেই লাগল, কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে, এই ভেবেই তো বিলু অস্থির। ইরফানের সেলাইয়ের মেশিনের চাকাটা ঘুরেই চলেছে বিলুর দেখার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ইতিহাসের ভগ্নদশা ওকে আক্রান্ত করেছে, নিশ্চুপ করিয়ে দিয়েছে, বিলুকে চেনাতে মোটেই দেরি করে নি। কাঁকটা বিলুর হতভম্ব দশায় অস্থির হয়ে এই নির্মম ঘোরালো বাতাসেও জানতে চায় – এই পৃথিবীর জন্ম হওয়ার খুব কি দরকার ছিল? জন্ম যদিবা হল, অন্ত হওয়ার এত তাগিদ কেন! এমন হলে এই মানুষগুলোর কী দশা হবে! উত্তরটা ও নতুন কোন হিসেবেই চায়। ‘সক্বলে ফেইল মেরেছে যে।’
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)