শান্তনু ভট্টাচার্য
এবার তিনি সেই সুরঙ্গের ভিতরে ঢুকে পড়লেন। সুরঙ্গে নীল অন্ধকার। সেই নীল রংটা কোত্থেকে আসছে তা ভাবতে-ভাবতে তিনি হাঁটতে লাগলেন সুরঙ্গের মেঝেতে।
আসলে এটা সুরঙ্গ নয়। সুরঙ্গের মতো একতলার একটা বদ্ধ টানা চাতাল। এবং এই নীল আলো আসলে চাঁদের জ্যোৎস্না। কোনোভাবে ঠিকরে ঢুকে পড়েছে চাতালে— তিনি বুঝে নিলেন।
তাঁর এই বুঝে নেওয়ার মধ্যে মজবুত যুক্তি আছে—এই বাড়ির প্রত্যেকটি খাঁজ-খোপ, সব তিনি নিজের হাতের খয়েরি তালু দুটোর মতোই চেনেন।
খুব ধীরে হাঁটছিলেন তিনি। এবার নিজেকে থামালেন। দুটো হাত চোখের সামনে মেলে ধরলেন। নীল আলোয় দেখলেন তালুর ওপর ছড়িয়ে থাকা কবেকার সেই পুরোনো রেখাগুলোকে। এক হাতের আঙুল দিয়ে অপর হাতের তালুতে বোলালেন—কড়া পড়েছে। সেদিনের মলিনতা হারিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে হাত দুটো।
আবার তিনি হাঁটা শুরু করলেন। সুরঙ্গ-চাতাল পেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন সেই খোলা উঠোনে। এই আয়তকার উঠোনের ওপরে জ্যোৎস্না মাখা নীল আকাশ। তিনি আকাশে তাকালেন। আকাশে নিটোল নীল চাঁদ। সেই চাঁদের বুক থেকে ঝেঁপে নামছে জ্যোৎস্না। আকাশে মাথা তুলে তিনি চাঁদের দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। কতদিন পর তিনি এভাবে চাঁদ দেখলেন!
চাঁদ থেকে চোখ নামিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন পেরিয়ে বাঁয়ে ঘুরলেন। ডান দিকে চৌবাচ্চা, আগে যেখানে সব সময় জল ভর্তি থাকত। এখন তাতে জল আছে কি না বুঝতে পারলেন না তিনি। ধরেই নিলেন, নেই। চৌবাচ্চার একপাশে মাকড়সার বাহারি জাল। থম মেরে থাকা অন্ধকারে মাকড়সাটা কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে!
তিনি ক-পা এগোলেন। সময় নিয়ে, সাবধানে। বাঁয়ে সিঁড়ি। প্রথম ধাপে পা দিলেন তিনি। তারপর দ্বিতীয় ধাপে, তৃতীয় ধাপে, চতুর্থ ধাপে—তিনি সিঁড়ি ভাঙছেন। হাঁটুতে জোর দিয়ে, সামনে একটু ঝুঁকে। নিজেকে ওপরে তুলে নিয়ে যেতে তার এই চলন-অভ্যাস তো আজকের নয়!
যে-ধাপগুলো একসময় ভীষণ চেনা ছিল, সীমিত ক্ষমতার তামাটে বাল্বের আলোয় এখন তা যেন অচেনা মনে হচ্ছে! তিনি মনের মধ্যে নিজেকে দেখে হেসে ফেললেন। কোনো কোনো ধাপে দাঁড়িয়ে দু-পাশের দেওয়াল দুটো দেখলেন সময় নিয়ে। পলেস্তারা খসেছে অনেক জায়গায়। যেখানে খসেনি সেখানে বিবর্ণ হয়েছে দেওয়াল। তামা রঙের আলো মেখে তা যেন কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে!
তিনি আরও অনেকগুলো সিঁড়ি ভাঙলেন। আরও ক-টা ভাঙতে হবে। একটু থেমে আগামী সিঁড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেললেন। অসহায়তা থেকে উঠে আসা যে-শ্বাস দীর্ঘ হল। শুধু দু-দিকের দেওয়াল নয়, চারপাশ এবং উপরের সিলিং-এর দিকে তাকালেন তিনি— সবকিছুই কেমন তাম্রবর্ণ!
আবার তিনি সিঁড়ি ভাঙছেন। হয়তো তাঁর জন্যই জ্বেলে রাখা এই তামা রঙের আলোয় তিনি সইয়ে নিয়েছেন তাঁর দৃষ্টি। আধমরা আলোয় একটু দূরেই তিনি সেই দরজাটা দেখতে পেলেন, যে-দরজাটা খানিক পরেই তিনি ধাক্কা দিয়ে খুলবেন, যে-দরজাটার সামনে তাঁকে একদিন এসে দাঁড়াতে হবে বলে তিনি অনেক আগেই জানতেন।
আরও কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে গেলেন তিনি। একবার জোরে শ্বাস নিয়ে ও ফেলে বুক শক্ত করে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। গোয়েন্দা-দৃষ্টিতে ওপর থেকে নীচ অবধি জরিপ করলেন দরজাটাকে। সেদিনের রঙটাই রয়েছে, কিন্তু ক্ষয়ে গেছে তার লাবণ্য। পাল্লা দুটোর বুকে তিনি হাত বোলালেন, নরম পরশে। তারপর ধাক্কা দিলেন একবার। দু-বার। বুঝলেন, ভেতর থেকে বন্ধ। এবার কড়ায় আঙুল গলালেন তিনি। নাড়ালেন, আঙুলকে যতটা সম্ভব বশে রেখে। ভেবেছিলেন, মার্জিত এই ধাতব শব্দে হয়তো ভেতর থেকে সাড়া আসবে! কিন্তু এল না। দ্বিতীয় বার কড়া নাড়লেন, এবার আর বশে রাখলেন না আঙুল। ধরেই নিলেন, অমার্জিত এই শব্দ নিক্ষেপণে এবার সাড়া আসবে দরজার ওপাশ থেকে। কড়া থেকে আঙুল তুলে এনে দরজার গায়ে চোখ রেখে অপেক্ষা করলেন।
ভিতরে দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে।
পাল্লা দুটো ফাঁক হল। দুটো পাল্লায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মানুষটা। বয়সের ভারে শরীর ভেঙেছে, কিছুটা হেলে পড়েছে সামনে। মুখের ওপর আলো-ছায়ার রেখাগুলো এই মুহূর্তে তাঁর মুখটাকে বড়ো ভৌতিক করে তুলেছে! যার দিকে চেয়ে থাকাই দুষ্কর!
—এসো।
মানুষটা আগে হেঁটে চলেছেন। খুব ধীরে, সামনে ঝুঁকে, মেঝেতে পায়ের পাতা ঘষে-ঘষে। পিছনে তিনি। বাইরের মতো এখানেও তামা রঙয়ের আলো। এবং তা আরও নিস্তেজ। তিনি ডানে-বাঁয়ে দৃষ্টি ঘোরাচ্ছেন—সবকিছু আগের মতোই আছে; দেওয়ালের ছবি, কাঠের আসবাব, তাকের বই—সব!
ফালি বারান্দা পেরিয়ে মানুষটা চৌকো মাপের ঘরটাকে ঢুকলেন। তিনি জানতেন মানুষটা তাকে নিয়ে এই ঘরেতেই বসবেন। এই ঘরটা যে মানুষটার ভীষণ প্রিয়! নিজের হাতে, নিজের মতো করে তিনি এই ছোটো ঘরটা সাজিয়েছিলেন, সাজিয়ে রাখতেন। কারণে- অকারণে নিজেকে বন্দি রাখতেন এ-ঘরে।
মানুষটা তাঁর সেই ছোপড়ার গদি আঁটা বড়ো কাঠের চেয়ারটাতেই বসলেন। তার দিকে তাকিয়ে বললেন—বসো।
নির্দেশ পেয়ে তিনি বসলেন তুলোর গদি রাখা ছোটো মাপের লোহার চেয়ারটাতে। তাঁর প্রিয় সেই কালো চেয়ারটা!
—তোমাকে দু-একটা ছোটো, কিন্তু প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য ডেকে পাঠিয়েছি।
এটুকু বলে মানুষটা তাঁর কথা থামালেন। মানুষটার কথার মধ্যেই কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে তাঁর ওপর সরাসরি দৃষ্টি রাখলেন তিনি। মানুষটার চোখে-মুখে এখনও সেই দীপ্তিটা রয়ে গেছে, সেদিনের সেই গাঢ় দীপ্তিটা! যে-দিপ্তীটা তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে দিয়ে ঠিকরে বের হত, যে- ব্যক্তিত্বকে তাঁর কাছে-দূরের সবাই সমীহ করত এবং তার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা।
—খুব যদি না ভুল বলি, তাহলে তুমি গত মাসে ষাট অতিক্রম করে গেছ…
নব্বই বছরে এসে মানুষটার গলার স্বর কি কিছুটা বদলে গেছে? না কি তা আগের মতোই আছে?
পিঠের নরম গদিতে শরীরটা এলিয়ে দিয়েছেন মানুষটা। কথা বলার আগে বোধহয় পর্যাপ্ত বাতাস ভরে নিলেন বুকে—জানি, তুমি এখনও ভয়ের মধ্যেই রয়েছ এবং সেটাই স্বাভাবিক। আততায়ী মাত্রই ভীতু। সর্বদাই ভয় তার মাথার ওপর চেপে বসে থাকে।… তুমি আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলে; পারোনি, ব্যর্থ হয়েছ। সত্যি বলতে কী, তখন আমি চেয়েছিলাম তোমার শাস্তি হোক, কঠিন শাস্তি প্রাপ্ত হও তুমি। কিন্তু এখন আমি আমার মনোভাব বদল করেছি। বলা যায়, বদল হয়ে গেছে। আজ আমি চাই না তুমি শাস্তি পাও। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা বুকে ভয়ে নিয়ে, নিজেকে ব্যর্থ করে তুমি তোমার শাস্তি পেয়ে গেছ। নিজেই নিজেকে কঠিন শাস্তি দিয়েছ।
—আপনি খুশি হয়েছেন!
— হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?
এখনও মানুষটার কথার বাঁধুনি আর ঝাঁঝ কি আগের মতোই আছে?
—আপনি নিশ্চয় চেয়েছিলেন আমার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হোক!
চশমার ভারী কাচের নীচে নব্বই বছরের পুরোনো চোখ দুটো বুজিয়ে নিলেন মানুষটা—আমি তোমার দ্বীপান্তর চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম একটা জনমানবহীন দ্বীপে তুমি নির্বাসিত হও। সাগরের জলে নিজের মুখটা দ্যাখো, নিজেকে চেনো। নিজের হাতে নিজের বুকে আঘাত করে হৃদয়ের কম্পন অনুভব করো।…কিন্তু ‘দ্বীপান্তর’ শাস্তিটাই যে আজ আর নেই! জনশূন্য কোনো দ্বীপ আজ আর হয়তো এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না!
মরচে পড়া হারিকেনের ঘোলাটে কাচের ভিতর আলোর টুকরোটা একটু যেন দুলে উঠল!
তবে যে শাস্তি আমি তোমাকে দিতে চেয়েছিলাম, সেই শাস্তি আমি নিজেই ভোগ করেছি এবং করছি। দ্বীপান্তর। এক নির্জন দ্বীপে একা একা নিজের হৃদয় যাচাই করছি। তাতে অবশ্য আমার কোনো খেদ নেই, দুঃখ নেই।
—জানি।
—জানাটা তোমার মহত্ব।
মানুষটা কি ঘাড় ঘুরিয়ে খোলা জানালাটার দিকে তাকিয়ে আর এক বার শ্বাস উগরালেন?
চেয়ারের কোলে শরীরটা আরও মেলে দেবার চেষ্টায় ঘাড়টা ডায়ে কিছুটা কাত করে ফেললেন মানুষটা—তুমি ভেব না আমি তোমাকে বিদ্রুপ করলাম। সে-অধিকার আজ আর আমার নেই।
— কিন্তু আমার তো মনে হয় এখনও আপনার অধিকারের ব্যাপ্তি সাগরতুল্য।
একটু সময় নিলেন মানুষটা। ধরে রাখা সময়ের ভিতর বোধহয় বুজিয়ে ফেললেন রুগ্ন চোখ দুটো—‘এখনও’ শব্দটা আমার আজ ভীষণ ভারী মনে হয়। শব্দটার মধ্যে এমন এক নিবিড়তা লুকিয়ে আছে যে, এর আবেশ থেকে বেরিয়ে আসা যায় না, আবার কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়ানোও ভীষণ কঠিন। এ যেন এক নেশা!
হারিকেনের আলোটা আবার দপদপ করছে। মানুষটা এখন কাঁপতে থাকা সেই আগুনের টুকরোটার দিকেই তাকিয়ে আছেন— এই ঘরের বাল্বটা নষ্ট হয়ে গেছে বেশ ক-দিন হল। অকেজো বাল্বটা বদল করতে পারতাম, কিন্তু করিনি। অন্ধকারকে নতুন করে চিনতে চাইছি, তার আর কোনো রূপ কোথাও লুকিয়ে আছে কি না তা বুঝতে চাইছি আর একবার!
মানুষটা বোধহয় বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া এক উষ্ণ শ্বাস-প্রবাহকে বুকের ভিতরেই থামিয়ে দিলেন! ব্যস্ত হয়ে উঠলেন যেন— যাক, যেজন্য অনেক তত্বতালাশ করে তোমায় ডেকে আনলাম…আমার একটা সিদ্ধান্ত এবং তা অনেক ভাবনাচিন্তার ফসল…
কথাটা হয়তো আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা না করে মাঝপথে থামালেন তিনি এবং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
ধীর পদক্ষেপে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মানুষটা। দরজা খুলে খুব সম্ভব হলদেটে, কারণ আগুন-আলোয় রঙটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, একটা বড়ো খাম নিয়ে ফিরে এলেন এবং কোনো ভূমিকায় না গিয়ে এগিয়ে দিলেন—নাও। সেদিন যা তুমি আমাকে শেষ করে লুটে নিতে চেয়েছিল, তা এর মধ্যে আছে।
হারিকেনের আগুনটা এভাবে কাঁপছে কেন!
— আলোর সন্ধানে ছুটতে-ছুটতে একসময় মনে হল, আলো বস্তুটা নিছকই আপেক্ষিক। এর কোনো রঙ নেই। আমরা আলো বলতে যা দেখি সেটা আসলে একটা চোখের ভ্রম। সত্য আসলে অন্ধকার। অন্ধকারই স্থাবর। অন্ধকার কোনো ভ্রমের অস্তিত্ব শিকার করে না। ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সততার বীজ নিহিত থাকে অন্ধকারের মধ্যে, সব সৃষ্টির ভ্রুণ লুকিয়ে থাকে অন্ধকারের গহ্বরে। মানুষ যখনই অন্ধকারকে মুছে দিতে চেয়েছে, তখনই তার ওপর নেমে এসেছে প্রাকৃতিক আঘাত। এই মহাবিশ্ব থেকে যদি কোনোদিন চিরতরে অন্ধকার বিদায় নেয় তবে সেদিনই প্রাণের বিনাশ ঘটবে—একসময় এই ধারণায় জারিত হই আমি।
মানুষটা থামলেন। যেন এক মুক্তমঞ্চে হাজারো মানুষের সামনে তাদের অনুরোধে এতক্ষণ কথা বলছিলেন! মানুষটার ঠোঁটের ওপর কি একটা হাসির আভা ফুটে উঠছে?
মানুষটা পুনরায় কথা শুরু করলেন—আমি আমার লক্ষ্য বদল করলাম, একদিন হঠাৎ-ই, মাঝরাতে। আলোকে সরিয়ে রেখে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। নতুনভাবে, নতুন উদ্যমে কাজে নামলাম। হাঁটা শুরু করলাম অন্ধকারের সন্ধানে। অন্ধকারের রঙ ও রূপ খুঁজতে শুরু করলাম বিজ্ঞানের তত্ত্ব-সূত্র মেপে। সারা পৃথিবী আমি দৌড়ে বেড়াই অন্ধকারের বর্ণ-লাবণ্য-মাধুর্য খুঁজতে। আমি যেন উন্মাদ হয়ে যাই! এত রঙ…এত রঙ! আঁধারের মোহে আমি যেন গভীর থেকে অতি গভীরে তলাতে থাকি… বিজ্ঞান ও গণিতের জটিল সূত্র কাজে লাগিয়ে নিভৃতে আমি যা করেছি তা মানব সভ্যতায় নতুন এক দিক খুলে দেবে, আমি নিশ্চিত। এভাবে এ-কাজ আমার আগে আর কোনো বিজ্ঞানী করেছে বলে তো আমার জানা নেই!
যেন একটা গল্প বলে গেলেন! যার প্রত্যেকটা কথা ব্যবহার হল মেপে। সঠিক শব্দ খুঁজে এনে যেন তৈরি হল বাক্যগুলো। যেমনটা তিনি আগেও করতেন। শেষ কথাগুলোর উপর গাম্ভীর্যের এক গভীর আচ্ছাদন রাখলেন মানুষটা। এর আগে কি উনি এমনভাবে অহংকারী হয়ে উঠেছিলেন কখনও?
মানুষটা চুপ করে গেছেন। এই ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। কোনোদিন ছিলও না। তবু সময় তার শর্ত মেপে এই হলুদ ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সেই কবে থেকে!
— অন্ধকার নিয়ে গবেষণা করতে-করতে আজ এক এক সময় মনে হয় পৃথিবীর সব অন্ধকার যেন পরতে পরতে আমার শরীরে-মনে গেঁথে বসেছে। এবং এটাকেই আমি আমার কাজের সর্বোচ্চ পুরস্কার ও স্বীকৃতি বলে মনে করি, নিজের জন্য আমার গর্ব হয়!
মানুষটা কি এবার উচ্ছ্বাসের চরম সীমা অতিক্রম করে যাবেন?
—এই খামের মধ্যে আমার সারা জীবনের গবেষণার ফলাফল নিখুঁতভাবে রাখা আছে। আমি একটা বর্ণ-শব্দও কোথাও প্রকাশ করিনি। এটা তোমাকে দিলাম, এটা তুমি তোমার নামে প্রকাশ করো।
হারিকেনের কাচ-বন্দি আগুনের টুকরোটা কি আবার কেঁপে উঠল, নাকি চারপাশে হাজারটা ঝাড়বাতি জ্বলে উঠল একসঙ্গে, নাকি পৃথিবীর সব অন্ধকার মেঘ হয়ে নেমে এলো এই ঘরে!
— কৃতি ছাত্র, সন্ধিৎসু গবেষক হিসাবে তোমার একটা স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিল, যা তুমি পাওনি…
জ্যোৎস্না-রাতের নীল বাতাস ঘরের মধ্যে দৌড়ে নিল খানিক।
— যদি মনে করো আমার এই গবেষণাপত্রটির আলোর মুখ দেখার অধিকার নেই, তবে কোনো অন্ধকার কুয়োর মধ্যে এটাকে ডুবিয়ে দিও। অন্ধকারের কথা অন্ধকারই বুকে আগলে রাখবে।
এ-ধরণের কথার বিপরীতে বলার জন্য তৎক্ষণাৎ ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। মস্তিষ্কের কোষে জবাবের শব্দ-বাক্যগুলো সাজাতে সময় লাগে। সে-সময় না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মানুষটা।
লোহার কালো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনিও।
—তুমি আর কখনও আমার কাছে এসো না। কথা দিলাম, আমিও আর কখনও তোমায় ডাকব না।
মানুষটা হেঁটে যাচ্ছেন; ঘর থেকে বেরিয়ে শুরু বারান্দা ধরে। যে-পথে আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশি। সন্দেহ নেই, কঠিন অন্ধকার মাখা তাঁর নিভৃত কক্ষের দিকেই তিনি হেঁটে যাচ্ছেন।…নাকি না, সে-ঘর এখন ভেসে যাচ্ছে ফুটফুটে বিজলিতে!
বিবর্ণ সেই চৌকাঠ পেরিয়ে উঁচু সিঁড়িগুলো ভেঙে-ভেঙে নীচে নেমে আসছেন তিনি। তামা রঙের মেঝেতে-দেওয়ালে তাঁর অন্ধকার রঙের ছায়া পড়ছে।
তিনি সিমেন্ট বাঁধানো সেই আয়তকার উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। আকাশে তাকালেন— চাঁদটা নেই। একটা ছোটো মেঘ-খণ্ড এসে ঢেকে দিয়েছে তাকে, যদিও সেই নীল আলোটা রয়ে গেছে চারপাশে!…আলো নয়, আলোর রেশ। মেঘ টুকরোর নাগাল এড়িয়ে যা ভেসে যেতে চাইছে অনন্ত আকাশে।
আহত আলো চোখে নিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন সেই সুরঙ্গের মধ্যে। সুরঙ্গ তো নয়, বদ্ধ এক চাতাল! চাঁদের নিভু আলো এখানে তার নীল প্রভাব ফেলতে পারিনি। তিনি হেঁটে যাচ্ছেন এক কঠিন অন্ধকার পথে। যেন এক উপদ্রুত অঞ্চল তিনি পেরিয়ে যাচ্ছেন। মানুষটার ভাঙাচোরা নিঝুম মুখটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে—মানুষটা কি তাঁর অন্ধকার ছড়ানো রুদ্ধ কক্ষে চোখ বন্ধ করে আরও অন্ধকারের প্রত্যাশায় তলিয়ে যাচ্ছেন মনের অতলে? নাকি পুত্রের গৌরব অর্জনের সেই সোনালি মুহূর্তটা কল্পনায় এনে বদ্ধ ঘরের প্রখর আলোয় বাহারি আয়নায় নিজের উজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে আছেন?