অমিত বসাক
লেখক পরিচিতি
(লেখক ২২ বছর ধরে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন অন্য কলেজে। সমবায় ব্যাঙ্ক ও অকৃষি সমবায় সমিতির ওপর গবেষণাধর্মী তার দুটি বই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা নতুন আঙ্গিকের একটি বই আমি মলে ঘুচিবে জজ্ঞাল। ভ্রমণ ও সমবায় বিষয়ক কিছু লেখা আজকাল ও গণশক্তি পত্রিকাতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্বার এ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণে পাহাড়প্রেমী লেখক বারবারই ছুটে গেছেন হিমালয়ে:কেদারনাথ,তুঙ্গনা্থ,রূপকুন্ড,বৈজনাথ,যজ্ঞেশ্বর,হর কি দুন, পিন্ডারী, কাফনি, মুন্সিয়ারি, প্যাংগং, সান্দাকফু এবং এরকম আরো অনেক জায়গায়।)
—————————————————————————————————————- ভোর সাড়ে চারটে –পাঁচটা নাগাদ বাইরে এসে আনন্দে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। এখনো দিনের আলো ফোটেনি। এ কোথায় এসে পড়লাম-এই কি স্বর্গ। জ্যোৎস্না রয়েছে এখনও-সেই আলোতে দেখতে পেলাম দুধ সাদা সব তুষারশৃঙ্গ প্র্রায় অর্ধাচন্দ্রাকারে আমাদের ঘিরে রয়েছে। সবই যেন প্রায় হাতছোঁয়া দূরত্বে। আস্তে আস্তে চারদিক আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগলো-তুষার হিমালয়ের অঙ্গনে ঢুকে পড়েছে সোনার রথ।………………। এই সব মনকাড়া স্বপ্নের অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে শুরু হল এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় লেখকের ধারাবাহিক ভ্ৰমণ কাহিনী “হিমালয়ের ডাইরীর” অংশ হিসেবে “পিন্ডারী ও কাফনীর পথে ”।
প্রথম পর্ব
পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে তা আছে এই কুমায়ুনে।এই তুষারশৃঙ্গ হ্রদ নদী জলপ্রপাতের সিম্ফনীর ভিতরে। হিমালয়ের কপালে কুমায়ুন যেন বৈদুর্যমনির টিপ।কুমায়ুন হিমালয় মানেই পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন সৌন্দর্যের উষ্ণ আমন্ত্রণ।কুমায়ুন হিমালয়-ত্রিশূল,নন্দাদেবী,নন্দাঘোট,চৌখাম্বা,বানজারা,মাইকতোলি,পঞ্চচুল্লি তষারশৃঙ্গের হাতছানি,ঘন পাইনবনের নিবিড় সান্নিধ্য,সরযূ-গোমতী-কোশি নদীর উচ্ছলতা। কুমায়ুনের কথা উঠলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে নৈনিতাল,ভীমতাল,আলমোড়া,কৌশানি,রাণিখেত আরও কত কত নাম। কিন্তু এবার চলেছি আরও দূরে-পিন্ডারী ও কাফনীর উৎসমুখে–পিন্ডারী ও কাফনী গ্লেসিয়ারে।
পাহাড়ে যখন উঠি তখন প্রতিবারই মনে হয় এটাই বুঝি শেষ,আর আসবো না। কী দরকার এত কষ্ট করার? কিন্তু নিচে আসলেই আর মন মানে না। আবার শুরু হয় পরের পরিকল্পনা পাহাড়ে যাবার। তুষারমৌলি হিমালয় আবার ডাকে, বেরিয়ে পড়ি। এ নেশা ড্রাগের নেশার থেকেও ভয়ঙ্কর। ঠিক টেনে নিয়ে যাবেই।
এবার চলেছি আমরা অর্থাৎ আমি ও ভাইদা পিন্ডারী ও কাফনী হিমবাহের উৎসমুখে। সেই উদ্দেশ্যে হাওড়া থেকে রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে কাঠগোদাম অর্থাৎ বাঘ এক্সপ্রেসে রওনা দিলাম।আমাদের গন্তব্য আপাতত কাঠগোদামের আগের স্টেশন হলদুয়ানি। দুই রাত ট্রেনে কাটিয়ে হলদুয়ানি পৌঁছলাম প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা দেরিতে। ফলে ভারারী যাবার বাস পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সৌভাগ্যবশত স্টেশনের পাশেই গাড়ি স্ট্যান্ড থেকে একটা মারুতি ভ্যান পেয়ে গেলাম। আমাদের সঙ্গী ছয়জনের একটি দল। ওরা চলেছে সুন্দরডঙ্গা-মাইকতোলি বেসক্যাম্প। আমরা আজ যাব বাগেশ্বর পর্যন্ত। পথে আলমোড়ায় কিছু খেয়ে আবার চলা। শুধু পাহাড় আর পাহাড়। অবশেষে রাত সাড়ে নটা নাগাদ এসে পৌঁছলাম বাগেশ্বর। দূরত্ব ১৯০ কিমি হলদুয়ানি থেকে। গোটা শহর ঘুমাচ্ছে। শুধু জেগে আছে হোটেল সিদ্ধার্থ। এখানেই রাতের আশ্রয় নিলাম। পাশের খাবারের দোকানে অতিকষ্টে রুটি আর ডিমের ওমলেট পাওয়া গেল। যাহোক শরীর আর টানছিল না। দু’রাত ট্রেন ধকল, তার উপর টানা ১৯০ কিমি মারুতি করে এই বাগেশ্বরে আসা। হোটেলে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে যখন বিছানায় গেলাম রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ঠান্ডাও বেশ লাগছিল।
পরের দিন হোটেল বয়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। গরম চায়ের কাপ হাতে সে দরজায়। এর মধ্যেই বেশ কিছু গাইড কাম পোর্টার এসে উপস্থিত। আমরা এই পথের (অর্থাৎ পিন্ডারী ও সু্ন্দরডুঙ্গা) অভিজ্ঞ গাইড পুষ্কর সিং এর খোঁজ নিচ্ছিলাম। কিন্তু শুনলাম তাকে এখন পাওয়া যাবে না। সে একটা টিম নিয়ে সুন্দরডুঙ্গা গেছে। তার সাথে দেখা হলেও হতে পারে ঢাকুরিতে। অগত্যা অন্য গাইড ঠিক করলাম। ওর নাম আনন্দ সিং। বাড়ী খাতি গ্রামে। ওর পারিশ্রমিক পঁরাও পিছু ৫০০ টাকা, সেই সঙ্গে খাওয়া। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ জিপে করে রওনা দিলাম ভারারির উদ্দেশ্যে। বাগেশ্বর থেকে এর দূরত্ব ২৩ কিমি। কিছুটা যাবার পর গোমতীর উপর একটা ব্রীজ পেলাম। বাঁদিকে কিছুটা দূরে গোমতীর নীল জলধারা মিলেছে সরযূর দুর্বার জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে। প্রবল তার গর্জন। বাগেশ্বর জনপদটি দুই পূর্ণতোয়া, গোমতী আর সরযূ নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। ৩২০০ ফুট উচ্চতায় বাগেশ্বর একটি চিত্ররূপময় পাহাড়ি জনপদ। বাগেশ্বরের পূর্ব ও পশ্চিমে ভিলেশ্বর ও নীলেশ্বর পর্বতমালা এবং উত্তরে সুরজ কুন্ড এবং দক্ষিণে অগ্নি কুন্ড দ্বারা বেষ্টিত। বারাণসীর মত বাগেশ্বরও শিবক্ষেত্র। পবিত্র সঙ্গমে আছে বাগনাথের মন্দির। বাগেশ্বর শহরের নাম বাগনাথ মন্দির থেকে।প্রতিবছর মকর সংক্রান্তিতে এখানে বিরাট মেলা বসে। হিন্দু কিংবদন্তি অনুসারে ঋষি মার্কণ্ডেয় এখানে ভগবান শিবের উপাসনা করেছিলেন । ভগবান শিব ঋষি মার্কণ্ডেয়কে বাঘের আকারে এখানে এসে আশীর্বাদ করেছিলেন । এই রৌদ্রমুখরিত দিনে দুই পাশের পাহাড় শ্রেণীর মধ্যবর্তী গিরিখাতের ভিতর দিয়ে দুরন্ত গতিতে নেমে আসা সরযূর যে চিত্ররূপ ফুটে উঠেছিল তা যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্র শিল্পীর আঁকা ল্যান্ডস্কেপকেও ম্লান করে দিতে পারে।
দ্বিতীয় পর্ব
ভারারী যেতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগল। পথে পড়ল ছবির মত গ্রাম কাপকোট। সরযূ মায়ের আঁচলে আর নন্দাদেবীর কোলে যেন লালিত পালিত শিশু এই কাপকোট শান্তির নিবিড়। এখান থেকে পাথুরে রাস্তা পাহাড়ের গা বেয়ে ক্রমশঃ উঠে গেছে সং এর দিকে। আবার একটা জীপে করে রওনা হলাম সং এর উদ্দেশ্যে। পথে একটা জায়গায় পথের বাঁকে এই প্রথম তুষার ধবল শৃঙ্গ দেখলাম। সং পৌঁছাতে প্রায় ৩০ মিনিট লেগে গেল। গুটিকয় ঘর আর তার লাাগোয়া ছাপড়া দেওয়া খাবারের দোকান এদিক ওদিক। ওরকমই একটা দোকানে চা আর ওমলেট খেলাম।
আজ অক্টোবরের ১৬ তারিখ। সকাল ১১ টাা নাগাদ আমরা আমাদের ট্রেকিং শুরু করলাম। হাঁটা শুরু করতে বেশ দেরীই হয়ে গেল। আজ আমাদের গন্তব্যস্থল খুব দূরের নয়-৩ কিমি দূরের লোহারক্ষেত। আজ হাঁটার প্রথম দিন। তাই বেশী হাঁটা উচিত নয়। ঐ চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে পাথরের রাস্তা এঁকে বেঁকে আস্তে আস্তে উপরে উঠে গেছে। হাল্কা চড়াই। সামনে গাইড আনন্দ সিং,আর পিছনে পিছনে আমরা। একটু হাঁটতেই প্রথম প্রথম কষ্ট হতে লাগলো। প্রচন্ড রোদের তেজ। ঘামে পোষাক ভিজে যাচ্ছে। গা থেকে উইন্ডচীটার খুলে ফেললাম। একটু যাচ্ছি একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। এখানে PWD র একটি বাংলো আছে। কিন্তু আমাদের আরও উপরে উঠতে হবে-আপার লোহারক্ষেত(৫৭৫০ ফুট)। এইভাবে প্রায় বেলা ১টা নাগাদ লোহারক্ষেতে পৌঁছালাম। উঠলাম কুমায়ুন বিকাশ নিগম মন্ডলের(KMVM) বাংলোয়। বাংলো সংলগ্ন ছোট্ট মাঠে দেখলাম দুটি টিম বসে আছে-একটি পিন্ডারী থেকে ফিরছে,আর অন্য দলটি সুন্দরডুঙ্গা ও দেবীকুন্ডে যাচ্ছে। যা হোক কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর বাথরুমে গিয়ে স্নান করলাম। গায়ে যেন কেউ বরফের করাত বসাচ্ছে-কি ঠান্ডা,বরফগলা জল। পরম আরাম অনুভব করলাম। পাশেই ভগবতী মাতার মন্দিরে গিয়ে নমস্কার করে আসলাম। ইতিমধ্যে চৌকিদার এসে খবর দিল খাবার রেডি। খিচুড়ী আলুভাজা আর ডিমের ওমলেট-পেটপুরে খেলাম,যেন অমৃত। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। শুক্লপক্ষের রাত। চাঁদ বেশ দেরীতে উঠলো। সমগ্র পাহাড় উপত্যকা চাঁদের মায়াবী আলোর বন্যায় যেন ভেসে যাচ্ছে-এক অপার্থিব অনুভূতি।
আজ ১৭ ই অক্টোবর।আমাদের পায়ে হাঁটার দ্বিতীয় দিন। আজকের গন্তব্য ঢাকুরী হয়ে খাতি গ্রাম। লোহারক্ষেত থেকে ঢাকুরী ১১ কিমি। সকাল সাড়ে সাতটায় হাঁটা শুরু করলাম। ক্রমশঃ পাহাড় ভেঙ্গে শুধু উপরেই উঠা। পথ গেছে ঘুরে ঘুরে। প্রাণান্তকর চড়াই। একটু চলার পর পরই শরীরে হাঁফ ধরছে। কিছুটা চলার পর পথে একটা কাঠের সাঁকো পড়লো।কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর আবার চলা। শুধুই চড়াই আর চড়াই। এই চড়াই চলবে সোজা ঢাকুরী পাস পর্যন্ত। এই চড়াই এর বুঝি আর কোন শেষ নেই। কিন্তু দুঃখের পরেই তো সুখের পরশ পাওয়া যায়। অবশেযে প্রায় ৬ ঘন্টা পর এসে উঠলাম ঢাকুরী পাসে(৯২০০ ফুট)। ঢাকুরী টপের ডানদিকে রয়েছে দেখলাম দেবী নন্দাদেবীর ছোট্ট একটি মন্দির। মন্দিরের পাশে ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে,আর কয়েকটা ঘন্টা ঝুলছে। আর বামদিকে আরও উপরে ঘন সবুজ বন। নিচে ছবির মত সুন্দর স্বপ্নের দুয়ার ঢাকুরী(৮৭০০ ফুট)। যেন হঠাৎই ঢুকে পড়েছি শ্বেতশুভ্র তুষারশৃঙ্গের বেড়ার মধ্যে। পাইন,দেবদারু,রোডোডেনড্রনের ছায়ামাখা পথ ধরে নিচে নেমে আসতেই স্বপ্নের দুয়ার খুলে গেল। গাঢ় সবুজ গালিচা পাতা এক মনোরম উপত্যকা ঢাকুরী। উপত্যকার মাঝখানে PWD এর বাংলো;ডানদিকে দুটি ছোট ছোট হোটেল;আর উপত্যকার উত্তরপ্রান্তে ঢালের পাশে KMVM বাংলো। আর সমগ্র উত্তরাংশ জুড়ে রয়েছে মাইকতোলি ও অন্যান্য শৃঙ্গ। হালকা মেঘের আনাগোনায় মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে মাইকতোলি। আমার জীবনের এক অসাধারন অভিঞ্জতা। এখানেই দেখা হল সেই গাইড পুষ্কর সিং এর সাথে। ওর সাথে এই পথ নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হল। সমগ্র ঢাকুরী জুড়ে দেখলাম অনেকগুলি তাঁবু পড়েছে। অধিকাংশই এখন বাড়ীর পথে। ইতিমধ্যে দুপুরের আহার ভাত ডিমের ডালনা সহযোগে করলাম।ঠিক ২-৩০ মিনিটে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার আমাদের লক্ষ্যস্থল ৮ কিমি দূরের খাতি গ্রাম । ঢাকুরী ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না। ঠিক করলাম ফেরার সময় এখানে থাকবো। শুনেছি ঢাকুরী থেকে সূর্যোদয় দেখা এক অসাধারন অনুভূতি। খাতির পথে প্রথম ৪ কিমি উতরাই এবং পরের ৪ কিমি চড়াই। উপত্যকার ডানদিকের পাথর বিছানো রাস্তা ধরে ক্রমশঃ নিচের দিকে চলেছি। হাল্কা বনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। পাখির একটানা কুজ্ঞন। ঝিঁঝিঁর ডাক। এরপর রাস্তা একটু একটু করে উপরে উঠে গেছে। তবে এখন শরীর সয়ে গেছে। মাঝপথে দেখলাম একটা স্কুলবাড়ি। পাহাড়ের ঢাল লালে লাল হয়ে আছে-ওগুলি রামদাদা।প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে চলে এলাম খাতি(৭২৫০ ফুট)। গ্রামে প্রবেশের আগেই বেশ কিছু নিষ্পাপ শিশু দৌঁড়ে এল। তাদের আব্দার “মেঠাই”। আমরা মেঠাই অর্থাৎ লজেন্স দিলাম। ওদের ফটোও তুললাম। ওদের সদা প্রাণোঞ্ছল মুখ সরল হাসিতে ভরে গেল। খাতি বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে ফসল ফলে রয়েছে। এখানে ওখানে মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে;গরু ছাগল ফিরে আসছে ঘর মুখে। রাতে মাথা গুজলাম একটা ছোট হোটেলে। রাতের খাবার খিচুড়ি আর ডিমভাজা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ললাম। কিন্তু ঘুম কি সহজে আসে? পিন্ডার নদের গর্জনে কান ঝালাপালা হবার উপক্রম।
তৃতীয় পর্ব
১৮ তারিখ,ট্রেকিং এর তৃতীয় দিন। আজ আমরা যাব দ্বোয়েলি। খাতি থেকে এর দূরত্ব ১১ কিমি। এই খাতি থেকেই একটি পথ চলে গেছে জাতোলী হয়ে সুন্দরডুঙ্গা-ভার্নোটি-মাইকতোলি বেসক্যাম্প-দেবীকুন্ডের দিকে। আমরা চলেছি ডানদিকের পথে। পিন্ডার নদীর পার ধরেই এই পথ চলে গেছে। নিচে পিন্ডার নদী দুরন্ত গতিতে বয়ে চলেছে। কিছুটা যাবার পর আর কোন পথ নেই-বিশাল ধস-বিশাল বিশাল গাছ সব নদীর উপর যেন শুয়ে পড়েছে। অতিকষ্টে ধীরে ধীরে নেমে আসলাম প্রায় নদীর গর্ভে,বোল্ডারের উপর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দুইদিকে পাহাড় আর পাহাড়-গভীর বন,আর মাঝখানে আমরা। এইভাবে প্রায় ৪০/৪৫ মিনিট পার হয়ে গেল। সামনে দেখলাম একটা কাঠের সাঁকো। কাঠের নড়বড়ে পুল পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। বিশাল বিশাল সব আকাশছোঁয়া মহীরুহ-দেওদার-পাইন-চীর আর আখরোট গাছের চাদোয়া। বাঁদরের কিচির মিচির,বনমুরগীর দল,আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখীর কলকাকলী আমাদের সঙ্গী। সামনেই খাদের ওপাশে ডানদিকের পাহাড়ের কোল বেয়ে প্রায় ২০০-২৫০ ফুট উপর থেকে এক বিশাল জলপ্রপাত সোজা পিন্ডারের বুকে আছড়ে পড়ছে,আর তাতে রামধনূর সাতরঙ্গের খেলা চলছে। কিছুটা যাবার পর সামনেই পিন্ডার ও কাফনীর সঙ্গমের ব্রীজ পেলাম। এই ব্রীজ পার হলেই দ্বোয়েলী। ব্রীজের উপর থেকে ওপারের দ্বোয়েলীকে অসাধারন লগছিল। এর উচ্চতা প্রায় ৯০০০ ফুট। এখানে KMVM এবং PWD এর বাংলো আছে। আমরা PWD এর বাংলোয় রাতের আশ্রয় নিলাম। ওখানকার চৌকিদারই খাবার ব্যবস্থা করলেন। এখানেই KMVM বাংলোয় অনুপদা,পীযুষদাদের সঙ্গে আলাপ হল। শুনলাম ওরা চারজন কাল কাফনী যাবে। যদিও পথেই শুনেছিলাম কাফনীর পথে ধস নেমেছে। খুব দু্গম পথ। তবে PWD রাস্তা করছে। আমরা আমাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করলাম। ঠিক করলামও তাহলে আগে কাফনী যাবার চেষ্টা করবো,তারপর পিন্ডারী।
পরেরদিন ১৯ তারিখ,ভোর পাঁচটাতেই গাাইড আনন্দের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভোর সাড়ে পাঁচটায় হাাঁটা শুরু করলাম। ওদিকে অনুপদারাও বেড়িয়ে পড়েছে। আজ আমাদের সম্মিলিত টিমের সদস্য সংখ্যা সাত জন। অনুপদারা তিন জন (একজন অসুস্থতার জন্য থেকে গেছেন),আমরা দুজন আর দুজন গাইড। এখানে প্রসঙ্গত বলি এই অনুপদার সঙ্গে পরের বছর আমি হরকিদুন ট্রেকং এ গেছিলাম। আসলে পাহাড়ে মানুষের সাথে মানুষের বন্ধুত্ব এই ভাবেই হয়। সদা হাস্যময় বিনয়ি অনুপদার সাথে আমার সখ্যতা আজও অটুট। যাহোক আমাদের এবারের ট্রেকিং এ ফিরে আসি। আজ আমাদের ট্রেকিং করতে হবে ২৪ কিমি-১২ কিমি যাওয়া এবং ১২ কিমি আসা। এখনও পুরো আলো ফোটে নি। আবছা আলোয় পাাহাড়ের ঢাল বরাবর সরু পথরেখা ধরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। প্রায় দেড় কিমি যাাওয়ার পর দেখি কোন রাস্তারই অস্তিত্ব নেই। সামনে কোন পথই নেই। বিশাল ধস। পুরো পথ কয়েকশো ফুট নীচে নদীর মধ্যে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে আছে। বাঁদিকে পাাহাড়ের গায়ে সরু সরু বাঁশ গাছ। গাইডের সাহায্যে অতি সাবধানে ঐসব হেলানো বাঁশ গাছ ধরে ধরে ঝুরো মাটিতে পা ফেলে ফেলে এগোতে লাগলাম। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি। চোখ মন সব কিছুই ঐ পায়ের পাতায় আবদ্ধ। আমরা যেন ভূমিকম্প বিদ্ধস্ত কোন জায়গায় চলে এসেছি। কোন কোন জায়গায় কাফনী নদীর দিক পরিবর্তন হয়ে গেছে ধসের ফলে। সরু এক চিলতে ঝুরো মাটির পথ-পাহাড়ের খাঁজে কোনক্রমে শুধু পা রাখার জায়গামাত্র। এভাবে খুব সাবধানে পাহাড়ের দেওয়াল ধরে পা টিপে টিপে ১০০/১৫০ মিটার যাবার পর এক জায়গায় এসে দেখি সামনে শুধুই বোল্ডার-Bolder Zone ।কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করার পর আবার একটি ধস আমাদের পার হতে হল;ভাবলে এখনও বুক কেঁপে ওঠে। একদম সরু পথরেখা-পাথুরে মাটির উপর গাইড আনন্দের পিছন পিছন এক একজন এগোচ্ছি,আর ঝুর ঝুর করে মাটি ঝরে পড়ছে। আরো কিছু মাটি ঝরে পড়লেই সোজা গিয়ে পড়বো কয়েকশো ফুট নিচে কাফনীর খরস্রোতা জলে। অন্ধকারের পরই যেমন উঁকি মারে সোনালী আলোর পরশ,ঠিক এরকমই বিপদসঙ্কুল ঐ ধসের সাম্রাজ্য পেরিয়ে প্রবেশ করলাম বিরাট বিরাট হলদেটে ঘাসের জঙ্গলে। দুধ সাদা নন্দাকোট একদম চোখের সামনে-প্রায় হাতছোঁয়া দূরত্বে। এদিকে ডানদিকে কাফনী নদী আর বাঁদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের দেওয়াল;মাথাগুলো ছুঁচলো হয়ে আছে। দূরে উপত্যকায় একদল হরিণের মতো জন্তু দৌঁড়ে ক্রমশঃ পাহাড়ের খাঁজে হারিয়ে গেল। আমরা অবশেষে কাফনী হিমবাহের প্রায় কাছে চলে আসলাম;ঘড়িতে তখন সময় ১২-১৫ মিনিট। পিছনে নন্দাকোট। হিমবাহের মুখটা দিয়ে তির তির করে বেরিয়ে আসছে জলের ধারা-কাফনী নদী। হিমবাহের উপরটা ছাই ছাই রঙ্গের;মোরাম বিছানো।ওদিকে ইতিমধ্যে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। কোথা থেকে একদল মেঘ এসে ক্রমশঃ নন্দাকোটকে ঢেকে দিতে লাগলো। ওদিকে গাইড ও তাড়া দিতে লাগলো আর অগ্রসর না হবার জন্য। তাই একদম জিরো পয়েন্টে যেতে পারলাম না। ওখানেই আমরা কিছুক্ষণ থাকলাম। এরপর আবার সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর পথ ধরে অতি সাবধানে ফিরে আসলাম দ্বোয়েলীতে। ঘড়িতে তখন বিকাল ৫-৩০ মিনিট। সারাদিন খুবই ধকল গেছে;তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
চতুর্থ পর্ব
২০ তারিখ, আজ আমাদের ট্রেকিং-এর পঞ্চম দিন। আমরা যাব আজ আমাদের চরম লক্ষ্যের একদম কাছে, ফুরকিয়া হয়ে পিন্ডারীর এক কিলোমিটার আগে পাইলট বাবার আশ্রমে। দ্বোয়েলিতে KMVM বাংলোর পিছন দিক দিয়ে রাস্তা চলে গেছে ফুরকিয়ার দিকে। সেই রাস্তা ধরে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ রওনা দিলাম ফুরকিয়ার উদ্দেশ্যে। দ্বোয়েলি থেকে ফুরকিয়ার দূরত্ব ৫ কিমি। বেশ ঠান্ডা লাগছিল।তাপমাত্রা ৫/৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। পথ মোটামুটি চলার মত। প্রথমে কিছুটা চড়াই, এরপর হালকা চড়াই উৎরায় পথ। একদিকে পাহাড়ের দেওয়াল, এর ধার দিয়ে উটের কুঁজের মতো পথ। চওড়ায় চার থেকে ছয় ফুটের মধ্যে। আর নীচে শুধুই অতল খাদ। সারাটা পথ ধরে শুধু এভাবেই হাঁটা। প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগলো ফুরকিয়া(১০৬০০ফুট) পৌঁছতে। এখানেও KMVM ও PWD এর বাংলো আছে ছোট একচিলতে জমির উপর। গরম খিচুড়ি আর ডিম ভাজা সহযোগে দুপুরের আহার এখানেই সারলাম।
প্রায় দেড়ঘন্টা সময় এখানে কাটিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম পিন্ডারীর উদ্দেশ্যে। প্রথমদিকে পথে কয়েকটি ঝরণা পড়লো। আর একটা বিষয় আমাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল যা না বললেই নয়। দ্বোয়েলি পর্যন্ত পথে অনেক নাম জানা, না জানা পাখির আনাগোনা দেখেছি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আজকের এই পথ পরিক্রমায় কোন পাখিরই হদিশ পেলাম না। চারদিকে অদ্ভুত এক নির্জনতা। এদিকে মেঘের আনাগোনাও শুরু হয়ে গেছে। কনকনে ঠান্ডা,পাগলা হাওয়ার দাপট আর মেঘের রাজত্বের মধ্যে দিয়ে আমরা এগোতে লাগলাম। কোন কোন সময় কয়েক হাত দূরের সঙ্গী ভাইদা, আনন্দকেও দেখতে পাচ্ছি না। পিন্ডারী নদীকে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে গেলাম। দূরে উপত্যকার মাঝে নন্দাদেবীর মন্দিরটি দেখতে পেলাম। পতাকা পত্পত্ করে উড়ছে। অবশেষে মন্দির প্রাঙ্গনে এসে পৌঁছলাম। টুকরো টুকরো পাথর দিয়ে তৈরী মন্দিরটি। মন্দিরের গায়ে লাগানো বাবাজীর ঘর কাম রান্নার জায়গা। স্বামীজী আমাদের গরম চা আর পুরি দিয়ে স্বাগত জানালেন। স্বামীজীর সাাথে কথা বলে আমাদের একটা ভুল ভাঙ্গলো। তার নাম স্বামী ধর্মানন্দ, পাইলট বাবা নয়। মন্দির থেকে বেশ কিছুটা নিচে দুটি ছোট ছোট পাথরের চালাঘর, অনেকটা যেন ইগলুর মতো। এরই একটাতে আমাদের ছয়জনের রাতের থাকার ব্যবস্থা হল। মাটিতে ঘাস বিছানো। একমাত্র ছোট্ট দরজা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। রাতের খাবার গরম খিচুড়ি। অবশেষে স্লিপিং ব্যাগের ভিতর নিজের আপাতমস্তক মুড়ে ফেললাম। গায়ের ফেদার জ্যাকেটও খোলার কোনো প্রশ্নই নেই। সন্ধ্যা ছটা-সাড়ে ছটাতেই যেন মনে হল রাত ১২ টা। ওদিকে পাথরের ফাকফোকড় দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। গায়ে যেন সুঁচ বিঁধছে। ভোর রাত্রে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। সারা রাত কারোরই ঘুম হল না ।
আজ ২১ তারিখ। ভোর সাড়ে চারটে –পাঁচটা নাগাদ বাইরে এসে আনন্দে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। এখনো দিনের আলো ফোটেনি। এ কোথায় এসে পড়লাম, এই কি স্বর্গ! জ্যোৎস্না রয়েছে এখনও। সেই আলোতে দেখতে পেলাম দুধ সাদা সব তুষারশৃঙ্গ প্র্রায় অর্ধচন্দ্রাকারে আমাদের ঘিরে রয়েছে। সবই যেন প্রায় হাতছোয়া দূরত্বে। আস্তে আস্তে চারদিক আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগলো। তুষার হিমালয়ের অঙ্গনে ঢুকে পড়েছে সূর্যের সোনার রথ। চোখের সামনে আলোয় উদ্ভাসিত হতে লাগলো এক এক করে সব তুষারশৃঙ্গ—পানজোল (১৮০০০ফুট),বালজোরী (১৯৮৫৭ফুট),পানালীদুয়ার (২১৮৬০ ফুট),নন্দীখাত (২১৬৯০ ফুট),ছাঙ্গুজ (২০৭৯০ ফুট),নন্দাকোট (২২২৫১১ ফুট)। তুষারশৃঙ্গের মাথায় আলোর খেলা দেখতে দেখতে ৩০/৪০ মিনিটের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম “পিন্ডারী জিরো পয়েন্টে”। এর উচ্চতা ১২৫০০ ফুট। জিরো পয়েন্ট মানে এখানেই পথ শেষ। এর পর আর এগনো যাবে না। আমাদের বাঁদিকে কোমর সমান মাটির দেওয়াল, আর এর পরেই অনন্ত খাদ। ডানদিকেও অতল খাদ। মাটির দেওয়ালের গায়ে একটা ঘন্টা বাঁধা রয়েছে। আমরা প্রত্যেকে ঘন্টা বাজিয়ে লজেন্স দিয়ে নন্দাদেবীর পূজা দিলাম। গাইডরা সঙ্গে করে ধূপ নিয়ে এসেছিল। ওরা ধূপ জ্বালিয়ে নন্দামাঈ-এর সামনে রাখলো। আমাদের তখন বাধভাঙ্গা উচ্ছাস-আনন্দ আর ধরে না। আমাদের ফটোসেশন যেন থামতেই চায় না। শুধুই ক্যামেরার শাটার টানা, আর ক্লিক ক্লিক ক্লিক। আমাদের এত দিনের স্বপ্ন সফল। নন্দাখাতের একদম নিচে রয়েছে পিন্ডারী গ্লেসিয়ার। এর ডানদিকে ক্রমশঃ উপরে উঠে গেছে ট্র্রেলস পাস, এঁকে বেঁকে নদীর মতো বরফের স্তুপ নিচের দিকে নেমে গেছে। পিন্ডারী হিমবাহের মুখ ভাল করে না দেখলে বুঝতে পারা যাচ্ছে না। ধসে সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। সরু একটা মুখ দিয়ে তির তির করে সরু ফিতের মতো জলের ধারা বেরিয়ে আসছে, পিন্ডারী নদী। চোখ-মনের খিদে মিটিয়ে অবশেষে রওনা দিলাম নিচের দিকে। ফিরে আসতে আসতে মনের অলিতে গলিতে সেই কথাটাই যেন বারবার ভেসে উঠতে লাগলোঃ
“সুন্দরের দূরত্বে কখনো হয় না ক্ষয়। দুর্গমতা,দূরত্ব না থাকলে কি সৌন্দর্য খোলে?”
সমাপ্ত
(****পরের সংখ্যায় লেখকের নতুন ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী —-রহস্যে ঘেরা রূপকুন্ডের পথে )