শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(যা কিছু দেখি, তাই কি বাস্তব, নাকি যা কিছু অন্তরালে থাকে সেই আপাত অদেখা জীবনেই লুকিয়ে আছে বাস্তবের সারাৎসার। আমরা যদি কোন জাদুবলে সেই অদেখা জীবনকে জীবন্ত করে তুলতে পারি, গোটা সমাজজীবন আর তার চারপাশের চেনা জগৎটাই হয়ত একদিন পাল্টে যাবে, কিংবা অবাক হয়ে ভাবতে থাকবে, যাকে বাসভূমি বলে জেনে এসেছি এতকাল, আদপেই তা নয়, আসলে চোখে পট্টি পরানো সম্পূর্ণটাই এক ধাঁধার জগৎ। লেখক এই উপন্যাসে তার খোলস ছাড়িয়ে আসল জগৎ ও ঘুমন্ত মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন অন্য মোড়কে, যা আসলে স্বপ্নভঙ্গ নয়, কোন এক সুন্দর সকালে দেখে ফেলা আলো ঝলমলে জগতের বাহিরে ভিন্ন এক ভূমি, লড়াকু মানুষের জীবন, পশুদের চিৎকার, পাখিদের কলরব, পরম্পরায় মাখা  নোনা ঘামের কলেবর। উপন্যাসে বিচরণ করুন আর সেই কুশীলবদের নতুন করে আবিষ্কার করুন, চিনে নিন অচেনা, অপরাজিত, অপরিচিত নতুন এক বাস্তবতা, লেখকের সৃষ্ট জগতের  অপরনাম ‘অমরাবতী’ )

তৃতীয়  অধ্যায়

অনন্ত এখনও ভাঙা রেডিওটার নব ঘোরাতে ঘোরাতেই ভাবে কোথায় গেলে ওর মনের মতো কথাগুলো শুনতে পাবে, গানের কলিগুলো সুর হয়ে মনের কোণে এসে এমন জোরে ধাক্কা মারবে, সারাদিনের ক্লান্তিগুলো ঝরঝর করে ঝরে পড়বে। যেতে তো হবে অনেক দূর, কেউ যদি পৌঁছে যায় ওর আগে, সারাদিনটাই মাঠে মারা যাবে। কেউ যেন ভেতর থেকে বলে ওঠে ‘দৌড়ও, অনন্ত দৌড়ও, সময় যে ফুরিয়ে যাবে।’ অনন্ত জানে না এমন নয়, কী অনন্ত শক্তি সময়ের। কেমন করে থাবা বসায় প্রতি মুহূর্তে। কী জানি কখন হোঁচট খাবে। কত মানুষের ধাক্বাধাক্বি, জটলা। সকলে যেন হাত পা ছুঁড়ছে। মনে ওদের কত বাসনা। ‘ও দাদা, চোখে ন্যাবা হয়েছে!’ বলেই কোথাও যেন উবে যায়। কোথাও গেল যেন। সামনেই তো কোনো এক ধর্মীয় সংস্থার আর্চ টাইপের গেইট। মানুষটা ওখানেই হারিয়ে গেল। কী তার উদ্দেশ্য! কিছুই তো বোঝা গেল না। অনন্ত’র ইচ্ছে হলো উঁকি মেরে দেখে মানুষটা কোন জালে জড়িয়ে গেল কিনা। কোথায় সময়ের তালাচাবি? ও দরজাটা গিয়ে খুলবে। অনন্ত সময়ের আলোআঁধারিতে ও ডুব দেবে। চেঁচিয়ে বলবে, ‘ওগো তোমরা কে কোথায় আছ, মানুষটাকে খুঁজে এনে দাও। অচেনা শহরে ও পথ হারিয়েছে।’ পরক্ষণেই ভাবল, ও কি পাগল হয়েছে। মানুষের জন্য এত টান কেমন করে এসে এত দলা পাকাল। আবার কেউ বলল, অনন্ত তোমার তো কিছু হলো না, মাঝে মাঝে থেমে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এটা তো এক ধরণের মনোরোগ ! ‘কী আমি পাগল হয়েছি!’ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো একটার পর একটা রাস্তা ছেড়ে কিছু আলো যেখানে ডুবছে আর নিভছে, সারি সারি শাল পাতার থালা, কব্জি ডুবিয়ে গোগ্ৰাসে গিলছে, ওরা কারা! এর মধ্যে এই মানুষটা আছে! কেন ওকে চিনতে চাইছে ও! চিনতে তো হবেই। না চিনে যে উপায় নেই ওর। আম পাতা জাম পাতার মচর মচর শব্দ ওকে নাড়িয়ে দিল। কুকুরের বিষ্ঠার ঘ্রাণ ওই গরম ডালের ধোঁয়ায় মিশে যাচ্ছে। তবে কী ডালের ধোঁয়া, এত এত নিরন্ন মানুষের মাঝে ওই মানুষটি আর ও একই বৃত্তে আঁটকে গেল। এর থেকে ছিটকে যাবার কোন উপায় নেই! অনন্ত খুঁজতে চায়। 

মানুষটির অস্তিত্ব ওকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। মনে হয় কোথায় যেন ও নিজেই লুকিয়ে আছে ওই মানুষটির মধ্যে। এই দেখে এই নেই, ইহ জীবনে এ মুখ খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে কি মানুষটার অপমৃত্যু হলো ওর কাছে। হতে পারে এক পলক দেখা, অনাত্মীয় হল কেমন করে। ওই তো! সেই চোখ, সেই মুখ, গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে। ‘এই যে চললেন কোথায়?’ ‘আমি আপনাকে চিনি বুঝি। পাগল কোথাকারে!’ লোকটা বিচ্ছিরি হেসে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে চলে গেল। ‘কোথায় যেন দেখেছি? কবে যেন আমার হাতঘড়িটা সারিয়ে দিয়েছিল। ‘ লোকটা অনন্তকে অনেক শোকদুঃখের গল্প শুনিয়েছিল। মানুষের যে কেন এত দুঃখ হয়। মজিদ না কি একটা নাম যেন। আব্বার অকালেই ইন্তেকাল হয়েছিল। বড় আশা ছিল পুরনো বাড়িতে ফিরে যাবে। পূরণ আর হল কই। কি এক মারণ রোগ এসেছিল সারা দেশে, ঘরের বের হওয়া দূরে থাক, মানুষের মুখগুলোই তো দেখতে পায়নি সেই শোকে। ‘আচ্ছা, একটু শুনবেন। একটু কথা বলতে চাই, চলে যাচ্ছেন কেন? আমার না মানুষের কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়। কাকে আর সেসব কথা বুঝিয়ে বলব দিনরাত শুধু কাঁদি।’ ঔষধের দোকানের কর্মচারী। একটু দেরি হলে চাকরিটি নট। বউবাচ্চা নিয়ে মাথা গুঁজে থাকে ভাঙাচোরা টালির চালের ঘরে। মনের মধ্যে কতশত আকাঙ্খার ঝড় বয়ে যায়। দূরত্বটা কেবল কম নয়। পায়ে হেঁটে মেরে দেয়। রোজই তো আসে, রোজই তো যায়। আসা যাওয়ার এ কেমন খেলা। ভবসাগরের কথা মনে পড়লে ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠে। জোরে জোরে পা ফেলা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস। এই দাসত্বের জ্বালা বড় জ্বালা। মনের খেয়ালে পাল্টে যায় এমন করে বুঝতেই পারে না। মানুষের সঙ্গে কথা বলবে বলে একটা উপায় ও বের করেছে। আব্বুর দুঃখটা যে ও কিছুতেই ভুলতে পারে না। ওর মনটায় যেন জাঁকিয়ে বসেছে। নতুন এক হাঁটার কায়দা রপ্ত করেছে। ভাবনাগুলো এসে যাবে হাতের মুঠোয়। রাস্তা কেন যে সরকারি লোকজন এমন করে খুঁড়ে খুঁড়ে চলে যায়, এ-ও আর এক অভ্যাস, মানুষগুলো মরল কি বাঁচল, আর কে দেখে। কোমর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে হাঁটাতেই ধাক্কাটা লাগল। দাঁড়িয়ে রইল হাঁ করে কিছুক্ষণ। নেই কাজ নেই বেতন, এমনি তো কাজের ধরন। তবে আর কি। সব ভুলে মেরে দিল তো। সোজাসুজি দৃষ্টিটা গিয়ে পড়ল ওই খাদের গভীরে। এই গভীরেই তো যত নাড়িভুঁড়ি। শহরের মানুষের আলো আর তৃষ্ণা ভরাট করে চলে রাতদিন, নাড়ির টান যেমন করে হয়। ওখানেই তো এক কিশোরের মুখ। কত লোকই তো ঠিকানা বের করে দেয়, জানিয়ে দিয়েছে মনের মতো। 

কিশোরের অস্ফূট শব্দগুলো উঃ আঃ করে ধাক্কা খেতে খেতে অন্য এক উচ্চারণের জন্ম দেয়। মানুষের কন্ঠকেও ব্যাঙ্গ করে। অনন্ত উত্তর খুঁজে বেড়ায় কেন এরকমটা ঘটতে থাকে। কিশোর গভীরে গিয়ে মাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে, গন্ধ শোঁকে। অনন্ত লম্বা হয়ে শুয়ে আরো অনেক কিছুর সন্ধান করে। এমন যোগসূত্র খোঁজা দুরহ, কারা কখন এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছে। ওর কাজ বোধ হয় শেষ, এবার টেনে তোলার পালা। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে, গাময় ভোগের গন্ধে ভরপুর। ও কী বুঝে যেন অনন্ত’র কাঁধে চেপে বসে। কেউ নেই বুঝি গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে। চিকচিক রোদের কানাকানি ওর গায়ের কালচে রঙকে কচলাতে  শুরু করে। অনন্ত ওকে বুকে চেপে ধরে বলে ‘আয়, আয়, আয়, কাছে আয়।’ কিশোরের মনে হয় কেউ কোথাও নেই। বুকে এসে লাফিয়ে পড়ে, যেমন করে ক্ষত বিক্ষত পাখির ছানা ডানা ঝাপটে এসে পড়ে মা-পাখির কোলে। কিশোরটির নিঃশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করে। জলের লাইনের কলকল শব্দ কানে বাজে। অনন্ত’র মনঃশ্চক্ষুতে কত কী ভাসে। কি মনে হয়, কত কিছুর বিনিময়েই না আমাদের জীবনচক্র। আমরা কোনো কিছুকেই ছাড় দিতে শিখিনি। কিশোরের চোখের পাতায় বেদনার রেখাগুলো ওলট পালট খায়। কিশোরের চোখগুলো ওর নিজের মতো। কেউ তো দেখতে চাই নি, ও কেমন করে কাঁদছে, কোন মুহূর্তে ও হাসিতে ফেটে পড়েছে, উচ্চঃস্বরে চিৎকার করে বলেছে, ‘ ঐ ঐ, যা, আমার কথা অনেক দূর উড়ে যা।’ বন নেই, বাদাড় নেই, বকাবকি নেই, ধাক্কাধাক্কি নেই। আরও কত কি চাই, বুঝেও বুঝে উঠতে পারে না। অনন্ত কিশোরটিকে লুকিয়ে ফেলতে চায়। ওকে যে এখনও অনেককিছু দেওয়ার বাকি থেকে গেল। কারা যেন আবারো বলছে, ‘ অনন্ত দৌড়ও, আরও দৌড়ও, যত জোরে পার দৌড়ও, আর যে সময় হাতে নেই।’ এক অতি সংকোচের ভাব এসে ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ বাপু, একটু থামলে হয় না।’ কিশোরটি ওর হাত দুটো ছেড়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেদিকেই তো তাকিয়ে একদল ছেলেমেয়ে আপনমনে এগিয়ে চলেছে, দেখেশুনে মনে হচ্ছে ওদের গন্তব্য ওরা জানে। উচ্ছলতা মন খুঁড়ে বাহিরে ছাপাবে বলে কত আকুতি। কিশোরটি কী হাত মুঠো করে ধরে ফেলবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে। কী নিদারুণ এক প্রতিচ্ছবি পলে পলে বেড়ে চলেছে। হ্যাঁ, গাছই তো, কত লম্বা গাছ, পাতায় পাতায় কত রকমের ধ্বনি। পাতাগুলো উড়ে উড়ে এসে কিশোরটির হাতের মুঠোয় আসবে বলে নেচে বেড়াচ্ছে। কোন এক জাদুবলে মাঝপথেই আটকা পড়ে যায়। কিশোরটি হাঁ করে চেয়ে থাকে। ভয়ে বুক দুরু দুরু করে অনন্তর। অনন্ত ডেকে ওঠে, ‘ও মানিক, ও মানিক’। ওর কোনও নাম থাকতে পারে ও বিশ্বাসই করতে পারে না। কে ডাকে অসময়ে! সময়ের অসময়ের বালাই তো নেই তবে সময় নিয়ে আজ চিন্তা কেন! মাটির গভীরে ছিল বলেই কি। গভীরতার গল্পগুলো কি একটু অন্যরকম হয়ে যায় থেকে থেকে। কিশোরটির মন কিন্তু খুশিতে নেচে ওঠে। অনন্ত’র কন্ঠেই কি কোনো জাদু আছে। এই বিদ্যা রপ্ত করতেও হয়ত এমন যাপনের প্রয়োজন হয়, জীবনের অন্য চাওয়া পাওয়াগুলো দিনে দিনে গৌণ হয়ে যায়, অনেক কিছু না-পাওয়াই শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়। অনন্ত নিজেও তো জানে না কেমন করে এরকমটা হল! কে শেখাল, কেইবা বলে দিল মানিক বলে ডাকতে। ও কিশোরটিকে কিছুতেই এই অন্ধকার গহ্বরে যেতে দিতে পারে না। মানুষগুলো তো এইদিকেই দৌড়ে দৌড়ে আসছে, কাঁধে হাতে খন্তা, কোদাল, কাটারি, লম্বা লোহার শিক। ওরা কি ওঐ কিশোরকে তুলে নিয়ে যাবে বলেই তেড়ে আসছে। একী এত টানাটানি আর মুখে কত কথা – ‘ নামবি না মানে, আলবাত নামবি, না হলে পেটের ভাত জুটবে কেমন করে! ঢোক বেটা ঢোক।’

ছাগলের দলবেঁধে আসা অনেকেরই কাছে দৃশ্যদূষণ তো বটেই, নাসারন্ধ্র বন্ধ করে বলেই ফেলে, ‘ওয়াক থু’। মনুষ্যেতর না নীচ মনুষ্য দুই ক্ষেত্রেই বাবুলোকদের  একই শব্দমালা প্রয়োগ করতে দ্বিধা থাকার তো কথা নয়। ওদের কল্পনার অবয়বে দুটোই সমান গোত্রের, কেউ দু’পেয়ে আর কেউ চারপেয়ে এইটুকুই কেবল তফাৎ করে। দূর দূর করে তাড়িয়ে মারতে অনর্থ কোন ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়া কাজের কথা নয়। কলুর বলদ কিনা, এই কথাটা ভাবতে কি বাড়তি মাথা মারতে হয়, যা তৈরি হয়ে রয়েছে তাই কাফি। না হয় কি বলে, ‘দেখ দেখ ওই উটকো বেহায়ারা আবার আমাদের এলাকা দাপাতে চলে এসেছে। শীগগিরিই ওঐ বেটার ছেলেকে চালান করে গুঁতিয়ে। ওগুলোকে কেমন গুঁতোচ্ছে, ছড়ির বাড়িতে এখন পিঠ ফাটাচ্ছে, দৌড়ও, পরে এক এক করে কোতল করবে, ধারালো লম্বা ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে তেল মশলা পেঁয়াজ রসুনে আমরা সাটাব।’ ‘ তাহলে আর এত ঘেন্না করে চোখ কপালে তুলে লাভ লোকসান খু্ঁজে কী লাভ।’ এসব কথা শুনে অনন্তর চক্ষু তো চড়কগাছ।ওদের বলাকওয়া তো থামে না, বলেই চলে।  ‘ওই হারামজাদার একার কম্ম নয়। আরো দু’চারটাকে টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে তো আয়। কতগুলো তো আধা উলঙ্গ হয়ে এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা-ও যদি বেঁকে বসে দু’ঘা লাগিয়ে নিয়ে আসবি।’ অনন্তের চোখে অন্ধকার নামে। ছাগলের দলের অন্ত নেই। ওরা ওদের প্রভুদের সমীহ করে। মারের চোটে বেন্দাবন দেখছে, তবুও এক ফোঁটা চোখের জলও যদি গড়াত। কোনটা ভেজে ওঠে না এমন তো নয়, রসনায় এত লালা ঝরে দেখতে তো পায় না কোনটা হাসি, কোনটা কান্না। কোন কালেই তো দেখতে পায়নি। কানেও কম শুনতে পাচ্ছে! ওদের যে চ্যাং দোলা করে নিয়ে আসছে, হাউমাউ করে কান্না তো জুড়েছে। নাকি কখন যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে উঠতে হয় সেই বোধটাই হারিয়ে ফেলেছে। কে ওদের বাপ, কে ওদের মা, কে আর কবে শুনিয়েছে। রাস্তার কুকুরগুলোই তো গা চেটে চেটে, পোঁদ ঘষটিয়ে শিখেয়েছে ভালোবাসার রকম সকম। রাত হলে পায়ে পায়ে জড়িয়ে ঘূমিয়ে পড়ে  আর আলোর মুখ দেখলেই  চেয়েচিন্তে খাবে বলে দোকানে দোকানে হাত পাতে। কারও কারও দু’একটা লাথি খেলে কুঁইকুঁই করে। ভাবে এটাই বুঝি করতে হয়। মারামারি করে মাথাও ফাটায়। ‘বেজম্মার দল, খাই খাই, কেবলই খাই খাই।’ অনন্ত আবারও কেন যেন ডাক দেয় নিজের মনেই যে নাম মনে আসে, সেই নামে। ওরা সাড়া দিল কি দিল না কি এল গেল, মনের আশ তো মিটল। ছাগলের দল আর মা-বাপের ঠিকানাহীন মানিক, ঝন্টু মন্টুকে একই দাড়িপাল্লায় দাঁড় করিয়ে কোমর বেঁকিয়ে ডানে বাঁয়ে পা ফেলে পথ কাটে। হাঁটার ছন্দের তালে তালে অনন্ত পেছন ফিরে তাকায়। একী! কী আশ্চর্য! ছাগলের দল ধীরে ধীরে কেন উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, শত চেষ্টাতেও ওদের মালিকেরা ওদের বশে রাখতে পারছে না। তবে কি ওরা এতক্ষণে বুঝে ফেলেছে কী হতে চলেছে, হয়তো মরিয়া হয়ে ওদের শেষ চেষ্টা। জীবনকে বাজি রেখেই ওদের এই শক্তি সঞ্চয়। ওরা একটু একটু করে উপরে উঠছে। তবে কী ওদের কোন  অদৃশ্য ডানা গজিয়েছে। কতশত শব্দই তো ভেসে আসছে, কিছু কিছু চেনা শব্দ – ভ্যাঁ ভ্যাঁ। ধরতে পারলে না। কাঁচকলা খাও। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ছাগলের দল উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। পথচারীদের শত শত চোখ যেন ছানাবড়া। কী হচ্ছে, কিছুই যেন বোধগম্য হচ্ছে না। ‘ জাদু নাকি!’ ওরা ক্ষণেক হতভম্ব হয়ে ‘কাজকর্ম চুলোয় যাক’ এমন রহস্য উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনন্তের এমন অবস্থা হল ‘নট নড়ন চড়ন’। কারও কাছে কোন জবাব নেই। ওরা এক স্বপ্নের পৃথিবীতে হাঁটা শুরু করে। আরও আশ্চর্য হল ওই ঠিকাদারদের পোষা কিশোরদের একই অবস্থা দেখে। ওরাও ওই দৃশ্য দেখে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল, কোনোভাবে ডানা গজাতে পারে কিনা। কতক্ষণ ধরে হাত দুটো ধরে টানাটানি করল। একসময় টের পেল একটু হলেও ডানা গজিয়েছে। ওদের ওড়ার চেষ্টা দেখে রোজ দেখা লোকগুলো ভাবল, ‘ওরা এমনিতেও মরবে, অমনিতেও মরবে, মরতে চাইছে মরুক’। 

অনন্ত আর নিজেকেই যেন চিনতে পারছে না। ভাবনাগুলো মরে যেতে লাগল ‘,কী হচ্ছে এসব!’ এই জীবন নিয়ে ওদের একটুও ভয় হল না। কী অকল্পনীয় সুখ এই ডানা ঝাপটানোয়, কিশোররা কি জানত! ছাগলদেরও ইচ্ছাপূরণ হয়, মানুষগুলো আর কবে বুঝবে! অবাক চোখে ওরা জীবনের ছান্দিক উপলব্ধির জের টেনে চলবে। চিন্তাশূন্য মন নিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে ভিন্ন ছবি আঁকবে। মানুষরা উড়ছে, পাগলেরা উড়ছে, একই আকাশে। যাদের ডানা গজায়নি, এমন অত্যাশ্চর্য পরিক্রমায় হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল দুপাশের পথচারীরা, সমান পাল্লায় মাপজোক করতে মন চাইল না। ঠিকাদারদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল।  স্থান পরিবর্তন যে এভাবেও সম্ভাবনার সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ওরা একটুও অনুমান করতে পারেনি। পতপত শব্দে উড়ে বেড়াচ্ছে, শোনা যাচ্ছে মেঘের চলাফেরার উচ্চকিত ধ্বনিতে আরও কত যে মিশ্রিত আলাপন, এমন শোনায় ওরা আলোড়িত হল। ভেসে যাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা হলো, ওদের চলনেও হচ্ছে নানা অঘটন। ফলওয়ালা, ভুজিওয়ালা, আনাজ, তেলেভাজা, ফুচকা বিক্রেতারা অনেকক্ষন ওদের কাজকর্ম থামিয়ে দিয়ে ভাবল যদি ওদের জায়গাটা এমন হতো, ‘ দেখিয়ে তো দিল মুরোদখানা।’ ছাগলের আর ঠিকাদারদের ছটফটানি আর হায় হুতাশে চমকে গেল, শিরশির করতে লাগল গোটা শরীর, দু’হাতের আঙুলগুলো মুঠো করে প্যান্টের দু’পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোয়াল শক্ত করে ভাবতে লাগল, কেমন করে ওদের নামিয়ে নিয়ে আসবে, ছাগল মালিকদের চিৎকার চেঁচামেচিই সম্বল হল, মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল বেশ করে আর হাতের লাঠি গুলো ঘোরাতে ঘোরাতেই পরখ করতে লাগল, কোথাও তো কোন চমৎকার আছে। ওরা লাঠি দিয়ে বেশ করে  নিজেদের পাছায় মারতে লাগল যদি এমনটা হয়। না না কিছুতেই উড়তে দেওয়া যাবে না। ‘ বেটার ছেলেদের নিচে নামিয়ে না আনতে পারি তো…’। 

অনন্ত এবার কি আরো দৌড়বে, নাকি কাণ্ডকারখানা দেখার মজা লুটবে! একটা কাঁকড়াবিছে সুড়সুড় করে এদিকেই এগিয়ে আসছে, নজর গেল সেইদিকে। অনন্তকে দেখে কিঞ্চিৎ দাঁড়িয়ে গেল। মানুষের মুখ দেখে ওর আপাদমস্তক দেখে নেওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হল। কি জানি ওর কোন প্রবৃত্তিটা ওকে প্রবলভাবে ধাক্কা মারল, কামড়ানোর ইচ্ছেটা একটুও চাগাড় দিল না, ইতস্তত চলাফেরার পরে নিজেকে খানিকটা সংযত করে পথ ছেড়ে গাছের গুঁড়ির পাশে গিয়ে পকপকিয়ে অনন্তকে দেখতে লাগল। দু’পায়ের উপর ভর করে ভাঁজ করা হাঁটু নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে যে মানুষটি দুটি পয়সার জন্যে হাত বাড়িয়েছিল, সে-ও ওঐ‌ অমূল্য দৃশ্যটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল। সেই মুহূর্তে কোন ভাবনায় ও আক্রান্ত হয়েছিল সেটা বোঝার সাধ্য অনন্তের ছিল না। সে শুধু অকস্মাৎ ওদের সখ্যতা একটু একটু টের পেয়েছিল, হয়ত পথচলার ইশারায় নিত্য নতুন ঘটনায় ও রোজই কমবেশি এমন আস্বাদ টেনে নেয়, ভাগাভাগি করবে এমন পালা বলাকওয়ার ওর ক্ষমতা কোথায়। কোনটা যে বিষ, আর কোনটা যে বিষাক্ত, নিজে বুঝলেও কাউকে বোঝাবার দায় যে থাকে না, পরগাছার জীবনের মায়া যে অন্যখাতে বয়। অনন্ত ওঐ পূর্ণ-অপূর্ণ মানুষ আর কাঁকড়াবিছের মধ্যে যোগসূত্র খোঁজে। অপাংক্তেয় আর দুচ্ছার শব্দদুটি ঘোরাফেরা করে, ধাক্কা যে মারে না জোরে কে আর বলবে। এর আগেও ও দৌড়তে গিয়ে জোরে ধাক্কা খেয়েছে, দেখেও কি এড়িয়ে গেছে। ঠিক এমনি সময় ঝাড়ুদার সাফাই করতে করতে ধুলোবালি ওড়াতে ওড়াতে চলে যেতে চায়। ওকেও ওর একটু অন্যরকম লাগে, ধরা অধরার মাঝখানে ও দাঁড়িয়ে থাকে। দু’এক কলি গানের গুনগুনানি যে নেই, সুরে সুরে যে আক্ষেপ নেই, এমন কথা বললে, পাগলের দীর্ঘশ্বাসই তো বলবে, শোনার তাগিদটা মাঠে মারা যায়। ওই বোধহয় কোন ফাঁকে সুড় পাকানো বিছেটাকে দেখে ফেলেছিল, লেজে লেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর ছানারা। একটুও এদিক নয়, একটুও ওদিক নয়, এমন নিশ্চিন্তে, মনের আনন্দে এত যে মানুষের ফাঁকফোকর দিয়ে সুড়ুৎ করে অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরছে ওরা কেমন করে জানবে। মানুষের শরীর ছুঁয়ে গেলে অল্পস্বল্প টের পায়, একেবারে অন্যরকম, চেখে দেখলে মনে হয় মিষ্টি স্বাদ, ক্রমে ক্রমে বুঝে নেয়, এদের কব্জা করতে পারলে মন্দ হতো না। কৌশল কিনা, পিছিয়ে গিয়ে বুঝতে চায় কতটা দূরত্বে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়তে সুবিধা হবে। ‘বাদাম চাই, বাদাম চাই’ হেঁকেডেকে যে মানুষটি কৌটো নাড়ায় তাকেই লক্ষ্য করে, যদি ঝোপ বুঝে কোপ মারতে পারে। বাদামওয়ালা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গল্পগাছা করে শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে, কে হুল ফোটাল, কে আবার রঙ্গরসিকতা করল, কে আবার থু থু করে পচা বাদাম গায়ে ছিটাল, সে তো অনেক দূরের কথা। অনন্ত উদাসীন হলেও, বেমানান নয়, কারা ছক কষছে, কারা ছক ভাঙছে ও একটু আধটু জানে। তাই তো বাদামওয়ালার বুঁদ হয়ে থাকাকে অনন্ত প্রশ্রয় দেয়। ওর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে নোনা ঘামের গন্ধ, ওর উচ্চারণে আত্মীয়তার জ্যান্ত আস্বাদ। রোজকার অস্ফুট শব্দগুলোকে ও চিনে নেয়। বিছেগুলোর তিক্ত, বিষ ছড়ানোর উগ্ৰ বাসনায় ও ভয় পায় না। ও জানে ওরা দিনরাত শুধু ছোবলের আকাঙ্খায় সময় গোনে। অনন্ত এই মানুষগুলোর ইশারা বোঝে।  ঝাঁকে ঝাঁকে গদিওয়ালা চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে আসে। ওদের দাঁড়াগুলো পাকানো, কোনটা লম্বা, কোনটা গোটানো। যারা এতক্ষণ উবুড় হয়ে কাজ করছিল, ওরা মাথা নিচু করে সব কথার তীরে ঘায়েল হয়ে ছটফট শুরু করে। এদের না আছে উঠোন, না আছে ঘর, কোন এক প্রান্তে মাথা গুঁজে কোনরকমে সময়টা পার করে চলে। 

কে খুঁজে দেবে জীবন, কোথায় গেলে পাবে আর কেই বা দেবে সম্মানের ছিটেফোঁটা। লোকগুলো বেঁকে গেছে, ওদের পিঠের উপর ঘুরঘুর করছে সেই বিছেগুলো, জানাবোঝা গেলেও নড়চড় হবে, কার এমন বুকের পাটা আছে। এই বুঝি প্রাণবায়ু নিঃশেষিত হয়। ওরা দাঁড়া দিয়ে শিড়দাঁড়া বেয়ে গলার কাছে চলে আসে। ওরা ভারী বোঝায় নূব্জ হয়ে যেইমাত্র পথ পরিবর্তনের চেষ্টা করে, গদিটা শূন্য হয়ে যায়, বিছে কিংবা বিচ্ছুরা কথার পরে কথা জুড়ে মুখের চোয়াল বাঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে এমন বাক্যরচনার মহড়া দেয় মনে হতে থাকে এই বুঝি সব শেষ। অনন্ত ভিরমি খায় – এ কী হল! সব রসাতলে যায়। জ্যান্ত সমাধি থেকে উঠে আসে মরাকান্নার শব্দ। গুমরায়। সকলে যখন ঘরে ফেরার তোড়জোড় করে, বিচ্ছুরা সক্রিয় হয়ে বলে, ‘এই সাম্রাজ্য তোর বাপ সামলাবে, বোকাচোদার দল।’ ওরা একবার হাঁ, একবার না বলে নিজেদের চলন্ত রোবট বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। ‘তুই যাবি না, তোর বাপ যাবে।’ কান্নার শব্দগুলো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বলতে চায়, ‘তোমাদের আর কত চাই। আরো চাই, আরো চাই।’ ওমা একি ওদের জিভগুলো কেমন করে উল্টো দিকে ঘুরে গেল। বিচ্ছুরা ওদের দাঁড়াগুলোকে শক্ত করে বিশেষ পরিকল্পনার দিকে ছুটে যায়। তখনো বজ্রাঘাত হয়নি, বিদ্যুৎও চমকায়নি, কালো কালো মেঘগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কাকে ডাকছে কেউ জানে না। আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে। বিচ্ছুরা সব কিলবিল করে ওঠে। অনন্ত বুঝতে পারে না ওর কী করা উচিত। বিচ্ছুরা আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করবে না,এমনি এক স্থির প্রতিজ্ঞা নিয়েছে। এবার ওরা ধীরে ধীরে লেজ থেকে বের করতে শুরু করে সেই ধারাল কাঁটা। ওরা ওদের গলার কাছাকাছি চলে আসে। কি অসম্ভব সেই বিষের জ্বালা। অনন্তের শরীরে দু’একবার প্রবেশ করেছে বটে, কাবু করতে পারেনি। অনন্ত চিৎকার করতে শুরু করে – দৌড়ও দৌড়ও। তোমরা কি বুঝেও বুঝতে পারছ না। ওরা এসে গেছে। তোমরা কি দেখেও দেখতে পাচ্ছ না, ওরা তোমাদের গোটা শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে, এবার বিষ ঢালবে। তোমাদের মনের উপর দখল নিতে পারে নি, এখনও সময় আছে, মনটাকে কাজে লাগাও। অচিরেই না হয় মনের উপর অধিকার কায়েম করতে চাইবে। ওরা এতকাল ওই চেষ্টাও চালিয়েছে। তোমাদের বাপ-ঠাকুরদারা জবাব দিয়েছে, এবার তোমাদের পালা। মনটাকে শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেল, দ্বিতীয় আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। অনন্ত আবার ছোটার আগেই ওই বার্তাটাই পৌঁছে দিল। ও নিজেও তো ভুক্তভোগী। ওঐ অস্ত্রের আবির্ভাবের দিনগুলো ওর বড়ই চেনা। 

বিলুর অচেনা জগতের হদিস অনন্ত কখনও জানবে না। সেই সীমা অতিক্রমনের বিদ্যেটা জানা নেই ওর। ক্রমাগত অনুশীলনই ওকে সেই দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। অনন্ত আরো খুঁজতে চায়। ঠিকানাবিহীন এই পথ বড় দুর্গম, কাঁকর বালি সরিয়ে গেলেও কেউ না কেউ প্রস্তুত হয়ে থাকবে ওকে দমিয়ে দেবে বলে। ওই লোকগুলো সে পথেই তো আস্তানা গেড়েছে। ওরা এইভাবেই তো হেঁকে হেঁকে বাঁচে। কোন রাস্তা যে আর খোলা নেই। ওরা এইভাবেই নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করে। ইটপাটকেল ছোড়ে। একটা ঘরেই জরাজরি করে নিজেদের ভালোমন্দ ভাগ করে নেয়। জন্ম মৃত্যুর হিসেব কষে। কখন যে কোথা থেকে কান্নার রোল এসে অস্থির করে দেয়, মরা মানুষটার শরীর ঘিরে হায় হুতাশে জীবনের মানে খোঁজে। অনন্ত হাঁটাহাঁটি করে এক বিন্দুতে এসে স্থির হয়ে যায়। ওঐ তো দূরে এক প্লাস্টিক ঘেরা পায়খানা ঘরে লোকজন যায় আর আসে। লম্বা লাইন। কুকুরগুলো পেটটা পরিষ্কার করে বার কয়েক ঘেউঘেউ করে নিল, বাচ্চা কোলে নিয়ে মা-টা কি যেন ভেবে নিল, ওকেও যে অনন্তের মতো দৌড়তে হবে। কোলেরটা ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলে সাবিত্রী অস্থির হয়ে পায়চারি করে। সময়ের যে ওর গোনাগুনতি হিসেব, ছয় ছয়টা বাড়ির কখন কোথায় যাবে। বেচারা স্বামী হুজ্জতি করে গলায় ঢক ঢক করে গিলে আধা-মাতাল হয়ে রিকশার ঘন্টি বাজিয়ে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতেই চলে গেল। কি জানি আবার কোন যাত্রীকে না ছিটকে ফেলে দিয়ে পাবলিকের মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে দরমার বেড়ার ঘরে ফিরে চিৎপটাং হয়, কাজের বাড়িতে বসেও ভয়ে বুক কাঁপে সাবিত্রীর ভেবে ভেবে। ‘দোষ বলে দোষ, মেয়েছেলের দোষ যে, দিনরাত কালি মাগীর পেছনে ঘুর ঘুর করে, ওঐ মাগীর স্বামী যে পালিয়ে গিয়ে আর একটা মেয়েছেলের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, তাই তো আমারটার দিকে নজর। বাগে পাই একবার, মুখে চুনকালি না মাখিয়েছি তো বাপের বেটি নই, কচি ছেলের দিব্যি খেয়ে পেতিজ্ঞা করলাম।’ ওরা দিনেরাতে এমন কত প্রতিজ্ঞাই যে করে। শুধুই কি পেটে খিদে, মনেরও তো খিদে। পচা জমা জলের গন্ধে ভূত পালায়, মশারা বন বন করে, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু গোটা বস্তিতে। অনন্ত নজর ঘুরিয়ে এইভাবেই  থেমে যায়। 

কত জীবনের গল্প ওর ঝোলায় পুরে আরও অনেক গল্পের রস চেটেপুটে নেয়। সাবিত্রীরা ছোটে পূব দিকে তো ও পশ্চিমে। হোঁচট খেয়েও উঠে দাঁড়ায়। ডালে বসে কাকটা কা কা করে ডেকেই চলে। বিলু ওর দিকে চেয়ে চেয়ে কখনও আকাশে ওড়ে আবার ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে নিতে নামে। অনন্তের সঙ্গে ওর মুখোমুখি হয়ে যাওয়া নেহাতই কাকতালীয় । না হয় লোকটার কাকচক্ষু হতে যাবে কোন দুঃখে। গরগর করে ঠিকুজি কুষ্টি সব তো বলে দেয়। বলে, ‘দেখ, ভালো করে দেখ, গোটা শহরটাকে দেখতে পাস কিনা।’ অনন্ত মোটা কাঁচের ফাঁক দিয়ে চোখ পাকিয়ে দেখে। কী দেখতে পেল ও। লক্ষ লক্ষ লোক গিজগিজ করছে। উঁচু প্রাচীরটায় একটুও ফাটল না ধরিয়ে কাণ্ডটা মানুষের কোমরের মতো পেঁচিয়ে জাপটে ধরে আছে এমন করে যেন আর কারোই নিস্তার নেই, একটু এদিক ওদিক হলেই বংশ শুদ্ধ বিনষ্ট হবে, ষোল কলা পূর্ণ হবে। এমন দুনিয়ার চেহারা সুরত ওতো কোনকালে দেখে নি, তাহলে কি সবটাই বিলুর কারসাজি, নাকি ওঐ লোকটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভেলকি দেখাচ্ছে – ছু মন্ত্রর ছু, কালি কুত্তার গু। কাকটার গলা এত বিচ্ছিরি শোনাচ্ছে কেন! কোন অশুভ সময়ের ইঙ্গিত! বেড়ালটাও চোঁ করে পালিয়ে যাবার আগে বাচ্চাদের গলা করে ম্যাও ম্যাও করে বারকয়েক কান্নার ঝড় বইয়ে দিয়ে গেল। কী সুখ পেল বেড়ালটা, এনে তো দিল মনে একরাশ ভয়। লোকটা তখনও কি একটা দেখাবে বলে মনপ্রাণ ঢেলে ষোলো আনা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। ওর দেখা ওই জাদুর শহরটাকে দর্শন না করাতে পারলে ওর নিস্তার নেই। ‘ দেখলি কেমন গোটা শহরটার কেমন ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে।’ ‘ কই কিছু নেই তো!’      ‘সে কীরে! এই তো আমি দেখলাম, তুই কিছুই দেখতে পেলি না! সময়টা কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে চক্রাকারে। তুই একটা গবেট। চোখে ন্যাবা হয়নি তো!’ অনন্ত ধীরে ধীরে নিজের উপর বিশ্বাস হারাতে শুরু করে। কোন পথে যাবে? আবার কি ফিরে ফিরে দেখবে। কিছুতেই যে এই অত্যাশ্চার্য শহরটাকে দেখার লোভ সামলাতে পারছে না। কি যেন ওর উপর এসে ভর করেছে। ওরা সব মাথা নিচু করে বাকরুদ্ধ হয়ে মায়ার বাঁধন ছিঁড়তে চাইছে। ওরা হাহাকার করে উঠছে থেকে থেকে। মুখে উচ্চারণ করছে, ‘এ বড় দুঃসময়! জন্মের সুসময়ে মা কেন আমাদের গলাটিপে মেরে ফেলল না, তাহলে তো এমন দিন এসে ধাক্কা মেরে ফেলে দিত না। কে যেন বলল, ফিরে যা, নিজেদের ঘরে ফিরে যা।’ অনন্ত এখনও জানে না কোনটাকে বলে নিজেদের ঘরে। লোকটা আবারো বলল, ‘ দেখরে বাপ দেখ, এই সুযোগ হেলায় হারাস না, কালেভদ্রে একবার আসে।’ অনন্ত লোকটার দেওয়া অদ্ভুত চশমাটা পরে নেয়। আশায় বুক বাঁধে। এইবার ও এমন কিছু দেখে ফেলবে নিশ্চয়ই আগে কখনো দেখেনি। ‘ শত শত আগুনের গোলা ধেয়ে আসছে, আর বুঝি নিস্তার নেই। লোকগুলো নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ওদের পোড়ানো হচ্ছে। ওরা কীসের আকষর্ণে আবার গর্ভে ফিরে যেতে চাইছে! এটাও কি জীবনকে না চেনার আর এক ঘোষণা, না হলে এত শূ্ন্যতা কেন? অনন্ত একা দাঁড়িয়ে আছে এত লম্বা চওড়া রাস্তায়। কেউ কোথাও নেই। লোকটার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। এ কী স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন! কিছু লোক বলে গেল অনন্ত পাগল হয়েছে, না হলে এমন করে ছাপোষা লোকগুলোর রুটি রোজগারে ভাগ বসিয়ে বলে, ‘আয় তোরাও দেখবি আয়। সাহেবসুবোরা দু হাত তুলে করতালি দেয় আর বলে, কেমন দিলুম, ও তো আমাদেরই লোক, যা এবার রসাতলে যা। অনন্ত বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে, বিলুকেই খুঁজে বেড়ায় আর বিলু খোঁজে কাকেদের ঘরবাড়ি। ওঐ লোকটা কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে এসে বলে, ‘নির্বোধ, কেমন বোকা বানিয়ে দিলাম তো!

এমন উলঙ্গ হয়ে যায়! কারা ওরা, কে না জানে। কোন এক পৃথিবীর বাতায়নে বসে নিজেদের ঘরে ডুব দিতে চাইছে। শরীরে  অমৃত সুখের ধ্বজা উড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরছে, তবু তাকে কি আনন্দে লালন করে চলেছে, মনে তাদের যন্ত্রণা সুখ। বিলু ইশারায় জানাচ্ছে অনন্তকে, কেমন তারা নিজেদের মুড়িয়ে রেখেছে একবার জানবি না। অনন্ত বলে বেড়াচ্ছে সেও কী সম্ভব! পলক না ফেলা দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে মরে।  আবীর রঙের আলতো ছোঁয়ায় এপাশ ওপাশ করে। অনন্ত যেতে তো চায় কিন্তু কেন যাবে!  কত তো রঙ রঙিন হয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে রূপের আগুনে, নিজেরা পুড়ছে, অন্যদেরও পোড়াচ্ছে। আসছে এক এক করে কারা যেন ওদের শরীর কিছুক্ষণ অন্তত ছিঁড়ে খাবে বলে। লালসার রস দিনমান বয়ে বেড়িয়েছে এক শরীর থেকে অন্য শরীরে। ‘নে, নিবি তো নে, আর কত নিবি। শরীর যত চাইছে তত খা। খাবি না আবার না হলে পেট পুরবে কী করে, চ্যাটের সুখ শরীরে ঢালবি না, তা আবার হয় নাকি!’ অনন্ত মাথা ঝুঁকিয়ে দেখে কত বিষ ঘন কালো হয়ে রয়েছে জমাট বাঁধা অন্ধকারে। অল্পস্বল্প আলো এসে মেখে দিচ্ছে ক্লান্ত শ্রান্ত খাঁচা। কার বাসা কে রয়, শুধুই লাশ হয়ে আছে। ধুলোমাখা বাতাসের প্যানপ্যানাতিতে কত না আত্মীয়তা। কারা কাঁদে আনন্দের ডামাডোলে। দুমুঠো খাবারের আশায় পাত পেতে বসে থাকে। ছেঁড়া ছেঁড়া শালপাতার ফাঁকে কত না রসের আয়োজন, কত কিইনা মিশে আছে, ধুলো আর বালি জুতোর গায়ে সেঁটে থাকা কফ, থুথু, সব যে মিশে যাচ্ছে একটু একটু করে ভাতের থালায়।  যুবতী মেয়েগুলোর ছলাকলা, কথার জাদুতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলা, মাঝবয়সীদের শরীরে পড়ন্ত রূপের ছেনালি, ধরবে না ফেলবে কে জানে।  ল্যাংটা শিশুগুলো, ঘুরছে তো ঘুরছেই, কোন হেলদোল নেই। একটা কেরা পোকা কিলবিল করে ওদের মুখের কাছে ঘুরে বেড়ায়, এই শহরের মুখ কিনা, কত তো ছিরি! শহরের নামি দোকানের খাবার – চিকেন, মাটন রোল,চিকেন কাটলেট, বিরিয়ানি, কাবাব টেবিলে থরে থরে সাজানো। ক্যামেরাম্যান তাক করে আছে, সাংবাদিক কথার জারিজুরিতে বিজ্ঞাপনি রঙ ছড়াচ্ছে চ্যানেলের সৌজন্যে। ওদের তোবড়ানো মুখগুলো কোন ফাঁকে রসনা তৃপ্ত মুখগুলোর সঙ্গে মিশে যায়, ওরাও হয়ে যায় বিনোদনের খোরাক। পাশে দাঁড়ানো লোকটা বলল, ‘ আসুন, আমরা অভ্যর্থনা জানাই।’  শরীরের মজা লুটতে আসা ড্রাইভারের সঙ্গে দর কষাকষি করে,  চুলে সুগন্ধি তেল মাখা, শরীরে ঘেউ খেলানো, পাউডার ছড়ানো মুখগুলো। সদ্য প্রসবিনী মায়ের ভরন্ত মাইগুলো থেকে ওরা টেনে নিচ্ছে যত রস, টপ টপ করে ঝরে পড়ছে রসের হাঁড়িতে। অনন্তের শরীরেও কি জ্বালা ধরাচ্ছে? টের পাচ্ছে না এমন তো নয়, কেমন করে মেলাবে ও মুখগুলোর সঙ্গে। বাচ্চাটা দৌড়ে এসে বলল, ‘মা খাব।’ ‘ কে মা, কার মা, সন্তানের মুখটা মুহূর্তে অচেনা হয়ে যায়।’ খরিদ্দারটা জ্বালিয়ে মারে, ‘আর কতক্ষণ?’ অনন্ত কি এখনও দাঁড়িয়ে থাকবে, ওদের দলে জায়গা করে নেবে কিনা। ও জানে না, জানতে চায়ও না। আঁধারটা কখন যে জমাট বেঁধেছিল, হুই আকাশে। কই কোন রামধনু অনন্তের চোখে ধরা তো পড়ছে না ! কাকটা মন্দিরের চুড়োয় বসে মন দিয়ে তো দেখছিল কত কাণ্ডকারখানা। কার কাছে ও জবাব চাইবে? অনন্তের কাছে! ও নিজেই এখন নিজেকে সামলাতে গিয়ে হচ্ছে বেসামাল। বিলুর হাতে কাঁসরঘন্টা ছিল, বাজিয়েই তো চলে – ঢঙ ঢঙ। ওরা যারা মজা লুটবে বলে পিছু নিয়েছে, নেচে নেচে গেয়ে চলে, হরি হে মাধব! হরিবোল, বলো সবে ‘হরিবোল’, জোরসে বলো ‘হরিবোল’।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *