তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গদেশে গণিতশাস্ত্রকে অবলম্বন করে জটিল সমস্যার সমাধান করে ভারতবিদ্যাচর্চায় অন্য এক রকম অবদান রেখেছিলেন বিশিষ্ট পন্ডিত রাধানাথ শিকদার। তিনিই ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। গণিত শাস্ত্রের পাশাপাশি সাহিত্যের অঙ্গণে তাঁর অবাধ বিচরণ ভারতের বিজ্ঞান দর্শনে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছে, প্রকারান্তরে সমৃদ্ধ করেছে ভারত বিদ্যা চর্চা কে। যদিও তাঁর প্রধান কীর্তি মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা নিরূপণ করা। কিন্তু এর পাশাপাশি তাঁর আরও কীর্তি রয়েছে, যার অনেকটাই আমাদের অজানা।
রাধানাথ শিকদার আবির্ভূত হয়েছিলেন ১৮১৩ সালের ৫ অক্টবর, কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। পিতা তিতুরাম শিকদার ছিলেন সে যুগের যথেষ্ট শিক্ষিত মানুষ এবং আধুনিক শিক্ষা – দীক্ষা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এই গুন তাঁর পুত্রের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ১৮২৪ সালে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। তিনি সেখানে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও কে। এখানে অধ্যায়নের সময় তিনি তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি মোট সাত বছর হিন্দু কলেজে ছিলেন। কলেজ জীবনে তাঁর সহপাঠী ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণা রঞ্জন মিত্রমজুমদার, হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়দের। অর্থাৎ এক অনির্বচনীয় বুধমন্ডলের সাহচার্যে তাঁর ছাত্রজীবন বিকশিত হয়েছিল।
ছাত্রজীবনে সাহিত্য এবং গণিত দুটি বিষয়ে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ইংরেজী ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষাটা তিনি ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। কলেজে তাঁর গণিতের শিক্ষক জন টাইটলার তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক ক্লাসিকগুলির সংস্কৃত অনুবাদ কর্মে। যদিও রাধানাথ শুরু করেও তা শেষ করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত গণিতই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর উৎকর্ষতা প্রকাশের প্রধান জায়গা। তিনি বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্য ও দর্শনকে মিলিয়ে এক অসামান্য মাত্রা দান করেছিলেন।আর সেটাই তাঁর ভারতবিদ্যাচর্চায় প্রতিফলিত হয়েছে।গণিত বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা এবং লেখালিখি ভারতের বিজ্ঞান ভাবনাকেই সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষায় নতুন ভোর এনেছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জ্যমিতির এমন একটি সম্পাদ্য সমাধান করে ফেলেছিলেন যা ‘গ্লিনিংস ইন সায়েন্স’ পত্রিকায় ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ছিল সম্পূর্ণ ভাবে রাধানাথের নিজস্ব আবিষ্কার। ওই বছরই রাধানাথ কলেজের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ করে শোনান। তার শিরোনাম ছিল ‘, The cultivation of sciences is not more favourable to individual happiness, not more useful and honourable to nation, than that of political literature’ এবং তা Asiatic Journal and Monthly Miscellane’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
তবে রাধানাথকে সবাই মনে রেখেছে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা পরিমাপের জন্য। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সে বিষয়কে তুলে ধরা যেতে পারে। ১৮০০ সালে ব্রিটিশদের অনুকরণে এদেশে স্থাপিত হয়েছিল জমি জরিপ বিভাগ। আর এর প্রকৃত কাজকর্ম শুরু হয়েছিল ১৮০২ সালে। এরপর ১৮২৭ সালে ওই সংস্থার সার্ভেয়ার জেনারেল পদে নিযুক্ত হয়ে জর্জ এভারেস্ট ভারতের ২৭টি স্থানে জরিপের কাজ সম্পন্ন করার জন্য ট্রিগণমিতি জানা কিছু দক্ষ তরুণের সন্ধান করছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের শিক্ষক ড. টাইটেলর সাহেব তাঁর প্রিয় ছাত্র রাধানাথের নাম সুপারিশ করেন। ১৯ বছরের রাধানাথ কলেজের পাঠে ছেদ টেনে সার্ভেয়ার জেনারেলের পদে যোগ দিলেন। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দেরাদুনে ‘computor’ পদ দিয়ে, যে পদে তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়। তিনি তাঁর সহজাত গাণিতিক প্রতিভার সাহায্যে কাজের উপযোগী ফরমুলা তৈরী করে জরিপ সংক্রান্ত যে কোন কাজের সঠিক সমাধান করতেন। এভারেস্টের মতো উন্নাসিক সার্ভেয়ার জেনারেল ১৮৩৮ সালে রাধানাথ সম্পর্কে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ” … there are few in India wheather European or non native that can at all compete with him. Even in Europe these mathematical attainments would rank very high.” ১৮৫১ সালে রাধানাথের পদোন্নতি ঘটে ‘computor general’ হিসাবে।
ইতিমধ্যে এভারেস্টের উত্তরসুরি এন্ড্রু ওয়াঘ সার্ভেয়ার জেনারেল হয়েছেন। ওয়াঘ সাহেব রাধানাথকে এমন এক গাণিতিক সূত্র বের করতে বললেন , যার দ্বারা ১০০ মাইল দূর থেকেও হিমালয়ের চূড়াগুলোর পরিমাপ পাওয়া সম্ভব হয়। নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে ১৫০ মাইল দূরত্ব থেকে স্বপ্রবর্তিত এক্সরে সিস্টেম নামে এক বিশেষ পদ্ধতিতে হিমালয়ের ১৫ নং চূড়ার উচ্চতা নিরূপণ করলেন ২৯,০০২ ফুট। সময়টা ছিল এর ১৮৫৫। এরপর আরো কাছ থেকে সেই চূড়ার উচ্চতা মাপলেন ২৯.০২৯ ফুট।এটাই ছিল সঠিক পরিমাপ। পরে রাধানাথের দ্বারা উচ্চতা নিরূপিত শৃঙ্গটির নাম রাখা হয় এভারেস্ট শৃঙ্গ (এই শৃঙ্গটির একটি স্থানীয় তিব্বতী নাম ছিল ‘ চোমো লুংমা’)। কিন্ত উপেক্ষিত রয়ে গেলেন বাংলার আধুনিক গাণিতিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ এবং হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের উচ্চতা পরিমাপকারী রাধানাথ শিকদার।
আমরা আগেই জেনেছি, রাধানাথ কেবল গণিতেই সুপণ্ডিত ছিলেন না, তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল সাহিত্যিক সত্তা, যা বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রর হাত ধরে সুপ্রতিস্থিত হয়েছিল। যুগ্মভাবে একটি পত্রিকা শুরু করেন তাঁরা, নাম ছিল ‘মাসিক পত্রিকা’। এই পত্রিকার গদ্য ছিলো সুললিত, তা মৌখিক বাংলা ঘেঁষা। সাধারণ পাঠকরা তো বটেই, মহিলারাও এই পত্রিকাটির যথেষ্ঠ সমাদর করতো। এখানে রাধানাথ ও অন্যান্যরা ঐতিহাসিক উপাখ্যানের মাধ্যমে নারী শিক্ষার পক্ষে এবং হিন্দু সমাজে যে কুসংস্কার ও রক্ষণশীল মনোভাবের বিপক্ষে কলম ধরেছিলেন। এগুলি উনিশ শতকের সমাজ সচেতনতার পক্ষে খুব কার্যকরী ছিল।এই পত্রিকার মাধ্যমে রাধানাথ গ্রীক ও সাহিত্যের চর্চা করতেন। এই পত্রিকার জন্যই তিনি প্লুটার্ক জেনোফোণের রচনা অনুসরণ করেই তিনি প্রবন্ধ ও গল্প রচনা করতে থাকেন। সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর রচনা ভারত বিদ্যা চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছিলো।
১৮৭০ সালে মাত্র ৫৭ বছরে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর প্রয়াণে ১৮৭০ সালের ২৩ মে ‘Hindu Patriot’ লিখেছিল “…he was the first Bengali Youth to have learut the mathematics invented by Newton and Laplace and accomplished great things in science and obstronomy”। প্রচার বিমুখ, স্পষ্ট বক্তা, ঋজু মেরুদণ্ডের অধিকারী, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ রাধানাথ উপেক্ষিতই রয়ে গেছেন। উপেক্ষার শিকার শুধু ইংরেজ শাসকদের কাছেই ছিলেন না, বাঙালিদের কাছেও তিনি বিস্মৃতির অতলে চলে গেছেন।